দ্রুত খবর ছড়াল, ‘সল্টলেকে সিনেমা দেখতে এসে সিআইডি-র জালে হুগলির ত্রাস হুব্বা শ্যামল।’ পরের দিন সব কাগজে প্রথম পাতায় জায়গা পেল ‘অপারেশন হুব্বা’। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর কলকাতা সংস্করণে শ্যামল-গ্রেফতারের খবরের হেডিংটা তুলে দেওয়ার লোভ সামলানো কঠিন, ‘ ‘‘Dawood Ibrahim of Hooghly’’ arrested by CID’.
পুরনো মামলা অনেক ঝুলছিল শ্যামলের নামে। তবু এক বছরের বেশি দীর্ঘস্থায়ী হল না শ্যামলের কারাবাস। জামিনে বেরিয়ে গেল। কী করে? বেশিরভাগই ছিল খুনের মামলা। কোনও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ছিল না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। আর থাকলেও কারও ঘাড়ে মাথা ছিল না শ্যামলের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে মুখ খোলার। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে কিছু সাক্ষী তবু জোগাড় করা গিয়েছিল কয়েকটা মামলায়। চার্জশিট দেওয়া হয়েছিল শ্যামলকে ‘ফেরার’ দেখিয়ে। কিন্তু বিচারপর্ব যখন শুরু হল, সাক্ষীরা ‘hostile’ হয়ে গেল। পুলিশের কাছে দেওয়া আগের বয়ান অস্বীকার করল (আইনি পরিভাষায় বিরূপ সাক্ষ্যদান)। কেন করল, অনুমেয় অনায়াসে। ‘হুব্বা শ্যামল’— এই পাঁচ অক্ষরের রোষে পড়ার ভয়ে। কে আর সাধ করে হাঁড়িকাঠে মাথা দিতে চায়? শ্যামল না হয় ধরা পড়েছে। কিন্তু গ্যাংয়ের বাকিরা তো বাইরে আছে। কেউ ‘দাদা’-র বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার সাহস দেখিয়েছে জানলে ছেড়ে দেবে তারা?
কোনও মামলায় ‘বিরূপ সাক্ষ্য, কোনওটায় সাক্ষীরই অভাব, আবার কোনওটায় ‘শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া’ (Test Identification Parade)-য় অভিযুক্তকে চিনতে সাক্ষীর অস্বীকার করা। দোষী সাব্যস্ত করা দুরূহ হচ্ছিল ক্রমশ। নামীদামি আইনজীবীদের পিছনে শ্যামল টাকাও খরচ করছিল দেদার। পুলিশের ব্যর্থতাই, আটকে রাখা গেল না বেশিদিন। জামিনে মুক্ত হয়ে ফের হুগলির মাটিতে পা রাখল শ্যামল। টিমের ছেলেদের বলল, ‘ভালই হল। একেবারে ফ্রেশ হয়ে এলাম। এবার বাওয়াল কম, ব্যবসা বেশি।’
কী বেশি, কী কম, সেটা পরের ব্যাপার। তারও আগে শ্যামল আবিষ্কার করল, জেলে থাকার এই এক বছরে ব্যবসার অঙ্ক বদলে গেছে অনেক। শ্যামলের অনুপস্থিতির সুযোগে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই নিজের দখলে নিয়ে ফেলেছে রমেশ। শ্যামল লক্ষ করছিল, বছরখানেক আগেও টিমের যারা ‘শ্যামলদা’ অন্ত প্রাণ ছিল, তাদের অনেকেই জার্সিবদল করেছে। যাদের কাছে এখন রমেশই শেষ কথা।
গ্যাং ভাগ হয়ে যায়নি। শ্যামল-রমেশ কাজ করছিল একসঙ্গেই। কিন্তু কোথাও একটা তাল কেটে গিয়েছিল। ২০০৭-১০, এই সময়টায় সম্পর্কের ফাটল নানা মতবিরোধে ক্রমশ আরও চওড়া হয়েছিল। আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদটাই যা হয়নি। তবে মনকষাকষি যতই হোক, শ্যামলের একটা ন্যূনতম বিশ্বাসের জায়গা অটুট ছিল রমেশের প্রতি। বলত, ‘এখনও যদি বলি, এই প্রজেক্টটায় হাত দেওয়া ঠিক হবে না, রমেশ মেনে নেবে। অমত থাকলেও মেনে নেবে। মুখের উপর না বলার হিম্মত হবে না।’
এই ‘বিশ্বাস’-টাই কাল হয়েছিল শ্যামলের। সময়টা ২০১১-র জুন। শ্রীরামপুরের কাছে একটা জমি দেখতে গিয়েছিল শ্যামল-রমেশ। জমি জরিপের পর্ব মিটে যাওয়ার পর রমেশ বলেছিল শ্যামলকে, ‘দুপুরের খাওয়াটা আমার ওখানে খেয়ে যা।’ রিষড়ার দাসপাড়ায় রমেশের ফ্ল্যাট ছিল একটা। রমেশেরই গাড়িতে চড়ে দু’জনে রওনা দেয় দাসপাড়ায়। শ্যামলের সঙ্গীরা বলেছিল, ‘দাদা, আমরাও যাই সঙ্গে?’
