‘কখন?’—উত্তর পাওয়া গেছে।
‘কীভাবে?’—ময়নাতদন্তের রিপোর্ট জানিয়েছে।
‘কোথায়?’— উত্তর মেলেনি এখনও।
‘কে?’ বা ‘কারা?’—‘কেন’-র রহস্যই এখনও ভেদ করা গেল না, ‘কে বা কারা’ তো পরের ব্যাপার। নতুন করে সব শুরু করতে হবে।
নতুন করে শুরুই শুধু নয়, শেষও যে করতে হবে দুঃসাধ্য দ্রুততায়, পরের দিন সকালেই বুঝে গেলেন এসপি। যাঁকে রাখঢাকহীন ভাষায় জানিয়ে দিলেন ডিজি, ‘খুব বেশি সময় দিতে পারব না আর…ম্যাক্সিমাম চার-পাঁচ দিন.. তার মধ্যে হল তো হল…নয়তো সিআইডি উইল টেক ওভার।’
পুলিশ সুপারের গাড়ি বাংলো থেকে বেরল সাড়ে আটটা নাগাদ। গন্তব্য, ভিআইপি এনক্লেভ। মিসেস গুপ্তার সঙ্গে আরেকবার খোলাখুলি কথা বলা দরকার।
.
আত্মীয়দের আনাগোনা এখনও লেগেই আছে গুপ্তা-পরিবারে। দাদার মৃত্যুর খবর পেয়েই সোমবার সন্ধেতেই মা-কে নিয়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন বোন দীপিকা। সংসারটা মূলত দীপিকাই সামলাচ্ছেন এখন। উপায় কী আর? ছেলের অকালমৃত্যুতে মা শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন। জ্ঞান হারাচ্ছেন যখন-তখন। কবিতাও সারাদিন নিজের ঘরে শুয়ে থাকছেন নিস্তব্ধ। মেয়ে দিয়া ছাড়া আর কারও সঙ্গে কথা প্রায় বলছেনই না।
ড্রয়িং-কাম-ডাইনিং রুমের একটা সোফায় বসেছিলেন পুলিশ সুপার। রাকেশের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের খুব বেশি দেরি নেই আর। শ্রাদ্ধের পরের দিন আবাসনে আয়োজিত হবে স্মরণসভা। সেই সভার জন্য দাদার ছবির একটা কোলাজ তৈরি করছেন বোন দীপিকা, পুরনো ফ্যামিলি অ্যালবাম ঘেঁটে।
চা-বিস্কুট এসেছে। খুচরো কথার মধ্যে দীপিকা ছবিগুলো দেখাতে থাকেন এসপি-কে। ‘এইটা ভাইয়ার কোলে আমি, ছোটবেলায় রাজস্থান বেড়াতে গিয়ে। এইটা ভাইয়ার ফিফটিন্থ বার্থডের। এটা কলেজের এক্সকারশনে বন্ধুদের সঙ্গে ভাইজ্যাগে। আর এটা ভাইয়ার বিয়ের দিন আমার সঙ্গে…’ গলা বুজে আসে দীপিকার। মাথা নিচু করে ফেলেন।
‘আর এটা?’
ফ্রেমের ডানদিকের একটা ছবিতে চোখ আটকে গেছে এসপি-র। একটা বই হাতে নিয়ে কিছু একটা পড়ছেন রাকেশ। দাঁড়ানো অবস্থায়, সামনে মাইক্রোফোন।
দীপিকা মুখ তোলেন, ‘এটা মুশায়েরার।’
—মুশায়েরা?
—হ্যাঁ, দাদা কবিতা লিখত তো! ডাকও পেত ঘরোয়া কবিতা পাঠের আসরে। অবসর সময়ে সাহিত্য চর্চা করত।
—তাই? আপনার দাদা তো বেশ গুণী মানুষ ছিলেন। ওঁর লেখা কবিতাগুলো নিয়ে একটা বই বের করার কথা ভেবে দেখতে পারেন কিন্তু।
ফের গলা ধরে আসে দীপিকার, ‘হ্যাঁ, এটা ভাল বলেছেন। দাদারও ইচ্ছে ছিল একটা বই বেরোক।’
—আপনাদের কাছে ওঁর লেখাগুলো নেই?
