৫ম। পুলিসের সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, তালাবদ্ধ গৃহের ভিতর সেই যুবতী কন্যার মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে। আরও প্রমাণিত হইল যে, যে গৃহে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, সেই গৃহের তালার চাবি গোফুর খাঁর নিদর্শনমত ওসমান খাঁর নিকট হইতে পাওয়া গিয়াছে।
৬ষ্ঠ। একজন পাইক,যে গোর খার পাইক বলিয়া পরিচয় প্রদান করিল,—তাহার দ্বারা এই ঘটনার আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনা প্রমাণিত হইল; অর্থাৎ খাজানা আদায় করি বার নিমিত্ত হেদায়েতের বাড়ী হইতে সেই স্ত্রীলোককে আনয়ন হইতে, গোফুর খাঁন বাড়ীর ভিতর লাস পাওয়া পর্যন্ত যে সকল ঘটনা অপরাপর সাক্ষী দ্বারা প্রমাণিত হইল, তাহার সমস্ত অংশেই এই পাইক সৰ্ব্বতোভাবে পোষকতা করিল।
৭ম। লাস পরীক্ষাকারী ডাক্তার সাহেবের দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, অনাহারই সেই স্ত্রীলোকটীর মৃত্যুর কারণ।
৮ম। এই সকল প্রমাণ ব্যতীত অপর আর কোনরূপ প্রমাণের যাহা আবশ্যক হইল, তাহাও প্রজাগণের দ্বারা প্রমাণিত হইতে বাকী রহিল না।
এই মোকদ্দমায় গোফুর খা ও তাঁহার পুত্রের উপর যে সকল প্রমাণ সংগৃহীত হইল, তাহা দেখিয়া গোফুর খাঁ বেশ বুঝিতে পারিলেন যে, এই বৃদ্ধ বয়সে কোনরূপেই তাঁহার আর নিষ্কৃতি নাই। আরও বুঝিতে পারিলেন যে, দারোগা সাহেবের পূর্বোক্ত স্ত্রীলোকটীকে তাঁহার পুত্র বাহির করিয়া জানায়, এবং দারোগা সাহেব তাহার নিকট তাহার পুত্রের বিপক্ষে নালিশ করিলেও, তিনি তাহার কোনরূপ প্রতিবিধানের চেষ্টা করেন না বলিয়াই, দারোগা সাহেবের সাহায্যে তাঁহার এই সর্বনাশ উপস্থিত হইল। কিন্তু তিনি বড়ই আশ্চর্যান্বিত হইলেন যে, হেদায়েতের কন্যার মৃতদেহ তাঁহার বাড়ীর তালাবদ্ধ গৃহের ভিতর কিরূপে আসিয়া উপস্থিত হইল। যখন প্ৰজামাত্রই বলিতেছে যে, গোফুর খাঁ তাহার পুত্রের ন্যায়, সকলই অবগত আছেন, তখন গোফুর খাঁ এ সম্বন্ধে কিছুই অবগত নহেন, বা তাহার জ্ঞাতসারে এ কাৰ্য ঘটে নাই, এ কথা বলিলেই বা কোন বিচারক তাহা বিশ্বাস করিবেন?
সপ্তম পরিচ্ছেদ।
গোফুর খাঁর একজন অতি বিশ্বাসী কর্ম্মচারী ছিলেন, তাহার নাম হোসেন। পুলিস যখন প্রথম অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করেন, বা যে সময় গোফুরের গৃহে হেদায়েতের কন্যার মৃত দেহ পাওয়া যায়, সেই সময় হোসেন সেই স্থানে উপস্থিত ছিল না; জমিদারীর কাৰ্য্য পৰ্যবেক্ষণ করিবার নিমিত্ত তিনি স্থানান্তরে গমন করিয়াছিলেন। তাঁহার মনিবের এইরূপ বিপদ উপস্থিত হইয়াছে জানিতে পারিয়া, জমিদারী হইতে তিনি আপনার মনিবের বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, মনিব ও মনিব-পুত্র উভয়েই হত্যাপরাধে ধৃত হইয়া ছেন। তাহাদিগের উপর যে সকল প্রমাণ সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা জানিতে পারিয়া, তিনি অতিশয় ভাবিত হইলেন। তখন এই বিপদ হইতে তাহার মনিবকে কোনরূপে উদ্ধার করিবার উপায় দেখিতে না পাইয়া, নির্জনে গিয়া তিনি একদিবস রাত্রি কালে দারোগা সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন।
দারোগা সাহেব তাহাকে পূর্ব হইতেই চিনিতেন। তাহাকে দেখিবামাত্রই কহিলেন, কি হে হোসেনজি! কি মনে করিয়া?
