২১ ডিসেম্বরের বিকেলে ‘কল মনিটরিং সেল’ থেকে ফোন এল ডিআইজি-র কাছে।
—স্যার, একটা দেড় মিনিটের কনভার্সেশন হল মিনিটদশেক আগে।
—কী?
—বলছে, কাল বাগুইআটি যাবে। বলল, ‘পাগলি’ ফিট করে রাখিস…
—কখন যাবে বলেছে?
—বলল, সেকেন্ড হাফে।
—এখন টিএল?
—বেলুড়।
—যার সঙ্গে কথা হল, তার সাবস্ক্রাইবার ডিটেলস নিয়েছ?
—ইয়েস স্যার। তন্ময় বলে একজনের নাম দেখাচ্ছে। অ্যাড্রেস গুপ্তিপাড়া।
—নম্বরটা ট্র্যাক করেছ?
—হ্যাঁ স্যার, কনভার্সেশনের সময়ের লোকেশন ব্যান্ডেল। ওই ফোনটার পরেই সুইচড অফ। ট্র্যাক রাখছি স্যার।
—গুপ্তিপাড়ার ঠিকানাটা টেক্সট করো। রাইট নাউ।
গুপ্তিপাড়ার ওই ঠিকানায় যে তন্ময় বলে কেউ থাকে না, সেটা এসপি হুগলি খোঁজখবর নিয়ে ডিআইজি-কে জানিয়ে দিলেন ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই। ভুল নাম দিয়ে, ভুল ঠিকানা দিয়ে সিমটা নেওয়া হয়েছে। ফোন আবার চালু হওয়া অবধি অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই।
দেড় মিনিটের কথা-চালাচালি থেকে কী জানা যাচ্ছে? আগামীকাল বাগুইআটি যেতে পারে। বলছে, সেকেন্ড হাফে যাবে। মানে, বিকেলে, সন্ধে বা রাতে। ‘পাগলি’ ফিট করে রাখতে বলেছে। এটাও অপরাধ দুনিয়ার ভাষা। ‘পাগলি’ অর্থাৎ মহিলা। যা দাঁড়াচ্ছে, কোনও মহিলার সঙ্গে নিভৃতে সময় কাটানোর জন্য কাল বাগুইআটি যেতে পারে। অবশ্য শ্যামলের যা মারাত্মক ধূর্ত স্বভাব, কে বলতে পারে, ‘বাগুইআটি’-ও হয়তো কোডনেম! আসলে হয়তো যাবে অন্য কোথাও। ফোনে ইচ্ছে করে ‘মিসলিড’ করছে। যদি তা-ও হয়, ইনপুট যেখানে কয়েকদিনের মধ্যে একাধিক খুনের, চান্স নিতেই হবে। ধরে নিতে হবে, বাগুইআটিই।
বাছাই করা কিছু সোর্সকে জরুরি তলব করা হল সন্ধেতেই। কথা হল বিস্তারিত। কেষ্টপুর আর বাগুইআটির মাঝামাঝি একটা জায়গায় ঠেকের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। এক প্রোমোটারের বাড়ি। গত বছর একটা সময় শ্যামলের নিয়মিত যাতায়াত ছিল এখানে। ফুর্তিটুর্তি হত রাতবিরেতে। বাগুইআটি যদি হয়, এখানেই যাওয়ার সম্ভাবনা নিরানব্বই শতাংশ।
বাড়িটা ‘আইডেন্টিফাই’ করা যাবে? সোর্সের উত্তর ইতিবাচক। ঠিক হল, সকাল থেকে শুরু হবে ‘অপারেশন শ্যামল’। ভোরের দিকেই সোর্সকে নিয়ে একটা টিম দেখে আসবে ফ্ল্যাটটা। সাদা পোশাকের ফোর্স কীভাবে ছড়িয়ে থাকবে চারপাশে, সেই ‘ডিপ্লয়মেন্ট প্ল্যান’ করে রাখতে হবে।
