অগ্রন্থিত ঘনাদা

অসম্পূর্ণ ঘনাদা

বাহাত্তর নম্বরের তেতালার টঙের ঘর সত্যিই যে তখন খালি করে ঘনাদা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, বুনো বাপি দত্তের হপ্তায় হপ্তায় ডজন ডজন বিগড়ি হাঁস খাইয়ে আমাদের সকলের হাঁস ও সবরকম মাংসেই অরুচি ধরাবার কথা। যাঁরা জানেন তাঁদের সকলেরই মনে পড়বে।

ব্যাপারটা যা ঘটেছিল তা বাহাত্তর নম্বরেরই উপযুক্ত কিছু। দুকথায় পুরনো স্মৃতিটা একটু ঝালিয়ে নিই। নতুন এক বোর্ডার বুনো বাপি দত্ত ফি শনিবার ছুটির রবিবারটা কাটিয়ে আসার জন্য দেশে যাবার সময় এক জোড়া করে বিগড়ি হাঁস সঙ্গে নিয়ে যেত।

এক শনিবার দেশে যাবার সময় তার কেনা বিগড়ি হাঁসের জোড়া না দেখে সে খাপ্পা। স্বয়ং ঘনাদাই তার সে হাঁস কেটে সেদিন তাদের খাইয়েছেন জেনে সে একেবারে আগুন। সে আগুন জল করে দিতে ঘনাদা যা শোনালেন বাপি দত্ত তাতেই জল হয়ে ঘনাদার প্রতি অতল ভক্তি আর অটল বিশ্বাসে দিনের পর দিন হপ্তার পর হপ্তা ডজন ডজন বিগড়ি হাঁস কিনে এনে খাইয়ে মেসের সকলের মাংসে অরুচি ধরিয়ে ছাড়লে।

ঘনাদা বাপি দত্তের জোড়া বিগড়ি হাঁস কাটবার কৈফিয়ত হিসেবে শুনিয়েছিলেন যে, তিনি বিগড়ি হাঁস পেলেই কাটেন এক বিশেষ কারণে। সে হাঁসের পেট থেকে তিনি তাঁর একটি নস্যির কৌটো উদ্ধার করতে চান।

কেন? কারণ সেই নস্যির কৌটো দুনিয়ার সবার সেরা হিরে মাণিকের খনির চেয়ে দামি।

কেন?

কারণ তিব্বতের টাকা মাকানের অসীম তুষার প্রান্তরে তুচ্ছ এমন একটি হ্রদ আবিষ্কার করেছিলেন যার প্রতি কৌটা জল অমূল্য বললেই হয়। সে জল হচ্ছে-~- বিজ্ঞানীরা যাকে বলে—ভারী জল। সাধারণ জলে অক্সিজেন আর হাইড্রোজেনের পরমাণুর যে অনুপাত থাকে, ভারী জলে তা থেকে একটু আলাদা। সেই তফাৎটুকুর জন্য বর্তমান যুগের পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের গবেষণায় বৈজ্ঞানিকেরা সে জল নিয়ে অসাধ্য সাধনের ভোজবাজি দেখাতে পারেন।

এই হ্রদ আবিষ্কার করেও এক দুশমনের হাতে ধরা পড়ে জান-প্রাণ সমেত সবকিছু খোয়াবার উপক্রম হলে ঘনাদা তাঁর আবিষ্কার একেবারে ব্যর্থনা হতে দেবার দুরাশায় তাঁর আবিষ্কৃত হ্রদের সঠিক ভৌগোলিক অবস্থান এক টুকরো কাগজে লিখে সেই কাগজ কুচিটা তাঁর নস্যির কৌটোয় ভরে একটি বিগড়ি হাঁসের ঠোঁট ফাঁক করে তার গলার ভিতর ঠেলে দিয়ে তাকে গিলিয়ে দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বিগড়ি হাঁসটা ছিল শিকারিরা যাকে ব্রাহমিনি হাঁস বলে সেই জাতের। হিমালয়ের ওপরের তুষার প্রান্তর থেকে দারুণ শীতের সময় ওরা ভারতবর্ষের বিশেষ করে বাংলাদেশের জলায় শীত কাটাতে আসে। অমন ব্রাহমিনি হাঁস ঘনাদা পেলেন কোথায়? সেও তাঁর ভাগ্য বলতে হয়। দুশমনের কাছ থেকে পালাবার সময় এক তুষার ঢাকা টিলা পার হবার সময় হাঁসটাকে দেখতে পান। হাঁসটা সুদূর সাইবেরিয়া থেকে হিমালয় পেরিয়ে ভারতবর্ষ পাড়ি দেবার পথে খানিক বুঝি বিশ্রাম করতে নেমেছিল টিলাটার ওপর। ঘনাদা হাঁসটাকে শুধু দেখেননি। যে—

একটি খসড়া গল্প – তিনি—অর্থাৎ

না, তিনি নেই।

নেই মানে কী, তা বুঝতে যদি কষ্ট হয় তো স্পষ্ট করেই বলছি—তিনি বেপাত্তা, অর্থাৎ নিরুদ্দেশ।

হ্যাঁ, যথার্থ নিরুদ্দেশ যাকে বলে, অর্থাৎ কোথাও কেউ তাঁর হদিস পাচ্ছে না।

অথচ চেষ্টার কি কোনও কসুর আছে!

তিনি বলে কথা! সারা পৃথিবীময় পাহাড় পর্বত সাগর নদী ডিঙিয়ে সমস্ত হটলাইন এমন গন গন করছে যে বুঝি গলেই যায়।

হট-লাইন কী বস্তু জানা নেই বুঝি?

বুঝিয়ে দিচ্ছি তাহলে–

পৃথিবীতে আজ যারা মহাশক্তি, ওই শক্তি-ই হয়েছে তাদের এক অভিশাপ। কেউ তারা কারও চেয়ে তো কম যায় না। একজন যদি এক হাতিয়ারে হয় উনিশ, তাহলে আর-একজন সাড়ে আঠারোর কম কখনও নয়। আর এ হাতিয়ারে যে সাড়ে আঠারো সেই আর-এক হাতিয়ারে অন্য জনের উনিশ ছাড়িয়ে প্রায় সাড়ে উনিশ।

এই উনিশ বিশের রেষারেষিতে সব তরফই সব সময়ে তটস্থ হয়ে আছে, পাছে জিভ ফসকানো কোনও কথার ভুলে বা চটপট কিছু শোনার দোষে এক লহমার কিছু উলটো বোঝাবুঝিতে একের বদলে আর বোতাম টেপার আহাম্মকিতে পলকে প্রলয় না ঘটে যায়।

তেমন কিছু গোলমেলে ব্যাপার হতে পারার একটু আঁচ পেলেই প্রতি তরফের যাঁরা মাথা তাঁরা আর পাঁচ কানে খবর পাবার জন্যে অপেক্ষা করেন না। একেবারে সরাসরি মাথায় মাথায় কথা চালাচালির ব্যবস্থা করেন।

এ ব্যবস্থা এমন পাকা নিখুঁত যে তার মধ্যে এনগেজড, নো-রিপ্লাই কি রংনম্বর হবার জো নেই।

সমুদ্রের এপারের মুল্লুকের চাঁই হটলাইনের ফোনটি তোলামাত্র ওপারের খোদ কর্তার ফোন টনক নড়ার মতো বেজে উঠবে। কথাবার্তা যা হবে তা একেবারে সাফসুফ কাটছাঁটা পরিষ্কার। তার মধ্যে বাইরের কারও একটুও টু শব্দ করারও উপায় নেই।

অবশ্য যখন তখন যেমন তেমন ব্যাপারে এ হট লাইন কখনও চালু হয় না। হয় অতি গুরুতর পৃথিবী জোড়া সমস্যা কি সংকটের ব্যাপারে।

এখন যেমন হচ্ছে।

হ্যালো! হ্যালো!–হট লাইন গুমরোচ্ছে-কোনও খবর আপনারাও পাচ্ছেন? আপনাদের কে.জি.থুড়ি, গোয়েন্দা পুলিশ সারা মুল্লুক চষে ফেলছে বাল্টিক আর মেডিটারেনিয়ন থেকে আর্কটিক প্যাসিফিক পর্যন্ত! আমরাও পাচ্ছি না। কী? কী? একটু ধরতে বলছেন? হ্যাঁ, হ্যাঁ, ধরে আছি! কী খবর? বলুন, বলুন। হ্যাঁ চুচিদের মুলুকে দেখা গেছে একজনকে। চিমসে মর্কটের মতো? ওখান থেকে বেরিং স্ট্রেট পেরিয়ে যাবার তালে আছে? আমরা যেন হুশিয়ার থাকি! থাক, থাক— আর বলতে হবে না। আমি এখনই আলাস্কায় হুকুম পাঠাচ্ছি। বর্ডার গার্ড সবকটা জাহাজ লঞ্চ স্টিমবোট নিয়ে যেন দিনরাত খাড়া পাহারায় থাকে। ওপার থেকে লঞ্চ, স্টিমার জেলেডিঙি তো বটেই, মায় ওয়ালরস কি সী-লায়নের যদি একটা ভেসে আসে সেটাও পাকড়াও করতে ছাড়বে না। কে জানে কী তাঁর প্যাঁচ। ওরই ভেতর লুকিয়ে আসা তাঁর পক্ষে অসম্ভব নয়—অ্যাঁ!! কী বলছেন!মানে—মানে— ওরকম হুকুম যেন না দিই,—দিয়ে থাকলে যেন খারিজ করি এক্ষুনি-কেন? কেন?—মানে চুকচিদের মুল্লুকে যাঁকে দেখা গেছে তিনি চুচি ভাষাই ভাল জানেন না। দু-চারটে কথা শুধু বলতে পারেন। তাও ভুল উচ্চারণ!

না। তাহলে এ তিনি সে তিনি নন কখখনই।

কিন্তু তিনি, সেই আসল তিনি তাহলে কোথায়?

দেখা যাক আর-এক হটলাইনে কিছু হদিস মেলে কি না!

এ হটলাইন চলছে পশ্চিম সাগরের এক মহাদ্বীপ থেকে পূর্ব দক্ষিণ সাগরের আর-এক মহাদেশ প্রমাণ দ্বীপে।

এ হটলাইনে আলাপ যা চলছে তা অতি গোপন সাংকেতিক ভাষায়।

যদি কোনওরকমে কোথাও কিছু গলে বেরিয়ে গিয়ে শোনা-ও যায় তা বোঝার সাধ্য নেই কারও।

শুনতে যা পাওয়া যাবে তা তো এই—না, মুদি দেবে না। তবে হ্যাঁ, গোয়ালা ইঁদুর পুষছে। চুপ চাপ চুপ চাপ

মানে আছে এসব আবোল তাবোলের? হ্যাঁ, আছে। তবে কথা ধরে নয়। কথাগুলো বলতে যে শব্দের যেসব অক্ষর লাগে সেই অক্ষরের সঙ্গে অক্ষরের জোড়ায় সাংকেতিক অর্থ যা, কথাগুলো আসার সঙ্গে সঙ্গে সুপার কম্পিউটারে কষে বার হয়ে চলন্ত টেপ-এ ছাপা হয়ে যাচ্ছে।

দু তরফের দুই মাথা ওই রকম এক-একটি সুপার কম্পিউটার টেলিফোনের হট লাইনের সঙ্গে জুড়ে নিয়ে বসে আছেন। এপার ওপারে ধাঁধার ভাষায় কথা চালাচালি হবার সঙ্গে সঙ্গে সেই চলন্ত টেপ-এ তার মানে পেয়ে যাচ্ছেন।

মানেটা সামান্য একটু ফাঁস করেই না হয় দেওয়া যাক। মোটমাট আলাপটা যখন শূন্যেই গিয়ে পৌঁছচ্ছে তখন ওই কটা কথায় কম্পিউটারে ভেদ করা মানেটুকু জানিয়ে দিলে কোনও ক্ষতি নেই।

পশ্চিম আর পুবের দুই ছোটবড় দ্বীপরাজ্যের হট লাইনের আলাপের সোজা বাংলাটা এই রকম,—হ্যাঁ, আমরা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছি। দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত বাদ নেই, সুতরাং মেনে নাও, তিনি নেই, তিনি নেই। যিনি নেই বলে এত হতাশা সেই তিনিটা কে? আর সে তিনি যেই হোন, তাঁকে সারা দুনিয়ায় এত খোঁজাখুঁজি কেন?

খোঁজাখুঁজি—পৃথিবীতে এক দারুণ সংকট উপস্থিত হয়েছে বলে। এমন সংকট যার কিনারা করতে গিয়ে দুনিয়ার সব বাঘাবাঘা দেশ প্রায় কুপোকাৎ।

তাই খোঁজ পড়েছে সেই তিনি-র। পারলে এক তিনিই এখন এ বিপদ থেকে। উদ্ধার করতে পারবেন।

কিন্তু তাঁকে পাওয়া যাবে কোথায়? তিনি হঠাৎ একেবারে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন। হাওয়ায় না মিলিয়ে গেলে এত করেও কেউ তাঁর হদিস পায় না।

কোথায় না তাঁকে খোঁজা হয়েছে? শহরে বাজারে গ্রামে গঞ্জে হাটে মাঠে পাহাড়ে জঙ্গলে নদীতে সাগরে তুষার-ঢাকা দুই মেরু থেকে তপ্ত বালুর টাকলামাকান গোবি সাহারা পর্যন্ত। কোথাও তাঁর চুলের টিকিটি পর্যন্ত দেখা যায়নি।

তাহলে এখন উপায়?

***

সেই প্রথম শিশির থেকে শুরু করে পালা করে রিলে রেসের মতো গৌর শিবুর পর গল্পের খেই ধরে আমি এখানে বেশ একটু কাহিল অবস্থাতেই থামলাম।

তাহলে এখন উপায়?-টা শুধু গল্পের নয়, আমাদেরও সত্যিকার উদ্বিগ্ন জিজ্ঞাসা।

যখন থেকে যেভাবে কাঠকুটো যা পারি জোগাড় করে চকমকি ঠুকে ফুঁ দিতে শুরু করেছি তাতে এতক্ষণে আগুন তো বেশ ধরে আসবার কথা।

তার জায়গায় একটু ধোঁয়াও তো দেখা যাচ্ছে না।

চালটা কি তাহলে ভুল হয়ে গেছে একটু?

নিজেদের গল্পের বুনুনিতেই যেন মশগুল হয়ে মৌরসি পাট্টার আরাম কেদারায় যিনি সেই তখন থেকে বসে আছেন তাঁকে একেবারে গ্রাহ্যই না করার ভানটা একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে?

এখন এ গল্পের জট যা পাকিয়েছি তা সামলাব কী করে?

আরাম কেদারার উনি কি সেই মজাই দেখছেন? যাঁকে জব্দ করবার জন্য এত প্যাঁচ তাঁর কাছেই নিজেদের প্যাঁচে জড়িয়ে মরতে বসেছি যে!

তবু হাল ছাড়লে চলবে না। আরম্ভ যখন করেছি তখন যা করে পারি চালিয়ে যেতেই হবে।

ন্যাড়া ছাদের সিঁড়িতে বিদ্যাসাগরী চটির আওয়াজ পাবার পরই আমাদের আগের রাতের ছকে নেওয়া ফন্দি অনুসারে শিশিরের ওপরই প্রথম গাওনা শুরু করবার বরাত ছিল।

ঠিক করা ছিল যে আগে থাকতে কিছু ভাবাভাবি নয়। একেবারে ঠিক সময়টিতে চটজলদি যা মাথায় আসে তাই দিয়ে সে গল্প শুরু করে দেবে। সে গল্প যত আজগুবি যত আষাঢ়ে তোক তত ভাল।

যাঁকে কাত করতে এত তোড়জোড় তিনি সাদাসিধে প্যাঁচে তত কাবু হবার নয়। তাঁর মাথাতেও চক্কর দেবার মতো জবর কিছু তাই চাই।

তিনি বেশ কিছুদিন ধরে যা আমাদের জ্বালাচ্ছেন সে কথাটাও মনে রেখে তার শোধ নেবার চেষ্টা করতে ছাড়ব কেন?

এ ক-দিন কী তিনি করেছেন?

আমাদের সঙ্গে অসহযোগ? মেসের খাওয়া বন্ধ?

না। ওসব কিছু না। বরং আরও যেন আপনভোলা ভালমানুষ হয়ে উঠেছেন।

প্যাঁচটা তাঁর ওই ভালমানুষিতেই। গায়ে জ্বালা-ধরানো আপনভোলা ভালোমানুষি!

আমরা হয়তো শনিবারের বিকেলের জমায়েতে একথা সেকথার পর আলাপটা উগ্যান্ডার ইদি আমিনের বিষয়ে ঘুরিয়ে এনেছি। মতলবটা এই যে ইদি আমিনের শয়তানি দত্যিপনার দু-চারটে সত্যি মিথ্যে চুটকি দিয়ে তাতিয়ে ওঁর কাছ থেকে গরম গরম কিছু একটা বার করব।

উনি সে ধার দিয়েই যাননি। হঠাৎ যেন আধকালা হয়ে গিয়ে কান শুনতে ধান শুনে ইদি আমিনের কথা থেকে মণ দরে আদা কেনার ব্যাপারে চলে গেছেন।

আমাদের তোড়জোড় তো বটেই বনোয়ারির আনা ভুরভুরে গন্ধ-ছাড়া প্লেট-আলোকরা চিংড়ির কাটলেটগুলো যেন ভস্মে ঘি ঢালা হয়েছে।

টঙের ঘরের তার এই কায়দাটাই নতুন। চেপে ধরব যে তার কোনও উপায় নেই। তিনি তো মেজাজ করে ফারাক হয়ে যাননি। দু-বেলা আমাদের সঙ্গেই আছেন একেবারে সদাশিব হয়ে।

শুধু তাঁকে আসরে নামাবার সব ফন্দি এক সস্তা বেয়াড়া প্যাঁচে দিচ্ছেন ভেস্তে।

সোজাসুজি নিউট্রন বোমার কথা তুলে তাঁর মতামত চাইলে তিনি যেন আকাশ থেকে পড়েছেন! ওসব বিদঘুটে নাম তাঁর যেন কানেই যায়নি কখনও।

খানিক কেমন একটু হতভম্ব হয়ে চেয়ে থেকে প্রসঙ্গটা যেন ঠিক বুঝেছেন ভাব দেখিয়ে মুলতানি গোরুর দুধ সম্বন্ধে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছেন।

এ সব পিত্তি-জ্বালানো চালাকির জবাব দেবার জন্যে আমাদের ওই আবোল। তাবোল প্যাঁচ।

যা খুশি একটা কিছু ধরে যত পারো আহাম্মকির গুল ঝেড়ে যাও। আরাম কেদারার তিনি যেন চিড়বিড়িয়ে উঠে আমাদের এক হাত না নিয়ে পারেন না।

কিন্তু একটানা আবোল তাবোল শুনে যাওয়াও তো চারটিখানি কথা নয়। যেটুকু গলাবাজি করেছি তাতেই তো আমাদের জিভ বেরিয়ে এসেছে।

শিশির তাই যেন কতকটা কাঁদো কাঁদো গলায় দিশাহারা অবস্থায় আরম্ভ করে—

তাহলে এখন উপায়?—ভাবছে সারা দুনিয়া। উপায় সত্যিই বুঝি নেই। কিন্তু তাহলেও হাল ছাড়া তো চলবে না।

বাঘা বাঘা সব মাতব্বর দেশ নয়, তাদের সামান্য একটা নখকুনির মতো পুঁচকে একটা ফুটকির মতো দ্বীপ, ব্রিটেন আর আয়ারল্যান্ডের মাঝখানের আইল অফ ম্যান-এর প্রেসিডেন্ট তাঁর লাইব্রেরি ঘরে বসে তাঁর আদরের বেড়ালটার মোটা ল্যাজে হাত বুলোতে বুলোতে হঠাৎ যেন জিভ কামড়ে চমকে লাফিয়ে উঠলেন!

ঠিক! ঠিক! এই কথাটা তো কারও মনে হয়নি।

বাঘা বাঘা দেশের বিশ্বজোড়া খোঁজাখুঁজির মধ্যে ওই তুচ্ছ ঠিকানাটাই ফাঁক পড়ে গেছে।

প্রেসিডেন্ট তখই ফোন করলেন তার সেক্রেটারিকে—শিগগির! শিগগির! এই ঠিকানায় এখুনি কেবল পাঠাও-বাহাত্তর নম্বর বনমালী নস্কর লেন—

মূর্খ!! ইডিয়ট!

অ্যাঃ—আমরা চমকিত। এ কার গলা? শিশিরের এই যা থাকে কপালে বলে ঝাঁপ দেওয়া প্যাঁচেই শেষ পর্যন্ত কাজ হল?

অসমাপ্ত

কালো ফুটো সাদা ফুটো

না, না, মাপ করবেন। দোহাই আপনাদের। আজ আর পেড়াপিড়ি করবেন না। আজ ওঁকে এই নিয়ে বিরক্ত করতে পারব না—

ছুটির দিন। একটু সকাল থেকেই আড্ডা ঘরে সবাই জমায়েত হয়েছি। টঙের ঘরের তিনিও নেমে এসে তাঁর মৌরসি কেদারাটা দখল করে বসেছেন।

এই সময়ে বারান্দা থেকে নীচের দিকে কাকে না কাদের উদ্দেশ করে গৌরের ওই চেঁচামেচি ভাল লাগে!

চেঁচামেচিটা কেন, কাকে উদ্দেশ করে তাও তো বোঝা যাচ্ছে না।

ওদিকে মৌরসি কেদারায় তাঁর মেজাজটাই না এই সাত সকালে বিগড়ে যায়।

প্রায় ধমকের সুরে গৌরকে তাই ডাকতে হল, এই, কী হচ্ছে কী? কার সঙ্গে কী জন্য অমন চেঁচামেচি করছিস?

আর কার সঙ্গে? গৌর বারান্দার রেলিং থেকে আমাদের দিকে ফিরে বিরক্ত গলায় বললে, সক্কাল বেলাই কী ঝামেলা দেখ দিকি!

এইটুকু বলেই আবার বারান্দার থেকে নীচের দিকে মুখ নামিয়ে একসঙ্গে বিরক্তি আর কাতরতা মিশিয়ে বললে, বললাম তো—আজ কিছু হওয়া সম্ভব নয়। আপনারা বরং আপনাদের নাম ঠিকানা রেখে গিয়ে পরের রবিবারে আসুন—হ্যাঁ, হ্যাঁ পরের—ওঁকে না আগে থেকে না জানিয়ে—–

ভেতর থেকে আবার আমাদের গলা ছেড়ে গৌরকে ডেকে ব্যাপারটা জানবার চেষ্টা করতে হল, শোন শোন, গৌর, শোন। ব্যাপারটা হয়েছে কী! এই সাত সকালে কার সঙ্গে চেচামেচি করছিস! কে ওরা? কী চায়?

কে ওরা? কী চায়? গৌর একেবারে গনগনে মেজাজে বললে, সব পত্রপত্রিকার প্রতিনিধি। এসেছেন দুর-দুরান্তর থেকে ঘনাদার ইন্টারভিউ মানে সাক্ষাৎকার নিতে। তাও কি কাছে পিঠের কোথাও থেকে? একজন এসেছে হলদিয়ার কাছের কোন গ্রাম থেকে, আর-একজন দুর্গাপুর থেকে, আর একজনরা বিহারের দানাপুর থেকে।

উৎসাহ খুব? আমাদের স্বীকার করতেই হল—তা কী নিয়ে ইন্টারভিউ মানে সাক্ষাৎকার তারা চায়?

কী নিয়ে আবার! গৌর আমাদের ওপরেই বিরক্ত হয়ে বললে, সাক্ষাৎকার কী নিয়ে হয় তা জানো না? এই আপনি কোথায় জন্মেছেন, পড়াশুনা কী করেছেন, আপনার বাড়িঘর কোথায়, কে আছে সেখানে কী খেতে ভালবাসেন!

এইসব নিয়ে বকিয়ে ঘনাদাকে জ্বালাতন করবে? আমরা ঘোর আপত্তি জানিয়ে বললাম, এ সাক্ষাৎকারে ওদের লাভ কী?

লাভ—যাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হল তাঁকে নিয়ে বিনা খরচে অতি সহজে কাগজের খানিকটা পাতা ভরানো। গৌর তেতো গলায় বোঝালে, আজকাল এই এক নতুন কায়দা হয়েছে কাগজের কদর বাড়াবার। যাদের লেখা জোগাড় করা শক্ত তাদের সাক্ষাৎকার নাও। না দিয়ে পার পাওয়া সহজ নয়।

তা যে নয়, নীচের চেঁচামেচির মাত্রা চড়ে যাওয়া থেকেই তা তখন বোঝা যাচ্ছে। নীচে থেকে নানা পর্দার গলায় ডাক আসছে, ও মশাই শুনুন না, একবার শুনেই যান না।

কী করা যায় বলো তো, গৌর অসহায় ভাবে আমাদের দিকে তাকাল। ঠিক কী করা যায় ভেবে না পেয়ে আমরাও যখন সমান অসহায় তখন সমস্যাটা যাঁকে নিয়ে উপায়টা তিনিই বাতলালেন।

শোনো হে, শোনো! বলে ঘনাদা আমাদের জানালেন, ওই ইন্টারভিউ-এর জন্যে তিন দল এসেছে বলছ? বেশ ভাল কথা। ওই তিন দলকে একটা প্রস্তাব জানিয়ে বলো তা মানলে ওদেরই—ওরা একটা সাক্ষাৎকার পেতে পারে।

সাক্ষাৎকার পেতে পারে? ঘনাদা নিজেই কথা দিচ্ছেন? উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কী প্রস্তাব, ঘনাদা?

প্রস্তাব এই যে, ঘনাদা ব্যাখ্যা করে শোনালেন, সাক্ষাৎকার আমি এক দলকেই দেব। আর শুধু একটা মাত্র প্রশ্নের বিষয়ে। এখন ওরা নিজেদের মধ্যে ঠিক করুক,

কোন দলের কোন প্রশ্ন নিয়ে ওরা সাক্ষাৎকার চায়। ওরা যদি নিজেদের মধ্যে সে বোঝাপড়া না করতে পারে তাহলে সব সাক্ষাৎকার বাতিল।

ঘনাদার প্রস্তাবটা ভালই ছিল। কিন্তু সেটা যে সত্যি কাজ দেবে তা ভাবিনি। ভেবেছিলাম, নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি করেই তিন দল তাদের সুযোগটা নষ্ট করে করবে।

কিন্তু তা হল না। সবই হারাবার চেয়ে কিছু পাওয়াই যে ভাল বুঝে তিন দল এক হয়ে একটি প্রশ্ন নিয়েই ঘনাদার ইন্টারভিউ নিতে নীচে থেকে আমাদের আড্ডা ঘরে উঠে এল। এদিকে ওদিকে সুবিধা মতো বসে একটু তোতলামি নিয়েই তাদের প্রশ্নটা জানাল।

প্রশ্ন শুনে আমরা খুশিই হলাম বলতে পারি। যা ভয় করেছিলাম সেরকম সৃষ্টি ছাড়া কোনও প্রশ্ন নয়। তার বদলে নিতান্ত সরল সহজ একটা জিজ্ঞাসা। সেটা হল এই যে সারাজীবনে ঘনাদা তো দুনিয়ার অনেক জায়গায় ঘুরেছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্য করেছে তাঁকে কোন জায়গা? সব চেয়ে আশ্চর্য করেছে কোন জায়গা?

ঘনাদা যেভাবে প্রশ্নটা নিজের মুখে আবার উচ্চারণ করে শোনালেন মনে হল উত্তরটা দিতে তাঁকে বেশ ভাবতে হবে।

কিন্তু না। প্রশ্নটা নিজে আউড়ে নিয়ে তৎক্ষণাৎ উত্তরটা তিনি শুনিয়ে দিলেন—ঘুঘুডাঙা।

ঘুঘুডাঙ্গা!

ইন্টারভিউ নিতে আসা দল চুপ তো বটেই, আমরাও একেবারে হাঁ।

আমাদের অবস্থাটা ঠিক মতো অনুমান করে ঘনাদা এবার ব্যাখ্যা করে বললেন, শুধু ঘুঘুডাঙা শুনে অবশ্য বুঝতে কিছু পারবে না। জায়গাটা তেমন দূর কোথাও না হলেও নামকরা কোনও জায়গা নয়। সত্যি কথা বলতে গেলে ঘুঘুডাঙা নামটাই খুব কম লোকের জানা আছে। হাওড়া থেকে লুপ লাইনে যেতে খানা জংশন ছাড়াবার কিছু পর বিরাট একটা ডাঙা পেরিয়ে যেতে হয়। ছোটখাটো ডাঙা তো নয়, মাঝে মাঝে দু-চারটে শাল পিয়ালের পাতলা জঙ্গল নিয়ে ডাঙাটা একনাগাড়ে অমন চল্লিশ-পঞ্চাশ মাইল ছড়ানো। নদী নালা নেই, শুধু এখানে সেখানে লাল কাঁকুরে মাটির ঢিবি নিয়ে জায়গাটার যেন আধা মরুভূমির মতো চেহারা।

এই নেহাত নিষ্ফলা সকল কাজের বার ডাঙা জমিটা আমার চেনা এক খেয়ালি ভদ্রলোক একেবারে জলের দরে শ-দেড়েক বিঘে কিনে সেখানে একটা বাংলো গোছের বাড়ি বানিয়ে ছিল। তার আশা ছিল এই নিষ্ফলা আধা-মরু ডাঙার অনেক নীচে কোথাও কোনও পাতাল-ধারার সন্ধান সে পাবে, আর কল্পনা ছিল যে তাই দিয়ে ওখানে এক নন্দনকানন বানিয়ে তুলবে। ডাঙা জমিটা কিনে বাংলো বাড়িটার অর্ধেক তুলতে তুলতেই খেয়ালি মানুষটা মরে যায়! তার যারা ওয়ারিশন তারা এখন ঘনাদার লোককে জলের দরেই ও সম্পত্তি বেচে দিতে রাজি থাকলেও বহুদিন কোনও খরিদ্দার তাদের জোটেনি। সে সময়টা, শুধু নির্জনতার খাতিরে আমি মাঝে মাঝে সেখানকার সেই আধা তৈরি বাংলো বাড়িটা ভাড়া নিয়ে সেখানে গিয়ে কিছু দিনের জন্য থাকতাম। ও ডাঙা জমি যে প্রথম কিনেছিল সেই খেয়ালি মানুষটি জায়গাটার নাম দিয়েছিল নন্দন। আমিই তা বদলে ঘুঘুডাঙা নাম রেখেছিলাম।

সেবার যখন ঘুঘুডাঙার বাংলোয় যাই তখন বর্ষাকাল শেষ হয়েছে। দেশে সেবার সব জায়গায় বৃষ্টি হয়েছে প্রচুর। শুধু ঘুঘুডাঙা একেবারে খটখটে শুকনো মরুভূমি। আকাশের মেঘগুলো যেন ওই অঞ্চলটা পার হবার সময় জল ঢালতে ভুলে যায়।

তবু শরতের গোড়ায় ওই ধু ধু লাল মাটির ডাঙারও কেমন একটা রূপ যেন খোলে। বিশেষ করে ভোরের আলোয় তার দিগন্ত ছোঁয়া শূন্যতারই একটা আলাদা আকর্ষণ আছে!

অনেক দূরের এক পুরো রেলস্টেশনও নয়, নম্বর দেওয়া হল্ট যাকে বলে, সেইরকম স্টেশনে বিকেলের আগে এক অখদ্যে প্যাসেঞ্জার ট্রেন থেকে নেমে জাদুঘরে রাখবার মতো গোরুর গাড়িতে কখনও মেঠো কাঁচা রাস্তা কখনও সটান উঁচুনিচু এবড়োখেবড়ো পাথুরে ডাঙার ওপর দিয়ে প্রায় দু প্রহর গাড়ি চালিয়ে রাত এগারোটা নাগাদ আমার ঘুঘুডাঙার বাংলো বাড়িতে এসে পৌঁছই। বহু দূরের এক গাঁ থেকে এক মুনিস-চাষি চৌকিদার হিসাবে মাঝে মাঝে এসে এ বাংলোটা দেখাশুনো করে যায়। আগে থাকতে চিঠিতে খবর দেওয়ায় সে এসে হয়তো ঘরদোরগুলো একটু সাফসুফ করে খাটিয়াটাটিয়া পেতে শোবার বিছানাটিছানা একটু ঝেড়ে ঝুড়ে দিয়ে চলে গেছে। রাতের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে আমার জন্য তার থাকার কথা নেই, সে থাকেনি। গোরুরগাড়ির গাড়োয়ানও আমায় পৌঁছে দিয়ে পরের দিন সকালে তার খেপ আছে বলে গাড়ি নিয়ে চলে গেল।

ওই ধু ধু ঘুঘুডাঙার আধভাঙা বাংলো বাড়িতে আমি একেবারে একা।

এই পর্যন্ত বলে ঘনাদা থেমে তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সঙ্গে আমাদের সকলের ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, কী ভাবছ সবাই? এরপর যা দেখব তা আশ্চর্য এক ভূতের কাণ্ডকারখানা? না। যা দেখেছি তা ভৌতিকের চেয়ে আরও আশ্চর্য ব্যাপার, কল্পনাও তার নাগাল পায় না এমন অবিশ্বাস্য রকম অদ্ভুত কিছু।

ঘনাদা আবার একটু থামলেন। আমরা প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে আছি। সারাদিনের ক্লান্তি। ঘনাদা বলতে শুরু করলেন, সঙ্গে আনা খাবারের সামান্য কিছু খেয়ে শুয়ে পড়ার পর কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। ঘুমটা ভোর হতেই বোধহয় ভাঙল। কিন্তু এ কী রকম ভোর! ভোরের আলো এমন সবুজ হল কী করে। হ্যাঁ, সবুজ। একটু বেশি করে হলদে মেশানো একরকম অদ্ভুত সবুজ! বিছানা ছেড়ে এক লাফে উঠে চারিদিকে চেয়ে একেবারে হতভম্ব। এ কোথায় আমি আছি! এখন কি স্বপ্ন দেখছি তাহলে? না, স্বপ্ন নয়। নিজেকে চিমটি কেটে, নাকে সুড়সুড়ি দিয়ে ঘেঁচে পরীক্ষা করে বুঝলাম, আমি পুরোপুরি জেগে আছি। কিন্তু কোথায়? আমার চারিধারে ঘরের দেওয়াল কি মাথার ওপর ছাদ নেই! কেমন যেন কাঁচের মতোই স্বচ্ছ একরকম ঢাকনা। আমি সামনে একটু এগিয়ে যেতেই সে ঢাকনা আপনা থেকেই যেন অদৃশ্য কবজায় উঠে গেল।

কিন্তু তারপর সামনে এ কী দেখলাম? কোথায় সেই ধু ধু করা লাল কাঁকুরে ডাঙা! এ তো যেন বাঁধানো সমুদ্র তীরের খানিকটা। সমুদ্রের রঙ হলুদ মেশানো সবুজ, আর সমুদ্রের ধারে অসংখ্য গুহার মতো ফাঁকওয়ালা বিশাল এক চ্যাপ্টা নিচু দালান যার বিরাট ছাদটা মাপে একটা ছোটখাটো পার্কের মতো। আমাদের পৃথিবীর বড় বড় প্রাসাদের বাইরে কোনও বিশাল ছড়ানো বাগান থাকে—বিশাল ছড়ানো ছাদটা যেন তাই। কিন্তু সে পার্কের মতো ছাদে ওরা কারা? হ্যাঁ, নীচের অগুনতি গুহা-মুখ থেকে উঠেই তো সমুদ্রের জলে সাঁতরে বেরিয়ে আসতে আর সেখান থেকে গুহা-মুখে ঢুকতে দেখা যাচ্ছে ওদের। কিন্তু ওরা কী রকম প্রাণী? চেহারাটা কতকটা ঘেরাটোপে অক্টোপাসের মতো নয় কি? হ্যাঁ, অক্টোপাসই। তবে ঘেরাটোপের ওপরে চকচকে চোখ বসানো প্রকাণ্ড মাথাটার চারিধারে চারটে বাহুঁ, আর বাকি চারটে খাটো ঘাঘরার মত ঘেরাটোপের নীচে। সেগুলোয় ভর দিয়ে তাদের চলাফেরাই শুধু অদ্ভুত নয়, অদ্ভুত তাদের আরও অনেক কিছু। প্রথমত তাদের গায়ের রঙ। পার্কের মতো বিরাট চ্যাপ্টা প্রাসাদের ছাদে কিছু একটা জটলার ব্যাপার আছে বলে মনে হয়! অসংখ্য ঘেরাটোপ জড়ানো অক্টোপাস সেখানে জড়ো হয়েছে দেখা যাচ্ছে। নীচের সমুদ্র থেকে গুহা-মুখ দিয়ে দলে দলে যেমন আসছে ওপরের আকাশ থেকেও তেমনই বড় বড় বাদুড়ের মতো প্রাণীর পিঠে সওয়ার হয়ে আসছে আরও অনেকে। শুধু বাদুড়ের পিঠে চড়ে আসাটাই আশ্চর্য নয়। আশ্চর্য তাদের গায়ের রঙও। নীচের ছাদে যারা জড়ো হয়েছে তাদের মধ্যে চারটে নীল হলদে থাকলেও অধিকাংশই সবুজ রঙ-এর। কিন্তু হাঁসে চড়ে যারা আসছে ওরা সবাই ফিকে লাল। মনে হচ্ছে একটা খুব বড় গগাছের সমাবেশ এখানে হচ্ছে। কিন্তু কাদের সমাবেশ? কারা এরা? স্বপ্ন যদি না হয় তাহলে এ কী দেখছি।

হঠাৎ কপালে কী একটা ঠাণ্ডা ছোঁয়ায় চমকে উঠে দেখলাম ঘেরাটোপ জড়ানো এক অক্টোপাস মূর্তি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার মাথার ওপর থেকে কপালের দুধারের রগে কী একটা এঁটে দিয়েছে।

প্রথমে একটু মাথা ঝিম ঝিম। তারপরই স্পষ্ট শুনতে পেলাম, ভয় পেয়ে নাযা তোমার মাথায় পরিয়ে দিয়েছি তাতে, তোমার নিজের ভাষা যা-ই হোক, আমাদের সব কথা তুমি নিজের ভাষাতেই স্পষ্ট বুঝতে পারবে। এ কোনও অণুবশ যন্ত্রট নয়। যে যেখানকারই হোক, তোমার মতো বুদ্ধিমান প্রাণীর মস্তিষ্কের যে-অংশের বিশেষ ক্ষমতায় পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের কৃত্রিম ভাষা মূল যথার্থ অর্থে অনুবাদ হয়ে যায়, আমাদের দুজনের মস্তিষ্কের সেই অংশই এ-যন্ত্রে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এই জুড়ে দেওয়ার দরুন তোমার কথা আমি, আর আমার কথা তুমি ঠিক যেন নিজেদের ভাষায় বলা কথার মতোই বুঝতে পারছ। এখন তোমার মনে যে প্রশ্ন একটা উঠেছে তার উত্তর আগে দিচ্ছি, শোনো। তুমি যা দেখছ তা সত্যই এই জগতের এক মহাসমাজ। এ জগতের সব প্রান্তবাসী আমাদের সব জাতি উপজাতির প্রতিনিধি এখানে এ-জগতের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক চরম সিদ্ধান্ত নিতে চায়। আমাদের হাতে সময় বেশি নেই। তোমার মনের অন্য ক-টি প্রশ্নের উত্তর সংক্ষেপে আগে দিয়ে নিচ্ছি। হ্যাঁ, তুমি যা ভেবেছ তাই। তোমাদের জগতের ফাইলাম মোলাস্ক-এর অক্টোপাসের মতো প্রাণীই এখানে সভ্যতার সবচেয়ে উঁচু ধাপে পৌঁছেছে। তোমাদের পৃথিবীতেও এই ফাইলাম মোলাস্ক-এর অক্টোপাস-এর মতো প্রাণীর মধ্যেও অনেক সম্ভাবনা যে আছে। তাদের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং প্রকাণ্ড মাথায় বুদ্ধিটুদ্ধির পরিচয় থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। সময় নেই তাই সে কথা এখন থাক। আমাদের এই মহাসমাবেশ কী জন্য তাই বলি। তোমাদের দেশের বাদুড়ের মতো প্রাণীর পিঠে চড়ে আমাদের একদল প্রতিনিধিকে আসতে দেখে তুমি অবাক হয়েছ। ভাবছ বাহন হিসেবে বেগবান যন্ত্র উদ্ভাবন করতে পারিনি বলেই আমরা আদিমকালের মতো অন্য প্রাণীই বাহন হিসাবে ব্যবহার করি। না, তা নয়। আমরা যন্ত্রবিদ্যায় প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছে, যে বিজ্ঞান পরমাণু-বোমা দিয়ে সৃষ্টি ধ্বংস করতে চায়, তা রোধ করার প্রতিজ্ঞা নিয়েছি। আজকের মহাসমাবেশও তাই নিয়ে। সময় নেই, নইলে আমাদের সব জাদুঘরে পারমাণবিক যুগের সমস্ত আশ্চর্য যন্ত্র তোমায় দেখাতাম। সেগুলো বাতিল করে এখন জাদুঘরে রাখা হয়েছে। আমাদের একদল এখন আর-সব যন্ত্র, এমন কী এই আমার ঘেরাটোপের মতো বস্ত্র বোনবার যন্ত্রও, বাতিল করে একেবারে আদিম প্রাকৃতিক অবস্থায় ফিরে যেতে চায়। আর-এক দল কিন্তু যন্ত্রের ওপর রাশ টেনে প্রকৃতির সঙ্গে সুর মেলানো জীবনের সঙ্গে তার একটা সামঞ্জস্য করতে চায়। আমরা আরও পিছিয়ে একেবারে সেই আদিম অবস্থায় ফিরে যাব, না যন্ত্রকে সরল স্বাভাবিক জীবনের সঙ্গে বেঁধে আর এক সভ্যতা সৃষ্টি করব এই প্রশ্নের আজ মীমাংসা হবে। এদিকে সময় যে একেবারে ফুরিয়ে এসেছে সে খেয়াল আমার নেই! আমি

বাধা দিয়ে বললাম, বারবার তুমি সময় নেই সময় নেই বলছ কেন বলো তো! কীসের সময় নেই।

সময় নেই আমাদের আলাপের। মাথার ভেতর শুনলাম, যা তুমি দেখছ শুনছ এসব কোথা থেকে কী করে সম্ভব হল তুমি নিশ্চয় ভাবছ। শোনো, তুমি যা দেখছ তা এক আশ্চর্য অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কালো ফুটোর জগতের মানুষ তুমি সাদা ফুটোর ভেতর দিয়ে আর-এক বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ব্যাপার দেখতে পাচ্ছ। কালো ফুটোর কথা তুমি ভাল করে জানো। তোমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তোমাদের মাঝে প্রতি সেকেন্ডে ১৮৬০০০ মাইল যে-আলোর গতি সেই আলো লক্ষ কোটি বছরে যা পার হতে পারে না, তোমাদের সেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাইরে আরও বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যে থাকতে পারে, তোমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কালো ফুটো থেকেই তার কিছু আভাস তোমরা বোধহয় পেয়েছ। কালো ফুটো এমন এক প্রচণ্ড মাধ্যাকর্ষণের গর্ত যেখানে মাধ্যাকর্ষণের টানে কাছাকাছি গ্রহ তারা সব কিছু এমন তলিয়ে যায়

যে সেখান থেকে আলো কি বেতার তরঙ্গও বাইরে আসতে পারে না।

গ্রহ নক্ষত্রের মতো সব কিছু যার মধ্যে তলিয়ে যায় সেই ফুটোর মধ্যেই কি তারা জমা হয়ে থাকে? না আর-এক দিকে আর-এক ফুটো আছে তাদের বার হবার? সেই রকম সাদা ফুটোর কথা যারা অনুমান করেছেন তাঁরা ভুল করেননি। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে অন্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যোগাযোগের এমনই কালো ফুটো আর সাদা ফুটো সত্যি আছে।

বিশ্ব নয়, নিখিল ব্ৰহ্মাণ্ডই বলি। সেই নিখিল ব্রহ্মাণ্ডের কোনও অজানা নিয়মে কিছুক্ষণের জন্য তোমাদের ব্রহ্মাণ্ডের সাদা ফুটো দিয়ে অন্য জগতের কিছুক্ষণের যোগাযোগ সম্ভব হয়েছে। তিন ডাইমেনশন বা মাপের জায়গায় চারের কি পঞ্চম ডাইমেনশন-এর কল্যাণে কিছুক্ষণের জন্য এক জায়গায় পরস্পরকে দু জগৎ ছুঁয়েই ফেলেছে। কিন্তু সে শুধু সামান্য একটু সময়ের জন্য। ওই দেখো, এখনই সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। বিদায় ক্ষণিকের বন্ধু, বিদায়।

মাথার ভেতর শব্দতরঙ্গ যেমন থামল, অদ্ভুত রঙের জগৎও তেমনই কিছুক্ষণের জন্য ঝাপসা হয়ে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। কই, কোথায় সেই সবুজ আলোর সভা অক্টোপাসের দেশ? এ তো সেই ধু ধু লাল মাটির মরু প্রান্তর।

আর আমি কি বিছানায় শুয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম? না, তা তো নয়, আমি ভাঙা বাংলোর বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছি। যা দেখছি কিছু তাহলে মিথ্যে নয়!

ঘনাদা চুপ করলেন।

সাক্ষাৎকার নিতে আসা একজন জিজ্ঞাসা করল, আপনার দু কপালে সাঁটা। যন্ত্রটা—সেটা খুলে নিয়ে গেছিল তো?

কিছু না বলে ঘনাদা শুধু ঠোঁটের ওপর তর্জনীটা চাপা দিলেন।

শিবু ব্যাখ্যা করে বলল, আপনাদের শুধু একটা প্রশ্ন করারই অনুমতি ছিল সেটা ভুলবেন না।

ঘনাদাকে কী করে পেলাম

একটা প্রশ্ন প্রায়ই শুনতে হয়।

ঘনাদাকে কোথায় পেলেন?

কোথায় আবার? পেয়েছি নিজেরই মধ্যে, আপনাদের সকলের মধ্যেও।

বলাই বাহুল্য, উত্তরটা সকলকে খুশি করে না। কিন্তু কথাটা নির্ভেজাল সত্যি নয় কি?

আজ বলে নয়, মানুষের মুখে যখন থেকে কথা ফুটেছে তখন থেকেই বাহাদুরি নিতে বাড়িয়ে বলা বানিয়ে বলা তার শুরু হয়েছে, সন্দেহ নেই। সেই কোন আদ্যিকালে প্রথম যে গোদা লেজ-খসা গেছে বাঁদর গাছের ডাল ছেড়ে মাটিতে নেমে একটু খাড়া হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করে দু-এক পা হেঁটেই মাটিতে কেতরে পড়েছিল, সেও বোধহয় তার সঙ্গী-সাথীদের কিছু অঙ্গভঙ্গি আর কিচির-মিচির ঘোঁৎঘোঁতানি দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল যে চার পায়ের বদলে দু পায়েই সোজা হয়ে দাঁড়ানো আর হাঁটা তার কাছে দাঁত কিড়মিড়ির মতোই সোজা।

ঘনাদাকে পাবার জন্যে খুব বেশি খোঁজাখুঁজির হয়রানি তাই হয়নি। মানুষের চিরকেলে স্বভাবই নতুন কালের ধড়াচূড়া পরে ঘনাদা হয়ে বেরিয়ে এসেছেন।

তা, ঘনাদা তো আসর জমাতে খাস ভূমিকায় নিজেই মুল গায়েন হয়ে বিজ্ঞানের ধোঁয়ায় ফাঁপানো সব গালগল্প শোনান। তারপর আবার তস্য তস্য কী ও কেন?

দুকথায় সহজ করে বলতে চাইলে বলতে হয়, প্রথমটায় বিজ্ঞানের রহস্য যদি প্রধান হয় তাহলে দ্বিতীয়টায় ইতিহাসের।

ঘনাদার নিজের বাহাদুরি গল্প লিখতে লিখতে মাঝে মাঝে তস্য তস্য নিয়ে মাতবার আসল কারণটাও তাহলে কবুল করি।

আসল কারণ হল এই যে, নিজের যা ভাল লাগে, নিজে যাতে যা আনন্দ পাই স্বাভাবিকভাবে পাঠকদেরও করতে চাই তার ভাগীদার।

আবিষ্কার উদ্ভাবন আর সন্ধানের দুঃসাহসিক বৈচিত্র্যে আমাদের এই শতাব্দীর প্রথম থেকেই বিজ্ঞানের রহস্য রোমাঞ্চ উত্তেজনায় স্পন্দমান।

নিজে যা অনুভব করি বিজ্ঞানের জগতের সেই রহস্য রোমাঞ্চ বিস্ময়ের স্বাদ পাঠকদেরও কিছু দিতে পারি কি না দেখবার জন্যই একটু কৌতুকের সুর মিশিয়ে ঘনাদাকে আসরে নামানো।

বিজ্ঞানের মতো ইতিহাসের রহস্য রোমাঞ্চ উত্তেজনা বড় কম নয়, তার প্রত্যক্ষ স্বাদ নিতে আর দিতে কার শরণ নেব? সত্য যেখানে কল্পনার চেয়েও বিস্ময়কর ও বিশ্বাসের অতীত, পৃথিবীর ইতিহাসের সেই সব আশ্চর্য অধ্যায়ের জীবন্ত পরিচয় পাবার জন্য এবারে ফিরে গেলাম তস্য তস্য অর্থাৎ ঘনাদারই নানা ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষদেরই কাছে।

–প্রেমেন্দ্র মিত্র

ঘনাদার বাঘ

শিবু প্যাঁচটা ভাল কষেছে।

ক-দিন ধরে হাওয়াটা বেয়াড়া বইছিল।

বাহাত্তর নম্বরের সময়টা এরকম মাঝেমধ্যে একটু আধটু যায় না এমন নয়। যা কিছু করি, গুমোট যেন আর কাটতে চায় না। টঙের ঘরে তাঁকে তখন কিছুতেই বাগ মানানো যায় না। কখনও তিনি কোনও কিছু ঘোষণা ছাড়াই পূর্ণ অসহযোগ চালিয়ে ন্যাড়া ছাদের সিঁড়িতে তাঁর বিদ্যাসাগরি চটি ছোঁয়ানই না। আবার কখনও সকাল বিকেল দুবেলা আমাদের সঙ্গে ওঠবোস করেও মুখে যেন কুলুপ দিয়ে রাখেন। কুলুপ খোলাতে মোগলাই চাইনিজ ফরাসি কতরকম রসুইয়ের কেরামতি যে লাগে তার হিসেব দেওয়া শক্ত।

কিন্তু এবার অবস্থাটা একেবারে আলাদা। আমাদের সেই টঙের ঘরের তিনি নন, তাঁরই চেহারা জাল করে আর যেন কে আমাদের বাহাত্তর নম্বরের উপর ভর করেছেন। চেহারা এক, কিন্তু ভাবগতিক ধরনধারণ সব যেন আলাদা। খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে তো সে মানুষের পছন্দ অপছন্দের কোনও হদিসই পাওয়া যাচ্ছে না।

যা রাবড়ি পাকিয়েছে দেখে এলাম মোড়ের মিঠাইওয়ালা—আমি হয়তো ক-দিন ধরে চপ কাটলেট কাবাব চিনা-চপসুয়ে ইত্যাদি হার মানবার পর বাইরে থেকে প্রায় হাঁফাতে হাঁফাতে এসে ফলাও করে বর্ণনা করেছি। আমার রসালো বর্ণনা আরও মারাত্মক করে তোলবার জন্য গৌর যেন আমার ওপর খাপ্পা হয়ে ভেংচি কেটে বলেছে, রাবড়ি পাকিয়েছে মিঠাইওয়ালা, তুমি দেখে এলে! তাতেই আমরা কৃতার্থ হয়ে গেলাম, কেমন!

কেন? কেন? আমি যেন বোকা সেজে অত্যন্ত ক্ষুণ্ণ হয়ে বলেছি, গণেশ হালুইকরের সদ্য উনুন থেকে নামানো রাবড়ির কড়াইয়ের ভুরভুরে গন্ধে সারা মিঠাইপাড়া মাত হয়ে গেছে। তাই দেখে এসে আমার বলাটা কী অন্যায় হয়েছে,

শুনি?

দোষের এই হয়েছে যে, শিশির গৌরের হয়ে কাটা ঘায়ে নুন ছড়িয়ে বলেছে, তোমার বর্ণনা শুনে আমাদের এখন বুক চাপড়ানো ছাড়া আর কিছু করবার নেই। গণেশ হালুইকরের রাবড়ির কড়াইয়ের বর্ণনা দিতে হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে আসার বদলে দু-কিলো কিনে আনতে পারলে না। গণেশ হালুইকরের রাবড়ির কড়াই একবার ভিয়েন থেকে নামবার পর কতক্ষণ দোকানে পড়ে থাকে। এতক্ষণে কড়াই চাঁছাপোছা হয়ে সব বিক্রি হয়ে গেছে দেখো গিয়ে! তবু পাঠিয়ে দেখি একবার বনোয়ারিকে, কী বলেন ঘনাদা?

শেষ কথাগুলো ঘনাদার দিকে চেয়ে যেন তাঁর অনুমতি নেওয়া।

কী বলেছেন তাতে ঘনাদা? অনুমতি দিয়েছেন, না জানিয়েছেন আপত্তি?

কী যে করেছেন সেইটে বোঝাই শক্ত।

আপত্তি ঠিক করেছেন তা বলা যায় না, কিন্তু যা বলেছেন, সেটাকে সানন্দ না হোক, কোনওরকম অনুমতিই বলা চলে কি?

নিজের মৌরসি আরামকেদারায় বসে হাতের কাগজটা থেকে মুখ না তুলেই নির্লিপ্ত গলায় তিনি বলেছেন, রাবড়ি আনাবে? তা ইচ্ছে হয়, আনাও। আর কিছু না হোক গায়ে চর্বি জমবে, ভুঁড়ি বাড়বে। মানে—

ঘনাদাকে আর কিছু বলতে হয়নি। তিনি পরের কথাটা আরম্ভ না করতেই মেজাজটা বুঝে নিয়ে শিবু চাল বদলে ফেলেছে।

রাবড়ি খাবে, রাবড়ি? সে আমাদের ভেংচিয়ে বলেছে, রাবড়ি খায় কারা? যত নিষ্কর্মা পেটুক। রাবড়ি খায় আর কুমড়োপটাশ হয়ে একদিন ফুটিফাটা হয়ে মারা যায়। না, না, ওসব রাবড়ি-টাবড়ি বাহাত্তর নম্বরে আর চলবে না।

ওদিকে কোপ্তা কাবাব মোগলাই পরোটাও নয়, আবার তার বদলে রাবড়িও না। তাহলে চলবেটা কী? সে জিজ্ঞাসাটা জিভের ডগায় এলেও কেউ আর আমরা করিনি। যাঁর জন্য এত পাঁয়তারা সেই তিনিই হঠাৎ কী যেন একটা অত্যন্ত দরকারি কথা মনে পড়ায় ব্যস্ত হয়ে উঠে ন্যাড়া ছাদের সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়েছেন।

 

ওদিকে যাচ্ছেন কোথায়, ঘনাদা? আমাদের ব্যাকুল প্রশ্ন যেন ভাল করে শুনতেই না পেয়ে কী একটা অস্পষ্ট জবাব দিয়ে ন্যাড়া ছাদের সিঁড়ি বেয়ে তাঁর টঙের ঘরে চলে গেছেন।

তা চলুন। মুশকিল আসানের চাবিকাঠি আমরা বোধহয় পেয়ে গেছি। অন্তত শিবুর তা-ই ধারণা। টঙের ঘরে উধাও হবার পর সেদিনই আড্ডাঘর থেকে তার নিজের কামরায় নিয়ে গিয়ে চাপা গলায় হলেও কেল্লাফতের মতো উত্তেজনা নিয়ে বলেছে, আর বোধহয় ভাবনা নেই। এবারকার ফুসমন্তর মনে হচ্ছে পেয়ে গেছি।

এবারকার ফুসমন্তর? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছি। সে আবার কী?

সে আবার কী বুঝিয়ে বলতে হবে? শিবু আমার বুদ্ধির স্থূলতায় হতাশ হয়ে বলেছে, ওঁর মেজাজ তাতিয়ে সুরে বেঁধে টঙ্কার ছাড়াতে কখন কী মোচড় লাগে তার ঠিক আছে? ওই মোচড়কেই বলছি ফুসমন্তর। কখনও তা কুলপির বদলে গরম কফি, আবার কখনও রাবড়ির বদলে মাথা না ঘামানো কিছু মানে অ্যাকশন। হ্যাঁ, এবারের ফুসমন্তর হল তাই।

তা সেই ফুসমন্তরই শিবু প্রয়োগ করল পরের দিন সকালে। দিনটা ছিল রবিবার। তাই সকাল থেকেই আমরা যথাস্থানে জমায়েত হয়েছি। টঙের তিনি আসতে একটু দেরি করে আমাদের উদ্বেগ বাড়ালেও শেষ পর্যন্ত উদাস উদাস কেমন একটু অন্যমনস্কভাবে নিজের মৌরসি চেয়ারটি দখল করেছেন। আসরটায় নেহাত ছাতা না ধরে যায় সেইজন্য আমরা ফুটবল নিয়ে হাওয়া গরম রাখবার চেষ্টা করতে করতে শিবুর নাটকীয় প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করছি।

কিন্তু কোথায় শিবু? ফুটবল আর স্টেডিয়াম নিয়ে ঝগড়ার সব পুরনো খোঁচাখুঁচিগুলো যখন প্রায় ফুরিয়ে এসেছে তখন শিবু এসে ঘরে ঢুকেছে সত্যিই নাটকীয় ভাবে।

তবে তার প্রবেশের চিত্রনাট্যটা একটু আলাদা বলে প্রথমে একটু ভড়কেই যে গেছলাম তা অস্বীকার করব না।

ঠিক ছিল যে ফুটবল নিয়ে আমাদের নকল ঝগড়ার মাঝে শিবু একেবারে ঝড়ের মতো ঘরে এসে ঢুকে একপাক নেচে নিয়েই—তারপর ঘোষণা করবে—মার দিয়া! মার দিয়া কেল্লা।

কী মার দিয়া? কোন কেল্লা আবার মেরে এলে? আমাদের গলায় উঠবে সন্দিগ্ধ জিজ্ঞাসা। আবার তোমার সেই বাহাত্তর নম্বরের বদলে নতুন কোনও বাসা-টাসার খোঁজ নয় তো?

না, না—শিবু আমাদের আশ্বস্ত করে জানাবে—নতুন বাসা-টাসা নয়, বাহাত্তর নম্বর ছেড়ে খাস অমরাবতীর জোড়া ফ্ল্যাট পেলেও যে কেউ তোমরা নড়বে না তা জানি। ওসব কিছুর বদলে কোন কেল্লা ফতে করেছি একটু আন্দাজ করো তো দেখি?

এরপর প্যারিসের ভারত মেলায় যাবার ফ্রি টিকিট থেকে স্বয়ং পেলেকে একদিন বাহাত্তর নম্বরে এনে খানাপিনা করানো পর্যন্ত আন্দাজ করে হার মানবার পর শিবু তার কেল্লা ফতেটা ব্যাখ্যা করে আমাদের অবাক করে দেবে এই ছিল কথা।

তার জায়গায় শিবুর একী নাটকীয় প্রবেশ! সে যেন পালহেঁড়া হালভাঙা নৌকোর মতো কোনওরকমে বন্দরে এসে ভিড়ে মুখ থুবড়ে পড়ে হতাশ গলায় বলেছে, না, আর হল না।

সিনারিও বদলেছে। কিন্তু পরের সংলাপটা আপনা থেকেই মুখে এসে গেল। সত্যি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কী, হল না-টা কী?

সে আর বলে কী হবে? শিবু একটু বেশি পাঁয়তারা কষে বললে, যা সুবিধেটা হয়েছিল!