হোসেন। আর মহাশয়! কি মনে করিয়া! কি মনে করিয়া আমি আপনার নিকট আসিয়াছি, তাহা আর আপনি বুঝিতে পারিতেছেন না কি?
দারোগা। আপনি কি মনে করিয়া আসিয়াছেন, তাহা আমি কিরূপে বুঝিতে পারিব? আপনার অন্তরের কথা আমি কিরূপে জানিব?
হোসেন। সে যাহা হউক, যাহা হইবার তাহা হইয়াছে, এখন আপনি কোনরূপে উঁহাদিগকে না বাঁচাইলে, আর বাঁচিবার উপায় নাই।
দারোগা। কাহাদিগকে বাঁচাইতে হইবে? তোমার মনিব ও মনিক-পুত্রকে?
হোসেন। তদ্ভিন্ন আমি এই সময় আর কাহার জন্য আপনার নিকট আসিব?
দারোগা। আগে যদি আপনি আসিতেন, তাহা হইলে উঁহাদিগকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিতে পারিতাম, কিন্তু এখন সে চেষ্টা বৃথা। এখন আমার ক্ষমতার অতীত হইয়া পড়িয়াছে।, হোসেন। যে পর্যন্ত মোকমার চুড়ান্ত বিচার শেষ হইয়া না যায়, সে পর্যন্ত আপনার ক্ষমতার সীমা এড়াইতে পারে না। এখন আমাকে কি করিতে হইবে বলুন। আপনি যাহা বলিবেন, আমি তাহাই করিতে, বা যাহা চাহিবেন, তাহাই প্রদান করিতে প্রস্তুত। এখন যেরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া হউক, উঁহাদিগের প্রাণ আপনাকে রক্ষা করিতেই হইবে।
দারোগা। দেখুন হোসেন সাহেব, এ পর্যন্তু ওসমান যেরূপ অত্যাচার করিয়া আসিতেছে, তাহাতে উহার প্রতি কাহার দয়া হইতে পারে? আপনি ত অনেক দিবস হইতে গোফুর খাঁর নিকট কৰ্ম্ম করিয়া আসিতেছেন; বলুন দেখি, তাঁহার প্রজাগণের মধ্যে কোন ব্যক্তি ওসমানের অত্যাচারে প্রপীড়িত হইতে বাকী আছে। বলুন দেখি, কয়জন লোক আপনার জাতি-ধৰ্ম্ম বজায় রাখিয়া, তাহার জমিদারীর মধ্যে বাস করিতে সমর্থ হইয়াছে। বলুন দেখি, কতগুলি স্ত্রীলোক তাহার জমিদারীর মধ্যে বাস করিয়া তাহাদিগের সর্বপ্রধান-ধৰ্ম্ম সতীত্ব রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছে। যাহার এই সকল কাৰ্য, তাহাকে আপনি এই বিপদ হইতে রক্ষা করিতে চাহেন। স্ত্রীলোকের ধর্ম নষ্ট করা ব্যতীত যাহার অপর আর কোন চিন্তা নাই, সুন্দরী স্ত্রীলোককে কোন গতিতে তাহার পিতা, মাতা, ভ্রাতা বা স্বামীর নিকট হইতে অপহরণ করিবার যাহার সর্বদা মানস, আপনার পাশব বৃত্তি চরিতার্থ করিবার নিমিত্ত যে ব্যক্তি সকল কাৰ্য্যই অনায়াসে করিতে পারে, আপনি তাহার প্রাণ রক্ষার নিমিত্ত আমাকে অনুরোধ করিবেন না। তাহাকে এই মোকদ্দমা হইতে বাচাই বার কথা দুরে থাকুক, তাহাকে সাহায্য করিবার নিমিত্ত অতি সামান্য মাত্র চেষ্টা করিলেও, তাহাতে মহাপাতক হয়। তাই বলি, আপনি আমাকে এরূপ অনুরোধ করিবেন না। সহস্র সহস্র মুদ্রা প্রদান করিলেও, এ কাৰ্য্য আমার দ্বারা কোনরূপেই হইবে না।