ঠিকই তো। শুধু তো কলকাতা নয়, পাঠকের প্রবল কৌতূহল তো স্বাভাবিকই সেই সব ঘটনা নিয়েও, যা ঘটেছিল রাজ্য পুলিশের এলাকায়। এবং যার সমাধান হয়েছিল নিখাদ পেশাদারি উৎকর্ষে। এমন সব ঘটনা, এমন সব মামলা, এমন সব চরিত্র, কুড়ি-পঁচিশ বছর পেরিয়ে গেলেও যা নিয়ে এখনও অনন্ত আগ্রহ সাধারণের। কী হয়েছিল, কেন হয়েছিল, কীভাবে হয়েছিল, তা মোটামুটি মনে থাকলেও নেপথ্যকথা আরও বিশদে জানার ঔৎসুক্যে ভাটা পড়েনি বিন্দুমাত্র।
সেই আগ্রহ-ঔৎসুক্য-কৌতূহল নিরসনের যথাসাধ্য প্রয়াস রয়েছে ‘আবার গোয়েন্দাপীঠ’-এ। এই বইয়ের একাধিক কাহিনিতে বাধ্যতই উঠে এসেছে শিশু-কিশোরদের অপরাধ-মনস্তত্ত্বের কাটাছেঁড়া। উঠে এসেছে এমন কিছু কেসের সবিস্তার ঘটনাপ্রবাহ, যার ভয়াবহতা আজও গেঁথে রয়েছে আমবাঙালির স্মৃতিতে।
প্রথম দুটি খণ্ডের পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় আরও একটি সংগত প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। মহিলা গোয়েন্দা কি নেই পুলিশে? পুরুষতন্ত্রই একচেটিয়া? যদি তা না হয়, তা হলে ‘গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার’ সিরিজ়ের দুটি বইয়ে কেন স্থান পায়নি মহিলা গোয়েন্দাদের সমাধান করা কোনও কেস?
পুরুষদের কিছুটা আধিপত্য আছে তদন্তক্ষেত্রে, অনস্বীকার্য। কিন্তু সে দাপট মোটেই নয় নিরঙ্কুশ। মেধা-পরিশ্রম-আন্তরিকতার ত্র্যহস্পর্শে বহু জটিল মামলার সুচারু সমাধান করেছেন মহিলা গোয়েন্দারা। বাস্তবের ফেলু-ব্যোমকেশদের সঙ্গে সমানে পাল্লা-দেওয়া ‘মিতিনমাসি’-দের দক্ষতার নমুনা এই খণ্ডে ধরা রইল কলকাতা পুলিশের এক বিরল মামলার তদন্তপ্রক্রিয়ায়।
কলকাতার নগরপাল শ্রীঅনুজ শর্মার উৎসাহ এবং প্রশ্রয় ছাড়া দিনের আলো দেখত না এই বই। তাঁকে জানাই অশেষ কৃতজ্ঞতা। বিভিন্ন মামলার ব্যাপারে বহু প্রাসঙ্গিক তথ্য সরবরাহ করে যে সহকর্মীরা অকৃপণ সাহায্য করেছেন, তাঁদের ছোটই করা হয় শুকনো ধন্যবাদ জানালে। কৃতজ্ঞতা রইল অকুণ্ঠ।
কয়েকটি কাহিনিতে নাম পরিবর্তন করা হয়েছে কিছু পার্শ্বচরিত্রের। যাঁরা এখনও জীবিত, এবং সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। আসল নাম ব্যবহার করে ওঁদের সামাজিক বিড়ম্বনা বাড়াতে চাইনি।
আশা, এ বই রহস্যরসিক পাঠকের ভাবনার রসদ জোগাবে। চিন্তার উপাদান জোগাবে অপরাধ-বিজ্ঞানের পড়ুয়াদের।
গোয়েন্দাপীঠ, আবার।
১ জানুয়ারি, ২০২০
কলকাতা
১. শ্যামলদা, ভাল আছেন?
শ্যামলদা, ভাল আছেন?
—শালা পুরো পৈতে করে দিয়েছি বডিটাকে।
—মানে?
—আবে…পৈতে বুঝিস না? আড়াআড়ি নামিয়ে দিয়েছি। চিরে গেছে পুরো। ঘাড় থেকে কোমর অবধি। ওই যে রে, যেভাবে পৈতে থাকে বামুনদের। আর মালটাকে কুপিয়েছি ওর মায়ের সামনে। বুড়ি তো রক্ত দেখে বেহুঁশই হয়ে গেল…
—মায়ের সামনে মারলে এভাবে?
