বিভ্রান্তি দূর হল সোয়া তিনটে নাগাদ। যখন দ্বিতীয় ফোনের সিমও স্থিতাবস্থা কাটিয়ে বদলাতে শুরু করল পজিশন। এবং দক্ষিণে নয়, টিএল ক্রমে সরতে থাকল দক্ষিণেশ্বর পেরিয়ে বালির দিকে। দ্বিতীয় ফোনে একটা ইনকামিং কল এল। ফোনটা ধরে যে হ্যালো বলল, সে শ্যামল নয়। এ সেই লোক, যে সকালের ফোনে বলেছিল, ‘দাদা এখন ঘুমচ্ছে।’ যিনি ফোন করেছেন, তিনি বললেন, ‘শ্যামলের সঙ্গে কথা ছিল।’ উত্তর এল, ‘দাদা একটু ব্যস্ত এখন। আপনার সঙ্গে পরে কথা বলিয়ে দেব।’ ফোনটা ডিসকানেক্ট হওয়ার মিনিটখানেকের মধ্যেই দ্বিতীয় ফোন থেকে প্রথম ফোনে কল গেল।
—দাদা, ‘পার্টি’-র ফোন ছিল, কথা বলতে চায়।
—পরশু সাইটে আসতে বল বারোটা নাগাদ।
ধন্দের জায়গা নেই আর। শ্যামল প্রথম ফোনটা ব্যবহার করছে। যে ফোনের টিএল জানাচ্ছে, শ্যামলের অবস্থান এখন মধ্যমগ্রামের কাছাকাছি। গত মিনিট পনেরো ধরে স্ট্যাটিক। বাগুইআটিতে থাকা টিমকে অ্যালার্ট করা হল।
মধ্যমগ্রামের কাছাকাছি কোথায় আছে? স্ট্যাটিক আছে কেন পনেরো মিনিট? গাড়িতে তেল ভরছে? কোনও ঠেক আছে ওই এরিয়ায়? নাকি লাঞ্চ করছে কোনও রেস্তোরাঁ বা ধাবায়? ডিআইজি নিজে এসএস সিআইডি-র সঙ্গে ছিলেন এয়ারপোর্টের কাছাকাছি। পিছনের গাড়িতে ছিলেন ইনস্পেকটর হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আরও তিনজন অফিসার।
দুটো গাড়ি এয়ারপোর্ট থেকে মধ্যমগ্রাম অবধি চক্কর দিল পরের আধঘণ্টা। পেট্রল পাম্পগুলো দেখা হল। ঢুঁ মারা হল যশোর রোডের বিখ্যাত ধাবা ‘শের-ই-পাঞ্জাব’-এও। যদি ভাগ্য ভাল হয়, যদি বাই চান্স চোখে পড়ে যায়। পড়ল না চোখে।
গাড়ির নম্বর জানা নেই। কী ধরনের গাড়িতে আছে, জানা নেই। সম্ভাব্য গন্তব্য সম্পর্কে একটা আন্দাজ আছে মাত্র। শুধু ‘টাওয়ার লোকেশন’ ফলো করে শ্যামলের মতো অত্যন্ত ধূর্ত ক্রিমিনালকে ধরা যে প্রায় দুঃসাধ্যের পর্যায়ে পড়ে, বেশ বুঝতে পারছিলেন ডিআইজি এবং তাঁর টিমের সদস্যরা। বাগুইআটির ওই ফ্ল্যাটে যদি আজ সত্যিই যায়, ধরা যাবে নিশ্চিত। কিন্তু যদি না যায়? এভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ফোনের অবস্থান ‘ফলো’ করে করে সম্ভব কখনও?