নিজের বিপদ-আপদ সম্পর্কে সদাসতর্ক থাকা শ্যামল সেদিন আত্মঘাতী আত্মবিশ্বাস দেখিয়ে ফেলেছিল। বারণ করেছিল সঙ্গীদের, ‘ধুর, যাচ্ছি তো রমেশের বাড়িতে। তোরা চলে যা। কী আর হবে? ম্যাক্সিমাম মেরে দেবে।’ তারপর বহু বছরের সুখ-দুঃখের সঙ্গী রমেশের দিকে তাকিয়ে চোখ মেরেছিল। ইয়ারকির ঢংয়ে বলেছিল, ‘কী রে রমেশ, মেরে দিবি নাকি একা পেয়ে?’ উত্তরে রমেশও হেসে উঠেছিল হো হো করে। বলেছিল, ‘হ্যাঁ, ম্যাক্সিমাম মেরে দেব। কী আর হবে?’
কী যে হবে, সেটার আঁচ রমেশের ফ্ল্যাটে পা রাখা মাত্রই পেয়েছিল শ্যামল। একসময়ের বিশ্বস্ততম সঙ্গীরা হাতে ছুরি-পিস্তল নিয়ে বসে। নেপু, জিতেন্দর, চিকুয়া… আরও কয়েকজন। শ্যামল ঢুকতেই যারা নিমেষের মধ্যে ঘিরে নিয়েছিল। কোমরে যে নাইন এমএম-টা গোঁজা থাকত সবসময়, সেটা ছোঁয়ারই সুযোগ পায়নি শ্যামল। রমেশ বলেছিল, ‘দ্যাখ শ্যামল, যে ভাবে চলছে, একসঙ্গে ব্যবসা চালানো আর সম্ভব নয়। আলাদা হয়ে গেলে হয় তুই আমাকে ফুটিয়ে দিবি, নয়তো আমি তোকে খালাস করে দেব। তাই ভাবলাম…।’ বাক্যটা শেষ করেনি রমেশ। ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে পাঁচটা শব্দ খরচ করেছিল নেপুর উদ্দেশে, ‘আমি বেরলাম… তোরা দেখে নে।’
নির্দেশ পালন করেছিল নেপু-জিতেন্দররা। ‘দেখে নিয়েছিল’, যা দেখার। তিনদিন নিখোঁজ থাকার পর বৈদ্যবাটি খালে ভেসে উঠেছিল হুব্বা শ্যামলের দেহ।
শ্যামলের যদি বিচার হত আদালতে, দোষী সাব্যস্ত হলে কী হতে পারত সম্ভাব্য পরিণতি? যাবজ্জীবন কারাবাস বা ফাঁসি। টাকার তো অভাব ছিল না। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করতই। উচ্চ থেকে উচ্চতর কোর্ট অবধি গড়াত মামলা। গড়িয়ে যেত বছরের পর বছর।
সব অন্যায়ের শাস্তিবিধান বাস্তবের আদালতে নির্ধারিত হয় না। কিছু অপরাধের, কিছু অপরাধীর বিচার হয় হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট পেরিয়ে ‘সর্বোচ্চ’ আদালতে। কর্মফলের হিসেবনিকেশ সুদে-আসলে মিটিয়ে দেওয়া হয় সেখানে। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ডিভাইন জাস্টিস’। হুব্বা শ্যামলের মৃত্যু যেমন। বৈদ্যবাটি খাল থেকে দেহ উদ্ধার হয়েছিল, লিখেছি। কী অবস্থায় উদ্ধার, বলা হয়নি। বডির কাঁধ থেকে কোমর, আড়াআড়ি চেরা ছিল ধারালো অস্ত্রের টানে।