প্রাথমিক তথ্য বলতে? ১০ ফেব্রুয়ারি রবিবার ছিল। অফিস যাওয়ার কোনও ব্যাপার ছিল না রাকেশের। দুপুর সোয়া একটা নাগাদ ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়েছিলেন মা-কে এয়ারপোর্টে ছেড়ে আসতে। মা সপ্তাহখানেকের জন্য হায়দরাবাদ যাচ্ছিলেন মেয়ের কাছে। দুপুর দুটোর একটু পরে স্ত্রী-র মোবাইলে ফোন করে রাকেশ জানান, ‘আমার কিছু কাজ আছে। ফিরতে একটু দেরি হবে।’
আর বাড়ি ফেরেননি রাকেশ। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে, সন্ধে গড়িয়ে রাত আটটা বেজে যাওয়ার পর উদ্বিগ্ন কবিতা ফোন করেছিলেন রাকেশকে। ফোন ‘সুইচড অফ’ ছিল। কবিতা আতঙ্কিত হয়ে যোগাযোগ করেছিলেন আত্মীয়দের সঙ্গে, রাকেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে। রাকেশের দুই খুড়তুতো ভাই বাগুইআটি ফাঁড়িতে রাতেই ‘মিসিং ডায়েরি’ করেছিলেন। যে ‘মিসিং ডায়েরি’ মূল্যহীন হয়ে যায় পরের দিন মুড়াগাছায় রাকেশের দেহ উদ্ধারের পর। প্রাসঙ্গিক তথ্য পাওয়া গেল আরও কিছু। রাকেশ ডানহাতে ঘড়ি পরতেন। গলায় থাকত রুপোর চেন। ডানহাতে আংটি পরতেন দুটো। চোখে চশমা উঠেছিল কলেজে পড়ার সময়েই। অথচ উদ্ধার হওয়া দেহে
বারাসতের অফিসে ফিরে পুলিশ সুপার এই মামলার তদন্তে গঠন করলেন একটা ‘কোর টিম’। যাতে থাকলেন এই কেসের তদন্তকারী অফিসার সাব-ইনস্পেকটর রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, ঘোলা থানার অ্যাডিশনাল ওসি সমীর ভট্টাচার্য, ওসি তপনকুমার বিশ্বাস, নিউ ব্যারাকপুর ফাঁড়ির সাব-ইনস্পেকটর সুবীর চক্রবর্তী, জগদ্দল থানার ওসি সুবীর চ্যাটার্জি এবং জেলার বাছাই করা চারজন সাব-ইনস্পেকটর, ‘ক্রাইম ওয়ার্ক’-এ যাঁদের দক্ষতা প্রশ্নাতীত। ঠিক হল, এই টিমের কাজকর্মের তদারকিতে থাকবেন অ্যাডিশনাল এসপি, ব্যারাকপুর। যাঁকে সাহায্য করবেন এসডিপিও ব্যারাকপুর আর এসডিপিও বেলঘরিয়া। সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে পুলিশ সুপার স্বয়ং, যিনি প্রতি সন্ধেয় বসবেন টিমের সঙ্গে। দৈনিক সান্ধ্য-বৈঠকে কাটাছেঁড়া করা হবে তদন্তের অগ্রগতি।
কীভাবে এগোনো হবে, সেটা ছকে নেওয়া হল। তৈরি হল আশু করণীয়ের তালিকা। কে কোনটা করবে, ভাগ করে দেওয়া হল দায়িত্ব।
এক, রাকেশের মোবাইলের সিডিআর (কল ডিটেলস রেকর্ড) অবিলম্বে জোগাড় করা। এবং অন্তত গত এক মাসের রেকর্ড চেক করা। দিন ধরে ধরে। অফিস এবং বাড়ির লোকজন ছাড়া বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে কাদের সঙ্গে তুলনায় বেশি যোগাযোগ ছিল, জানতে হবে। তৈরি করতে হবে ‘ফ্রিকোয়েন্ট কলার্স’-দের লিস্ট। ঘটনার দিন এয়ারপোর্টে মা-কে ছেড়ে বেরনোর পর স্ত্রী-কে ফোন করেছিলেন। সেই ফোনের কতক্ষণ পর থেকে মোবাইল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল? বন্ধ হওয়ার মুহূর্তের ‘টাওয়ার লোকেশন’? পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী খুনটা হয়েছে রবিবার দুপুর থেকে বিকেলের মধ্যে। প্রকাশ্যে কেউ দিনের বেলায় খুন করে না এভাবে। খুনটা নিশ্চিতভাবে কোনও ঘরের মধ্যে হয়েছে এবং রাতের অন্ধকারে বডি পাচার করা হয়েছে খুনের জায়গা থেকে মুড়াগাছায়। কোন এলাকায় খুন? টাওয়ার লোকেশন থেকে একটা আভাস অন্তত পাওয়া যেতে পারে।
