ঘোলা থানার ডিউটি অফিসারকে সোয়া ছ’টা নাগাদ যিনি ফোনটা করেছিলেন, তিনি উদ্বিগ্ন গলায় শুধু এটুকু বলেছিলেন, ‘মুড়াগাছা থেকে বলছি। এখানে পুকুরপাড়ে একটা বড় বস্তা পড়ে আছে। নাইলনের দড়ি দিয়ে বাঁধা। মনে হচ্ছে বস্তায় মুড়ে কেউ কিছু ফেলে রেখে গেছে। রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে বস্তাটা থেকে। থানা থেকে কেউ এলে ভাল হয়। এখানে লোক জমে গেছে।’
লোক যে সত্যিই জমেছে বিস্তর, মুড়াগাছায় গিয়ে টের পেলেন ঘোলা থানার অফিসাররা। থানা থেকে বেশি দূরে নয় মুড়াগাছা। কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেই। হঠাৎ চাঞ্চল্যকর কিছু ঘটার আভাসে-ইঙ্গিতে যেমন হয় আধা-শহর আধা-গ্রামীণ এলাকায়, পুকুরের ধারে ভিড়-জমানো কৌতূহলী মুখগুলোয় চাপা উত্তেজনা। পুলিশ এসেছে, পুলিশ এসেছে! কী আছে ওই বস্তায়, জানা যাবে এবার।
জানার পর উত্তেজনা বদলে গেল আতঙ্কে। বস্তা থেকে বেরল হাফহাতা গোলাপি রঙের শার্ট আর কালো ট্রাউজ়ার পরিহিত এক পুরুষের লাশ। দেখে মনে হয়, বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। সর্বাঙ্গ নাইলনের দড়ি দিয়ে বাঁধা। গলাতেও দড়ির প্যাঁচ। ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে চোখ। শ্বাসরোধ করে খুন। মুখটা থেঁতলে গেছে ভোঁতা কিছুর আঘাতে। পোশাকের অনেকটা লাল হয়ে গেছে রক্তে। বুকের উপর পড়ে আছে লাল রঙের একটা ব্লাউজ়। আর একটা রুমাল। ছোট, ত্রিকোণ। মহিলারা সাধারণত যেমন ব্যবহার করেন।
খুনটা যে এই পুকুরপাড়ে হয়নি, হয়েছে অন্য কোথাও, এবং খুনি বা খুনিরা বডিটা বস্তাবন্দি করে এখানে ফেলে গেছে, সেটা বুঝতে গোয়েন্দা হওয়ার দরকার হয় না। কে বা কারা করেছে, খুনটা আদতে হয়েছে কবে-কোথায়-কখন, মৃতের পরিচয়ই বা কী, সেসব পরে ভাবার। প্রাথমিক কাজগুলো আগে সারল ঘোলা থানার পুলিশ। দেহের ছবি তোলা, বডি তুলে থানায় নিয়ে গিয়ে পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়া এবং ঘটনাটা থানার বড়বাবুকে জানানো।
মৃত অজ্ঞাতপরিচয় থাকলেন না বেশিক্ষণ। হাতে ঘড়ি বা আংটি ছিল না। হয় পরেননি, নয় যে বা যারা খুনটা করেছে, সে বা তারা খুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু ট্রাউজ়ারের পিছনের পকেটে রাখা মানিব্যাগটা নিয়ে যায়নি। টাকাপয়সা ছিল না ওতে, বা থাকলেও নিয়ে গেছে খুনি বা খুনিরা। ব্যাগে শুধু পড়ে ছিল ভিজিটিং কার্ডটা। যা জানিয়ে দিল নিহতের পরিচয়।
.