কী সুবিধেটা হয়েছিল, কী? ভান না করে বিরক্তি নিয়েই এবার বললাম, অত ধোঁয়া-টোঁয়া না ছেড়ে সাফ কথাটা বল দেখি।

সাফ কথা বলব? শিবুর যেন বলতে গিয়ে গলা ধরে এল দুঃখে। সাফ কথাটা হল, সুন্দরবন।

সুন্দরবন! আমরা সত্যিই হতভম্ব। সুন্দরবনে আবার কী?

সুন্দরবনের ব্যাঘ্র প্রকল্পের নাম শুনেছ! শিবু যেন আমাদের ওপরেই গরম হয়ে বলেছে, লাট-বেলাট হলেও সেখানে যাবার হুকুম মেলে না। এক কাঠুরে কি মধু-জোগাড়ে সেখানে যেতে পারে প্রাণ হাতে নিয়ে, গেলে অবশ্য প্রাণটি তার হাতেও বেশিক্ষণ থাকবে না। কাঠ কাটতে কি মধু জোগাড় করতে যারা যায় তারা যাবার আগে নিজেদের শ্রাদ্ধ-টাদ্ধ সেরেই যায় বলে শুনেছি। সরকারি বনবিভাগের তাই সেখানে কড়া পাহারা। অনুমতি না নিয়ে কেউ যেন সেখানে না যায়, আর অনুমতি কেউ যেন না পায় সেদিকেও কড়া নজর।

শিবুর নতুন চালটা এতক্ষণে কিছুটা বুঝে ফেলেছি। তাই সবজান্তার চালে বললাম, তা কড়া নজর তো হবেই। দুনিয়া থেকে বাঘ প্রাণীটা যাতে লোপ না পায় তাই জন্যেই এই ব্যবস্থা। বাঘ যেখানে গিজগিজ করত সেই সুন্দরবনে বাঘ মাত্র এখন এই কত—মানে বড় জোর কত হবে—এই ধরো হাজারখানেক।

এদিক থেকে নাসিকাধ্বনির মতো একটা যেন শব্দ শুনলাম, সেটা ঘনাদারই কি

তা বোঝবার আগেই শিবুর ভেংচিকাটা ঠাট্টা শোনা গেল—হাজার-হাজার! সুন্দরবনে হাজার দু-হাজার বাঘ! প্রমাণ করতে পারলে রয়্যাল জুয়োলজিক্যাল সোসাইটির সভ্যপদ তো বটেই, চাইকী প্রাণীতত্ত্বে নোবেল প্রাইজও পেয়ে যেতে পারিস।

মারটা এবার ইংরেজিতে যাকে বলে বিলো দ্য বেল্ট মানে কোমরের নীচে হয়ে যাচ্ছে না? চটে উঠেই বললাম, হাজার দু-হাজার না তো কত, তুই জানিস? ঠিক কি কেউ জানে, না জানতে পারে?

হ্যাঁ, পারে, আর পেরেছে। শিবু এবার আসর জমিয়ে বললে, বারো বছর আগে উনিশশো তিয়াত্তরে সুন্দরবনে বাঘ কত ছিল জানো? মাত্র একশো পঁয়ত্রিশ। হ্যাঁ, খুশি মতো অবাধ শিকার করার অত্যাচারে বাঘ তখন প্রায় লোপ পেতে বসেছে পৃথিবী থেকে। বাঘ তো শুধু এশিয়ারই প্রাণী। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেই সাইবেরিয়া থেকে এই দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বর্মা মালয় থেকে সুমাত্রা ফিলিপাইন ইত্যাদি দ্বীপে। যা আছে তাও ধীরে ধীরে লোপ পেয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে এখানেও, যা তাদের আসল আস্তানা সেই ভারতবর্ষেই।

শিবুর বক্তৃতার দিকে কানটা রাখলেও আড়চোখের দৃষ্টিটা আছে ঘনাদার দিকে, কখন তিনি শিবুর মাতব্বরির মাপসই জবাবটা দেন।

কিন্তু কই? তিনি তো বেশ নির্বিকারভাবে চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে সিগারেট টেনে যাচ্ছেন।

শিবুর প্যাঁচটা কি তাহলে ভেস্তে গেল? না, তার পটকার বারুদ ভিজে। ভাল করে ধরতে চাইছে না।

শিবু তখন বলে যাচ্ছে, হ্যাঁ, এই ভারতবর্ষে বারো বছর আগে মোট মাত্র এক হাজার আটশোটি বাঘ ছিল। তা-ও সেই ১৯৫৫-র গোড়ায়। বন্দুক হাতে পেলেই ট্রিগার টানার আঙুল সুড়সুড় করা এক খ্যাপা শিকারির গুলিতে ত্রিশ-ত্রিশটা তাগড়া বাঘ মারা যাবার পর মধ্যপ্রদেশের অনেকটা জায়গা ন্যাশনাল পার্ক বলে ঘোষিত হবার পরও—

তা যা সব হবার তা তো হয়েছে, শিবুকে একটু থামিয়ে হুঁশিয়ার করবার জন্যই এবার বলতে হল, কিন্তু সুন্দরবনের কথা হঠাৎ এল কেন? আর নাম করতে গলাটা অমন করুণ হল কীসে?

করুণ হল কীসে? শিবু দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে বললে, হল যে মওকাটা মিলছিল সেট ফসকে গেল বলে।

মওকাটা কী? এবার শিবুর সঙ্গে সঙ্গত চলল আমাদের—ওই সুন্দরবনে যাওয়ার? সে তত ইচ্ছে করলেই যাওয়া যায়। শুধু বনবিভাগ দপ্তর থেকে একটা পাশ জোগাড় করলেই হল।

হ্যাঁ, তাই হয় বটে? শিবু ভারিক্কি চালে বলল, কিন্তু পাশ দেওয়া এখন এক্কেবারে বন্ধ বললেই হয়।

কেন, হঠাৎ এত কড়াকড়ি কেন? আমাদের কৌতূহল।

কড়াকড়ি শুধু ওই কানকাটার জন্য! শিবু প্রায় কাঁপা গলায় জানাল।

কানকাটা? কানকাটা আবার কে?

কে বা কী তা ঠিক কেউ কি জানে? কেউ যে তাকে দেখেছে তাও জোর করে বলতে পারে না, শিবু গলাটা কেমন একটু নামিয়ে বললে, শুধু নানান সব আজগুবি কথা তাকে নিয়ে কানাকানি হয়। সোঁদরবনের জঙ্গলে সে কখন কোথায় হানা দেবে তার কোনও হদিস পাবার উপায় নেই। এই নাকি সেদিন এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটেছে হাঁসখালির চাষিগাঁয়ের মাইল দুয়েক মাত্র দূরে। চার কাঠুরে আর মধু-জোগাড়ে মিলে গাদা-বন্দুক আর কাস্তে বল্লম নিয়ে অতি হুশিয়ার হয়ে ছোট একটা খাল পেরিয়ে ওদিকের লাট অঞ্চলে যাচ্ছিল। খালটা নেহাত ছোট, হাঁটুজলও হবে না। সেইটুকু পার হয়ে ওদিকে শুকনো ডাঙায় উঠে সবাই একেবারে থ। ছিল তারা চারজন। চারজন একসঙ্গে খালে নেমেছিল, তা আর-একজন গেল কোথায়? তা খালে চোরাবালি কি গাঢ়াগর্ত নেই যে তলিয়ে যাবে। কুমির নেই যে টেনে নিয়ে যাবে। আর তা নিলেও ঝটপটানির আওয়াজ পাওয়া যেত! সাড়া নেই, শব্দ নেই, হঠাৎ একটা মানুষ হাওয়া হয়ে গেল কী করে?

এ সেই কানকাটা ছাড়া আর কেউ নয়। মুখ দিয়ে ভয়ে না বার হোক, সকলের মনে সেই এক কথা। কানকাটা মানে সোঁদরবনের সেই দুশমন শয়তান যাকে চোখে কেউ দেখেছে কি না ঠিক নেই। কিন্তু ওই কানকাটা বর্ণনাটাই কেমন করে তার সঙ্গে জুড়ে গেছে। কানকাটা বলতে যে ভয়ংকর এক প্রাণীর মুখের ইঙ্গিত দেওয়া হয় সেটার সঙ্গে নাকি বাঘেরই কিছু মিল আছে। মিল চেহারায় একটু থাকলেও আর-কিছুতে নয়। এ শয়তান দুশমন নাকি যেখানে যখন খুশি দেখা দিতে পারে। জমিতে নাকি তার থাবার দাগ পড়ে না। ছায়াও পড়ে না কোথাও তার শরীরের।

এই কানকাটার যে সব ভয়ংকর ব্যাপারের কথা সুন্দরবনের এক অঞ্চলে মুখে মুখে ফিরছে তা আজগুবি গল্প,না তার মধ্যে কিছু সত্য আছে এখনও স্থির করতে না পারলেও আমাদের বনবিভাগের সাবধানের একটু কড়াকড়ি বাড়াতে হয়েছে, এই হয়েছে। মুশকিল। শিবু শেষ কথাগুলি বলে যেন হতাশ হয়ে থামল। না, আজ শিবুকে সত্যিই বাহাদুরি দিতে হয়। এতক্ষণ ধরে আসর দখল করে রাখলেও সে খেলাটা সাজিয়েছে। ভাল। এখন আমরা ঠিক মতো দু-একটা খুঁটি নাড়তে পারলেই বাজিমাত হতে পারে।

শিবুর এগিয়ে দেওয়া খুঁটিটাই তাই নাড়লাম। বললাম, কড়াক্কড়ি বাড়িয়েছে, মুশকিল তো এই? পাশ দেওয়া বন্ধ তো করেনি? তা কড়াকড়িটা কী বাড়িয়েছে? কী তারা চায়, কী?

কী চায়? শিবুর গলায় গভীর হতাশা। তারা চায় সঙ্গে একজন শিকারি নিতে হবে।

হাসব না কাঁদব এমন গলায় বললাম, এই শুনে তুই এমন একটা মওকা নষ্ট করে এলি? একটা শিকারির অভাবে?

না হে, না। শিবু যেন তার সমালোচনায় জ্বলে উঠে বললে, বন্দুক হাতে পেলেই ঘোড়া টেনে ছুড়তে পারে তেমন শিকারি ভাবছ নাকি! ওরা যা চায় তা অন্য জাতের শিকারি। চোখের দৃষ্টি আর বন্দুকের গুলিতে যার গাঁটছড়া বাঁধা। ডান বাঁ, যে দিকে হোক, যা যখনই দেখে তক্ষুনি তা ফুটো করে দিতে পারে গুলিতে এমন শিকারি ওরা চায়। নইলে ওই কানকাটার তল্লাটে পাঠাবে কোন ভরসায়?

এই ব্যাপার! আমরা এবার অবাক হয়ে শিবুর দিকে তাকালাম-এমন শিকারি দরকার শুনে তুই পিছিয়ে এলি? এমন কারও কথা তোর মনে পড়ল না যে–

অ্যাঃ, ছিঃ ছিঃ—আমাদের কথা শেষ হবার আগেই শিবু লজ্জায় দুঃখে জিব কেটে নিজের কানদুটো মলতে মলতে বললে, হ্যাঁ, তোরা আমার কান দুটো মলে দিতে পারিস। আমার কিনা ঘনাদার কথাটাই মনে হয়নি। ছি–ছি—

থাম! থাম! শিবুর আত্মধিক্কারে বাধা দিয়ে বললাম, তা মওকা তো এখনও শেষ হয়ে যায়নি। ঘনাদাও সশরীরে হাজির। ঘনাদাকে নিয়ে গেলেই তো হয়। কী। বলেন, ঘনাদা?।

প্রশ্নটা সবাই মিলে যাঁর দিকে ফিরে করলাম তাঁর মুখে তখন কোনও ভাবান্তর নেই। ফুরিয়ে আসা সিগারেটটায় শেষ টানের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, সুন্দরবনে যাবার কথা বলছ? হ্যাঁ, শেষ গেছলাম বটে ১৯৭৩-এ। বাঘ তখন সেখানে মাত্র ১৩৫টা। তার পরের বছরই আবার মধ্যপ্রদেশের কানহার ন্যাশনাল পার্কে ভারতের প্রথম ব্যাঘ্র প্রকল্প চালু হওয়ার ব্যাপার দেখতে গিয়ে দেখি, ১৯৫৪-তে যে-প্যাঁচ দিয়ে কানহার ন্যাশনাল পার্কের পত্তন করিয়ে বন্দুক ধরা চিরকালের মতো ছেড়ে দিই বনবিভাগের হিসেবে সেই সাজানো ভুলটা কুড়ি বছরেও ধরা পড়েনি।

দাঁড়ান! দাঁড়ান! আমরা আকুল প্রার্থনা জানিয়ে বললাম, যা বললেন সেই প্যাঁচালো জটে বুদ্ধিশুদ্ধি সব জড়িয়ে গেছে। ধরবার মতো কোনও খেইই পাচ্ছি না। ব্যাপারটা একটু ভাল করে বুঝতে দিন। এই যেমন প্রথম কথা হল, আপনি বন্দুক ছোঁড়া ছেড়ে দিয়েছেন সেই ১৯৫৪-তে! আর এমন একটা প্যাঁচ কষেছিলেন যার দরুন ন্যাশনাল পার্কের পত্তন হলেও বনবিভাগের হিসেবে একটা ভুল থেকে যায়।

নির্বোধের প্রতি অনুকম্পাভরে দুবার মাথা নেড়ে ঘনাদা বললেন, হ্যাঁ, ১৯৫৪-তেই বন্দুক ছোঁড়া চিরকালের মতো ছেড়ে দিই। আর আমার প্যাঁচের দরুন হিসেবের যে ভুলটা সেদিন হয়েছিল বনবিভাগ এখনও তা শোধরাতে পারেনি।

বনবিভাগের হিসেবে ভুল! এবার আমাদের জিজ্ঞাসা—ভুলটা কী?

ভুলটা মোট বাঘের হিসেবের, ঘনাদা জানালেন, ১৯৭২-এ বনবিভাগের মতে কানহাতে বাঘের সংখ্যা হল ১৮০০া ওই অঙ্কটাই ভুল!

তার মানে?—আমাদের সন্দিগ্ধ জিজ্ঞাসা—ওটা যদি ভুল হয় তাহলে ঠিক সংখ্যাটা কত?

ঠিক সংখ্যাটি হল ১৮০২—ঘনাদা যেন অনিচ্ছার সঙ্গে জানালেন—এ ভুল সেই ১৯৭২-এরই নয়, ভুলটা চলে আসছে সেই ১৯৫৪ থেকে। যখন সেই এক খুনে সাহেবের হাতে গণ্ডা গণ্ডা বাঘ মারা যাবার পর দেশময় সোরগোল ওঠার পর মধ্যপ্রদেশের ওই অঞ্চলটা কানহা ন্যাশনাল পার্ক বলে সরকারি ভাবে ঘোষিত হয়। গণ্ডা গণ্ডা বাঘ মারা নিয়ে দেশময় শোরগোল তোলার পেছনে কার কতটুকু হাত ছিল। সে আর ক-জন জানে!

তার মানে? আমরা উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলাম, ওই শোরগোল তোলার মধ্যে আপনিই ছিলেন আর ওই গুনতির ভুলের মধ্যে—

ব্যাপারটা হয়েছিল কী?

ব্যাপারটা এই যে, ঘনাদা যেন নেহাত অনিচ্ছার সঙ্গে বিস্তারিত করে বললেন, তখনকার দিনে এক খুনে মেজাজের সাহেব কল-টল নেড়ে একসঙ্গে একবারে ত্রিশটা বাঘ মারবার লাইসেন্স জোগাড় করেছিল। দুনিয়া থেকে তখনই বাঘের বংশ লোপ পাবার অবস্থা হয়েছে। আজ যেখানে ২৬৪, সেই সুন্দরবনেই বাঘ তখন ১৩৫-এরও নীচে নেমে গেছে। আর বনবিভাগের হিসেবেই যেখানে তিন হাজার বাঘ মধ্যপ্রদেশের সেই কানহায় তখন ১৮০০-রও অনেক কম। দুনিয়ার শিকারি মহলে তো বটেই, সব মানুষদের মধ্যেও বাঘের মতো প্রাণীকে বিলুপ্তি থেকে বাঁচাবার জন্য সংরক্ষণের উপায়ের কথা ভাবা হচ্ছে। সেই সময়ে একটা-দুটো নয় একেবারে ত্রিশ-ত্রিশটা বাঘ খুশি মতো সাবাড়! প্রথমে একটা দুটো থেকে দেখতে দেখতে দেশের সব অঞ্চলের কাগজে এই নিয়ে লেখালেখি শুরু হল। দেশ তখন স্বাধীন। সরকারি মহলে, বিধানসভায়, লোকসভায় প্রশ্ন উঠল এই নিয়ে।

তারপর ক্রমেই ব্যাঘ্র-প্রকল্প শুরু না হলেও মধ্যপ্রদেশের ওই অঞ্চলটা কানহা ন্যাশনাল পার্ক নামে আলাদা করা হল। খুনে মেজাজের সেই ব্যাঘ্রমেধ বিলাসী সাহেবের পাপে শেষ পর্যন্ত কিন্তু সুফলই ফলেছিল ব্যাঘ্র-প্রকল্পের সূত্রপাত হয়ে। মজার কথা এই যে সেই খুনে শিকারি সাহেব কিন্তু তার পুরো লাইসেন্স-এর বরাদ্দমত ত্রিশটা বাঘ মারেনি, মেরেছিল মাত্র আটাশটা।

তাহলে? তাহলে?—আমাদের প্রশ্ন করতেই হল—সরকারি গুনতিতে সেই আটাশটাই লেখা আছে তো?

না। ঘনাদা একটু হেসে জানলেন, সরকারি গুনতিতেই পুরোপুরি ত্রিশটা শিকার করা বাঘের কথাই লেখা আছে। আটাশের জায়গায় ত্রিশ ধরার ওই ভুলের জন্যই বনবিভাগের মোট হিসেবে ওই সংখ্যার ভুল থেকে গেছে।

কিন্তু গুনতিতে অমন ভুল হবে কেন? আমরা নাছোড়বান্দা হয়ে জানতে চাইলাম, বনবিভাগের লোকেরা তো শিকার করা বাঘ না দেখে আন্দাজে সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়নি।

না, তা দেয়নি। ঘনাদা ধৈর্য ধরে বললেন, মিথ্যে করেও কিছু লেখেনি। তারা বনের মধ্যে শিকার করা বাঘ স্বচক্ষে দেখে দেখেই হিসেব লিখেছে।

তা কী করে হয়?—আমরা সন্দিগ্ধ-আটাশের পর আরও দুটো শিকার করা বাঘ এল কোথা থেকে, গেলই বা কোথায়?

কোথা থেকে এল আর কোথায় গেল তা জানে শুধু একজনই।—ঘনাদা হাতের সিগারেটের শেষটুকু ফেলে ওঠবার উপক্রম করলেন।

তাঁকে চেপে ধরে বসিয়ে আর একটা সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে বসিয়ে বললাম, সে একজন তো আপনি বলুন, ওটা কি ম্যাজিক-এর ব্যাপার?

না, ম্যাজিক নয়—ঘনাদা করুণা করে বিশদ হলেন—আমি তখন বারশিঙ্গা হরিণের খোঁজে ওই কানহার জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বারশিঙ্গা হল ডালপালা মেলা শিং-এর এক অপরূপ হরিণ। আজ সরকারি কড়াকড়িতে সে হরিণের সংখ্যা চারশো ছাড়াতে চলেছে আর সেই ১৯৫৪-তে সে হরিণ গোটা পঞ্চাশ-ষাটটা ছিল কিনা। সন্দেহ! বারশিঙ্গার সন্ধানে ওখানকার জঙ্গলে ঘোরার সময়েই ওই খুনে বাঘ শিকারির কথা কানে আসে। ওই জাতের বেপরোয়া খুনে শিকারিদের অত্যাচারে বাঘ বলে প্রাণীবংশটাই যে লোপ পেতে বসেছে তাই নিয়ে সব দেশের সহৃদয় জ্ঞানীগুণী বৈজ্ঞানিক মহলে জোর আন্দোলন চলছে। অবাধ বাঘ শিকার বন্ধ না করলে ভারতবর্ষে এই প্রাণীটি কিছুদিন বাদে আর দেখা যাবে না তাই জানিয়ে সরকারি ওপর মহলে লেখালেখিও কম হচ্ছে না। তারই ভেতর ত্রিশ-ত্রিশটা বাঘ মারবার লাইসেন্স দেবার মতো এমন অন্যায় কী করে হল তা নিয়ে দিল্লি ছোটাছুটিতে তখন কোনও লাভ নেই, আর তার সময়ও নেই জেনে খোদ খুনে শিকারির সঙ্গেই দেখা করবার চেষ্টা করলাম। দেখা করা শক্তও ছিল না। কারণ ত্রিশটা বাঘ মারার হুকুম যে জোগাড় করেছে সে তো শিকারে নয়, যেন ঘটা করে বিয়ে করতে এসেছে এমনই তার সমারোহ। জঙ্গলের মধ্যে চাকর-বাকর-বাবুর্চি-খানসামা নিয়ে তাঁবুই পড়েছে তিনটে। তার মধ্যে বড় তাঁবুটা যেন রাজদরবার।

অন্য দুই তাঁবুর খবরদারির পর সেখানে যাবার তখন অনুমতি পেলাম যেন ভিখিরির মতো। ভেতরে যখন ঢুকলাম তখন শিকারি সাহেব বিকেলের নাস্তা করছেন। সামনের টেবিলে পাখ-পাখালি আর খরগোশ হরিণের মতো হরেক রকম জংলি শিকারের মাংসের সব প্লেট সাজানো। শিকারির হাতে কিন্তু তরল বস্তুর গেলাসই ধরা।

যা শিকার করতে এসেছেন সেই বাঘের মতোই চেহারা। সেই রকমই গলায় আমায় বললে, কী? কী চাস তুই? এই জঙ্গলেও তোদের হাত থেকে রেহাই নেই? এখানেও এসেছিস ভিক্ষে করতে?

হ্যাঁ, ভিক্ষে করতেই এসেছি, সবিনয়ে বললাম, দয়া করে যদি সে ভিক্ষা দেন।

কী? কী ভিক্ষা চাস এই জঙ্গলে? শিকারি সাহেব গর্জন করে বললো।

আজ্ঞে, সবিনয়ে বললাম, শুধু দশটা বাঘ।

দশটা বাঘ! তার সঙ্গে রসিকতা ভেবে সাহেব রাগে প্রায় ফেটে পড়ে আর কী! আমার সঙ্গে চালাকি করতে এসেছিস? আভূভি নিকালো—

দোহাই আপনার হাতজোড় করে একবার বললাম, আমার কথাটা দয়া করে একটু শুনুন। আপনি এ পর্যন্ত কুড়িটা বাঘ মেরেছেন। আরও দশটা মারবার আপনার হুকুম আছে। আমাদের ভারতবর্ষের খাতিরে, বাঘের বংশের খাতিরে ওই দশটা বাঘ আর মারবেন না। ওগুলো দুনিয়াকে ভিক্ষে দিন।

কে কার কথা শোনে? আভি নিকালো হিয়াসে! বলে সাহেব যেন খ্যাপা গণ্ডারের মতোই আমার দিকে তখন ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

সেই ঝোঁকেই তাঁবুর মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ার পর টেবিলে খানার প্লেটগুলো তার গায়ের ওপর ছুড়ে দিয়ে তার গেলাসটার তরল বস্তুও তার ওপর ঢেলে দিয়ে। চলে এলাম।

সাহেব তখন মেঝে থেকে উঠে রাগে চিৎকার করছে, পাকড়ো উসকো, পাকড়ো উ বদমাস কো—

কিন্তু কে পাকড়াবে! জঙ্গলে মিলিয়ে যাবার আগে সাহেবের লোকজন তাঁবু থেকে বেরিয়েছিল বটে, কিন্তু ওই বার হওয়া পর্যন্তই।

সাহেবকে একটু শিক্ষা দিয়ে আসার পর জঙ্গল যেন আমার কাছে বিষ হয়ে উঠল। একদিন যায়, দুদিন যায়, আর সাহেবের, একটা একটা করে নতুন বাঘ শিকারের খবর পাই। রাগে দুঃখে আমার যেন হাত-পা কামড়াতে ইচ্ছে হয়।

এই অবস্থায় বনবিভাগের সদর দপ্তরে গিয়ে দেখা করলাম। তারা যে নিরুপায় তা জেনেও আইন কেউ ভাঙলে তাদের কতদূর এক্তিয়ার তা জেনে নিলাম।

তারপর কিছুদিনের জন্য জঙ্গল ছাড়লাম। ফিরে যখন এলাম তখন সাহেবের সাতাশটা বাঘ মারা হয়ে গেছে। ক-দিন বাদে আটাশটাও পূর্ণ হল। তারপরই বনবিভাগের স্থানীয় কর্তা আর সেপাই সান্ত্রীদের ডেকে শিকার করা বাঘের লাশ দেখালাম।

বনের মধ্যে এক জংলা ঝোপের ধারে শিকার করা বাঘের লাশ পড়ে আছে। খুনে শিকারি সাহেব সেটা তখনও সরিয়ে নিয়ে যাবার সময় পায়নি। সেটার কথা বনবিভাগের দপ্তরে জানায়ওনি।

প্রমাণের জন্য শিকারির মারা বাঘটার পেটের ওপর পা রেখে দাঁড়িয়ে একটা ফটো তোলালাম। বেপরোয়া খুনে হলেও সাহেব যে অব্যর্থ শিকারি তা তার বাঘটার কানের ভেতর দিয়ে নির্ভুল গুলি চালানোতেই প্রমাণ করে বোঝাতে ফুটো কানের যেটা দিয়ে গুলি যাওয়ার দরুন রক্ত ঝরে পড়েছে সেই কানটা টেনে দেখালাম। বাঘটার বয়স বুঝতে তার মুখটা হাঁ করে দাঁতগুলোর অবস্থাও দেখলাম।

এই বাঘটা খুঁজে পাবার দুদিন বাদেই আবার বনবিভাগের অফিসার আর সেপাইদের ডাকতে হল। আবার একটা বাঘের লাশ পাওয়া গেছে। এবার জঙ্গলের আধা-শুকনো ঝিলের ধারে। বাঘের পেছনের দুটো পা ঝিলের কাদা জলের মধ্যে আধ-ডোবা হয়ে আছে।

বাঘের লাশটা দেখিয়ে অফিসারকে একটু অবাক হয়েই বললাম, আশ্চর্য ব্যাপার দেখেছেন। এ বাঘটা যেন আগের বাঘটার ঠিক যমজ। শুধু হলদে কালো ডোরাগুলো আরও স্পষ্ট আর মাথাটা যেন আরও ঘোট। সে অবশ্য মাথায় লোমগুলো এখনও তেমন বাড়েনি বলে। এটার দেখুন কানের ভেতর দিয়ে গুলি গেছে আর

এরপর যা বলে গেলাম অফিসারের তাতে তেমন কান আছে বলেই মনে হল না। বাঘ যে শিকার করা হয়েছে লাশ দেখে তার প্রমাণ পেয়েই তিনি ব্যাপারটা যেন চুকিয়ে ফেলতে পারলে বাঁচেন।

ব্যাপারটা পুরোপুরি চুকোবার ব্যবস্থা তার পরদিনই হল। বনবিভাগের অফিসার আর রক্ষী সেপাই-টেপাই মিলে সেদিন ভোর হবার পরই খুনে শিকারির তাঁবুতে গিয়ে হাজির।

সাহেব তখন সাজগোজ করে শিকারে বার হবার জন্য তৈরি হয়েছে। বনবিভাগের অফিসার, সেপাই আর সেই সঙ্গে আমায় দেখে একেবারে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বললে, ব্যাপার কী? এই সকালে আমাকে বিরক্ত করতে আসার মানে?

মানে আর কিছু নয়, অফিসার আমাদের আগেকার বোঝাপড়া মতো ভদ্রভাবেই বললেন, আপনি এখন কোথায় যাচ্ছেন তাই জিজ্ঞাসা করা।

কোথায় যাচ্ছি তাই জিজ্ঞেস করতে এসেছ? সাহেব একেবারে খাপ্পা হয়ে বললে, তোমরা কি কানা? দেখতে পাচ্ছ না, শিকারে যাচ্ছি?

শিকারে যাচ্ছেন তা দেখতে পাচ্ছি, অফিসার তখন একটু কড়া গলায় বললেন, কিন্তু কী শিকারে সেইটেই জানতে চাই। কারণ আপনার সঙ্গে যে বড় শিকারের ভারী রাইফেল রয়েছে তা নেওয়ার আর কোনও দরকার তো আপনার নেই।

দরকার নেই মানে? সাহেব একেবারে অগ্নিমূর্তি হয়ে বললেন, বাঘ শিকার কি আমি এয়ার গান দিয়ে করব নাকি?

তা কেন করবেন?—অফিসার এখনও ধৈর্যের অবতার—কিন্তু বাঘ শিকারই যে আপনার শেষ হয়ে গেছে!

শেষ হয়ে গেছে মানে! সাহেব পারলে যেন আমাদেরই গুলি করে এমন গলায় বললে, আমি আটাশটা বাঘ মেরেছি। এখনও দুটো আমার বাকি।

অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে বলছি, অফিসার কড়া গলায় বললেন, আপনার গণনা আমরা মানতে পারব না। আপনি যে ত্রিশটা বাঘই মেরেছেন তার প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। সুতরাং দরকার হলে জোর করেই আপনার শিকার আমাদের বন্ধ করতে হবে।

শিকার বন্ধ করবে তোমরা! সাহেব রাগে খেপে গিয়ে হাতের বন্দুকটা সত্যিই আমাদের দিকে তুলেছিল। আমি এক ঝটকায় তার কাছ থেকে সেটা কেড়ে নিতে অফিসার কড়া গলায় বললেন, এই বেয়াদবির জন্য আপনাকে এখনই হাতকড়া পরাতে পারি। কিন্তু তা করব না। আপনি ইচ্ছে করলে দিল্লি থেকে নতুন করে হুকুম আনিয়ে এ জঙ্গলে বাঘ শিকার করতে পারেন। নইলে এখান থেকে আপনাকে বিদায় নিতে হবে।

খুনে সাহেব রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে সেই বিদায়ই নিয়েছিল। আর তারপর আসেনি।

অফিসারকে ধন্যবাদ দিয়ে আমিও কানহার জঙ্গল ছেড়ে এর পর বালাঘাটে গিয়ে যার সঙ্গে দেখা করি তার নাম শশী নায়ার। নায়ারকে থোক হাজার টাকা দিতে গিয়েছিলাম, কিন্তু সে তা নেয়নি।

বলেছিলাম, এ তো আপনার পাওনা, তবু নেবেন না কেন? আপনার সাহায্য ছাড়া এ কাজ হাসিল করতে পারতাম কি!

কাজ তো শুধু আপনার নয়।নায়ার আমার হাত ধরে নাড়া দিয়ে বলেছিল, কাজ সমস্ত দেশের হয়েই করেছি। তার জন্য টাকা নেওয়া আমার পাপ হবে। প্রার্থনা করি আমাদের এই ব্যাপার থেকেই অবাধ বাঘ শিকার বন্ধ হবে।

নায়ারকে সাদরে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, তোমাকে আর কী ধন্যবাদ দেব, নায়ার! তবে তুমি না সাহায্য করলে ওই খুনে শিকারিকে এমন করে জব্দ করতে পারতাম না। তবে তোমার এই উপকারের কথা মনে করে আমিও একটা প্রতিজ্ঞা আজ করছি নায়ার। একমাত্র মানুষখেকো বাঘের বেলায় ছাড়া বাঘ কেন, কোনও শিকার করতেই আর বন্দুক ধরব না।

দুজনে করমর্দন করে পরস্পরের কাছে বিদায় নিলাম। নায়ার তার সঙ্গে তার পোষা তালিম দেওয়া বাঘটাকে অবশ্য নিয়ে গেল। নায়ার ম্যাঙ্গোলোরের এক মস্ত সার্কাস কোম্পানির বাঘ-সিংহের ট্রেনার। কানহার জঙ্গল থেকে ক-দিনের জন্যে ওর কাছেই গিয়েছিলাম দু-চার দিনের জন্য বাঘটা ধার নিতে। এই বাঘটাই নিখুঁতভাবে শিকার করা মরা বাঘের অভিনয় করে আমাদের কাজ হাসিল করে দিল।

ঘনাদা উঠে যেতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তা আর হল না। বনোয়ারি আর রামভুজ তখন দুটো বড় বড় ট্রেতে যেসব গরম গরম সদ্য ভাজা আহার্যের প্লেট নিয়ে ঢুকছে তার গন্ধে সমস্তটা ঘর তখন আমোদিত।

প্রথমে শামিকাবাবের প্লেটটা হাতে তুলে নিয়ে তার প্রতি যথোচিত মনোযোগ দেবার আগে ঘনাদাকে আর একটা জিজ্ঞাসার জবাব দিতে হল।

সুন্দরবন থেকে যা শুরু হয়েছিল কানহার জঙ্গলে শিকারের হিসাব রাখতে তার কথাটা যে ভুলেই যাওয়া হয়েছে সেই কথাটা স্মরণ করিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কিন্তু সুন্দরবনের ওই কানকাটার রহস্যের কোনও জবাব তো মিলল না। জবাব কিছু নেই বোধহয়না ঘনাদা?

আছে! আছে! কাঁটায় গাঁথা কাবাবের টুকরো প্লেট থেকে মুখে তোলার আগে, থেমে, ঘনাদা যত সংক্ষেপে হোক সেরে বললেন, প্রথমত ওই কানটা সোঁদরবনের কেঁদো বাঘের কীর্তি ভূতপ্রেত কি বানানো গল্প নয়। সুন্দরবনের মানুষখেকো বাঘ অমনই আজগুবি ভয়ংকরই হয়। তাদের চলাফেরার কোনও সাড়া পাওয়া যায় না। অমন চার-পাঁচজনের দল থেকে একজনকে কেমন করে সে তুলে নিয়ে যায় পাশের সাথীও তার হদিস পায় না। তবে শিকারির গুলিটুলিতে নয়, এ মানুষখেকোদের ঢিট করবার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এমন শিক্ষা দেবার প্যাঁচ হয়েছে যে মধু-জোগাড়ে কি কাঠুরে কাউকে কোলের কাছে পেলেও তারা না ছুঁয়ে ছুটে পালাবে। উপায়টা হল সুন্দরবনের নানা জায়গায় লোভনীয় টোপের মতো করে কাঠুরে আর মধু-জোগাড়েদের জ্যান্ত মানুষদের মতো মূর্তি রেখে দেওয়া। মানুষখেকো বাঘ লোভে পড়ে একবার সে রকম কোনও মূর্তির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে ইলেকট্রিক শক খেয়ে আধমরা হয়ে ছিটকে পড়বে। এরপর মানুষের চেহারার কোনও কিছুর ধারেকাছে সে কখনও ঘেঁষবে কি! সুন্দরবনে এরকম মূর্তি এখন সারা জঙ্গলে ছড়িয়ে রাখার ব্যবস্থা হচ্ছে।

কিন্তু সেখানে আবার লোডশেডিং থাকবে না তো?

কাবাব গাঁথা টুকরো তখন ঘনাদা মুখে তুলেছেন। তাঁর কাছে কোনও উত্তর পাওয়া গেল না।

মৌ-কা-সা-বি-স বনাম ঘনাদা

ছুটির দিন। দুপুর বেলা খাওয়াদাওয়া শেষ হতে একটু দেরিই হয়। তবু যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি সে পাট চুকিয়ে ঘনাদা তাঁর খাওয়া সেরে নিজস্ব সেই চিলেছাদের টঙের ঘরে উঠে যাওয়ার পরই সবাই একসঙ্গে দোতলার সিঁড়ির বাঁকে শিশিরের ঘরে গিয়ে জমায়েত হয়েছি।

জমায়েত যে হয়েছি তা ঠিক খোশ-মেজাজ নিয়ে গুলতানি করবার জন্য নয়। তার বদলে রীতিমত একটা লজ্জা আর অপমানের জ্বালা নিয়ে।

লজ্জা আর অপমানের জ্বালাটা যা নিয়ে তার ব্যাপারেই শিবু তখন নীচের খাবার ঘরে খাওয়া শেষ করার পর আমাদের সঙ্গে ওপরে না এসে বাইরের গেটের পাশের লেটারবক্স হাতড়াতে গেছে আর আমরা শিশিরের ঘরে এসে জড়ো হয়ে অধীর আগ্রহে তার জন্য অপেক্ষা করছি।

অপেক্ষা বেশিক্ষণ করতে হল না। মিনিট দশেকের মধ্যেই শিবু এসে হাজির হল, কিন্তু যে চেহারা নিয়ে সে দেখা দিলে তাতে, ফলাফল সম্বন্ধে কোনও সংশয়ের অকাশ না থাকলেও হতাশ কণ্ঠেই জিজ্ঞাসা না করে পারলাম না—কী আজও কিছু নেই?

থাকবে না কেন, শিবু হতাশ কণ্ঠটা আরও গাঢ় করে জানালে, যা থাকবার তাই আছে।

তার মানে, নেই—টিটকিরির চিরকুট?

হতাশার সঙ্গে বেশ একটু ক্ষোভের জ্বালা নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেও শিবুর হাত থেকে চিরকুটটা নিয়ে না পড়ে পারলাম না।

পড়ার অবশ্য নতুন কিছু নেই। বেশ কিছুক্ষণ থেকে সোজাসুজি স্পষ্ট সমস্যার ধাঁধাটাঁধার বদলে যে ধরনের জ্বালা ধরানো টিটকিরির চিমটি আসছে তারই আর একটি নমুনা।

এবারেও সেই পোস্টকার্ডের মাপের একটা ধবধবে সাদা কার্ড। তার সম্বোধন নেই। কোথা থেকে আসছে তার কোনও হদিস নেই। কার্ডের মাঝামাঝি মোটা মোটা অক্ষরে শুধু লেখা—দুয়ো।

এ রকম কার্ড এ ক-দিনে আরও কয়েকটা পাওয়া গেছে। এক না হলেও সবগুলিই অপমান ধরা টিটকিরি দিয়ে লেখা।

এই জাতের যে কার্ড পাওয়া গেছে তাতে তার ভাষণ সংক্ষিপ্ত হলেও ভাষা একটু বিস্তারিত ছিল।

মাপজোকে এক হলেও সে কার্ডে বক্তব্য একেবারে অস্পষ্ট নয়।

লেখার ধরন-ধারণ অবশ্য এক। প্রমাণ আকারের সাদা কার্ডের মাঝখানে পর পর মোটা মোটা অক্ষরে কথাগুলি সাজানো

কে না কারা? এখনও বুঝলে কিছু, দুয়ো।

এর পরের চিঠিটা আর একটু বড় হলেও মোটেই ধোঁয়াটে নয়। তার একটি খোঁচাই স্পষ্ট করে দেওয়া। পর পর তিন লাইনে সাজিয়ে লেখা–

কোথায় এখন।

টঙের ঘরের তিনি!

ড়ুব মেরেছেন কোথায়?

নিয়মিতভাবে পর পর এ ধরনের ভেংচিকাটা চিঠি নিয়ে মেজাজগুলো তখন আমাদের কী হয়েছে তা বোধহয় বলে বোঝাবার দরকার নেই।

এ যে মৌ-কা-সা-বি-স-এর কাণ্ড সে বিষয়ে কোনও মতেই আমাদের সন্দেহ নেই।

কিন্তু কে সে মৌ-কা-সা-বি-স?

কে না কারা?

আমাদের এমন কানমলা দেবার এ গরজই বা তার বা তাদের কেন?

আর আমাদের এই বাহাত্তর নম্বরের বাসার ডাকবাক্সে তারা তাদের চিঠি চালানই বা করছে কখন? কীভাবে?

সারাক্ষণ যতখানি সম্ভব আমরা সজাগ পাহারায় থেকেছি।

সকলে দল বেঁধে না হোক, কেউ না কেউ তো বটেই।

এই এত পাহারার মধ্যে কখন কী ভাবে তারা তাদের এই সব চিঠি চালান করছে। আমাদের চিঠির বাক্সে?।

দিনের বেলা তো নয়ই, রাত্রেও আমাদের অজান্তে চিঠির বাক্সে কিছু ফেলা অসম্ভব বললেই হয়। কারণ সন্ধ্যা হতে না হতেই আজকাল আমরা বাইরের গেট চাবি দিয়ে বন্ধ করার ব্যবস্থা করেছি।

অন্য কারও তো নয়ই, আমাদের নিজেদেরও কারও বাইরে থেকে ভেতরে আসতে হলে চাবি দিয়ে গেট না খুলিয়ে আসা যাওয়ার উপায় ছিল না।

এই অবস্থায় আমাদের অজান্তে আমাদের ডাকবাক্সে চিঠি বা চিরকুট চালান কেমন করে সম্ভব!

ব্যাপারটা যা দাঁড়িয়েছে তাতে আমরা পরস্পরের ওপর সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছি।

আমাদেরই কেউ কি চুপি চুপি এই সব চালাকি করছে। কিন্তু কে সে হতে পারে?

এ রকম মজার বেয়াড়াপনা করে তার লাভই বা কী!

আর তাছাড়া মৌ-কা-সা-বি-স যে সব মাথাগুলোনো ধাঁধার রহস্য আমাদের সামনে সাজিয়ে ধরেছে, একা এমন কিছু করার মতো বুদ্ধিও আমাদের কার আছে?

শিবুর?

না। কোনও একটা মজার ব্যাপার নিয়ে বেশ একটু হইচই বাধিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছাড়া আর কোনও এলেম তার থাকার পরিচয় তো এখনও পেয়েছি বলে মনে হয় না।

যদিই বা এরকম ক্ষমতা তার থাকে, আপাতত তা অনুমানের মধ্যে রেখে অন্যদের কথা বিচার করে দেখতে পারি।

প্রথমে নিজেকে বিচারের দাঁড়িপাল্লায় তুলে চোখ বুজেই সরাসরি বাদ দিতে। পারি।

না, আমি দু চারটে খোঁচা দিয়ে সোজা কথাকে কখনও কখনও প্যাঁচালো করতে পারি, কিন্তু ভেবে চিন্তে সাজিয়ে গুছিয়ে একটা ধাঁধা বানানো–সে আমার কর্ম নয়।

আমার পর বাকি থাকে শুধু গৌর আর শিশির।

তা দু-দুজনের কেউ যে ফেলনা নয় একথা অকপটে স্বীকার না করে উপায় নেই। কিন্তু বাদ সেধেছে দুজনের নিজস্ব চরিত্রের বিশেষত্ব।

গৌর ইচ্ছে করলে সবই পারে। কিন্তু সকলের সঙ্গে সমান উৎসাহে যে কোনও ধান্দায় মাততে আপত্তি না থাকলেও মৌ-কা-সা-বি-স-এর মতো বাহাদুরির জন্য নিজের গরজে সময় আর বুদ্ধি খরচ সে করবে বলে মনে হয় না।

শিশিরের পক্ষে সে রকম কিছু করা অবশ্য সম্ভব।

কিন্তু ব্যাপারটা আরও তাহলে জমকালো হওয়া দরকার।

জমকালো না হোক, ব্যাপারটা এখন যা দাঁড়িয়েছে তাতে একটা গায়ে জ্বালাধরানো টিটকিরির চাবকানির আভাস আছে বলে অবশ্য শিবু, গৌর, শিশির কারওই সামান্য গা ঝাড়া দিয়ে তাচ্ছিল্য করার ভাবটা আর নেই।

রহস্যটার একটা মীমাংসা তাই না করলেই নয়।

কিন্তু কীভাবে সে ব্যাপারে অগ্রসর হওয়া যায় ঠিক মতো বুঝতে না পেরে আপাতত শিবুর ওপরেই একটু চড়াও হয়ে বললাম, এতক্ষণ লেটারবক্স হাতড়ে তুই শুধু এই লেখাটুকু পেলি?

তার মানে? হঠাৎ আক্রমণটা কোন দিক দিয়ে যায়—কেনই বা এমন বেয়াড়া হয়ে ওঠে তা বুঝতে না পেরে শিবু বেশ একটু গরম মেজাজ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, কী বলতে চাইছিস তোরা।

আমরা-আমরা মানে— বলবার কিছু না পেয়ে আমরা তখন তোতলামিতে পৌঁছে গেছি।

আমাদের হয়ে শিবুই কথাগুলো গরম মেজাজে জানিয়ে দিলে, তার মানে আমি ওই কাটা কার্ডের টুকরোটা লিখে আনতে দেরি করছিলাম বলতে চাস?

না না— আমরা এবার অপ্রস্তুত হয়ে সরব প্রতিবাদ জানালাম।

তা–মানে তা কেন বলব—মানে বলছিলাম কী—

ও সব বাজে কথা রাখ— শিবুর চড়া মেজাজ ঠাণ্ডা হল না—স্পষ্ট আমায় যে সন্দেহ করছিস তা সাহস করে স্বীকার কর না।

না, না, মানে আমরা অপ্রস্তুত হয়ে যা বলতে যাচ্ছিলাম শিবু তাতে বাধা দিয়ে বললে, শোন, মিছিমিছি কথা বাড়িয়ে তো লাভ নেই। সত্য কথাটা তাই আমাদের সকলেরই স্বীকার করা ভাল। আসল ব্যাপারটা যা দাঁড়িয়েছে তা এই যে রহস্যটার ঠিক মতো কোনও হদিস না পেয়ে আমরা সকলেই সকলকে মনে মনে সন্দেহ করতে আরম্ভ করেছি। আমি নিজে এখন তা অকপটে স্বীকার করছি যে আমি নিজেও তাই করে একদিন হাতেনাতে আসল আসামিকে ধরবার মতলবে ছিলাম। তার জন্যে বেশ একরকম ফাঁদও পেতেছি।

সত্যিই তুই আমাদেরই কাউকে সন্দেহ করেছিস? অবিশ্বাস্য স্বরে জিজ্ঞাসা না করে পারলাম না। আর তাকে ধরবার জন্যে ফাঁদও পেতেছিস? নিজের কানকেই বিশ্বাস না করতে পেরে একটু রুক্ষ গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, কাকে?

কাকে জানতে চাইছিস? শিবু বিনা দ্বিধায় জানাল, কাকে না করেছি সেইটিই বরং জিজ্ঞাসা কর। তবে সে প্রশ্নেরও সঠিক জবাব দিতে পারব না।

তার মানে? একটু ধমক দেবার ভঙ্গিতে বলবার চেষ্টা করলাম, কী আবোল-তাবোল বকছিস।

হ্যাঁ, শুনলে আবোল-তাবোলই মনে হয়, শিবু অকপটে স্বীকার করলে, কিন্তু কথাটা পুরোপুরি ঠিক। সন্দেহ যখন শুরু হয়েছে তখন এক এক করে কেউই বাদ পড়েনি।

কেউই বাদ পড়েনি! নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে না পেরে বললাম, সন্দেহ করেছিস এক এক করে আমাদেরই সকলকে!

হ্যাঁ, তাই করেছি। শিবু সোজাসুজি জানালে, আর তার মধ্যে প্রথম কাকে সন্দেহ করেছি শুনবি?

এ ধরনের কথায় মেজাজ ঠিক রাখা যায়? বেশ একটু কড়া গলাতেই বললাম, সেইটেই তো জানতে চাই।

বেশ, শোন তাহলে, শিবু যেন নিজের দায়টা কাটিয়ে নিয়ে বললে, প্রথম সন্দেহ করেছি আর কাউকে নয়, এই তোমাকেই!

আ-আ-আমাকে? আমি তোতলা হয়ে কথাটা যখন জিজ্ঞাসা করতে পারলাম, ঘরেও অন্যদিকে তখন চাপা হাসির শব্দটা খুব অস্পষ্ট নয়।

সেটা গ্রাহ্য না করে তোতলামিটা এবার কাটিয়ে উঠে প্রায় ধরা গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, প্রথম সন্দেহ করলি এই আ-মা-কেই? মানে আমি প্রথমে মৌ-কা-সা-বি-স-এর ওই গোটা দু-তিন চালাকির খেল দেখিয়ে সে সব প্যাঁচের পুঁজি ফুরিয়ে যাবার পর এমনই করে সবাইকে টিটকিরি দিয়ে বাহাদুরি করছি।

হ্যাঁ, আমার মেজাজের ঝাঁঝটা গ্রাহ্যই না করে শিবু সোজাসুজি এবার স্বীকার করলে, হ্যাঁ, প্রথমে তোর ওই বোকা বোকা ভাবগতিকটা হয়তো একরকম সেজে থাকা বলেই সন্দেহ হয়েছিল। তারপর অবশ্য

শিবুকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে জ্বলন্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, তারপর অবশ্য কী?

তারপর, শিবু এবার একটু হেসেই বললে, বুঝলাম যে তোমায় সন্দেহ করাটা সম্পূর্ণ ভুল। মানে—

শেষ পর্যন্ত বুঝলে তাহলে সে কথা? খুশি হয়ে শিবুকে একটু তারিফ জানাতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তা আর হল না। শিবু তখন তার বক্তব্যটা শেষ করে বলছে, মানে তখন খেয়াল হয়েছে যে বোকা সাজাটা সহজ হলেও তোমার পক্ষে মৌ-কা-সা-বি-স-এর ওই সব প্যাঁচের এক-একটা গল্প ফাঁদা-তোমার কর্ম নয়। সে বুদ্ধি তোমার নেই।

এ অপমানের কি জবাব নেই?

থাকলেও তখন তা ভেবে বার করতে না পেরে নীরবে তা হজম করে শিবুর কথাই শুনে যেতে হল।

শিবু তখন বলছে, তোমাকে বাতিল করে তখন গৌর-শিশিরের কথা ভাবছি। হ্যাঁ, ওদের দুজনের পক্ষেই এরকম একটা বাহাদুরি দেখানো অসম্ভব নয়, আর বিশেষ করে ওদের যা দস্তুর—দুজনে সেইরকম জোট বেঁধে যদি কাজ করে।

শিবু একটু থেমে গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে এবার বললে, কিন্তু সেইটেই আর সম্ভব নয়।

সম্ভব নয়? আমি গৌর আর শিশিরের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? তা সম্ভব নয় কেন?

তাও বুঝিয়ে বলতে হবে? শিবু আমার মূঢ়তায় তার হতাশাটা গলার স্বরে বুঝিয়ে দিয়েও বললে, লীগ চ্যাম্পিয়ানশিপ-এর হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে না। এখন ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান জোট বাঁধবে কী? মুখ দেখাদেখিও বন্ধ।

না, না, তা কেন গৌর আর শিশির দুজনেই প্রতিবাদ করে জানালে, ও সব খেলাধুলোর ঝগড়া আমরা মাঠেই রেখে আসি। ও ঝগড়া বাড়ি বয়ে আনব নাকি?

ঠিক, ঠিক, আমারই ভুল হয়েছে। শিবু নিজের ভুল স্বীকারের সঙ্গে মুখ টিপে একটু হেসে বললে, কিন্তু আসামিদের তালিকা থেকে একে একে সবাই বাদ যাবার পর পড়েছি ফাঁপরে। আমাদের চিঠির বাক্সের ও সব নাক কান মলা চিঠি দিয়ে মজা করছে কে বা কারা?

সত্যিই কি ব্যাপারটা তাহলে ভুতুড়ে কিছু?

এ ব্যাপারে একমাত্র যিনি সব সন্দেহের বাইরে আছেন এ বিপাকে পড়ে এবার তাঁর শরণ নেবার কথা ভাবতে হচ্ছে! হ্যাঁ, টঙের ঘরের সেই তিনি। মৌ কাসা-বি-স-এর এ-রহস্যের কোনও সমাধান যদি থাকে তাহলে একমাত্র তাঁর কাছেই তা পাওয়া সম্ভব। তাই তাঁর শরণই এবার নিতে হবে।

তা নিতে চাও নাও, একটু সন্দেহ প্রকাশ করেই জানতেই চাইছিলাম, কিন্তু এ ব্যাপারে তিনি সন্দেহের বাইরে কেন মনে করছ?

করছি, শিবু একটু গম্ভীর হয়েই জবাব দিল, গোড়ায় মৌ-কা-সা-বি-স-এর চিঠিগুলো তাঁর নিজের হাতের লেখার নকল দেখে।

তাঁর নিজের হাতের লেখার নকল। শিশিরই অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, সে লেখা যে নকল তা বুঝলে কী করে?

বুঝলাম তাঁর হাতের লেখার সঙ্গে মিলিয়ে, শিবু ব্যাখ্যা করে এবার বোঝালে, ওঁর হাতের লেখা আমাদের কাছে অতি সামান্যই আছে। একবার আমাদের এই বাহাত্তর নম্বর ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার হুমকি দিয়ে যখন খবরের কাগজের বাড়িভাড়ার বিজ্ঞাপন দেখে ভাড়ার আবেদনের চিঠি লিখেছিলেন বনোয়ারিকে দিয়ে ডাকে পাঠাবার জন্য, তখন সে সব চিঠি ডাকবাক্সের বদলে আমাদের কাছেই জমা করেছি। সেই চিঠির লেখার সঙ্গে মিলিয়ে বুঝলাম এ লেখা ঘনাদার। সেই নিজের লেখারই নকল-নকল শুধু আমাদের ধোঁকা দেবার জন্য? এ ধোঁকা দেবার চালাকি কে বা কারা করছে তা বার করবার জন্য টঙের ঘরের তাঁরই শরণ নিতে হবে।

আরে মেঘ না চাইতেই জল! গৌর টিপ্পনি কাটলে, সিঁড়িতে তাঁর চটির আওয়াজ বোধহয় শোনা যাচ্ছে।

গৌর ভুল বলেনি। মিনিট কয়েক বাদে বিদ্যাসাগরি জোড়া চটির আওয়াজ নীচ থেকে ওপরে উঠে তখনকার আস্তানাঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে আবার আমাদের দরজায় ফিরেই বোধহয় কড়া ঠেলা দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আর দরকার হল না।

শিবুই ভেতর থেকে দরজা খুলে ধরে যেন কুর্নিশ করার মতো ভঙ্গিতে বললে, আসুন না। আপনি বোধহয় অন্তর্যামী। এইমাত্র আপনার কাছে যাবার কথাই ভাবছিলাম। কেমন করে তা বুঝে নিজে থেকেই তার আগে এসে পড়েছেন!

এ আদিখ্যেতায় ঘনাদা বিশেষ গললেন বলে মনে হল না। কথাগুলো যেন গ্রাহ্যই না করে তিনি ঘরের ভেতর গৌরের ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ানো সোফাটায় বসে গম্ভীরভাবে বললেন, ব্যাপার কী বলল তো, এমন ছুটির দিন বিকেলে তোমরা আড্ডাঘরের বদলে এখানে এসে জমা হয়েছ, আমার কাছেও যাবার কথা ভাবছিলে? কী হল কী হঠাৎ এমন?

হঠাৎ নয়, শিবুই গলাটা ভারি করে জানালে, ব্যাপারটা হয়েছে অনেকদিন। ছেলেখেলা বলে কিন্তু এখন আর উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। মীমাংসার জন্যে তাই আপনার শরণ নিতে যাচ্ছিলাম।

সে কথা তো অনেকবার শুনলাম, ঘনাদা একটু অধৈর্যের সঙ্গে বললেন, কিন্তু ব্যাপারটা হয়েছে কী?

একটু চুপ করে আমাদের সকলের মুখের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে ঘনাদা হঠাৎ যেন দিব্যদৃষ্টি পেয়ে বললেন, সেই তোমাদের মৌ-কা-সা-বিস আবার খোঁচা দিয়েছে? চিঠি দিয়েছে কিছু আবার।

চিঠি দিয়েছে, আবার দেয়নি—

শিবু হেঁয়ালি করে জানাবার চেষ্টা করাতে তার ওপর বিরক্ত হয়ে ঘটনাটা যা দাঁড়িয়েছে, ঘনাদাকে একটু বিস্তারিত করে জানালাম।

সেই সঙ্গে মৌ কাসা-বি-স-এর শেষ চিঠিগুলোও দেখাতে ভুললাম না।

ঘনাদা যেরকম গম্ভীর মুখে আমাদের পেশ করা কাগজপত্র প্রথমে দেখছিলেন, শেষের দিকে হঠাৎ তার বদলে তাচ্ছিল্যভরে হেসে ওঠাতে কিন্তু আমাদের অবাক হতে হল।

এই! এই তোমাদের সমস্যা! ঘনাদা ওঁর কাছে জড়ো হওয়া কাগজের টুকরোগুলো সামনের টেবিলের ওপর নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন, করে দেওয়া এ যদি রহস্য হয়, তাহলে তার সমাধান এইগুলোর মধ্যেই করে দেওয়া আছে। এই কাগজের টুকরোগুলোর মধ্যেই।

আমরা অবাক হলাম। সেই সঙ্গে ঘনাদা বোধহয় আমাদের নিয়ে ঠাট্টা করছেন এই সন্দেহ করে একটু চুপ।

ক্ষোভটা গোপন না করে একটু তেতো গলাতেই জানতে চাইলাম, সমাধানটা আছে বুঝলাম, কিন্তু সেটা কোন ভাষায় তা একটু জানাবেন? ভাষাটা বাংলা না এসপেরান্টো গোছের কিছু?

না, না ওসব কেন হবে! ঘনাদা জড়ো করা কার্ডগুলোর একটা তুলে নিয়ে তার পেছনের সাদা পাতার সামনে যা লেখা আছে সেই কথাগুলোই নিজের পকেট থেকে একটা কলম বার করে লিখতে লিখতে বললেন, এই কার্ডের এক পিঠের লেখাটাই অন্য পিঠে লিখলাম। একটু মন দিয়ে পড়লে মানেটা বোঝা জলের মতো সহজ হবে বলে মনে করি।

কথাটা শেষ করে নিজের হাতের দুপিঠে লেখা কার্ডটা অন্য কাগজগুলোর মধ্যে মিশিয়ে দিয়ে হঠাৎ উঠে পড়ে দরজা দিয়ে ছাদের সিঁড়ির দিকেই পা বাড়াতে বাড়াতে যা বললেন তাও একটা ধাঁধা। বলে গেলেন, এবার লেখাটা পড়তে পারবে আশা করি। লেখা না পড়তে পারো কলম পড়লেই চলবে।

এ আবার কী আজগুবি কথা?

মনে হল ঘনাদার বিদ্যাসাগরি চটির শব্দ ন্যাড়া ছাদের সিঁড়িতে মিলিয়ে যাবার আগে তাঁকে মানেটা বোঝাবার জন্য ধরে নিয়ে আসি।

কিন্তু সেটা আর পারলাম না। তার বদলে মৌ-কা-সা-বি-স-এর টুকরো কার্ডগুলোর ভেতর থেকে ঘনাদার উলটো পিঠে লেখা কার্ডটা খুঁজে বার করে একটু মন দিয়ে পড়বার চেষ্টা করলাম।

কিন্তু তাতে লাভ কী হল?

কার্ডটায় এক পিঠে যা লেখা ছিল ঘনাদা অন্য পিঠে ঠিক তাই লিখেছেন।

মূল কার্ডটায় লেখা ছিল একেবারে সংক্ষিপ্ত দুটি মাত্র শব্দ কার্ডের ঠিক মাঝখানে মোটা মোটা অক্ষরে লেখা-কে আমি। কার্ডের অন্য পিঠে ঘনাদা আমাদের সামনে সেই কথাই লিখেছেন—

কে আমি!

তাহলে?

নেহাত সস্তা ধাপ্পা বলে কাগজটা অন্য সবগুলোর সঙ্গে কাগজ ফেলার ঝুড়িতে ফেলতে গিয়ে হঠাৎ ঘনাদার শেষ কথাই মনে পড়ল।

কী বলে গেছেন ঘনাদা।

বলে গেছেন—লেখা না পড়তে পারো কলম পড়লেই চলবে।

ঠিক! ঠিক!

লেখা ক-টার মানে বুঝতে আর দেরি হল না।

এক এক করে অন্য কার্ডগুলোর লেখাগুলোও পড়ে দেখলাম। ঘনাদার কথাই ঠিক। লেখার কলমই লেখককে চিনিয়ে দিয়েছে।

কেমন সে কলম? এমন আজগুবি কিছু নয়। শুধু নিব-এ একটু দোষ আছে। ওপর দিকে কলমের টান দেবার সময় খুব মিহি, প্রায় অদৃশ্য কালির ছিটে কাগজের ওপর ছড়ায়।

এই সূক্ষ্ম ছিটে মৌ-কাসা-বি-স-এর যত চিঠি আমরা পেয়েছি সবগুলিতেই একটু ভাল করে লক্ষ করলে দেখা যায়।

সেই ঘরে—তখনই সেই টঙের ঘরে ছুটলাম?