দুই, রাকেশের পেশাগত জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য চাই। একেবারে খুঁটিনাটি পর্যায়ে। অফিসে ওঁর ঊর্ধ্বতন, অধস্তন… সবার সঙ্গে কথা বলতে হবে। জানতে হবে, কোনও গোলমাল চলছিল কিনা অফিসে? কোনও পেশাগত চাপে ছিলেন? থাকলে কী বা কেমন সেই চাপ? অফিসে কোনও সহকর্মিণীর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক ছিল? এমন ঘনিষ্ঠতা কোনও, যা নিয়ে অফিসে গসিপ, আড়ালে-আবডালে আলোচনা?
তিন, তথ্য চাই ব্যক্তি রাকেশ সম্পর্কেও। এত জিনিস থাকতে মৃতদেহের উপর লাল ব্লাউজ় কেন? লেডিজ় রুমাল কেন? কোনও মহিলাঘটিত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছিলেন রাকেশ? যা কারও বা কাদের তুমুল ক্রোধ বা ঈর্ষার কারণ হয়েছিল? সেই থেকে খুন? পাড়াপ্রতিবেশী আর বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কথা বলে রাকেশের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে যতটা সম্ভব খবর নিতে হবে। কোনও তথ্যই ফেলে দেওয়ার নয়, তদন্তের এই গোড়ার শর্তটা মাথায় রেখে।
চার, এত জায়গা থাকতে মুড়াগাছার পুকুরপাড়ে বডি ফেলে আসা কেন? জায়গাটা আগে থেকে ঠিক করা ছিল? সম্ভবত তাই। এবং যদি তা-ই হয়, তা হলে স্থানীয় দুষ্কৃতীদের এক বা একাধিকের জড়িত থাকার সম্ভাবনা প্রবল। যার বা যাদের এলাকার ভূগোল সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ছিল। সুতরাং ঘোলা-খড়দা-টিটাগড়-ব্যারাকপুর—স্থানীয় সমস্ত দাগি দুষ্কৃতীর গত আটচল্লিশ ঘণ্টার গতিবধি সম্পর্কে খবর চাই। এমন পুরনো পাপী কেউ আছে, যাকে এলাকায় দেখা যাচ্ছে না গতকাল থেকে? যার যেখানে যা সোর্স রয়েছে, পত্রপাঠ মাঠে নামাতে হবে।
পাঁচ, যথাসম্ভব দ্রুত ‘ডিটেকশন’ চাই। বারো ঘণ্টাও হয়নি বডি উদ্ধার হয়েছে, এর মধ্যেই মার্ডারটা নিয়ে হইচই শুরু হয়েছে। সেটা যে আরও বাড়বে তাড়াতাড়ি কিনারা না হলে, সেটা আন্দাজ করার জন্য কোনও পুরস্কার নেই।
হইচই যে এর মধ্যেই বেড়েছে অনেকটাই, সেটা এসপি টের পেলেন রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ ফের বাগুইআটি গিয়ে। যখন ঢুকছেন, বিভিন্ন নিউজ় চ্যানেলের একডজন ‘বুম’ নিমেষে ধেয়ে এল মুখের দিকে। পাশ কাটিয়ে ঢুকলেন কোনওমতে। ফ্ল্যাটে তখনও লোকভরতি। ময়নাতদন্ত-পর্ব চুকতে দুপুর গড়িয়ে গেছে। শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে সন্ধেয়। রাকেশের মা এবং বোন পরেরদিন সকালেই ফ্লাইট ধরে হায়দরাবাদ থেকে ফিরে আসছেন কলকাতায়।