সোয়া চারটে নাগাদ ফের বদলাতে শুরু করল ফোন-গতিবিধি। মাইকেলনগর পেরিয়ে ঢুকল এয়ারপোর্ট সেক্টরে। এবার কি তা হলে বাগুইআটির ফ্ল্যাট? কিন্তু এটা কী হল? ভিআইপি রোড ধরে উত্তরের দিকে যেতে যেতে ‘টাওয়ার লোকেশন’ হঠাৎই পূর্বমুখী। রাজারহাটের দিকে যাচ্ছে। সোজা ভিআইপি রোড না ধরে রাজারহাটের ভিতর দিয়ে বাগুইআটি যাবে? ডিআইজি-র গাড়িও ঢুকল রাজারহাটের রাস্তায়। হল্ট করল চিনার পার্কের কাছাকাছি।
বাগুইআটির ধারেকাছেও যে আপাতত যাওয়ার পরিকল্পনা নেই শ্যামলের, সেটা পরিষ্কার হয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। ফোন-অবস্থান জানিয়ে দিল, শ্যামল রাজারহাট-নিউটাউনের রাস্তা ধরে যাচ্ছে সল্টলেকের দিকে। এ তো মহা মুশকিল হল। বাগুইআটিতে যাওয়াটা ঝুঁকির হয়ে যাবে আজ, কোনওভাবে আন্দাজ করেছে? দুপুর-বিকেল-সন্ধে-রাত, কোনও না কোনও সময় বাগুইআটিতে আসবে, এই ধারণা নিয়েই ‘অপারেশন’-টা প্ল্যান করা। অথচ সন্ধে হয়ে এল, ওদিকে যাওয়ার কোনও নামগন্ধ নেই।
সিআইডি-র গাড়ি যখন সল্টলেকের দিকে এগোচ্ছে, স্পেশ্যাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট জিজ্ঞেস করেই ফেললেন ডিআইজি-কে, ‘স্যার, এভাবে আর কতক্ষণ? শ্যামল যা সেয়ানা জিনিস, হয়তো কোনও হিন্ট পেয়েছে কোথাও থেকে। তাই বাগুইআটির দিকটা মাড়াচ্ছেই না।’
—আর ঘণ্টাখানেক দেখব। তারপর ব্যাক। ধরো যদি বাগুইআটিতে রাতের দিকে যায়, টিম তো থাকছেই।
সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কের কাছে যখন গাড়ি থামালেন ডিআইজি, তখন ঘড়িতে সোয়া পাঁচটা। শ্যামলের ফোনের টিএল সল্টলেকে স্ট্যাটিক পাঁচটা থেকে। ঠিক পৌনে ছ’টায় একটা ইনকামিং কল এল শ্যামলের মোবাইলে। ফোনটা ধরল শ্যামলই।। ধরেই ‘পরে করিস’ বলে কেটে দিল ফোনটা। ফোনের অন্যদিকে যে-ই থাকুক, সুযোগই পেল না কিছু বলার।
সাড়ে ছ’টা বাজতে চলল। টিএল বদলাচ্ছে না। প্রায় দেড়ঘণ্টা হয়ে গেল সল্টলেকেই থিতু। কোথায় আছে? এখানে কোনও ফ্ল্যাট ভাড়া করেছে, যেমন করে থাকে মাঝেমধ্যে? যে মহিলার সঙ্গে সময় কাটানোর কথা বাগুইআটিতে, তাঁকে কোনওভাবে খবর পাঠিয়েছে সেই ফ্ল্যাটে আসতে? ফোনটা যেরকম অধৈর্যভাবে রেখে দিল, তাতে এটুকু বোঝা যাচ্ছে, যেখানেই থাকুক, যা-ই করুক এখন, কোনও ডিস্টার্বেন্স চাইছে না।
কোথায় থাকতে পারে… কোথায় থাকতে পারে… ভাবতে ভাবতেই আচমকা একটা ‘ব্রেনওয়েভ’ ঝটকা দিল হিমাদ্রিকে। দেড়ঘণ্টা নট নড়নচড়ন, ফোন এলে কেটে দিচ্ছে… ফ্ল্যাট ছাড়া অন্য জায়গাও তো হতে পারে। সিটি সেন্টার তো বেশি দূরে নয়। তা হলে কি…? উত্তেজনা চেপে রাখতে পারেন না হিমাদ্রি, ‘স্যার, লোকেশন স্ট্যাটিক এতক্ষণ, সিনেমা দেখছে না তো?’
ডিআইজি চকিতে তাকান হিমাদ্রির দিকে। মুখ খোলেন কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর, ‘পসিবল, কোয়ায়েট পসিবল। হতেই পারে। আর যদি না-ও হয়, ট্রাই নিতে ক্ষতি নেই। লেটস গিভ ইট আ শট।’
দুটো গাড়ি মিনিট তিনেকের মধ্যে ব্রেক কষল সিটি সেন্টারের ক্রসিং থেকে সামান্য দূরে। হিমাদ্রি এবং আরেকজন অফিসার পায়ে হেঁটে এগোলেন সিটি সেন্টারের দিকে। এবং যা জানার ছিল, জেনে নিয়ে ফিরে এলেন মিনিটদশেকের মধ্যে।