এতক্ষণ এক ভদ্রলোক কথোপকথন শুনছিলেন পাশের সোফায় বসে। দেহ উদ্ধারের দিন যখন এসেছিলেন এই ফ্ল্যাটে, তখনও এঁকে দেখেছিলেন এসপি। নিজেই পরিচয় দেন ভদ্রলোক, ‘স্যার, আমি রঞ্জিত। রঞ্জিত পোদ্দার। আমার কাছে আছে রাকেশের রিসেন্ট বেশ কিছু লেখা। আমিও একটু-আধটু লেখার চেষ্টা করি। রাকেশ আর আমি ঠিক করেছিলাম, পরের বইমেলায় কবিতার বই বার করব দু’জনে। আমি কিছু লিখলে সবার আগে ওকে পড়তে দিতাম। রাকেশও যখন কিছু লিখত, আমাকে দিয়ে বলত, ‘‘কেমন হয়েছে?’’ ’
—বেশ তো, সময় নিয়ে বের করে ফেলুন বইটা।
—হ্যাঁ স্যার…
—আচ্ছা, ওঁর লেখাগুলো একটু দেখা যেতে পারে?
—হ্যাঁ, হোয়াই নট? রিসেন্ট লেখাগুলো আমার বাড়িতেই আছে। কিন্তু হাউ উইল দ্যাট হেল্প?
—না না, ইনভেসটিগেশনের জন্য নয়। এমনি দেখতাম। সাহিত্য আমারও পছন্দের বিষয়। অবশ্য আপনার আপত্তি থাকলে…
কথা শেষ হওয়ার আগেই রঞ্জিত বলে ওঠেন, ‘না স্যার, আপত্তি কিসের? আমার বাড়ি কাছেই, উল্টোডাঙায়। কাউকে যদি কাইন্ডলি পাঠিয়ে দেন, তার হাতে দিয়ে দেব লেখাগুলো। কিন্তু হিন্দি কবিতা… মানে আপনি…’
এসপি মৃদু হাসেন, ‘আমি বাঙালি, কিন্তু হিন্দি মোটামুটি পড়তে পারি।’
যে জন্য সকাল-সকাল ছুটে আসা বাগুইআটির এই ফ্ল্যাটে, সেটা হল। মিসেস গুপ্তার সঙ্গে একান্তে মিনিট পনেরো কথা। হুঁ-হাঁ আর হ্যাঁ-না-তেই উত্তর সীমাবদ্ধ রাখলেন মহিলা। নতুন তথ্য পাওয়া গেল না কিছু। মরিয়া পুলিশ সুপার শেষ চেষ্টা করলেন আন্দাজে ঢিল ছুড়ে, ‘ম্যাডাম, আমরা যা খবর পাচ্ছি, মিস্টার গুপ্তার একটা এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার ছিল… আপনি জানতেন কিছু?’ কবিতা স্থিরচোখে তাকালেন, ‘বিশ্বাস করি না। আপনারা ভুল খবর পেয়েছেন।’ কী আর বলার থাকে এরপর?
ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় রঞ্জিত পোদ্দারকে দেখিয়ে ওসি ঘোলাকে নির্দেশ দিলেন এসপি, ‘ইনি উল্টোডাঙায় থাকেন। ঠিকানা নিয়ে নাও, লোক পাঠাও এখনই। উনি কিছু কাগজ দেবেন। ওগুলো আমার অফিসে পাঠিয়ে দিয়ো। অ্যাজ় আর্লি অ্যাজ় পসিবল।’
কিছুতেই যখন কিছু হচ্ছে না, তদন্ত যখন সর্বার্থেই ক্লুলেস, কেস যখন চলে যেতেই বসেছে সিআইডি-র কাছে, কী লিখতেন রাকেশ, সেটাই না হয় পড়ে দেখা যাক। কবিতা থেকে কবিমনের গতিপ্রকৃতির সন্ধান মেলে যদি!
.
সাদা কাগজে লেখা রাকেশের কবিতাগুলো পুলিশ সুপারের অফিসে পৌঁছল দুপুর আড়াইটের সামান্য পরে। হোঁচট খেতে খেতে কিছু শব্দ আর বাক্য পড়তে পারা এক, কবিতার রসাস্বাদন আরেক। লেখাগুলো উলটে-পালটে দেখতে গিয়ে এসপি বুঝে গেলেন, এর মর্মোদ্ধার তাঁর কম্মো নয়।