পৈতে করে দিয়েছিল।
২. হাতে মাত্র ৯৬ ঘণ্টা
—একটা জিনিস বোঝো। এটা পার্সোনাল ইগোর ব্যাপার নয়। আমি জানি, তোমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছ। কিন্তু এটাও তো বুঝতে হবে যে গভর্নমেন্ট কেসটা নিয়ে প্রেশারে আছে। অলমোস্ট সেভেন্টি টু আওয়ার্স হয়ে গেল মার্ডারটার পর। স্টিল ক্লুলেস!
—কিন্তু স্যার…উই আর ট্রাইং আওয়ার বেস্ট…
—বললাম তো…আই নো দ্যাট, বাট ইয়োর বেস্ট মে নট অলওয়েজ় বি গুড এনাফ। যা বলছি শোনো। আমাকে এটা নিয়ে কথা শুনতে হচ্ছে। খুব বেশি অপেক্ষা করা যাবে না আর। তুমি পরিষ্কার করে বলো আর কতদিন লাগতে পারে?
—এধরনের কেসে তো ওইভাবে টাইমলাইন বলা মুশকিল স্যার।
—ট্রু… কিন্তু ওই যে বললাম, আর খুব বেশি সময় দিতে পারব না। ম্যাক্সিমাম চার-পাঁচ দিন… তার মধ্যে হল তো হল… না হলে সিআইডি উইল টেক ওভার।
—রাইট স্যার।
ফোনটা রেখে দেওয়ার পর মেজাজটা তেতো হয়ে যায় এসপি-র। এই ভয়টাই পাচ্ছিলেন গত রাত্রে। মিডিয়া যা হইচই শুরু করেছে, কেসটা সিআইডি-কে না দিয়ে দেয়। সাতসকালে মোবাইলে খোদ ডিজি-র নম্বর ভেসে উঠতেই প্রমাদ গনেছিলেন। এবং যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধে হল। সময় বেঁধে দেওয়া হল। পারলে চার-পাঁচ দিনের মধ্যে সল্ভ করো। না হলে ছেড়ে দাও। সিআইডি দেখবে।
লালবাজারের যেমন ডিডি, অর্থাৎ ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট, পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের তেমন সিআইডি (ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট)। কোনও জটিল কেস যদি দ্রুত সমাধান করতে ব্যর্থ হয় থানা, কলকাতায় সেটা অবধারিত চলে যায় ডিডি-র হাতে। কখনও কখনও ঘটনা ঘটার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। আর রাজ্য পুলিশের এলাকায় হলে একই ভাবে জেলা পুলিশের কেসের তদন্তের দায়িত্ব পড়ে সিআইডি-র উপর। স্বাভাবিক এবং প্রচলিত প্রথা। থানার হাজারটা কাজ থাকে। কেসের তদন্ত তার মধ্যে একটা। কিন্তু ডিডি বা সিআইডি-র মূল কাজই হল ঘোরালো মামলার তদন্ত। ডিজি যেমন বললেন, পার্সোনাল ইগোর ব্যাপার নেই এখানে।
ভুল। কে বলল নেই? ইগোর ব্যাপার আছে। সে কলকাতা পুলিশ হোক বা রাজ্য, একটা সুস্থ প্রতিযোগিতার ব্যাপার থাকেই থানা বনাম ডিডি বা সিআইডি-র। যাদের কাছে কোনও কেস চলে গেলে থানার মনে হয়ই, আমরা পারলাম না, তাই ওদের দিল। সূক্ষ্মভাবে হলেও এই ‘আমরা-ওরা’-টা আছেই।
এসপি-রও ঠিক সেটাই মনে হয় ডিজি-র সঙ্গে মিনিটখানেকের ফোনটা শেষ হওয়ার পর। তিনদিনেও পারিনি যখন, ধরে নেওয়া হচ্ছে, ‘আমরা’ পারব না। ‘ওরা’ পারবে।
