রমেশ সহমত ছিল না এই গাঁধীগিরির তত্ত্বে। বরং বক্তব্য ছিল, সিন্ডিকেট আছে, থাকুক। যেমন চলছে চলুক। কিন্তু প্রোমোটিংয়ের কাজে যে কোনও সময় বাজারে মন্দা আসতেই পারে। তাই সিন্ডিকেটের পাশাপাশি হাওড়া-হুগলিতে লোহার ছাঁটের ব্যবসাটাও চালানো উচিত সমান তালে। তোলাবাজির পরিধিও আরও বাড়ানো দরকার। আর সেটা করতে হলে নিয়মিত ‘অ্যাকশন’ করতে হবে। এবং নিজেদেরও মাঝেমধ্যে সামনে থাকতে হবে। না হলে গ্যাং বা ব্যবসা, দুটোর উপর থেকেই নিয়ন্ত্রণের রাশ আলগা হবে ক্রমশ। কারণ, দুটোই যথেষ্ট বেড়েছে কলেবরে। এখন হঠাৎ করে পুরোপুরি ‘ভদ্রলোক’ সেজে গিয়ে লাভ নেই। আর রাজনীতিতে যোগ দিলেই তো আর একঝটকায় অতীত কীর্তি সব মুছে যাবে না। পুলিশও পিছু ছাড়বে না।
পিছু ছাড়ার প্রশ্নই ছিল না। সেই যে ’৯১-এ শ্যামল ধরা পড়েছিল মুঘলসরাইয়ে জিআরপি-র হাতে, তারপর আর ধরা যায়নি। দীর্ঘ ব্যর্থতায় হতাশা আসেই। শ্যামলের ক্ষেত্রেও হতাশা বারবার গ্রাস করেছিল পুলিশকে। চেষ্টা কিন্তু তা বলে থেমে থাকেনি। জেলা পুলিশ এবং সিআইডি, দু’তরফেই। সিআইডি-র ‘মনিটরিং সেলে’ বিশেষ টিম তৈরি হয়েছিল শ্যামলের ‘ট্র্যাকিংয়ে’। পুলিশ যে হাল ছাড়েনি, শ্যামল জানত বিলক্ষণ। তাই চালিয়ে যেত অহরহ সিম বদলানোর খেলা। নির্দিষ্টভাবে হদিশ পাওয়া কঠিন থেকে কঠিনতর হত পুলিশের পক্ষে। তবু লেগে থাকতে হত। কথা আছে না, সুন্দর মুখের জয় সর্বত্ৰ। তদন্তের ক্ষেত্রে অন্য। ধৈর্যের জয় সর্বত্র। সবুর করো এবং মেওয়া ফলার অপেক্ষায় থাকো।
সরাসরি খুনখারাপিতে ২০০২-০৩-এর পর থেকে আর জড়াতে চাইত না শ্যামল। জড়াতে বাধ্য হল ২০০৫-এর ডিসেম্বরে। একটা সাইটের প্রজেক্ট প্ল্যান নিয়ে শ্যামলের সঙ্গে মতের মিল হচ্ছিল না প্রোমোটারের। উপরমহলে কিছু যোগাযোগ ছিল এই প্রোমোটারের। অন্যায় দাবির কাছে অন্যদের মতো গলবস্ত্র হয়ে নতজানু হওয়া দূরে থাক, উলটে শ্যামলের লোকদের শাসিয়েছিলেন, ‘তোদের দাদাকে বলে দিস, যা ইচ্ছে ডিমান্ড করবে আর আমি মেনে নেব, সেটা হবে না। চমকে লাভ নেই। তেমন হলে ফেলে রাখব জমিটা। প্রজেক্ট হবে না।’
একেবারে সরাসরি বিদ্রোহ খোদ হুব্বা শ্যামলের বিরুদ্ধে! পালটা চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দেওয়া একরকম— ‘যা পারিস করে নে… তোর জোরজুলুম মানব না।’ মস্তানি আর তোলাবাজির দুনিয়ায় সবচেয়ে জরুরি বিনিয়োগ হল ‘ভয়’। ‘ভয়’ পেয়েই অন্যায্য দাবি মেনে নেওয়া। ‘ভয়’ পেয়েই নিঃশর্ত নতিস্বীকার। ‘ভয়’-এর চাষ করেই মুনাফার ফসল তোলা। তা সেই ‘ভয়’-ই যদি চলে যায়, যদি কেউ শ্যামলকে চোখ রাঙিয়েও পার পেয়ে যায়, তা হলে শ্যামলের অস্তিত্বই সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। বিদ্রোহের নিশান তোলার মাশুল দিতে হল ওই প্রোমোটারকে। শ্যামল নিজে অ্যাকশনে নামল। ২০০৫-এর ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে প্রজেক্টের সাইট ম্যানেজারকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে মারল। এবং প্রকাশ্য হুমকি দিয়ে গেল কয়েকদিনের মধ্যে প্রোমোটারের পুরো ফ্যামিলি উজাড় করে দেওয়ার।
এই হুমকিটা যে ফাঁকা আওয়াজ নয়, সত্যিই যে হাওড়া-নিবাসী প্রোমোটারের বাড়িতে ভয়ানক কোনও অ্যাকশনের প্ল্যান করছে শ্যামল, তার আঁচ পেল সিআইডি-র মনিটরিং সেল। কল-ইন্টারসেপশনে ধরা পড়ল শ্যামলের সঙ্গে এক সহযোগীর মিনিটদেড়েকের কথোপকথন। শ্যামলকে বলতে শোনা গেল, ‘শালার বড্ড পুড়কি হয়েছে! দ্যাখ না কী করি! এক হপ্তার মধ্যে বাড়ির হাফ থেকে ফুল হাওয়া করে দেব পুরো।’ বাড়ির ‘হাফ থেকে ফুল’? এটা ‘ডিকোড’ করা কোনও সমস্যা নয়। ‘হাফ থেকে ফুল’, অর্থাৎ ছোট থেকে বড়, সবাইকে মেরে দেওয়ার প্ল্যান করছে!
একটা খুন হয়ে যাওয়ার পর তদন্তে নেমে অপরাধীকে খুঁজে বের করা এক জিনিস। রুটিন কাজ। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি এক বা একাধিক খুন হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, এটা জেনে যাওয়ার পর খুনগুলোকে প্রতিহত করা আরেক। রুটিন নয়। ঢের বেশি কঠিন, ঢের বেশি উদ্বেগের।
জরুরি বৈঠকে বসলেন ডিআইজি, সিআইডি (অপারেশনস), ‘ক্রাইম ওয়ার্ক’-এ যাঁর তর্কাতীত দক্ষতা শুধু রাজ্যে নয়, দেশের পুলিশ মহলেও বহুচর্চিত। শ্যামলের মোবাইলের তিনটে সিমের কথা জানা ছিল অফিসারদের। কিন্তু আগে যেমন লিখেছি, কখন কোনটা অ্যাকটিভ থাকবে, কখন কোনটা ব্যবহার করবে, সেটা আন্দাজ করা ছিল শিবের অসাধ্য। কোনটা হয়তো সকাল ন’টায় চালু হল। সোয়া ন’টায় খুচরো দুটো ফোনের পর বন্ধ সারাদিনের জন্য। কোনটা আবার সারাদিন খোলা, কিন্তু অ্যাকটিভিটি নেই। কোনওটায় ফোন এলে শ্যামল নয়, তুলছে অন্য কেউ। পাশ থেকে হয়তো শ্যামলের গলা শোনা যাচ্ছে। টাওয়ার লোকেশন (টিএল) বদলাচ্ছে দিনে কম করে হলেও পাঁচবার। কখনও বেলুড়, কখনও বালি, কখনও ব্যান্ডেল, কখনও শ্রীরামপুর, কখনও আবার মধ্য কলকাতা। কোনও কোনওদিন আবার তিনটে ফোনই সারাদিন বন্ধ। কিন্তু মোবাইল ছাড়া কাটাচ্ছে কী করে? হতেই পারে, চতুর্থ কোনও সিমও আছে, যা অজানা এখনও পর্যন্ত।
চারটে কাজ করার আছে আপাতত। সোর্সদের নতুন করে অ্যাকটিভেট করা। এসপি হুগলিকে পুরো ব্যাপারটা জানিয়ে রাখা। এসপি হাওড়াকে বলে ওই প্রোমোটারের বাড়ির আশেপাশে সাদা পোশাকের নজরদারির ব্যবস্থা করা। এবং শ্যামলের যে নম্বরগুলো জানা আছে, সেগুলো ‘রাউন্ড দ্য ক্লক’ মনিটর করা।