- বইয়ের নামঃ ঘনাদা সমগ্র
- লেখকের নামঃ প্রেমেন্দ্র মিত্র
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, গল্পের বই
অগ্রন্থিত ঘনাদা
অসম্পূর্ণ ঘনাদা
বাহাত্তর নম্বরের তেতালার টঙের ঘর সত্যিই যে তখন খালি করে ঘনাদা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, বুনো বাপি দত্তের হপ্তায় হপ্তায় ডজন ডজন বিগড়ি হাঁস খাইয়ে আমাদের সকলের হাঁস ও সবরকম মাংসেই অরুচি ধরাবার কথা। যাঁরা জানেন তাঁদের সকলেরই মনে পড়বে।
ব্যাপারটা যা ঘটেছিল তা বাহাত্তর নম্বরেরই উপযুক্ত কিছু। দুকথায় পুরনো স্মৃতিটা একটু ঝালিয়ে নিই। নতুন এক বোর্ডার বুনো বাপি দত্ত ফি শনিবার ছুটির রবিবারটা কাটিয়ে আসার জন্য দেশে যাবার সময় এক জোড়া করে বিগড়ি হাঁস সঙ্গে নিয়ে যেত।
এক শনিবার দেশে যাবার সময় তার কেনা বিগড়ি হাঁসের জোড়া না দেখে সে খাপ্পা। স্বয়ং ঘনাদাই তার সে হাঁস কেটে সেদিন তাদের খাইয়েছেন জেনে সে একেবারে আগুন। সে আগুন জল করে দিতে ঘনাদা যা শোনালেন বাপি দত্ত তাতেই জল হয়ে ঘনাদার প্রতি অতল ভক্তি আর অটল বিশ্বাসে দিনের পর দিন হপ্তার পর হপ্তা ডজন ডজন বিগড়ি হাঁস কিনে এনে খাইয়ে মেসের সকলের মাংসে অরুচি ধরিয়ে ছাড়লে।
ঘনাদা বাপি দত্তের জোড়া বিগড়ি হাঁস কাটবার কৈফিয়ত হিসেবে শুনিয়েছিলেন যে, তিনি বিগড়ি হাঁস পেলেই কাটেন এক বিশেষ কারণে। সে হাঁসের পেট থেকে তিনি তাঁর একটি নস্যির কৌটো উদ্ধার করতে চান।
কেন? কারণ সেই নস্যির কৌটো দুনিয়ার সবার সেরা হিরে মাণিকের খনির চেয়ে দামি।
কেন?
কারণ তিব্বতের টাকা মাকানের অসীম তুষার প্রান্তরে তুচ্ছ এমন একটি হ্রদ আবিষ্কার করেছিলেন যার প্রতি কৌটা জল অমূল্য বললেই হয়। সে জল হচ্ছে-~- বিজ্ঞানীরা যাকে বলে—ভারী জল। সাধারণ জলে অক্সিজেন আর হাইড্রোজেনের পরমাণুর যে অনুপাত থাকে, ভারী জলে তা থেকে একটু আলাদা। সেই তফাৎটুকুর জন্য বর্তমান যুগের পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের গবেষণায় বৈজ্ঞানিকেরা সে জল নিয়ে অসাধ্য সাধনের ভোজবাজি দেখাতে পারেন।
এই হ্রদ আবিষ্কার করেও এক দুশমনের হাতে ধরা পড়ে জান-প্রাণ সমেত সবকিছু খোয়াবার উপক্রম হলে ঘনাদা তাঁর আবিষ্কার একেবারে ব্যর্থনা হতে দেবার দুরাশায় তাঁর আবিষ্কৃত হ্রদের সঠিক ভৌগোলিক অবস্থান এক টুকরো কাগজে লিখে সেই কাগজ কুচিটা তাঁর নস্যির কৌটোয় ভরে একটি বিগড়ি হাঁসের ঠোঁট ফাঁক করে তার গলার ভিতর ঠেলে দিয়ে তাকে গিলিয়ে দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বিগড়ি হাঁসটা ছিল শিকারিরা যাকে ব্রাহমিনি হাঁস বলে সেই জাতের। হিমালয়ের ওপরের তুষার প্রান্তর থেকে দারুণ শীতের সময় ওরা ভারতবর্ষের বিশেষ করে বাংলাদেশের জলায় শীত কাটাতে আসে। অমন ব্রাহমিনি হাঁস ঘনাদা পেলেন কোথায়? সেও তাঁর ভাগ্য বলতে হয়। দুশমনের কাছ থেকে পালাবার সময় এক তুষার ঢাকা টিলা পার হবার সময় হাঁসটাকে দেখতে পান। হাঁসটা সুদূর সাইবেরিয়া থেকে হিমালয় পেরিয়ে ভারতবর্ষ পাড়ি দেবার পথে খানিক বুঝি বিশ্রাম করতে নেমেছিল টিলাটার ওপর। ঘনাদা হাঁসটাকে শুধু দেখেননি। যে—
একটি খসড়া গল্প – তিনি—অর্থাৎ
না, তিনি নেই।
নেই মানে কী, তা বুঝতে যদি কষ্ট হয় তো স্পষ্ট করেই বলছি—তিনি বেপাত্তা, অর্থাৎ নিরুদ্দেশ।
হ্যাঁ, যথার্থ নিরুদ্দেশ যাকে বলে, অর্থাৎ কোথাও কেউ তাঁর হদিস পাচ্ছে না।
অথচ চেষ্টার কি কোনও কসুর আছে!
