মিসেস গুপ্তার সঙ্গে আধঘণ্টা একান্তে কথা বলা গেল বিস্তর অনুরোধ-উপরোধের পর। মহিলা নিশ্চুপ বসেছিলেন বিছানায়। প্রাথমিক সমবেদনা জানানোর পর যা কিছু প্রশ্ন করলেন এসপি, হয় মাথা হেলিয়ে, নয় দু’-একটা শব্দে উত্তর দিলেন কবিতা। কাউকে সন্দেহ হয়?— না। রাকেশের কোনও শত্রু ছিল?—না। এবং শেষ পর্যন্ত যাবতীয় দ্বিধা কাটিয়ে, ‘আপনাদের দাম্পত্য সম্পর্ক কেমন ছিল?’একটাই শব্দ খরচ করলেন সদ্য স্বামীহারা মহিলা, ‘ভাল।’
এসপি খুঁটিয়ে লক্ষ করছিলেন মিসেস গুপ্তাকে। শোকের নানারকম চেহারা হয়। হয় উদ্বেল, নয় সংযত, অথবা দুটোর মাঝামাঝি। বা অন্য কোনও প্রকাশ। শোক তো শোকই। নির্দিষ্ট বিশেষণে বাঁধা যায় কখনও?
যদি যেত, মিসেস গুপ্তাকে ‘সংযত’-র গোত্রে ফেলা যেত দ্বিধাহীন। বাহ্যত অন্তত শোকতাপের আকুলতা নেই তেমন। অবশ্য ‘শোকে পাথর হয়ে যাওয়া’ বলেও তো কথা আছে বাংলায়। ভিতরের উথালপাথাল বাইরে আসে না সবার। আধঘণ্টার বাক্যালাপের পর তবু মনে হয় এসপি-র, ভদ্রমহিলাকে একটু যেন বেশিই নিরুত্তাপ লাগছে। নাকি ভুল ভাবছেন? মহিলা শোকে পাথর হয়ে গেছেন এবং বাহ্যিক প্রকাশটা তাই উচ্চকিত নয়?
রাত সাড়ে দশটা নাগাদ ভিআইপি এনক্লেভ থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার সময়ও ফের হামলে পড়ল মিডিয়া। বক্তব্য চাই এসপি-র। ‘তদন্ত সবে শুরু হয়েছে, সমস্ত দিকই খতিয়ে দেখা হচ্ছে’ জাতীয় একটা গতানুগতিক ‘কোট’ দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লেন পুলিশ সুপার।
নামকরা বাণিজ্যিক সংস্থার পদস্থ কর্তার নৃশংস খুন। বস্তাবন্দি অবস্থায় দড়ি-বাঁধা দেহ উদ্ধার। দেহের উপর ব্লাউজ় এবং মহিলাদের ব্যবহার করা রুমাল। এটা তেমন খবর নয়, প্রথম দু’-এক দিন হইচইয়ের পর যা স্বাভাবিক গতিতে চলে যাবে প্রথম পাতা থেকে ভিতরের পাতায়। প্রাইম টাইম থেকে সরে যাবে চ্যানেলের আর পাঁচটা খবরের ভিড়ে। এই খুনে রহস্য আর জল্পনা হাঁটছে হাত-ধরাধরি করে। সমাধান না হওয়া পর্যন্ত মিডিয়ার অণুবীক্ষণের নীচে থাকবেই পুলিশের প্রতিটি নড়াচড়া, খুনের সম্ভাব্য কারণ নিয়ে হাজার তত্ত্ব উড়তে থাকবে হাওয়ায়।
ঠিক এখানেই চ্যালেঞ্জ বর্তমান প্রজন্মের তদন্তকারীদের। মিডিয়ার গোয়েন্দাগিরি সামলে নিজেদের গোয়েন্দাগিরি চালিয়ে যাওয়া। শুধু তদন্ত করা এবং কেসের সমাধানই যথেষ্ট নয়। কী লাইনে তদন্ত এগোচ্ছে, তার আঁচ যাতে মিডিয়া না পায়, কাগজে পড়ে বা চ্যানেলে দেখে যাতে সাবধান না হয়ে যায় সম্ভাব্য অপরাধীরা, সেটাও নিশ্চিত করা। কাজটা যে আজকের যুগে কী প্রাণান্তকর কঠিন, সেটা তদন্তকারী অফিসার মাত্রেই জানেন।
সোমবারে তৈরি ‘করণীয়’-র তালিকার কতটা কী এগোল, খতিয়ে দেখতে ‘কোর টিম’-এর সঙ্গে মঙ্গলবার সান্ধ্য-মিটিংয়ে বসলেন এসপি।