না, বিকেলের খাবারের ফরমাশগুলো গরম গরম এসে পৌঁছবার জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষাই করলাম।

খাবার কী এল তার বর্ণনার বোধহয় দরকার নেই। শুধু স্পেশ্যাল আইটেমটার একটা বর্ণনা দিই। সেই এক বারকোশ প্রমাণ পূর্ণচাঁদের মাপের একটি নরম পাকের কাঁচাগোল্লা, সাদা জমির ওপর নীলচে লালচে ক্ষীরের বুটি ভোলা অক্ষরে লেখা–মৌ-কা-সা-বি-স-এর ভাঙা কলম।

রবিনসন ক্রুশো মেয়ে ছিলেন

রবিনসন ক্রুশো! আসলে তিনি কে ছিলেন জানেন? একজন মেয়ে। সকলের দিকে চেয়ে একটু অনুকম্পার হাসি হেসে ঘনশ্যামবাবু বললেন, তবে আপনারা আর সেকথা জানবেন কী করে?

আহত অভিমানে শিবপদবাবু কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আর সকলের চোখের ইশারায় নিজেকে তিনি সামলে নিলেন।

ঘমশ্যামবাবুর এই উক্তি নিঃশব্দে হজম করে উৎসুকভাবে সকলে তাঁর দিকে তাকালেন।

ঘনশ্যামবাবুর কথার প্রতিবাদ পারতপক্ষে কেউ আজকাল করেন না। কেন যে করেন না তা বুঝতে গেলে ঘনশ্যামবাবুর এই বিশেষ আসরটি ও তাঁর নিজের একটু পরিচয় বোধ হয় দেওয়া দরকার।

কলকাতা শহরের দক্ষিণে একটি কৃত্রিম জলাশয় আছে, করুণ রসিকতার সঙ্গে আমরা যাকে হ্রদ বলে অভিহিত করে থাকি। জীবনে যাদের কোনও উদ্দেশ্য নেই।

অথবা উদ্দেশ্যের একাগ্র অনুসরণে যাঁরা পরিশ্রান্ত, উভয় জাতের সকল বয়সের স্ত্রী পুরুষ নাগরিক প্রতি সন্ধ্যায় সেই জলাশয়ের চারিধারে এসে নিজের নিজের রুচিমাফিক স্বাস্থ্য অর্থ কাম মোক্ষ এই নব চতুর্বর্গের সাধনায় একা-একা বা দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায় বা বসে থাকে।

এই জলাশয়ের দক্ষিণপাড়ে জলের কাছাকাছি এক-একটি নাতিবৃহৎ বৃক্ষকে কেন্দ্র করে কয়েকটি বৃত্তাকার আসন পরিশ্রান্ত বা দুর্বল পথিক ও নিসর্গদৃশ্য-বিলাসীদের জন্য পাতা আছে।

ভাল করে লক্ষ করলে এমনই একটি বৃত্তাকার আসনে প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যায় পাঁচটি প্রাণীকে একত্র দেখা যাবে। তাঁদের একজনের শিরোশোভা কাশের মতো শুভ্র, একজনের মস্তক মর্মরের মতো মসৃণ, একজনের উদর কুম্ভের মতো স্ফীত, একজন মেদভারে হস্তীর মতো বিপুল আর একজন উষ্ট্রের মতো শীর্ণ ও সামঞ্জস্যহীন। প্রতি সন্ধ্যায় এই পাঁচজনের মধ্যে অন্তত চারজন এই বিশ্রাম-আসনে এসে সমবেত হন। এবং আকাশের আলো নির্বাপিত হয়ে জলাশয়ের চারিপার্শ্বের আলো জ্বলে ওঠার পর ফেরিওয়ালাদের ডাক বিরল না হওয়া অবধি, স্বাস্থ্য থেকে সাম্রাজ্যবাদ ও বাজার-দর থেকে বেদান্ত-দর্শন পর্যন্ত যাবতীয় তত্ত্ব আলোচনা করে থাকেন।

ঘনশ্যামবাবুকে এ-সভার প্রাণ বলা যেতে পারে, প্রাণান্তও অবশ্য তিনিই।

এ-আসর কবে থেকে যে তিনি অলংকৃত করেছেন ঠিক জানা নেই, তবে তাঁর। আবির্ভাবের পর থেকে এ-আসরের প্রকৃতি ও সুর একেবারে বদলে গেছে। কুম্ভের মতো উদরদেশ যাঁর স্ফীত সেই রামশরণবাবু আগেকার মতো তাঁর ভোজন-বিলাসের কাহিনী নির্বিঘ্নে সবিস্তারে বলার সুযোগ পান না, ঘনশ্যামবাবু তার মধ্যে ফোড়ন কেটে সমস্ত রস পালটে দেন।

রামশরণবাবু হয়তো সবে গাজরের হালুয়ার কথা তুলেছেন, ঘনশ্যামবাবু তারই মধ্যে রানি এলিজাবেথের আমলে প্রথম কীভাবে হল্যান্ড থেকে ইংল্যান্ডে গাজরের প্রচলন হয় তার কাহিনী এনে ফেলে সমস্ত প্রসঙ্গটার মোড় ঘুরিয়ে দেন।

কোনও দিন বিলিতি বেগুনের জেলি সম্বন্ধে রামশরণবাবুর উপাদেয় আলোচনা শুরু না হতেই ঘনশ্যামবাবু তাঁর শীর্ণ হাড় বেরোনো মুখে একটু অবজ্ঞার হাসি টেনে বলেন, হ্যাঁ, বেগুন বলতে পারেন, তবে বিলিতি নয়।

তারপর কবে দু-শো খ্রিস্টাব্দে গ্যালেন নামে কোন গ্রিক বৈদ্য মিশর থেকে আমদানি এই তরকারিটির বিশদ বিবরণ লিখে গিয়েছিলেন, তারও প্রায় বারো-শো বছর বাদে দক্ষিণ আমেরিকার পেরু থেকে কীভাবে জিটোমেট নামে অ্যাজটেক জাতের এই তরকারিটি টোম্যাটো নামে ইংল্যান্ডে ও ইউরোপে প্রচলিত হয়, বিষাক্ত ভেবে কত দিন খাদ্য হিসেবে টোম্যাটো ব্যবহৃত হয়নি সেই কাহিনী সবিস্তারে বলে ঘনশ্যামবাবু ভোজন-বিলাসের প্রসঙ্গকে ইতিহাস করে তোলেন।

মস্তক যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব ইতিহাসের অধ্যাপক শিবপদবাবুর ঐতিহাসিক কাহিনীকেও আবার তেমনই ভোজন-বিলাসের গল্পে

অনায়াসে ঘুরিয়ে দেন।

আসল কথা এই যে, সব বিষয়ে শেষ কথা ঘনশ্যামবাবু বলে থাকেন। তাঁর কথা যখন শেষ হয় তখন আর কিছু বলবার সময় কারও থাকে না।

তাঁর ওপর টেক্কা দিয়ে কারও কিছু বলাও কঠিন। কথায় কথায় এমন সব অশ্রুতপূর্ব উল্লেখ ও উদ্ধৃতি তিনি করে বসেন, নিজেদের অজ্ঞতা প্রকাশ পাবার ভয়েই যার প্রতিবাদ করতে কারও সাহসে কুলোয় না।

ঘনশ্যামবাবু এই সান্ধ্য-আসরের প্রাণস্বরূপ হলেও তাঁর সম্বন্ধে বিশেষ কিছু কারও জানা নেই। কলকাতার কোনও এক মেস-এ তিনি থাকেন ও ছেলে-ছোকরাদের মহলে ঘনাদা-রূপে তাঁর অল্পবিস্তর একটা খ্যাতি আছে এইটুকু মাত্র সবাই জানে। শীর্ণ পাকানো চেহারা দেখে তাঁর বয়স অনুমান করা কঠিন আর তাঁর মুখের কথা। শুনলে মনে হয় পৃথিবীর এমন কোনও স্থান নেই যেখানে তিনি যাননি, এমন কোনও বিদ্যা নেই যার চর্চা তিনি করেন না। প্রাচীন নালন্দা তক্ষশিলা থেকে অক্সফোর্ড কেমব্রিজ হার্ভার্ড, চিনের প্রাচীন পিঁপিঁন থেকে ইউরোপের সালো প্রাগ হিডেলবার্গ লাইপজিগ পর্যন্ত সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেই তাঁর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে বলে মনে হয়।

তাঁর পাণ্ডিত্যে যত ভেজালই থাক, তার প্রকাশে যে মুনশিয়ানা আছে এ-কথা স্বীকার করতেই হয়।

তাঁর কথার প্রতিবাদ না করে আমরা আজকাল তাই নীরবে তাতে সায় দিয়ে থাকি।

রবিনসন ক্রুশোর প্রসঙ্গটার বেলায়ও সেইজন্যেই জিভের উদ্যত বিদ্রোহ আমরা কোনওরকমে সামলে নিলাম।

মাথার কেশ যাঁর কাশের মতো শুভ্র সেই হরিসাধনবাবুর ছোট্ট দৌহিত্রীটির দরুন সেদিন প্রসঙ্গটা উঠেছিল।

দৌহিত্রীটিকে সেদিন হরিসাধনবাবু বুঝি আদর করে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। যে বয়সে ছেলেদের সঙ্গে তাদের পার্থক্যটা মেয়েরা বুঝতে শেখে না বা বুঝেও মানতে চায় না, মেয়েটির বয়স ঠিক তাই। আমাদের গল্পগুজবের মধ্যে কিছুকাল মনোনিবেশ করবার বৃথা চেষ্টা করে হ্রদের মাঝখানের দ্বীপের মতো জায়গাটিকে দেখিয়ে সে বুঝি বলেছিল, দেখেছ দাদু, ঠিক যেন রবিনসন ক্রুশোর দ্বীপ!

দাদু কিংবা আর কারও মনোযোগ তবু আকর্ষণ না করতে পেরে সে আবার বলেছিল, বড় হলে আমি রবিনসন ক্রুশো হব—জানো?

এত বড় একটা দুঃসাহসিক উক্তির প্রতি উদাসীন থাকা আর বুঝি আমাদের সম্ভব হয়নি। মেদভারে যাঁর দেহ হস্তীর মতো বিপুল সেই ভবতারণবাবু হেসে বলেছিলেন, তা কি হয় রে, পাগলি। মেয়েছেলে কি রবিনসন ক্রুশো হতে পারে।

মেয়েটির হয়ে হঠাৎ ঘনশ্যামবাবুই প্রতিবাদ করে বললেন, কেন হয় না? একটু চুপ করে কিঞ্চিৎ অনুকম্পার সঙ্গে আমাদের দিকে চেয়ে তিনি আবার যা বললেন, তার উল্লেখ আগেই করেছি।

আমাদের কোনও প্রতিবাদ করতে না দেখে ঘনশ্যামবাবু এবার শুরু করলেন, রবিনসন ক্রুশো ড্যানিয়েল ডিফোর লেখা বলেই আপনারা জানেন। এ-গল্পের মূল কোথায় তিনি পেয়েছিলেন তা জানেন কি?

মস্তক যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ সেই শিবপদবাবু সসংকোচে বললেন, যতদূর জানি, আলেকজান্ডার সেলকার্ক বলে একজন নাবিকের জীবনের অভিজ্ঞতা শুনেই এ-গল্প তিনি বানিয়েছিলেন।

যা জানেন তা ভুল! ঘনশ্যামবাবুর মুখে করুণামিশ্রিত অবজ্ঞা ফুটে উঠল, আত্মম্ভরি ইংরেজ সাহিত্যিকরা আসল কথা চেপে গিয়ে যা লিখে গেছে তা-ই অম্লান বদনে বিশ্বাস করেছেন। মনমাউথের বিদ্রোহে যোগ দেবার জন্যে ড্যানিয়েল-এর একবার ফাঁসি হবার উপক্রম হয় জানেন তো? লন্ডনের বাসিন্দা বলে কোনওরকমে। সে-যাত্ৰা তিনি রক্ষা পান। তারপর নতুন রাজা-রানি উইলিয়ম আর মেরি দেশে আসার পর ড্যানিয়েল কুগ্রহ কাটিয়ে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। সেই সময় ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে তাঁকে যেতে হয় স্পেনে। সেই স্পেনেই মাদ্রিদ শহরের এক ইহুদি বুড়োর দোকানে খুঁটিনাটি জিনিসপত্র ঘাঁটতে-ঘাঁটতে একটি ত্রয়োদশ শতাব্দীর পুঁথি পেয়ে তিনি অবাক হয়ে যান। সে-পুঁথির অনুলেখক রাস্টিসিয়ানো আর তার কথক স্বয়ং মার্কো পোলো।

উদর যাঁর কুম্ভের মতো স্ফীত সেই রামশরণবাবু সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলেন মার্কো পোলো মানে, যিনি ইউরোপ থেকে প্রথম চিনে গেছলেন পর্যটক হয়ে, রবিনস ক্রুশোর মূল গল্পের লেখক তা হলে তিনি!

একটু রহস্যময়ভাবে হেসে ঘনশ্যামবাবু বললেন, না, তিনি হবেন কেন! তিনি শুধু সে-গল্প সংগ্রহ করে এনেছিলেন মাত্র। সংগ্রহ করেছিলেন চিন থেকে।

ষোলো বছর বয়সে মার্কো পোলো তাঁর বাপ আর কাকার সঙ্গে পৃথিবীর অদ্বিতীয় সম্রাট কুবলাই খাঁর রাজধানী ক্যাম্বালুকের উদ্দেশে সাগর-সম্রাজ্ঞী ভেনিসের তীর থেকে রওনা হন। ফিরে যখন আসেন তখন তাঁর বয়স একচল্লিশ। দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে অর্ধ-পৃথিবীর অধীশ্বর কুবলাই খাঁ-র বিশ্বস্ত কর্মচারীরূপে প্রায় সমস্ত চিন তিনি পর্যটন করে ফিরেছেন। ১২৮২ খ্রিস্টাব্দে ইয়াং চাও-এর এক লবণের খনির পরদিৰ্শক হিসাবে কাজ করবার সময় বিখ্যাত চিনা লেখক ও সম্পাদক সান কাও চি-র সঙ্গে তাঁর সম্ভবত সাক্ষাৎ হয়। সান কাও চি তখন অতীতের সমস্ত চিনা কাহিনী ও কিংবদন্তি সংগ্রহ করে তাতে নতুন রূপ দিচ্ছেন। সেই সান কাও চির কাছে শোনা। একটি চিনা গল্পই রবিনসন ক্রুশোর প্রধান প্রেরণা।

মার্কো পোলোরা চিন থেকে তাঁদের বিশ্রী ননাংরা বেঢপ তাতার পোশাকের ভেতরে সেলাই করে শুধু হীরা মোতি নীলা চুনিই নয়, আরও অনেক কিছুই এনেছিলেন। ভেনিস-এর ডোজেকে তাঁরা যা যা উপহার দেন, ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দে লেখা মারিনো ফালিএবোর প্রাসাদের মূল্যবান দ্রব্যের তালিকায় তার কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। সেসব উপহারের মধ্যে ছিল স্বয়ং কুবলাই খাঁর দেওয়া আংটি, তাতারদের পোশাক, তেলা একটি তরবারি, টাঙ্গুটের চমরিগাই-এর রেশমি ললাম, কস্তুরী মৃগের শুকিয়ে রাখা পা আর মাথা, সুমাত্রার নীলগাছের বীজ।

কিন্তু বাইরে যা এনেছিলেন তার চেয়ে অনেক বেশি সম্পদ এনেছিলেন পোলো তাঁর স্মৃতিতে বহন করে। জেনোয়া-র কারাগারে বসে সেই স্মৃতি-সমুদ্র-মথিত কাহিনীই তিনি মুগ্ধ শ্রোতাদের কাছে বলে যেতেন।

মুগ্ধ শ্রোতা কারা? না, শুধু তাঁর কারাসঙ্গীরা নয়, জেনোয়া-র অভিজাত সম্প্রদায়ের আমির-ওমরাহ পুরুষ-মহিলা সবাই। এই কারাকক্ষ তখন জেনোয়া-র তীর্থস্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে রূপকথার চেয়ে বিচিত্র সুদূর ক্যাথের অপরূপ কাহিনীর মধুতীর্থ।

কিন্তু সাগর-সম্রাজ্ঞী ভেনিসের পরম শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পাত্র মার্কো পোলো জেনোয়ার কারাগারে কেন? সে অনেক কথা। দেশে ফেরবার মাত্র তিন বছর বাদে ভেনিস-এর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী জেনোয়া-র নৌবাহিনী লাম্বা দোরিয়ার নেতৃত্বে একেবারে আদ্রিয়াতিক সাগরে চড়াও হয়ে এল। আর সকলের সঙ্গে মার্কো পোলো গেলেন একটি রণতরীর অধিনায়ক হয়ে যুদ্ধে। সেই যুদ্ধে পরাজিত হয়েই আরও সাত হাজার ভেনিসবাসীর সঙ্গে তিনি জেনোয়ায় বন্দি হলেন।

জেনোয়া-র কারাগারে তাঁর মুগ্ধ শ্রোতাদের মধ্যে হেলে-পড়া মিনারের শহর পিসা-র এক নাগরিক ছিলেন। নাম তাঁর রাস্টিসিয়ানো। কাব্যের ভাষা প্রেমের কাহিনীর অপরূপ ভাষা হিসেবে ফরাসি তখনই ইউরোপে সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছে। পিসার লোক হলেও সেই ফরাসি ভাষায় রাস্টিসিয়ানোর অসাধারণ দখল ছিল। মার্কো পোলোর অপূর্ব সব কাহিনী সেই ভাষায় তিনি টুকে রাখতেন।

তাঁর সেই টুকে রাখা কাহিনীই সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছে তারপর। দেড়শো বছর বাদে জেনোয়া-র আর এক নাবিক সেই কাহিনীর ল্যাটিন অনুবাদ পড়তে-পড়তে, সিপার সোনায় মোড়া প্রাসাদচূড়া যেখানে প্রভাত-সূর্যের আলোয় ঝলমল করে সেই সুদূর ক্যাথের স্বপ্নে বিভোর হয়ে গেছেন। সে নাবিকের নিজের হাতে সই করা ও পাতার ধারে ধারে মন্তব্য লেখা বইটি এখনও সেভিল-এর কলম্বিনায় গেলে দেখতে পাওয়া যায়। সেনাবিকের নাম কলম্বাস।

আরও প্রায় দু-শো বছর বাদে ড্যানিয়েল ডিফো মাদ্রিদ-এর এক টুকিটাকি শখের জিনিসের দোকানে রাস্টিসিয়ানোর অনুলিখিত এমনই আর-একটি পুঁথির সন্ধান পান। সেই পুঁথি থেকেই তেত্রিশ বছর বাদে রবিনসন ক্রুশোর গল্প তিনি গড়ে তোলেন।

মর্মরের মতো মস্তক যাঁর মসৃণ সেই শিবপদবাবু এবার বুঝি না বলে পারলেন না, কিন্তু রবিনসন ক্রুশো মেয়ে হলেন কী করে?

সান কাও চি-র যে-গল্প মার্কো পোলোর মুখে শুনে রাস্টিসিয়ানো টুকে রেখেছিলেন, তাতে মেয়ে বলেই তাঁকে বর্ণনা করা আছে। ড্যানিয়েল অবশ্য সেগল্পের নায়িকার নাম ও জাতি দুই-ই পালটেছেন।

মাথার কেশ যাঁর কাশের মতো শুভ্র সেই হরিসাধনবাবু বললেন, কিন্তু সেই পুঁথির গল্পটা কিছু শুনতে পারি?

সেই গল্প শুনতে চান? কিন্তু আসল কাহিনী অনেক দীর্ঘ, সংক্ষেপে তার সারটুকু আপনাদের বলছি শুনুন—

 

সুং রাজবংশের রাজধানী তখনও উত্তরের কাইফেং থেকে টাসুট দৌরাত্ম্যে কিত্সাই নগরে সরিয়ে আনা হয়নি। পৃথিবীর আশ্চর্যতম শহর হিসাবে কিনসাই-এর নাম কিন্তু তখনই মালয়, ভারতবর্ষ, পারস্য ছাড়িয়ে সুদূর ইউরোপে পর্যন্ত পৌঁছেছে। দ্বাদশ তোরণ ও দ্বাদশ সহস্র সেতুর এই নগরে চুয়ান উ নামে এক সদাগর তখন বাস করেন। সদাগরের মণি-মাণিক্য ধন-রত্নের অবধি ছিল না, কিন্তু সবচেয়ে মূল্যবান যে-সম্পদ তাঁর ছিল, সে হল তাঁর একমাত্র কন্যা নান সু।

কিসাই-এর খ্যাতি যেমন সারা পৃথিবীতে, নান সু-র রূপের খ্যাতি তেমনই সারা। চিনে তখন ছড়িয়ে গেছে। অসামান্য রূপ হয় নিজের, নয় সংসারের সর্বনাশ ডেকে আনে। নান সু-র রূপের বেলায়ও সে নিয়মের ব্যতিক্রম হল না? উত্তরের কিতানরা তখন কাইফেং-এর ওপর সমুদ্রের তরঙ্গের মতো বারবার হানা দিচ্ছে। সেই কিতানদের দলপতি চুয়ো সান-এর কানে একদিন কী করে নান সু-র অসামান্য রূপ-লাবণ্যের খবর পৌঁছোল। কাইফেং-এর নগর প্রাকারের ধারে তার দুরন্ত সৈন্যবাহিনীকে থামিয়ে চুয়োে সান তার সন্ধির শর্ত সুং রাজসভায় জানিয়ে পাঠাল, দ্বাদশ তোরণ ও দ্বাদশ সহস্র সেতুর যে নগরের মরকত নীল হ্রদের জলে স্বপ্নের মতো সব হরিৎ দ্বীপ ভাসে সেই নগরের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ চিনের নয়নের মণি নান সু-কে তার চাই। নান সু-কে পেলেই কাইফেং-এর প্রান্ত থেকে ভাঁটার সমুদ্রের মতো তার দুর্ধর্ষ বাহিনী সরে যাবে।

রবি ন স ন তু শো মেয়ে ছিলে ন

২৩ সমস্ত চিন চঞ্চল হয়ে উঠল এ-সংবাদে, রাজসভা হল চিন্তিত, নান সুর পিতা চুয়ান উ সদাগর প্রমাদ গনলেন।

একটি মাত্র মেয়ের জীবন বলি দিয়ে সমগ্র চিনের শান্তি ক্রয় করতে সুং রাজসভা শেষ পর্যন্ত দ্বিধা করলেন না। চুয়ান উ-র কাছে আদেশ এল নান সু-কে কাইফেং-এ পাঠাবার।

জাফরি কাটা জানলার ভেতর দিয়ে আর গজদন্তের পাখার ওপর দিয়ে ব্রীড়াবনতা নবযৌবনা নান সু তখন বাইরের পৃথিবীর যেটুকু পরিচয় পেয়েছে তার সমস্তই জুড়ে আছে একটিমাত্র মানুষের মুখ। সে-মুখ কিত্সাই নগরের তরুণ নৌ-সেনাপতি সি হুয়ান-এর।

নান সু কেঁদে পড়ল বাপের পায়ে, নতজানু হল সি হুয়ান। কিন্তু চুয়ান উ নিরুপায়। রাজাদেশ লঙ্ঘন করার শক্তি তাঁর নেই।

যেতেই হবে নান সু-কে সেই বর্বর কিতান-দলপতিকে বরণ করবার জন্যে উত্তরের সেই হিমের দেশে। নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে সি হুয়ান-এর ওপরই নান সু-কে নিয়ে যাবার ভার পড়ল।

দ্বাদশ তোরণ আর দ্বাদশ সহস্র সেতুর নগর থেকে সি হুয়ান-এর রণপোত যেদিন মেঘের মতো সাদা পাল মেলে রওনা হল সমস্ত কিসাই নগর সেদিন চোখের জল ফেললে। কিন্তু সি হুয়ান আর নান সুর মনে কোনও দুঃখ সেদিন নেই। ভাগ্য তাদের যদি পরিহাস করে থাকে ভাগ্যকেও তারা বঞ্চনা করবে—এই তাদের সংকল্প।

সাত দিন সাত রাত রণপোত ভেসে চলল সীমাহীন সাগরে। রণপোতের হাল ধরে আছে স্বয়ং সি হুয়ান। উত্তরে হিমের দেশের কোনও বন্দরে নয়, দক্ষিণের রৌদ্রোজ্জ্বল সাগরের মায়াময় কোনও দ্বীপই তার লক্ষ্য। একবার সেখানে পৌঁছেলে নিঃশব্দে রাত্রের অন্ধকারে নান সু-কে নিয়ে সে নেমে যাবে। সুং সাম্রাজ্যের অবিচার আর বর্বর কিতান বাহিনীর অত্যাচার যেখানে পৌঁছোয় না তেমনই এক নির্জন দ্বীপে নান সু-কে নিয়ে সে ঘর বাঁধবে। হালকা হাঁসের পালকের ভেলা সেজন্যে সে আগে থাকতেই সঙ্গে নিয়ে এসেছে।

মানুষের এ-স্পর্ধায় ভাগ্য বুঝি তখন মনে মনে হাসছে। সাত দিন সাত রাত্রি বাদে হঠাৎ দুর্যোগ নেমে এল আকাশে। দুর্যোগ ঘনাল মানুষের মনে।

সি হুয়ান নিজের হাতে হাল ধরায় তার অনুচরেরা গোড়া থেকেই একটু বিস্মিত হয়েছিল, সাত দিন সাত রাত্রিতেও গন্তব্য স্থানে না পৌঁছে তারা সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল। উত্তর নয়, দক্ষিণ দিকেই তাদের রণপোত চলেছে, আকাশের তারাদের অবস্থানে সে-কথা বোঝবার পর তাদের সে-সন্দেহ বিদ্রোহ হয়ে জ্বলে উঠল।

রাত্রের আকাশে তখন প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে। সমুদ্র উঠেছে উত্তাল হয়ে। ভাগ্যের সঙ্গে যারা জুয়া খেলে, বিপদকেই সুযোগরূপে ব্যবহার করবার সাহস তারা রাখে। এই ঝটিকাক্ষুব্ধ সমুদ্রেই পালকের ভেলা সমেত নান সু-কে নীচে নামিয়ে সি হুয়ান তখন নিজে নেমে যাবার উপক্রম করছে। বিদ্রোহী অনুচরেরা হঠাৎ এসে তাকে ধরে বেঁধে ফেলল।

উন্মত্ত এক তরঙ্গের আঘাতে রণপোত থেকে ভেলা সমেত দূরে উৎক্ষিপ্ত হতে-হতে নান সু শুধু ঝড়ের গর্জন ছাপিয়ে একটা চিৎকার শুনতে পেল, ভয় নেই, নান সু, ভয় নেই। আমি যাচ্ছি। আমি যাব-ই।

জ্ঞান যখন হল নান সুর ভেলা তখন ছোট্ট এক পার্বত্য দ্বীপের সৈকতের ওপর পড়ে আছে।

সভয়ে নান সু উঠে বসল, উৎকণ্ঠিতভাবে তাকাল চারিদিকে। কয়েকটা সাগর-পাখি ছাড়া কোথাও কোনও জনপ্রাণী নেই। দূরে অশান্ত নীল সমুদ্রের ঢেউ পার্বত্য তটের ওপর ক্ষণে ক্ষণে আছড়ে এসে পড়ছে।

শশকের মতো ক্ষুদ্র নবনী-কোমল নান সু-র পা—সে পা তো কঠিন পার্বত্য ভূমির ওপর দিয়ে হাঁটবার জন্য নয়, তবুনান সু-কে ক্ষত-বিক্ষত পায়ে সমস্ত দ্বীপ পরিভ্রমণ। করতে হল, কোথাও কোনও জনপ্রাণীর দেখা সে পেলে না।

তুষারধবল নান সুর অতিসুকোমল হাত—গজদন্তের চিত্রিত পাখা ছাড়া আর কিছু যে-হাত কখনও নাড়েনি, তবু সেই হাতে কণ্টকগুল্ম থেকে ফল ছিঁড়ে নান সু-কে ক্ষুধা নিবৃত্তি করতে হল।

ভীরু সলজ্জ নান সুর চোখ—আঁখি পল্লব তার কাঁপতে কাঁপতে একটু উঠেই চিরকাল নেমে এসেছে, তবু সেই চোখ উৎকণ্ঠিতভাবে মেলে পাহাড়ের চূড়া থেকে দূর সাগরের দিকে তাকে চেয়ে থাকতে হল দিনের পর দিন সি হুয়ান-এর আশায়। আসবে, সে বলেছে, আসবেই।

কত দিন কত রাত গেল কেটে। উত্তরের আকাশে কতবার সপ্তর্ষিমণ্ডলের বদলে শিশুমার আর শিশুমারের বদলে সপ্তর্ষি ধ্রুবতারার প্রধান প্রহরী হয়ে তাকে প্রদক্ষিণ করে গেল, তার কোনও হিসেবই নান সুর আর রইল না।

কখন ধীরে ধীরে তার হৃদয় থেকে সমস্ত লজ্জা আর দেহ থেকে জীর্ণবাস খসে পড়ে গেল সে জানতে পারল না।

অনেক কিছু তার গেল, গেল না শুধু চোখের সেই উৎসুক দিগন্ত সন্ধানী দৃষ্টি আর মনের সেই অবিচলিত প্রতীক্ষা।

একদিন সেই প্রতীক্ষা সফল হল। দূর দিক্রবালে দেখা দিয়েছে সাদা পালের আভাস। দেখতে-দেখতে দূরের সেই পোত স্পষ্ট হয়ে উঠল, লাগল এসে শিলাকঠিন কূলে।

কে নামছে সেই পোত থেকে। ওই তো সি হুয়ান!

অধীর আগ্রহে পাহাড়ের চূড়া থেকে উচ্ছল ঝরনার মতো নামতে লাগল নান সু।

মাঝপথেই সি হুয়ান-এর সঙ্গে দেখা হল।

উচ্ছ্বসিতভাবে নান সু যেন গান গেয়ে উঠল, এসেছ, সি হুয়ান, এসেছ এতদিনে?

লুব্ধভাবে যে তার দিকে এগিয়ে আসছিল সে যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটু বিমূঢ়ভাবে চমকে দাঁড়াল, কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলে, এসেছি এতদিনে মানে? কে তুমি!

সি হুয়ান-এর বিস্মিত অথচ লুব্ধ দৃষ্টি নিজের সর্বাঙ্গে অনুভব করে নান সু কাতরভাবে বললে, আমায় চিনতে পারছ না, সি হুয়ান? আমি নান সু।

নান সু!নান সু তো এই দ্বীপের নাম। যে-দ্বীপ খুঁজতে আমরা বেরিয়েছি, যে-দ্বীপ। এতদিনে খুঁজে পেয়েছি!

আমার খোঁজে তা হলে তুমি আসোনি? এসেছ দ্বীপের খোঁজে!

হ্যাঁ, এই নান সু দ্বীপের খোঁজে সাত সাম্রাজ্যের ঐশ্বর্য যার মাটিতে পোঁতা আছে। বলো কোথায় সে-ঐশ্বর্য?

অশ্রুসজল চোখে নান সু এবার যেন আর্তনাদ করে উঠল, তোমার কি কিছু মনে

নেই, সি হুয়ান! মনে নেই তোমার রণপোত থেকে কেমন করে ঝড়ের রাতে আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়েছিল?

রণপোত থেকে ছাড়াছাড়ি! সাত পুরুষে আমাদের কেউ রণপোত চড়েনি। আট পুরুষ আগে এক সি হুয়ান কীরকম নৌ-সেনাপতি ছিলেন বলে শুনেছি। এই নান সু দ্বীপের গুপ্ত তথ্য নাকি তাঁর কাছ থেকেই পাওয়া। কিন্তু সে তো কাইফেং যখন চিনের রাজধানী ছিল সেই দু-শতাব্দী আগের কথা!

দু-শতাব্দী আগেকার কথা! অস্পষ্ট আবেগরুদ্ধ স্বরে উচ্চারণ করলে নান সু, তারপর নবাগত নাবিকের লুব্ধ দৃষ্টিতে হঠাৎ নিজের পরিপূর্ণ নগ্নতা আবিষ্কার করে চমকে উঠল।

নাবিক তখন লোলুপভাবে তার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নান সু শরাহত হরিণীর মতো প্রাণপণে ছুটে পালাল, ছুটে পালাল সেই পর্বতচূড়ার দিকে, জীবনের পরম স্বপ্ন আজও যাকে ঘিরে আছে।

কিন্তু পদে-পদে তার দেহ কী গুরুভারে যেন ভেঙে পড়ছে, লুব্ধ হিংস্র নাবিকের হাত থেকে আর বুঝি রক্ষা পাওয়া যায় না।

পর্বতচূড়ার প্রান্তে এসে যখন সে আছড়ে পড়ল তখন শরীরে এতটুকু শক্তি আর তার অবশিষ্ট নেই।

কিন্তু লুব্ধ নাবিক তাকে সবলে আকর্ষণ করতে গিয়ে হঠাৎ সভয়ে শিউরে পিছিয়ে এল।

সবিস্ময়ে নান সু একবার তার দিকে, তারপর নিজের দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার একাগ্র প্রতীক্ষা দীর্ঘ দুই শতাব্দী ধরে যে-যৌবনকে অক্ষয় করে ধরে রেখেছিল সে-যৌবন দেখতে-দেখতে সরে যাচ্ছে। চোখের ওপর তার শরীর শুকিয়ে যাচ্ছে, কুঁকড়ে যাচ্ছে, কুৎসিত হয়ে যাচ্ছে।

বহু যুগের অভ্যাসে আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে দূর-দিগন্তের দিকে সে বুঝি একবার তাকাল। চারিদিকে নীল সমুদ্র মথিত করে ও কারা আসছে! কারা? সে চিৎকার করে উঠল।

ওরাও সি হুয়ান! অট্টহাস্য করে উঠল নাবিক, হুয়ান-এর পাঁচ হাজার বংশধর! ওরাও আসছে এই নান সু দ্বীপের গুপ্তধনের সন্ধানে, আসছে পুড়িয়ে মারতে সেই ডাকিনীকে দু-শতাব্দী ধরে এ-দ্বীপের গুপ্তধন যে আগলে রেখেছে।

যে-পাহাড়ের চূড়া থেকে নান সু-র উৎসুক চোখ দুশতাব্দী ধরে দিচ্চক্রবাল সন্ধান করে ফিরেছে সেদিন রাত্রে জীবন্ত মশালরূপে তারই শীর্ষ সে উজ্জ্বল করে

ঘনশ্যামবাবু চুপ করলেন।

কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকবার পর মর্মরের মতো মস্তক যাঁর মসৃণ সেই শিবপদবাবু বললেন, কিন্তু রবিনসন ক্রুশোর সঙ্গে এ-গল্পের কোনও মিল তো নেই?

থাকবে কী করে? ঘনশ্যামবাবু একটু হাসলেন, সপ্তদশ শতাব্দীর ইংরেজ কসাই-এর ছেলে, গেঞ্জি আর টালির ব্যবসাদার ড্যানিয়েল ডিফো এ-গল্পের সূক্ষ্ম মর্ম কতটুকু বুঝবেন! মোটা বুদ্ধিতে তাই একে তিনি ছেলে-ভুলোনো গল্প করে তুলেছেন!

এ গল্পের আসল মর্মটা তাহলে কী? মাথার কেশ যাঁর কাশের মতো শুভ্র সেই হরিসাধনবাবু জিজ্ঞাসা করলেন। কিন্তু উত্তরে ঘনশ্যামবাবু এমনভাবে তাকালেন যে, এ-প্রশ্ন দ্বিতীয় বার তোলবার উৎসাহ কারও রইল না।

অদ্বিতীয় ঘনাদা (গল্পগ্রন্থ)

ঘড়ি

মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গলের চ্যারিটি ম্যাচের চার-চারটে হোয়াইট গ্যালারির টিকিট আগে থাকতে কেনা থাকা সত্ত্বেও ঢাকা, বরিশাল, হুগলি ও বর্ধমান জেলার চারিটি সুস্থ সবল উগ্র ক্লাবপ্রেমিক যুবক, আষাঢ় মাসের একটা আশ্চর্য রকম খটখটে বিকেলে ঘরে বসে কাটিয়েছে, এমন কথা কেউ কখনও সুস্থ মস্তিষ্কে বিশ্বাস করতে পারে?

জানি তা পারা সম্ভব নয়, তবু এই অবিশ্বাস্য ঘটনা আমাদের জীবনে ঘটেছে বলে তার কাহিনী অত্যন্ত লজ্জিত ভাবে নিবেদন করছি। ঘনাদার সঙ্গে যাদের পরিচয় হয়নি এবং ঘনাদার মতো অঘটনঘটন কুশলী অসামান্য ব্যক্তি যাদের মেসে নাই, তাদের কাছে এ কাহিনী বলা যে বৃথা বাক্য ব্যয় তা অবশ্য জানি।

ঘনাদা যে দিনকে রাত করতে পারেন এবং অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন, একথা তারা জানবে কী করে? সওয়া পাঁচটায় খেলা আরম্ভ, কিন্তু সেদিন আমরা পরস্পরকে তাগাদা দিতে শুরু করেছি বেলা বারোটা থেকেই। টিকিট আগে থাকতে কেনা থাকলে কী হয়, টিকিট যারা কিনে রেখেছে, গেটে তাদের ভিড়ও তো কম নয়। সেই ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই যদি খেলা শুরু হয়ে যায়, তা হলে তখন খেলা দেখব, না সিটের নম্বর খুঁজে বেড়াব?না, যেতে যদি হয়, আগে যাওয়াই ভাল। সর্বসম্মতিক্রমে এই প্রস্তাব গ্রহণ করে আমরা ক্ষণে-ক্ষণে পরস্পরকে উৎসাহিত যেমন করেছি, নজরও রেখেছি তেমনই এ ওর ওপরে।

আমাদের গৌর বড় বেশি ঘুমকাতুরে। দুপুরে খাওয়ার পর একটু গড়িয়ে নেওয়া তার চাই-ই, আর একবার গড়ালে কত বেলা পর্যন্ত তা যে গিয়ে ঠেকবে তার কোনও ঠিক নেই। তাই শিবু তাকে পাহারা দিয়েছে। আধ ঘণ্টা, পনেরো মিনিট অন্তর জিজ্ঞাসা করছে, কীরে গৌর, জেগে আছিস তো?তারপর গৌরের ক্রমশ সংক্ষিপ্ত ও উত্তরোত্তর উষ্ণতর প্রতিবাদ শুনে বলেছে, দেখিস, ঘুমোসনি যেন?

শিবুর ওপর আবার পাহারায় রাখতে হয়েছে শিশিরকে। শিবুর বড় ভুলো-মন। ঠিক বেরুবার সময় রাস্তায় বেরিয়ে সে হয়তো বলবে, ওই যা, মনি ব্যাগটা ফেলে এসেছি, কিংবা নিদেন পক্ষে বলবেই, দাঁড়া ভাই-ঘরের জানালাটা বন্ধ করে আসি, নইলে বৃষ্টিতে সব ভিজে যাবে।

শিশির তাই মিনিটে-মিনিটে শিবুকে সাবধান করেছে, কোনও কিছু ভুল যেন তার না হয়। শিশিরের ওপর আবার নজর রাখতে হয়েছে আমাকে। কোনও কিছু দরকারি। কাজে বেরুবার ঠিক আগের মুহূর্তে তার একটা কিছু হারাবেই। হয় এক পাটি জুতো সে খুঁজে পাবে না, কিংবা পাঞ্জাবির বোতাম তার কোথায় যে আছে মনে করতে না পেরে নিজের ও আমাদের সকলের টেবিল দেরাজ ঘেঁটে সে তছনছ করবে।

ওদের সকলকে পাহারা দেওয়া সত্যি দরকার। কিন্তু আমাকে অমন ক্ষণে-ক্ষণে বিরক্ত করার সত্যি কোনও মানে হয়? ওদের ধারণা—কোথা থেকে এ-ধারণা হল তা জানি না–আমার নাকি সময়ের কোনও জ্ঞান নেই। এক-আধ ঘণ্টা এদিক-ওদিক কখনও কখনও আমার হয় না এমন কথা বলছি না, কিন্তু তাই বলে পনেরো মিনিট অন্তর ঘড়িটা একবার দেখুন দিকি! অথবা, ক-টা বাজল খেয়াল আছে? শুনতে কার ভাল লাগে।

বিরক্ত হয়ে শেষে ঘড়িটাই আমি গৌরের বিছানার ওপর ফেলে দিয়ে বলেছি, ঘড়িটা নিজের কাছেই রাখো না, ক-টা বাজল তা হলে আর মিনিটে মিনিটে জিজ্ঞেস করতে হবে না!

ঠিক সেই মুহূর্তে ঘনাদা ঘরে ঢুকে গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলেছেন, উহুঃ, ঠিক হচ্ছে না, ঠিক হচ্ছে না ওটা।

কী ঠিক হচ্ছে না, ঘনাদা—অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছি আমরা।

ঘনাদা তখখুনি কোনও জবাব না দিয়ে ধীরে-সুস্থে শিশিরের টেবিল থেকে কেসটা তুলে তা থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধরিয়ে আরাম করে—আরামকেদারার অভাবে তার বিছানার ওপরই দুটো বালিশ ঠেসান দিয়ে বসে—একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বলেছেন, ওই না-দেখেশুনে ঘড়ি নেওয়া।

ঘনাদার রকম-সকম ভাল মনে হয়নি। ইশারায় শিশির, গৌর, শিবুকে সাবধান করে দিয়ে একটু হেসে বলেছি, ও-ঘড়ি আর দেখবার শোনবার কিছু নেই ঘনাদা, সুইটজারল্যান্ডের একেবারে সবচেয়ে বনেদি কারখানার ছাপ ওতে মারা।

ঘনাদা একটু হেসেছেন, ছাপ ওরকম মারা থাকে। ছাপ দেখে কি আর ঘড়ি চেনা যায়?

আপনি ঘড়িও চেনেন নাকি ঘনাদা? শিবু বুঝি না জিজ্ঞেস করে পারেনি।

হ্যাঁ, তা একটু চিনি বইকী! না চিনলে এই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ আর কি হত? তার দরকারই হত না।

ঘনাদার সঙ্গে আমাদের বেশ ভাল রকমই পরিচয় আছে, তবু একথার পর খানিকক্ষণ আমরা একেবারে থ হয়ে গেছি। কারুর মুখ দিয়ে কোনও কথাই বেরোয়নি। গৌরই প্রথম বলেছে, কিন্তু ঘড়ি তো আপনাকে ব্যবহার করতে কখনও দেখলাম না!

না, ঘড়ি-টড়ি আমি ব্যবহার করি না! সিগারেটে একটা সুখটান দিয়ে ঘনাদা বলেছেন, তবে, ঘড়ি একবার পেয়েছিলাম কয়েকটা।

পেয়েছিলেন? কটা ঘনাদা? শিশিরের বিদ্রূপটা খুব অস্পষ্ট নয়। কিন্তু ঘনাদা নির্বিকার ভাবে খানিকক্ষণ চোখ বুজে থেকে বলেছেন, যতদূর মনে পড়ছে, মোট দু-লক্ষ তিপ্পান্ন হাজার তিনশো একটা। ঘনাদার কাছে থাকা আর নিরাপদ নয় বুঝে শিবুকে তাড়া দিয়ে বলেছি, ওহে, ওঠো না এইবার। সময় তো হয়ে এল।

শিবু তা সত্ত্বেও জিজ্ঞাসা করেছে, সে-সব ঘড়ি গেল কোথায় ঘনাদা? কোথায় রেখেছেন মনে নেই বুঝি ?

না, মনে থাকবে না কেন, খুব মনে আছে। সেগুলো রেখেছিলাম, ১২৫ ডিগ্রি দ্রাঘিমা যেখানে ৩৫ ডিগ্রি অক্ষাংশকে কেটে বেরিয়ে গেছে ঠিক সেইখানে। তবে সেগুলো এখন অচল।

ঘনাদা গলা খাঁকারি দিয়ে নড়েচড়ে বসতেই সভয়ে উঠে পড়ে শিশিরকে ঠেলা দিয়ে বলেছি, উড়ে পড়া শিশির, তুমি তো আবার শিরে সংক্রান্তির সময় জুতো খুঁজতে জামা হারিয়ে ফেলবে।

কিন্তু ঘনাদা তখন শুরু করে দিয়েছেন, ১৯৩৭ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর, প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণে যে বিরাট সাইক্লোন আর টাইড্যাল ওয়েভ অর্থাৎ প্রলয় বন্যা দেখা দেয়, তার কথা তোমাদের মনে আছে কিনা জানি না। তবে, খবরের কাগজে বিশদভাবেই সব বিবরণ বেরিয়েছিল। টাইড্যাল ওয়েভের পাহাড় প্রমাণ ঢেউ পশ্চিমে নিউজিল্যান্ড ও পুবে দক্ষিণ আমেরিকার চিলির পার্বত্য উপকূল পর্যন্ত তো পৌঁছোয়ই; উত্তরে, অথবা ঠিক করে বলতে গেলে, উত্তর-পশ্চিমে ডুসি, পিটকেয়ার্ন দ্বীপ থেকে শুরু করে তাহিতি টোঙ্গা ফিজি সামোয়া পর্যন্ত অসংখ্য দ্বীপ প্রায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় বললেই হয়। অস্ট্রাল দ্বীপপুঞ্জের কয়েকটা তো একেবারে নিশ্চিহ্নই হয়ে গিয়েছিল কিছুকালের মতো। প্রচণ্ড ঝড়ে আর এই সমুদ্র বন্যায় কত লোক যে মারা যায় তার লেখা-জোখা নেই।

টাইড্যাল ওয়েভ-এর প্রায় দুমাস আগের কথা। হাওয়াই থেকে সামোয়া হয়ে, ফিজি দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত তখন আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা চালাই, তিনটে জাপানি মালের জাহাজ ভাড়া নিয়ে। আমদানি-রপ্তানির কারবারটা অবশ্য লোক দেখানো ব্যাপার। বাইরে এই সব দ্বীপ থেকে ইউরোপ আমেরিকায় নারকোল-শাঁস চালান দিয়ে তার বদলে ছুরি কাঁচি থেকে শুরু করে, ঘড়ি সাইকেল সেলাই-এর কল পর্যন্ত টুকিটাকি নানা জিনিস আমদানি করি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে ধান্দায় ঘুরি, তারই সম্পর্কে হঠাৎ একদিনেই আমেরিকা আর ইংল্যান্ড থেকে গোপন কোড-এ লেখা দুটি রেডিয়ােগ্রাম একসঙ্গে এসে হাজির। নেভিল আর ফ্রাঙ্ক দুজনেই তখন বেঁচে।

শিশির অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছে, নেভিল আর ফ্রাঙ্ক? তারা আবার কে?

গৌর গম্ভীর মুখে বলেছে, বুঝতে পারলিনে? নেভিল—চেম্বারলেন আর ফ্রাঙ্কলিন—রুজভেল্ট!

ওঁরাই আপনাকে তার করেছিলেন? চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞাসা করেছে শিবু, আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল বুঝি?

যেন অত্যন্ত সামান্য ব্যাপার, এইভাবে কথাটা হাত নেড়ে উড়িয়ে দিয়ে ঘনাদা বলেছেন, যাক গে সেসব কথা। হ্যাঁ, যা বলছিলাম—দুই রেডিয়োগ্রামেই এক কথা, সমূহ বিপদ, প্রশান্ত মহাসাগরের কাজ ফেলে এক্ষুনি যেন চলে আসি।

কিন্তু একটা মানুষ একসঙ্গে আমেরিকা আর ইংল্যান্ডে তো যেতে পারে না। সেই মর্মেই দুটো তার দু জায়গায় পাঠিয়ে আরও বিশদ বিবরণ জানতে চাইলাম।

বিশদ বিবরণ শুধু পরের রেডিয়োগ্রামে নয়, বেতারের খবরেও কিছুটা তার পরদিন পাওয়া গেল। ইউরোপ আমেরিকা ইংল্যান্ডের নানা জায়গায় হঠাৎ রহস্যজনক ভাবে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হয়ে বড় বড় বাড়ি-ঘর, কারখানা, রেলের লাইন প্রভৃতি উড়ে যাচ্ছে। গোয়েন্দা-পুলিশ সব জায়গায় এই অভাবনীয় ব্যাপারে শুধু ছুটোছুটি করে হিমসিম খাচ্ছে না, কিছু বুঝতে না পেরে একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে গেছে। ভ্যাবাচ্যাকা হওয়া কিছু বিচিত্র নয়। কারণ যেসব জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটছে, পুলিশ সেখানে কোনওরকম বোমা বারুদ ডিনামাইটের নাম-গন্ধও পাচ্ছে না এবং এরকম এলোপাথাড়ি ধ্বংসের কাজ চালাতে পারে এমন কোনও দেশদ্রোহী প্রবল গুপ্তদলের কথাও তাদের জানা নেই।

অবস্থা এই রকম সঙ্গিন বলেই, আমাদের বিভাগের বড় বড় মাথা যে যেখানে আছে সকলের ডাক পড়েছে পরামর্শ সভায়। কিন্তু ইংল্যান্ড আমেরিকা, দু জায়গার কোথায় যাব, দোমনা হয়ে ঠিক করতে না পেরেই, শেষ পর্যন্ত স্থির করলাম, সামোয়া দ্বীপের পালোলো উৎসবটা আগে না দেখে অন্য কোথাও যাব না। ভাবলাম, কাছে থেকে যা দুর্বোধ, দূর থেকে ঠাণ্ডা মাথায় সে রহস্যের খেই হয়তো পেয়েও যেতে পারি।

পালোলো উৎসব পৃথিবীর একটি অষ্টম আশ্চর্য ব্যাপার বললেই হয়। বৎসরে মাত্র দুটি দিন এই উৎসব হয়। সামোয়া আর ফিজি দ্বীপপুঞ্জের চারিদিকে ঠিক নির্দিষ্ট অরিখে যেন অলৌকিক মন্ত্রবলে পালোলো নামে সংখ্যাতীত এক রকম সামুদ্রিক পোকা জলের ওপর ভেসে ওঠে, দুভাগ হয়ে বংশ বিস্তার করবার জন্যে। পালোলোর এই বংশ বিস্তারের লগ্ন সামুদ্রিক মাছেদেরও জানা। ঝাঁকে ঝাঁকে তারাও সেদিন ভেসে ওঠে। পালোলোরা বংশ বিস্তার যত না করে, সমুদ্রের এই মাছেদের পেটে যায় তার বেশি। কিন্তু পালোলো আর মাছের ঝাঁকের ওপরেও আছে আর এক প্রাণী। তারা, পলিনেশিয়ান জেলে। মাছ ও পালোললা দুই-ই তাদের কাছে পরম সুখাদ্য। রাশি রাশি মাছ ও পালোলো ধরবার সুযোগ হয় বলে বৎসরের এই দুটি দিন তাদের কাছে একটা মস্ত পরব।

কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায়, খোশ মেজাজে এ-পরব দেখা সেবার আমার ভাগ্যে নেই। হাওয়াই দ্বীপের হনলুলু থেকে এপিয়া বন্দরে আসবার পথে জাহাজেই ওই দুটি রেডিয়োগ্রাম পেয়েছিলাম। সামোয়া দ্বীপপুঞ্জের উপোলু দ্বীপের এই এপিয়া বন্দরটিই তখন আমার কারবারের প্রধান ঘাঁটি। সেখানে পৌঁছেই খবর পেলাম, দিন তিনেক আগে আমার ওয়্যার হাউজ থেকে বড় গোছের একটা চুরি হয়ে গেছে। চুরি না বলে তাকে ডাকাতিই বলা উচিত। রাত্রে দরজার তালা ভেঙে প্রায় হাজার পঞ্চাশ টাকার মাল ডাকাতেরা সরিয়ে নিয়ে গেছে আমার দুজন পাহারাদারকে পিছমোড়া করে বেঁধে। পুলিশকে খবর আগেই দেওয়া হয়েছিল। নিজে গিয়ে থানায় একবার দেখাও করতে হল–এপিয়া—ব্রিটিশ এলাকা। প্রধান পুলিশ কর্মচারি আমার বিশেষ পরিচিত জন লেমান নামে একজন মার্কিন। কী কী ধরনের কত মাল চুরি গেছে তার একটা তালিকা তাকে দিলাম। দামি মালের মধ্যে ইউরোপ থেকে আনানো শ-পাঁচেক রেডিয়ো সেট আর শ-তিনেক সাইকেল। কয়েক বাক্স ঘড়িও তার মধ্যে ছিল। লেমান আমায় আশ্বাস দিলে যে, মাল যদি চোরেরা ইতিমধ্যে পাচার করেও দিয়ে থাকে, তবু সাইকেল আর রেডিয়ো বেশির ভাগই সে উদ্ধার করে দিতে পারবে। তবে ঘড়িগুলোর কথা বলতে পারে না। সেগুলো হাতে হাতে লুকিয়ে চালান দেওয়া সহজ। খুশি হয়ে বললাম, তুমি অন্যগুলো যদি উদ্ধার করে দাও, ঘড়িগুলোর জন্য আমি ভাবি না। সেগুলো নেহাত সস্তা খেলো জিনিস। চেহারা দামি ঘড়ির মতো জমকালো হলেও, আসলে ছেলে-ভুলানো জাপানি মাল।

কিন্তু এই সস্তা খেলো ঘড়িগুলোই এক জ্বালা হয়ে উঠল। লেমানের কাছ থেকে বাড়ি ফিরে দেখি, আবার দুটি তার এসে হাজির। তার একটি লণ্ডন থেকে, আগেরগুলির মতোই তাড়াতাড়ি রওনা হবার তাগিদ, আর একটি জাপানের যে-কোম্পানি থেকে ঘড়িগুলো আমায় পাঠানো হয়েছে, সেগুলো আমি যেন অবিলম্বে ফেরত পাঠাই, কারণ আমি যে-ঘড়ির অর্ডার দিয়েছিলাম তার বদলে এগুলি চালান দেওয়া হয়েছে।

যে-ঘড়ি চোখেই দেখিনি তা অর্ডার-মাফিক না অন্যকিছু, কী করে আর জানব, ঘড়িগুলো যে আমার গুদাম থেকে চুরি গেছে, এই কথা জানিয়ে এক টেলিগ্রাম করে পালোলো উৎসবের জন্য একটি মোটর লঞ্চে করে বেরিয়ে পড়লাম। লন্ডনের টেলিগ্রামের জবাবই আর দিইনি। মনটা সেজন্যে একটু খচখচ করছিল। কাজে ফাঁকি দিয়ে এই পরব দেখতে গিয়েই প্রধান রহস্যের সূত্র যে পেয়ে যাব তখন তো আর জানতাম না!

মাঠের ওপর যেমন মেলা হয়, পালোলো উৎসব তেমনই সমুদ্রের ওপরকার মেলা। বন্দর ছাড়িয়ে কয়েক মাইল যাবার পর সমুদ্রের একটি বিশেষ অঞ্চলে যে দৃশ্য চোখে পড়ে তা বর্ণনা করে কঠিন। মাইলের পর মাইল জলে অগুনতি পালোলো আর মাছের ঝাঁক কিলবিল করছে। মাছেদের রুপোলি ডানার ঝিলিকে সমুদ্রে যেন ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে মনে হয়। পোকা ও মাছের লোভে অসংখ্য সামুদ্রিক পাখি সেই সঙ্গে সাদা পাখার ঝাপটায় বাতাস তোলপাড় করে ফিরছে। এরই ভেতর যেদিকে চাও, পলিনেশিয়ান জেলেদের নানা রংয়ের ডিঙি আর জাল। সেসব ডিঙিতে উৎসবের সাজে মেয়েরাও এসেছে মজা দেখতে। নৌকাগুলোতে নানা রঙের নিশান আর ফুলের সাজ, মেয়েদের মাথায় ও গলায় ফুলের মালা, কেউ-কেউ আবার বাজনাও এনেছে গান গাইতে ও বাজাতে! আমার মতো দু-চার জন শৌখিন লোক একলা বা দল বেঁধে শুধু এই দৃশ্য উপভোগ করবার জন্যই নিজেদের মোটর লঞ্চে বা ছোট স্টিমারে এসে জড়ো হয়েছে।

পালোলো উৎসব খুব ভাল ভাবেই জমেছিল। উজ্জ্বল, নির্মেঘ আকাশ, ঝড় বাতাসহীন শান্ত সমুদ্র, হঠাৎ তারই মাঝে বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতো একটা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। সেই সঙ্গে কাছাকাছি তিনটি নৌকো আরোহীদের নিয়ে আকাশে টুকরো-টুকরো হয়ে ছিটকে উঠে একেবারে নিশ্চিহ্ন। এ কী আশ্চর্য ব্যাপার! সমুদ্রের জলে মাইন না থাকলে তো এ রকম হতে পারে না! কিন্তু মাইন

এ-অঞ্চলে কেমন করে থাকবে? আসবে কোথা থাকে?

দেখতে-দেখতে আরও দু জায়গায় ওই রকম দুটি বিস্ফোরণ পর-পর হয়ে গেল। পলকের মধ্যে উৎসবের আনন্দ আতঙ্কে পরিণত হল। সমুদ্র তখনও তেমনই মাছে আর পোকায় কিলবিল করছে, সাগর-চিলগুলো তেমনই ঝাঁকে ঝাঁকে জলের ওপর ছোঁ মারছে, কিন্তু মাইনের ভয়ে জেলে ডিঙিগুলি প্রাণপণে সে-অঞ্চল ছেড়ে পালাচ্ছে।

মোটর লঞ্চে আমিই অবশ্য প্রথম এই দুর্ঘটনার খবর এপিয়াতে নিয়ে এলাম। দেখা করলাম গভর্নরের সঙ্গে। তিনি তো এ-খবর শুনে একোরে থযুদ্ধবিগ্রহ নেই, কোনও গোলমাল কোথাও নেই, হঠাৎ সামোয়া দ্বীপপুঞ্জের বিশেষ একটি সামুদ্রিক অঞ্চলে মাইন ভাসিয়ে দিয়ে যাবে কে? তাও বন্দরের মধ্যে হলে না হয় উদ্দেশ্য খানিকটা বোঝ যেত, যেখানে কস্মিনকালে জেলেডিঙি ছাড়া কোনও বড় জাহাজ যায় না, সেখানে এ-মাইন ভাসানোতে কার কী স্বার্থ? ভাল করে ব্যাপারটার সন্ধান নেবার জন্য আমার সঙ্গেই একটি পলিশ লঞ্চ পাঠাবেন বলে গভর্নর ঠিক করলেন। লেমানকে খবর পাঠিয়ে দিলেন, আমায় আমার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাবার জন্য। দু মুঠো খেয়ে নেবার জন্য আমার আস্তানায় গিয়ে দেখি, আর এক হাঙ্গামা সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। যে-কোম্পানির কাছ থেকে ওইসব ঘড়ি আনিয়ে ছিলাম, তাদের একজন বড় কর্মচারী নিজে এসেছেন ঘড়িগুলো ফেরত নিয়ে যাবার জন্য। কর্মচারীর নাম মি. ওকামোতো। শুনলাম তিনি ইয়োকোহামা থেকে প্লেনে করে আজ সকালেই এসে এখানে পৌঁছেছেন ও আমার জন্য এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে আছেন। একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ওই কটা সস্তা খেলো ঘড়ির জন্য আপনাদের এত মাথাব্যথা?

