অরিজিৎকে ফোনে ধরলেন পুলিশ সুপার। অরিজিৎ, এসপি-র কলেজজীবনের সহপাঠী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়ান।
‘এই অরিজিৎ, শোন না, একটা কাজ করে দিতে হবে। ইউনিভার্সিটিতে কতক্ষণ থাকবি?… কিছু হিন্দি কবিতা পাঠাব তোর কাছে। তোদের হিন্দি ডিপার্টমেন্টের কোনও প্রোফেসরকে পড়াতে পারবি ওগুলো? তারপর সেই প্রোফেসরের সঙ্গে একবার কথা বলব। আর ইংরেজির কাউকে বলে লেখাগুলো অনুবাদ করে দিতে বল প্লিজ়। হাতে সময় বেশি নেই। আজ রাতের মধ্যে হলে ভাল, না হলে লেটেস্ট কাল সকাল। করে দে ভাই।’
অরিজিৎ একটু অবাকই হন শুনে। তারপর রসিকতা করেন হালকা, ‘তা হলে চাকরিটা ছেড়েই দিচ্ছিস ফাইনালি? লেখার হাত তো তোর বরাবরই ভাল। লেখালিখি শুরু করবি নাকি পাকাপাকি? খুব ভাল। গুড ডিসিশন। চোর-ডাকাত ছেড়ে যখন কবিতায় মন দিয়েছিস…’
এসপি হাসেন, ‘আরে ধুর, এই লেট থার্টিজ়-এ আর কে চাকরি দেবে নতুন করে? দরকার আছে বলে বলছি। চাপে আছি রে একটু…’
অরিজিৎ বললেন, ‘ঠিক আছে। এখনই পাঠা। দেখছি।’
সে-রাতে হয়ে উঠল না। কিন্তু পরের দিন, বৃহস্পতিবার সকাল ন’টার মধ্যে এসপি-র বারাসতের বাংলোয় পৌঁছে গেল রাকেশ গুপ্তার সাম্প্রতিক হিন্দি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ।
দীর্ঘ কবিতা নয়। ষোলো থেকে আঠারো লাইন গড়ে। অনুবাদগুলো প্রত্যেকটাই পড়লেন এসপি। একবার নয়, দু’-তিনবার করে। ভদ্রলোক আহামরি কিছু লিখতেন না। প্রেমের কবিতা প্রত্যেকটাই। নির্দিষ্ট কাউকে ভেবে, কাউকে উদ্দেশ করে লেখা? অবশ্য তা-ই বা হতে হবে কেন ? নির্দিষ্ট কাউকে উদ্দিষ্ট হতেই হবে, এমন নিয়ম আছে নাকি প্রেমের কবিতায়?
কিন্তু তা হলে খটকা লাগছে কেন? কেন মনে হচ্ছে, কোথাও একটা যোগসূত্র লুকিয়ে আছে শব্দগুলোয় ? আবার পড়তে থাকেন এসপি। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি লাইন। এবং পড়তে পড়তেই ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি!’ তা হলে কি…?
অরিজিৎকে ফোনে ধরেন এসপি, ‘তোর ওই হিন্দি প্রোফেসরের নম্বরটা টেক্সট কর তো শিগগির। আর ওঁর নামটা বল।’
এসএমএস-এ নম্বরটা আসতেই মোবাইলের বোতাম টেপেন পুলিশ সুপার। হিন্দির অধ্যাপকের সঙ্গে কথোপকথন হয় এরকম।
—ভেরি সরি ত্রিপাঠীজি… বিরক্ত করছি একটু। কবিতাগুলোর অনুবাদ পড়লাম। একটা বিষয়ে আপনার মতামত জানা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে । তাই আপনাকে বিরক্ত করা…
—না না, বিরক্ত কিসের? বলুন না।
—কবিতাগুলো পড়ে আমার একটা জিনিস স্ট্রাইক করছে। আপনারও সেটা মাথায় এসেছে কিনা, সেটাই জাস্ট…
—বলুন না..