রাকেশের সিডিআর বলছে, মোবাইল বন্ধ করেছিলেন তিনটে সতেরো মিনিটে। তখন টাওয়ার লোকেশন ছিল বিমানবন্দর থেকে কয়েক কিলোমিটার উত্তরে মাইকেলনগরের কাছে। স্ত্রী-কে ফোন করেছিলেন দুটো দশে, বলেছিলেন, ফিরতে দেরি হবে। তার ঘণ্টাখানেক পর থেকে ফোন বন্ধ। নিজেই সুইচ অফ করেছিলেন? না কি অন্য কেউ বাধ্য করেছিল? আগে থেকে কারও সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল? জিজ্ঞাসাচিহ্ন একাধিক। উত্তর এখনও অধরা।
রাকেশের গত এক মাসের কল ডিটেলস থেকে এমন কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না, যা তদন্তে নির্দিষ্ট দিশা দেখাতে পারে। বন্ধুবান্ধব যাঁদের সঙ্গে কথা বলতেন, তাঁদের অধিকাংশেরই ‘ব্যাকগ্রাউন্ড চেক’ হয়ে গেছে প্রাথমিক। দেখা হয়েছে সবার রবি-সোমের টাওয়ার লোকেশন। সন্দেহ করার মতো কিছু? নাহ! রাকেশের শনি-রবির ফোন-তালিকা দেখা হয়েছে বিশেষ মনোযোগে। কিন্তু সবই রুটিন ফোন, অফিস-বাড়ি-বন্ধু। এসএমএস-ও রুটিনের পর্যায়েই।
বন্ধুদের মধ্যে বিশেষ ঘনিষ্ঠ দু’জনের নাম পাওয়া যাচ্ছে, যাঁদের সঙ্গে প্রায় রোজই ফোন বা মেসেজ-চালাচালি হত রাকেশের। অরুণ কাটিয়াল আর সঞ্জীব সুরেকা। অরুণ থাকেন লেকটাউনে, সঞ্জীব দমদমে। দু’জনেই রাকেশের বহুদিনের বন্ধু সেই কলেজজীবন থেকে। দু’জনেই দেহ উদ্ধারের খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলেন থানায়। ছিলেন শেষকৃত্য পর্যন্ত। অরুণ-সঞ্জীব দু’জনেরই সুখী দাম্পত্য জীবন। পারিবারিক কোনও জটিলতার আভাস মেলেনি এখনও পর্যন্ত। খোঁজখবর অব্যাহত আছে।
সঞ্জীবের থেকে মাসখানেক আগে রাজারহাট এলাকায় একটা ফ্ল্যাট বুক করার জন্য আড়াই লক্ষ টাকা ধার করেছিলেন রাকেশ। ওই অ্যাডভান্স বুকিং গত মাসে বাতিল করে টাকা তুলে নিয়েছিলেন। তবে সঞ্জীবকে এখনও ধারের টাকা ফেরত দেননি। অনেকদিনের বন্ধু, রাকেশকে তাগাদাও দেননি সঞ্জীব। রাকেশ বন্ধুকে বলেছিলেন, ফ্ল্যাট নয়, ভাল জমির খোঁজে আছেন। জমি-বাড়ি সংক্রান্ত কোনও ঝামেলায় ফেঁসে গেছিলেন কি না, জানা যায়নি এখনও। আরও খোঁজ নেওয়া দরকার। রাকেশ আর্থিকভাবে মোটামুটি সচ্ছলই ছিলেন। মাসে মাইনে পেতেন পঁয়ষট্টি হাজারের কাছাকাছি। ধার-টার যদি কিছু থেকেও থাকে, সেটা শোধ করাটা গুরুতর সমস্যা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কম।
অফিসে কোনও ঝামেলা? যতটুকু খোঁজখবর করা গেছে আপাতত, সেখানেও কোনও ‘লিড’ নেই। এই কোম্পানিতে যোগ দিয়েছিলেন বছরখানেক হল। অমায়িক ব্যবহারের জন্য জনপ্রিয় ছিলেন সহকর্মীদের মধ্যে। পরিশ্রমী এবং দক্ষ আধিকারিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন কোম্পানিতে।