—সে তো একটা কর্পোরেট অফিসে একজন সিনিয়র এগজ়িকিউটিভের কাছে কত লোকই আসে। তাতে কী প্রমাণ হল?
—ঠিক স্যার, কিন্তু সঙ্গে আরও একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস বলছে। বলছে, যতক্ষণ এই লোকটা ঘরে থাকত, সাহেব নাকি বাইরে লাল বাতি জ্বালিয়ে দিতেন। অর্ডারলিকে বলেও দিতেন, যাতে ভিতরে কেউ না আসে। এটা নাকি কখনও অন্য কোনও ভিজিটরের ক্ষেত্রে করতেন না।
এসপি-কে এখনও নিরুত্তাপ শোনায়, ‘তাতেই বা কী এমন গুরুতর প্রমাণ হচ্ছে?’
—বলছি স্যার। গুপ্তাজি-র লাস্ট তিন মাসের ভিজিটর্স লিস্ট স্ক্যান করেছি গত ঘণ্টা দুয়েক ধরে। এই লোকটার আইডেন্টিটি এস্ট্যাব্লিশ করা গেছে স্যার। এর নাম চন্দন। চন্দন বসু। বনগাঁয় বাড়ি, ক্রিমিনাল হিস্ট্রি আছে স্যার…’
—কী হিস্ট্রি?
—আইসি বনগাঁ-কে ফোন করে নামটা দিয়েছিলাম স্যার। এসডিপিও বনগাঁ সাহেবকেও বলেছিলাম। এই কিছুক্ষণ আগে আইসি বনগাঁ ফোন করেছিলেন স্যার। থানার ‘অ্যারেস্ট রেজিস্টার’-এ নাম আছে এই চন্দনের। মাস ছয়েক আগে একে ডিস্ট্রিক্ট এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ অ্যারেস্ট করেছিল। ব্লু ফিল্মের অনেক সিডি সিজ় হয়েছিল সেই কেসে।’
এসপি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছেন এবার। কথা বলতে বলতেই পায়চারি করছেন দ্রুত। স্নায়ুতে উত্তেজনার লাবডুব টের পাচ্ছেন দিব্যি। রাকেশের উভকামী হওয়ায় আভাস কবিতায়, স্বামীর মৃত্যুর খবরেও স্ত্রী-র আপাত-নিরুত্তাপ থাকা, ব্লু ফিল্মের ব্যবসায় গ্রেফতার হওয়া যুবকের সঙ্গে মাসে দু’বার করে রাকেশের অফিস-বৈঠক….বিন্দুগুলো যোগ করলে সমাধান-রেখার একটা অবয়ব ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।
সুবীর প্রশ্ন করেন, ‘এই চন্দনটাকে তুলে নিই স্যার?’
—না, ডোন্ট রাশ। আগে ছেলেটার ফোন নম্বরটা নিয়ে নাও বনগাঁ থানা থেকে। পেয়ে যাবে অ্যারেস্ট রেজিস্টারে। রবিবার ১০ ফেব্রুয়ারি দুপুর থেকে সোমবার সকাল অবধি টাওয়ার লোকেশন নিয়ে জানাও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কোন সার্ভিস প্রোভাইডারের ফোন ইউজ় করে সেটা জানাও কুইকলি। আমি বলে দিচ্ছি ওদের টপ লেভেলে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পেয়ে যাবে সিডিআর।
ঘণ্টাখানেক পেরনোর আগেই সুবীর ফোন করলেন আবার। এবং যে চূড়ান্ত উত্তেজিত ভঙ্গিতে ‘স্যার!’ বলে কথা শুরু করলেন, পুলিশ সুপার বুঝে গেলেন, সমাধান আসন্ন।
‘স্যার, খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে! রবিবার দুপুর দুটো থেকে সোয়া তিনটে পর্যন্ত মাইকেলনগর, তারপর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত নিউ ব্যারাকপুর সেক্টরে স্ট্যাটিক। রাত দেড়টায় মুড়াগাছার কাছাকাছি!’