সিনেমায় হলে কী হত এসব ক্ষেত্রে? পুলিশ অফিসারকে চব্বিশ বা আটচল্লিশ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেওয়া হত কেসের কিনারার জন্য। এবং ‘কী হইতে কী হইয়া’ যেত, অলৌকিক দক্ষতায় নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যেই ঠিক ধরে ফেলত পুলিশ।
এটা সিনেমা নয়। এসপি ভাবতে থাকেন, হাতে চার-পাঁচ দিন মাত্র সময়। তার মধ্যে হবে আদৌ? সবে তিনদিন হয়েছে। হ্যাঁ, বলার মতো কোনও ‘লিড’ নেই এখনও। কিন্তু মরিয়া চেষ্টা চলছে দিনরাত। ডিজি সাহেব ঠান্ডা মাথার মানুষ। কিন্তু আজ ফোনে যথেষ্ট অধৈর্য শোনাচ্ছিল। ওঁর দিক থেকেও ভাবার চেষ্টা করেন পুলিশ সুপার। এই দু’দিনেই যা লেখালেখি আর প্রচার হচ্ছে কেসটা নিয়ে, রাজ্যের পুলিশপ্রধান হিসেবে নিশ্চয়ই প্রবল চাপে আছেন। সিআইডি-কে কেসটা দিলেই যে কোনও জাদুদণ্ডে দু’দিনের মধ্যে কিনারা হয়ে যাবে মামলার, এমনটা ডিজি-ও নিশ্চয়ই আশা করেন না। কিন্তু সিআইডি-র মতো ‘স্পেশ্যালাইজ়ড ইনভেস্টিগেটিং ইউনিট’-কে দায়িত্ব দিলে চাপমুক্তি হয় সাময়িক। সরকার কতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখছে ঘটনাটা, সেটা প্রমাণিত হয়। জনসমক্ষে বার্তা যায় একটা।
ডিজি বললেন, চার-পাঁচ দিন। অঙ্কের হিসেবে কত? ৯৬ থেকে ১২০ ঘণ্টা। বেশ। তা-ই সই। আরেকবার মিস্টার গুপ্তার বাড়ি যাওয়া দরকার। আজই। এবং এখনই। বলে রাখা দরকার ওসি আর এসডিপিও (সাব-ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার)-কে। ডিস্ট্রিক্ট কন্ট্রোল রুমের নম্বর ডায়াল করেন পুলিশ সুপার, ‘এসপি বলছি…।’
বারাসতের এসপি বাংলো থেকে গাড়ি রওনা দিল সকাল সাড়ে আটটায়। গন্তব্য, বাগুইআটি। গাড়ি যখন মধ্যমগ্রাম পেরচ্ছে, পুলিশ সুপার ফ্ল্যাশব্যাকে সাজিয়ে নেন ঘটনাক্রম। গত দু’দিন ধরে কেসটা নিজে মনিটর করছেন। মাথায় গেঁথে আছে সব। কিন্তু তাতে আর লাভ কী হল? ডিজি-র কথাটা কানে বেজেই চলেছে, ‘সিআইডি উইল টেক ওভার।’
.
১১ ফেব্রুয়ারির সাতসকালে ঘোলা থানায় ফোনে খবরটা এসেছিল। উত্তর ২৪ পরগনার বেলঘরিয়া মহকুমার এই থানাটা খুব বেশিদিন হল তৈরি হয়নি। কয়েক বছর আগে খড়দা থানা ভেঙে এই ঘোলা থানার পত্তন।
কারণও ছিল নতুন থানা তৈরির। আয়তনের নিরিখে একটা বিশাল এলাকা ছিল খড়দা থানার অন্তর্গত। বিটি রোডের দু’ধারের ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকা তো ছিলই। সঙ্গে ছিল সোদপুর-পানিহাটি মোড় থেকে পূর্বদিকে চলে যাওয়া রাস্তাটাও। ঘোলা হয়ে বারাসতমুখী যে রাস্তার সংলগ্ন ছিল বিলকান্দা-তালবান্দা-নিউ ব্যারাকপুরের বিস্তৃত অঞ্চল। যেখানে বেআইনি মদের ভাটির রমরমা, মস্তানদের দাপাদাপি, খুনজখম-মারামারি ব্যস্তসমস্ত রাখত খড়দা থানাকে। মূলত আইনশৃঙ্খলাজনিত সুবিধার্থেই খড়দাকে দ্বিখণ্ডিত করে ঘোলাকে দেওয়া হয়েছিল নতুন থানার মর্যাদা।