গুপ্তা স্যার খুব খুশি হয়েছিলেন। টাকা দিতে চেয়েছিলেন। নিইনি। জানতে চেয়েছিলেন, কী করি, কোথায় থাকি। বলেছিলাম, তেমন কিছু করি না বলার মতো, বেকারই ধরতে পারেন। উনি ভিজিটিং কার্ড বার করে আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘একদিন অফিসে এসো, কী করা যায় দেখি।’’ সেই ওঁর সঙ্গে প্রথম আলাপ।’
—তা গেলি ওঁর অফিসে?
—দিন পনেরো পরে গেলাম। বড় চাকুরে, একটা কিছু ব্যবসাপাতিতে যদি হেল্প করেন, একটু ভালভাবে থাকতে পারব। বেকার ছেলে স্যার। পড়াশুনো ওই বারো ক্লাস অবধি। গ্যারেজে সারাইয়ের টুকটাক শিখেছিলাম। বাকি এদিক-সেদিক সাপ্লাইয়ের কাজ করতাম। খুব কম ইনকাম। তার মধ্যে বিয়ে করে ফেলেছিলাম বছর দুই আগে। টাকার খুব দরকার ছিল।
—সাপ্লাইয়ের কাজ ছাড়া আর কী করিস?
—ক্যাসেট আর সিডি-র দোকানে পার্ট টাইম কাজ করি। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকার কাজ।
—আর?
চন্দন একটু চুপ করে থেকে ফের বলতে শুরু করে।
—বনগাঁয় কয়েকটা জায়গা আছে স্যার, যেখানে লুকিয়ে ব্লু ফিল্ম শো চলে রাতের দিকে। সেখানে অপারেটরের কাজ করি মাঝে মাঝে। কোথায় এইসব সিডি পাওয়া যায়, কোথায় চটি বই পাওয়া যায়, সব জানি। হেব্বি ডিমান্ড এসব সিডি-র। সেগুলো ডেলিভারির কাজও করতাম। শো যারা চালাত, তারা যেমন যেমন বলত, যেখান থেকে যা সিডি আনতে বলত, আনতাম। পুলিশ আমাকে ধরেওছিল কিছুদিন আগে। কেস দিয়েছিল। সাতদিন জেলে ছিলাম। আমি স্যার একটু ভাল পথে রোজকারের রাস্তা খুঁজছিলাম।
— হুঁ…
—প্রথম দিন গুপ্তা স্যারের দেখা পেলাম না। অফিসে ছিলেন না। দিনসাতেক পরে আবার গেলাম। হাতজোড় করে বললাম, একটা কাজকর্মের ব্যবস্থা করে দিন না স্যার। উনি চা খাওয়ালেন। কতদূর পড়াশুনা করেছি, কী কাজ করি, সব খুঁটিয়ে জানতে চাইলেন। আমি যখন বললাম, ক্যাসেট আর সিডি -র দোকানে পার্টটাইম কাজ করি, উনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, কী ধরনের সিডি?
— তুই কী বললি?
—আমি স্যার প্রথমে বুঝতে পারিনি উনি ঠিক কী বলতে চাইছেন। বললাম, সিনেমার সিডি। তখন উনি আবার একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘কী ধরনের সিনেমা? ফিল্ম তো অনেক রকমের হয় । বড়দের ফিল্ম, ছোটদের ফিল্ম…’
গুপ্তা স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে এবার আমি কিছুটা আন্দাজ করতে পারলাম, উনি কী বলতে চাইছেন। আমি সাহস করে বলে ফেললাম, ‘যেমন চাইবেন, তেমন এনে দিতে পারি স্যার। যেমন বলবেন। থ্রি এক্স আছে স্যার।
গুপ্তা স্যার একটু হাসলেন। হেসে বললেন, ‘থ্রি এক্স-ও অনেক রকমের হয়।’ আমি আবার একটু থমকে গেলাম। চুপ করে আছি দেখে উনি বললেন, ‘আদমি-অওরত ছাড়াও থ্রি এক্স হয়। আদমি-আদমি হয়। অওরত-অওরত হয়।’ এবার ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল আমার কাছে। গুপ্তা স্যার ‘আদমি-আদমি’ র ক্যাসেট পাওয়া যাবে কিনা জানতে চাইছেন। মার্কেটে আমরা যাকে ‘হোমো-সিডি’ বলি ।
এরপর একদম খোলাখুলি কথা হল। গুপ্তা স্যার বললেন, ‘তুমি আমাকে ক্যাসেট-সিডি এনে দেবে। অফিসেই আসবে। অফিসের ল্যান্ডলাইনে ফোন করে আমার পিএ-র থেকে টাইম চাইবে। কী জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট জানতে চাইলে বলবে, সাহেব সাপ্লাইয়ের কাজে ডেকেছেন। দিন আর সময় পিএ বলে দেবে। ভাল সিডি হলে ভাল টাকা দেব। আর তোমার অন্য কোনও কাজের ব্যাপারটাও দেখছি আমি।’
—বেশ… তারপর?