একটু সলজ্জভাবে হেসে মি. ওকামোতো বললেন, ঘড়িগুলো সস্তা হতে পারে, কিন্তু ভুলটা কোম্পানির পক্ষে বড় বেশি লজ্জার। সেইটে শোধরাবার জন্যই তাঁদের এত বেশি ব্যাকুলতা।

কিন্তু, ঘড়ি যে চুরি গেছে তা তো আপনাদের জানিয়েছি।

মি. ওকামোতো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে যা বললেন, তাতে আরও অবাক হলাম। এ-ঘড়ি ফেরত না নিয়ে যেতে পারলে তাঁর মুখে চুনকালি পড়বে, তাই এ ভুলের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ কিছু গুণাগার দিতেও তিনি প্রস্তুত।

বুঝলাম, ঘড়ি চুরির কথা মি. ওকামোত বিশ্বাস করতেই পারছেন না। একটু বিরক্ত হয়েই তাই বললাম, আপনাদের ওই ছেলে-ভুলানো ঘড়ি লুকিয়ে রেখে আমার কোনও লাভ আছে মনে করেন? সত্যি চুরি গেছে কিনা, চলুন আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি।

চুরি প্রমাণ করবার জন্য গুদামে যাওয়ার আর দরকার হল না, মি. লেমান আমার খোঁজে সেই মুহুর্তেই এসে ঘরে ঢুকলেন। ওকামোতের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললাম, ইনিই এখানকার পুলিশ-চিফ। আমার গুদাম ভেঙে ডাকাতরা ঘড়ি এবং অনেক কিছু নিয়ে গেছে কি না, ওঁর কাছেই শুনতে পাবেন!

মি. লেমান আমার কথা সমর্থন করার পর শান্তশিষ্ট ওকামোতো হঠাৎ একেবারে জ্বলে উঠলেন। সবেগে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে-যেতে যা বলে গেলেন তার মর্ম এই যে, তাঁদের কোম্পানির সঙ্গে এই চালাকি করার ফল কী, আমরা শিগগিরই হাড়ে হাড়ে বুঝব।

মি. লেমান একটু অবাক হয়ে বললেন, কী এমন দামি ঘড়ি মশাই, যার জন্য এত আস্ফালন?

দেখবেন? বলে আমার ম্যানেজারকে একটি ঘড়ি নিয়ে আসতে বললাম। চোরেরা কেস ভেঙে নিয়ে যাবার সময় কয়েকটি ঘড়ি গুদামের মধ্যে অসাবধানে পড়ে গেছল। সেগুলো আমি বাড়িতেই আনিয়ে রেখেছিলাম। ম্যানেজার তা থেকে একটি ঘড়ি এনে আমার হাতে দিলে। লেমান সেটি নিয়ে একটি পরীক্ষা করে বললেন, এ-জাতের বুদ্ধি সত্যি অসাধারণ। এমনিতে দেখলে মনে হবে, যেন নামজাদা কোন সুইস কোম্পানির হাতঘড়ি?

হেসে বললাম, অথচ দাম তার দশ ভাগের এক ভাগও নয়।

টেবিলের উপর সেখানকার খবরের কাগজটা ভোলা ছিল, তার ওপর ঘড়িটা রেখে উঠে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ, ঘড়ির তলায় যে-খবরের শিরোনামটা দেখা যাচ্ছিল সেইটে পড়বামাত্র মাথার ভেতর দিয়ে যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। মি. লেমানকে উত্তেজিতভাবে বললেন, মাপ করবেন মি. লেমান, আপনার সঙ্গে আজ যেতে পারছি না। ড. ডেভিসের কাছে এখুনি আমার যাওয়া দরকার!

সে কী! ড. ডেভিসের কাছে হঠাৎ কেন? অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন মি.

লেমান।

কেন? ড. ডেভিস পৃথিবীর একজন নামজাদা রাসায়নিক বলে। তিনি যে কয়েক মাসের জন্য শরীর সারাতে এপিয়াতে এসে বাস করছেন এ-ও আমাদের সৌভাগ্য বলে।

কিন্তু পালোলো উৎসবের দুর্ঘটনাগুলোর রহস্য আগে সন্ধান করতে গেলে ভাল হত নাকি?

না, মি. লেমান, মনে হচ্ছে, আপনারও সেখানে যাবার আর দরকার নেই। বলে টেবিল থেকে ঘড়িটা তুলে নিয়ে মি. লেমান কোনও কিছু বলবার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম।

সেদিন সারারাত ড. ডেভিসের সঙ্গেই তাঁর বাইরের ঘরে গভীর গবেষণায় কাটালাম। পরের দিন দুপুরেই ইউরোপ আমেরিকার সমস্ত বড় বড় রাজ্যে গোপন কোডে টেলিগ্রাম করে দিলাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের কাছে।

পনেরো দিন পর্যন্ত ইউরোপ ও আমেরিকার নানা জায়গা থেকে অল্প-বিস্তর। দুর্ঘটনার সংবাদ পাওয়া গেল। আমাদের এপিয়া ও কাছাকাছি নানা জায়গা থেকেও কয়েকটা বিস্ফোরণের খবর এল। তারপর সব গেল শান্ত হয়ে। ইউরোপ ও আমেরিকার যে-কোনও রেডিয়ো খুললে এই কদিন প্রতি ঘন্টায় একটি বিশেষ বিজ্ঞপ্তিই বার বার শোনা যেত। প্রতি খবরের কাগজে ওই একই কথা। ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে দুটি জাহাজ তখন এপিয়ার দিকে রওনা হয়েছে। জাহাজ দুটি এসে পৌঁছোল, ১৯৩৭ সালের ১৩ই ও ১৪ই সেপ্টেম্বর। সেই সঙ্গে আমেরিকা থেকে চারটি বিরাট আর্মি প্লেনও আনিয়ে নিয়েছিলাম। ১৫ই সেপ্টেম্বর জাহাজ দুটি থেকে সেই চারটি প্লেনে কয়েকটি বড় বড় কাঠের বাক্স তুলে আমি ও ড. ডেভিস সকাল আটটায় রওনা হলাম। সন্ধ্যা নাগাদ চারটি প্লেন যেখানে একসঙ্গে পৌঁছোল, আমাদের চার্ট দেখে বুঝলাম, তার দ্রাঘিমা ১২৫ ডিগ্রি আর অক্ষাংশ ৩৫ ডিগ্রি। বেতার ইঙ্গিতে সকলকে আদেশ জানাবার পর চারটি প্লেন থেকে কয়েকটি বড় বড় বাক্স সমুদ্রের ওপর ফেলে দেওয়া হল।

ড. ডেভিস আর আমি দুজনেই এতক্ষণ যেন কীসের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়েছিলাম। এতক্ষণে তিনি ধরা-গলায় বললেন, সভ্য জগতের সবচেয়ে বড় বিপদ বোধহয় কেটে গেল।

আমি একটু ম্লান হেসে বললাম, আপাতত!

ঘনাদা চুপ করলেন।

গৌর উৎসুকভাবে জিজ্ঞাসা করলে, ওই বাক্সগুলোর মধ্যে কী ছিল, ঘনাদা? ঘড়ি?

হ্যাঁ, দুলক্ষ তিপ্পান্ন হাজার তিনশো একটা ঘড়ি। ঘড়ি নয়, তার প্রত্যেকটা হল এক-একটি খুদে অ্যাটম বোমার শামিল। এমনভাবে সেগুলি তৈরি যে, কোনওটি তিন দিন, কোনওটি বা তিন মাস ধরে দম দেওয়ার পরই তার গোপন দুটি খুদে কুঠরি খুলে গিয়েটি, এন. টি.-এর চেয়েও সাংঘাতিক দুটি রাসায়নিক পদার্থ একসঙ্গে মিশে যায়। এই মিশ্রণের ফলে যে বিস্ফোরণ হয় তা অ্যাটম বোমার মতো না হলেও ডিনামাইটের চেয়ে অনেক বেশি প্রচণ্ড। যে-কোম্পানি এই ঘড়ি তৈরি করেছিল, সস্তা দরে সমস্ত ইউরোপ আমেরিকায় এগুলি ছড়িয়ে দিতে তাদের কোনও অসুবিধা হয়নি। কারখানার মজুর থেকে কেরানি উকিল ডাক্তার অনেকেই এ-ঘড়ি সস্তার লোভে অজান্তে কিনে হাতে পরেছে। তার ফলে দুই দেশের সর্বত্র অতর্কিত বিস্ফোরণ হতে শুরু করে। আর কিছু বেশি দিন এই ঘড়ি চালাতে পারলে ওসব দেশের কলকারখানা, রেল, জাহাজ, কীভাবে যে ধ্বংস হয়ে যেত, কেউ তার হদিসই পেত না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের তাহলে আর দরকারই হত না।

ইউরোপের বদলে ভুলক্রমে কয়েক বাক্স ঘড়ি যদি আমার কাছে না এসে পড়ত, সে-ঘড়ি আবার যদি চুরি না যেত, পালোলো উৎসবে ওইরকম রহস্যময় বিস্ফোরণ তার কয়েকদিন পরেই যদি না ঘটত, ঘড়ির কোম্পানির প্রতিনিধি ওই সামান্য সস্তা খেলো ঘড়ি ফেরত নেবার জন্য প্লেনে করে ছুটে আসবার মতো। গরজ যদি না দেখাত এবং সবচেয়ে যে ব্যাপারে আমার টনক নড়ে ওঠে, আমার ম্যানেজার সেইদিনকার কাগজের একটি বিশেষ সংবাদের ওপর ঘড়িটি যদি না রেখে যেত, তাহলে এ দারুণ সর্বনাশ রহস্যের সমাধান করবার মতো খেই আমি। খুঁজে পেতাম না।

খবরের কাগজে ইউরোপের কয়েকটি কারখানার বিস্ফোরণের সংজর ওপর ঘড়িটা দেখবার পরই হঠাৎ এই সমস্ত ব্যাপারের মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে বলে আমার মনে হয়। ড. ডেভিসকে দিয়ে ঘড়িটা খুলে পরীক্ষা করবার পর আমি এ-বিষয়ে নিঃসন্দেহ হই। নিরপরাধ পলিনেশিয়ান জেলেদের কেউ কেউ না জেনে আমার কারখানা থেকে চোরাই ঘড়ির কয়েকটা কিনেই উৎসবের দিনের ওই সমস্ত বিস্ফোরণের কারণ হয়, এ তখন আমার আর বুঝতে বাকি নেই।

ঘনাদা কতকক্ষণ চুপ করে আর-একটা সিগারেট ধরাতেই শিশির বললে রেডিয়ো আর খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েই তা হলে এই ঘড়িগুলো সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু এত জায়গা থাকতে ওই কত দ্রাঘিমা আর অক্ষাংশ বললেন, সেখানে এগুলো ফেলবার মানে কী?

মানে ম্যাপ খুললেই বুঝতে পারবে। স্থলভাগ থেকে যতদুরে সম্ভব এ সর্বনাশা জিনিস ফেলতে হবে তো! ম্যাপে দেখতে পাবে, ওই জায়গার ধারে কাছে একটা দ্বীপের ফুটকি পর্যন্ত নেই।

ওখানে ফেলার দরুন কোনও ক্ষতি তা হলে আর হয়নি? জিজ্ঞাসা করলে শিবু।

না, তা আর বলি কী করে? হতাশভাবে বললেন ঘনাদা, ১৭ই সেপ্টেম্বরের টাইড্যাল ওয়েভ আর সাইক্লোনের কথা তো আগেই বলেছি। তার মূলে তো ওই ঘড়ি।

কিন্তু এদিকে ঘড়িতে কটা বাজে জানো? গৌর প্রায় আর্তনাদ করে উঠল,

রেফারি এতক্ষণে বোধহয় ফাইনাল হুইসল দিচ্ছে।

অ্যাঁ! প্রায় সমস্বরে সবাই চিৎকার করে উঠে ফ্যালফ্যাল করে পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

দাঁত

মাছ ধরতে যাওয়া আর হল না।

এতদিনের এত জল্পনা কল্পনা আয়োজন-উদ্যোগ সব ভেস্তে গেল। অথচ কী উৎসাহ নিয়েই না সব ব্যবস্থাপত্তার করা গেছল। কী নিখুঁত তোড়জোড়! কী নির্ভুল অভিযানের খসড়া!

মাছ ধরা তো নয়, সত্যিই রীতিমতো একটা যুদ্ধযাত্রা।

শিবুর ওপর কমিসেরিয়েট-এর ভার, শিশির আছে আসেনাল-এর তদারকে, আর গৌর নিয়েছে ট্রান্সপোর্ট-এর ঝক্কি।

অর্থাৎ শিবু ব্যবস্থা করবে ভূরি-ভোজনের, শিশির জোগাবে ছিপ-বড়শি, টোপ, চার আর গৌর দেবে পৌছে সেই আশ্চর্য অজানা জলাশয়ে যেখানে সভ্যতার সংস্পর্শহীন সরল মাছেরা এখনও কুটিল মানুষের কারসাজির পরিচয় পায়নি।

তারপর শুধু ছিপ ফেলা আর মাছ তোলা।

গত কদিন ধরেই তাই দারুণ উৎসাহ উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে মেসের দিন কাটছে। ধরার পর অত মাছ আনা যাবে কী করে তাই নিয়েও তুমুল তর্ক হয়ে গেছে এবং আনাও যদি যায় তা হলে বাজারে কিছু বিক্রি করতে ক্ষতি কী—এ প্রস্তাব করতে গিয়ে খেলোয়াড়ি মেজাজের অভাবের অভিযোগে শিবুকে দস্তুরমতো অপ্রস্তুত হতে হয়েছে।

শখের মাছ ধরে এনে বিক্রি।

মাছ চালানোর ব্যবসা করলেই হয় তা হলে!

এই বেঁফাস কথার সাফাই গাইতে শিবুকে সরকারি স্বাস্থ্য বিভাগের পর্যন্ত দোহাই পাড়তে হয়েছে। এত মাছ একসঙ্গে এনে এই ভাদ্রের গরমে পচলে শহরের স্বাস্থ্য বিপন্ন হতে পারে এই তার বক্তব্য।

কিন্তু তাতেও সে পার পায়নি।

পাবে কেন! খিচিয়ে উঠেছে শিশির।

বিলিয়ে দেব আমরা। উদার হয়ে উঠেছে গৌর।

প্রতিবেশীদের মধ্যে কাদের মাছ বিলিয়ে অনুগ্রহ করা যায় তার একটা তালিকাও তৈরি হতে বিলম্ব হয়নি।

এই তালিকা তৈরির মাঝখানে উদয় হয়েছেন ঘনাদা।

শিশিরের কাছে তিন হাজার তেষট্টিতম সিগারেটটা ধার নিয়ে ধরাতে ধরাতে বলেছেন, কী হে, তোমাদের Operation Pisces-এর কতদূর!

জানতি পার নার জ দেওয়া পিসেজ শুনে প্রথমটা একটু ভড়কে গেলেও তাড়াতাড়ি সামলে নিয়েছি। শিবু থাকতে আমরাও বিদ্যেয় কম যাই নাকি! পিসেজ তো জ্যোতিষের মীন অর্থাৎ মৎস্য রাশির ল্যাটিন নাম। আমরা হেসে বলেছি, দূর আর কোথায়! আপনার জ্যোতিষের মৎস্য রাশি উঠোনে এনে ফেলেছি বললেই হয়।

উৎসাহের চোটে সেই আশ্চর্য পুকুরের সরল সুবোধ মাহদের কথা উচ্ছাস ভরেই শুনিয়েছি এবার।

ঘনাদা কিন্তু শুধু একটু মুখ বেঁকিয়েছেন।

মাছ ধরতে তা হলে যাচ্ছ না। ঘনাদার কথায় যেন কোথায় খোঁচা।

যাচ্ছি না মানে? কী করতে যাচ্ছি তা হলে?

বলো, মাছ মারতে। মাছ ধরা আর মারার মধ্যে তফাত আছে কিনা। একটা হল খেলা আর একটা খুন। যে মাছ খেলাতেই জানে না তাকে ধরা নয় শুধু মারা-ই যায়।

কথাগুলো মোটেই মনঃপূত হয়নি আমাদের। তাই খুঁত ধরে বলেছি, মাছ আবার খেলাতে জানবে কী! মানুষই তো মাছকে খেলিয়ে তোলে।

খেলায়, খেলায়, মাছও খেলায়। তেমন মাছ হলে মানুষকেই খেলায়। আর মাছ যদি খেলোয়াড় না হয় তা হলে ছিপ ধরাই মিছে। তবে তেমন খেলোয়াড় আর আজকাল আছে কোথায়? শেষ দেখেছিলাম নীলিমা-কে।

নীলিমা! আমরা অবাক।

হ্যাঁ, নীলিমা। নামটা অবশ্য আমারই দেওয়া। মেয়ে নয়, মাছ। ওপরে গাঢ় নীল আর নীচে ধোঁয়াটে রুপোলি। পাক্কা সাত হাত বিশমনি টুনি। ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাভালন শহরের নাম শুনেছ কি না জানি না। মোটর বোটে ছিপ দিয়ে সমুদ্রের টুনি ধরার খেলা সেই শহরের মাথা থেকেই প্রথম বেরোয়। কিন্তু নীলিমার কাছে ঘ না দা সমগ্র সেই শহরের মাথা একেবারে হেঁট হয়ে গেছল সেবার। বাঘা বাঘা টুনি শিকারি যেখানে জমা হয়, অ্যাভালনের সেই টুনা ক্লাব একেবারে নিঃঝুম। নীলিমার কাছে হার মেনে সমস্ত শহর মর্মাহত। নীলিমা টোপ গেলে অম্লানবদনে, কিন্তু সে যেন শিকারিকে আহাম্মক বানাবার জন্যেই। নাচিয়ে খেলিয়ে বেচারা শিকারিকে নাকালের চূড়ান্ত করে শেষ পর্যন্ত ছিপের সুতোটি কীভাবে সে কেটে পালায় কেউ বুঝতে পারে । তাই নীলিমা মাছের ছদ্মবেশে জলকন্যা এমন একটা গুজবও তখন রটে গেছে।

সেই অ্যাভালন শহরে সেবার…

বেড়াতে গেছলেন, আর বাঘা বাঘা শিকারিরা যার কাছে মাথা মুড়িয়েছে, সেই নীলিমাকে মোটরবোটের বদলে ডাঙা থেকেই, হুইলের জায়গায় হাত-ছিপেই ধরে সবাইকে একেবারে তাক লাগিয়েই দিয়েছিলেন—এই তো? ঘনাদার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে এইভাবে শেষ করেও গৌর থামেনি, তার ওপর জুড়ে দিয়েছে, এ আর শোনাবেন কী! খবরের কাগজেই তো তখন বেরিয়েছিল। আমরা পড়েছি।

গৌর আমাদের দিকে সমর্থনের জন্যে তাকিয়েছে। কলের পুতুলের মতো আমরাও মাথা নেড়ে সায় দিয়েছি বটে, কিন্তু বুঝতে তখন আর আমাদের বাকি নেই যে, অবস্থা চিকিৎসার বাইরে গেছে।

একসঙ্গে ঘনাদার গল্প তাড়াতাড়ি থামানো ও তাঁকে খুশি রাখাই হয়তো গৌরের উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু ফল হয়েছে হিতে বিপরীত।

না, পড়োনি, ঘনাদার গলায় বিষাদের মেঘের ডাক, পড়তে পারো না। কারণ ব্যাপারটা যা বানালে তা নয়। আর খবরের কাগজে কিছু বার করতেই দেওয়া হয়নি।

শুনুন ঘনাদা, শুনুন। আর শুনুন!

ঘনাদা ততক্ষণে সিঁড়ি দিয়ে তাঁর টঙের ঘরে উঠছেন।

গৌরের ওপর আমরা সবাই খগহস্ত হয়েছি।

দিলি তো সর্বনাশ করে।

বাঃ! আমি তো ভালই করতে চেয়েছিলাম। গৌরের করুণ কৈফিয়ত, খবরের কাগজে পড়েছি শুনলে খুশি না হয়ে খাপ্পা হবেন কে জানত! তা ছাড়া স্টেশন-ওয়াগন যে দেবে তার সঙ্গে এই সকালেই দেখা না করলে নয়। গল্প একবার গড়ালে দুপুরের আগে কি থামত!

দোষ গৌরকে খুব দেওয়া যায় না। মাছ ধরার আয়োজনের এই ঝামেলার মধ্যে ঘনাদার গল্পটা মুলতুবি রাখার পক্ষে আমাদের সবারই সায় ছিল মনে মনে।

কিন্তু ঘনাদার মন তো আর তা শুনে গলবে না।

সেই যে তিনি বেঁকলেন, আর সোজা করে কার সাধ্য! উৎসাহ না থাকলেও আমাদের খেয়ালে আপত্তি তাঁর ছিল না আগে। আমাদের সঙ্গ ও শিক্ষা দেবার কথাও দিয়েছিলেন। সে কথা তিনি স্পষ্ট করে ফিরিয়ে নেননি এখনও। কিন্তু ভাবগতিক দেখে আমরা চিন্তিত।

রবিবারে আমাদের অভিযান! শুক্রবারে ঘনাদা তাঁর ঘর থেকে সন্ধের পর নামলেন না। ঠাকুর ওপরেই খাবার দিয়ে এল। শুনলাম তাঁর সর্দি। শনিবার সকালে শোনা গেল সর্দির সঙ্গে জুরভাব, আর রাত্রে বুলেটিনে জানলাম দাঁতের ব্যথা।

দাঁতের ব্যথা! খাবার-ঘরে আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম।

খাওয়ার পরই একতলায় শিশিরের ঘরে দরজা ভেজিয়ে মন্ত্রণাসভা বসল। ঘনাদা যে আমাদের সব মজা মাটি করবার প্যাঁচ কষেছেন, তা আর বুঝতে তখন বাকি নেই। কিন্তু আমাদেরও জেদ, ঘনাদাকে পাই বা না পাই, মাছ ধরতে যাব-ই। আর তার আগে ঘনাদাকে একটু জব্দও না করলে নয়।

পরদিন সকাল সাতটা বাজতে না বাজতেই ঘনাদার ঘরে গিয়ে সবাই আমরা হাজির। আমরা আর সদ্য ভাজা এক প্লেট গরম ক্রোকেট।

কী ব্যাপার, ঘনাদা! তিন দিন ধরে নীচে নামছেন না, আমাদের সঙ্গে যাবেন না নাকি?

কী করে আর যাই! ঘনাদার দীর্ঘশ্বাস আমাদের, না ক্রোকেট-এর প্লেটের উদ্দেশে বোঝা কঠিন।

হ্যাঁ, দাঁতের ব্যথা নিয়ে যাওয়া উচিতও নয়, আমরা সহানুভূতিতে গদগদ। কিন্তু ক্রোকেটগুলো কেমন হল আপনাকে একটু চাখানোও তো তা হলে যাবে না। সবই আমাদের ভাগ্য। চল হে।

আমাদের সঙ্গে ক্রোকেট-এর প্লেটও অন্তর্ধান হওয়ার উপক্রম দেখে ঘনাদা আর বুঝি সামলাতে পারলেন না।

অত যখন পেড়াপীড়ি করছ, দাও দেখি একটা চেখে। ঘনাদার নেহাত যেন অনিচ্ছা।

আমাদেরও যেন সঙ্কোচ—কিন্তু এই দাঁতের ব্যথায়…

গৌর প্লেটটা ঘনাদার প্রায় নাকের কাছ দিয়েই ঘুরিয়ে নিয়ে যায় আর কী!

তার হাত থেকে প্লেটটা একরকম কেড়ে নিয়েই ঘনাদা আত্মবিসর্জনের সুরে বললেন, তোক ব্যথা। একটা দায়িত্বও তো আছে। সঙ্গেও যাব না, আবার কী ছাইপাঁশ সঙ্গে নিচ্ছ, দেখেও দেব না, তা কি পারি!

প্রথম কামড়টা নির্বিঘ্নে-ই পড়ল, তারপর দ্বিতীয় কামড়–কটাস!

আমরা একসঙ্গে হাঁ হাঁ করে উঠলাম।

একদিকে ক্রোকেট-এর ভেতর থেকে বড় মার্বেল গুলিটা মেঝেতে আর একদিকে ঘনাদার মুখ থেকে দুপাটি দাঁত প্লেটের ওপর তখন ছিটকে পড়েছে।

চোখ বড় বড় করে সেদিকে তাকিয়ে গৌর গলায় মধু ঢেলে জিজ্ঞেস করলে, বাঁধানো বলে মনে হচ্ছে না? বাঁধানো দাঁতেও ব্যথা হয় তা হলে?

ঘনাদা কি অপ্রস্তুত?

আমাদেরই মনের ভুল!

ফোকলা মুখেই করুণামিশ্রিত সহিষ্ণুতার হাসি হেসে দাঁতের পাটি কুড়িয়ে নিয়ে মুখে লাগিয়ে ঘনাদা বললেন, না, তা হয় না।

তারপর তাঁর গলার স্বর গাঢ় হয়ে উঠল রহস্যে—তবে ছেলেমানুষি চালাকি করে আজ তোমরা যা জানলে একদিন তা ধরা পড়লে এই দুনিয়ার চেহারাখানাই পালটে যেত। কাঁচা দাঁত তুলিয়ে সেদিন যদি না বাঁধিয়ে রাখতাম, আর সেই নীলিমার কাছে হদিস যদি না পেতাম, তা হলে পৃথিবীর ইতিহাস আজ অন্যভাবে লেখা শুরু হত।

আবার নীলিমা! আমরা চঞ্চল হয়ে উঠি ঘর থেকে বেরুবার জন্য।

কিন্তু ঘনাদা তখন বলে চলেছেন, এই দুপাটি বাঁধানো দাঁতই এক ভুইফোড় রাজ্যের লোভর থাবা থেকে সেদিন মানুষকে বাঁচিয়েছে।

অ্যাভালন শহরের নাম সেদিন করেছি। শহরটা কোথায় বলিনি। এ শহর হল ক্যালিফোর্নিয়ার পশ্চিমে সেন্ট ক্যাটালিনা নামে ছোট এক দ্বীপে। পুরো দ্বীপটা যেন একটা নাদা পেট বেলেমাছ, দক্ষিণ-মুখো চলেছে। অ্যাভালন শহরটা যেন তার চোখ। এ শহরে বেড়াতে আমি যাইনি শখ করে। গেছলাম ডেকস্টা নামে এক পুরোনো বন্ধুর ডাকে। ডেকস্টা নামে অবশ্য তাকে খুঁজে পাবার আশা করিনি। শ্রীকৃষ্ণের শত নামের মতো তারও নামের সংখ্যা অগুনতি আর সেই সঙ্গে ছদ্মবেশও। কিন্তু নাম আর চেহারা তার যত রকমেরই হোক, স্বভাব তার চিরকাল এক। যেখানে কোনও গোলযোগের গন্ধ সেখানেই ডেকস্টা। জীবনে কত বিপদের মুখেই যে দুজনে একসঙ্গে দাঁড়িয়েছি তার হিসেব নেই। এই কিছুদিন আগেও অন্যতম শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক অ্যান্টনি ফিশার অন্তর্ধান হওয়ার পর তার খোঁজে প্রাণ হাতে নিয়ে কী না করেছি। খোঁজ যে পাইনি সে অবশ্য আমাদের একটা কলঙ্ক। এই ডেকস্টার জরুরি সংকেত টেলিগ্রাম পেয়েই অ্যাভালনে ছুটেছিলাম। টেলিগ্রামে এখনকার নাম সে দেয়নি। যে নামেই থাকুক তাকে খুঁজে আমি বার করবই সে জানত।

ঘনাদার দম নেওয়ার ফাঁকে নীচে স্টেশন-ওয়াগনের হর্ন শুনতে পেলাম। মন তখনও উসখুস করছে।

আচ্ছা, তা হলে, বলে গৌর তো উঠেই দাঁড়াল, কিন্তু ওই উঠে দাঁড়ানো পর্যন্তই।

ঘনাদা আবার ধরলেন।

অ্যাভালনে নেমেই ডে কস্টাকে খুঁজে ঠিক বার করলাম। কিন্তু জীবিত অবস্থায় নয়। ডে-কস্টা আমার পৌছোবার আগের দিনই সেন্ট ক্যাটালিনার পশ্চিম দিকের সমুদ্রে কেমন করে ড়ুবে মারা গেছে। ওখানকার ক-জন জেলে তার হাঙরে ঠোকরানো মৃতদেহটা উদ্ধার করেছে কোনওমতে। অ্যাভালনের কেউ তাকে ডে-কস্টা বলে শনাক্ত করতে অবশ্য পারেনি। মিলার বলে যে ছদ্মনামে সে এখানে ছিল দু-একজন সেই নামেই তাকে চিনেছে।

ডেকস্টার ড়ুবে মরাটা আমার কাছে কেমন রহস্যময় ঠেকল। ফুর্তির সাঁতার কাটতে ড়ুবে মরার ছেলে তো সে নয়। কী করতে সে এখানে এসেছিল? আমাকেও ডেকে পাঠাবার কারণ কী?

ডে-কস্টাই নেই—এ রহস্যের হদিস কে দেবে! তবু তার সংকেত-টেলিগ্রামটা আর একবার পড়ে দেখলাম। ডে-কস্টা অতি সাবধানী। সংকেত-লিপিতে পাঠানো টেলিগ্রামের পাঠোদ্ধার করলেও কিছু সন্দেহ করবার নেই। টেলিগ্রামের কথা হল এই, অ্যাভালনের টুনি মাছ সব শিকারীর স্বপ্ন। ধরবে তো তাড়াতাড়ি এসো।

না, এ টেলিগ্রামে আসল রহস্যের কিছুই বোঝবার উপায় নেই। সত্যিই রহস্য কিছু নেই, এমন কি হতে পারে! সংকেত-লিপিটা হয়তো তার রসিকতা, আসলে ক-দিনের ছুটি উপভোগ করবার জন্যে টুনি মাছ ধরতে সে আমায় ডেকে পাঠিয়েছে, এমন হওয়াও তো সম্ভব।

কিন্তু এ ব্যাখ্যা মন কেন যেন মানতে চায় না। ডেকস্টার মতো মানুষ খেলা কি ছুটির মর্ম জানে না, রহস্যের পেছনে ছোটাই তাদের জীবন, তাদের ছুটি।

তা হলে টুনি শিকারের মধ্যেই রহস্যের সূত্র হয়তো কোথাও লুকিয়ে আছে নাকি?

অ্যাভালন শহরে তখন নীলিমাই একমাত্র প্রসঙ্গ। রাস্তায় ঘাটে দোকানে বাজারে ও-ছাড়া আর কথা নেই। টুনা ক্লাবে তাই যেতে হল। ছিপ নিয়ে মোটর বোট ভাড়া করে একদিন টুনি-শিকারেও বেরুলাম। দেখাও পেলাম নীলিমার, আর কানমলাও যথারীতি। নাচিয়ে খেলিয়ে নীলিমাকে যখন প্রায় বোটে তুলতে যাচ্ছি, কেমন করে ওই ইস্পাতের তারের মতো শক্ত সুতো কেটে সে পালাল।

রোখ চেপে গেল আমারও। কিন্তু একদিন দুদিন তিনদিন নীলিমার কাছে নাকের জলে চোখের জলে হয়ে চার দিনের দিন আর শিকারে বেরুলাম না। মোটর লঞ্চ ভাড়া করে গেলাম আসল ক্যালিফোর্নিয়ার নিউ পোর্ট শহরে। ড়ুবুরির পোশাক পরে গভীর সমুদ্রের তলায় বল্লম দিয়ে মাছ শিকার সেখানকার এক খেলা। একদিন সেই খেলায় কাটিয়ে টুনা ক্লাবে ফিরতেই টিটকিরি শুলাম, কী রে নিগার! টুনা ধরার শখ মিটল! পালিয়েছিলি কোথায়?

টিটকিরি আর কারুর নয়, ক্লাবের সবচেয়ে ধনী সভ্য বেনিটোর। যেমন বদখদে সাদা গণ্ডারের মতো লোকটার চেহারা, তেমনই তার পয়সার অহঙ্কার। সাদা চামড়ার সভ্যদেরই সে মানুষ বলে গণ্য করে না তো আমাকে!

আমার কাছে কোনও জবাব না পেয়ে সে আমার টেবিলের ধারেই এসে দাঁড়িয়ে গোরিলার মতো হাতের বিরাশি সিক্কা একটি চাপড় আমার পিঠে বসিয়ে মুলোর মতো দাঁত বের করে হেসে বললে, তুই গুগলি ধর, বুঝেছিস, হাঁটু জলে কাদা ঘেঁটে গুগলি! যেমন মানুষ তেমনি তো শিকার।

ঠাট্টার ছলে সঙ্গে সঙ্গে আর একটি গোরিলা-হাতের রদ্দা।

তবু কোনও জবাব না দিয়ে শুধু একটু হাসলাম।

বেনিটো ঘৃণা ভরেই এবার আমায় রেহাই দিয়ে চলে গেল।

বেশির ভাগ পয়সার সামনে দণ্ডবৎ হলেও মার্কিন মাত্রেই অমানুষ নয়। বেনিটোর এই অহেতুক জুলুম অনেকেরই খারাপ লেগেছে বুঝলাম। কেউ কেউ এসে আমার ওপর রাগও দেখালে—তুমি মানুষ না কী! কী বলে ওই অসভ্য জানোয়ারটার জুলুম সহ্য করলে বল তো!

হেসে বললাম, জুলুম আর কী। বড়লোকের রসিকতাই ওই রকম। অত বড় একটা নিজস্ব পেল্লায় জাহাজ নিয়ে যে দুনিয়াটা টহল দিয়ে বেড়াতে পারে, কত তার পয়সা ভাবতে পারো। ওরকম লোক আমাদের মতো মানুষকে পোকা-মাকড় মনে করবে না তো করবে কে! একটু খুশি রাখলে ওর জাহাজের পার্টিতে একদিন নেমন্তন্নও তো পেতে পারি।

মার্কিন বন্ধুরাও মুখ বেঁকিয়ে এবার সরে গেল। বুঝলাম আমার ওপর যেটুকু শ্রদ্ধা তাদের ছিল তা-ও খুইয়েছি।

কিন্তু বেনিটোর জাহাজের পার্টিতে সত্যিই একদিন নিমন্ত্রণ পেলাম।

তার আগে নিউপোর্ট থেকে আনা ড়ুবুরির পোশাকে একদিন সমুদ্রে আমি নেমেছি। কোনও কোনও মরিয়া টুনি শিকারি তখনও নীলিমাকে ধরবার আশা ছাড়েনি। মোটর বোট নিয়ে দু-একজন সেদিনও তাই বেরিয়েছে।

নীলিমার অজেয় হওয়ার রহস্য সেদিনই বুঝলাম আর সেই সঙ্গে ডেকস্টার মৃত্যুরহস্যও বুঝি কতকটা!

কিন্তু আসল যে রহস্য তখন অনুমানও করতে পারিনি, বেনিটোর জাহাজের পার্টির রাতেই তা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল।

জাহাজ তো নয়, জলের ওপর স্বর্গপুরী। টুনা ক্লাবের সবাই তো বটেই, আভালনের নাম করা কেউ নিমন্ত্রণ থেকে বাদ পড়েনি। মস্ত ওপরের ডেক ঝলমল করছে রংবেরং-এর আলোর পোশাকে। নাচগান খাওয়া ফুর্তি চলছে অবিরাম।

সারা রাতই চলবার কথা। কিন্তু রাত সাড়ে বারোটায় হঠাৎ সমস্ত উৎসব থেমে গেল এক নিমেষে। ডেকের ওপরকার সমস্ত ফুর্তিবাজের দল যেন কাঠের পুতুলের মতো স্তব্ধ। শুধু বেনিটোর কর্কশ বাজখাঁই গলা শোনা গেল

বন্ধু সব, আমার জানাতেও ঘৃণা হচ্ছে যে, আপনাদের মধ্যে এমন একজন নীচ ননাংরা জানোয়ার আছে যে অতিথি হওয়ার সুযোগ নিয়ে চুরি করতে এখানে ঢুকেছে। আমার অত্যন্ত মূল্যবান কিছু কাগজপত্র ও জিনিস এই জাহাজে আমি সঙ্গে নিয়ে বেড়াই। এইমাত্র আমি জানতে পেরেছি যে সকলের ফুর্তি করার সুযোগে আমার সেই গুপ্ত সিন্দুক-ঘরের দরজা সে কৌশলে খুলে ঢুকেছে। ঢুকে যা-ই সে করুক এ জাহাজ থেকে পালাতে সে পারেনি এ বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত। ধরা তাই সে পড়বেই। আজকের উৎসব বাধ্য হয়েই আমাকে এখানে বন্ধ করতে হচ্ছে। আপনাদের শহরে ফিরে যাবার লঞ্চের ব্যবস্থাও আমি অবিলম্বে করছি, কিন্তু তার আগে নিজেদের আত্মসম্মানের খাতিরেই আপনারা যদি নিজের নিজের নাম জানিয়ে আপনাদের কাছে আমার মূল্যবান জিনিস যে কিছু নেই তার প্রমাণ স্বেচ্ছায় দিয়ে যান আমি বাধিত হব।

খানাতল্লাশিতে কিছুই অবশ্য পাওয়া গেল না এবং বলাবাহুল্য, সব অতিথি বিদায় নেবার পর যে নামটি বাকি রইল তা আমার।

জাহাজের একটি কামরাতেই তখন আমি বসে আছি। কটা সিগারেট যে পুড়েছিল মনে নেই, কিন্তু কামরার দরজার হাতলে বাইরে থেকে হাত পড়তেই উঠে দাঁড়িয়ে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে বললাম, এসো বেনিটো, তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছি! খানাতল্লাশি করতেই বুঝি এত দেরি হল!

বেনিটোর হতভম্ব ভাবটা কাটতে কয়েক সেকেন্ড লাগল। তারপর হিংস্র গোরিলার সঙ্গে রঙে ছাড়া তার মুখের আর বুঝি কিছু তফাত রইল না।

কিন্তু এ ভাবটাও সে সামলে নিলে। ইঁদুরকে থাবার মধ্যে পেলে শিকারি বেড়াল তখুনি তাকে কামড়ে ছিড়ে খায় না।

বেনিটো অদ্ভুত পৈশাচিক মুখ-টেপা হাসি হেসে আমার দিকে এগিয়ে এল। তার মুখ দেখে বুঝলাম এমন তারিয়ে তারিয়ে জিঘাংসা মেটাবার সুযোগ পেয়ে তার আনন্দ আর ধরে না।

ব্যাঙ হয়ে সাপের গর্তে সিঁধ কেটেছিস, তোর সাহস আছে বলতেই হবে। কিন্তু লাভ কী হল এ-সাহসে। পারবি পালাতে?

বেনিটোর শেষের কথাগুলোয় রাগের চিড়বিড়িনি চাপা রইল না। তবু হেসে বললাম, পালাতে যাবই বা কেন? তোমার জাহাজটা তো তোফা আরামের।

বলে বসতে যাচ্ছিলাম, এক হেঁচকায় আমায় টেনে তুলে দাঁতে দাঁতে কিষ্কিন্ধ্যার কড়মড়ানি তুলে বেনিটো বললে, আরামই তোকে দেব, তার আগে কোথায় কী লুকিয়েছিস, দেখি।

অম্লান বদনে হাত তুলে দাঁড়ালাম। তন্ন তন্ন করে সব পরীক্ষা করে বেনিটো গর্জন করে উঠল, ভেবেছিস এখন কোথাও লুকিয়ে রেখে পরে পাচার করবি সুযোগ বুঝে। কিন্তু তার আগে তোকেই যে পাচার হতে হবে।

ডে কস্টার মতো—কেমন!

এক মুহূর্তের জন্যে চমকে উঠে বেনিটো আরও হিংস্র হয়ে উঠল, হাঁ, ডেকস্টার মতো। সে-ও তোর মতো এ জাহাজের রহস্য ফাঁক করতে এসেছিল।

এ জাহাজের রহস্য তা হলে আছে কিছু! দামি জিনিসের মধ্যে আমি তো লুকোনো সিন্দুকে এক বান্ডিল কাগজই দেখলাম।

সে কাগজ তুলে ঘেঁটেছিস তা হলে? বেনিটোর রাগের পারা চড়ছে।

তা ঘেঁটেছি বইকী, তবে নিইনি যে কিছু সে তো তুমি নিজেই গুনে দেখেছ।

আমার নির্বিকার ভাবটাই বুঝি বেনিটোর বেশি অসহ্য।

না নিলেও, টুকে যে রাখিসনি তাতে বিশ্বাস কী!

ও বাবা, ওই বিদঘুটে মাথা-গুলোনো এক বান্ডিল অঙ্ক আমি টুকব, এইটুকু সময়ে!

যা-ই করে থাকিস, নিস্তার তোর নেই। এ জাহাজের রহস্য জেনে কেউ জ্যান্ত ফেরে না। ডেকস্টার মতোই তোকে হাঙরদের ভোজে লাগাবার ব্যবস্থা করছি এখুনি। তবে তোর ওই কেলে মাংস হাঙরেও বোধ হয় ছোঁবে না।

তা হলে তোমার মতো যে মাংস হাঙরের পছন্দ তাই তাদের পাতে দিলে ভাল হয় না?

কী বলব, খ্যাপা গোরিলা না ষাঁড়, না দুই-এর একত্র সম্মিলনের মতো বেনিটো এবার আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

জামাটা ঝেড়ে নিয়ে আর একটা সিগারেট ধরিয়ে বললাম, অনেক দিনের অনেক কিছুর শোধ নেবার আছে বেনিটো, এত তাড়াতাড়ি কীসের?

ঘাড়মুড় গুজে কেবিনের যে ধারে বেনিটো পড়েছিল সেখান থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে এবার সে সাবধানে আমার দিকে এগুতে লাগল। তাড়াহুড়োয় কিছু হবে সে বুঝেছে।

কাছাকাছি এসেই সাঁড়াশির মতো দু হাত দিয়ে সে আমায় জাপটে ধরতে গিয়ে সেই যে পড়ল আর ওঠবার নাম নেই। রদ্দাটা অত জোর হবে ভাবিনি।

কোমর ধরে তুলে তাকে কামরার সোফাটার ওপর বসিয়ে দিলাম।

পরমুহূর্তেই দেখি তার পিস্তল আমার দিকে তাক করা। আমি তাকে ধরে তোলবার সময় সুযোগ পেয়ে সে পকেট থেকে সেটা বার করেছে।

এইবার শয়তান? শয়তানের মতোই বেনিটোর মুখের হাসি—বল, কী করেছিস আমার সিন্দুকের কাগজপত্র ঘেঁটে?

সিগারেটে একটা টান দিয়ে বললাম, আর বলে লাভ কী! বললেও যা না বললেও তা-ই। মরতে তো হবেই।

না, সত্য কথা যদি বলিস তো একটা সুযোগ তোকে দেব।

শুনতে পাই সুযোগটা?

এই জাহাজ থেকে সাঁতরে দ্বীপে যাবার সুযোগ।

হেসে বললাম, ডেকস্টাকেও এই সুযোগই তো দিয়েছিলে, কিন্তু এখানকার হাঙরগুলো যে বড় হ্যাংলা।

এখনও রসিকতা! বেনিটো চিৎকার করে উঠল, এ পিস্তলটা কি রসিকতা মনে হচ্ছে?

পাগল, বিশেষত তোমার মতো আনাড়ির হাতে। কিন্তু যা বলব শুনলে যদি তোমার মেজাজ আরও খারাপ হয়?

তবু শুনতে আমি চাই। বেনিটো হুংকার দিলে।

তবে শোনো, নেহাত যখন ছাড়বে না। ও কাগজপত্রের আমি ফোটো নিয়েছি।

ফোটো নিয়েছিস?

হ্যাঁ, নির্ভুল মাইক্রোফোটো যাকে বলে, এক এক করে সব পাতার।

অতি কষ্টে নিজেকে সামলে নিল বেনিটো, কোথায় সেসব ফোটো?

সেসব তো আর এ-জাহাজে নেই।

জাহাজে নেই! উত্তেজনায় বেনিটো উঠে দাঁড়াল, কোথায় ফেলেছিস!

ফেলব কেন! পাঠিয়ে দিয়েছি। আশ্চর্য যে guided missile অর্থাৎ দূর থেকে চালানো অস্ত্রের এখানে পরীক্ষা চালাচ্ছ, অস্ত্র পরীক্ষার সঙ্গে রসিকতার লোভ সামলাতে না পেরে টরপেডোর মতো যে জলে-ডোবা অস্ত্র দিয়ে টুনি শিকারিদের ছিপের সুতো কেটে নীলিমাকে অজেয় করে তুলে সবাইকে থ করে দিয়েছ, সেই টরপেডো দিয়েই নিউপোর্ট-এর সমুদ্রকূলে সে-সব ফোটো পাঠিয়ে দিয়েছি। খবর যাদের দেওয়া আছে তারা কাল সকালেই সমুদ্রতীর থেকে টরপেডো তুলে তা খুলে সে-সব ফোটো উদ্ধার করবে।

মিথ্যা কথা? বেনিটোর আর্তনাদ না চিৎকার বোঝা যায় না! সে টরপেডো একজন ছাড়া কেউ চালাতে জানে না।

যে জানে সে-ই চালিয়েছে। আমার নয়, বেনিটোর পেছনে আর একজনের কণ্ঠস্বর। শীর্ণদেহ, কিন্তু ঋজু সৌম্য চেহারার এক বৃদ্ধ বেনিটোর পিঠে পিস্তল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কখন তিনি তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, বেনিটো উত্তেজনার মধ্যে বুঝতেও পারেনি।…

দিশাহারা অবস্থায় তার মুখ দিয়ে কটা অস্ফুট আওয়াজ শুধু বেয়োয়, আপনি— অ্যান-ট-নি…

হ্যাঁ, আমি অ্যান্টনি ফিশার। চুরি করে বন্দী করে নিয়ে গিয়ে পাঁচ বছর ধরে যাকে দিয়ে ক্রীতদাসের মতো যা খুশি তোমরা করিয়েছ সেই হতভাগ্য নীচ বৈজ্ঞানিক। আমি দুর্বল, মরতে আমি ভয় পাই। তাই তোমাদের হুকুম কাপুরুষের মতো আমি তামিল করেছি। আমায় দিয়ে শুধু এই দূর থেকে চালানো অস্ত্র তোমরা তৈরি করিয়ে নাওনি, যে কোবাল্ট বোমা আজও কেউ তৈরি করতে পারেনি, তার সমস্ত অঙ্ক লিখিয়ে নিয়েছ। সে অঙ্কের খাতা আর তোমাদের শুধু একলার নয়। তার হুমকি দেখিয়ে দুনিয়াকে আর তোমরা ভয় দেখাতে পারবে না, এই আমার সান্ত্বনা। নরপিশাচদের হাতের পুতুল হয়ে যে আমায় থাকতে হবে না তার জন্যে এই মানুষটিকে ধন্যবাদ।

বেনিটোর হাত থেকে তার পিস্তল কেড়ে নিয়ে বললাম, আমায় নয়, ধন্যবাদ দিন সেই ডে কস্টাকে, প্রাণ দিয়ে এ-রহস্যের কিনারা করার ইঙ্গিত যে দিয়ে গিয়েছে।

তার সংকেত-টেলিগ্রাম যে আপনাকেই নিয়ে তা এতদিনে কাল সবে বুঝেছি। টুনা-শিকারির কথাটার ভেতর যে অ্যান্টনি ফিশার নামটা লুকোনো আছে তা আগে মাথাতেই আসেনি।

কিন্তু কিন্তু ফোটো তোলা হল কীসে? বেনিটো এই হতাশার মধ্যেও জিজ্ঞেস না করে পারেনি। আমি গোপনে কে কী নিয়ে জাহাজে উঠেছে সব সন্ধান রেখেছি। ছোট-বড় কোনও ক্যামেরা তোমার কাছে দেখা যায়নি। ক্যামেরা তোমার ছিল কোথায়?

আমার কথা শুনেও ক্যামেরা কোথায় ছিল বুঝতে পারছ না!

কথা শুনে মানে? হঠাৎ মানেটা বুঝতে পেরে বেনিটো মেঝের ওপরই হতভম্ব হয়ে বসে পড়ল।

হ্যাঁ, সোজাসুজি ক্যামেরা আনলে ধরা পড়তে হবে জানতাম বলেই এমন ব্যবস্থা করেছিলাম যা সন্দেহের বাইরে। আমার বাঁধানো দাঁতই গুপ্ত ক্যামেরা। ছবি সমেত সেই বাঁধানো দাঁতজোড়া-ই টরপেডোতে পাঠিয়েছি। ফোকলা মুখে সব কথা যদি না বোঝাতে পেরে থাকি তো দুঃখিত।

আমার রদ্দায় যা হয়নি এই শেষ কটা কথায় তাই হল। বেনিটো মাথা ঘুরে পড়ে একেবারে অজ্ঞান।

টরপেডো গুপ্ত ক্যামেরায় ফোটো নিয়ে যথাস্থানেই পৌঁছেছিল। বেনিটো আর তার জাহাজটাকে তার পরদিন থেকে সেন্ট ক্যাটালিনার ধারে কাছে কিন্তু কেউ দেখেনি। সেই সঙ্গে টুনা ক্লাবের আর একটি লোককে যার সম্বন্ধে ক্লাবের সভ্যদের ধারণা আজও অত্যন্ত নিচু।

ঘনাদা থামলেন।

মাছ ধরতে যাওয়ার আর তখন সময় নেই।

দাদা

দিন আর আমাদের কাটতে চায় না।

চার চারটে সুস্থ সবল জোয়ান ছোকরার পক্ষে এ খানিকটা অবিশ্বাস্য ব্যাপারই বটে।

কেন, কলকাতায় কি খেলাধুলো সব বন্ধ হয়ে গেছে? গড়ের মাঠ কি ভাগাভাগি করে নিয়ে লোকে সেখানে দালান-কোঠা তুলেছে? ফুটবল ক্রিকেট হকি কি দেশ থেকে আইন করে তুলে দেওয়া হল?

না।

তবে?

কলকাতার ছবিঘরগুলো কি সব বন্ধ? থিয়েটার বায়োস্কোপ সভাসমিতি মজলিশ কি আজ শহর থেকে উধাও?

না। তা নয়!

তবে?

কলকাতার সাঁতার, কুস্তি, বক্সিং, দৌড়ঝাঁপ সব কি উঠে গেছে?

না। সবই আছে। শুধু ঘনাদা মেসে নেই।

সত্যিই ঘনাদা মেস থেকে চলে গেছে। একেবারে তল্পিতল্পা গুটিয়ে আমাদের হতভম্ব করে চলে গেছেন এবং এ পর্যন্ত আর ফিরে আসেননি।

প্রথমে দিন দুয়েক আমরা তেমন গ্রাহ্য করিনি।

এ মেসের এমন মৌরসি পাট্টা ছেড়ে ঘনাদা যাবেন কোথায়? ফিরে তাঁকে আসতেই হবে।

কিন্তু দেখতে দেখতে দু-দশ দিনের জায়গায় দু-চার মাস কেটে গেছে, এখন প্রায় বছর ঘুরতে যায়, তবু ঘনাদার ফেরবার নাম নেই।

প্রথম বিস্মিত থেকে আমরা চিন্তিত হয়েছি, তারপর ব্যাকুল হয়ে খোঁজখবর করেছি এবং শেষে, এখন তাঁর ফেরবার সম্ভাবনা সম্বন্ধে হতাশ হয়ে, শিবুর উপর খাপ্পা হয়ে উঠেছি।

কারণ ঘনাদাকে মেস ছাড়া করবার মূলে যদি কেউ থাকে তো সে শিবু।

কী দরকার ছিল বাপু সেই টুপির কথাটা তোলবার?

টেনজিং নোরকে হিলেরির সঙ্গে এভারেস্ট চূড়া জয় করেছেন—সকালের কাগজে খবরটা পড়ে, বসবার ঘরে আমরা গুলতানি করছি। এমন সময় ঘনাদা তাঁর টঙের ঘর থেকে নেমে এলেন।

কী ব্যাপার হে, এত হই-চই কীসের! ঘনাদা তাঁর আরামকেদারায় গা এলিয়ে শিশিরের দিকে হাত বাড়ালেন।

শিশির কৌটো খুলে তাঁকে সিগারেট এগিয়ে দিচ্ছে যথারীতি, হঠাৎ বলে উঠল,—ব্যাপার গুরুতর, ঘনাদা। খবরের কাগজে এখুনি একটা প্রতিবাদ পাঠাতে হবে।

প্রতিবাদ! কেন হে? ঘনাদা সিগারেটটা তখন ধরাচ্ছেন।

প্রতিবাদ নয়! শিবু দস্তুরমতো উত্তেজিত, এ তো জালিয়াতি! এ তো চুরি! এ তো মানহানি!

রহস্যটা আমরাও তখন ধরতে পারিনি। ঘনাদা সিগারেটে প্রথম টানটা দিয়ে এতক্ষণে একটু কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, মানহানি আবার কার?

আপনার! শিবু বোমাটি ছাড়ল।

আমার! ঘনাদার সিগারেটে দ্বিতীয় টানটা ভাল করে দেওয়া হল না।

হ্যাঁ, আপনার! আমরা প্রতিবাদ করব, নালিশ করব, খেসারত আদায় করব, শিবু ঝড়ের মতো বলে চলল, বলে কিনা এভারেস্টে উঠেছে!

ব্যাপারটা এতক্ষণে আমরা বুঝেছি এবং ঘনাদাকে আড়চোখে দেখে নিয়ে তৈরিও হয়েছি।

গৌরই বোকা সেজে জিজ্ঞাসা করলে, তুমি কি বলতে চাও এভারেস্টে এরা ওঠেনি?

আলবত তা-ই বলতে চাই।শিবু নিজের বাঁ হাতের চেটোর উপরই ডান হাতে ঘুষি মারল।

তোমার এ রকমের সন্দেহের কারণ? শিশির গম্ভীরভাবে শুধদলে।

কারণ? শিবু নাটকীয় ভাবে সকলের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললে,কারণ, টুপি।

টুপি! আমরা যেন আকাশ থেকে পড়লাম।

হ্যাঁ, ঘনাদার টুপি! শিবু ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বললে, এভারেস্টে উঠলে সে টুপি পেত না? আর সে টুপি পেলে এভারেস্টে প্রথম ওঠবার বাহাদুরি আর করত!

ঠিক! ঠিক! আমরা সবাই সায় দিলাম, কাগজে এখুনি ঘনাদার নাম দিয়ে একটা চিঠি পাঠাতে হবে। আমরাই লিখে দিচ্ছি, ঘনাদার শুধু একটা সই!

ঘনাদার সিগারেটে তৃতীয় টান আর দেওয়া হল না। তিনি আরামকেদারা থেকে কী একটা কাজের নাম করে উঠে পড়লেন। সেই যে উঠে বেরিয়ে গেলেন, আর যে ফিরবেন কখন কী জানি।

ঘনাদার অভাবে মেস আমাদের অন্ধকার।

আড্ডায় এসে আমরা বসি, বিরস মুখে এক এক করে, আবার উঠে যাই। কিছুই আর জমে না।

হঠাৎ সেদিন সন্ধ্যায় এই ঢিমে আসর একটু চঞ্চল হয়ে উঠল। ঘনাদার তেতলার ঘরখানা এ পর্যন্ত খালিই আছে। প্রথমে নিজেদের গরজে আমরা কাউকে সেখানে ঢুকতে দিইনি।

কিন্তু গত দু-এক মাস ধরে মেসের অন্য বোর্ডারদের মুখ চেয়ে নিজেদের জেদ ছেড়ে দিতে হয়েছে। ঘনাদার আসবার কোনও ভরসাই নাই। মেসের ক্ষতি করে কতদিন একটা ঘর আটকে রাখা যায়? এখনও কেউ ঘর দখল করেনি, তবে লোকে। আসা-যাওয়া করছে।

কিন্তু হঠাৎ ওপরের সেই ঘরে কীসের শব্দ? জিনিসপত্র নাড়ার না? পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ির পর শিবুই আগে বারান্দায় গিয়ে একবার ওপরে উঁকি দিয়ে এল। হাঁ, ওপরের ঘরে আলো জ্বলছে।

কাউকে আর কিছু বলতে হল না। হুড়মুড় করে সবাই একসঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে গিয়ে উঠলাম।

ঢোকবার আগেই ঘরের ভেতর থেকে ডাক এল, আসুন, আসুন!

ঘরের চৌকাঠেই থমকে দাঁড়ালাম সবাই। ইনি তো ঘনাদা নন!

আসুন, আসুন, ভেতরে আসুন। ভদ্রলোক অমায়িক। ঘনাদা রোগা লম্বা শুকনো, ইনি মোটা বেঁটে এবং দিব্য গোলগাল। কিন্তু তবু কোথায় যেন মিল আছে! সে মিল ভাল করেই কিছুক্ষণ পরে টের পেলুম, কিন্তু তখন দরজায় আমাদের অবস্থা ন যযৌ ন তস্থৌ।

আমতা আমতা করে বললাম, না, ভেতরে আর যাব না। আমরা আসি।

আসবেন কী! বিলক্ষণ! ছুটোছুটি করে এসে দরজা থেকেই ফিরে যাবেন!

ব্যাপারটা একটু বিসদৃশই বটে। এসে যদি চলে যাই তা হলে এত হন্তদন্ত হয়ে আসবার মানেটা কী! তবু কাঁচুমাচু হয়ে বোঝাবার একটু চেষ্টা করলাম, না, মানে আমরা ভেবেছিলাম–আমাদের ঘনাদা এ-ঘরে থাকতেন কিনা!

ঘনাদা! ভদ্রলোক যেন চিন্তিত।

আমরা বুঝিয়ে বললাম, হাঁ, নাম ঘনশ্যাম দাস। এই মেসে অনেকদিন ধরে ছিলেন কিনা—

হঠাৎ হো হো হাসিতে আমরা চমকে উঠলাম।

ভদ্রলোক বেশ কিছুক্ষণ হেসে নিয়ে তারপর বললেন, ঘণ্টা!

ঘণ্টা! আমরা তাজ্জব।

হাঁ, হাঁ, আমাদের ঘণ্টা!ভদ্রলোক এবার আরও একটু বিশদ হলেন, আপনারা যাকে ঘনাদা বলতেন সেই হল আমাদের ঘণ্টা। হাঁ মনে পড়েছে বটে, ঘণ্টা এই রকম একটা মেসে কোথায় থাকত বলেছিল। তারপর গল্প-টল্পও দু-চারটে শুনেছি।

আপনি ঘনাদাকে চিনতেন? আমরা উদগ্রীব।

চিনতাম বই কী! ভদ্রলোক হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, কিন্তু ঘণ্টা তো আর ফিরবে না।

ফিরবে না! কেন? আমরা ঘরের ভিতর তখন ঢুকে পড়েছি।

কানের প্লাগ খুলে গেল যে!

কানের প্লাগ! খালি তক্তপোশটায় কখন সবাই বসে পড়েছি টেরও পাই নাই। ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, কানের প্লাগ খুলে গেল মানে।

মানে? মানে বোঝাতে অনেক দূর যেতে হবে।ভদ্রলোক চিবুক ও বুকের মাঝে অদৃশ্য গলাটায় হাত বুলিয়ে কড়িকাঠের দিকে মুখ তুলে অনেক দূরেই যেন দৃষ্টি মেলে শুরু করলেন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে। এদিকে ইংরেজ-মার্কিন, ওদিকে রুশ, কে আগে বার্লিন দখল করবে তার পাল্লায় রুশদের জিত হয়েছে। বার্লিন একটা ধ্বংস-পুরী। ইংরেজ মার্কিনের বোমা আর রুশদের গোলায় শহর গুড়ো হয়ে যে ধুলো উড়েছে আকাশে, তাই তখনও থিতোয়নি। দিনের বেলাতেই যেন ঝাপসা কুয়াশায় অন্ধকার। ভয়ে ভয়ে পথ চলতে হয়, কোথাও কোনও নড়বড়ে ছাদ কি দেওয়াল মাথায় ভেঙে পড়ে তার ঠিক নেই।

কাইজার উইলহেল্ম স্ট্রাস—চমকে উঠবেন না, ওটা রাস্তার নাম—তা থেকে বেঁকে একটা সরু গলি রাস্তায় চলেছি সেদিন, এমন সময় চমকে উঠলাম!