রাকেশ গুপ্তা, কোম্পানি সেক্রেটারি। নিউটাউনের এক নামি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। মোবাইল নম্বর আর মেইল আইডি দেওয়া আছে কার্ডে। দ্রুত যোগাযোগ করা হল ওই কোম্পানির অফিসে। পাওয়া গেল বাড়ির ঠিকানা। ল্যান্ডলাইন নম্বর।
বাগুইআটির ভিআইপি এনক্লেভ-এর বাসিন্দা ছিলেন রাকেশ। ভিআইপি রোড ধরে এয়ারপোর্টের দিকে যেতে রাস্তার উপরেই পুরনো এবং পরিচিত আবাসন। খবর দেওয়া হল বাড়িতে। ঘোলা থানায় ছুটে এলেন রাকেশের আত্মীয়-বন্ধুরা। এলেন অফিসের সহকর্মীরাও। দেহ শনাক্ত হল। দায়ের হল খুন এবং প্রমাণ লোপাটের মামলা। ঘোলা থানা। কেস নম্বর ২০, তারিখ ১১/২/২০০৮। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২/২০১ ধারায়।
খবর পাওয়ামাত্র ওসি আর অ্যাডিশনাল ওসি তো বটেই, ঘটনার গুরুত্ব বুঝে থানায় চলে এসেছিলেন এসডিপিও বেলঘরিয়া, অ্যাডিশনাল এসপি, ব্যারাকপুর এবং উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার স্বয়ং। খুঁটিয়ে দেখেছিলেন বডি।
পোস্টমর্টেমে দ্রুত পাঠানো হয়েছিল দেহ। মৃত্যুর কারণ হিসেবে ডাক্তার কী লিখবেন, জানাই ছিল। ‘Death due to asphyxia caused by ligature strangulation…।’ যেটা জানা ঢের বেশি জরুরি ছিল, সেটা খুনের সম্ভাব্য সময়। ডাক্তার বললেন, রাকেশের মৃত্যু ঘটেছে দেহ আবিষ্কারের অন্তত চোদ্দো-পনেরো ঘণ্টা আগে। অর্থাৎ, খুনটা সম্ভবত হয়েছে আগের দিন, মানে ১০ ফেব্রুয়ারির দুপুর থেকে সন্ধের মধ্যে।
সাধারণ বুদ্ধিতে এটা বোঝাই যাচ্ছিল, এই খুনে এক নয়, একাধিকের যুক্ত থাকার সম্ভাবনা নিরানব্বই শতাংশ। বছর চল্লিশের রাকেশ যথেষ্ট স্বাস্থ্যবান ছিলেন। তাঁকে এভাবে মেরে দড়ি দিয়ে বেঁধে বস্তাবন্দি করে ফেলে আসা সম্ভব কোনও একজনের পক্ষে? তর্কের খাতিরে না হয় ধরে নেওয়া গেল, খুনটা একজনই করেছে। এবং সে যথেষ্ট শক্তিশালী। তা হলেও খুনের পরে লাশ সরিয়ে ফেলার বন্দোবস্ত করতে আরও এক বা একাধিকের সাহায্য লেগেছিল নিশ্চিত।
পুলিশ সুপার যখন সহকর্মী অফিসারদের নিয়ে পৌঁছলেন বাগুইআটির ভিআইপি এনক্লেভে, বেলা প্রায় সাড়ে দশটা। টিভি মারফত খবরটা জানাজানি হয়ে গেছে ততক্ষণে। আবাসিকরা ভিড় জমিয়েছেন রাকেশের একতলার ফ্ল্যাটের সামনে। গেটের বাইরে কৌতূহলী জটলা দানা বাঁধছে ক্রমশ। প্রেসের গাড়ি এসে থামছে একে একে।
ছিমছাম টু-বেডরুম ফ্ল্যাট। সচ্ছলতার যতটা ছাপ আছে ঘরে, বৈভবের ততটা নয়। রাকেশ গুপ্তা এই ফ্ল্যাটে থাকতেন সাত বছর হল। স্ত্রী কবিতা এবং আট বছরের মেয়ে দিয়াকে নিয়ে। কবিতা এখন সন্তানসম্ভবা। দ্বিতীয় সন্তানের সম্ভাব্য জন্মক্ষণ মাস তিনেকের মধ্যেই। রাকেশের বাবা বেঁচে নেই। মা আছেন। এই আবাসনেই পাশের ব্লকের একটা ফ্ল্যাটে থাকেন। রাকেশরা দুই ভাই-বোন। বোন দীপিকার বিয়ে হয়েছে হায়দরাবাদে।
ফ্ল্যাটটা দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে নেহাতই মাঝারি সাইজ়ের। তার মধ্যেই পাড়াপ্রতিবেশী-আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবদের থিকথিকে ভিড়। যে ভিড়টা পুলিশ ঢুকতেই রাতারাতি আরও বেড়ে গেল কিছুটা। ওই ভিড়ভাট্টা আর কান্নাকাটির মধ্যে রাকেশের স্ত্রী-র সঙ্গে আলাদা কথা বলার সুযোগই ছিল না। তা ছাড়া স্বামীর এভাবে খুন হওয়ার খবর পেয়েছেন সবে কয়েক ঘণ্টা হল। এখন পুলিশি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো মানসিক অবস্থায় থাকবেন, আশা করাটাই অমানবিক। এসপি ঠিক করলেন, শেষকৃত্য হয়ে যাওয়ার পর রাতের দিকে এসে কথা বলবেন। প্রাথমিক তথ্যগুলো বরং জেনে নেওয়া যাক আত্মীয়দের থেকে।