এসপি দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন, ‘এবার তুলে নাও চন্দনকে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। বাড়িতে দুম করে রেইড করতে যেয়ো না। যদি না থাকে, তা হলে আসবেই না আর রেইড হওয়ার পর। হাওয়া হয়ে যাবে। আগে জেনে নাও, কোথায় আছে বা কোথায় থাকতে পারে। লোকাল ছেলে। খবর পাওয়াটা কঠিন হবে না। আমি এসডিপিও বনগাঁ-কে বলে দিচ্ছি। রেডি হয়ে টিম নিয়ে আধঘণ্টার মধ্যে বেরিয়ে পড়ো। সিভিল গাড়িতে। সিভিল ড্রেসে। কুইক!’
ওসি-র সোর্স নেটওয়ার্ক শক্তপোক্ত হলে একটা মহকুমা শহরে কারও অবস্থান ট্র্যাক করা কঠিন ব্যাপার নয় কিছু। দ্রুত জানা গেল, চন্দন বাড়িতে নেই। আছে শ্বশুরবাড়িতে, গোবরডাঙ্গায়। চন্দনকে গ্রেফতার করে পুলিশ যখন বারাসত রওনা দিল, তখন রাত সাড়ে ন’টা পেরিয়ে প্রায় পৌনে দশ।
‘না স্যার আমি কিছু করিনি’ বা ‘আমি কিছু জানি না’ জাতীয় বাক্যবন্ধ ব্যবহারের সুযোগই পেল না বছর তিরিশের চন্দন। কলার চেপে ধরে তাকে প্রথম প্রশ্নটাই করা হয়েছিল, ‘রাকেশ গুপ্তা বলে কাউকে চিনিস?’ এবং হতচকিত চন্দন ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কিছু বলার আগেই ঝটিতি প্রশ্ন নম্বর দুই, ‘গুপ্তাসাহেবেকে কোথায় নিয়ে গেছিলি মাইকেলনগর থেকে? রাত দেড়টায় মুড়াগাছায় কী করছিলি?’ চন্দন ততক্ষণে থরথরিয়ে কাঁপতে শুরু করেছে। কথা বেরচ্ছে না মুখ দিয়ে। ধেয়ে এল তিন নম্বর প্রশ্ন, ‘আমরা পুরোটাই জানি। শুধু তোর মুখ থেকে শুনতে চাই। একটা মিথ্যে বললে চামড়া গুটিয়ে দেব। এবং শুকোব তোর বাড়ির উঠোনেই। কে কে ছিলি, কেন মারলি, শুরু থেকে বল।’
এসপি-র পা জড়িয়ে ধরে এবার কেঁদে ফেলল চন্দন, ‘বলছি স্যার। কিছু মালকড়ি সালটে নেওয়ার প্ল্যান ছিল। জানে মেরে দেওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু গুপ্তা স্যার এমন চিল্লামিল্লি করলেন যে না মারলে ফেঁসে যেতাম।’
রাকেশ গুপ্তা হত্যা রহস্যের যবনিকা পতন। চন্দন শুরু করল একেবারে গোড়া থেকেই। মাস চারেক আগে যখন রাকেশ গুপ্তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল সল্টলেকে।
‘আমি বন্ধুদের সঙ্গে সল্টলেকের সিটি সেন্টারে সিনেমা দেখে বেরচ্ছিলাম। সন্ধে হয়ে গেছে তখন। গুপ্তা স্যারও সিটি সেন্টারে এসেছিলেন। বেরচ্ছিলেন গাড়ি নিয়ে। সঙ্গে ওঁর মিসেস ছিলেন। ওঁর গাড়িটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। উনি নেমে বনেট খুলে ঠিকঠাক করার চেষ্টা করছিলেন। বৃষ্টি পড়ছিল। আমি গাড়ি সারাইয়ের টুকটাক কাজ শিখেছিলাম বারো ক্লাসের পর। দাঁড়িয়ে গিয়ে বলেছিলাম, কী হয়েছে, দেখব একটু স্যার? মিনিট কুড়ি নাড়াঘাঁটা করে গাড়িটা স্টার্ট করিয়ে দিয়েছিলাম। স্টার্ট নেওয়ার সময় পিছন থেকে ঠেলেও দিয়েছিলাম গাড়িটা।