দাদা।

কাতর ডাকটা আমার পেছন থেকেই, কিন্তু চমকালাম—আওয়াজ শুনে নয়, এই দাঁতভাঙা ভাষার দেশে দাদা বলে বাংলায় কে ডাকতে পারে তা-ই ভেবে।

ফিরে তাকিয়ে দেখি আমাদের ঘণ্টা। অকাজে বেপোট জায়গায় বেঘোরে পড়তে তার জুড়ি নাই। বিরক্ত হয়েই বললাম, তুমি আবার এখানে কোথা থেকে হে।

ঘণ্টা ছুটে এসে আমার হাত দুটো বাড়িয়ে ধরে বললে, সব কথা পরে বলব দাদা, এখন আমায় বাঁচাও।

দিব্যি বেঁচেই তো আছো দেখছি, বাঁচাব আর কী? বলে বিদ্রুপ করে আবার মায়াও হল একটু। বললাম, কী ফ্যাসাদ আবার বাধিয়েছ শুনি।

ঘণ্টা কিছু বলবার আগেই হঠাৎ বড় রাস্তার দিকে মেশিন-গান পটপটিয়ে উঠল। চোখের পলক পড়তে না পড়তে ঘণ্টা আর সেখানে নাই। এক দৌড়ে রাস্তার ধারে এক বোমা-ভাঙা বাড়ির শুকনো এক চৌবাচ্চায় গিয়ে তখন সেঁধিয়েছে। সেখানে গিয়ে ধরতেই কাঁপতে কাঁপতে বললে, ফ্যাসাদ দাদা ওই।

অবাক হয়ে বললাম, আরে, ও তো বেওয়ারিশ বাড়ি-ঘর পেয়ে যুদ্ধের গোলমালে যারা লুটপাটের ফিকিরে আছে তাদের রুশ সান্ত্রীরা গুলি করছে। তোমার ওতে ভয়টা কীসের?

ভয়টা কীসের তো বলে দিলে! আমার চেহারাটা কি লুটেরার বদলে দেবদূতের মতো যে, সান্ত্রীরা আমায় ছেড়ে কথা কইবে।

ঘণ্টার কাঁদুনি শুনে হাসিই পেল একটু, বললাম, চেহারা তোমার যা-ই হোক না, মিলিটারি পাস তো আছে।

হাঁ, মিলিটারি পাস! আমি কি রুজভেল্ট চার্চিলের ইয়ার, না স্টালিনের দোস্ত যে মিলিটারি পাস পাব! প্রাণটা নিয়ে ইদুরের মতো এই ক-দিন বার্লিন শহরে লুকোবার গর্ত খুঁজে ছুটোছুটি করছি। কখন ধরা পড়ি কে জানে?

এবার পিঠ চাপড়ে তাকে সাহস দিয়ে বললাম, আচ্ছা ভয় নাই, মিলিটারি পাসের ব্যবস্থা তোমায় করে দেব।কিন্তু মরতে এই শহরে এমন সময় কেন এসেছিলে বলো তো?

ভরসা পেয়ে ঘণ্টা তখন একটু চাঙ্গা হয়েছে। বললে, বেশি কিছু নয়, দাদা একটা হিসাবের কল। তার একটা সুলুক সন্ধান নিয়ে যেতে পারলেই মোটা বকশিশ পেতাম। কিন্তু কারিগর সমেত সেকল এখন রুশদের গোলায় কোন পাতালে চাপা পড়েছে কে জানে!

না হেসে আর পারলাম না। বললাম, সাগর ডিঙোতে তোমার মতো ব্যাঙকে যারা পাঠিয়েছে তাদেরও বলিহারি! আরে, ওটা সামান্য হিসাবের কল নয়, পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য ইলেকট্রোনিক ব্রেন, আর ও যন্ত্র যিনি তৈরি করে বিজ্ঞানের জগতে যুগান্তর এনেছেন তাঁর নাম হল ড. বেনার। ওদিকে মিত্রশক্তি আর এদিকে রাশিয়া তাঁকে পাবার জন্য অর্ধেক রাজত্ব এখুনি দিতে প্রস্তুত। কিন্তু পাবে কোথায়? সে গুড়ে বালি! ড. বেনার মারাও যাননি, তাঁর যন্ত্রও কোথাও চাপা পড়েনি। মিত্রশক্তি যেদিন নরম্যান্ডির কূলে নেমেছে, তিনটে স্পরকেল সাবমেরিনে তাঁর যন্ত্রপাতি সাজসরঞ্জাম চড়িয়ে সেদিনই তিনি উধাও।

হতভম্ব হয়ে ঘণ্টা এবার শুধােলে, এত কথা তুমি জানলে কী করে, দাদা?

কী উত্তর আর দেব। হেসে বললাম, এই বার্লিন শহরে ঘাস কাটতে কি অলিগলি ঘুরে বেড়াচ্ছি মনে করো?

ঘনাদার দাদা সত্যিই একটু হেসে এবার থামলেন। বদ অভ্যাস যাবে কোথায়? শিশির সিগারেটের টিনটা আপনা থেকেই তখন বাড়িয়ে দিয়েছে। দাদা কিন্তু সেটিকে মোলায়েম ভাবে প্রত্যাখ্যান করে প্রকাণ্ড এক ডিবে থেকে সশব্দে এক টিপ নস্যি নিয়ে নাক মুছলেন।

ড. বেনারকে তারপর আর পাওয়া গেছে? গৌরের আর তর সইছে না। আমাদেরও অবশ্য তাই।

বলছি, সবই বলছি। কিন্তু তার আগে ড. বেনারের যন্ত্রটার একটু পরিচয় দেওয়া দরকার। বড় বড় অফিসের ক্যালকুলেটিং মেশিন দেখেছেন, দু ঘণ্টার অঙ্ক দু সেকেন্ডে সব কষে দেয়? গাঁয়ের কামারশালের সঙ্গে টাটার কারখানার যা তফাত, এই ক্যালকুলেটিং মেশিনের সঙ্গে ড. বেনারের ইলেকট্রোনিক ব্রেনের তা-ই। সাত-সাতটা অঙ্কের শুভঙ্কর সাত বছরে যে-অঙ্কের শেষ পায় না, ভূতুড়ে যন্ত্র তা সাত সেকেন্ডে কষে দিতে তো পারেই, তা ছাড়া কী যে পারে না—তা-ই বলাই শক্ত। মিত্রশক্তি আর রাশিয়া হন্যে হয়ে ড. বেনারকে এই জন্যেই খুঁজেছে। বিজ্ঞানের যত আশ্চর্য আবিষ্কার, তত সূক্ষ্ম জটিল তার অঙ্ক। ড. বেনারের ভূতুড়ে যন্ত্র যারা দখলে পাবে অন্য পক্ষকে তাঁরা পাঁচশো বছর পিছিয়ে ফেলে যেতে পারবে।

কিন্তু কোথায় ড. বেনার, আর কোথায় তাঁর ভূতুড়ে কলের মাথা?

যুদ্ধ শেষ হল। গলায় গলায় যাদের ভাব, তারা আদায় কাঁচকলায় গিয়ে পৌছোল। দু দলের চর-গুপ্তচরেরা দুনিয়া তোলপাড় করে ফেললে, কিন্তু ড. বেনার নিপাত্তা। অতলান্তিকের তলাতেই কোথাও স্পরকেল ড়ুবোজাহাজগুলি সমেত তিনি ড়ুবেছেন, এই ধারণাই শেষ পর্যন্ত সকলের হত, যদি না…

ঘনাদার দাদা একটু থেমে আমাদের অবস্থাটা একটু লক্ষ করে নিয়ে আবার শুরু করলেন, যদি না নরওয়ের ক-টা তিমি ধরা জাহাজ পর পর অমন নিখোঁজ হত।

আজকালকার তিমিরা জাহাজ তো তখনকার পালতোলা মোচার ভোলা নয়, সে জাহাজকে জাহাজ, আবার কারখানাকে কারখানা। আস্ত তিমি ধরে গালে পরে তেল-চর্বি থেকে ছাল চামড়া হাড় মাংস সব সেখানে আলাদা করে বার করবার বন্দোবস্ত আছে। তার হারপুন কামান যেমন আছে, বেতারযন্ত্র আছে তেমনই বিপদে পড়লে খবর পাঠাবার। সেরকম জাহাজ নেহাত চুপিসারে টুপ করে ড়ুবতে পারে না, একটু কান্নাকাটি শোনা যাবেই।

ব্যাপারটা কী, জানবার জন্যে কেঁচো খুঁড়তে একেবারে গোখরোর গর্তে গিয়ে পৌঁছোলাম। ব্যাফিন আইল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ফ্রবিশার বে, সেইখানে ছোট এক বেনামি দ্বীপ। ভাড়া করা একটা মোটর লঞ্চে সেখানে যখন গিয়ে উঠলাম তখন গভীর রাত।

রাত অবশ্য সেখানে মাসখানেক ধরেই গভীর। উত্তর মেরুর কাছাকাছি জায়গা তো! একটা দিনরাতেই প্রায় বছর কেটে যায়।

একটা সরু খাঁড়ির মধ্যে মোটর লঞ্চ ঢুকিয়ে নামলাম তো বটে, কিন্তু সেই আবছা অন্ধকারের রাজ্যে বরফ-ঢাকা পাথুরে জায়গায় দু-পা গিয়েই ঘণ্টা আর যেতে চায় না। ঘণ্টা সেই থেকে সঙ্গে আছে বলা বাহুল্য।

ঘণ্টাকে বোঝাব কী? নিজেরই তখন কেমন অস্বস্তি হচ্ছে, দুনিয়ার হেন বিপদ নেই যাতে পড়িনি। কিন্তু এ যেন সব কিছু থেকে আলাদা ব্যাপার! ভয়ংকর একটা আতঙ্কই যেন আবছা অন্ধকার হয়ে চারিদিকে ছমছম করছে, আকাশ থেকে, মাটির তলা থেকে একটা বুক-গুর-গুর করা ভয়ের কাঁপুনি উঠে সমস্ত শরীর হিম করে দিচ্ছে। কিন্তু তা বলে থামলে তো চলবে না। ঘণ্টাকে ধমক দিতে যাচ্ছি এমন সময় চিৎকার করে উঠল, পালাল! পালাল!

ফিরে দেখি, সত্যি একটা আবছা মূর্তি পাথুরে একটা ঢিবির পাশ থেকে ছুটে আমাদের লঞ্চটায় গিয়ে লাফিয়ে ওঠে আর কি!

তখুনি ছুট, খানিকটা ধস্তাধস্তি! মূর্তিটাকে কাবু করে মাটিতে ফেলতেই সে কাতরে উঠল, ছাড়ো, আমায় ছাড়ো, যদি বাঁচতে চাও তো এখুনি না পালালে নয়!

চোস্ত জার্মান কাতরানি শুনে টর্চটা জ্বেলে তার মুখে ফেলে দেখি, এ কী! এ যে ড. বেনার। কিংবা তাঁর ভূতও বলা যায়। ফ্যাকাশে মুখে যেন রক্ত নেই! শরীরে হাড়ের ওপর শুধু চামড়াটা আঁটা।

অবাক হয়ে গেলাম, ব্যাপার কী ড. বেনার? আপনার খোঁজে যমের এই উত্তর দোরে এলুম, আর আপনি পালাচ্ছেন কেন?

সব বলব, আগে লঞ্চে উঠে বেরিয়ে পড়ো, তারপর।

আমি কিন্তু নাছোড়বান্দা। সব কথা না শুনে নট নড়ন-চ, নট কিচ্ছু।

নিরুপায় হয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ড. বেনার তারপর যা বললেন তা শুনে আমরা থ! দুনিয়ায় এরকম তাজ্জব ব্যাপার কখনও কেউ শোনেনি, কল্পনা পর্যন্ত করেছে কিনা সন্দেহ।

ড. বেনার অতলান্তিকে ডোবেননি, তিনটে সাবমেরিন নিয়ে অনেক ভেবে চিন্তে যমের অরুচি দ্বীপে এসে উঠেছিলেন। যেসব লোকজন সঙ্গে এনেছিলেন তাদের দিয়ে কয়েক বছর ধরে ধীরে ধীরে তিনি তাঁর আশ্চর্য কলের মাথা তারপর। বসিয়েছেন। এমন সব উন্নতি তারপর সে কলের করেছেন যে, জার্মানির যে-যন্ত্র তখনই পৃথিবীর বিস্ময় ছিল তা এর কাছে ছেলেখেলা হয়ে গেছে। এই এক দানবীয় কলের মাথা দিয়ে সমস্ত পৃথিবী তিনি জয় করবেন, শাসন করবেন—এই তাঁর জেদ। একলের মাথা শুধু অঙ্ক কষে না, ভাবে, আর যে-কোনও বিষয়ে ভেবে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছোয় তা নির্ভুল। পৃথিবীর সব দিকের সমস্ত বৈজ্ঞানিকের মাথা একত্র করলেও এর তুলনায় তা সমুদ্রের কাছে ডোবা। সৃষ্টি রহস্যের বড়বড় কূটকচাল তো বটেই, ছোটোখাটো তুচ্ছ বিষয়েও তার বুদ্ধির প্যাঁচ একেবারে থ করে দেয়। এই দানবীয় কলের মাথার পরামর্শ পেলে মানুষের সভ্যতা গোরুর গাড়ির তুলনায় একেবারে রকেটে উড়ে এগিয়ে যাবে। শুধু ক-টা কল টিপলেই হল। আলাদিনের পিদিম এর কাছে কিছু নয়।

ড. বেনার হাতে স্বর্গ পেয়ে যখন ধরাকে সরা দেখছেন এমন সময় একদিন বিনা মেঘে বজ্র পড়েছে। ড. বেনার আঁতকে উঠে একদিন টের পেয়েছেন যে, তিনি কলকে নয়, কলই তাঁকে চালাচ্ছে! কল টিপে ভাবালে যে ভাবত সে-যন্ত্র কেমন করে স্বাধীন হয়ে উঠেছে। আর সে স্বাধীনতার মানে কী? নিজের ভাবনা নিজেই শুধু ভাবে না, এমন অদৃশ্য আশ্চর্য শক্তি তার ভেতর জেগেছে যে তাই দিয়ে ধারে কাছে তুচ্ছ মানুষ যারা থাকে, তাদের একেবারে খেলার পুতুল বানিয়ে দেয়। তার সে শক্তির কাছে কারও রেহাই নাই। মানুষ তাকে দিয়ে এতদিন প্রশ্নের উত্তর জেনেছে, এখন সে মানুষকে প্রশ্ন করে তার সবকিছু জানবে, যেমন খুশি চালাবে—এই তার দানবীয় খ্যাপামি। হাতে ছুরি পেলে দুরন্ত ছোট ছেলের যেমন সবকিছু কেটে সুখ, এ যন্ত্রের তেমনই পৈশাচিক বিলাসপ্রশ্ন করায় আর প্রশ্ন শোনায়। সময় যেন তার কাটে না। আর কিছু যখন নেই তখন খালি প্রশ্ন করতে হবে তাকে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন! আর পট পট তার উত্তর দিয়ে তখুনি সে চাইবে আবার প্রশ্ন। জিজ্ঞাসা করবার মতো প্রশ্ন খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে উন্মাদ হয়ে ড. বেনারের সঙ্গীরা একে একে সব শেষ হয়ে গেল। ক-টা তিমি ধরা জাহাজ কী কুক্ষণে এখানে এসে পড়েছিল। তাদের লোক লস্কর সব দুদিনেই কাবার! পালাবার উপায় নাই তার হাত থেকে। অদৃশ্য অজানা শক্তিতে এ দ্বীপের দশ মাইলের মধ্যে যে কেউ আছে, তার কাছে বাঁধা। ড. বেনার তাঁর জীবনের সমস্ত বিষয়ে পাণ্ডিত্য হাটকে কোনও রকমে প্রশ্নের পর প্রশ্ন জুগিয়ে এখনও টিকে ছিলেন, কিন্তু তাঁর সমস্ত পুজিও শেষ। এখুনি না পালালে আর রক্ষা নাই।

সব শুনে জিজ্ঞাসা করলাম, কিন্তু অদৃশ্য শক্তিতে যদি বাঁধা হন তা হলে আপনি পালাচ্ছেন কী করে? আমরাই বা কিছু বুঝতে পারছি না কেন?

ড. রে বললেন, নেহাত দৈবাৎ একটা সুযোগ পেয়ে একটা তার আমি আলগা করে দিতে পেরেছি আজ। কলের মাথা তাই খানিকক্ষণের জন্যে বিকল হয়ে আছে। কিন্তু সে বেশিক্ষণ নয়, এখুনি হয়তো শুধরে নিয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠবে।

তা হলে উপায়?

উপায় এখুনি লঞ্চ চালিয়ে বেরিয়ে পড়া।

কিন্তু দশ মাইল পার হবার আগেই যদি ওই দানব জেগে উঠে!

তারও একটা উপায় করেছি। ড. বেনার পকেট থেকে ক-টা ছোট ইলেকট্রিক প্লাগের মতো জিনিস বার করে আমাদের হাতে দিয়ে বললেন, শিগগির এইগুলো দু কানে গুঁজে দিন। পরীক্ষা এখনও হয়নি, তবে আমার ধারণা—কলের মাথার অদৃশ্য শক্তি কানের ভেতর দিয়েই আমাদের মগজে হুকুম চালায়। আমার গোপনে তৈরি এ-প্লাগ সে-শক্তিকে খানিকটা ক্ষীণ করে দিতে পারবে।

মোক্ষম সময়েই প্লাগের ঠুলি দুটো হাতে পেয়েছিলাম। শরীরে হেঁচকা টানে যেমন হয় হঠাৎ মাথায় ঠিক তেমনই একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়েই বুঝলাম দৈত্য-মাথা জেগেছেন। তৎক্ষণাৎ ঠুলি দুটো দুকানে গুঁজলাম। কিন্তু ঠুলিতে কি আটকায়! মনে হল কে যেন আমার মগজে ভর করে প্রাণপণে আমায় কোথায় টানছে। ঠুলির দরুন টানটা একটু কম—এই যা।

পড়ি কি মরি তিনজনে লঞ্চে গিয়ে উঠে ইঞ্জিন চালিয়ে দিলাম। কানের ঠুলি যেন অদৃশ্য টানে ফেটে বেরিয়ে যাবে।

লঞ্চ তখন চলেছে এই ভাগ্যি। কিন্তু আহাম্মকের মরণ যাবে কোথায়? কানের যন্ত্রণাতেই বোধহয় ঘণ্টা একটা কানের ঠুলি একবার একটু খুলতেই—আর দেখতে হল না! ধর, ধর করতে করতে ঘণ্টা লঞ্চ থেকে জলে লাফিয়ে পড়ল। আমাদের

লঞ্চ তখন তীরবেগে বার-দরিয়াই চলেছে। ঘণ্টার সঙ্গে সেই শেষ দেখা।

হঠাৎ কাশির শব্দে আমরা ফিরে তাকিয়ে একেবারে থ।

আমরা যদি থ হয়ে থাকি তো আমাদের নতুন দাদা একেবারে হাড়গোড় ভাঙা দ।

কোনও রকমে শুকনো গলায় ঢোঁক গিলে বললেন, এ কী! ঘন্—মানে ঘনশ্যাম তুমি কি, কখন এলে?

ঘনাদার মুখে কোনও ভাবান্তর নেই। গম্ভীরভাবে বললেন, তা এসেছি অনেকক্ষণ।

কিন্তু তুমি তো…,নতুন দাদার কথাটা আর শেষ হল না।

ঘনাদা বললেন, হ্যাঁ, অক্ষত শরীরেই ফিরে এসেছি কাজ শেষ করে।

কী করে, ঘনাদা? কেমন করে? আমরা এক সঙ্গেই বোধহয় চেঁচিয়ে উঠলাম।

ঘরে তক্তপোশ ছাড়া আর বসবার জায়গা নেই। তারই একধারে বসে শিশিরের এগিয়ে দেওয়া টিনটা থেকে একটা সিগারেট নিয়ে হাতের ওপর ঠুকতে ঠুকতে ঘনাদা তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন, অত অবাক হবার কী আছে! এমন শক্ত ব্যাপার তো কিছু নয়। তাকে স্রেফ একটি প্রশ্ন গিয়ে করলাম : ব্যস, তাতেই খতম।

কী প্রশ্ন, ঘনাদা?

ঘনাদা বললেন, প্রশ্ন আর কী! জিজ্ঞাসা করলাম—গাছ আগে, না বীজ আগে? সে তা-ই ভাবছে, ভাবতে ভাবতে এতদিনে শেষও হয়ে গেছে বোধহয়।

হঠাৎ জোর করে ঘনাদার পায়ের ধুলো নিয়ে আমাদের নতুন দাদা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

ফুটো

গৌর ছুটতে ছুটতে এসে যে-খবরটি দিলে তাতে আমাদের চক্ষু একেবারে চড়ক গাছ!

ঘনাদা আবার বুঝি মেস ছেড়ে যায়!

আবার?!?!

কী হল কী?? ছুটির দিন দুপুরবেলায় বসবার ঘরের মেঝেয় সবে তখন শতরঞ্জিটা পেতে তাস-জোড়া নিয়ে বসেছি। হঠাৎ এ-সংবাদে যেন যুদ্ধের সময়কার সাইরেনের আওয়াজে ধড়মড় করে উঠে পড়লাম।

প্রথম চোটটা গৌরের ওপরই গিয়ে পড়ল। শিশির তো মারমূর্তি হয়ে বললে— তুই তুই—নিশ্চয়—তুই-ই সব নষ্টের মূল।

আহা, আমি মূল হতে যাব কেন? গৌর নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল, সব নষ্টের মূলে ওই ফুটো!

ফুটো!!

হ্যাঁ, দেখবেই চলো না।

আর দুবার বলবার দরকার হল না। গৌরের পিছু-পিছু সবাই ঘনাদার তেতলার ঘরে গিয়ে উঠলাম।

উঠে বুঝলাম ব্যাপারটা গুরুতর।

আমাদের এতজনকে এমন হুড়মুড় করে তাঁর ঘরে ঢুকতে দেখেও ঘনাদার কোনও ভাবান্তর নেই।

তিনি গম্ভীর মুখে তাঁর জিনিসপত্র গোছাতে তন্ময়।

জিনিসপত্র বলতে সাধের গড়গড়াটি বাদে একটি ছোট কম্বল জড়ানো বিছানা ও একটি পুরোনো রংচটা ঢাউস তোরঙ্গ।

এই তোরঙ্গটি আমাদের সকলেরই অত্যন্ত কৌতূহলের বস্তু। তার ভেতর কী যে আছে আর কী যে নেই এ নিয়ে বহুদিন আমাদের অনেক গবেষণা তর্কাতর্কি হয়ে গেছে।

কারওর সামনে কোনওদিন এ তোরঙ্গ খুলতে ঘনাদাকে দেখা যায়নি। নিন্দুকেরা তাই এমন কথাও বলে থাকে যে তোরঙ্গটি ঘনাদার গল্পেরই চাক্ষুষ রূপা ওর ভেতর থেকে ঘনাদা না বার করতে পারেন এমন জিনিস নেই, কিন্তু আসলে ওটি একেবারেই ফাঁকা।

আমাদের দেখে আজকেও ঘনাদা সশব্দে তোরঙ্গের ডালাটি বন্ধ করে দিতে ভোলেন না, তারপর তাঁর সেই কম্বল জড়ানো বিছানা নিয়ে এমন ব্যস্ত হয়ে পড়েন যেন সাত রাজ্যের ধন তার মধ্যে তিনি জড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

ব্যাপার কী, ঘনাদা! এত বাঁধাবাঁধি কীসের? আমাদের জিজ্ঞাসা করতেই হয়।

ঘনাদা এতক্ষণে যেন আমাদের দেখতে পান। বিছানা বাঁধা থামিয়ে একটু দুঃখের হাসি হেসে বলেন, আর কেন? এখানে থাকা তো চলল না!

কেন, ঘনাদা!

কী হল, কী?

আমাদের প্রশ্ন ব্যাকুল থেকে ব্যাকুলতর হয়ে উঠে। শিবু উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করে, কালকের মাংসের চাপটা কি সুবিধের হয়নি?

গৌর তাতে রসান দিয়ে বলে, আজ তো আবার গঙ্গার ইলিশ এসেছে।

শিশির সাগ্রহে সিগারেটের টিনটা এগিয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করে, ভাতে, না কাঁচা ঝোল কোনটা আপনার পছন্দ?

কিন্তু ভবী আজ কিছুতেই ভোলবার নয়। গঙ্গার ইলিশের নামেও ঘনাদাকে টলানো যায় না। শিশিরের সিগারেটের টিনের দিকে দৃকপাত পর্যন্ত না করে তিনি ক্লান্তভাবে বলেন, আমার পছন্দে কী যায়-আসে আর। আমি তো আর থাকছি না।

থাকছেন না! কেন বলুন তো! ওয়াশিংটন কি লন্ডন থেকে জরুরি ডাক এল নাকি? এই সংকটকালেও শিবুর মুখ ফসকে রসিকতাটা বোধহয় বেরিয়ে যায়। আমরা কিন্তু শিবুর ওপর খেপে যাই।

কী পেয়েছিস কী, ঘনাদাকে! হেট করে ডাকলেই অমনই উনি চলে যাবেন? সে ইডেন কি ডালেস হলে যেত! বলে কতদিন সাধ্যসাধনা করেও ওঁকে নিয়ে যাওয়া যায় না! না, না সত্যি কী ব্যাপার বলুন তো, ঘনাদা?

ঘনাদা, কেন বলা যায় না, একটু যেন প্রসন্ন হয়েছেন মনে হয়। বিছানা বাঁধার যে দড়িগাছটা এতক্ষণ ধরে নানাভাবে নাড়াচাড়া করছিলেন সেটা ছেড়ে দিয়ে অত্যন্ত গম্ভীর ভাবে বলেন, কেন, সত্যি জানতে চাও?

চাই বই কী! আমরা সমস্বরে আগ্রহ জানাই।

উঠে দাঁড়িয়ে যেন কোনও দারুণ রহস্য উদঘাটন করতে যাচ্ছেন এই ভাবে ঘনাদা আমাদের ইশারায় ঘরের একটা দেওয়ালের কাছে নিয়ে যান। তারপর হঠাৎ নাটকীয়ভাবে একদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলেন, দেখো!

গৌরের কাছে ব্যাপারটা আগে একটু জেনে তৈরি থাকলেও আমরা প্রথমটা একটু হতভম্বই হয়ে যাই।

ঘনাদার আজকাল দৃষ্টিভ্রম হচ্ছে নাকি! সাদা দেওয়ালে স্বপ্ন দেখছেন! তারপর অবশ্য ব্যাপারটা চোখে পড়ে।

মেঝে থেকে দেওয়াল যেখানে উঠেছে, সেখানে একটি কোণে একটা পেনসিল গলাবার মতো ছোট একটা ফুটো!

আমরা অতি কষ্টে হাসি সংবরণ করি, কিন্তু ঘনাদা যেন সহ্যের সীমা পার হয়ে গেছেন এমনই ভাবে বলেন, এই ফাটা-ফুটো ঘরে মানুষ বাস করতে পারে?

আঙুল গলাবার মতো একটা ফুটোয় ঘরটা কেন মানুষের বাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছে বুঝতে তখন আর আমাদের বাকি নেই।

অপরাধটা আমাদের সবাইকার। নীচের কলতলাটা অনেকদিন থেকেই ভেঙে চুরে গেছল। বাড়িওয়ালাকে অনেক ধরেটরে দিন কয়েক আগে আমরা সে জায়গাটা নতুন সিমেন্ট দিয়ে মেরামতের ব্যবস্থা করেছি।

কলতলা মেরামত দেখেই ঘনাদা আবদার ধরেছিলেন, কলতলার সঙ্গে তাঁর ঘরটাও একবার মেরামত চুনকাম করে দিতে হবে।

আবদারটা অন্যায়। আমরা ঘনাদাকে অনেক করে বোঝাবার চেষ্টা করেছি। কলতলা সারাচ্ছে বলেই হঠাৎ সমস্ত বাড়ি ছেড়ে দিয়ে তেতলার একটা কুঠরি মেরামত করতে বাড়িওয়ালা রাজি হবে কেন? তা ছাড়া সেটা কি ভাল দেখাবে! কিছুদিন বাদেই সমস্ত বাড়িটা চুনকামের সময় তাঁর ঘরটার যা করা হবে।

কিন্তু কে কার কথা শোনে! ঘনাদা সেদিন থেকে গুম হয়ে যা চেপে রেখেছিলেন, আজ এই ফুটো দিয়েই তা ফাটবার উপক্রম।

অবস্থা সঙ্গিন বুঝে আমাদের বাধ্য হয়েই চাল পালটাতে হয়।

রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে বলি, আপনার ঘরের এ-অবস্থা হয়েছে তা তো জানতাম না।

গৌর সায় দিয়ে বলে, না, এ-ঘর এখুনি মেরামত ব্যবস্থা করা দরকার।

বাড়িওয়ালা যদি রাজি না হয়, আমরা চাঁদা তুলেই আপনার ঘর মেরামত করে দেব! শিশির দরাজ হয়ে ওঠে।

আগুনে জল পড়ে ঘনাদা যখন প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে এসেছেন তখন শিবুর একটি বেফাঁস কথায় আবার সব বুঝি মাটি হয়ে যায়!

সত্যি! ফুটো বলে ফুটো? শিবু হঠাৎ ফোড়ন কেটে বসে, ও ফুটো দিয়ে ঘনাদা কোনও দিন গলে যাননি, এই আমাদের ভাগ্যি!

ঘনাদা শিবুর দিকে ঘাড় ফেরান। সেই ঘাড় ফেরাবার ধরন আর তাঁর মুখে আষাঢ়ের মেঘের মতো ছায়া দেখেই আমরা সামলাবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠি।

কিন্তু সামলাব কী? হাসি চাপতে প্রায় দম ফাটার জোগাড়!!

সব হাসির বেগ কিন্তু একটি কথায় ঠাণ্ডা।

কী ফুটো জীবনে দেখেছ হে? ঘনাদার গলা নয় তো যেন মেঘের ডাক শোনা যায়।

আর মেঘের ডাকে চাতকের মতো সব হাসি-ঠাট্টা ভুলে আমরা উৎসুক হয়ে উঠি।

আপনি কী ফুটো দেখেছেন ঘনাদা?

পড়েছেন নাকি কখনও গলে?

হ্যাঁ পড়েছি! ঘনাদা গম্ভীর মুখে আবার তাঁর বিছানায় এসে বসে বলেন, পড়েছি চার কোটি মাইল!

চার কোটি মাইল একটা ফুটো! শিশির প্রায় উলটে পড়ে যায় আর কী!

পৃথিবীটা এফোঁড় ওফোঁড় করলেও তো আট হাজার মাইলের বেশি হয় না। গৌর হতভম্ব হয়ে নিবেদন করে।

না, তা হয় না, নির্বিকার ভাবে ঘনাদা জানান।

তবে…? বলার আগেই যে যেখানে পারি আমরা বসে পড়ি। ঘনাদা শুরু করেন।

প্যারাসুটটা আর যেন খুলতেই চায় না। বিশ হাজার থেকে দশ হাজার ফুট, দশ হাজার থেকে পাঁচ হাজার। পাঁচ থেকে আড়াই, আড়াই থেকে এক হাজার ফুট!

তখনও ঠিক যেন ইটের বস্তার মতো পড়ছি তো পড়ছি-ই!

নীচের তুষার-ঢাকা পৃথিবী বিদ্যুদবেগে আমার দিকে ছুটে আসছে দেখতে পাচ্ছি। আর কটা সেকেন্ড। তারপর বুঝি শরীরের গুঁড়োগুলোও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

কিন্তু ঠিক পাঁচশো ফুটের কাছে আসলটা না হলেও এরকম বিপদের জন্যে ফাউ হিসাবে যে ছোট প্যারাসুটটা সঙ্গে থাকে সেটা খুলে গেল ভাগ্যক্রমে। কিন্তু তাতে কি আর পুরোপুরি সামলানো যায়। ইটের বস্তার মতো না হোক, বেশ সজোরেই নীচে গিয়ে পড়লাম।

কী ভাগ্যি শীতের শেষে তুষার একটু নরম হতে আরম্ভ করেছে, চোটটা তাই তেমন বেশি হল না।

প্যারাসুট গুটিয়ে নিয়ে তারপর গা থেকে খুলে অবাক হয়ে চারিদিকে চাইলাম। ধূ-ধূ করা তুষার-ঢাকা তুন্দ্রা দিগন্ত পর্যন্ত বিছোনো! কিন্তু মিখায়েলের দেখা নেই কেন?

প্যারাসুট নিয়ে সে তো আমার আগেই ঝাঁপ দিয়েছে প্লেন থেকে। এমন কিছু দূরে তো সে নামতে পারে না যে চোখেই দেখা যাবে না ।

পর মুহুর্তেই রহস্যটা পরিষ্কার হয়ে গেল। মিখায়েলকে এখনও মাটির ওপর দেখব কী করে? এখনও সে তো শূন্যলোকে।

প্যারাসুট না খোলার দরুন আমি যেখানে বিদ্যুদবেগে কয়েক মুহূর্তে নেমেছি, সেখানে তার খোলা প্যারাসুট ধীরে সুস্থে ভাসতে ভাসতে এখনও নামছে।

আকাশে তাকিয়ে তার প্যারাসুটটা এবার দেখতে পেলাম। মিনিট খানেকের মধ্যে শ-খানেক গজ দূরে সে নামল।

প্যারাসুট ও সঙ্গের যৎসামান্য লটবহর গুছিয়ে নিয়ে দূরবিন দিয়ে চারিধার আর একবার ভাল করে দেখে অবাক হয়ে বললাম, কই হে, মেরুর একটা শেয়ালও তো দেখতে পাচ্ছি না। তোমার ড. মিনোস্কি এই মহাশশ্মানে কোথায় লুকিয়ে থাকবেন!

আছেন নিশ্চয় কোথাও এখানে! এবং আমাদের তাঁকে খুঁজে বার করতেই হবে।

আহা, সে কথা তো অনেকবারই শুনিয়েছ। কিন্তু জায়গাটা ভুল করোনি তো? এই চেলস্কিন অন্তরীপ হল উত্তর মেরুর দিকে রাশিয়ার শেষ স্থূলবিন্দু। তারপর শুধু অনন্ত মেরুসমুদ্র। ঠিক এই জায়গাটিই ড. মিনোস্কি তাঁর যুগান্তকারী পরীক্ষার জন্যে বেছে নিয়েছেন এ খবরটায় কোনও ভুল নেই তো?

না, তাতে ভুল নেই। মিখায়েল খুব জোর গলায় ঘোষণা করলেও মনে হল তার মনেও একটু সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

সন্দেহ কিন্তু সত্যই অমূলক। তুষার-ঢাকা সেই তুন্দ্রার মধ্যে ড. মিনোস্কিকে আমরা শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেলাম। কিন্তু তার আগে তাঁকে খোঁজার মূলে কী ছিল একটু বলে দেওয়া বোধ হয় দরকার!

অনেকেই বোধহয় জানে না যে গত মহাযুদ্ধের পর থেকে পৃথিবীর দুটি প্রধান শক্তি নিজেদের অজেয় করে তোেলবার জন্য মহাশূন্যে পর্যন্ত ঘাঁটি বানাবার কথা ভাবতে শুরু করেছে। একজন বৈজ্ঞানিক তত তাঁর পরিকল্পনা কাগজে কতকটা প্রকাশও করে দিয়েছেন। পৃথিবী থেকে মাইল পঞ্চাশ উঁচুতে খুদে চাঁদের মতো একটা শূন্যে ভাসমান বন্দর বসানোে হবে। সে বন্দর চাঁদের মতোই পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে তার চারিধারে ঘুরপাক খাবে। আর সেই বন্দর যে প্রথম মহাশূন্যে ভাসাতে পারবে পৃথিবী বলতে গেলে তার হাতের মুঠোয়। মহাশূন্যে এই বন্দর ভাসানো শুধু রকেট অর্থাৎ হাউই-বিজ্ঞানের দ্বারাই সম্ভব। দুটি মহাশক্তি তাই হাউই-বিজ্ঞান সম্বন্ধে পরস্পরের কাজের ওপর কড়া নজর রেখেছে। এ-বিজ্ঞানে কে কোন দিকে কতখানি এগিয়ে

গেল, সোজাসুজি জানবার উপায় নেই তা বলাই বাহুল্য, তাই দুই রাজ্যের। কল্পনাতীত পুরস্কারের লোভে প্রাণ হাতে নিয়ে বহু গুপ্তচর এই বিষয়ে যথাসম্ভব খবর সংগ্রহ করবার আশায় ঘুরছে।

 

অবশ্য ড. মিনোস্কির ওপর এই গুপ্তচরদের নজর না পড়াই উচিত। হাউই-বিজ্ঞান তাঁর গবেষণার বিষয় নয়। আগের যুগে যেমন আইনস্টাইন, এযুগে তেমনই তিনি অসাধারণ একজন গণিতবিশারদ। অনন্ত সৃষ্টির মধ্যে যে অসীম অঙ্কের রহস্য রয়েছে—তার জট খোলায় তিনি আর সকলের চেয়ে অনেকদূরে এগিয়ে গেছেন।

এই মিনোস্কিও গুপ্তচরদের লক্ষ্য হতে পারেন একথা ভাবতে পারলে বিশ হাজার ফুট থেকে এই চেস্কিন অন্তরীপের ওপর আমি ঝাঁপ দিতে রাজি অবশ্য হতাম না। কিন্তু সে কথা যথাসময়ে বলা যাবে।

দূরবিন চোখে দিয়ে মিখায়েলের সঙ্গে সেই তুষার-ঢাকা তুন্দ্রা যখন আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখছি তখনও আমি জানি যে মিনোস্কিরই গোপন নিমন্ত্রণে তাঁর আশ্চর্য রেডিয়ো-টেলিস্কোপ দেখতে আমি এসেছি। তাঁর নিজের ফরমাশ মতো এই আশ্চর্য টেলিস্কোপ যে রাশিয়ার এক জায়গায় বসানো হয়েছে এ-খবর দুনিয়াসুদ্ধ লোক তখন পেয়েছে। শুধু জায়গাটা যে কোথায় দু-চারজন ওপরওয়ালা বাদে তা রাশিয়ার কেউ জানে না। এ-টেলিস্কোপ এ-যুগে অসাধারণ এক কীর্তি। আলো দিয়ে নয়, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বেতার-তরঙ্গ দিয়ে সুর মহাশুন্যের খবর এ টেলিস্কোপে পাওয়া যায়। অ্যারিজোনার লাওয়েল অবজারভেটারির কি দক্ষিণ আফ্রিকার ব্লুমফনটেনের টেলিস্কোপের চেয়ে এই বেতার-দুরবীক্ষণ-যন্ত্র অনেকগুণ শক্তিশালী। তা ছাড়া এ-টেলিস্কোপের সুবিধে হল এই যে মেঘ, কুয়াশা বা ধোঁয়া কিছুতেই অচল হয় না। আলোর ওপর যার নির্ভর সে-টেলিস্কোপ অ্যারিজোনা বা দক্ষিণ আফ্রিকার মরুর মতো নির্মেঘ নির্মল আকাশের দেশে বসাতে হয়, কিন্তু এ টেলিস্কোপের সেরকম কোনও হাঙ্গামা নেই। এরকম একটি টেলিস্কোপ ইংল্যান্ডেও কিছুদিন হল বসানো হয়েছে, কিন্তু ড. মিনোস্কির টেলিস্কোপ নাকি তার চেয়ে অনেক জোরালো। শুধু তা-ই নয়, এ-টেলিস্কোপের সাহায্যে মিনোস্কি এমন এক আশ্চর্য পরীক্ষা নাকি করছেন বিজ্ঞানের যুগ যাতে পালটে যাবে।

এহেন লোক আমায় নিমন্ত্রণ করেছেন শুনে তেমন অবাক আমি হইনি। কারণ মিনোস্কির সঙ্গে অনেক আগেই আমার আলাপ হয়েছিল। তখন অবশ্য বিশ্ববিখ্যাত তিনি হননি।

নিমন্ত্রণটা বিশ্বাস করলেও এরকম লুকিয়ে সেটা করার কারণ আমি প্রথমটা বুঝতে পারিনি। মিখায়েলই সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিল।

কোনও শত্রুপক্ষের লোক না হলেও আমি বিদেশি বটে। আর যত প্রভাব প্রতিপত্তিই থাকে, বিদেশি একজন বন্ধুকে এসব গোপন জিনিস দেখানো মিনোস্কির পক্ষেও শোভন নয়। নেহাত আমাকে ভাল করে জানেন বলেই নিজের একান্ত বিশ্বাসী শিষ্য মিখায়েলের কাছে নিজের গোপন আস্তানার ঠিকানা জানিয়ে তারই মারফত এ-নিমন্ত্রণ তিনি করে পাঠিয়েছেন। তাঁর গোপন ঠিকানা মিখায়েলেরও আগে জানা ছিল না।

এ-নিমন্ত্রণের কথা যখন আমি শুনি তার কিছুদিন আগে মিখায়েলের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। আলাপ সে কতকটা গায়ে পড়েই করেছিল, কিন্তু হাতির মতো বিরাট চেহারার খরগোসের মত শান্তশিষ্ট লোকটাকে আমার খারাপ লাগেনি তার জন্য। মিনোস্কির দূত হয়েই সে যে আসল কথার সুযোগের অপেক্ষায় আমার সঙ্গে এভাবে আলাপ জমিয়েছে, এটুকু জানবার পর তার ওপর যেটুকু বিরাগ ছিল তা-ও কেটে গেছে। নিমন্ত্রণের কথা জানবার পর মিখায়েলের পরামর্শ মতো ওপরওয়ালাদের কাছে যেটুকু খাতির আছে তা-ই কাজে লাগিয়ে মিথ্যে অজুহাতে প্লেন জোগাড় করে তা থেকে প্যারাসুটে যথাস্থানে নামবার ব্যবস্থা করি। পাছে কেউ সন্দেহ করে বলে মিখায়েল নিজে এ সব জোগাড়যন্ত্রের ব্যাপারে মাথা গলায়নি। মাথা গলানো উচিত নয় বলেই আমায় বুঝিয়েছিল।

আসলে মিথ্যে সে যে কিছু বলেনি, সেই তুষার-ঢাকা তুন্দ্রার রাজ্যে মিনোস্কির গোপন মানমন্দির খুঁজে পাবার পর ভাল করেই বুঝলাম।

মানমন্দিরটি এমনভাবে তৈরি যে নেহাত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে না দেখলে তা তুষার-ঢাকা তুন্দ্রার অংশ বলেই মনে হবে। খুঁজে বার করতে সেই জন্যেই আমাদের অত কষ্ট হয়েছিল।

মানমন্দিরের ভেতর ঢুকে সমস্ত কষ্ট কিন্তু সার্থক মনে হল। এই চিরতুষারের দেশে মাটির নীচে এমন স্বর্গপুরী যারা বানিয়েছে মনে মনে তাদের তারিফ না করেও পারলাম না।

কিন্তু আরামে স্বর্গপুরী হলেও এ কীরকম মানমন্দির! কোথায় আশ্চর্য যন্ত্রপাতি, কোথায় বা আর সব লোকজন?

বাইরে যেখানে পারা-জমানো শীত, মানমন্দিরের ভেতরে সেখানে ঠাণ্ডার কোনও বালাই নেই। বড় একটা জাহাজের মতো পরম সুখে দিন কাটাবার সব রকম আয়োজন উপকরণই সেখানে প্রচুর। শুধু আসল জিনিসের কোনও চিহ্ন নেই।

শেষ পর্যন্ত মিনোস্কির কাছে নিজের কৌতূহলটা প্রকাশ না করে পারলাম না।

বিরাট একটা চাকার মতো প্যাঁচ লাগানো দরজা খুলে মিনোস্কি নিজেই আমাদের সিঁড়ি দিয়ে ভেতরে নিয়ে এসেছিলেন। প্রথমটা একটু অবাক হলেও আমায় চিনতে পেরে তাঁর আনন্দ যেন আর ধরে না।

একি, দাস! তুমি! তুমি এখানে আসবে আমি ভাবতেই পারিনি। বলে আমার হাত ধরে সজোরে তিনি ঝাঁকানি দিয়েছিলেন।

আমিও একটু ঠাট্টা করে বলেছিলাম, আমিই কি পেরেছিলাম। হঠাৎ প্লেনটা বিগড়ে যাওয়ায় প্যারাসুটে নেমে পড়লাম!

ওঃ, প্যারাসুটে নেমেছ।

তাঁর বিস্ময়টুকু দেখে হেসে বলেছিলাম, সাধে কি আর নেমেছি! আপনার শিষ্য এই মিখায়েলের কাছে শুনলাম, অন্য কোনও রকম নামা নাকি আপনার পছন্দ নয়। তবে প্যারাসুটের দড়ি যেভাবে জড়িয়ে গেছল খুলতে আর একটু দেরি হলে আপনার নিমন্ত্রণ রাখা এ জন্মে আর হত না।

তাই নাকি! এত কাণ্ড করে তোমাকে নিমন্ত্রণ রাখতে হয়েছে! বলে তিনি বেশ একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন।

মিখায়েল অবশ্য একান্ত অনুগত শিষ্যের মতো এর মধ্যে একটি কথাও বলেনি।

মিনোস্কি এখন ঘুরে ঘুরে সমস্ত জায়গাটা আমাদের দেখাচ্ছিলেন। তারই মধ্যে এক সময় আমার মনের কথাটা বলে ফেললাম। এ সব দেখে কী হবে, ড. মিনোস্কি! এর বদলে কুইন মেরি কোনও বড় জাহাজ দেখলেই তো পারতাম।

জাহাজই তো দেখছেন। মিনোস্কির মুখে অদ্ভুত একটু হাসি।

জাহাজ দেখছি। ঠাট্টাটা বুঝতে পারলাম না। মিখায়েলের গলা এতক্ষণে প্রথম শোনা গেল। সে গলার স্বর যেন অন্যরকম!

ঠাট্টা নয়! সত্যিই এটা জাহাজ। এমন জাহাজ এ-পর্যন্ত কেউ কল্পনাও করেনি।

জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে মিনোস্কি আবার বললেন, কিন্তু ঠাট্টার বদলে একটু ঠাট্টা করলেই বা দোষ কী! গুপ্তচর মিচেল যে আমার শিষ্য মিখায়েল হয়ে উঠেছে এটা একটু বেয়াড়া ঠাট্টা বলেই তো আমার মনে হয়।

অবাক হয়ে আমি যা বলতে যাচ্ছিলাম তাতে বাধা দিয়ে মিনোস্কি বললেন, তুমি শেষে এই নীচ কাজে নামবে আমি ভাবিনি, দাস।

ব্যাকুলভাবে এবার জানালাম, বিশ্বাস করুন ড. মিনোস্কি আমি এসবের কিছুই। জানি না। মিখায়েলকে সত্যিই আপনার শিষ্য ভেবে ওর কথায় বিশ্বাস করেছিলাম।

ছদ্মবেশী মিচেল এবার নির্লজ্জভাবে হেসে উঠে বললে, তোমার মতো আহাম্মককে তা না বিশ্বাস করাতে পারলে এখানে আসবার প্লেন, নামবার প্যারাসুট জোগাড় হত কী করে! আমার কার্যোদ্ধারই যে নইলে হত না।

কার্যোদ্ধার সত্যি হয়েছে ভাবছ? মিনোস্কি বজ্রস্বরে বলে উঠলেন, আমাদের পুলিশ এতই কাঁচা মনে করো! তোমরা এখানে রওনা হবার সঙ্গে সঙ্গে তারা সব কথা আমায় বেতারে জানিয়ে দিয়েছে। আমায় সাহায্য করবার প্রহরীও তারা পাঠাচ্ছিল। আমিই বারণ করে দিয়েছি।

বারণ করে ভাল করেননি ডা. মিনোস্কি। মিচেলের আসল চরিত্র তার গলার স্বরেই এবার বোঝা গেল, কী পরীক্ষা আপনি এখানে করছেন এখনও জানতে পারিনি, কিন্তু এখানকার যা কিছু দরকারি জিনিস সব সমেত আপনাকেও এখান থেকে পাচার করবার ব্যবস্থা করতেই আমি এসেছি। আমার নির্দেশ পেয়ে আমাদের দুটি প্লেন শিগগিরই এখানে নামবে।

অবিচলিতভাবে মিনোস্কি একটু হেসে বললেন, কিন্তু নেমে কিছু পাবে কি?

হ্যাঁ পাবে! মিচেল দাঁত খিচিয়ে উঠল, কোনও চালাকি যাতে তার আগে আপনি না করতে পারেন সেজন্যে আপনাকে একটু বাঁধব। এই সুটকো কালা আদমিটা অবশ্য ধর্তব্যই নয়।

যেমন চেহারা তেমনই মত্ত হাতির মতোই পদভরে ঘর কাঁপিয়ে মিচেল এবার এগিয়ে এল। পর মুহূর্তেই দেখা গেল ঘরের এক কোণের একটা সোফার ওপর ডিগবাজি খেয়ে পড় সে কাতরাচ্ছে।

জামাটা যেটুকু লাট হয়েছিল ঠিক করে বললাম, আর কিছু দরকার হবে ডা. মিনোস্কি?

ধন্যবাদ দাস! আর কিছুর দরকার নেই। তুমি না সাহায্য করলেও অবশ্য কিছু

ক্ষতি হত না। আমি তৈরি ছিলাম।

কাতরাতে কাতরাতেও মিচেল গর্জে উঠল, তৈরি থাকার করে দিচ্ছি। আমাদের লোকেরা এখানে নামল বলে!

তার আগে তোমাকে যে অনেক নামতে হবে। বলে মিনোক্তি আমার দিকে ফিরলেন, শোনো দাস, বিজ্ঞানের এক আশ্চর্য পরীক্ষা এবার আমি করতে যাচ্ছি। পরীক্ষায় বাঁচব কি মরব আমি জানি না। তাই এই শয়তানকেই শুধু আমার সঙ্গী করতে চাই। তুমি ইচ্ছে করলে এখন চলে যেতে পারো!

এত বড় সৌভাগ্য শুধু ওই শয়তানই পাবে। আমি কী অপরাধ করলাম!

হেসে আমার পিঠ চাপড়ে মিনোস্কি বললেন, এই জবাবই তুমি দেবে জানতাম। যাও ওই সোফাটায় আরাম করে বসে গিয়ে, যাও!

সোফায় বসতে না বসতেই মিনোস্কি দেওয়ালের একটি কী বোতাম টিপলেন। সঙ্গে সঙ্গে মেঝের একটা জায়গা ফাঁক হয়ে যেন ভোজবাজিতে অদ্ভুত একটা যন্ত্র বেরিয়ে এল। সে যন্ত্রের একটা কী হাতল টেনে ধরতেই কী যে হল কিছুই আর জানতে পারলাম না।

জ্ঞান যখন হল তখন দেখি ঠিক সেই ঘরেই সেই সোফাতেই বসে আছি। মিচেল তখনও অসাড় হয়ে তার জায়গায় পড়ে আছে। আর মিনোস্কি ঘরের একদিকের কাঁচের জানলার ধারে দাঁড়িয়ে বাইরে কী দেখছেন।

তাঁর কাছে ছুটে গিয়ে বললাম, কী হল কী বলুন তো? কী দেখছেন আপনি? নিজেই দেখো না, বলেই তিনি হাসলেন।

দেখে সত্যিই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। মেরুর তুষার-ঢাকা তুন্দ্রার বদলে এ যে টকটকে লাল বালির মরুভূমি! একি! সাহারা নাকি! সবিস্ময়ে বলে ফেললাম।

মিনোস্কি এবার সশব্দে হেসে উঠে বললেন, না, তার চেয়ে আর একটু দূর—এ হল মঙ্গল গ্রহের লাল বালির মরুভূমি। মঙ্গল গ্রহকে যার জন্য লাল দেখায়।

মঙ্গল গ্রহ! আমার না মিনোস্কির কার মাথা খারাপ হয়েছে তখন ভাবছি। কিন্তু তুষার-ঢাকা তুন্দ্রার বদলে লাল মরুভূমি তো সত্যিই দেখতে পাচ্ছি। পৃথিবীর কোনও মরুভূমির সঙ্গে তার মিলও নেই।

আমায় আবার সোফায় নিয়ে এসে বসিয়ে মিনোস্কি বললেন, সত্যিই, মঙ্গল গ্রহে আমরা নেমেছি। আমার পরীক্ষা সফল।

আমার বিমূঢ়তায় একটু হেসে তিনি আবার বললেন, মঙ্গল গ্রহ এবার পৃথিবীর কত কাছে এসেছে খবরের কাগজেও তা বোধহয় পড়েছ। পৃথিবী থেকে তার দূরত্ব এখন চার কোটি তিন লক্ষ মাইলের কাছাকাছি। কিন্তু এত কাছে এলেও, কোনও হাউই যন্ত্র দিয়ে ঘণ্টায় চার হাজার মাইল ছুটেও মাস দেড়েকের আগে আমরা পৌঁছতে পারতাম না। সে জায়গায় প্রায় চক্ষের নিমেছে আমরা এসেছি বলা যায়।

কিন্তু এলাম কী করে! আমি আগের মতোই বিমূঢ়।

এসেছি ফুটো দিয়ে গলে। আমার বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখের দিকে চেয়ে তিনি বললেন, হ্যাঁ, সত্যিই ফুটো! মহাশূন্যের ফোর্থ ডাইমেনসন মানে চতুর্থ মাপের ফুটো। লম্বা, চওড়া, উঁচু—এই তিন মাপ দিয়েই সৃষ্টির সব কিছু আমরা দেখতে জানি। গণিত-বিজ্ঞান এ ছাড়া আরও মাপের সন্ধান পেয়েছে, কিন্তু তা কাজে লাগাতে কেউ পারেনি এ পর্যন্ত। আমার এই পরীক্ষায় প্রথম সেই চতুর্থ মাপের জগৎ মানুষের আয়ত্তে এল।

ব্যাপারটা তোমায় আর একটু ভাল করে বোঝাই। খুব লম্বা একটা চিমটে মনে করো। এক দিকের ডগা থেকে আর এক দিকের ডগায় পৌঁছতে হলে একটা পিপড়েকে সমস্ত চিমটেটা মাড়িয়ে যেতে হবে। তাতে তাকে হাঁটতে হবে ধরো তিন গজ। কিন্তু চিমটের একটা ফলা থেকে আর একটা ফলা মাত্র এক ইঞ্চি দূরে যদি থাকে আর ওপরের চুলা থেকে নীচের ফলায় যাবার একটা ফুটো যদি পিপড়েটা পায় তা হলে এক ইঞ্চি নেমেই তিন গজ হাঁটার কাজ তার সারা হয়ে যাবে। লম্বা, চওড়া ও উঁচু—এই তিন মাপের জগতে যা অনেক দূর, চতুর্থ মাপ দিয়ে সেখানে অতি সহজে পৌঁছোবার এমন অনেক ফুটো মহাশূন্যে আছে। তেমন একটা ফুটোই আমি খুঁজে পেয়েছি।

এবার উৎসাহে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, মঙ্গল গ্রহটা তা হলে তো ঘুরে দেখতে হয়।

হেসে আমায় নিরস্ত করে মিনস্কি বললেন, না, না, এবার সেজন্যে তৈরি হয়ে আসিনি। তা ছাড়া এ ফুটো থাকতে থাকতেই পৃথিবীতে ফিরে যেতে হবে। অন্তত ওই শয়তান মিচেলটার জ্ঞান হবার আগে।

মিচেলের জ্ঞান পৃথিবীতে ফিরেই হয়েছিল। তখন তার হাতে হাতকড়া। প্লেনে করে মিনোস্কিকে চুরি করতে যারা নেমেছিল তাদের অবস্থাও তথৈবচ।

ঘনাদার কথা শেষ হতে না হতেই শিবু বলে উঠল, এই বছরেই তো জুন জুলাই-এর মাঝামাঝি মঙ্গল গ্রহ পৃথিবীর অত্যন্ত কাছে এসেছিল শুনেছি। কিন্তু সশরীরে তখন আপনি এই মেসেই ছিলেন মনে হচ্ছে।

কোনও উত্তর না দিয়ে শিশিরের হাত থেকে সিগারেটের টিনটা অন্যমনস্কভাবে তুলে নিয়ে ঘনাদা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

সুতো

না, এবারে অবস্থা একেবারে সঙ্গিন। খবরের কাগজের ভাষায় যাকে বলে সংকটজনক পরিস্থিতি।

অন্তত আমাদের বুদ্ধিতে আর কুল পাওয়া যাচ্ছে না।

একে একে সব কলাকৌশলই আমরা প্রয়োগ করেছি, কিন্তু সবই বৃথা।

কঞ্চির তীরের মতো আমাদের সব ফন্দিফিকির এক দুর্ভেদ্য বর্মে ঠেকে নিল হয়ে গেছে।

প্রথমে গৌর, তারপর আমি এবং আমাদের পরে শিবু ও শিশির হতাশ হয়ে ফিরে এসেছে। ঘনাদাকে তাঁর ঘর থেকে নীচে নামাতে পারিনি।

আজ সাতদিন ধরে তিনি স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছেন নিজের তেতলার ঘরে।

রামভুজ দু বেলা খাবারের থালা পৌঁছে দিয়ে আসে। উদ্ধব জলের কুঁজো ভরে দিয়ে এসে সে থালা যথারীতি রোজ দুবার নামিয়ে আনে।

ব্যস। মেসের সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক ঘনাদার নেই।

আমরা চেষ্টার ত্রুটি করিনি। কিন্তু ঘরের দরজাই না খুললে বাইরে থেকে কত আর কৌশল প্রয়োগ করা যায়। দরজায় টোকা দিয়ে তবু ডেকেছি, শুনছেন, ঘনাদা!

কোনও সাড়া নেই প্রথমে। বারকয়েক ডাকের পর ভেতর থেকে একটা আওয়াজ শোনা গেছে যার মধ্যে অভ্যর্থনার বাম্পও নেই!

কে?

প্রশ্নটা অর্থহীন, কারণ আমাদের সকলের গলাই ঘনাদার ভাল রকম চেনা। তবু সবিস্তারে পরিচয় দিয়ে শিবুই হয়তো জানায়, আজ্ঞে, আমি শিবু। আপনার সঙ্গে বিশেষ একটু দরকার ছিল।

পরে এসো।

মুশকিল ওইখানেই। ঘনাদা অন্য কিছু বলে বিদায় করতে চাইলে তবু উপরোধ অনুরোধ করা যায়। তিনি যদি রাগ দেখান তাতেও ক্ষমা চেয়ে তাঁকে সন্তুষ্ট করবার চেষ্টা করা যায়, কিন্তু পরে এসো বলবার পর বেশিক্ষণ তা নিয়ে আর সাধাসাধি চলে না।

পরে এসেও অবশ্য তাঁর দরজা খোলা পাওয়া যায় না। হয় তিনি ঘুমোচ্ছেন, নয় বাথরুমে গেছেন।

নিরুপায় হয়ে শেষে রামভুজের সঙ্গেই সেদিন রাত্রে তাঁর ঘরে ঢুকে পড়লাম। একটু চালাকি অবশ্য করতে হয়েছিল। দুবেলা রামভুজ এসে বড়বাবু, খাবার আনিয়েছি বলে ডাকলে তিনি দরজা খুলে দেন। আমরা একেবারে নিঃশব্দে রামভুজের পেছন পেছন এসে সেদিন দেওয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে গেছি।

দরজা খোলার পর রামভুজ মেঝের ওপর থালা বাটি সাজাচ্ছে এমন সময়ে আমাদের প্রবেশ।

ঘনাদা আসনে বসে সবে গেলাসের জলে হাতটা ধুয়ে মহাযজ্ঞের জন্য তৈরি হচ্ছেন, এমন সময় আমাদের ক-জনকে দেখে মুখে তাঁর আষাঢ়ের মেঘ নেমে এসেছে।

শিশির তখন তাঁকে দেখিয়ে দেখিয়েই নতুন সিগারেটের টিনটা ঢাকনা ঘুরিয়ে খুলে হাওয়া ঢোকবার আওয়াজটুকু পর্যন্ত শুনিয়ে দিয়েছে। শিবু যেন রেগে গিয়ে রামভুজকেই বকতে শুরু করেছে, তোমার কী রকম আক্কেল, ঠাকুর! ওইটুকু বাটিতে ঘনাদার জন্য মাংস এনেছ! কেন, আর বড় বাটি নেই মেসে?

তা, যে বাটিতে ঘনাদাকে মাংস দেওয়া হয়েছে তার চেয়ে বড় বাটি অবশ্য ফরমাস দিয়ে না গড়ালে বোধহয় পাওয়া মুশকিল।

কিন্তু হায়, সবই বৃথা!

