কর্মক্ষেত্রে কোনও মহিলা সহকর্মীর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের আভাস? মহিলা কর্মী অনেকেই আছেন সংস্থায়। রাকেশের পেশাগত সংস্রব ছিল মূলত পিএ অরুণিমার সঙ্গে। অরুণিমা সপ্রতিভ, সুন্দরী, কথাবার্তায় চৌকস। কিন্তু নানাভাবে খোঁজ নিয়েও রাকেশের সঙ্গে অরুণিমার কাজ-বহির্ভূত কোনও সম্পর্কের হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না। অন্য কোনও সহকর্মীর সঙ্গেও না। অন্তত এখনও পর্যন্ত।
রাকেশের অফিসের ডেস্কটপটা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পরীক্ষার জন্য। অফিসিয়াল ল্যাপটপও শনিবার রেখে গিয়েছিলেন অফিসে। দুটোই পাঠানো হয়েছিল প্রযুক্তি-বিশেষজ্ঞদের কাছে। যদি ‘ডিলিট’ করে দেওয়া কোনও ফাইল-ফোল্ডারের খোঁজ পাওয়া যায়। কিন্তু কোথায় আর? ‘হার্ড ডিস্ক’ ঘাঁটাঘাঁটি করেও কিচ্ছু পাওয়া যায়নি বলার মতো।
পাড়া-প্রতিবেশী? আবাসনের বাসিন্দারা? ওঁরা কী বলছেন, কী ভাবছেন? এখনও অনেকের সঙ্গে কথা বলা বাকি। তবে নিকটতম প্রতিবেশীদের মধ্যে যাঁদের সঙ্গে ইতিমধ্যেই কথা বলা হয়েছে, সবাই একটা ব্যাপারে একমত। রাকেশ অত্যন্ত ভদ্র এবং নম্র স্বভাবের মানুষ ছিলেন। কারও সাতে-পাঁচে থাকতেন না। কারও সঙ্গে সামান্যতম ঝগড়াঝাঁটিও কখনও হয়েছে বলে কেউ শোনেননি।
স্থানীয় সোর্স লাগানো হয়েছিল সোমবার বিকেলেই। মূলত বলা হয়েছিল রাকেশের ব্যক্তিজীবন নিয়ে খোঁজ নিতে। পাড়ায় কোনও চর্চা হত কিনা রাকেশকে নিয়ে, হলে কী নিয়ে চর্চা, এইসব। সোর্সরা যা খবর পেয়েছে এ পর্যন্ত, মিলে যাচ্ছে পাড়াপ্রতিবেশীদের ধারণার সঙ্গে। রাকেশ গুপ্তা অজাতশত্রু ছিলেন।
আর রাকেশের স্ত্রী কবিতা? তাঁর ব্যক্তিজীবন? কল ডিটেলস রেকর্ড থেকে অন্তত অন্য কোনও সম্পর্কের ন্যূনতম ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। সুখী দম্পতি হিসেবেই পাড়ায় এবং বন্ধুমহলে পরিচিত ছিলেন ওঁরা। বাহ্যিক সুখী দাম্পত্যের আড়ালে কোনও টানাপোড়েন ছিল? থাকলেও আভাস-ইঙ্গিত পাননি পরিচিতরা। বা পরিচিতদের মধ্যে কেউ কিছু জানলেও লুকিয়ে যাচ্ছেন। রাকেশের দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু অরুণ-সঞ্জীবের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক ছিল কবিতার? সোর্স বলছে, কল রেকর্ডসও বলছে, ‘ভাবীজি-ভাইয়া’-র স্বাভাবিক সম্পর্ক। ‘ডাল মে কুছ কালা’-র ইঙ্গিত নেই।
ব্যারাকপুর-বেলঘরিয়ার দাগি অপরাধীদের তালিকা তৈরি করে খোঁজখবর হয়েছে বিস্তারিত। কেউ জেলে, কেউ জামিনে বাইরে। যারা বাইরে, তারা দিব্যি আছে এলাকায়। এবং শনি থেকে সোমের গতিবিধি সন্দেহের উদ্রেক করছে না।
অতঃকিম? পেশাগত ঝামেলার আঁচ নেই। ধারদেনার সমস্যা নেই। দাম্পত্য অশান্তির ইঙ্গিত নেই। পরকীয়ার খোঁজ নেই। স্থানীয় অপরাধজগতের রাঘববোয়ালদের জড়িত থাকার আভাস নেই। এবং এত ‘নেই’-এর শেষে তদন্তকারীদের হাতেও পেনসিল ছাড়া আর কিছুই পড়ে নেই।
রাত হয়ে গেছে অনেক। অফিসারদের ছেড়ে দেন এসপি। উঠতে উঠতে ওসি ঘোলা বলেন, ‘আরও লোক লাগিয়েছি স্যার। দেখা যাক। মিডিয়া যা বাড়াবাড়ি শুরু করেছে, মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব মার্ডার বোধহয় চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ডিটেক্ট হয়ে যায়!’
