তিনটে শো শুরু হয়েছে পাঁচটার আশেপাশে। একটা বাংলা ছবি। ঘরোয়া, পারিবারিক। ইংরেজি ছবিও চলছে একটা। পোস্টার দেখে যেটুকু বোঝা যাচ্ছে, সায়েন্স ফিকশন জাতীয়। তিন নম্বর ছবিটা হিন্দি। নাম ‘KALYUG’। পোস্টারের ছবিই বলে দিচ্ছে, নাচগান-মারদাঙ্গা এবং সেক্সের ভরপুর সুড়সুড়ি সংবলিত বলিউডি মশলা ছবি। শ্যামল যদি সিনেমা দেখতে এসেই থাকে, ঘরোয়া পারিবারিক বা কল্পবিজ্ঞানের ছবি দেখে নিশ্চয়ই সময় ‘নষ্ট’ করছে না। দেখলে নির্ঘাত ওই ‘কলিযুগ’-ই দেখছে!
—শো শেষ হবে ক’টায়?
—স্যার, হিন্দি ছবিটার ডিউরেশন দেখলাম দুই ঘণ্টা ছয় মিনিট। শুরু হয়েছে পাঁচটা দশে। অ্যাড-ট্যাড আর ইন্টারভ্যাল মিলিয়ে আরও পনেরো-কুড়ি মিনিট ধরুন। সাড়ে সাতটার আশেপাশে ‘কলিযুগ’-এর শো ভাঙবে। তার একটু আগে ইংরেজি ছবিটা শেষ হবে। আর বাংলাটা শেষ হবে ওই হিন্দিটার কাছাকাছি সময়েই। এখন পৌনে সাতটা। কিছুটা সময় আছে হাতে।
ডিআইজি ছক কষে নেন দ্রুত। যদি আইনক্সেই থাকে, আন-আর্মড অবস্থায় আছে। মাল্টিপ্লেক্সের সিনেমাহলে একটা দেশলাইকাঠিও অ্যালাও হয় না। আর যে ছবিই দেখুক না কেন, দোতলার হল থেকে বেরিয়ে নীচে নামার একটাই সিঁড়ি। ঠিক হল, সিঁড়ির শেষ ধাপের মুখে থাকবেন ডিআইজি স্বয়ং, এসএস সিআইডি, হিমাদ্রি এবং আরও দু’জন অফিসার। আরেকটা টিম থাকবে সিটি সেন্টারের মেন এন্ট্রির ঠিক বাইরে। যারা গাড়িতে অপেক্ষা করবে, ওয়ারলেসে কল পেলে দৌড়ে আসবে, যদি প্রয়োজন হয়। সোয়া সাতটার মধ্যে ‘টেক পোস্ট’, অর্থাৎ প্ল্যানমাফিক নিজের নিজের পজিশন নিয়ে নেওয়া।
শেষ মুহূর্তের ব্রিফিং সেরে নিলেন ডিআইজি, ‘যদি পালানোর চেষ্টা করে, কেউ ফায়ার করবে না। জানি, প্রাইজ ক্যাচ, কিন্তু ফায়ারিং আন্ডার নো সার্কামস্ট্যান্সেস… আই রিপিট… আন্ডার নো সার্কামস্ট্যান্সেস… ভিড়ের মধ্যে পাবলিকের কোনও ইনজুরি হলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে…।’
আর আটচল্লিশ ঘণ্টা পরেই বড়দিন। সান্টা ক্লজের লাল-সাদা কাটআউটে ভরে গেছে সিটি সেন্টার চত্বর। ভিড়ে ভিড়াক্কার শপিং মলে খুশির ফুলকি উড়ছে।
আইনক্সের ইভনিং শো ভেঙেছে। লোকজন নেমে আসছে সিঁড়ি দিয়ে। ওইভাবে সার দিয়ে নেমে আসা এত লোকের মাঝে একটা নির্দিষ্ট লোককে খুঁজে বের করা মুশকিল। মুখগুলোর উপর দ্রুত চোখ বুলোচ্ছিলেন হিমাদ্রি আর ডিআইজি।
মাঝবয়সি, বেঁটে, গাট্টাগোট্টা চেহারার জনাদশেক লোক নেমেছে গত দু’-তিন মিনিটে। যাদের দেখে সন্দেহ করার মতো কিছু পাওয়া যায়নি, যাদের মুখের সঙ্গে ন্যূনতম মিলও নেই শ্যামলের। লোক নেমে আসছে ননস্টপ। নামছে, বেরিয়ে যাচ্ছে। মিশে যাচ্ছে ভিড়ে। একটা অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের গ্রুপ ওই নামছে হইহই করতে করতে। ওদের ঠিক পিছনের ধাপে দাঁড়ানো বেঁটে লোকটার উপর চোখ আটকে যায় হিমাদ্রির। বেঁটে… স্বাস্থ্যবান… কালো ফুলস্লিভ শার্ট…মাথায় টুপি। টুপিটা অনেকটা নামানো বলে মুখটা ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। লোকটার পাশেপাশেই নেমে আসছে লম্বা চেহারার আরেকজন। এর মাথাতেও টুপি।
বেঁটে লোকটা সিঁড়ির শেষ ধাপে প্রায়। সোর্সরা যা বলে শ্যামলের ইদানীংকার চেহারার ব্যাপারে, তার সঙ্গে তো অনেকটাই মিলছে। একটু মোটা। ফোলাফোলা মুখ। কিন্তু সোর্সরা তো এটাও বলে যে শ্যামলের পুরুষ্টু গোঁফ আছে। এর তো গোঁফ নেই। তা হলে?