ঘনাদা আমাদের দিকে ভ্রুক্ষেপ পর্যন্ত না করে রামভুজকেই উদ্দেশ করে বলেছেন, এসব নিয়ে যাও রামভুজ! আমি আজ আর খাব না।

আমরা হতভম্ব! রামভুজও তথৈবচ। তবে তার মুখেই প্রথম কথা বেরিয়েছে, খাইনে না কী বলছেন, বড়বাবু! আজ ভাল মটন আছে। আমি কোপ্তা কারি বানিয়েছি।

ঘনাদা আড়চোখে একবার মাংসের বাটিটার দিকে চাইলেও নিজের সংকল্পে অটল থেকেছেন।

না, আমার খাবার উপায় নেই। উপায় নেই! হঠাৎ হল কী? আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে সবিস্ময়ে! ঘনাদা রামভুজকেই শুনিয়ে বলেছেন, কারুর সামনে আমার খাওয়া বারণ, তুমি তো জানো।

রামভুজ কী জানে তা আর আমরা যাচাই করবার জন্য অপেক্ষা করিনি। সবাই তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে এসেছি অপ্রস্তুত হয়ে। ঘনাদার একথা শোনার পর আর সেখানে থাকা যায়!

 

সেই থেকে আজ সাতদিন হল ঘনাদার সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই।

ঘনাদার রাগটা এবার একটু বেশি এবং তা নেহাত অকারণেও নয়। আমাদের রসিকতাটা এবার বোধহয় মাত্রা একটু ছাড়িয়েও গেছল।

কিন্তু সব দোষ তো আসলে সেই বাপি দত্তর।

হাঁস খাইয়ে খাইয়ে আমাদের পাগল করে না তুললে তাকেই অমন একদিন খেপে গিয়ে মেস ছাড়তে হয়, না ঘনাদা আমাদের সঙ্গে সব সম্বন্ধ ঘুচিয়ে দেন!

বাপি দত্ত দুমাসে বিগড়ি হাঁসের পেছনে বেশ কিছু গচ্চা দিয়ে নিজেও জব্দ হয়ে গেল, আমাদেরও মেরে গেল। আপনি মজিলি তুই, মজালি লঙ্কায়। এই আর কী!

গায়ের জোরে না মারুক, যাবার সময় বাপি দত্ত যেসব বাক্যবাণ ছেড়ে গেছে, নেহাত গণ্ডারের চামড়া না হলে আমরা তাতেই কাবু হতাম। বাপি দত্ত রোজকার মতো মিউনিসিপ্যাল মার্কেট থেকে হাঁস কিনে এনে নিজেই সেদিন যথারীতি কাটতে বসেছে। ধৈর্য তার অসীম সন্দেহ নেই। দুমাস ধরে হাঁস কেটে নাড়িভুড়ি ছাড়া কিছু না পেয়েও সে দমেনি। ঘনাদার সেই সাত রাজার ধন মানিকের কৌটা কোন হাঁসের পেট থেকে বেরিয়ে হঠাৎ একদিন তাকে রাজা করে দেবে, এ বিশ্বাস নিয়েই সে রোজ হাঁস কাটতে বসে।

অন্যদিন আমরা কাছাকাছি ঘোরাফেরা করে ঠাট্টা বিদ্রুপ মাঝে মাঝে করি।

কী হে, দত্ত! পেলে কৌটো? বিগড়ি হাঁস ছেড়ে এবার পাতিহাঁস ধরো হে! ইত্যাদি।

এ-দিন কিন্তু আমরা বাপি দত্ত হাঁস কাটতে বসার পরই যে যেখানে পারি গা ঢাকা দিয়েছিলাম।

হঠাৎ বাপি দত্তর বাজখাঁই গলার চিৎকারে মেস কম্পমান! ইউরেকা! পেয়েছি। পেয়েছি।

আমরা যে যার জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে দোতলার বারান্দা থেকে সবিস্ময়ে নীচে উঁকি দিয়েছি এবার! ঘনাদা পর্যন্ত তাঁর তেতলার ঘর থেকে নেমে এসে বারান্দা দিয়ে গলা বাড়িয়েছেন।

বাপি দত্ত নীচের উঠোন থেকে কী একটা রক্ত-মাখা জিনিস হাতে তুলে ধরে শুধু বুঝি ধেই নৃত্য করতে বাকি রেখেছে—শিগগির শিগগির আসুন! মার দিয়া কেল্লা!

আমরা শশব্যস্ত হয়ে নীচে নেমে গেছি—ঘনাদাকেও এক রকম টানতে টানতে সঙ্গে নিয়ে।

নীচে নামবার পর বাপি দত্তের গলায় যত উত্তেজনা, আমাদের মুখে তত বিমূঢ় বিস্ময়!

বলেছি, অ্যাঁ! সেই কৌটো! সেই বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা যাতে কেনা যায় সেই ভারী জলের হ্রদের ম্যাপ?

আড় চোখে ঘনাদার মুখটাও দেখে নিয়েছি তার মধ্যে। কিন্তু কেমন, কী বলেছিলাম! ভাবখানার বদলে তাঁকে যেন কেমন ভ্যাবাচ্যাকাই দেখিয়েছে।

বাপি দত্তর সে দিকে লক্ষ নেই। কৌটোটা ঘনাদাকে সগর্বে দেখিয়ে সে হাঁপাতে হাঁপাতে হাঁসের পেট কেটে সেটা বার করার কাহিনী সবিস্তারে শুরু করেছে।

শিবু একটু কেশে বাধা দিয়ে বলেছে, কিন্তু কৌটোটা এবার খুললে হত না!

শিশির গম্ভীর মুখে সায় দিয়ে বলেছে, তবে খোলবার সম্মানটা ঘনাদারই পাওয়া উচিত।

বাপি দত্ত সোৎসাহে বলেছে, নিশ্চয়! নিশ্চয়! ঘনাদা ছাড়া খুলবে কে? কৌটোটা সে ঘনাদার দিকে এগিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু ঘনাদার হঠাৎ হল কী? এত বড় জয়-গৌরবের মুহূর্তে তিনি যেন সরে পড়তে পারলে বাঁচেন।

না, না, আমার কী দরকার! ও তোমরাই খোললা! বলে তিনি সটান সিড়ির দিকে পা বাড়িয়েছেন।

কিন্তু বাপি দত্তই তাঁকে আটকেছে। আনন্দে গদগদ হয়ে বলেছে, তা কি হয় নাকি! এ আপনারই কৌটো, আপনাকেই খুলতে হবে?

অগত্যা ঘনাদাকে বাধ্য হয়ে কৌটোটা খুলতে হয়েছে। আমরা সকলে তখন উদগ্রীব হয়ে তাঁকে চার ধারে ঘিরে দাঁড়িয়েছি। বাপি দত্তর চোখ দুটো প্রায় কোটর ঠেলে বুঝি বেরিয়েই আসে।

কৌটোর ভেতর থেকে এক টুকরো কাগজ বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসের যে চিৎকার উঠেছে তা প্রায় মোহনবাগান কি ইস্টবেঙ্গলের শেষ মিনিটে গোল দিয়ে জিতে যাবার সামিল।

বাপি দত্ত আর ধৈর্য ধরতে পারেনি। ঘনাদার হাত থেকে কাগজের পাকান টুকরোটা নিজের অজান্তেই ছিনিয়ে নিয়ে খুলে ফেলেছে।

তারপর তার মুখে পর পর যে ভাবান্তর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দেখা গেছে, ছায়াছবিতে হলে হাততালি পেত নিশ্চয়।

প্রথমে আহ্লাদে আটখানা, তারপরে চমকে হতভম্ব, তারপর একেবারে কালবোশখির কালো মেঘ।

সেই কালবোশেখির মেঘই গর্জে উঠেছে এবার, কার, কার এই শয়তানি?

গৌর বোকা সেজে বাপি দত্তের হাত থেকে কাগজের টুকরোটা নিয়ে পড়ে শুনিয়েছে ভাল মানুষের মতো।

কাগজের টুকরোতে গোটা গোটা করে ছাপার হরফের মতো লেখা—ঘনাদার গুল!

তারপর যে লঙ্কাকাণ্ড হয়েছে তার পরিণামেই বাপি দত্ত মেস ছেড়েছে আর ঘনাদা ছেড়েছেন আমাদের।

 

বিকেল বেলা।

ঘনাদার রুটিন আমাদের জানা। এতক্ষণে তিনি দুপুরের দিবানিদ্রা সেরে গড়গড়ায় পরিপাটি করে তামাকটি সেজে পরমানন্দে খাটের ওপর বালিশ হেলান দিয়ে বসে তা উপভোগ করছেন। এই গড়গড়ায় তামাক খাওয়াটা ইদানীং শুরু হয়েছে, আমাদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের পর।

হঠাৎ নীচে শোরগোল উঠল। গৌর গলা চড়িয়ে শিশিরকে বকছে, আচ্ছা, তুই পিয়নকে ফেরত দিলি কী বলে?

সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গলা। শিশিরকে সবাই মিলে আমরা কোণঠাসা করছি চেচিয়ে।

আহা! একবার জিজ্ঞেস করে দেখা তো উচিত ছিল?

একেবারে হিয়া নেহি বলে বিদেয় করবার কী দরকার ছিল!

ঘনাদার নাম যখন বললে, তখন তাঁকে একবার ডাকতে ক্ষতি কী ছিল!

শিশির যেন সকলের আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে রেগে জবাব দিলে, ডেকে লাভ কী! ঘনাদা কি ঘর থেকে বেরুতেন! আর রেজেস্ট্রি চিঠি ঘনাদার নামে কোখেকে আসবে?

কয়েক সেকেন্ড বিরতির মধ্যে টের পেয়েছি ওপরে গড়গড়ার ভুড়ুক ভুভুক আওয়াজ থেমে গিয়েছে।

দরজার খিলটা সাবধানে খোলার আওয়াজও যেন পাওয়া গেল। আমরাও গলা। চড়িয়ে দিলাম।

রেজেস্ট্রি করা চিঠি কেউ ফেরত দেয়? তার ওপর আবার ইনসিওর করা! ওই ইনসিওর শব্দটিতে বাজিমাত হয়ে গেল।

একটা গলা খাঁকারির আওয়াজে আমরা যেন চমকে চোখ তুলে তাকালাম। ঘনাদা ছাদের আলসের কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন ঘর থেকে বেরিয়ে।

এই যে ঘনাদা! শুনেছেন শিশিরের আহাম্মকি!

সেইটেই শুনতে চাইছি।

আর দুবার বলতে হল না। তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে সবাই ওপরের ছাদে গিয়ে হাজির। তারপর এর মুখের কথা ও কেড়ে নিয়ে সবিস্তারে ফলাও করে ব্যাপারটা জানানো হল। সেই সঙ্গে শিশিরকে গালমন্দ আর আমাদের থেকে থেকে আপশোস!

ইস, ইনসিওর করা চিঠি—! কী ছিল তাতে কে জানে!

কিন্তু পোস্টাফিসে গেলে এখনও তো সে চিঠি পাওয়া যায়! ঘনাদা নিজেই পথ খুঁজে বার করলেন আগ্রহের সঙ্গে।

আমরা তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। আর কী করে পাওয়া যাবে! কালই নাকি শেষ তারিখ ছিল চিঠি দেবার! আজ একবার শুধু শেষ চেষ্টা করবার জন্য এসেছিল। পিয়ন বলে গেল আজ দুপুরেই চিঠি যেখান থেকে এসেছে সেখানে ফেরত যাবে।

শিশিরকেই আমরা ধমকালাম, ফেরত যাবে মানে? এতদিন কী করছিল? রেজেস্ট্রি চিঠি এতদিন দেয়নি কেন?

নামের একটু গোলমাল ছিল যে। নাম ছিল Gana Sam Dos, তাইতেই পোস্টাফিস ঠিক বুঝতে পারেনি এতদিন? শিশির ব্যাপারটাকে আরও ঘোরালো করে তুললে।

আমরা শিশিরের ওপরেই চটে উঠলাম, বুঝতে পারেনি বললেই হল। নামে গোলমাল থাক, ঠিকানা তো ছিল, আর বিদেশের চিঠিতে নামের বানান তো কতরকম হতে পারে। ঘনাদার কি শুধু ইংরেজেদের সঙ্গেই কারবার! জার্মান, ফ্রেঞ্চ, ইটালিয়ান কার সঙ্গে নয়?

না, দোষ কিন্তু শিশিরের! শেষ পর্যন্ত আমরা শিশিরের ওপরেই গিয়ে পড়লাম, চিঠিটা ও কী বলে ফেরত দিলে?

খুব অন্যায় হয়েছে আমার! অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করবার জন্য শিশির যেন সিগারেটের টিনটা খুলে ধরল।

ঘনাদা অন্যমনস্ক ভাবে তা থেকে একটা তুলে নিতেই আর আমাদের পায় কে? চিঠিটা কোনও জার্মানের লেখা বোধহয়। শিবুই জল্পনা শুরু করে দিলে সোৎসাহে, ঘনাদাকে সেখানে হের ডস নামেই তো সবাই চেনে।

গৌর প্রতিবাদ জানালে, না, না, নিশ্চয়ই ফরাসি কেউ লিখেছে। কী শিশির নামের আগে সঁসিয়ে ছিল না?

মঁসিয়ে নয়, সেনর বলে মনে হচ্ছে। ইটালি থেকে কেউ লিখেছে বোধহয়। তাই? প্রশ্নটা শিশিরকেই করলাম।

শিশির অপরাধীর মতোই স্বীকার করলে চিঠির নামের আগে কী লেখা ছিল সে লক্ষই করেনি।

তা লক্ষ করবে কেন? তা হলে যে কাজ হত! বলে শিশিরকে ধমকে গৌর সোজা ঘনাদাকেই প্রশ্ন করলে, চিঠিটা কোথা থেকে কে পাঠিয়েছিল কিছু বুঝতে পারছেন?

কয়েকটা উৎকণ্ঠিত মুহূর্ত। পাল্লা কোনদিকে হেলবে? সন্ধি, না বিগ্রহ?

শিবু হঠাৎ পাল্লায় পাষাণ চড়িয়ে দিলে আলসে থেকে ঝুঁকে ঠাকুরকে চিৎকার করে ডেকে, আমাদের কবিরাজি কাটলেটগুলো আর চা ওপরেই নিয়ে এসো ঠাকুর। ঘনাদার দিকে ফিরে সলজ্জভাবে বিশদ বিবরণও দিয়ে দিলে, স্পেশা , অর্ডার দিয়ে আনিয়েছি আজ!

ওই পাষাণটুকুতেই পাল্লা হেলল। কাটলেটের কথা যেন শুনতেই পাননি এইভাবে ঘনাদা আগেকার প্রশ্নটাকেই তুলে ধরলেন, চিঠিটা কোথা থেকে কে পাঠিয়েছে, জানতে চাও, কেমন?

আমরা ঘনাদার আগেই তাঁর ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বললাম, হ্যাঁ, হঠাৎ বিদেশ থেকে ইনসিওর করা চিঠি!

ততক্ষণে ঘনাদার ঘরে আমরা ঢুকে পড়েছি। নীচে থেকে বড় ট্রেতে করে চা আর কাটলেটের ডিসও এসে গেছে।

ঘনাদা তাঁর তক্তপোশটিতে সমাসীন হয়ে অন্যমনস্ক ভাবে একটা কাটলেট তুলে নিয়ে বললেন, চিঠিটা হঠাৎ নয় হে, এই চিঠি…

কথাটা আর শেষ করা তাঁর হল না। পরপর চারটি স্পেশাল অর্ডার দেওয়া কবিরাজি কাটলেট যথাস্থানে প্রেরিত না হওয়া পর্যন্ত কথাটার সঙ্গে আমরাও মাঝপথেই ঝুলে রইলাম।

কাটলেটের পর ডান হাতের তর্জনী ও অনামিকার মধ্যে শিশিরের গুঁজে দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া সিগারেটটিতে দুবার সুখটান দিয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে তিনি বাক্যাংশটি শেষ করলেন।

…অনেকদিন আগেই আসার কথা।

তাহলে কে পাঠিয়েছে বুঝতে পেরেছেন! আমরা যেন অবাক!

তা আর বুঝিনি! ওই নামের বানান দেখেই বুঝেছি। আমার নামের বানান শুধু একজনেরই করা সম্ভব। আজ ছ-বছর ধরে তার এই চিঠির জন্যই দিন গুনছি!

ছ-বছর ধরে! খুব দামি চিঠি নিশ্চয়? শিশির চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞাসা করলে।

ধমকে বললাম, দামি না হলে ইনসিওর করে।

ঘনাদা কিন্তু একটু বিদ্রুপের হাসি হাসলেন, ইনসিওর তো নামে, নইলে ও-চিঠি ইনসিওর করার খরচা দিতে পেরুর ট্রেজারি ফতুর হয়ে যেত!

এবার নির্ভাবনা হয়ে কপালে চোখ তুলে জিজ্ঞাসা করলাম, চিঠিটার এত দাম?

কী ছিল ওতে? হিরে-মুক্তো? সরলতার প্রতিমূর্তি হয়ে জিজ্ঞাসা করলে শিবু।

দুর! হিরে-টিরে হলে তো ভারী হত! আর হিরের দাম যতই হোক ইনসিওর করবার খরচ দিতে ট্রেজারি ফতুর হয় নাকি? শিশির শিবুর মৃঢ়তায় বিরক্ত হয়ে উঠল।

কিন্তু পেরুর ট্রেজারি কেন? গৌর একেবারে সার কথাটা ধরে বসল, চিঠিটা পেরু থেকে এসেছিল নাকি?

ঘনাদা একটু হেসে আমাদের উগ্রীব মুখগুলোর ওপর একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, হ্যাঁ, পেরুর কুজকো শহর থেকে ডন বেনিটো ছাড়া আর কেউ ও-চিঠি পাঠাতে পারে না।

কিন্তু কী ছিল ওতে? আমরা উদগ্রীব।

আমাদের যথারীতি কয়েক সেকেন্ড রুদ্ধ নিশ্বাসে অপেক্ষা করিয়ে রেখে ঘনাদা ধীরে ধীরে বললেন, ছিল কটা রঙিন সুতো।

সুতো! আমরা এবার সত্যিই হতভম্ব।

সুতো মানে এই কার্পাসের তুলো থেকে যে সুতো পাকানো হয়? শিবুর মুখের হাঁ আর বুজতে চায় না।

হ্যাঁ, গাঁটপড়া রঙিন খানিকটা সাধারণ সুতোলি? ঘনাদা আমাদের দিকে সকৌতুক অনুকম্পার সঙ্গে তাকিয়ে বললেন, ওই সুতোর জট ক-টা পেলে, আমেরিকা এ পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে যেখানে যত ধার দিয়েছে, সব শোধ করে দেওয়া যায়। শুধু ওই গাঁটপড়া সুতোলি ক-টার জন্য গত সওয়া চারশো বছরে সওয়া চার হাজার মানুষ অন্তত প্রাণ দিয়েছে!

আমাদের এবার আর অবাক হবার ভান করতে হল না। গৌর শুধু ধরা গলায় কোনও রকমে জিজ্ঞাসা করলে, তা ওই সর্বনাশা সুতো আপনার কাছে পাঠাবার মানে?

মানে? মানে কিংকাজুর ডাক। কিংকাজু একরকম ভাম। মরণ নিশ্চিত জেনেও তার ডাক সেদিন চিনতে না পারলে এ গল্প শুনতে পেতে না। তবে ঘনাদা একটু হাসলেন। মানে ভাল করে বুঝতে হলে বারো বছর আগের ব্রেজিলের মাত্তো গ্রসোর এমন একটি জঙ্গলে যেতে হয় কোনও সভ্য মানুষ যেখান থেকে জীবন্ত কখনও ফিরে আসেনি।

সেই ভরসায় আপনি বুঝি সেখানে গেছলেন? দুম করে কথাটা বলে ফেলে শিশির একেবারে কুলের কাছে ভরাড়ুবি প্রায় করেছিল আর কী!

কিন্তু কবিরাজি কাটলেটের গুণ অনেক। শিশিরের কথা ঘনাদার যেন কানেই গেল না।

সিগারেটা একটা মোক্ষম টান দিয়ে তিনি নিজের কথাতেই মশগুল হয়ে শুরু করলেন, পাঁচটি প্রাণী আমরা প্রাণ হাতে নিয়ে সেই জঙ্গল দিয়ে চলেছি পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় একটি জাতির সন্ধানে। তাদের নাম শাভান্তে। ব্রেজিলের দুর্গমতম যে-জঙ্গলে তারা থাকে সেখানে পৌঁছতে হলে জলে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সাপ আনাকো আর কুমীর, আর রক্তখেকো পিরহানা মাছের ঝাঁকের হাত থেকে বাঁচতে হয়, আর দুর্ভেদ্য জঙ্গলের পথে যুঝতে হয় বাঘের বড় মাসি জাগুয়ার থেকে শুরু করে বিষাক্ত সাপ বিয়ে পর্যন্ত অনেক কিছুর সঙ্গে।

এসব বিপদের হাত এড়ালেই নিস্তার নেই। শাভান্তেরা দুনিয়ার সেরা ঠ্যাঙাড়ে। তীরধনুক তাদের আছে, কিন্তু গাঁটওয়ালা মোটা মোটা লাঠি দিয়ে মানুষ মারতেই তাদের আনন্দ। জঙ্গলে কোথায় যে তারা ওত পেতে আছে কিছুই বোঝবার উপায় নেই। প্রতি পদে কুড়ুল দিয়ে গাছ লতা পাতা কেটে যেখানে এগুতে হয় সেখানে বনের জানোয়ারের চেয়েও নিঃশব্দ-গতি শাভান্তেদের হদিস পাওয়া অসম্ভব।

শাভান্তেদের চাক্ষুষ দেখে ফিরে এসে বিবরণ দেবার সৌভাগ্য এ পর্যন্ত কোনও সভ্য পর্যটক কি শিকারির হয়নি। এ অঞ্চলের অন্য অধিবাসীরাও তাদের যমের মতো ভয় করে এড়িয়ে চলে। তবু তাদের কিংবদন্তি থেকেই শাস্তেদের সম্বন্ধে সামান্য যা কিছু বিবরণ এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে।

সেবার কিন্তু ঠিক বিজ্ঞানের খাতিরে শাভান্তেদের রাজ্যে ঢুকিনি। ওই অঞ্চলে দুবছর আগে সেনর বেরিয়েন নামে একজন পর্যটক নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তাঁকে খুঁজতে পরের বছর আর-একদল নিয়ে ডন বেনিটো নামে একজন বিখ্যাত শিকারিও ওই অঞ্চলে গিয়ে আর ফেরেননি। ব্রেজিল সরকারের পক্ষ থেকে এই দুজনের খোঁজ পাবার জন্য বিরাট এক পুরস্কার তখন ঘোষণা করা হয়েছে। কতকটা সেই পুরস্কারের লোভে, কতকটা অন্য এক মতলবে ছোট একটা দল নিয়ে সেই অজানা অঞ্চলে পাড়ি দিয়েছিলাম।

দলে পাঁচটি প্রাণী। তিনজন মোট বইবার কুলি বাদে আমি আর রেমরেমন্ডো। রেমরেমন্ডো আধা পতুর্গিজ, একজন ওদেশি শিকারি। ঠিক শাভান্তেদের রাজ্যে কখনও না গেলেও আশেপাশের অঞ্চলটা তার কিছু জানা ছিল বলে তাকেই পথ দেখাতে এনেছিলাম।

জানা এলাকা ছেড়ে অজানা মুল্লুকে ঢোকবার পরই কিন্তু বুঝেছিলাম, আমি যদি কানা হই তো সে চোখে দেখে না, এই অবস্থা!

রেনুরো নদীর তীরে দাঁড়িয়ে গভীর জঙ্গলের ভেতর ঢুকে তখন আমাদের দিশাহারা অবস্থা। তবু জঙ্গলের মধ্যে সামান্য একটু ফাঁকা জায়গা পেয়ে কুলিদের দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে সেদিন রাতে তাঁবু ফেলেছি। পালা করে আমি ও রেমরেমন্ডো পাহারায় থাকব—এই ঠিক হয়েছে। প্রথম রাতটা পাহারা দিয়ে সবে তাঁবুর মধ্যে দুচোখের পাতা একটু এক করেছি, এমন সময় রেমরেমন্ডোর ঠেলায় ধড়মড় করে উঠে বসতে হল।

শুনতে পাচ্ছেন, আমো! রেমন্ডো কাঁপতে কাঁপতে বললে।

কী, শুনব কী! বিরক্ত হয়ে বললাম, ও তো জংলি ম্যাকাও কাকাতুয়ার ডাক!

না, আমো, ভাল করে শুনুন! রেমরেমন্ডোর গলা দিয়ে ভয়ে কথাই বার হতে চাচ্ছে ।

মন দিয়ে এবার শুনলাম এবং সত্যই প্রথমে সমস্ত গায়ে আপনা থেকে কাঁটা দিয়ে উঠল।

ম্যাকাও-র কর্কশ ডাকের পরই ব্ৰেজিলের লাল বাঁদর গুয়ারিবাস-এর বুক কাঁপানো চিকার। তারপর সেটা থামতে না থামতেই ময়ুর জাতের পাভাস পাখির গলার ঝনঝনে ঝংকার।

রেমরেমন্ডোর দিকে চেয়ে দেখি সে ইতিমধ্যে ঘামতে শুরু করেছে।

এ অবস্থায় ঘেমে ওঠা কিছু আশ্চর্যও নয়। পাভাস পাখির ডাক বন্ধ হবার পরই জাগুয়ারের গলার ফাঁস ফ্যাঁস শোনা গেল, আর তারপরই আবার গুয়ারিবাস বাঁদরের ডাক।

আওয়াজগুলো ক্রমশ কাছেই এগিয়ে আসছে।

কী হবে, আমো! রেমরেমন্ডো মাটির ওপরই বসে পড়ল। তাকে সাহস দেব কী, নিজের অবস্থাই তখন কাহিল। তবু ধমকে বললাম, আমো আমো কোরো না। কতবার বলেছি আমি তোমার মনিব নয়, বন্ধু, আমো নয়, আমিগো।

যে আজ্ঞে, আমো বলে রেমরেমন্ডো তেমনই কাঁপতে লাগল।

বিপদের মধ্যেও না হেসে পারলাম না। তারপর আবার ধমক দিয়ে বললাম, লজ্জা করে না তোমার? তুমি না ব্রেজিলের সেরা শিকারি!

শিকারি হয়ে লাভ কী, আমো!

লাভ যে নেই তা আমিও জানতাম। এটা শাভান্তেদের শত্রু মারবার একটা কায়দা। সারারাত দল বেঁধে শত্রুকে বেড়াজাল দিয়ে ঘিরে এমনই জঙ্গলের নানা জানোয়ারের আওয়াজ করতে করতে তারা এগিয়ে আসে, আবার পিছিয়ে যায়। সারারাত শত্রুর চোখে ঘুম তো নেই-ই, প্রতি মুহূর্তেই আক্রমণের ভয়ে তটস্থ অবস্থা। এমনই করে সারারাত শত্রুর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিয়ে ভয়ে ভাবনায় আধমরা করে ভোরের দিকে শাভান্তেরা সমস্ত আওয়াজ থামিয়ে একেবারে যেন বিদায় নিয়ে চলে যায়। শত্রু তখন বিপদ কেটেছে মনে করে ক্লান্তিতে হয়তো একটু ঘুমিয়ে পড়ে। শাভান্তেরা ঠিক সেই সময়েই হানা দিয়ে তাদের গেটে লগুড় দিয়ে সব সাবাড় করে দেয়। শাভান্তেদের একটি লোকও তাতে মারা পড়ে না। শুধু ফন্দিতেই কাজ হাসিল হয়ে যায়।

বুনো জানোয়ারের ডাক ইতিমধ্যেই পিছিয়ে যেতে শুরু করেছে, টের পেলাম।

রেমরেমন্ডোকে ও সেই সঙ্গে নিজেকেও সাহস দেবার জন্য বললাম, এখুনি এত ভেঙে পড়বার কী হয়েছে। ওদের এ চালাকি তো সারারাত চলবে। ভোরে ওরা চড়াও হবার আগে পালাতে পারলেই হল।

কিন্তু পালাবেন কোথায়, আমো! আমরা মাত্র পাঁচজন, আর ওরা অন্তত পাঁচশো। পাঁচজন হলেও ওরা এমনিতে রাত্রে আক্রমণ করতে চায় না। কিন্তু পালাবার চেষ্টা করলেই ঠেঙিয়ে শেষ করে দেবে! আমাদের দুজনের দুটো বন্দুকে কটাকে ঠেকাবেন এই অন্ধকার জঙ্গলে?

রেমরেমন্ডোর কথাগুলো মিথ্যে নয়। কী বলে আপাতত তাকে শান্ত করব ভাবছি, এমন সময় জংলা আওয়াজ আবার কাছে এগুতে শুরু করল। প্রথমে টুকান পাখির চড়া গলা, তারপর জাগুয়ারের জাতভাই কুজার-এর গর্জন, আর সে-ডাক থামতেই সেই কিংকাজুর ঝগড়াটি বেড়ালের মতো ডাক।

এই ডাক শুনেই চমকে উঠে দাঁড়ালাম।

রেমরেমন্ডো সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে সভয়ে জিজ্ঞাসা করলে, কী হল, আমো?

এখুনি জানতে পারব। বলে বেরুবার চেষ্টা করতেই রেমরেমন্ডো দুহাতে আমায় জড়িয়ে প্রায় ককিয়ে উঠল, আপনি কি পাগল হলেন আমো! যাচ্ছেন কোথায়?

বেশ জোর করেই তার হাত ছাড়িয়ে কোনও উত্তর না দিয়ে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়লাম।

ঘুটঘুটে অন্ধকার যাকে বলে। দিনের বেলাতেই যেখানে চলাফেরা শক্ত, রাতের অন্ধকারে সে জঙ্গলে এক পা এগুনোই দায়। টর্চ জ্বালবার উপায় নেই বলেই সঙ্গে নিইনি। কোনওরকমে হোঁচট খেতে খেতে হাতড়াতে হাতড়াতে সেই জঙ্গল ভেদ করে চললাম।

কিংকাজুর ডাকের পর আবার গুয়ারিবাস-এর চিৎকার হতেই একটা শিস দিলাম উইরা পুরু পাখির তীক্ষ্ণ বাঁশির মতো আওয়াজ করে।

অন্যদিকের শব্দটা খানিক থেমে গেল তাইতেই।

তারপর ওদিক থেকে আবার ম্যাকাও পাখির ডাক শুরু হতেই আস্তা মানে টাপির-এর আওয়াজ শুরু করলাম।

জঙ্গল এবার একেবারে চুপ।

নিজেই আবার প্রসিওর আওয়াজ নকল করে তার উপর পাভাস পাখির গলার ঝংকার জুড়ে দিলাম।

জঙ্গলে আর কোনও শব্দ নেই। আমি কিন্তু যথাসম্ভব সাবধানে তও এগিয়ে চলেছি।

বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে যাবার পর জঙ্গল একটু ফাঁকা হতে দেখি, যা ভেবেছিলাম তাই।

একটা চিড়িয়াখানা! শিবু বোধহয় আর থাকতে না পেরেই বলে উঠল।

ঘনাদা ভুরু কুঁচকে সেদিকে তাকাতেই আমরা শিবুকে ধমকে উঠলাম, চিড়িয়াখানা! শিবুর যেমন বুদ্ধি! জঙ্গলে কখনও চিড়িয়াখানা থাকে!

ঘনাদা খুশি হলেন কি না বলা যায় না, কিন্তু তাঁর বর্ণনা আবার চলল।

বনের ওই ফাঁকা জায়গায় একটা তাঁবু। চারিদিক ঢাকা হলেও তার ভেতর থেকে জোরালো হ্যাসাক বাতির সামান্য আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। নিঃশব্দে সেই তাঁবুর পেছনে গিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ধেড়ে ইদুর কাপিবারার মতো আওয়াজ দিলাম।

তাঁবুর ভেতর থেকে বাঘের মতো গর্জন শোনা গেল, কিয়ে এস্তা আহি? অর্থাৎ, কে ওখানে?

বললাম, সয় ইয়ো! অর্থাৎ, আমি।

এবার তাঁবুটাই যেন দুলে উঠল এবং তার পর্দা সরিয়ে ছোটখাট পাহাড়ের মতো যে-লোকটি খেপে বেরিয়ে এল, অন্ধকারের মধ্যেও শুধু তার আকার দেখেই তাকে আমি তখন চিনে ফেলেছি।

সে বেরিয়ে আসতেই আমি নিঃশব্দে অন্যদিকে সরে গেলাম। টর্চ জ্বেলে সে তাঁবুর চারিদিকে ঘুরে যখন আবার ভেতরে ঢুকল তখন আমি তার জিনিসপত্র যা ঘাঁটবার ঘেঁটে দেখে তারই বিছানায় শুয়ে একটা সিগারেট ধরিয়েছি।

তাঁবুর ভেতর ঢুকে আমায় ওই অবস্থায় দেখে পাহাড় একেবারে আগ্নেয়গিরি হয়ে উঠল।

তবে রে, মুকুরা চিচিকা! মানে, পুঁচকে গন্ধগোকুল বলে সে তেড়ে আসতেই উঠে বসে বললাম, ধীরে, ধুমসো আই, ধীরে! আই হল দুনিয়ার সবচেয়ে কুঁড়ের ধাড়ি জানোয়ার ব্রেজিলের শ্লথ।

মাঝপথে থেমে সে একেবারে হতভম্ব হয়ে আমার দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে বললে, তুমি ডস্! এখানে! কী দেসিয়া উস্তেদ? মানে, কী তুমি চাও?

বিশেষ কিছু না! সেনর বেরিয়েন-এর সন্ধান করতে যে দলবল নিয়ে বেরিয়েছিল সেই বেনিটোর সঙ্গে একটু আলাপ করতে চাই। সেনর বেরিয়েন-এর কী হয়েছে, ডন বেনিটো-ই বা তাঁর খোঁজে বেরিয়ে কেন নিরুদ্দেশ, এসব খবর জানবার জন্য পৃথিবীর সবাই একটু উদগ্রীব কিনা!

আমার পাশেই সেই চার-মণী লাশ নিয়ে বসে ডন বেনিটো এবার হতাশভাবে বললে, সেনর বেরিয়েন শাভান্তেদের হাতে মারা গেছেন।

তা তো বুঝলাম, কিন্তু সে কথা জানবার পর সভ্য সমাজে না ফিরে ডন বেনিটো এই জঙ্গলের মধ্যে এখনও লুকিয়ে থাকতে এত ব্যাকুল কেন?

আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বেনিটো পালটা প্রশ্ন করে বসল এবার, তুমি আমার খোঁজ পেলে কী করে?

হেসে বললাম, তোমার একটু ঠিকে ভুলের দরুন, বন্ধু। তুমি মস্ত শিকারি। প্রত্নতত্ত্ব নিয়েও কিছু নাড়া-চাড়া করেছ, শুনেছি, কিন্তু প্রাণিবিদ্যাটায় তেমন পাকা তো নও, তাই শাভান্তেদের সঙ্গে ভাব করবার জন্য তাদের মতো হরবোলার গলা দুরস্ত করলেও একটা মস্ত ভুল করে ফেলেছ।

কী ভুল? বেনিটো বেশ খাপ্পা।

ভুল কিংকাজুর ডাক। ওই প্রাণীটি যে ব্রেজিলের এ অঞ্চলে থাকে না, সেইটি তোমার জানা নেই। শাভান্তেরা ও ডাক জানে না। ওই ডাক শুনেই বুঝলাম শাভান্তেরা নয়—অন্য কেউ ভয় দেখিয়ে আমাদের তাড়াতে চাইছে।

বেনিটোর জালার মতো মুখখানা তখন দেখবার মতো। হতভম্ব ভাবের সঙ্গে আপশোস, বিরক্ত, রাগের সেখানে একটা লড়াই চলেছে।

সে লড়াই শেষ হবার আগেই আবার জিজ্ঞাসা করলাম, কিন্তু ব্যাপার কী বলল তো? এই জঙ্গলে কোথায় সভ্য মানুষজন দেখলে খুশি হয়ে দেখা করবে, না ভয় দেখিয়ে তাদের তাড়াতে চাও?

আমি…মানে আমি… বেনিটো আমতা আমতা করে বললে, সেনর বেরিয়েনকে যখন ফিরিয়ে আনতে পারিনি তখন সভ্যসমাজে আর মুখ দেখাতে চাই না।

বটে! গম্ভীরভাবে বললাম, তুমি বিফল হবার লজ্জায় এখন অজ্ঞাতবাসই চাইছ তা হলে? ভাল কথা! কিন্তু আমাকে কি তা হলে শুধু হাতে ফিরতে হবে! ওদিকে ব্রেজিল সরকারের পুরস্কারটাও তো ফসকাচ্ছে।

কী, কী তুমি চাও? বেনিটো আমায় যে-কোনও ভাবে তাড়াতে পারলে বাঁচে বোঝা গেল।

কী চাই? যেন বেশ ভাবনায় পড়ে বললাম, এই জঙ্গলে কী-ই তোমার আছে যে দেবে?

তুমি বলো না কী চাও! ব্রেজিলের সরকার তোমায় যা পুরস্কার দিত তাই তোমায় যদি দিই, হবে? বেনিটো বেশ ব্যাকুল।

কিন্তু দেবে কী করে! এখানে অত টাকা তুমি পাচ্ছ কোথায়?

এখানে নয়, পেরুতে। এখুনি একটা চিঠি তোমায় লিখে দিচ্ছি। তুমি লিমায় গিয়ে যে-ঠিকানায় চিঠি দিচ্ছি সেখানে দেখালেই পাবে। বেনিটো আমায় রাজি করাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে বললে, আমার কথা তো বিশ্বাস করো?

খুব করি। কিন্তু অত টাকার আমার দরকার নেই। তুমি বরং…ঘরের চারিদিকে একবার চোখ ঘোরালাম।

বেনিটো অধীর হয়ে বললে, হ্যাঁ বলো, কী চাও। চাই খানিকটা সুতো! বলে ফেলে বোকার মতো চেহারা করে তার দিকে তাকালাম।

সুতো! সেই বিরাট জালার মতো মুখে মনের ভাব কি সহজে লুকোনো যায়। তবু প্রাণপণে ঠাণ্ডা থাকার চেষ্টা করে বেনিটো বললে, তুমি কি পাগল হয়ে গেছ নাকি। সুতোসুতো আবার কী?

কী আর, খানিকটা রঙিন সুতো। তা-ই হলেই আমার চলবে।

নাঃ, তোমার দেখছি সত্যি মাথা খারাপ হয়ে গেছে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে! বলে বেনিটো খুব জোরে হাসবার চেষ্টা করলে।

আমার পাগলামিতে তোমার হাসি পাচ্ছে? তা হলে আর একটা মজার গল্প বলি শোনন। পিজারোর নাম শুনেছ তো?

পিজারো? কে পিজারো? বেনিটো তামাশার সুরে বলবার চেষ্টা করলেও তার চোখ দুটোয় আর তখন হাসির লেশ নাই। ঠাট্টার সুর বজায় রেখে সে তবু বললে,

আমি তো পিজারো বলে একজনকে চিনি–আমাদের রাস্তা সাফ করত।

এ পিজাবোও এক রকমের ঝাড়ুদার, তবে প্রায় সওয়া চারশো বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকার পেরু সাফ করে দিয়ে গেছে।

ও, তুমি কংকিসতাপদার বীর পিজারোর কথা বলছ! বেনিটো যেন এতক্ষণে আমার কথা বুঝল, স্পেনের হয়ে যিনি পেরু জয় করেছিলেন!

হ্যাঁ, বিশ্বাসঘাতকতাকে যদি জয় করা বলল, খুনি আর শয়তানকে যদি বলো বীর।

খাঁটি ইস্পাহানি না হলেও এ কথাগুলো বেনিটোর খুব মধুর লাগল না, তবু নিজেকে সামলে সে বললে, তা—পিজারোর উপর যত খুশি গায়ের ঝাল ঝাড়ো। কিন্তু তার গল্প আমায় কী শোনাবে?

শোননই না। হয়তো প্রাণ খুলে হাসবার কিছু পাবে। পেরুর রাজাদের নাম যে ইংকা তা তোমায় বলবার দরকার নেই। পেরুর শেষ স্বাধীন ইংকা আতাহুয়ালপা কাজামারকা (Cajamarca) শহরে সরল বিশ্বাসে পিজারো আর তার একশো তিরাশি জন অনুচরকে অভ্যর্থনা করেন। সেই সাদর অভ্যর্থনার প্রতিদানে পিজারো চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে কৌশলে ইংকা আতাহুয়ালপাকে বন্দী করে। মুক্তির দাম হিসেবে ইংকা সোনা রুপোয় প্রায় কুবেরের ভাণ্ডার পিজারোকে দেন। সে সমস্ত নিয়েও পিজারো ইংকা আতাহুয়ালপাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। মানুষের ইতিহাসে সেই কলঙ্কিত তারিখ হল ১৫৩৩-এর ২৯শে নভেম্বর।

এই পর্যন্ত শুনেই বেনিটো ধৈর্য হারিয়ে বললে, তোমার সব কথা সত্যি নয়, তবু এ ইতিহাস পৃথিবীর কে না জানে!

সবাই যা জানে না তা-ই একটু তা হলে বলি। পেরুর শেষ ইংকার কাছ থেকে বিশ্বাসঘাতকতা করে পিজারো সোনাদানা যা নিয়েছিল, তা বিরাট দীঘির একটা গণ্ডুষ মাত্র। পেরু তখন সোনায় মোড়া বললেও বেশি বলা হয় না। ইংকারা নিজেদের সূর্যের সন্তান বলত, আর সোনাকে বলত সূর্যের চোখের জল। সোনায় তারা থালাবাটি ঘটি গয়না থেকে বড় বড় মূর্তিই শুধু তৈরি করত না, তাদের মন্দিরের মেঝেও হত সোনা দিয়ে বাঁধানো। কুজকো শহরের সূর্যমন্দিরের চারিধারে বর্ষার জলের নর্দমাগুলোও ছিল সোনার পাত নয়, তাল দিয়ে তৈরি। আর রুপো তো তখন এমন সস্তা যে কংকিসতাদের মানে পিজারোর বিজয়ী সৈনিকেরা তাই দিয়ে ঘোড়ার নাল বাঁধাত। পিজারো সোনার লোভে ইংকাকে আগেই মেরে না ফেললে আরও কত সম্পদ যে পেত কেউ ধারণাই করতে পারে না। কারণ কুজকো শহর থেকে ইংকা পুরোহিতেরা আতাহুয়ালপার মুক্তির জন্য আরও রাশি রাশি সোনার জিনিস তখন কাজামারকাতে পাঠাবার আয়োজন করছে। ইংকার হত্যার খবর পাবার পরই তারা পিজারোর আসল স্বরূপ বুঝে সে সোনাদানা সব লুকিয়ে ফেলে। কুজকো শহরই সোনার খনি জেনে পিজারো সে শহর লুণ্ঠন করেও তার আসল গুপ্ত ভাণ্ডারের সন্ধানই পায়নি। প্রধান ইংকা পুরোহিত ভিল্লাক উমু সেই সমস্ত ভাণ্ডারের এমন ভাবে হদিস রেখে দেন, ইস্পাহানিদের পেরু থেকে তাড়াবার পর যাতে সেগুলো উদ্ধার করা যায়। ইংকাদের কোনও লিখিত ভাষা ছিল না। তাঁরা যে ভাষায় কথা কইতেন তার নাম কেচুয়া। প্রধান পুরোহিত তাঁর সংকেত-চিহ্ন তাই ভাষার অক্ষরে লিখে যাননি। তিনি সংকেতগুলি যাতে রেখে গিয়েছিলেন তাকে বলে কিপু।

বেনিটো কী কষ্টে যে স্থির হয়ে আছে বুঝতে পারছিলাম। সে এখন হালকা সুরে বলবার চেষ্টা করলে, তোমার ও কিপু-মিপু শুনে হাসি তো আমার পাচ্ছে না!

পাচ্ছে না? তা হলে আর একটু শোনো। প্রধান পুরোহিতের পর এই সব কিপু দ্বিতীয় পুরোহিতের হাতেই পড়ে। তারপর পুরোহিত-বংশই শেষ হয়ে যাবার সঙ্গে, সেসব কিপু কোথায় যে হারিয়ে যায় কেউ জানে না। শেষ ইংকা আতাহুয়ালপার এক ভাইপো গার্সিলাসোদ্য লা ভেগা সারা জীবন সেসব কিপু খুঁজেছেন, কিন্তু পাননি। শুধু সম্প্রতি এখান ওখান থেকে কয়েকটা টুকরো কিপু উদ্ধার হয়েছে। কিন্তু মুশকিলের কথা এই যে কিপুর সংকেত-চিহ্ন পড়বার লোক পৃথিবীতে প্রায় নেই বললেই হয়।

বেনিটোর ধৈর্যের বাঁধ আর রইল না। রাগে উত্তেজনায় সে গর্জন করে উঠল এবার, কী তুমি বলতে চাও, কী? এ-গল্প আমায় শোনাবার মানে?

মানে এই যে পৃথিবীর দু-তিনটি মাত্র লোক এখনও কিপুর সংকেত-চিহ্ন বুঝতে পারেন, সেনর বেরিয়েন তাঁদের একজন। তাঁর শরীরে ইংকাদের রক্তও কিছু আছে। সারা জীবন শুধু পেরুতে নয়, কলম্বিয়ায়, ইকোয়েডরে, চিলিতে, বলিভিয়ায় ও ব্রেজিলে তিনি হারানো কিপু সন্ধান করে বেড়িয়েছেন। সংগ্রহও করেছেন কিছু। তাঁর শেষ সন্ধান এই মাত্তো গ্রস্সাের জঙ্গলে। পেরু স্পেনের কবলে যাবার পর ইংকাদের একটি শাখা টিটিকাকা হ্রদ পেরিয়ে প্রথমে বলিভিয়ায় ও পরে সেখান থেকে ব্রেজিলের এই অংশে এসে রাজ্য গড়বার চেষ্টা করে বলে কিংবদন্তী আছে। কুজকোর গুপ্ত ভাণ্ডারের সংকেত দেওয়া সবচয়ে দামি কিপু নাকি এই ইংকারাই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। সেনর বেরিয়েন এই কিপুর খোঁজেই এই দুর্গম জঙ্গলে এসেছিলেন। এবং আমি নিশ্চিত জানি যে তা তিনি পেয়েও ছিলেন।

তুমি নিশ্চিত জানো—বেনিটো একেবারে মারমূর্তি—হাত গুনে নাকি?

একটু হেসে হাতের মুঠোটা তার সামনে খুলে ধরে বললাম, হাত গুনে নয়, হাতের মুঠোয় ধরে–

আমার হাতের দিকে চেয়ে বেনিটোর জালার মতো মুখের ভাঁটার মতো চোখদুটো এয় ঠেলে বেরিয়ে আসে আর কী?

তার এই অবস্থা যেন দেখেও না-দেখে নিতান্ত ভাল মানুষের মতো বললাম, এই জন্যই তোমার কাছে একটি রঙিন সুতো মানে এই কিপু চাইছিলাম। এইটে পেলেই খুশি মনে আমি চলে যাই, তুমিও পরমানন্দে জঙ্গলে অজ্ঞাত বাস করো।

এতক্ষণে সেই মাংসের পাহাড় সত্যিই আগ্নেয়গিরি হয়ে উঠল। তবে রে কালা নেংটি কুটিয়া! বোড়ার রাজা আনাকোণ্ডার গর্তে এসেছ চুরি করতে! বলে সেই চার-মণী লাশ আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। একটু গা-ঝাড়া দিয়ে দেখি–

তাঁবুর কাপড় ছিঁড়ে সেই মাংসের পাহাড় বাইরে ছিটকে পড়ে খাবি খাচ্ছে–গৌরই ঘনাদার কথাগুলো জুগিয়ে দেবার চেষ্টা করলে।

ঘনাদা একটু ভুরু কুঁচকে বলে চললেন, না, দেখি আমিই তাঁবুর কোণে দড়ি-দুড়ার মধ্যে থুবড়ে পড়েছি। গা ঝাড়া দিয়ে ওঠবার পর বেনিটোর সে কী গর্বের হাসি, তারই সঙ্গে আবার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতো জ্বালা ধরানো কথার চিমটি, কী, ডস। প্যাঁচটা লাগল কেমন? বড় জব্দ করেছিলে আর বারে, তাই হরবোলা গলা সাধার সঙ্গে যুযুৎসুটাও শিখেছি।

তার হাসি থামাতে নিজেই এবার ঝাঁপিয়ে পড়লাম তার ওপর। কিন্তু আবার মাটি নিয়ে তার বিদ্রুপ শুনতে হল, জাপানি কুস্তি সুমোও শিখতে ভুলিনি, বন্ধু।

তার হাসি কিন্তু মাঝপথেই গেল বন্ধ হয়ে। মাটিতে পড়ে তখন সে গোঙাচ্ছে। গলাটায় আর একটু চাপ দিয়ে বললাম, সবই শিখেছ, শুধু এই বাংলা কাঁচিটাই শেখোনি। এখন বলল এ-কিপু কোথায় তুমি পেয়েছ? সেনর বেরিয়েনকে খোঁজার নাম করে এসে তাঁকে কোন ছলে মেরে এ-কিপু বাগিয়েছ—কেমন?

জবাবে তার মুখ থেকে একটু কাতরানির মতো আওয়াজ বেরুল মাত্র, না, না।

পায়ের ফাঁস একটু আলগা করতে বেনিটো ককিয়ে উঠল, হলফ করে বলছি, সেনর বেরিয়েন মারা যাবার আগে এ-কিপু আমায় দিয়ে গেছেন। তাঁর নিজের হাতে লেখা প্রমাণ আমি দেখাচ্ছি।

তাকে ছেড়ে দিয়ে বললাম, বেশ, দেখাও সে প্রমাণ। বাংলা কাঁচি দেখেছ, কোনও চালাকি করবার চেষ্টা করেছ কি একেবারে বাংলা তুড়ুম ঠুকে দেব।

মানে বুঝুক আর না বুঝুক চালাকি করবার উৎসাহ আর তখন বেনিটোর নেই। নিজের ঝোলা থেকে সত্যিই সে একটা আধময়লা চিঠি বার করে দেখালে। সেনর বেরিয়েনের হাতের লেখা আমার চেনা। দেখলাম তিনি সত্যিই তাঁর মৃত্যুশয্যায় বেনিটোর সেবার প্রশংসা করে তার হাতে কিপুটা দেওয়ার কথা লিখেছেন।

চিঠিটা তাকে ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, কিপুটা যখন সেনর বেরিয়েন নিজেই তোমায় দিয়েছেন, তখন সেটা নিয়ে তোমার এমন লুকিয়ে থাকার মানে কী?

বেনিটোর মুখ দেখে মনে হল পারলে মানেটা সে আমার গলা টিপেই বুঝিয়ে দেয়। কিন্তু পরিণাম ভেবেই বোধহয় নিজেকে সামলে সে চুপ করেই রইল।

হেসে আবার বললাম, মানেটা তাহলে আমিই বলি। এ-কিপু সেনর বেরিয়েন তোমাকে দান করেননি। নিজের মৃত্যুর পর এটা পেরুর সরকারি মিউজিয়মে পৌঁছে দেবার জন্য তোমার হাতে দিয়েছিলেন। তুমি এখন এই কিপুর অর্থ নিজে বার করে কুজকোর গুপ্তধন একলা বাগাতে চাও। এখনই সভ্য জগতে ফিরে গেলে তোমার গতিবিধি পাছে কেউ সন্দেহ করে, তাই তুমি কিপুর সংকেত-চিহ্ন না বুঝতে পারা পর্যন্ত এই জঙ্গলেই লুকিয়ে থাকার ব্যবস্থা করেছ। আমাদের ভয় দেখিয়ে তাড়াবার চেষ্টাও করেছিলে সেই জন্য।

তাই যদি করে থাকি তাতে দোষ কী? প্রাণের মায়া ছেড়ে এ-কিপু আমি সন্ধান করেছি। এ-কিপু আজ যখন আমার হাতে এসেছে তখন সে-গুপ্তভাণ্ডারের দখল আমি অন্য কাউকে দেব কেন?

হেসে বললাম, কিন্তু গুপ্তধন পাওয়ার আগে এ-কিপুর মানে তো বোঝা চাই। এ তো কয়েকটা গেরো দেওয়া রঙিন সুতোর জট মাত্র! ইংকাদের সাম্রাজ্য যাওয়ার সঙ্গে এই সুতোর গিটের সংকেত-চিহ্ন পড়বার বিদ্যাও প্রায় হারিয়ে গেছে। গুপ্তধনের লোভে তুমি সামান্য যা কিছু শিখেছ তা দিয়ে সারা জীবন চেষ্টা করলেও এর মানে খুঁজে পাবে না। সুতরাং এ-কিপু আমিই নিয়ে যাচ্ছি।

না, না! বেনিটো প্রায় কেঁদে উঠল, আমায় শুধু দুবছর সময় দাও। দুবছরে এ-কিপুর মানে যদি আমি না বুঝতে পারি তা হলে তোমাকেই এ-কিপু আমি পাঠিয়ে দেব।

ঘনাদা থামলেন।

তা হলে মানে বুঝতে না পেরেই এতদিনে সে সুতোটা আপনার কাছে পাঠিয়েছিল! কিন্তু দুবছর বাদেই পাঠাবে কথা ছিল না? শিশির সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করলে।

হ্যাঁ, কথা তা-ই ছিল। কিন্তু আমার ঠিকানা তো পাওয়া চাই। ঘনাদা শিশিরের নির্বুদ্ধিতায় যেন একটু বিরক্ত, কত মুল্লুক ঘুরে তবে ঠিকানা পেয়েছে কে জানে! দেরি হয়েছে তাইতেই।

কিন্তু সুতো সমেত চিঠিটাই যে এখন লোপাট। তাহলে উপায়? শিবু প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, ও-কিপুর মানেও তাহলে আর জানা যাবে না, গুপ্তধনও উদ্ধার হবে না।!

গুপ্তধন অনেক আগেই উদ্ধার হয়েছে! ঘনাদা আমাদের প্রতি একটু অনুকম্পার হাসি হেসে বললেন, আমি কি দুবছরের পরেও ঘুমিয়ে ছিলাম! পেরুর লিমা শহরে প্লাজা দস দে মেয়োর কাছে সরকারি মিউজিয়ামে গেলেই দেখতে পাবে, কিপু-তে যার সংকেত দেওয়া ছিল সে সমস্ত দুর্লভ সোনার জিনিস একটি আলাদা ঘরে সাজানো।

তার মানে? গৌর হতভম্ব হয়ে বললে, আপনি কিপ পড়তে পারেন। সেই রাতেই তার মানে বুঝে নিয়ে আপনি মুখস্থ করে ফেলেছিলেন।

ঘনাদা এ প্রশ্নের উত্তর দিতেই যেন ঘৃণা বোধ করে শিশিরের পুরো সিগারেটের টিনটা তুলে নিয়ে পকেটে ফেললেন।

নীচে নেমে শিশিরকে না জিজ্ঞেস করে পারলাম না, আচ্ছা, ইনসিওর করা চিঠিটা কি আমাদের বানানো, না সত্যি এসেছিল?

শিশির চিন্তিত মুখে বলল, তা-ই তো ভাবছি।

হাঁস

গৌর শিশির শিবুনয়, এ একেবারে বুনো বাপি দত্ত। যেমন গোঁয়ার তেমনই ষণ্ডা।

এহেন লোককে মেসে নতুন জায়গা দিয়ে কী ভুলই হয়েছে সেদিন রাত্রে হাড়ে-হাড়ে বুঝে আমরা সবাই ইষ্টদেবতা স্মরণ করতে লাগলাম।

কুরুক্ষেত্রের বুঝি আর বাকি নেই। বিরাট-পর্ব শুরু হয়ে গেছে। এথম বোমা ফেটেছে।

বোমাটা ফাটল রাত্রের খাওয়া-দাওয়ার পর।

খাওয়া-দাওয়াটা বেশ ভালই হয়েছিল। মফস্বলে যাদের বাড়ি তাদের কল্যাণে শুক্রবার রাত্রের খাওয়াটা আজকাল এই রকমই হয়। শুক্রবারের পর শনিবার হাফ । হলিডেতে তাঁরা সকাল সকাল বাড়ি যান আর ফেরেন সেই সোমবার সকালে। রবিবারের খ্যাঁটটার অভাব শুক্রবারের রাত্রের ভোজ দিয়েই তাঁরা তাই উশুল করে নেন।

মফস্বলীদের মধ্যে বাপি দত্ত একজন। সাঁটিয়েদের ভেতরও।

তিনবারের জায়গায় চারবার চেয়ে খেয়ে যেভাবে সে পাত চাটছিল ঘনাদা দেখলে বোধহয় ঈর্ষান্বিত হতেন। তাঁদের খাওয়ার রেষারেষির পাল্লায় ঠাকুর চাকরের জন্য কিছু থাকত কিনা সন্দেহ। কী ভাগ্যি ঘনাদা আজ শরীর খারাপ বলেনা, না-খেয়ে নয়—আগেই খেয়ে দেয়ে তাঁর ঘরে চলে গেছেন।

পেতলের থালাটা মাজবার দায় থেকে লছমনিয়াকে প্রায় নিষ্কৃতি দিয়ে নিজের হাত চুষতে চুষতে বাপি দত্ত বললে, বাঃ চমৎকার!

তা মাংসটা সত্যিই অপূর্ব রান্না হয়েছিল।

আঙুল চোষা শেষ করে ঝকঝকে থালাটার দিকে একবার যেন করুণ ভাবে চেয়ে বাপি দত্ত বললে, কেমন, আমি বলি কিনা যে মাংস খেতে হয়তো হাঁসের। ও মুরগি বলো আর পায়রা বলল হাঁসের কাছে কিছু না! যদি জাত বিগড়ি হাঁস হয়।

কেন, উটপাখি হলে মন্দ কী! শিব একটু ফোড়ন কাটল।

উটপাখি! উটপাখি আবার খায় নাকি? বাপি দত্তর বুদ্ধিটা চেহারার-ই মাপসই।

খেলে দোষ কী! একটাতে তোমারও কুলিয়ে যায়। অন্যদের জন্যেও মাংসের হাঁড়িতে টান পড়ে না। শিবু উৎসাহ দিলে।

একটু যেন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বাপি দত্ত বললে, না না, উটপাখি খাওয়াই যায় না, আর তাছাড়া হাঁসের তুলনা নেই—আসল বিগড়ি হাঁস। হাঁস আবার চেনা চাই।

কথাটা বলেই বাপি দত্তর কী যেন মনে পড়ে গেল। ঠাকুরকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলে, আজ হাঁস কিনে আনল কে, ঠাকুর?

ঠাকুর আমাদের ভালমন্দ বাজার করে। সে কিন্তু সামনে এলেও নীরবেই দাঁড়িয়ে রইল।

কই, কে কিনে এনেছে বললে না, তুমি? আজ্ঞে না, বাবু!

সে আমি জানতাম! বাপি দত্ত গর্বের হাসি হাসল। এ হাঁস চিনে আনা তোমার কর্ম নয়। কিন্তু কিনে আনল কে?

আজ্ঞে, কিনে আমরা কেউ আনিনি।

তোমরা কেউ আনননি! তাহলে বিগড়ি হাঁস কি নিজে থেকে উড়ে এসে তোমাদের হাঁড়িতে ঢুকল নাকি! ন্যাকামি কোরো না। বলো!

আজ্ঞে, আপনিই কিনে এনেছেন! ঠাকুরকে সভয়ে বলতেই হল।

আমি কিনে এনেছি! খানিকক্ষণ বাপি দত্তর মুখ দিয়ে আর কথা সরল না। তারপর আমরা টের পেলাম, পলতেয় আগুন লেগেছে। আমি মানেকাল বাড়িতে নিয়ে যাব বলে আমি যে কটা হাঁস কিনে রেখেছি, তা-ই কেটে রান্না হয়েছে! তাই তোমরা সবাই মিলে ফুর্তি করে খেয়েছ আর আমায় খাইয়েছ!

ঘরে কী বলে—আধুনিক কবিতার মতো—শিশির পড়লে শোনা যায়।

এইবার বোমা ফাটল।

কে? কে আমার হাঁস কেটেছে? কার এই শয়তানি আমি শুনতে চাই।

আমাদের চোখ যার যার থালার ওপর। কিন্তু উত্তর না দিলে ঠাকুরের নিস্তার নেই।

আজ্ঞে, বড়বাবু কেটেছেন।

বড়বাবু! বড়বাবু! বড়বাবু মানে তোমাদের সেই শুটকো মর্কট গেজেল চালিয়াৎ ঘনাদা!