—দরকার ছিল। ইচ্ছে করেই করেছি। মালটা পুলিশের খোঁচড়গিরি করছিল বড্ড। মহেশতলার ঠেকে গত হপ্তার রেইডটা ওই-ই করিয়েছিল। পাকা খবর আছে আমার কাছে। তাই ঘরে ঢুকে মারলাম। মায়ের সামনে পৈতে করে দিলাম। এই যে লুড়কে গেল… আর কারও হিম্মত হবে না মাথা তোলার…কই বে…ঢাল একটা মোটা করে… মাথাটা ছাড়ুক একটু…
—এই নাও দাদা… এইট্টি এমএল… তিনটে ঢকাঢক নামিয়ে দিলেই দেখবে মদটা চলকাচ্ছে ভেতরে…
—ধুর… ওসব এইট্টি ফেইট্টিতে থোড়ি চলকায় আমার! কিসে চলকায় জানিস? মার্ডারের পর। গরম রক্তটা যখন ছিটকে এসে মুখে লাগে না… কী আর বলি তোদের… বুঝবি না তোরা…গরমাগরম রক্ত স্ট্রেট ছিটকে এসে মুখে… আঃ… বিন্দাস… ও নেশার কাছে মদ-ফদ মায়া…
‘দাদা’-র ব্যাখ্যা স্তব্ধ করে দেয় গোল হয়ে ঘিরে বসে থাকা শ্রোতাদের। ‘দাদা’। বন্ধুদের কাছে ‘শ্যামল’। জুনিয়রদের কাছে ‘শ্যামলদা’। বা স্রেফ ‘দাদা’। বাকিদের কাছে, প্রতিপক্ষ গ্যাংয়ের কাছে, পুলিশের কাছে পরিচয় অন্য নামে। যে নামে রিষড়া-কোন্নগর অঞ্চলে বাঘ, গোরু এবং অন্যান্য যা যা প্রাণী আছে, সব এক ঘাটে জল খায়।
হুব্বা। হুব্বা শ্যামল।
.
ডাক্তার আর পুলিশ। নানাধরনের মৃতদেহ দেখতে হয় এই দুই পেশার লোকদের। সাধারণ লোকের গা গুলিয়ে উঠবে দেখলে, এমন থ্যাঁতলানো-দোমড়ানো-পচাগলা ক্ষতবিক্ষত ‘বডি’ খুঁটিয়ে দেখাটা ডাক্তার বা পুলিশের রুটিন কাজের মধ্যেই পড়ে। অভ্যেস হয়ে যায়। বিকৃত মৃতদেহ আলাদা করে কোনও প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয় না সচরাচর।
এই লাশটা ব্যতিক্রম। পড়ে ছিল রিষড়া রেলগেটের কাছে। বহু ডেডবডি দেখার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রিষড়া থানার ওসি-ও প্রথম দেখায় চোখ সরিয়ে নিতে বাধ্য হলেন। মৃতের বয়স পঁচিশ-তিরিশের বেশি নয়। শরীরের উপরের অংশ আড়াআড়িভাবে কোপানো। ডানদিকের কাঁধ থেকে বাঁদিকের কোমর অবধি। বেলাগাম বেরিয়ে পড়েছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। ছড়িয়েছে-ছিটিয়েছে রাস্তায়। ধারালো অস্ত্রের কোপ পড়েছে গলাতেও। এক নয়, একাধিক। এ খুনের বর্ণনায় ‘নৃশংস’ নেহাতই নরম বিশেষণ।
খবর পেয়ে স্পটে চলে এসেছেন এসডিপিও (সাব ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার), শ্রীরামপুর। যিনি লাশে একঝলক চোখ বুলিয়ে দৃশ্যতই সামান্য বিচলিত হয়ে পড়েছেন, এবং আপ্রাণ চেষ্টা করছেন স্বাভাবিক থাকার। ওসি তাকান এসডিপিও-র মুখের দিকে। আন্দাজ করার চেষ্টা করেন তরুণ আইপিএস অফিসারের অস্বস্তির কারণ, ‘স্যার, বডি আইডেন্টিফাই হয়নি এখনও। চেনেন নাকি একে?’