শিয়োর হওয়া যাচ্ছে না। কী করবেন এখন? সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেন হিমাদ্রি। লোকটা মাটিতে পা রাখামাত্র হিমাদ্রি একটু চেঁচিয়েই বলে ওঠেন, ‘কী শ্যামলদা, ভাল আছেন?’ সঙ্গে সঙ্গে টুপি-পরা বেঁটে লোকটা রিফ্লেক্স অ্যাকশনে মুখ ফেরায়, ‘কে?’ পাশে থাকা ছিপছিপে লোকটাও থমকে যায় হঠাৎ।
ব্যস, ওই ‘কে’-টাই যথেষ্ট ছিল। ডিআইজি সিআইডি নিমেষে হাত চেপে ধরেছেন লোকটার। হিমাদ্রি একটানে মাথা থেকে খুলে নিয়েছেন টুপি। চেহারা পরিষ্কার এবার। গোঁফ থাকুক না থাকুক, এ শ্যামল। প্রায় দেড় দশক ধরে পুলিশকে নাকের জলে-চোখের জলে করে দেওয়া হুব্বা শ্যামল। সঙ্গীটিও অচেনা নয়। বাপি, বেনারসি বাপি। ‘কলিযুগ’ দেখেই বেরচ্ছিল।
ওয়ারলেসে ‘কল’ পেয়ে চটজলদি দৌড়ে এসেছে বাইরে থাকা টিম । ডিআইজি পিস্তল ঠেকিয়ে দিয়েছেন শ্যামলের গলায়। হিমাদ্রিও কোমরে গোঁজা আগ্নেয়াস্ত্র বার করে সোজা তাক করেছেন বাপির দিকে। কলার ধরে টানতে টানতে যখন দু’জনকে বাইরে নিয়ে আসছে সিআইডি-র টিম, আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সিটি সেন্টারে। কী ঘটছে এটা? সিঁড়ি থেকে নামার পর দুটো লোককে ঘিরে ধরল কয়েকজন। তারপর রিভলভার ঠেকিয়ে ঘাড় ধরে বাইরে নিয়ে এসে গাড়িতে তুলছে। চোখের সামনে কিডন্যাপিং? শ্যামল আর তার সঙ্গীকে তুলে দুটো গাড়ি যখন বেরিয়ে যাচ্ছে হুউশ, ততক্ষণে হইচই শুনে ছুটে এসেছেন সিকিউরিটি ম্যানেজার। মোবাইলে ডায়াল করছেন বিধাননগর (দক্ষিণ) থানার নম্বর।
‘কিডন্যাপিং’-এর বার্তা পেয়ে থানার টহলদারি গাড়ি এসে পৌঁছনোর আগেই ডিআইজি ফোন করে জানিয়ে দিলেন উত্তর ২৪ পরগনার এসপি-কে, ‘উই হ্যাভ জাস্ট পিকড আপ হুব্বা শ্যামল ফ্রম সিটি সেন্টার। ওখানে একটু প্যানিক হতে পারে, দেখে নাও তাড়াতাড়ি।’ এসপি সঙ্গে সঙ্গেই ফোনে জানালেন ওসি বিধাননগর (দক্ষিণ)-কে। আতঙ্কের পরিবেশ কাটাতে সিটি সেন্টারের ‘পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেম’ থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘোষণা শুরু হল, ‘অযথা আতঙ্কিত হবেন না। কোনও কিডন্যাপিং এখানে হয়নি। সিআইডি রেইড করে দু’জন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে গেছে।’