—দেখুন, কবিতাগুলো তো প্রেমের। কিন্তু শব্দের প্রয়োগ বলুন বা উপমার ব্যবহার… আমি স্পেসিফিকসে যাচ্ছি না, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এই কবিতা কোনও নারীকে উদ্দেশ করে কোনও পুরুষ লিখতে পারে না।
— হুঁ…
—আমার মনে হচ্ছে, এই কবিতা কোনও পুরুষ কবি শুধুমাত্র কোনও পুরুষকে উদ্দেশ করেই লিখতে পারেন। নির্দিষ্ট কেউ না-ই হতে পারে। কিন্তু এটা পুরুষের প্রতি পুরুষের প্রেমের কবিতা। সমকামের কবিতা। পুরুষের শরীরী বর্ণনা এত ডিটেলে… প্রায় প্রতিটা কবিতায়… আর উপমাগুলোও…
উত্তর আসে মোবাইলের অন্য প্রান্ত থেকে, ‘এসপি সাহেব, ইউ আর রাইট। পড়ে আমারও মনে হয়েছে এটা। খুব ডিস্টিঙ্কটলি মনে হয়েছে। অলমোস্ট আনমিস্টেকেবল।’
—থ্যাঙ্কস আ লট ত্রিপাঠীজি… এটাই জানার ছিল।
ফোনটা রেখে দিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে বসেন এসপি। রাকেশ গুপ্তার মেয়ে আছে আট বছরের। দ্বিতীয় সন্তান আগতপ্রায়। সেই লোক এমন কবিতা লিখতেন, যার ছত্রে ছত্রে সমকামের ঘোষণা? রাকেশ কি তা হলে উভকামী ছিলেন? এই উভকামিতার কথা কোনওভাবে জেনে গিয়েছিলেন বলেই কি ততটা শোকসন্তপ্ত দেখায়নি রাকেশের স্ত্রী-কে?
যদি ধরেই নেওয়া যায় যে রাকেশ উভকামী ছিলেন, তাতেই বা তদন্ত এগচ্ছে কোথায়? রাকেশের চরিত্রের একটা সম্ভাব্য দিকের ব্যাপারে আভাস পাওয়া গেছে মাত্র। ‘সূত্র’ কোনওভাবেই এখনও বলা যায় না একে। তদন্তকারী টিমকে এসপি জানালেন ব্যাপারটা, ‘মিস্টার গুপ্তা প্রবাবলি বাইসেক্সুয়াল ছিলেন… খোঁজখবর করার সময় এই অ্যাঙ্গলটা মাথায় রেখো।’
সোম, মঙ্গল, বুধ পেরিয়ে বৃহস্পতি শেষ হতে চলল। ব্রেক-থ্রু হল না এখনও। এই সপ্তাহের মধ্যে না হলে আগামী সোমবার জেলা পুলিশের থেকে কেস ডায়েরি চেয়ে নেওয়া হবে ভবানী ভবনে সিআইডি-র সদর দফতরে, বুঝতে পারছিলেন এসপি। একটু হতাশই লাগছিল।
হতাশা কাটার সামান্য সম্ভাবনা দেখা দিল শুক্রবার বিকেলে, আইসি জগদ্দল সুবীর চ্যাটার্জির ফোনে। উত্তেজিত শোনাচ্ছে সুবীরকে, ‘স্যার, আপনি বললেন না গুপ্তাসাহেব বাইসেক্সুয়াল ছিলেন হয়তো। ওঁর কোম্পানির অফিসে আমি সোমবার বিকেল থেকেই দু’জনকে ফিট করে রেখেছিলাম। এরা রাকেশের অর্ডারলির কাজ করত বেসিক্যালি। এই চা-টা দেওয়া, ভিজিটর হ্যান্ডল করা.. এসব আর কী! এ ক’দিন ফিমেল অ্যাঙ্গলেই কনসেনট্রেট করছিলাম… আজ অন্য অ্যাঙ্গলে খোঁজ নিলাম… অনেকক্ষণ কথা বললাম…’
—হুঁ… কী পেলেন?
—ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার! এরা বলছে একটা পঁচিশ-তিরিশ বছরের লোক গত তিন মাস ধরে মাসে অন্তত দু’বার রাকেশের চেম্বারে আসত। দুপুর বারোটা থেকে সোয়া বারোটার মধ্যে আসত। মিনিট দশ-পনেরো ঘরে থাকত। তারপর চলে যেত।