এসপি হাসেন, ‘শোনো তপন, মিডিয়া কী করছে, কতটা ‘‘সেনশনালাইজ়’’ করছে, সেটা নিয়ে বেশি ভেবে লাভ নেই। ওটা হাতে নেই আমাদের। আমার চিন্তা হচ্ছে অন্য ব্যাপারে…’
ব্যারাকপুর এবং বেলঘরিয়ার এসডিপিও-রা প্রায় সমস্বরে বলে ওঠেন, ‘কী স্যার?’
—বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্সের একটা হাই-লেভেল ডেলিগেশন মার্ডারটা নিয়ে আজ ডেপুটেশন দিয়ে এসেছে রাইটার্সে… শিল্পক্ষেত্রে কর্মরতদের নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে.. এইসব আর কী… গভর্নমেন্ট কেসটা না সিআইডিকে দিয়ে দেয়…
‘কিন্তু স্যার…’, হতাশ দেখায় বেলঘরিয়ার এসডিপিও-কে।
থামিয়ে দেন পুলিশ সুপার। তরুণ এসডিপিও-র পিঠে হাত রাখেন, ‘বাড়ি যাও, কাল ভাবা যাবে আবার।’
রাতে শোওয়ার আগে একটু বই পড়া বরাবরের অভ্যেস এসপি-র। কিন্তু আজ ইচ্ছে করছে না। কেসটা ঘুরছে মাথার মধ্যে। তলিয়ে ভাবার চেষ্টা করছেন। এবং যত ভাবছেন, তত মাথায় ঘুরেফিরে আসছে রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর সেই বিখ্যাত কবিতার কয়েকটা লাইন। কয়েকটা শব্দ।
‘I kept six honest serving men.
They taught me all I knew.
Their names were what and why
And when
And how and where and who….’
অপরাধের সঙ্গে বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই কিপলিং-এর এই বহুচর্চিত কবিতার, যার ব্যঞ্জনা বহুমাত্রিক। কিন্তু লাইনগুলো এখন কী যে প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে এই মামলার তদন্তে! ‘হোয়াট, হোয়াই, হোয়েন, হাউ, হোয়ার, হু’। কী? কেন? কখন? কীভাবে? কোথায়? কে?
‘কী?’— জানা আছে।
‘কেন?’—মোটিভ অমিল। রাকেশের মানিব্যাগে যা টাকা ছিল, আততায়ীরা নিয়ে গেছে ধরে নেওয়া গেল। ছুটির দিনে মা-কে ছাড়তে এয়ারপোর্ট গেছিলেন। কত টাকা সঙ্গে থাকতে পারে? খুব বেশি ধরলেও হাজার দুই-তিন। আরও একটু বাড়িয়ে ভাবলে টেনেটুনে পাঁচ। লাখখানেক ক্যাশ তো আর সঙ্গে থাকার কথা নয়। রাকেশের চেন-ঘড়ি-আংটি পাওয়া যায়নি। ওগুলো বেচেই বা কত টাকা হতে পারে? যতই হোক, তার জন্য বড়জোর ছিনতাই হয়। এভাবে খুন নয়। সুতরাং ‘মার্ডার ফর গেইন’ হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। তা হলে? ঘুরেফিরে আটকে যাওয়া সেই মোটিভেই।