—আমি ওঁকে এ পর্যন্ত ছ’বার সিডি দিয়েছি। উনি প্রথমবার দু’হাজার টাকা দিয়েছিলেন। পরের বার থেকে তিন। আমার মাসে চার-পাঁচ হাজার বাড়তি রোজগার হচ্ছিল। আমি ওতেই খুশি ছিলাম, কিন্তু শিবু বলল, ‘কী পাতি চার-পাঁচ হাজারে খেলছিস…বড় দাঁও মারার কথা ভাব।’
—শিবু?
—শিবু আমার অনেকদিনের বন্ধু। একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি। এখন খড়দায় থাকে। একটা কারখানায় কাজ করে। মাঝে মাঝে আমরা ব্যারাকপুর স্টেশনে আড্ডা দিই শনি-রবিবার। আড্ডায় গুপ্তা স্যারের কথা বলতে শিবু লাফিয়ে উঠেছিল, ‘তুই কি গাধা নাকি! এটা মাসে চার-পাঁচ হাজারের কেসই না। মিনিমাম চার-পাঁচ লাখ!’ আমি বললাম, মানে?
শিবু বলল, মালটা এত বড় চাকরি করে। নিজের ফ্ল্যাট ভিআইপি রোডের উপর। ওকে একটা টোপ দে। বল, একটা দারুণ সিডি আছে, কিন্তু ভাড়া দেওয়া যাবে না। কোনও একটা জায়গায় গিয়ে দেখতে হবে। আমি বললাম, কিন্তু যদি না আসে? শিবু হাসল। বলল, আরে আসবে আসবে, ওর বাপ আসবে… ঠিক আসবে। তুই লোভ দেখাবি, বলবি, রিয়েল সিনও থাকবে। আমি বললাম, রিয়েল সিন মানে? শিবু বলল, আরে গাধা, বলবি পার্টনার রেডি থাকবে তোর স্যারের জন্য। মাথায় ঢুকল? আমি বললাম, সে না হয় এল, তারপর?
শিবু বলল, ‘তারপর তো সোজা। বলব, লাখ চারেক ছাড়ুন, না হলে আপনার কীর্তি ফাঁস করে দেব। বাড়িতে আর অফিসে সবাই জানবে, বউ প্রেগন্যান্ট, একটা বাচ্চা মেয়েও আছে আর আপনি মাসে মাসে হোমো-সিডি আনিয়ে দেখছেন। দেখবি সুড়সুড় করে মাল খসাতে রাজি হয়ে যাবে। দু’-একটা আরও ছেলেপুলে লাগবে কাজটায়। ভাব একবার, যদি চারজন-ও হয়, পার হেড লাখখানেক। যদি দু’লাখ পাওয়া যায়, তা হলেও পঞ্চাশ হাজার!’
শিবুর কথা শুনে মাথাটা ঘুরে গেল আমার। এক লাখ পার হেড? মাসে সাকুল্যে আট-দশ হাজার রোজগার হয় এদিক-ওদিক করে। তা-ও সব মাসে নয়। সেখানে একেবারে লাখখানেক পেয়ে গেলে তো নিজের একটা ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করার কথা ভাবা যাবে অন্তত। রাজি হয়ে গেলাম শিবুর কথায়।