‘অপারেশন’ কাল। কিন্তু রাত থেকেই ‘টাওয়ার লোকেশন’ মিনিটে মিনিটে মনিটর করতে হবে। ফিল্ডে চারটে টিম থাকবে সকাল থেকে। নেতৃত্বে থাকবেন ডিআইজি (অপারেশনস) স্বয়ং। সঙ্গে থাকবেন সিআইডি-র স্পেশ্যাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট অফ পুলিশ। যিনি এসএস( সিআইডি) বলে পরিচিত রাজ্য পুলিশে। একটা টিম থাকবে উল্টোডাঙায়। একটা কেষ্টপুরে। বাগুইআটিতে স্ট্যাটিক টিম একটা। ডিআইজি থাকবেন এয়ারপোর্টের কাছে। দুটো গাড়ি নিয়ে। শ্যামলের ফোনের টিএল যেমন যেমন জানা যাবে, সেভাবে ‘মুভ’ করবে ফিল্ডে থাকা ইউনিট। মনিটরিং সেল প্রতি দশ মিনিট অন্তর যাদের জানাতে থাকবে শ্যামলের ফোন-অবস্থান।
২২ ডিসেম্বর, ২০০৫। সকাল থেকে শ্যামলের তিনটে সিমই বন্ধ। একটা চালু হল সোয়া দশটা নাগাদ। যাতে একটা ফোন এল সাড়ে দশটার সামান্য পরে। বালি এলাকার কোনও এক প্রোমোটারের ফোন। নিছক কাজের কথাই হল। সিমেন্ট-বালির ডেলিভারি সংক্রান্ত। ফোনটা অবশ্য শ্যামল ধরল না। ধরল অন্য একজন। যে ফোনের অন্য প্রান্তে থাকা প্রোমোটারকে শুরুতেই বলল, ‘দাদাকে এখন দেওয়া যাবে না। ঘুমচ্ছে। যা বলার আমাকে বলুন।’ পাশ থেকে একটা জড়ানো গলা শোনা গেল, ‘কার ফোন রে?’ এতদিনের ট্র্যাকিংয়ের অভিজ্ঞতায় গলাটা মনিটরিং সেলের সবার চেনা। শ্যামল।
টাওয়ার লোকেশন? ডানলপ সংলগ্ন এলাকা। সঙ্গে সঙ্গে সোর্সদের চট করে বাজিয়ে নেওয়া হল একবার। ডানলপ এলাকায় কোনও নতুন ডেরার সন্ধান জানা আছে? কোনও নতুন কাজে হাত দিয়েছে ওই অঞ্চলে? যতটুকু জানা গেল, মাসছয়েক আগে সিঁথিতে একটা সাইটে কিছু টাকা ঢেলেছিল শ্যামল। তখন যাওয়া-আসা ছিল মাসে দু’-একবার। কিন্তু ‘ঠেক’ বলতে যা বোঝায়, তেমন কিছুর খোঁজ নেই।
একটা ব্যাপারে সন্দেহ নেই আপাতত। শ্যামল এখন ডানলপ এলাকায় আছে। বাকি দুটো ফোন অবশ্য এখনও বন্ধ। টাওয়ারের অবস্থান ‘স্ট্যাটিক’ থাকল দুপুর প্রায় দুটো অবধি। সেই সাড়ে দশটার পর থেকে ফোন এসেছে তিনটে। কথোপকথনে উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। ব্যবসাপাতির ফোন। যার মধ্যে শেষ ফোনটা শ্যামল নিজেই ধরেছে। এবং ছাড়ার আগে বলেছে, ‘পরে কথা হবে, এখন বেরচ্ছি একটু।’
বেরল যে, সেটা বোঝা গেল আড়াইটের পর, যখন ‘টাওয়ার লোকেশন’ বদলাতে শুরু করল ফোনের। বেলঘরিয়া পেরিয়ে বরানগর। বরানগর পেরিয়ে টালা। ফোনের বদলাতে থাকা অবস্থান বুঝিয়ে দিল, হুব্বা শ্যামল এখন দক্ষিণমুখী। নাকি ভুল ভাবা হচ্ছে? শ্যামল আদৌ নয়, শ্যামলের কোনও সঙ্গী? ধন্দের কারণ, ইতিমধ্যেই চালু হয়েছে দ্বিতীয় ফোনটা, যার অবস্থান দেখাচ্ছে ডানলপ সেক্টর। দুটো ফোনের কোনওটাতেই কথোপকথন হচ্ছে না কিছু।
দুটো সম্ভাবনা। এক, শ্যামল এখনও ডানলপ এলাকাতেই কোথাও আছে। দ্বিতীয় সিমটা ব্যবহার করছে। কোনও সঙ্গীর কাছে এখন প্রথম চালু হওয়া ফোনটা আছে, যে উত্তর থেকে দক্ষিণে যাচ্ছে। দুই, শ্যামল ডানলপ থেকে বেরিয়ে এসেছে প্রথম ফোনটা নিয়ে। এবং নর্থ টু সাউথ যাচ্ছে। আর দ্বিতীয় সিমটা ব্যবহার করছে কোনও সঙ্গী, যে তখনও ডানলপেই রয়েছে। বেরয়নি শ্যামলের সঙ্গে।