হে ধরণী দ্বিধা হও—আমরা তখন ভাবছি।

কিন্তু ভাববার সময়ও পাওয়া গেল না।

সকড়ি হাতে এঁটো মুখ না ধুয়েই বাপি দত্ত তখন সিঁড়ি দিয়ে রওনা হয়েছে ওপরে! আমাদের ছুটতে হল পেছনে।

আরে শোনো! শোনো, দত্ত।

কে কার কথা শোনে।

ছাদ পর্যন্ত পৌঁছোবার আগেই শুনতে পেলাম ঘনাদার ঘরের দরজা সারা পাড়াকে সজাগ করে সশব্দে আর্তনাদ করছে। বর্মা নয়, সি-পির সামান্য সেগুন কাঠ। তার আর কতটুকু জান!

বাপি দত্তকে এখন সামলানো বুনো মোষের মওড়া নেওয়ার চেয়েও শক্ত। তবু মরিয়া হয়ে তাকে ধরতে যাব এমন সময় দরজা ভেতর থেকেই খুলে গেল।

কী ব্যাপার! ঘুম চোখে যেন সদ্য বিছানা থেকে উঠে এসে হাই তুলে ঘনাদা বললেন, এত রাত্রে দরজায় টোকা কেন?

টোকা শুনেই বোধহয় বাপি দত্ত কাত। পাড়ার লোক যে আওয়াজে ডাকাত পড়ার ভয়ে এতক্ষণে হয়তো লালবাজারে ফোন করেছে তার নাম টোকা!

কিন্তু ভেতরের বারুদ তখনও জ্বলছে। বাপি দত্ত গর্জন করে উঠল, কেন, আপনি জানেন না! কে আমার হাঁস কেটেছে?

আমিই কেটেছি। ঘনাদা নির্বিকার।

আপনিই কেটেছেন তা আমি জানি। নইলে এত বড় আস্পর্ধা কার হবে। কিন্তু কার হুকুমে কোন সাহসে আপনি আমার হাঁস কেটেছেনবাড়ি নিয়ে যাব বলে বাছাই করে কেনা আমার চার চারটে হাঁস!

চারটে তো মোটে! ঘনাদা যেন দুঃখিত।

ওঃ, চারটে হাঁস কিছু নয় আপনার কাছে! বাপি দত্ত আগুন।

কিছুই নয়। এ পর্যন্ত কেটেছি বারোশো বত্রিশটা। আরও কত যে কাটতে হবে কে জানে! ঘনাদা তাঁর খাটের দিকে বিষণ্ণ ভাবে পা বাড়ালেন। আমরাও সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু তখুনি থামতে হল।

যাচ্ছেন কোথায়? বাপি দত্ত হুংকার দিয়ে উঠল, আপনার ওসব গুল আমার কাছে ঝাড়বেন না। ওসব চালাকি আমি সব জানি।

জানো! ঘনাদা যেন অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ফিরে দাঁড়ালেন। জানো গারুসেরচ কাকে বলে!

কী বললেন! বাপি দত্ত ক্ষিপ্ত।

ঙগারুসেরচঙ্‌! তুমি নয়, হাঁসের নাম। ঘনাদা আশ্বস্ত করলেন, জানো, তিনশো সেরা শিকারি দুনিয়ার সমস্ত জলা জঙ্গলে এই হাঁস খুঁজে ফিরছে? জানো, একটা হাঁসের জন্য গলায় গলায় যাদের ভাব এমন দু-দুটো রাজ্য এ ওর গলা কাটতে পারে? জানো একটা হাঁসের পেট কেটে এই কলকাতা শহরটা কিনে নিয়েও যা থাকে, তাতে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ইজারা নেওয়া যায়!

এই শেষের কথাতেই বাপি দত্ত কাবু। তবু গলাটা চড়া রেখেই শুধোল, কী আছে সে হাঁসের পেটে? হিরে, মানিক?

হিরে মানিক! ঘনাদা অবজ্ঞার হাসি হাসলেন, এই বুদ্ধি না হলে হাঁস শুধু এতকাল খেতেই কেনো!

কী আছে তা হলে? বাপি দত্ত এবার উদগ্রীব।

কী আছে? ঘনাদা জুত করে নিজের খাটের ওপর বসলেন। আমরাও যেখানে যেমন পারলাম বসলাম। শিশির সদ্য খাওয়া থেকে উঠে এসে সিগারেটের কৌটোটা আর সঙ্গে আনতে পারেনি। তার দিকে একটু ভৎসনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘনাদা গম্ভীর ভাবে বললেন, আছে একটা নস্যির কৌটো।

নস্যির কৌটো! আমি ভাবছিলাম কলকে বুঝি কিছুর! বাপি দত্তর বিদ্রুপে কিন্তু আর তেজ নেই। খাটের ধারেই সে-ও জায়গা নিয়েছে।

ঘনাদার মুখে তীব্র ভ্রুকুটি দেখা গেল। রাত তো অনেক হয়ে গেল, এখন শুতে গেলে হয় না। তিনি হাই তুললেন।

আমরা সন্ত্রস্ত, বাপি দত্ত নাছোড়বান্দা। নস্যির কৌটো কেন? চার চারটে হাঁসের শোক সে প্রায় ভুলেছে মনে হল।

কেন? উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালের জুলাই মাসের সতেরোই তারিখে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু মালভূমিতে তুষারঝড়ে পথ হারিয়ে মরতে বসেছিলাম বলে, দুনিয়ার সেরা শয়তান ফন ব্লুল সদলবলে নেকড়ের পালের মতো আমার পিছু নিয়েছিল বলে, প্রাণ যায় যাক, মান বাঁচাবার আর কোনও উপায় ছিল না বলে, যোল হাজার দশ ফুট উঁচু গুরলা গিরিদ্বারের তিন মাইল সোজা খাড়াই-এর পথে ভূত দেখেছিলাম বলে, আর বন্দুকের শেষ গুলিতে চাঙ্গু-টাকে মারতে পেরেছিলাম বলে!

বাপি দত্তের মুখের হাঁটা আমাদের সকলের চেয়ে বড়।

কোনওরকমে হাঁ বুজিয়ে সে জিজ্ঞাসা করলে, ভূত! ভূতের নাম চাঙ্গু? সেই ভূত গুলিতে মারলেন!

ভূত নয়, মারলাম চাটাকে। চাঙ্গু হল ও অঞ্চলে নেকড়ে বাঘের নাম। ঘনাদা যেন ক্লান্তভাবে একটু থেমে আবার বললেন, তোমরা তো হাত মুখও ধোওনি দেখছি।

হাত মুখ! বাপি দত্তই সবাই আগে রুমাল বার করে হাত মুখটা চটপট মুছে ফেলে বললে, নেমন্তন্ন খেতে এসেছি মনে করলেই হয়! হ্যাঁ, তারপর শুনি।

তারপর নয়, তার আগে। ঘনাদা শুরু করলেন, কৈলাসটা চক্কর দিয়ে মানস সরোবর আর রাক্ষসতাল হয়ে টাকলাকোটে এসে তখন আটকে গেছি। টাকলাকোট ভারতে আসতে তিব্বতের শেষ গ্রাম। তার পরই বিপুলেখ গিরিদ্বার হয়ে ভারতে নামতে হয়। টাকলাকোটে এসেই শুনলাম বিপুলেখ গিরিদ্বার বরফ পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে। পারাপার হওয়া মানুষের অসাধ্য! অসময়ে আসার দরুন এধরনের বিপদ যে হতে পারে তা অবশ্য আগেই জানতাম। মানস সরোবরের যাত্রীদের মরশুম অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। খাস তিব্বতিরাও এ অসময়ে শীত কাটাবার জন্যে তৈরি হয়ে গাঁ থেকে নড়ে না। টাকলাকোটের মোড়ল জানালে শীতটা আমায় তাদের গাঁয়েই কাটাতে হবে। আপত্তি করলাম না। কাছাকাছি দেখবার শোনবার অনেক কিছুই আছে। দশ বারো মাইলের মধ্যে সিম্বিলিঙ গুম্ফা, খেচরনাথ গুফা তো বটেই, তাছাড়া কিছুদূরে গেলে এ অঞ্চলে এখনও নাকি ডং পাওয়া যেতে পারে। আর ডং যদি না মেলে তো গোয়া কি চো কি না আঁধিয়ান পেলেই বা মন্দ কী?

শিবুর কাশির শব্দে ঘনাদা থামলেন। গৌর বললে, এই সবে একপেট খেয়ে আসছি কিনা। মাথাটা কী রকম ঝিমঝিম করছে!

একটু ভ্রূকুটি করে ঘনাদা বললেন, ও, মাথায় ঢুকছে না বুঝি! আমারই দোষ। তিব্বতের কথা বলতে সেখানকার ভাষাই এসে যায়। গোয়া আর চো হল ছোট আর বড় দু-জাতের তিব্বতি হরিণ আর না আঁধিয়ান হল সেখানকার বুনো ভেড়া।

আর ডং বুঝি গাধা! উংকি থেকে? বাপি দত্ত সোৎসাহে শুধোলে।

আরে না! ডং গাধা হবে কেন? ঘনাদা যেন বিশেষ তাৎপর্যের সঙ্গে বাপি দত্তের দিকে তাকালেন। ডং হল বুনো চমরি গাই। খুব কমই পাওয়া যায় আজকাল।

হ্যাঁ, টাকলাকোটে থাকি আর এদিক সেদিক বন্দুক নিয়ে শিকারে বেরোই! শীতটা সেবার একটু আগেই পড়েছিল। যেদিকে যাই শুধু তুষার আর তুষার। জন্তু জানোয়ারও সব শীতের ভয়ে আগেই নীচে নেমে গেছে বোধহয়। বেশির ভাগ দিন শুধু হাতেই ফিরতে হয়।

এর মধ্যে একদিন খেয়াল হল এই শীতের দিনে গিরিদ্বার থেকে আর-একবার কৈলাস আর মানস সরোবর দেখব। ভারতবর্ষ থেকে যেতে এই গুরলা গিরিদ্বার পার হবার সময়ই প্রথম কৈলাস আর মানস সরোবরের দর্শন পাওয়া যায়।

মোড়ল মানা করলে। গুরলা গিরিদ্বার এখন বরফে মানুষের অগম্য। তা ছাড়া আকাশের লক্ষণও নাকি ভাল নয়। তবু কে কার কথা শোনে। বারফু পর্যন্ত বারো মাইল এক রকম নির্বিঘ্নেই গেলাম, তারপর কিছুদুর যেতে না যেতেই কোথায় আকাশ কোথায় মাটি আর খেয়াল রইল না। তিব্বতের তুষারঝড় যে কী বস্তু যে নিজের চোখে দেখেছে তারও বর্ণনা করতে ভাষায় কুলোবে না। একেবারে প্রলয় কাণ্ড! ছেড়া ঘুড়ির মতো সে ঝড়ে কখনও শূন্যে কখনও মাটিতে পাক খেয়ে—কোথা গিয়ে যে পৌঁছোলাম, জানি না। হাত-পাগুলো যে আস্ত আছে তাইতেই তখন অবাক।

শিবুর কাশিটা নিশ্চয়ই ছোঁয়াচে। এবার গৌর শিশির দুজনে কাশি চাপতে গিয়ে বিষম খেয়ে কেলেঙ্কারি। ঘনাদার আগে বাপি দত্তই বিরক্ত হয়ে উঠল-কী সব কেশো রুগি এখানে জুটেছে। হাসপাতালে গেলেই তো পারো।

কাশির রেশ মেলাবার আগেই ঘনাদা আবার ধরলেন, কিন্তু অবাক হওয়ার তখনও বাকি আছে। তুষারঝড় যেমন হঠাৎ খেপে ওঠে তেমনই হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়। গা ঝেড়ে ঝুড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দেখি, চেনা কোনও কিছুই চোখে পড়ছে না। এক-একটা বড় বড় পাহাড় ছাড়া সবই যেন নতুন। তিব্বতের তুষার-তেপান্তরে হারিয়ে যাওয়া মানে যে কী আমার চেয়ে ভাল করে আর কে জানবে। দশ দিন দশ রাত হেঁটে, মানুষের আস্তানা খুঁজে পাওয়া অসাধ্য। আর দশ দিন দশ রাত টিকলে তো! সঙ্গে তো মাত্র দিন দুয়েকের রসদ ছিল, তাও ঝড়ে কোথায় গেছে ছড়িয়ে আছে শুধু হাতের বন্দুকটি। তবু যতক্ষণ খাস ততক্ষণ আশ। যে-কোনও দিকে যাবার চেষ্টা করতেই হবে। পা বাড়াতে গিয়ে হঠাৎ চমকে উঠলাম।

ঝড়ের ঝাঁকানিতে শেষে মাথাই খারাপ হয়ে গেল নাকি! নইলে এ অদ্ভুত ব্যাপার কী করে সম্ভব?

সেই জনমানবহীন ধুধু তুষার-প্রান্তরে বিশুদ্ধ ফিনিস ভাষায় কে ডাকছে—কে আছ কোথায়? কাছে এসো, আমার কথা শুনে যাও।

গায়ে কাঁটা দিয়ে শিরদাঁড়াটার ভেতর শিরশির করে উঠল। যে দিকে চাই কোথাও মানুষ দূরে থাক, একটা কাক পক্ষীও তো নেই।

খানিক চুপ করার পর আবার সেই ডাক এল। এবার ফরাসিতে।

নিজের গায়ে চিমটি কাটলাম। সাতানব্বই হাজার সাতশো সাতান্নকে একাশি হাজার নশো বাইশ দিয়ে গুণ করলাম মনে মনে। না, মাথা তো খারাপ হয়নি একেবারে। এ অশরীরী আওয়াজ তা হলে কেমন করে শুনছি?

আবার সেই ডাক। এবার ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে। আশ্চর্য, এ গলা যে খানিকটা চেনাই মনে হচ্ছে। কিন্তু তাই বা কী করে হতে পারে! সাত বছর বাদে এ গলা তো শোনবারই কথা নয়!

মিনিট কয়েক থেমেই ঘুরে ঘুরে সেই ডাক আসছে। যেদিক থেকে ডাকটা আসছিল সেই দিকেই এবার গুটি গুটি এগুলাম। কোথাও কোনও একটা ছায়া পর্যন্ত নেই। শুধু থেকে থেকে ওই আওয়াজ।

খানিক দূর গিয়েই একেবারে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ঝুরো তুষারে অর্ধেক প্রায় ঢাকা একটা মানুষের দেহ।

এ কী! এ যে সত্যই ড. ক্যালিও—ফিনল্যান্ডের বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক। সাত বছর আগে সিনকিয়াং থেকে তিব্বতে যাবার পথে দস্যুদের হাতে যিনি মারা পড়েছেন বলে সবাই আমরা জানি। তাঁর তিব্বতে যাওয়ার খেয়াল নিয়ে তখন লেখালেখিও হয়েছিল অনেক কাগজে।

এবার ব্যাকুলভাবে সেখানে বসে পড়ে ড. ক্যালিওর দেহটা পরীক্ষা করলাম। না, সাত বছর আগে মারা না পড়লেও অন্তত সাত দিন আগে যে তিনি মারা গেছেন এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। বরফের দেশ বলে দেহটা তেমন বিকৃত হয়নি। পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ রাসায়নিকের এর চেয়ে বুঝি সাত বছর আগে দস্যর হাতে মারা যাওয়াই ভাল ছিল। এই তুষার প্রান্তরে তিল তিল করে মরতে কী কষ্টই না পেয়েছেন, কে জানে।

পর মুহূর্তেই শরীরের লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠল। ড. ক্যালিওর গলার স্বরে সেই ডাক আবার। তুষার-ঢাকা নিস্তব্ধ প্রান্তরে সে-ডাক কোথা থেকে আসছে? সভয়ে চেয়ে দেখলাম, তাঁর মৃতদেহ থেকে অন্তত নয়।

উন্মাদ করে দেবার মতোই অলৌকিক ভয়াবহ ব্যাপার। কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা রাখতেই হবে। তা রাখতে না পারলে আর সহজ-সুস্থ মানুষ হিসেবে সেখান থেকে ফিরতে হত না, আর তার পর ফন ব্রুলের সন্ধান পাওয়া যেত না।

 

গুরলা গিরিদ্বারের প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে এই দুর্দান্ত শীতে ফন ব্রুল একান্ত নির্জনে সদলবলে তার ছাউনি যেখানে গেড়েছে সেখানে কয়েক দিন বাদে সকালে এক পথ-হারানো ডোকপা মানে রাখাল গিয়ে হাজির। তুষারঝড়ে তার সব খোয়া গেছে। উপোসে ঠাণ্ডায় সে আধমরা। একপাল চমরী আর ঝাকুস অর্থাৎ ভারতবর্ষের গোৰু আর তিব্বতের চমরী মেশানো পশু নীচের টাকলাকোটে পৌঁছে দিয়ে সে দু-জন বন্ধুর সঙ্গে কিছু রসদ নিয়ে যুগোলো গুম্ফায় ফিরছিল। মাঝে তুষার ঝড়ে কে কোথায় গেছে সে জানে না।

ফন ব্লুল যেমন শয়তান তেমনই চৌকশ। তিব্বতি ভাষা সে ভাল করেই জানে। সামান্য একটা তিব্বতি রাখাল হলেও তবু নানারকমে প্রশ্ন করে ডোকপাকে পরীক্ষা করে তবে তাকে ছাউনিতে ঠাঁই দিলে। ছাউনি মানে গোটা পাঁচ-ছয় তাঁবু। কিন্তু তিব্বতের শীতের সঙ্গে যোঝবার মতো করে তৈরি। একটিতে থাকে ব্রুল নিজে। আর একটিতে তার অনুচরবৃন্দ আর রসদ যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। অনুচরের ভেতর তিব্বত, লাদাক, সিনকিয়াং সব জায়গার লোকই আছে।

ডোকপা লোকটা কাজের। একদিন খেয়ে দেয়ে একটু চাঙ্গা হয়েই শুধু কাজের গুণে সে ব্রুলের নজরে পড়ে গেল। তাঁবু পরিষ্কার, বন্দুক সাফ থেকে সাহেব-সুবোর হেন কাজ নেই, সে জানে না।

দুদিন বাদে তাকে দিয়ে হ্যাসাক বাতি সাফ করাতে করাতে ব্লুল হঠাৎ একটা বুটের (ঠাক্কর দিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, এই বেটা ভূত! এসব সাহেব-সুবোর কাজ শিখলি কোথায়?

আজ্ঞে, হেডিন সাহেবের সঙ্গে ছিলাম যে কবার।

হেডিন সাহেব! বুল অবাক। কে হেডিন?

আজ্ঞে গরিবের মা বাপ সোয়েন হেডিন।

ব্রুল সাহেব এবার যেন একটু হতভম্ব। সোয়েন হেডিনের সঙ্গে তুই কাজ করেছিস। তিব্বতের এ-অঞ্চল তো তুই তা হলে জানিস কিছু?

আজ্ঞে তা আর জানি না! এমন সব পাহাড়, নদী, হ্রদের খবর রাখি, এ দেশের লোকেরাও যার নাম জানে না।

বেশ বেশ! তোকে আমার কাজে লাগবে। বলে ব্রুল বেরিয়ে গেল, তার পরদিন তাঁবু উঠিয়ে নতুন পথে রওনা হবার ব্যবস্থা করতেই বোধহয়।

পরের দিন পর্যন্ত ঢুলকে অপেক্ষা করতে হল না।

সেদিনই বিকেলের দিকে কাছাকাছি বুঝি শিকারে গেছল একটু। সন্ধের পর ফিরে এসে ঘরে ডোকপাকে দেখে একটু বিরক্তই হয়ে উঠল।

কী করছিস কী এখানে এখন, ভূত কোথাকার!

হ্যাসাক বাতিটা তুলে এদিক ওদিকে ঘোরাতে ঘোরাতে ডোকপা বললে, আজ্ঞে, একটা জিনিস খুঁজছি।

জিনিস খুঁজছি! হতভাগা জানোয়ার! এটা তোমার জিনিস খোঁজবার সময়! কী খুঁজছিস, কী?

আজ্ঞে, একটু জল।

জল! প্রথমটা ব্লুল হাসবে না রাগবে ঠিক করতে পারল না। তার পরমুহূর্তেই তার প্রকাণ্ড বাঘের মতো মুখখানা লাল হয়ে উঠল রাগে। হুংকার দিয়ে বললে, কী এখানে খুঁজছিস?

আজ্ঞে একটু ভারী জল, ডিউটোরিয়াম অকসাইড।

পায়ের তলায় হঠাৎ পৃথিবীটা সরে গেলেও ঝুল বোধহয় এমন চমকে উঠে ফ্যাকাশে মেরে যেত না। সামলাতে তার কিন্তু বেশিক্ষণ লাগল না। তবে রে, শয়তান! বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা! বলে পাক্কা সাড়ে ছফুট দুমনী লাশটা নিয়ে ডোকপার ওপর এবার সে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অত বড় লাশটা তো আর চারটিখানি কথা নয়! একদিকের দড়ি ছিঁড়ে তাঁবুর একটা কোণ ঝুলে পড়ল।

হ্যাসাক বাতিটা একটু সরিয়ে রেখে বললাম, তাঁবুটা বড়ই ছোট। এর মধ্যে অত লাফালাফি দাপাদাপি কি ভাল?

বাপি দত্ত হঠাৎ লাফ মেরে উঠল উত্তেজনায় ও! আপনিই তাহলে ডোকপা! আমিও তাই ভাবছিলাম, ডোকপাটা এল কোথা থেকে।

করুণামিশ্রিত অবজ্ঞার সঙ্গে বাপি দত্তর দিকে একবার চেয়ে ঘনাদা আবার শুরু করলেন, গা-টা ঝেড়ে ঝুড়ে উঠে বুল বেশ একটু হতভম্ব হয়েই আমার দিকে এবার তাকাল। যা শিক্ষা ওইটুকুতেই হয়েছে তাতে গায়ের জোর পরীক্ষা করবার উৎসাহ আর তার তখন নেই। কিন্তু ভেতরের জ্বালা যাবে কোথায়! গলা দিয়েই সেটা বেরুল আগুনের হলকার মতো—কে তুই! কী মতলবে এখানে ঢুকেছিস?

বললাম তো, শুধু একটা ভারী জলের খোঁজে। এক শিশি যে-জল এই হাইড্রোজেন বোমার যুগে বেচলে সারা জীবন পায়ের ওপর পা দিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায়। ড. ক্যালিও প্রাণের মায়া ত্যাগ করে এই সদুর তিব্বতে এসে যে ভারী জলের এমন স্বাভাবিক এক গুপ্ত হ্রদ খুঁজে পেয়েছেন, পিপে পিপে চালান দিলেও যা একশো বছরে ফুরোবে না। ড. ক্যালিও কাজ সেরে দেশে ফেরবার মুখে নিরীহ সাধারণ পর্যটক ভেবে যে-জলের হ্রদ আবিষ্কারের কথা তোমার মতো শয়তানকে বলেছিলেন, আর ড. ক্যালিওর কাছে যে জলের হ্রদের গুপ্ত মানচিত্র কেড়ে নিয়ে তাঁকে তুষার ঝড়ের মধ্যে একলা মরতে ছেড়ে দিয়ে তুমি এখন হ্রদের সন্ধানে চলেছ।

এসব কথা তুই জানলি কী করে! রাগে বিস্ময়ে ব্রুলের গলাটা তখন কাঁপছে।

জানলাম ড. ক্যালিওর কাছে।

হতে পারে না! বুল চেঁচিয়ে উঠল, ড. ক্যালিওকে কথা বলবার অবস্থায় আমি রেখে আসিনি।

তাই নাকি! শয়তানের নিজের মুখের এই স্বীকারটুকুই চাইছিলাম।

কোথা থেকে তুই জানলি আগে বল। ব্লুল পারলে আমায় ছিঁড়ে খায়।

তাহলে শোন। জানলাম ড. ক্যালিওর ভূতের কাছে!

ভুতের কাছে! ব্রুল বুঝি খেপেই যায়।

হেসে বললাম, হ্যাঁ, ভূতের কাছে। আর জেনেছি যে ঠিক তাতে কোনও সন্দেহ আছে কি?

কিন্তু জেনে তোর লাভ কী! হঠাৎ ব্রুল তাঁবুর ধারে রাখা তার বন্দুকটা তুলে নিয়ে আমার দিকে উঁচিয়ে তার চাল আর গলা দুই-ই পালটে ফেললে, এ-জলের হ্রদ কি তুই কখনও খুঁজে পাবি ভেবেছিস? আর পেলেও তোর মতো কালো মর্কটের কাছে ও-জল কিনবে কে?

বিদ্রুপের হাসি হাসতে গিয়ে হঠাৎ ব্রুল থমকে আমার দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল। টুপি সমেত মাথার চুলটা আর তিব্বতিদের চেহারার ধরনের সামান্য যে কটা দাড়ি-গোঁফ মুখে ছিল তা আমি তখন খুলে ফেলেছি।

দাস।

হ্যাঁ, মূলার, সেই দাস, তোমার সঙ্গে অনেক দিনের বোঝাপড়া যার বাকি। ড. ক্যালিও তোমায় নিরীহ ব্রুল বলেই জেনেছিলেন। কিন্তু আমি তোমার আসল পরিচয়টা ভুলিনি-বিজ্ঞানের কলঙ্ক, জালিয়াৎ খুনে ফাঁসির আসামি জেল-পালানো মূলার! জীবনের প্রথমে ল্যাবরেটরির রেডিয়াম চুরি করে ধরা পড়ার পর অনেকবার যে নাম পালটেছে, সে-ই!

মূলার এবার সত্যিই হো হো করে হেসে উঠল, যাক, ভালই হয়েছে, দাস, নিজে থেকে এ সুযোগটা আমায় দিয়েছ বলে। মূলার নামটা যারা ভোলেনি তাদের সংখ্যা আমি কিছু কমাতে চাই।

মূলার বন্দুকটা আমার দিকে বাগিয়ে ধরল। হেসে বললাম, শিকার করে তো এই ফিরলে বন্দুকে আর টোটা আছে কি? হিংস্রভাবে হেসে মূলার জবাব দিলে, আছে একটাই আর সেই একটাই তোমার মতো মর্কটকে মারবার পক্ষে যথেষ্ট।

কিন্তু মর্কট মারা গেলে ভারী জলের হ্রদ আর খুঁজে পাবে কি?

পাব না মানে? রাগে খিচিয়ে উঠলেও মূলারের চোখ দেখে বুঝলাম সে অত্যন্ত বিচলিত হয়েছে।

সে ম্যাপ—ম্যাপ তুই চুরি করেছিস? রাগে মুলার প্রায় তোতলা।

নইলে কি শুধু তোমার খিদমতগারি করতে এ তাঁবুতে ঢুকেছি! আরে, সামলে সামলে! আমায় মারলে ম্যাপ পাবে কোথায়! সে কি আমার বুক পকেটে তোমার সুবিধের জন্য রেখে দিয়েছি?

কোথায় রেখেছিস? তবু মূলার বন্দুকটা বুঝি ছুঁড়েই দেয়।

বলব, কিন্তু হ্রদের জলে আমার আধা বখরা চাই।

আধা বখরা? মূলার চট করে কী ভেবে নিয়ে বললে, তাই সই। কোথায় ম্যাপ?

বলছি বলছি, অত ব্যস্ত কেন? আগে বখরাটা কী রকম শোনো!

কী রকম?

যে শিশিতে এ-জল চালান যাবে সেইটে তোমার, জলটা আমার!

কী! এই অবস্থায় এই ঠাট্টায় একেবারে চিড়বিড়িয়ে উঠে মূলার এক পলকের জন্য বুঝি একটু অসাবধান হল।

এক হাতে বন্দুকটা কেড়ে নিয়ে আর এক হাতে হ্যাসাক বাতিটা আছড়ে ফেলে আমিও তৎক্ষণাৎ তাঁবু থেকে ছুট।

হ্যাসাক বাতিটা বৃথাই পড়েনি। ছুটতে ছুটতে দূর থেকে ফিরে দেখলাম তাঁবুগুলো দাউ দাউ করে জ্বলছে।

কিন্তু মূলারের মতো শয়তানকে যে ওইটুকুতে ঠেকানো যায় না, পরের দিন সকালেই তা টের পেলাম।

তিব্বতের মত উঁচু মালভূমির পাতলা হাওয়ায় প্রাণপণ ছুটে, ক্লান্তিতে খিদেয় সত্যিই তখন আমার অবস্থা কাহিল। সেই অবস্থায় মাঝারি গোছের একটা তুষার চুডোর ওপর উঠে চারদিক দেখতে গিয়ে বুকটা হঠাৎ ধ্বসে গেল।

পিঁপড়ের মতো হলেও বহুদুরে একটা চলন্ত প্রাণীকে দেখা যাচ্ছে। সেটি আর কিছু নয়—মূলার স্বয়ং—আর তার পায়ে স্কি। শয়তানটা যে সঙ্গে স্কি-ও এনেছিল এইটিই ভাবতে পারিনি। শুধু পায়ের দৌড়ে তার সঙ্গে আর কতক্ষণ পারব! হাতের বন্দুকটা ভার হলেও ফেলে দিতে তো পারি না।

প্রাণও যদি যায় এ-ম্যাপ মূলরাকে পেতে দেব না। এই পণ করে খোলা প্রান্তর ছেড়ে এবার পাহাড়ের গায়ে গায়ে যেতে লাগলাম। কিন্তু খিদেয় যে বত্রিশ নাড়িতে পাক দিচ্ছে। পেটে কিছু না পড়লে আর তো দাঁড়াতেই পারব না।

হঠাৎ পাহাড়ের একটা বাঁক ঘুরেই হাতে যেন স্বর্গ পেলাম। সামনের একটা চুডোর ওপর কটা গারুসেরচঙ নামে ব্রাহ্মিণী বালিহাঁস। শীতের সময় ভারতের গরমে সব জলায় উড়ে যাবার পথে বোধহয় বিশ্রাম করতে নেমেছে। বন্দুকে একটা মাত্র গুলি, কিন্তু তাতেই আহারের সমস্যা মিটে যাবে মনে করার সঙ্গে সঙ্গেই আর-একটা মতলব বিদ্যুতের মতো মাথায় খেলে গেল।

কিন্তু গুলি না করে হাঁস ধরি কী করে!

সে সমস্যা ভাগ্যই মিটিয়ে দিলে। চমকে দেখি পাহাড়ের অন্যধার দিয়ে নিঃশব্দে একটা চাঙ্গু মানে নেকড়ে বাঘ ওই হাঁসের লোভেই গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে। দুরুদুরু বুকে বন্দুক বাগিয়ে বসে রইলাম। পাঁচ, দশ, পনেরো সেকেন্ড নেকড়েটা ঝাঁপিয়ে হাঁস ধরবার সঙ্গে সঙ্গেই গুলি। নেকড়েটা লুটিয়ে পড়ল মরে, আর তার মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ল, ভয়েই আধমরা অজ্ঞান হাঁসটা।

ছুটে গিয়ে হাঁসটা তুলে নিলাম। না, জখম কিছু হয়নি, শুধু ভয়েই অসাড়। দেখতে দেখতেই সাড় ফিরল তার, আর ম্যাপটা পাকিয়ে দলা করে যার মধ্যে রেখেছিলাম সেই ছোট কৌটোটা তার মুখে পুরে দিয়ে বেশ করে ঝাঁকুনি দিলাম। কোঁৎ করে হাঁসটা সে-কৌটোটা গিলে ফেলতেই তাকে শূন্যে দিলাম ঠুড়ে। পড়-পড় হয়ে দুবার পাখা ঝাপটা দিয়েই সে দূর আকাশে উধাও হয়ে গেল। বুঝলাম, হিমালয় পার

হয়ে আর সে থামবে না। সে হাঁস এই ভারতবর্ষের না হোক, দুনিয়ার কোনওনা-কোনও জলায় শীতকালে আসেই। আজও তাকে তাই খুঁজছি। ক-জন বড় বড় বৈজ্ঞানিককে গোপনে এ কথা জানিয়েছি। তাঁদের ভাড়া করা অন্তত তিনশো শিকারিও এই খোঁজে ফিরছে।

তা হলে এখনও হাঁসটা পাওয়া যেতে পারে? বাপি দত্ত উৎসাহিত।

আলবত পারে। ঘনাদা নিঃসংশয়।

কিন্তু মূলার কী করলে? বন্দুকের শব্দ পেয়েও আপনাকে ধরতে পারলে না? শিশির যেন সন্দিগ্ধ।

তা পারল বই কী? আর তাই তার কাল হল। হাঁস উড়িয়ে দিয়ে লুকিয়ে পালাবার চেষ্টাতেই ছিলাম। কিন্তু তার আর তখন উপায় নেই। চেয়ে দেখি স্কি-তে চড়ে সে একেবারে পাহাড়ের তলায় পৌছে গেছে। স্কি ছেড়ে সে ওপরে উঠতে শুরু করল এবার। আমার হাতে খালি বন্দুক, তার হাতে গুলি-ভরা বন্দুক। চুডোর এমন জায়গায় আছি যে লুকোবারও উপায় নেই। ক্রমশই সে এগুচ্ছে। আর একটু উঠলেই অনায়াসে গুলি করতে পারবে। খালি বন্দুকটাই তার দিকে ছুঁড়ে মারলাম। সেটা বেয়াড়া একটা পাথরে ঠোক্কর খেয়ে একরাশ তুষার গুঁড়ো উড়িয়ে সশব্দে নীচে গিয়ে পড়ল। তাকে ছুঁতেও পারল না।

কী পৈশাচিক তার আনন্দের হাসি তখন।

আর উপায় নেই। নড়াবার মতো একটা পাথরও নেই কাছে। বরফও ঝুরো।

নীচে মূলার তখন ভাল করে বন্দুক বাগিয়ে ধরে তাগ করছে।

বন্দুকের গুলি তার ছুটল, কিন্তু একটু দেরিতে। মূলার তখন খাড়া পাহাড় দিয়ে তুষার গুডোর সঙ্গে গড়াতে গড়াতে নীচের বরফের নদীর মধ্যে কবর হতে চলেছে। তার সঙ্গে সেই চাঙ্গু মানে নেকড়েটাও। সেইটেরই লাশটা শেষ পর্যন্ত কিছু না পেয়ে ছুঁড়ে দিয়েছিলাম।

ঘনাদা থামতেই গৌরের বেয়াড়া প্রশ্ন আচ্ছা, নস্যির কৌটো পেলেন কোথায়? নস্যি নিতেন নাকি তিব্বতে?

নস্যির কৌটো বলেছি বলেই—তাই না? ফিল্ম যাতে থাকে সেই ছোট অ্যালুমিনিয়ামের কৌটো। মূলারের তাঁবুতেই পেয়েছিলাম।

এবার বাপি দত্ত আসল কথাটা তুলল, ভাগ্যিস ড. ক্যালিওর ভূত আপনাকে ডেকেছিল। তার কাছেই তো সব জানতে পারেন?

তা ভূতই বলতে পারো, তবে আসলে জিনিসটা একটা টেপ রেকর্ডার। ঘনাদা মুখ টিপে হাসলেন।

টেপ রেকর্ডার! আমরাও অবাক।

হ্যাঁ, ড. ক্যালিও জন্তুজানোয়ার থেকে পাখি-টাখির আওয়াজ ও তিব্বতিদের কথাবার্তা তুলে নেবার জন্যে ওটি সঙ্গে রাখতেন। শেষ পর্যন্ত মূলারের মতলব বুঝতে পেরে ওই যন্ত্রটি কাজে লাগাবার অদ্ভুত ফন্দি বার করেন। নিজের সব কথা ওই যন্ত্রে তুলে নিয়ে ওইটিই লুকিয়ে এক জায়গায় রেখে আসতে পেরেছিলেন মারা যাবার আগে, যন্ত্রটির এমন প্যাঁচ করেছিলেন যে ফিতেটা নিজে থেকেই একবার গুটিয়ে আর একবার খুলে যায় কথাগুলোও ঘুরে ঘুরে শোনা যায়। আওয়াজ ধরে আমি যন্ত্রটা খুঁজে বার করি একটা পাথরের তলায়। অন্য কটা ফিতে থেকে বাকি কথাগুলোও কিছুটা জানতে পারি। কিন্তু যন্ত্রটা বরফের গুঁড়ো দুকে ঝড়ের ধাক্কায় পাথরে ঠোকাঠুকি খেয়ে প্রায় তখন বিকল হয়ে এসেছে। আমি কিছুটা চালাতেই একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।

ফিতেটা খুলে সঙ্গে আনলে পারতেন! বুনো হাঁসের পেছনে ধাওয়া করার দরকার হত না। শিবুর কেমন বাঁকা মন্তব্য।

ঘনাদা কিছু বলবার আগে বাপি দত্তই শিবুর ওপর মারমুখো হয়ে উঠল, আনবার হলে ঘনাদা আনতেন না, আহাম্মক!

বলা বাহুল্য বাপি দত্তই সেই থেকে ঘনাদার সবচেয়ে বড় ভক্ত।

হাঁস খেতে খেতে আমাদের অরুচি ধরে গেল।

আগ্রা যখন টলমল (গল্পগ্রন্থ)

 আগ্রা যখন টলমল

না, তস্য তস্য!

বললেন শ্রীঘনশ্যাম দাস ওরফে ঘনাদা নামে কোনও কোনও মহলে যিনি পরিচিত। বিস্ময়ে বিহ্বলতায় কারও মুখে তখন আর কোনও কথা নেই।

ঘনশ্যাম দাস নিজেই সমবেত সকলের প্রতি কৃপা করে তাঁর সংক্ষিপ্ত উক্তিটি একটু বিস্তারিত করলেন:

মানে, আমার ঊর্ধ্বতন ষোড়শতম পূর্বপুরুষ মীর-ঈ-ইমারৎ সাওয়ানি নিগার—

ঘনশ্যাম দাসকে বাধা পেয়ে থামতে হল।

মেদভারে হস্তীর মতো যিনি বিপুল সেই সদাপ্রসন্ন ভবতারণবাবু বিস্ফারিত চোখে বলে উঠলেন, আপনার পূর্বপুরুষ বলছেন, অথচ ওই মীর না পীর কী বললেন!

ঘনশ্যাম দাস তাঁর সেই নিজস্ব ট্রেডমার্কের ছাপমারা করুণার হাসি হাসলেন।

মীর পীর নয়, মীর-ঈ-ইমারৎ সাওয়ানি নিগার বচনরাম দাস। মীর-ঈ-ইমার হল যাকে বলে বিল্ডিং সুপারিন্টেন্ডেন্ট আর সাওয়ানি নিগার মানে আমির-ওমরাহ রাজপুরুষদের না জানিয়ে গোপনে সবকিছু জরুরি খবর সংগ্রহ করে খোদ শাহানশাহ-এর কাছে লিখে ্পাঠানো যার কাজ।

আপনার পূর্বপুরুষ বচনরাম দাস তখন আগ্রায় থেকে ওই কাজ করতেন!

উদরদেশ যাঁর কুম্ভের মতো স্ফীত সেই রামশরণবাবু বিমূঢ়-বিস্ময় প্রকাশ করলেন।

কিন্তু একটু বেসুরো বাজল, মস্তক যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ সেই শিবপদবাবুর কণ্ঠ।

অবিশ্বাস ও বিদ্রূপের রেশটুকু গোপন না করে তিনি বললেন, সবই বুঝলাম, কিন্তু আপনার পূর্বপুরুষ ওই মীর-ঈ-ইমারৎ সাওয়ানি নিগার বচনলাল না বচনরাম

তখন আগ্রায় না থাকলে ভারতবর্ষের ইতিহাসই অন্যরকম লেখা হত বলছেন?

তাই তো বলছি। ঘনশ্যাম দাস অবোধকে যেন বোঝাতে বসলেন—১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে আগস্ট তারিখটার কথা একটু স্মরণ করুন। সারা দুনিয়ার চোখ-টাটানো শহর মোগল সাম্রাজ্যের অতুলনীয় রাজধানী আগ্রায় সেদিন যেমন সকাল হয়েছিল তেমনই নির্বিঘ্নে সন্ধ্যা যদি নামত, যদি হঠাৎ সেই তারিখটি আগ্রায়, না শুধু আগ্রার কেন, সমস্ত ভারতবর্ষের আকাশে আগুনের অক্ষরে না জ্বলে উঠত, তাহলে আজ যে ইতিহাসের ধারা আমরা দেখছি তা সম্পূর্ণ ভিন্নপথে কি প্রবাহিত হত না!

১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে আগস্ট।

তারিখটার তাৎপর্য স্মরণ করতে সবাই যতক্ষণ চিন্তাকুল, ততক্ষণে এ সমাবেশের একটু পরিচয় ও এ কাহিনীর উদ্ভবের একটু উপক্রমণিকা বিবৃত করা যেতে পারে।

এক এবং অদ্বিতীয় শ্রীঘনশ্যাম দাসকে কেন্দ্র করে এই সমাবেশটি সচরাচর কোথায় জমে থাকে এবং প্রায় নিত্য-নৈমিত্তিকভাবে কারা সেখানে উপস্থিত থাকেন, কেউ কেউ হয়তো জানেন।

স্থান এই কলকাতা শহরেরই প্রান্তবর্তী একটি নাতিনগণ্য জলাশয়, করুণ আত্ম-ছলনায় যাকে হ্রদ বলে আমরা অভিহিত করি কখনও কখনও।

জীবনে যাদের কোনও উদ্দেশ্য নেই, বা কোনও এক উদ্দেশ্যেরই একান্ত একাগ্র অনুসরণে যারা পরিশ্রান্ত, এই উভয় শ্রেণীর নানা বয়স্ক স্ত্রী-পুরুষ নাগরিক প্রতি সন্ধ্যায় এই জলাশয়ের তীরে নিজ নিজ রুচি ও প্রবৃত্তি অনুসারে স্বাস্থ্য অর্থ কাম মোক্ষ এই চতুর্বর্গের সাধনায় একাকী কিংবা সদলে ভ্রমণ করেন বা কোথাও উপবিষ্ট হন।

এ জলাশয়ের দক্ষিণ তীরে একটি নাতি-বৃহৎ পর্কটী বৃক্ষকে কেন্দ্র করে কয়েকটি আসন বৃত্তাকারে পাতা। আবহাওয়া অনুকূল হলে সেই আসনগুলিতে সাধারণত পাঁচটি প্রবীণ নাগরিককে নিয়মিতভাবে অপরাহুকালে সমবেত হতে দেখা যায়।

তাঁদের একজনের শিরোশোভা কাশের মতো শুভ্র, দ্বিতীয়ের মস্তক মর্মরের মতো মসৃণ, তৃতীয়ের উদরদেশ কুম্ভের মতো স্ফীত, চতুর্থ মেদভারে হস্তীর মতো বিপুল, এবং পঞ্চম জন উষ্ট্রের মতো শীর্ণ ও সামঞ্জস্যহীন।

এই পঞ্চরত্নের সভায় স্বাস্থ্য থেকে সাম্রাজ্যবাদ ও বাজার দর থেকে বেদান্ত-দর্শন পর্যন্ত যাবতীয় তত্ত্ব আলোচিত হয়ে থাকে।

আলোচনার প্রাণ অবশ্য শ্রীঘনশ্যাম দাস, প্রাণান্তও তিনি। কারণ সকল বিষয়ে শেষ কথা তিনিই বলে থাকেন এবং তাঁর কথা যখন শেষ হয় তখন আর কারও কিছু বলবার থাকে না।

থাকলেও ঘনশ্যাম দাসের সামনে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করা নিরাপদ নয়। কোথা থেকে কী অশ্রুতপূর্ব উল্লেখ ও উদ্ভট উদ্ধৃতি দিয়ে বসবেন সেই ভয়ে সকলেই অল্পবিস্তর সন্ত্রস্ত।

সেদিন নিতান্ত নির্দোষভাবেই আলোচনাটার সুত্রপাত হয়েছিল।

মাথার কেশ যাঁর কাশের মতো শুভ্র সেই হরিসাধনবাবু কিছুদিন ধরে এ সমাবেশে অনুপস্থিত ছিলেন।

তাঁর অনুপস্থিতির কারণ সম্বন্ধে ঔৎসুক্য প্রকাশ করে একটু পরিহাসের সূরে বলেছিলেন মর্মর-মসৃণ যাঁর মস্তক সেই শিবপদবাবু, কী মশাই! আমাদের যে ভুলেই গেছলেন! ড়ুব মেরেছিলেন কোথায়?

না, এই এখানেই ছিলাম! হরিসাধনবাবুকে কেমন যেন অস্বাভাবিক রকম কুণ্ঠিত মনে হয়েছিল।

এখানেই ছিলেন! অসুখবিসুখ করেনি নিশ্চয়? কুম্ভের মতো উদরদেশ যাঁর স্ফীত সেই রামশরণবাবুর জিজ্ঞাসা।

না, অসুখবিসুখ নয়-হরিসাধনবাবু যেন আরও লজ্জিত।

এবার সভার সকলেই কিঞ্চিৎ বিস্মিত। অসুখবিসুখ নয়, তবু পঞ্চরত্নের একজন স্বেচ্ছায় এই সান্ধ্য-সমাবেশে অনুপস্থিত! এ তো অবিশ্বাস্য ব্যাপার!

তাহলে সত্যিই ড়ুব মেরেছিলেন বলুন? শুধোলেন মেদভারে হস্তীর মতো যিনি বিপুল সেই ভবতারণবাবু, কীসে?

নিরীহ নির্বিবাদী ভবতারণবাবুকেই যেন ভরসা করে হরিসাধনবাবু তাঁর অন্তর্ধান রহস্যটা জানাতে পারলেন।

এই মানে, একটু পড়ালেখা করছি কিছুদিন থেকে। সলজ্জভাবে স্বীকার করলেন হরিসাধনবাবু।

লেখাপড়া নয়, হরিসাধনবাবু শব্দটা পড়ালেখা বলে যে উচ্চারণ করেছেন তা লক্ষ করেছিলেন বোধহয় সকলেই।

প্রথমত সে কারণে এবং দ্বিতীয়ত হরিসাধনবাবু এই বয়সে হঠাৎ পড়ালেখায়। মেতে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় মজলিশে আসাও বন্ধ করতে দ্বিধা করেননি উপলব্ধি করে সকলেই অতঃপর অত্যন্ত কৌতূহলী।

কী লেখাপড়া করছেন, মশাই!

আপনিও তো রামশরণবাবুর মতো ভোজনরসিক!

রান্নার কোনও বই-টই লিখছেন নাকি?

নানাদিকের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হরিসাধনবাবু যেন নিরুপায় হয়ে স্বীকার করতে বাধ্য হলেন—হ্যাঁ, বই-ই লিখছি, তবে রান্নার নয়।

রান্নার নয়? সকলে বিস্মিত—তবে কীসের?

আর রান্নার বই লেখা তো খুব সোজা। জনৈকের মন্তব্য—দেশি বিলাতি নানা বই থেকে টুকে মেরে দাও।

তবে রান্নার বই-এর তেমন কাটতি নেই। আর-একজনের আশঙ্কা!

আমি যা লিখছি তার কিন্তু খুব কাটতি! হরিসাধনবাবু একটু উৎসাহভরেই এবার জানিয়েছিলেন।

কী লিখছেন কী তাই শুনি না! স্বয়ং ঘনশ্যামবাবুর প্রশ্ন।

ঐতিহাসিক উপন্যাস।

সকলেই স্তম্ভিত ও নীরব।

হরিসাধনবাবু সকলের বিস্মিত বিমূঢ় দৃষ্টির সামনে অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে কৈফিয়ত দেবার চেষ্টা করেছিলেন।

সেই সেদিন ঐতিহাসিক উপন্যাসের কথা হচ্ছিল না? ভবতারণের ঘুম-ছাড়ানো দাওয়াইটা একবার তাই থেকে পরখ করে দেখবার সাধ হয়। সেই দেখতে গিয়েই নেশা চেপে গেল!

বলতে বলতে নিজের বক্তৃতাই হরিসাধনবাবুকে উদ্দীপিত করে তুলেছিল।

ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে তিনি বলেছিলেন, হলফ করে বলছি আপনাদের, ঐতিহাসিক উপন্যাসের মতো অত সুখ কিছুতে নেই। যেমন পড়ে সুখ, তেমনই লিখে। লিখতে লিখতে সময় যে কোথা দিয়ে কেটে যায় টেরই পাই না। যা লিখি তা তো হাজার পাতার এধারে থামতেই চায় না!

হাজার পাতার ঐতিহাসিক উপন্যাস আপনি লিখে ফেলেছেন! কপালে চোখ তুলে ধরা-গলায় বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন শিবপদবাবু।

হ্যাঁ, তবে একটা নয়! এবার গর্বভরেই বলেছিলেন হরিসাধনবাবু, তিনটে হয়ে গেছে, আর তার পরেরটা মাঝামাঝি এসে একটু আটকেছে।

কেন? নালা বুজে গেছে বুঝি!

ঘনশ্যাম দাসের ঈষৎ অকরুণ মন্তব্যটা হরিসাধনবাবু তাঁর আত্মপ্রকাশের উৎসাহে গায়েই মাখেননি এখন। সরলভাবে বলেছিলেন, আটকেছে মানে ক-টা নাম তারিখ গোছের খুঁটিনাটি জোগাড় করার জন্যে লেখাটা বন্ধ রেখেছি ক-দিন!

কিন্তু তিনটে তো লেখা শেষ হয়ে গেছে! বলেছিলেন শিবপদবাবু, সেগুলো কোথাও আটকায়নি বুঝি!

না, আটকাবে কেন? হরিসাধনবাবু তাঁর লিখনকৌশলের গুপ্তরহস্য ব্যক্ত করে দিয়েছিলেন, সব যে আগে থাকতে হাতের কাছে গুছিয়ে রেখেছিলাম। এই ধরুন প্রথম উপন্যাসটা বর্গির হাঙ্গামার সময়কার। তাতে প্রত্যেক পাতায় একবার করে ছিটোবার জন্যে রঘুজি ভোঁসলে আর ভাস্কররাম কোলহাটকর, আর দুকদম না যেতে যেতেই জপের মন্ত্রের মতো আউড়ে ড়ুকরে ওঠবার জন্যে মুবারক মঞ্জিল নাম ক-টা বাগানো ছিল, তারপর ঠিক ঝোপ বুঝে কখনও সলিমুল্লার তারিখ-ই-বাংলা, কখনও বাণেশ্বরের চিত্ৰচম্পু, কখনও পিরলেনকার-এর পোর্তুগিজ-ই-মারাটার-এর উল্লেখ ছড়িয়ে দিয়েছি। বারো আনা লেখা তো এই করেই সারা হয়ে গেছে।

উৎসাহে উত্তেজনায় হরিসাধনবাবু বোধহয় আরও অনেক কিছু বলে ফেলতেন, কিন্তু ঘনশ্যাম দাসই তাঁকে থামিয়ে বলেছিলেন, তিনটে উপন্যাসই লিখে ফেলে চারটের বেলা আটকালো তাহলে কোথায়?

ওই একটু আগ্রা শহরে। হরিসাধনবাবু একটু যেন অধৈর্যের সঙ্গে জানিয়েছিলেন—নাম-টাম অনেক জোগাড় করেছি। দিওয়ান-ই-তান, দিওয়ান-ই-আলা, খান-ই-সামান, তসদিক্‌ সাজাওল, মুশরিফ, বাহারিস্তান-ই-ঘৈরি, হেদায়েৎ-উল-কোয়াই গোছের চমকে দেওয়া সব আরবি ফারসি শব্দ আর সেই সঙ্গে সোজা বাংলায় একটু রসুন ফোড়ন দেবার মতো উর্দু বুকনি, যেমন— তাড়াতাড়ির জায়গায় তুরন্ত লেখা, ভাগ্যের বদলে কিসম, সুগন্ধের বদলে খোসবু, একটুর জায়গায় জেরাসে, বই-এর জায়গায় কিতাব গোছের একরাশ কথা বসিয়ে ফেলেছি। এখন আগ্রা শহরের একটু বিবরণ আর কয়েকটা তারিখ ঠিকমতো জানবার জন্যেই থামতে হয়েছে। বই কাগজ সেজন্য ঘাঁটছি। ওইগুলো পেলেই উপন্যাস আর থামবে না।

উপন্যাসের রং পালিশ তো বুঝলাম, বলেছিলেন ঘনশ্যাম দাস, কিন্তু–কী নিয়ে উপন্যাস? গল্প একটা আছে তো?

আছে না? কিঞ্চিৎ ক্ষুগ্নস্বরে বলেছিলেন হরিসাধনবাবু, ঐতিহাসিক উপন্যাসে যেমন থাকা উচিত ঠিক সেই গল্প আছে। খুন-জখম, মারামারি, কাটাকাটি, তার মধ্যে অকুতোভয় নায়ক, সুন্দরী সপ্রতিভ নায়িকা, ঠিক সময়মতো দৈবের আবির্ভাব, কবি-টবি বা যাত্রার বিবেক গোছের কাউকে মাঝে মাঝে আসরে ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া, তারই সঙ্গে বেশ একটু চটচটে করে আদিরস, কিছু আমার গল্পে বাদ নেই।

তা গল্পটা কবেকার? জিজ্ঞাসা করেছিলেন শিবপদবাবু, আগ্রা শহরের ঠিক কোন সময় বাবদ!

ভারতসম্রাট আওরঙ্গজেব-এর বয়স যখন পঞ্চাশ, অর্থাৎ পঞ্চাশের জন্মদিনের কাছাকাছি সময়ে! বলেছিলেন হরিসাধনবাবু।

এইবার সেই পেটেন্ট নাসিকাধ্বনি শোনা গেছল।

সকলে সচকিত হয়ে ঘনশ্যাম দাসের দিকে চাওয়ার পর তিনি একটু চিন্তিতভাবে। বলেছিলেন, সময়টা ভালোই বেছেছেন, কিন্তু তার মান রাখতে পারবেন কি! আগ্রা আর সেই সঙ্গে সমস্ত মোগল সাম্রাজ্যের ভিত ওই সময়কার একটি তারিখেই প্রথম মোক্ষম নাড়া খেয়ে চিরকালের মতো আলগা হয়ে যায়। অবশ্য সেই তারিখটায় ওই আগ্রা শহরে একটি মানুষ যদি উপস্থিত না থাকতেন তাহলে ইতিহাস কোন পথে যেত কিছু বলা যেত না। হয়তো অন্যভাবেই সে ইতিহাস লেখা হত।

একটু থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলার মতো একটা শব্দ করে ঘনশ্যাম দাস আবার বলেছিলেন, কিন্তু সেসব আর আপনারা জানবেন কোথা থেকে! বচনরাম দাসের নামই তো আপনারা শোনেননি বোধহয়।

না, শুনেছি বলে তো মনে পড়ছে না! শিবপদবাবু ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বচনরাম দাস বলছেন? তিনি আপনারই কেউ হবেন নাকি? প্রপিতামহ বা তার ওপরে অতিবৃদ্ধ কেউ?

না, তস্য তস্য। তখনই বলেছিলেন ঘনশ্যাম দাস।

 

২.

তারপর আলোচনাটা যে ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে আগস্ট তারিখটার তাৎপর্য বোঝার চেষ্টায় এসে থেমেছে, সে বিবরণ আগেই দেওয়া হয়েছে।

মস্তক যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ সেই ইতিহাসের অধ্যাপক শিবপদবাবু প্রথম আঁধারে আলোক দেখতে পেলেন।

১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে আগস্ট! তিনি কপাল কুঞ্চিত করে বললেন, সেদিন—সেদিনই শিবাজি আগ্রা থেকে পালিয়েছিলেন না?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওই তারিখেই! সোৎসাহে শিবপদবাবুকে সমর্থন করলেন হরিসাধনবাবু, মনেই পড়ছিল না এতক্ষণ, অথচ খাতায় আমি টুকে রেখেছি তারিখটা, উপন্যাসে এক জায়গায় সুবিধামাফিক লাগিয়ে দেব বলে।

নেহাত এক জায়গায় লাগিয়ে দেবেন ভেবেছিলেন তারিখটা! ঘনশ্যাম দাসের তীক্ষ্ণ শ্লেষটা হরিসাধনবাবুর কানেও এবার বিধল।

কেমন একটু থতমত খেয়ে বললেন, কেন? লাগিয়ে দেওয়া অন্যায় হবে?

হ্যাঁ, হবে—দাসমশাই-এর স্বর যেন চাবুক—তলোয়ার দিয়ে কুটনো কোটা যেমন অন্যায়, যেমন অন্যায় কামান দিয়ে মশা মারা, চন্দনকাঠে চুলো ধরানো, মুক্তো দিয়ে খুঁটি খেলা। ভারতবর্ষের ইতিহাসের ওই তারিখ শুধু একবার উপন্যাসে উল্লেখ করেই ভুলে যাবেন? ১৮৫৭ সাল নিয়ে আপনি গল্প লিখবেন শুধু কলকাতার বাবুবিলাসের, ১৯৪২ সাল পার হয়ে যাবেন ইঙ্গ বঙ্গ পাড়ার কেচ্ছাই শধু গাইতে গাইতে?

সবাই নীরব হতভম্ব! হরিসাধনবাবু তো অপরাধটা ঠিক না বুঝেও লজ্জায় অধোবদন।

প্রথম সাহস সঞ্চয় করে শিবপদবাবুই বলেন, তারিখটা ভারতের ইতিহাসে ভোলবার নয় জানি, কিন্তু তারিখের সঙ্গে আপনার সেই পূর্বপুরুষ বচনরামের সম্বন্ধ কী? তিনি তখন আগ্রায় না থাকলে কি ও তারিখটা পাঁজি থেকে বাদ যেত, না শিবাজি আগ্রা থেকে পালাতেন না?

শিবপদবাবু কথার শেষে হুলটুকু প্রায় অজান্তেই না রেখে পারলেন না।

হুলের বদলে ছোবলই বুঝি আসে ঘনশ্যাম দাসের।

সবাই যখন সেই ভয়েই সন্ত্রস্ত তখন ঘনশ্যাম দাস অপ্রত্যাশিত উদারতায় সকলকে অবাক করে দিলেন।

হুলটুকু যেন টেরই না পেয়ে বললেন, না, ও তারিখ পাঁজি থেকে বাদ যেত না, আর শিবাজিও আগ্রা থেকে ঠিকই পালাতেন, কিন্তু এদিকে পশ্চিম ওদিকে দক্ষিণ দিকের খুফিয়ানবিশ আর হরকরাদের পাঠানোে উলটোপালটা গুপ্ত খবরে আগ্রার দরবারে আলমগিরের তাহলে মাথা খারাপ হবার জোগাড় হত না, ফৌজদার আলি কুলী আর তাঁর অনুচরেরা বার বার দিনদুপুরে ভূত দেখতেন না, সুরাটের বৈদ্যকুলতিলক দ্বিজোত্তম নাভা তাঁর সুরাটের প্রাসাদোপম ভবনে বারাণসীধামের, এক অত্যাশ্চর্য দৈবানুগ্রহের কাহিনী সকলকে নিত্য শোনাতেন না, আর সেদিনের টলমল আগ্রা শহরের ভিত্তিমূলেই দারুণ আঘাত পেয়ে মোগল সাম্রাজ্য অত তাড়াতাড়ি বোধহয় ধ্বংস পেত না। তা না পেলে কোথায় থাকত তুচ্ছ একটা সাগরপারের হিমেল দ্বীপের রাঙামুখ ক-টা সওদাগর! এই ভাগীরথীর কাদামাটির তীরে শেকড় গাঁথবার আগে কালাপানির জলেই কবে তাদের ইতিহাস তলিয়ে যেত!

এত কিছু সব হতে পারেনি শুধু ওই তারিখে আপনার পূর্বপুরুষ বচনরাম আগ্রায় হাজির ছিলেন বলে!