তিনি বলে কথা! সারা পৃথিবীময় পাহাড় পর্বত সাগর নদী ডিঙিয়ে সমস্ত হটলাইন এমন গন গন করছে যে বুঝি গলেই যায়।
হট-লাইন কী বস্তু জানা নেই বুঝি?
বুঝিয়ে দিচ্ছি তাহলে–
পৃথিবীতে আজ যারা মহাশক্তি, ওই শক্তি-ই হয়েছে তাদের এক অভিশাপ। কেউ তারা কারও চেয়ে তো কম যায় না। একজন যদি এক হাতিয়ারে হয় উনিশ, তাহলে আর-একজন সাড়ে আঠারোর কম কখনও নয়। আর এ হাতিয়ারে যে সাড়ে আঠারো সেই আর-এক হাতিয়ারে অন্য জনের উনিশ ছাড়িয়ে প্রায় সাড়ে উনিশ।
এই উনিশ বিশের রেষারেষিতে সব তরফই সব সময়ে তটস্থ হয়ে আছে, পাছে জিভ ফসকানো কোনও কথার ভুলে বা চটপট কিছু শোনার দোষে এক লহমার কিছু উলটো বোঝাবুঝিতে একের বদলে আর বোতাম টেপার আহাম্মকিতে পলকে প্রলয় না ঘটে যায়।
তেমন কিছু গোলমেলে ব্যাপার হতে পারার একটু আঁচ পেলেই প্রতি তরফের যাঁরা মাথা তাঁরা আর পাঁচ কানে খবর পাবার জন্যে অপেক্ষা করেন না। একেবারে সরাসরি মাথায় মাথায় কথা চালাচালির ব্যবস্থা করেন।
এ ব্যবস্থা এমন পাকা নিখুঁত যে তার মধ্যে এনগেজড, নো-রিপ্লাই কি রংনম্বর হবার জো নেই।
সমুদ্রের এপারের মুল্লুকের চাঁই হটলাইনের ফোনটি তোলামাত্র ওপারের খোদ কর্তার ফোন টনক নড়ার মতো বেজে উঠবে। কথাবার্তা যা হবে তা একেবারে সাফসুফ কাটছাঁটা পরিষ্কার। তার মধ্যে বাইরের কারও একটুও টু শব্দ করারও উপায় নেই।
অবশ্য যখন তখন যেমন তেমন ব্যাপারে এ হট লাইন কখনও চালু হয় না। হয় অতি গুরুতর পৃথিবী জোড়া সমস্যা কি সংকটের ব্যাপারে।
এখন যেমন হচ্ছে।
হ্যালো! হ্যালো!–হট লাইন গুমরোচ্ছে-কোনও খবর আপনারাও পাচ্ছেন? আপনাদের কে.জি.থুড়ি, গোয়েন্দা পুলিশ সারা মুল্লুক চষে ফেলছে বাল্টিক আর মেডিটারেনিয়ন থেকে আর্কটিক প্যাসিফিক পর্যন্ত! আমরাও পাচ্ছি না। কী? কী? একটু ধরতে বলছেন? হ্যাঁ, হ্যাঁ, ধরে আছি! কী খবর? বলুন, বলুন। হ্যাঁ চুচিদের মুলুকে দেখা গেছে একজনকে। চিমসে মর্কটের মতো? ওখান থেকে বেরিং স্ট্রেট পেরিয়ে যাবার তালে আছে? আমরা যেন হুশিয়ার থাকি! থাক, থাক— আর বলতে হবে না। আমি এখনই আলাস্কায় হুকুম পাঠাচ্ছি। বর্ডার গার্ড সবকটা জাহাজ লঞ্চ স্টিমবোট নিয়ে যেন দিনরাত খাড়া পাহারায় থাকে। ওপার থেকে লঞ্চ, স্টিমার জেলেডিঙি তো বটেই, মায় ওয়ালরস কি সী-লায়নের যদি একটা ভেসে আসে সেটাও পাকড়াও করতে ছাড়বে না। কে জানে কী তাঁর প্যাঁচ। ওরই ভেতর লুকিয়ে আসা তাঁর পক্ষে অসম্ভব নয়—অ্যাঁ!! কী বলছেন!মানে—মানে— ওরকম হুকুম যেন না দিই,—দিয়ে থাকলে যেন খারিজ করি এক্ষুনি-কেন? কেন?—মানে চুকচিদের মুল্লুকে যাঁকে দেখা গেছে তিনি চুচি ভাষাই ভাল জানেন না। দু-চারটে কথা শুধু বলতে পারেন। তাও ভুল উচ্চারণ!