অকপট বিস্ময় বিমূঢ়তা ফুটে উঠেছে মেদভারে হস্তীর মতো যিনি বিপুল সেই ভবতারণবাবুর কণ্ঠে।

আসলে তিনি থাকায় হয়েছেটা কী? ইতিহাসের অধ্যাপক শিবপদবাবুর গলাটা এখনও বেসুরো। সম্ভ্রমের চেয়ে সন্দেহটাই যেন তার মধ্যে প্রধান।

হয়েছে এই যে, ঐতিহাসিকরা সেদিন পর্যন্ত হিমশিম খেয়েছেন আগ্রা থেকে পালিয়ে শিবাজির রাজগড় পৌঁছোবার বৃত্তান্ত নিয়ে। দাসমশাই অনুকম্পাভরে হেসে বললেন, ১৬৬৬-র ১২ই সেপ্টেম্বর, না তারও দু-মাস পরে ১১ই নভেম্বর, তিনি রাজগড়ে ফিরেছেন, তা-ই সঠিক বলা সম্ভব হয়নি। কৃষ্ণাজি অনন্ত সভাসদের শিব-ছত্রপতি-চেন-চরিত্র আর তারিখ-ই-শিবাজির বিবরণে গরমিল হয়েছে। আওরঙ্গাবাদ থেকে এক গুপ্তচর খুফিয়ানবিশ হিসাবে দিল্লিতে যে চিঠি পাঠিয়েছে তার খবরের সঙ্গে জেধে শাকাবলি-র বিবরণের সামঞ্জস্য হয়নি। সেই সঙ্গে অখণ্ডপ্রতাপ মোগলসাম্রাজ্যের প্রখর পাহারার শ্যেনদৃষ্টিকে উপেক্ষা করে খগরাজের কাছে মূষিকের ন্যায় অকিঞ্চিৎকর শিবাজি ভোঁসলের এই অবিশ্বাস্য পলায়নের যাত্রাপথকে নির্দেশ করে বিচিত্র নানা কাহিনীর ধারা জন্ম নিয়েছে।

ঘটনার সময়েই দূর-দূরান্তর থেকে সে সব কাহিনীর ঢেউ আগ্রা পর্যন্ত পৌঁছে ভারতসম্রাটকে বিভ্রান্ত ও উত্ত্যক্ত করে তুলেছিল।

শিবাজি কী কৌশলে তাঁর মোগল দুশমনদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছিলেন, স্কুলপাঠ্য ইতিহাসেও তার উল্লেখ মিলবে, পূজার নৈবেদ্যের নামে পাঠানো মিষ্টান্নের ঝুড়ির মধ্যে লুকিয়েই তিনি আর তাঁর ছেলে শম্ভুজি পাহারাদারদের এড়িয়ে তাঁর বন্দিশিবিরের বাইরে যান ঠিকই। কিন্তু তারপর কী করেছিলেন তিনি! কোন পথে রওনা হয়েছিলেন নিজের রাজ্যের দিকে?

আওরঙ্গজেব-এর সতর্ক পাহারায় ব্যবস্থার তো কোনও ত্রুটি ছিল না। বন্দিশিবিরে জয়সিংহের পুত্র রামসিংহের নিজস্ব রাজপুত অনুচরেরা শিবাজিকে পাহারা দেবার জন্যে মোতায়েন। দিবারাত্রি তারা ঘিরে থাকে শিবাজির শিবির। দিনে রাত্রে বহুবার। শিবাজির শয্যা পর্যন্ত তদারক করে যায়। শিবাজিকে গুপ্তঘাতকের হাত থেকে রক্ষা করাই অবশ্য তাদের আসল উদ্দেশ্য।

রাজপুত প্রহরীদের দ্বারা শিবাজির বন্দিশিবির ঘিরে শহর-কোতোয়াল সিদ্দি ফুলাদ জিসি আর দতি, মানে কামান-বন্দুক নিয়ে এক বিরাট বাহিনীকে পাহারায় রাখবার ব্যবস্থা করেছিলেন।

তা সত্ত্বেও পালিয়ে শিবাজি হঠাৎ অমন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেন কী করে? শিবাজির পালানোর খবর জানাজানি হয়েছিল প্রায় চোদ্দো ঘণ্টা পরে। এই চোদ্দো ঘণ্টা সময় হাতে পেয়েই শিবাজি কিন্তু যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন মনে হয়েছে।

খবর পাওয়া মাত্র আওরঙ্গজেব এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করেননি। আগ্রার সবচেয়ে সেরা ঘোড়ায় চড়ে ওস্তাদ সওয়ারেরা দিগ্বিদিকে ঝড়ের বেগে ছুটে গেছে শিবাজির সব পালাবার রাস্তা বন্ধ করবার নির্দেশ জানাতে। মালোয়া খাণ্ডেশের ভেতর দিয়ে শিবাজির দক্ষিণ দিকে যাবার সম্ভাবনা বেশি। সেদিকের সমস্ত ফৌজদারদের সতর্ক করে দেবার ব্যবস্থা হয়েছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তবু শিবাজিকে ধরা সম্ভব হয়নি।

প্রথম উড়ো খবর এসেছে মথুরা থেকে। আওরঙ্গজেব সে খবর বিশ্বাস করতে পারেননি। শিবাজিকে সেখানে নাকি সন্ন্যাসীর বেশে দেখা গেছে একদিন।

মথুরা আগ্রার উত্তরে। শিবাজির কি ভীমরতি ধরেছে যে, আওরঙ্গজেব-এর সেপাইরা ডালকুত্তার মতো তার সন্ধান করছে জেনেও দক্ষিণে নিজের রাজ্যের দিকে ছুটে উত্তরে রওনা হবেন!

প্রথমে খবরটায় বিশ্বাস না হলেও পরে শিবাজির এটা একটা সূক্ষ্ম চাতুরী বলেই সন্দেহ হয়েছে। সবাই যখন দক্ষিণ দিকে তাকে ধরবার জন্যে বিনিদ্র পাহারায় আছে তখন উত্তরে যাওয়াই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। শিবাজির ফন্দি যে এরকম কিছু হতে পারে, তার প্রমাণও যেন পাওয়া গেছে। উত্তর নয়, এবার পূর্বাঞ্চল থেকে। শিবাজিকে ছদ্মবেশে ইলাহাবাদে দেখা গেছে বলে লিখে পাঠিয়েছে এক হরকরা। বারাণসীধামে গঙ্গার ঘাটে একদিন সকালে শোরগোল উঠেছে শিবাজি ধরা পড়েছেন বলে। সংবাদটা সত্য নয় জানা গেছে তারপর।

সত্য মিথ্যা বিচারই কঠিন হয়ে উঠেছে এবার। গয়া, এমনকী সুদূর পুরী থেকেও শিবাজিকে স্বচক্ষে দেখার খবর লিখে জানিয়েছে অনেকে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। শিবাজি যেন ভোজবাজিতে নানা জায়গায় হঠাৎ দেখা দিয়ে আবার শূন্যে বিলীন হয়ে গেছেন।

ওদিকে আবার আওরঙ্গাবাদ থেকে এক খুফিয়ানবিশ-এর যে গোপন চিঠি ১৬৬৬-র ১৪ই নভেম্বর দিল্লি এসে পৌঁছেছে, তাতে আগ্রা থেকে পালাবার পঁচিশ দিন বাদেই শিবাজি রাজগড়ে পৌঁছে গেছেন বলে খবর দেওয়া হয়েছে। মথুরা ইলাহাবাদ বারাণসী গয়া পুরী হয়ে গণ্ডোয়ানা, হায়দরাবাদ ও বিজাপুরের পথে দিন-রাত্রি ঘোড়া চালিয়েও তো পঁচিশ দিনে আগ্রা থেকে রাজগড়ে পৌঁছনো অসম্ভব!

আগ্রা থেকে রাজগড় পর্যন্ত নাকের সোজা উড়ে যেতেই ছ-শো সত্তর মাইল।

কিন্তু উড়ে না গেলে সোজা একমুখো হয়ে তো চলা যায় না। রাস্তায় পাহাড় পর্বত। জঙ্গল আছে, আছে বহু নদী পার হওয়ার ঝামেলা, তার ওপর মোগল প্রহরীদের দৃষ্টি এড়াতে জানা সুগম পথ ছেড়ে দুর্গম ঘুরের পথে যাওয়ার প্রয়োজন। সরল রেখায় যা। ছ-শো সত্তর মাইল, আসলে তা হাজার মাইলের ওপর গিয়ে দাঁড়ায়। আর মথুরা বারাণসী গয়া পুরীর রাস্তায় তো কমপক্ষে কয়েক হাজার মাইল।

শিবাজি কোন পথে রাজগড়ে গেছেন তাহলে? আওরঙ্গাবাদের গুপ্তচরের খবর যদি ঠিক হয় তাহলে কাশী, ইলাহাবাদ, পুরী হয়ে পঁচিশ দিনে তাঁর রাজধানীতে পৌঁছনো অসম্ভব। এপথে যদি না গিয়ে থাকেন তাহলে অত জায়গা থেকে। শিবাজিকে অত লোকের দেখার গুজব ওঠে কী করে? সব গুজবই তো আজগুবি বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য কয়েকটি খবরের উৎসও আছে। যেমন, খাফি খাঁ সুরাটের যে ব্রাহ্মণ চিকিৎসকের কথা লিখেছেন, তাঁর বিবরণ অবিশ্বাস করবার নয়।

ব্রাহ্মণের নাম নাভা। সুরাটে তাঁর বিরাট জমকালো প্রাসাদগোছের বাড়ি। যে বাড়ি কেনার রহস্য যে তাঁর কাছে যায় তাকেই তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে শোনান। সে-বাড়ি নিজের চিকিৎসার উপার্জনে তিনি তৈরি করেননি। তীর্থ করতে তিনি কাশী গেছলেন। আশ্বিনের তখন শেষ। একদিন ভোরবেলা অন্ধকার থাকতে গঙ্গায় তিনি স্নান পূজাপাঠ করতে নেমেছেন হরিশ্চন্দ্রের ঘাটে। ঘাট তখন নির্জন। মাথায় পাগড়ি আর গায়ে মুড়িসুড়ি দিয়ে চাদর জড়ানো একটি লোক হঠাৎ তাঁর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করেছে, আপনি ব্রাহ্মণ?

আচার্য নাভা সবিস্ময়ে মাথা নেড়ে জানিয়েছেন, হ্যাঁ।

লোকটি কোমরের একটি থলি খুলে এক মুঠো মণিমুক্তা আশরফি আর হুন তাঁর হাত ভরে দিয়ে বলেছে, শিগগির আমায় তর্পণ করান।

নাভা বিমূঢ়ভাবে সেই অবিশ্বাস্য সম্পদ বস্ত্রপ্রান্তে বেঁধে অপরিচিত লোকটিকে গঙ্গাতীরে তর্পণ করাতে বসেছেন।

তর্পণ করতে করতেই কোথায় শারগাল শোনা গেছে ঘাটের ওপরে।

লোকটি হঠাৎ নাভার কো-কুশি কমণ্ডলু নিজের কাছে টেনে নিয়ে চাপা-গলায় বলেছে, এবার আমিই আপনাকে তর্পণ করাচ্ছি। ভক্তিভরে হাতজোড় করে বসুন।

হতভম্ব হয়ে নাভা তা-ই করেছেন।

ঘাটের ওপরে খোলা তলোয়ার হাতে নগররক্ষী সেপাই আর মহল্লার দারোগাকে এবার দেখা গেছে।

তারা নীচে নামতে শুরু করেছে।

অজানা লোকটি তার আগেই গায়ের চাদর খুলে ফেলেছে। দেখা গেছে তার গলায়ও উপবীত জড়ানো। ডান কাঁধে সে উপবীত আর উত্তরীয় রেখে দক্ষিণমুখো হয়ে বসে মাটিতে বাঁ হাটু রেখে ডান হাতের তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের মূল দিয়ে এক অঞ্জলি জল নিয়ে সে তখন বিশুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণে মন্ত্রপাঠ করছে, ওঁ যমায় ধর্মরাজায় মৃত্যবে চান্তকায় চ। বৈবশ্যতায় কালায় সর্বভূতক্ষরায় চা ঔড়ুস্বরায় দমায় নীলায় পরমোষ্ঠিনে। বৃকোদরায় চিত্রায় চিত্রগুপ্তায় বৈ নমঃ।

সেপাই আর দারোগা ঘাটের নীচে এসে দাঁড়িয়ে দুজনকেই লক্ষ করেছে কিছুক্ষণ।

অজানা লোকটি তখন নমো-তর্পণ সেরে পিতৃ আবাহন শুরু করেছে, ওঁ উশন্তা নিবীমবুশন্তঃ সমিধীমহি। উশন্ন শত আবহ পিতৃন হবিষে অন্তবে।

মন্ত্রপাঠের মাঝখানেই অধৈর্য হয়ে মহল্লার দারোগা আচার্য নাভাকে জিজ্ঞাসা করেছে, তাঁরা গঙ্গার ঘাটে নামবার পর আর কাউকে এদিকে আসতে দেখেছেন কি না?

ব্রাহ্মণকে মিথ্যা কথা বলতে হয়নি। তিনি বিনাদ্বিধায় জানিয়েছেন যে, তাঁরা দু-জন ছাড়া এ ঘাটে এ পর্যন্ত আর কেউ আসেনি।

দারোগা আর সেপাইরা তারপর চলে গেছে। অজানা লোকটির দিকে একবার দৃপাতও করেনি।

ব্রাহ্মণ অজানা লোকটির দিকে চেয়ে এবার তীব্র কৌতূহলের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করেছেন, কে আপনি? আপনার পিতৃ আবাহনের মন্ত্রপাঠ শুনে বুঝলাম, আপনি ঋগ্বেদী কি যজুর্বেদী ব্রাহ্মণ! কিন্তু চেহারা আপনার ক্ষত্রিয়ের মতো! অনুগ্রহ করে জানাবেন, আপনি কে?

অজানা লোকটি একটু হেসে বলেছে, আমার মুখে না-ই শুনলেন। আমি কে তা হয়তো অচিরেই জানতে পারবেন।

ব্রাহ্মণ তা-ই পেরেছেন। লোকটি শেষ কথা বলেই হরিশ্চন্দ্রের ঘাট থেকে গঙ্গায় নেমে ড়ুব দিয়েছিল। একটা কালোমাথা ভোরের অস্পষ্ট আলোয় ভেসে উঠেছিল বহুদূরে গঙ্গার স্রোতের প্রায় মাঝামাঝি। সেই লোকটিই হবে নিশ্চয়।

ব্রাহ্মণ নিজের পূজাপাঠ সেরে ঘাটের ওপর উঠেই সেখানে সমবেত উত্তেজিত জনতার কাছে কিছুক্ষণ আগেকার শোরগোলের কারণ জানতে পেরেছিলেন। খানিক আগে স্বয়ং শিবাজি-ই নাকি এই মহল্লায় মোগল সিপাহিদের হাতে ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে পালিয়ে গেছেন। অকাতরে অত মণিমুক্তো হুন দান করায় অজানা লোকটিকে শিবাজি বলেই বিশ্বাস হয়েছে নাভার, সেই সঙ্গে একটু ধোঁকাও লেগেছে তর্পণের বিশুদ্ধ মন্ত্র আবৃত্তিতে। শিবাজি সারাজীবন শস্ত্র নিয়েই লড়া করতে করতে এমন শাস্ত্র শেখবার সময় পেলেন কখন?

 

৩.

দাসমশাই একটু থামলেন।

ইতিহাসের অধ্যাপক এই ফাঁকটুকুর জন্যে যেন মুখিয়ে ছিলেন। দাসমশাই নীরব হতে না হতেই বলে উঠলেন, মাপ করবেন, খাফি খাঁর বিবরণ আমিও এক সময়ে পড়েছি। আপনি যা শোনালেন তার সঙ্গে খাফি খাঁর বিবরণের মিল তো বেশি নেই।

না থাকাই স্বাভাবিক। দাসমশাই তাচ্ছিল্যভরে বললেন, খাফি খাঁর বিবরণই যে বেঠিক। তিনি সুরাটের ব্রাহ্মণ চিকিৎসক নাভার—মনে রাখবেন উর্দু হরফের গোলমালে নামটা বাভাও হতে পারে কাছে যা শুনেছেন, তা ভাল করে সবটা বুঝতেও পারেননি। তিনি লিখে গেছেন, নাভা কাশীতে এক ব্রাহ্মণের শিষ্য হয়েছিলেন। সেই ব্রাহ্মণ গুরুর কাছে কিন্তু তিনি পেটভরে খেতে পেতেন না। ধান ভানতে শিবের গীতের মতো শিবাজির কথা বলতে গিয়ে গুরুর বাড়িতে নাভার খেতে না পাওয়ার গল্প বলা একেবারে অর্থহীন ও অবান্তর নয় কি? খাফি খাঁ তারপর লিখে গেছেন যে, শিবাজি নাভার হাতের মুঠোয় ধনরত্ন ভরে দেবার পর তাঁরই অনুরোধে নাভা শিবাজিকে কামানো, স্নান ইত্যাদি করাতে শুরু করেন। হিন্দু আচার-অনুষ্ঠান কিছু জানা থাকলে ব্রাহ্মণ-পুরোহিত যজমানের ক্ষৌরকর্ম করছেন এমন আজগুবি কথা খাফি খা লিখতেন না। খাফি খাঁ যা লিখে গেছলেন, তার ভিত্তিটা খাঁটি হলেও সম্পূর্ণ সঠিক বিবরণ তিনি দিতে পারেননি।

সে-বিবরণ আপনি শুধু পেরেছেন!

না, শিবপদবাবুর কৌতুক-মেশানো বিদ্রূপের খোঁচা নয়, মাথার কেশ যাঁর কাশের মতো শুভ্র, সেই হরিসাধনবাবুর মুগ্ধ সম্ভ্রমের বিহ্বলতা।

মহৎ অনাসক্তিতে এ উচ্ছাস অগ্রাহ্য করে দাসমশাই সবিনয়ে বললেন, শুধু আমি কেন, চেষ্টা করে হারানো আখবরাত খুঁজে বার করলে যে-কেউ এ বিবরণ পেতে পারেন।

ইতিহাসের অধ্যাপক আবার কী যেন ফ্যাকড়া তুলতে যাচ্ছিলেন। তাঁকে সে-সুযোগ দাসমশাই দিলেন না। তাড়াতাড়ি আগেকার কথার খেই ধরে শুরু করলেন—শুধু সুরাটের ব্রাহ্মণ চিকিৎসক নাভার বিবরণই নয়, শিবাজির দীর্ঘতর ঘোরানো পথে নিজের রাজ্যে ফেরার অন্য জোরালো প্রমাণও আছে। যেমন, গোদাবরীর তীরের একটি গ্রামে এক চাষি পরিবারের অবিশ্বাস্য সৌভাগ্যের কাহিনী।

এক সন্ধ্যায় এক সন্ন্যাসী দু-একটি শিষ্যসামন্ত নিয়ে ওই চাষির ঘরে আশ্রয় নেয়। কুটিরের কত্রী বৃদ্ধা কৃষক-জননী সাধু-সন্ন্যাসীদের ভাল করে খেতে না দিতে পারার আফশোশে শিবাজি আর তাঁর সেনাদলকে প্রাণভরে গালাগাল দেয়। কিছুদিন আগেই শিবাজির এক লুঠেরা দল সে-গ্রাম লুণ্ঠন করে গেছে।

সন্ন্যাসী আর তার সাঙ্গোপাঙ্গ নীরবে এসব অভিযোগ শুনে পরের দিন সকালে বিদায় নেয়। কিন্তু কিছুকাল বাদেই শিবাজির রাজদরবার থেকে ডাক আসে ওই পরিবারের। প্রাণের আশা ছেড়ে দিয়ে সে চাষি পরিবার সভয়ে গিয়ে হাজির হয় শিবাজির রাজসভায়। সেখান থেকে কল্পনাতীত উপহার নিয়ে তারা ফেরে। সৈনিকরা যা তাদের লুঠ করেছিল, শিবাজি তার চতুগুণ তাদের দান করেছেন।

এ-সব কাহিনী আওরঙ্গজেবের কাছেও পৌঁছে তাঁকে বিভ্রান্ত করে তুলেছে। ১৬৬৬-র ১৪ই নভেম্বর যে আখবরাত দিল্লি এসে পৌঁছোয়, তার খবরের সঙ্গে এসব বিবরণের কোনও সামঞ্জস্যই হয় না। আখবরাত-এর খবর হল, শিবাজি আগ্রা থেকে পালাবার পঁচিশ দিন বাদে ১২ই সেপ্টেম্বর রাজগড় পৌঁছেছেন। পোঁছে বেশ কয়েকদিন তিনি অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন, তারপর সেরে উঠে আবার অসুখে পড়েছেন।

আখবরাত-এর খবর সত্যি হলে সমস্ত ব্যাপারটা দুর্ভেদ্য রহস্য হয়ে দাঁড়ায় বলে মনে হয়েছে আওরঙ্গজেব-এর। রাজগড় থেকে মোগল গুপ্তচর শিবাজির রাজধানীতে ফেরার যে-খবর পাঠিয়েছে, তা আওরঙ্গাবাদের খুফিয়ানবিশের কাছে পৌঁছোতে লেগেছে অন্তত পাঁচ দিন। আর আওরঙ্গাবাদ থেকে দিল্লি পর্যন্ত আখবরাত আসতে একুশ দিন। তার আগে শিবাজির দুবার অসুখে পড়ার সময় ধরলে সবসুদ্ধ কমপক্ষে দু-মাস আগে শিবাজির রাজগড়ে পৌঁছোনো মিথ্যে নয় বলেই মনে হয়। কিন্তু তা কী করে সম্ভব?

এ-সমস্যার সমাধান না করতে পেরে আওরঙ্গজেব আওরঙ্গাবাদের খুফিয়ানবিশ-এর কাছে কড়া চিঠি পাঠিয়েছেন তার খবরটা খাঁটি কি না ভাল করে যাচাই করে জানবার জন্যে। কিন্তু খুফিয়ানবিশ-এর কোনও জবাব আসেনি। তাকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি আওরঙ্গাবাদে। আর-এক গভীর রহস্য সৃষ্টি করে সেও হঠাৎ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

১৬৬৬-র উনিশে আগস্ট সুতরাং সামান্য তারিখ নয়। আগ্রা শহর টলমল করে উঠে মোগল সাম্রাজ্যের বনেদে ফাটল দেখা দিয়েছে সেইদিনই।

অনেক দুঃখে ভারতসম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁর শেষ ইচ্ছাপত্রে লিখে গেছলেন: রাজশক্তির সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হল রাজ্যে যা-কিছু ঘটছে, সবকিছুর খবর রাখা,নইলে এক মুহূর্তের গাফিলতিতে চিরকাল আফশোশ করতে হয়। দেখো, উপযুক্ত হুঁশিয়ারির অভাবে শিবাজি সেই যে পালিয়েছিল, তারই জন্যে অন্তিমকাল পর্যন্ত যুদ্ধ-বিগ্রহের জ্বালা আমার ঘুচল ন।

কিন্তু সত্যিই আওরঙ্গজেবের শিবাজি সম্বন্ধে হুঁশিয়ারির কিছু ত্রুটি ছিল কি?

মনে হয় না। শিবিরে শিবাজিকে দিবারাত্রি পাহারা দিয়েছে রামসিং-এর রাজপুত অনুচরেরা। শিবিরের বাইরে এক মীর আতিশ-এর অধীনে তোপদার এক বিরাট সেনাদল সারাক্ষণ সজাগ থেকেছে! এই বেষ্টনী ভেদ করে শিবাজি পালিয়েই বা যাবে কোথায়!

আগ্রার পথঘাটে সেই কথাই আলোচনা করেছে বড়-ছোট সবাই।

 

৪.

শিবাজির পলায়নের কয়েক দিন আগেকার কথা। শহর-কোতোয়াল সিদ্দি ফুলাদ-এর বাড়ি এসেছিল মীর-ঈ-ইমার একটা জরুরি তলব পেয়ে।

সিদ্দি ফুলাদ ক-টা বিশ্বাসী ও চৌকস হালালখোর অর্থাৎ ময়লা সাফ করার মেথর চেয়েছেন মীর-ঈ-ইমারৎ-এর কাছে।

শহর-কোতোয়ালের সামান্য ক-টা ঝাড়ুদারের জন্যে মীর-ঈ-ইমারকে কেন তলব দিতে হয়, তা বুঝতে তখনকার দস্তুর একটু জানতে হয়। প্রত্যেক মহল্লায় বাড়ি-ঘর সাফ করবার ঝাড়ুদারেরাই ছিল কোতোয়ালের গুপ্ত খবর সংগ্রহের প্রধান। চর।

কোন মহল্লায় কার বাড়ির জন্যে হালালখোর দরকার, শুনে মীর-ঈ-ইমার-এর ঠোঁটের কোণে একটু হাসি ফুটে উঠেছে।

সে-হাসি ফুলাদ-এর দৃষ্টি এড়ায়নি। অন্য কেউ শহর-কোতোয়াল হলে সামান্য মীর-ঈ-ইমার-এর এ-বেয়াদপি সহ্য করতেন না। সিদ্দি ফুলাদ মানুষটা কিন্তু খুব খারাপ নয়। মনটা তাঁর খোলামেলা। তা ছাড়া মীর-ঈ-ইমারকে তিনি একটু অন্য চোখে না দেখে পারেন না। তার প্রতি গোপন একটা কৃতজ্ঞতা শহর-কোতোয়ালের আছে।

সিদ্দি ফুলাদ তাই একটু কপট রাগে ভুরু কুঁচকে বলেছেন, হাসছ যে বড়, বচনরাম! হাসবার কী আছে এতে? রামসিং-এর বাড়ি হালালখোর দরকার হয় না?

হবে না কেন, কোতোয়ালসাহেব! বচনরাম হাসিটুকু মুখ থেকে না মুছে ফেলেই বলেছে, তবে রামসিং বাহাদুরের জন্যে তো নয়, হালালখোর কার জন্যে লাগাতে হচ্ছে, তা তো জানি। ওই একটা নেংটিকে সামলাতে এত হাঁসফাঁস দেখে তাই একটু হাসি পায়। তাও যে-নেংটি তার আপনার গর্তে নেই, খোদ শের-ই-হিন্দুস্তানের ডেরায় নাক বাড়াতে এসে জাঁতাকলে বন্দি। জাঁতাকল ছাড়িয়ে যদি পালায়ও, তাহলে হবে কী? শাহানশাহ্-এর বিরাট রাজত্বের কোণে কানাচে পাহাড়ে-জঙ্গলে কোথায় একটা-দুটো নেংটি-নেউল চরে বেড়ায় তা কি মোগল-সাম্রাজ্যের মাথা ঘামাবার বিষয়!

সিদ্দি ফুলাদ বচনরামের দিকে চেয়ে তার অজ্ঞতায় একটু অনুকম্পার হাসিই হেসেছেন। বলেছেন, নেংটি যাকে বলছ, সে যে কী জিনিস, তাহলে জানো না, বচনরাম। ওই নেংটির দাপটে সমস্ত দক্ষিণ ভারতে থরহরিকম্প লেগেছিল, বিজাপুর রাজ্য যায়-যায়, জাঁদরেল সব মোগল সেনাপতিরা নাকের জলে চোখের জলে হয়েছে এই শিবাজির রণকৌশলে। ওকে তাই অনেক ফন্দি করে মিথ্যে টোপ দেখিয়ে আগ্রায় এনে পোরা হয়েছে। একবার এখান থেকে ছাড়া পেলে ও কী সর্বনাশ করতে পারে কেউ জানে না!

বচনরামের মুখে সরল বিস্ময়ই ফুটে উঠেছে যেন। কথাটায় বিশ্বাস করতে যেন। কষ্ট হচ্ছে এইভাবে সে বলেছে, ওই একরত্তি মানুষটার মধ্যে এত দুশমনি! আমারই মতো তো ক্ষয়া-পাতলা মাঝারি মাপের চেহারা!

তুমি কোথায় দেখলে শিবাজিকে! সিদ্দি ফুলাদ একটু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন।

দেখেছি আগ্রায় যেদিন প্রথম আসে, সেইদিনই। বচনরাম একটু হতাশ হওয়ার। সুর ফুটিয়েছে গলায়, শহরের নানা মহল্লায় নানা গুজব শুনে ইচ্ছে হয়েছিল স্বচক্ষে একবার মানুষটাকে দেখবার। এমন একটা কেও-কেটার ইস্তিল কেমন হয় তাও দেখতে চেয়েছিলাম। শহর ছাড়িয়ে তাই মানিকচাঁদের সরাই পর্যন্ত গেছলাম। গিয়ে আফশোশই হল। এই শিবাজি ভোঁসলের অভ্যর্থনা! আগ্রা শহর তাকে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনেনি।

সত্যিকার হোমরা-চোমরাদের বেলা ইস্তিবাল-এর কী দস্তুর? আগ্রা থেকে অন্তত একদিনের পথ বাকি থাকতে মানী অতিথি যাত্রা থামিয়ে বিশ্রাম করতেন। শাহানশাহ-এর প্রতিনিধি দামি উপহার নিয়ে সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে শোভাযাত্রা করে সসম্মানে তার পরদিন শহরের রাস্তা দিয়ে এনে জ্যোতিষীদের বিধান দেওয়া শুভসময়ে সম্রাটের সামনে হাজির করবেন। কোথায় কী! সব দেখলাম ভোঁ ভোঁ। শুনলাম, কুমার রামসিং-এর ওপর শিবাজিকে অভ্যর্থনা করার ভার ছিল। তিনি নাকি শিবাজির পৌঁছোবার খবর জানতেই পারেননি। জানতে যখন পেরেছেন। তখন আবার পাঠিয়েছেন তাঁর মুনশি গিরধরলালকে। ইস্তিকাল-এর এই ছিরি দেখেই আমার তো ভক্তি উড়ে গেছল। আগ্রা শহরে পরের দিন ঢোকবার পর আর-এক কেলেঙ্কারি। কুমার রামসিং-এর সেদিন বুঝি প্রাসাদ পাহারা দেওয়ার হফত চৌকি ছিল। সে কাজ সেরে রামসিং আর মুকলিস খাঁ তাঁদের লোকলশকর নিয়ে যখন শিবাজিকে অভ্যর্থনা করতে ছুটে গেছেন খোজা ফিরোজার বাগিচার পথ ধরে, তখন মুনশি গিরধরলাল শিবাজিকে নিয়ে আসছে দহর-আরা বাগিচার রাস্তায়। শেষে কোনওরকমে এ ভুল শুধরে শিবাজির সঙ্গে কুমার রামসিং-এর দলের দেখা হল খাসবাজারের নূরগঞ্জ বাগিচায়। তারপর শিবাজিকে প্রায় ঘোড়দৌড় করিয়ে শাহানশাহ্-এর কাছে হাজির করবার চেষ্টা। তখন দিওয়ান-ই-আম-এর পালা শেষ হয়ে গেছে, সম্রাট বসেছেন দিওয়ান-ই-খাস-এ গিয়ে। ছোট মীর বকশি আসাদ খাঁ সেখানে শাহানশাহ-এর সামনে হাজির করেছেন শিবাজিকে। শিবাজি ভোঁসলে। হাজার মোহর আর দু হাজার সিক্কা নজর দিয়েছেন। সেই সঙ্গে পাঁচ হাজার সিক্কা নিসার। সম্রাট কিন্তু মুখের একটা কথা বলেও শিবাজিকে সম্ভাষণ করেননি। শিবাজিকে তারপর নিয়ে গিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে পাঁচ-হাজারি মনসবদারদের সারিতে।

ধৈর্য ধরে এতক্ষণ পর্যন্ত সব শুনে শহর-কোতোয়াল একটু ভুরু কুঁচকে বলেছেন, তুমি এতক্ষণ ধরে যা শোনালে আগ্রা শহরে কারও তা জানতে বাকি আছে মনে করো! তবু অত ফলাও করে আমায় সব শোনাবার মানেটা কী বলো তো?

আজ্ঞে, সোজা মানে তো আগেই জানিয়ে দিয়েছি, কোতোয়াল সাহেব! বচনরাম সরলভাবে বলেছে, ওই যার ইস্তিল-এর নমুনা, শাহানশাহ্ যাকে মুখের একটা কথায় সম্ভাষণ করবার যোগ্য মনে করেন না, সেই তুচ্ছ একটা মানুষকে অত ভয় করবার কিছু আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। তাকে আটক রাখবার এত তোড়জোড় তাই একটু বাড়াবাড়িই মনে হয়।

উঁহুঃ—সিদ্দি ফুলাদ একটু হেসেছেন—তুমি একটা কথা ভুলে যাচ্ছ, বচনরাম। শিবাজির ইস্তিল যে ঠিকমতো হয়নি তা তাকে তাচ্ছিল্য দেখাবার জন্য নয়।

তবে কি সম্মান দেখাবার জন্যে!

বচনরামের গলার স্বরটা প্রায় বেয়াদবির কিনারা ছুঁয়ে গেছে।

চোখটা বচনরামের মুখে তোলবার সময় ঝিলিক দিয়ে উঠলেও সিদ্দি ফুলাদ খোঁচাটা তেমন গায়ে মাখেননি বোধহয়। ভুল শোধরাবার ভঙ্গিতে সহজভাবেই বলেছেন, সম্মান দেখাবার উদ্দেশ্যই ছিল, কিন্তু তারিখটাই গোলমাল করে দিয়েছে।

বচনরামের কাছে যেন একটা প্রশ্ন আশা করে একটু থেমেছেন শহর-কোতোয়াল। সে প্রশ্ন না আসায় নিজেই আবার বলেছেন, দিনটা কী ছিল এখন আশা করি মনে পড়েছে। শিবাজি যেদিন আগ্রায় এসে ঢুকলেন, শাহানশাহ্-এর সেই দিনই পঞ্চাশের জন্মদিন। শহরের কারও মাথায় আর কোনও চিন্তা কি আছে তখন! চার মাস আগে শাজাহান মারা গেছেন আগ্রার দুর্গে। সম্রাট আওরঙ্গজেব এতদিন দিল্লি থেকেই সাম্রাজ্য চালিয়েছেন। এই প্রথম তিনি দিল্লি ছেড়ে আগ্রায় এসে দরবার বসিয়েছেন। চোদ্দোশো গাড়িতে যে-সব ঐশ্বর্য এসেছে দিল্লি থেকে আগ্রায়, তা সাজিয়ে রাখা হয়েছে প্রাসাদে, সম্রাটের জন্মদিন পালন করতে যারা আসবে তাদের চোখ ধাঁধাবার জন্যে। তা সত্যিই তো আগ্রাবাসীর মাথা ঘুরে গেছে তৈমুরবংশের ঐশ্বর্য দেখে। বড়-ছোট সবাই তখন সম্রাটের জন্মদিনের উৎসবেই মত্ত। শিবাজি যদি আগ্রায়। পৌঁছোতে দেরি না করতেন, যদি একদিন আগেও তিনি আগ্রায় পা দিতেন, তাহলে এ সমস্ত গোলমাল কিছুই হত না।

সম্রাটের জন্মদিনের দরুন তাঁকে খাতির করে আগ্রায় আনার না-হয় ত্রুটি হয়েছে, কিন্তু শাহানশাহ নিজেই যে একটা কথা বলেও তাঁকে মেহেরবানি করেননি, তাঁকে যে পাঁচহাজারি মনসবদারদের সারিতে দাঁড় করানো হয়েছে, সেটাও কি জন্মদিনের গোলমালে? বচনরাম মাথা নেড়েছেনা কোতোয়াল সাহেব, যা-ই আপনি বোঝান, শিবাজি একটা কেও-কেটা আমি মানতে পারব না। সামান্য একটা পাহাড়ি ভুইয়ার লুঠেরা হয়ে দুদিন একটু পিঁপড়ের পাখা গজিয়েছিল। সে পাখা হেঁটে দিয়ে সম্রাট তাই তাকে পোকামাকড়ের শামিলই মনে করেছেন। আপনারাই মিছিমিছি শিবাজিকে ফানুসের মতো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তার ভয়-ভাবনায় অস্থির। এই যে জিসি-দতি নিয়ে শিবাজির শিবির ঘেরাও করে রেখেছেন, আগ্রার সাধারণ মানুষ তাতে কিন্তু তাজ্জব। তারা কেউ কেউ আবার হাসে। বলে, জিসি-দতি, মানে কামানবন্দুক লাগে ওই একটা পাহাড়ি চুহাকে আটকে রাখতে। বন্দুকচি তো নয়ই, নেহাত সাধারণ পাহারাদারের যারা শামিল সেই আশা-ও নয়, তারও চেয়ে ওঁচা যত হতভাগা বেকার বাউন্ডুলেদের দিয়ে গড়া সেহবন্দি ক-টা সেপাই রাখলৈই তো ঠাণ্ডা!

সেহ-বন্দি সেপাই রাখলেই ঠাণ্ডা! এবার সিদ্দি ফুলাদ বচনরামকে ব্যঙ্গ করেই হেসে উঠেছেন। তার পর চোখ দুটো কুঁচকে, মুখ বেঁকিয়ে বলেছেন, শহরের উটকো লোক যা বলে, তোমারও তাহলে তাই ধারণা!

বচনরাম চুপ করে থেকেই তার সায় জানিয়েছে।

সিদ্দি ফুলাদ এবার বচনরামের প্রতিবাদে যেন নয়, নিজের ও সেই সঙ্গে সারা মোগল জাহানের অন্তরের জ্বালাটা প্রকাশ করে বলেছেন, শোনো বচনরাম, ও চুহা নয়। পাহাড়ি চিতা। ওর নিজের এলাকায় পাহাড়-জঙ্গলে ও মোগল শেরকেও ঘায়েল করে। সায়েস্তা খাঁর শিক্ষাটাই মনে করো না! পুনায় ভোঁসলে পরিবারের নিজেদের মোকামে সায়েস্তা খাঁ তার লোক-লশকর হারেমসুদ্ধ নিয়ে আছে। তার নিজের সৈন্যবাহিনী তো আছেই, তার ওপর যশোবন্ত সিং-এর দশ হাজার জোয়ান। এইসব হেলায় তুচ্ছ করে শিবাজি চারশো বাছাই করা অনুচরের মধ্যে মাত্র দুশো জনকে নিয়ে সায়েস্তা খাঁর হারেমের ভেতর পর্যন্ত ঢুকে সব লণ্ডভণ্ড করে সায়েস্তা খাঁর বুড়ো আঙুল কেটে নিয়ে আসে। না বচনরাম, শিবাজি হেলাফেলা করবার লোক নয়, তা আলমগির ভালো কইে জানেন। তিনি দরবারে ওকে যে একটু অগ্রাহ্য করেছেন সে শুধু পরীক্ষা করবার জন্যে। তাতে ওরকম হাত-পা ছুঁড়ে চেঁচিয়ে সম্রাটের আর তাঁর। দরবারের অপমান করা কি শিবাজির উচিত ছিল?

ওঃ, হ্যাঁ, তাও তো বটে! শিবাজি তো খুব চেঁচামেচি করেছিলেন ওই দরবারের মধ্যেই! বচনরামের মুখের ভাবে অবিশ্বাস আর বিস্ময়ই যেন ফুটে উঠেছে।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে-মুখে একবার চোখ বুলিয়ে সিদ্দি ফুলাদ বলেছেন, চেঁচামেচি নয়, তাকে বলে কেলেঙ্কারি। সম্রাটের কাছে কোনও অভ্যর্থনা না পেয়ে পেছনের সারিতে দাঁড়িয়ে শিবাজি যেই শুনলেন কুমার রামসিং-এর কাছে যে, সেটা পাঁচহাজারি মনসবদারদের সারি, তৎক্ষণাৎ তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন কী! আমার খাতির এই! আমার ছেলে আগ্রা না এসেই পাঁচহাজারি মনসবদারি পেয়েছে। আমার কাছে যে চাকরি করে সেই নেতাজিও পাঁচ-হাজারি! আর আমি পাহাড়-জঙ্গল ভেঙে আগ্রা এসেছি এই সম্মান পেতে! শিবাজির সামনে দাঁড়িয়েছিল যশোবন্ত সিং আর প্রধান ওয়াজির জাফর খাঁ। সম্রাটের কাছে তারাও যখন খিলাত পেল শিবাজিকে বাদ দিয়ে, তখন শিবাজির চোখ দিয়ে যেন আগুন ছিটোচ্ছে। সম্রাটের পর্যন্ত তা নজরে পড়েছে তখন। কুমার রামসিংকে তিনি পাঠালেন শিবাজি অমন অস্থির কেন জানতে। শিবাজি যা মুখে আসে, বিক্ষোভে জানিয়ে মনসবদারি ছেড়ে দিয়ে এবার যা করেছে, বাবর শাহ-এর আমল থেকে মোগল রাজত্বে তা দিল্লি কি আগ্রা কোথাও কেউ করতে সাহস করেনি। শিবাজি সিংহাসনের দিকে পেছন ফিবে গটগট করে বাইরে বেরিয়ে গেছে। কুমার রামসিং সন্ত্রস্ত হয়ে তাকে হাতে ধরে ফেরাতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু শিবাজি সজোরে হাত ছিনিয়ে নিয়ে একটা থামের পেছনে গিয়ে সেই যে বসেছে, শত অনুনয়-বিনয়েও আর ওঠেনি। সেখানে বসেই কুমার রামসিংকে বলেছে, আমায় এখুনি কাটো মারো যা খুশি করো, সম্রাটের সামনে আমি যাব না। আলমগির কুমার রামসিং-এর কাছে শিবাজির অভিমানের কথাই একটু শুনেছেন। শুনে, অন্য ওমরাহদের শিবাজিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ফেরাতে বলেছেন, তাকে খিলাত পর্যন্ত দিয়েছেন, কিন্তু শিবাজি তার গোঁ ছাড়েনি। শাহনশাহকে তো এত কিছু বলা যায় না, তাঁকে এবার বোঝানো হয়েছে যে, দারুণ গরমে মারাঠা সর্দার বেহুশ হয়ে পড়েছে।

ওঃ! এত কাণ্ড! বচনরামের গলা এবার যেন অপ্রসন্ন–দরবারের বাইরে তো ঠিক খবর আমরা পাইনি। সত্য-মিথ্যে হরেকরকম গুজব আমাদের কানে এসেছে। সত্যি যা হয়েছে তাতে শাহানশাহ্ তো রাগ করতেই পারেন। তাই বুঝি আপনার ওপর হুকুম হয়েছিল শিবাজিকে কিল্লাদার রাদ-আন্দাজ খাঁর হাতে তুলে দেবার?

কে—কে বললে তোমায় এ কথা?

সিদ্দি ফুলাদ-এর হাবসি শ্যামলা মুখ এবার বেগনে হয়ে উঠেছে সত্যিকার রাগে। বচনরামের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছেন, এ সমস্ত মিথ্যা কথা!

তা তো হতেই পারে!বচনরামকে তেমন বিচলিত মনে হয়নি—বাজারে কতরকম বাজে গুজবই তো রটে। এও রটেছে যে, রাদ-আন্দাজ খাঁর জিম্মায় কেল্লার ভেতরে পাঠানো মানেই হল একেবারে শেষ করে দেওয়া। রাদ-আন্দাজ খাঁ নাকি পিশাচদেরও হার মানায় শয়তানিতে আর নিষ্ঠুরতায়। ছোট থেকে বড় হয়েছে সে শুধু এই নৃশংসতার জোরে। আলওয়ারের সনামী সম্প্রদায়কে ঝাড়ে বংশে শেষ করে দেওয়ার পরই নাকি আগ্রায় কিল্লাদারি পেয়েছে। সত্য-মিথ্যে জানি না, তার জিম্মায় শিবাজিকে পাঠানোর খবর পেয়ে কুমার রামসিং নাকি শাহানশাহ্-এর কাছে বলেছেন, তার আগে আমাকে মারবার হুকুম দিন, জাঁহাপনা! আমার বাবা শিবাজিকে অভয় দিয়ে আগ্রা পাঠিয়েছেন। রাজপুতের জবানের দাম তার প্রাণের চেয়ে বেশি। সম্রাট তাতে নাকি কুমার রামসিং-এর কাছে খত চেয়েছেন শিবাজিকে পাহারায় রাখার দায় স্বীকার করে। তাই লিখে দিয়েছেন কুমার। কিন্তু আবার নাকি নতুন ফন্দি হয়েছে শিবাজিকে শেষ করবার। ভারতের পশ্চিম সীমান্তে ইউসুফজাই আর আফ্রিদি বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করবার জন্যে কুমার রামসিং-এর সঙ্গে শিবাজিকে পাঠাবার মতলব হয়েছে। ঠিক হয়েছে, এবারও কাবুলের পথে আগুসার বাহিনীতে থাকবে সেই রাদ-আন্দাজ খাঁ, রাস্তাতেই হঠাৎ দুশমনদের আক্রমণের নাম করে শিবাজিকে যাতে খতম করে ফেলা যায়। কুমার রামসিং-এর জন্যে সে ফন্দিও কাজে লাগানো নাকি যায়নি।

এইসব গুজব আগ্রায় রটে তুমি বলছ।

সিদ্দি ফুলাদ-এর গলা এখন জলদগম্ভীর।

কিন্তু নির্দোষ বলেই বোধহয় বচনরামের ভয়-ডর কিছু নেই। অবিচলিতভাবে বলেছে, তা না হলে আমি আর কোথা থেকে জানব কোতোয়াল সাহেব! হালালখোর দু-চারজন নোকরির দায়ে সব সময়ে আসা-যাওয়া করে। তাদের কাছেই কখনও-সখনও উড়ো গুজব শুনি।

হুঁ! বলে সিদ্দি ফুলাদ কী যেন ভেবে নিয়ে আবার সহজ হয়ে বলেছেন, এ ধরনের খবর পেলে আমায় জানিও। আর গিয়েই ভাল দেখে দু-জন হালালখোর পাঠিয়ে দেবে।

যো হুকুম কোতোয়াল সাহেব! বলে সেলাম করে বচনরাম বেরিয়ে গেছে।

 

৫.

বচনরামের চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারেননি সিদ্দি ফুলাদ। দেউড়িতে বাঁধা তার ঘোড়ার আওয়াজ বাইরের রাস্তায় মিলিয়ে যেতে না যেতে তাঁর তবিনান-এর এক সিপাইকে পাঠিয়েছেন কাটরা-ই-পচার দারোগাকে তলব দিতে। বচনরাম ওই কাপড়ের বাজারের একটি বাড়িতেই থাকে। দারোগা এলে সিদ্দি ফুলাদ তাকে নির্দেশ দিয়েছেন সারা দিনরাত দু-জন হরকরা লাগিয়ে বচনরামের চলাফেরা। সবকিছুর খবর নিতে। দিন দুই এভাবে নজরবন্দি রেখে তৃতীয় দিনেই বচনরামকে ভোরবেলাই যেন কয়েদ করা হয়, এ-ই সিদ্দি ফুলাদ-এর হুকুম।

এ হুকুম দেবার আগে সামান্য একটু দ্বিধা জয় করতে হয়েছে সিদ্দি ফুলাদকে। বচনরামের কাছে একটা ঋণের কথা মন থেকে উড়িয়ে দিতে সময় লেগেছে। এই ঋণটুকুর জন্যেই বচনরামের অনেককিছু এ পর্যন্ত সহ্য করেছেন সিদ্দি ফুলাদ, তাকে একটু আশকারাই দিয়েছেন বলা যায়। কিন্তু এবার দাঁড়ি না টানলে নয়। বচনরাম মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। তা ছাড়া ওই ক্ষয়া-পাতলা অথচ ইস্পাতের মতো মজবুত আর ধারালো মানুষটাকে কেমন যেন ভয়ও হয় আজকাল, ভয় আর সন্দেহ। মানুষটার ভেতর যেন গোলমেলে কিছু আছে। এরকম লোককে সময় থাকতে নিকেশ করে দেওয়াই ভাল। ঋণের কথাটা মন থেকে মুছে ফেলবার জন্যে যুক্তিও একটা খাড়া করেছেন সিদ্দি ফুলাদ। বচনরাম তাঁর আশাতীত উপকার যদি একদিন করে থাকেও, সিদ্দি ফুলাদও তার প্রতিদান দিয়েছেন তাকে মীর-ঈ-ইমারৎ-এর কাজ পাইয়ে দিয়ে। খাঁটি সুন্নি ছাড়া শিয়ারাও সহজে যা পায় না, বিধর্মী হয়ে সেই কাজ কি যথেষ্ট নয়! তাইতেই শোধবোধ হয়ে গেছে অনেক আগে। সুতরাং এখন আর বিবেকের খোঁচা থাকা উচিত নয়। বিশেষ করে সাম্রাজ্যের খাতিরে এসব সন্দেহজনক মানুষের উচিত ব্যবস্থা করতে তিনি বাধ্য।

বচনরামের কাছে ঋণটা যত বড়ই হোক, তার চেয়ে বড় শাহানশাহ্ আওরঙ্গজেব-এর প্রতি তাঁর কর্তব্য।

ঋণটা অবশ্য ছোটোখাটো নয়। বচনরাম না থাকলে তাঁর নয়নের মণি একমাত্র মেয়েকে তিনি আর জীবনে পেতেন না। আর তাহলে আগ্রায় এসে এই একাধারে মীর আতিশ আর শহর-কোতোয়াল হওয়া তাঁর ভাগ্যে কি থাকত!

সে প্রায় তিন বছর আগের কথা। কচ্ছ উপসাগরের মান্দভি বন্দর থেকে মোগল নৌয়ারার দারোগাগিরি ছেড়ে স্ত্রী কন্যা নিয়ে আসছেন আগ্রায়। নামের আগে সিদ্দি থাকলেই জাঞ্জিরার হাবশি রাজবংশের লোক বুঝতে হবে। আর সিদ্দিদের ওপরই ছিল পশ্চিম সমুদ্রের নৌবাহিনীর ভার। সিদ্দি ফুলাদ-এর কিন্তু উচ্চাশা ছিল জল ছেড়ে ডাঙার উচ্চপদে ওঠবার। তাই তিনি চলেছিলেন এক কাফিলার সঙ্গে আগ্রায়।

রাজপুতানার মরুভূমির মধ্যে দিয়ে পথ। চোদ্দোআনা পথ তখন পার হয়ে এসেছেন। হিন্দৌন ছাড়িয়ে আর প্রায় পঁচিশ ক্রোশ যেতে পারলেই আগ্রা। সেখানেই মরুভূমির বালিয়াড়ির মাঝে এক রাত্রে ডাকাতের দল হানা দিয়েছে তাঁদের কাফিলায়। মরুভূমির ধুলোবালির ঝড় সে সময়ে যেন ঈশ্বরের দয়াতেই না উঠলে ধনসম্পদ মানুষজন কিছুই বা কেউই রক্ষা পেত না নিশ্চয়। ঝড়ই সিদ্দি ফুলাদ-এর দলকে সাহায্য করেছে। প্রচণ্ড বালুঝড়ের মধ্যে ডাকাতের দল আর তাদের শিকারদের দুরবস্থা হয়েছে একই। কে কোথায় যে ছিটকে গেছে কেউ জানে না। ঝড় থামবার পর চোখ মেলে চাইবার মতো অবস্থা হলে সিদ্দি ফুলাদ দেখেছেন, ধন-সম্পদ তাঁর বিশেষ কিছু খোয়া যায়নি, কিন্তু যা গেছে তার কাছে দুনিয়ার সম্পদ সিদ্দি ফুলাদ-এর চোখে তুচ্ছ। জাঞ্জিরার শ্রেষ্ঠ সুন্দরী, সিদ্দি ফুলাদ-এর নয়নের মণি, তাঁর কুমারী কন্যারই খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। বালির ঝড়ে সে নিজেই কোথাও কোনও ধূ-ধূ প্রান্তরে ছিটকে গিয়েছে, না দস্যুরাই তাকে হরণ করে নিয়ে গিয়েছে, কে জানে!

সিদ্দি ফুলাদ প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছেন শোকে হতাশায়। তাঁর মনে পড়েছে মান্দভির এক হিন্দু জ্যোতিষীর কথা। নৌবহরের কাজ ছেড়ে আগ্রা রওনা হবার আগে তাঁকে একদিন হাত দেখাতে গেছলেন সিদ্দি ফুলাদ। জানতে চেয়েছিলেন, আগ্রায় যে উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন তা বিফল হবে কি!

না, তা হবে না, বলেছিলেন হিন্দু জ্যোতিষী, অনেক কিছুই পাবেন আগ্রা গিয়ে, উঠবেন অনেক ওপরে। কিন্তু পাবেন যেমন অনেক কিছু, হারাবেনও তেমনই কোনও একটা রত্ন।

একটা রত্ন শুধু? জিজ্ঞাসা করেছিলেন সিদ্দি ফুলাদ।

হ্যাঁ, একটা রত্নই! বলে কীরকম যেন অদ্ভুতভাবে তাঁর দিকে চেয়েছিলেন জ্যোতিষী। তারপর আবার বলেছিলেন, একটা রত্নের বদলে অনেক কিছু পেতে আপনার আপত্তি নেই তা হলে?

সিদ্দি ফুলাদ হেসে বলেছিলেন, না, আপত্তি নেই। একটার জায়গায় অনেক পাব? তো ঠিক?

হ্যাঁ, তা পাবেন! কীরকম একটু রহস্যমেশানো হাসি মুখে মাখিয়ে বলেছিলেন জ্যোতিষী।

সেই একটি রত্ন মানে কি তাঁর প্রাণাধিক এই মেয়ে!

তা যদি জানতেন তাহলে কোনও সৌভাগ্যই তিনি চাইতেন না জীবনে। মান্দভিতে মোগল নৌবাহিনীর একজন অধ্যক্ষ হয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দিতেন।

একটি মাত্র মেয়ে। তার ভবিষ্যতের জন্য ভাবনা তত তাঁর সত্যি কিছু ছিল না। তাঁর নিজের কিছু থাক বা না থাক, ফিরোজা নিজের রূপগুণেই উপযুক্ত আমির-ওমরাহের ঘরে সাদরে সমাদরে জায়গা পেত।

মেয়ে তাঁর সত্যিই অসামান্যা সুন্দরী।

তাঁরা হাবশি, কিন্তু কাফ্রি তো নয়। সত্যি কথা বলতে গেলে, রং একটু ময়লা। হলেও যৌবনে ইরানি তুরানি সুপুরুষরা আভিজাত্য মেশানো দেহসৌষ্ঠবে তাঁর কাছে। দাঁড়াতে পারেনি। তিনি বিয়ে করেছেন আবার আসোয়ান-এর তখনকার ডাকসাইটে মিশরি সুন্দরীকে। ফিরোজা তাই একদিকে বসরার গুলের মতো মধুর আর কোমল,

আর একদিকে বিদ্যুতের চমক দেওয়া দীপ্তি তার রূপে।

কিন্তু এহেন রূপকেও ভুলিয়ে দেয় তার গুণ। ষোলো থেকে এখনও সতেরোয় পা দেয়নি, এরই মধ্যে নিজেদের আম্‌হারিক তো বটেই, তার ওপর আরবি, ফারসি, তুর্কি, এমনকী ভারতবর্ষের সংস্কৃত ভাষা পর্যন্ত, সে ভালরকম শিখেছে। এদেশের। গানবাজনার দিকে তাঁর ঝোঁক একটু বেশি। এমনিতে সে কোকিলকণ্ঠী, তার ওপর জেদ করে বীণা বাজানোও শিখেছে।

মেয়ের এই জেদ-ধরা গোঁ-ই সিদ্দি ফুলাদকে ভাবিত করেছে একটু-আধটু। এই জেদের জন্যেই মেয়েটা ভবিষ্যতে ঘা খাবে না তো! তাই বা খাবে কেন, নিজেকে বুঝিয়েছেন ফুলাদ সাহেব। এমন কিছু অন্যায় জেদ তো সে এখনও ধরেনি। আর যা ধরে তা শেষ পর্যন্ত সফল করেই ছাড়ে। যেমন, সেই তলোয়ার খেলা শেখার ঝোঁক। শুনেই বেগমসাহেবা তো আঁতকে উঠেছিলেন—মেয়েছেলে তলোয়ার খেলতে শিখবে কী। কিন্তু সিদ্দি ফুলাদ তাঁর স্নেহের প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। চারশো বছর আগে এই ভারতবর্ষেই এক মুসলিম মহিলা কি রানি হিসেবে অস্ত্রধারণ করেননি! স্বামীর সঙ্গে যুদ্ধে নেমে পরাজিত হয়ে প্রাণও দিয়েছিলেন। ফিরোজাকে তো আর সেরকম কিছু করতে হবে না। খেয়াল হয়েছে যখন, শিখুক। ফিরোজা তলোয়ার চালানো সত্যিই শিখেছে, এমন শিখেছে যে সিদ্দি ফুলাদ শুধু নয়, ফিরোজার শিক্ষাগুরু বুড়ো ওস্তাদও অবাক হয়ে গেছেন। বেশিদিন এ নেশা থাকেনি এই ভাগ্যি। মেয়ের এ-ধরনের খেয়াল বেশিদিন থাকে না।

এ মেয়ে সম্বন্ধে কত আশা না করেছেন সিদ্দি ফুলাদ, কত স্বপ্নই না দেখেছেন। বড় হবার, ধনী হবার এত যে চেষ্টা এ তো শুধু তারই জন্যে। আগ্রায় যাচ্ছেন। মোগল জাহানের রাজধানীতে আগ্রা শহরের শ্রেষ্ঠ সব পরিবারে তাঁর মেয়ের অসামান্য রূপগুণের খবর চাপা থাকবে না! ফিরোজা তার যোগ্য ঘর বর পাবে।

সব স্বপ্নই কি তাহলে ধূ-ধূ বালুর দেশের মরীচিকা হয়ে গেল?

উদ্ভ্রান্তের মতো সিদ্দি ফুলাদ কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচর নিয়ে মরুভূমির মধ্যে কন্যার সন্ধান করে ফেরেন।

কিন্তু কোথাও তার কোনও চিহ্নও নেই। না তার, না দস্যুদলের কারও।

 

৬.

দ্বিতীয়দিনে সকালবেলা উষার আলোয় রাঙা দিগন্তব্যাপী বালুকা-প্রান্তরে দূরে একজন ঘোড়সওয়ারকে দেখা যায়। ঘোড়সওয়ার ঘোড়া থামিয়ে পাষাণমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে নীচের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে।

ফুলাদ সাহেবের অনুচরেরা চিৎকার করে ওঠে হিংসায় আক্রোশে, ডাকু! ওই একটা ডাকু!

দূর থেকে সওয়ার মুখ তুলে তাকায়। কিন্তু পালাবার কোনও চেষ্টা তার দেখা যায়। যেমন ছিল তেমনই স্থিরভাবেই সে ঘোড়ার ওপর বসে থাকে।

সিদ্দি ফুলাদ আর তাঁর অনুচরেরা ঘোড়া ছুটিয়ে নিয়ে তাকে ঘিরে ধরে।

অনুচরেরা খোলা তলোয়ার নিয়ে তারপর লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গেছে, কিন্তু ডাকুটাকে তাতেও নির্বিকার থাকতে দেখে ফুলাদ সাহেব নিজেই অনুচরদের নিরস্ত করেছেন।

ডাকুটার ব্যবহার সত্যি তাঁর অদ্ভুত লেগেছে। ফুলাদ সাহেব ঘোড়া চেনেন। ডাকুটার ঘোড়া দেখেই তিনি বুঝেছেন, দূর থেকে যখন তাঁদের সাড়া সে পেয়েছিল, ইচ্ছে করলে তখনই সে নিজের ঘোড়া ছুটিয়ে পালাতে পারত। তার ঘোড়ার নাগাল ধরা সিদ্দি ফুলাদের দলের কোনও ঘোড়ার সাধ্যে কুলোত না।

তবু লোকটা পালাবার চেষ্টা তো করেইনি, এমনকী তাঁর অনুচরদের ঝাঁপিয়ে পড়বার উপক্রম করতে দেখেও কোমরের খাপবন্দি তলোয়ারের হাতলে পর্যন্ত হাত বাড়ায়নি।

বিস্ময়ের সঙ্গে রাগ ও বিরক্তি মিশিয়ে সিদ্দি ফুলাদ একটু তিক্ত বিদ্রূপের সুরেই বলেছেন, খুব তোমার সাহস, না? ভেবেছ, সাহস দেখেই আমরা চিনতে ভুল করব?

লোকটা ঠোঁট ফাঁক না করে সামান্য একটু হেসেছে। তারপর সিদ্দি ফুলাদকে উদ্দেশ করেই আবৃত্তি করেছে সুরেলা গলায়—হর কস কি খিয়ানৎ কুন আলবত্তা বতর্সদ। বেচারা নূরী না করে হ্যায় না ডরে হ্যায়।

সিদ্দি ফুলাদ সত্যি চমকে উঠেছেন। আকবরের সভাসদ বিখ্যাত ফৈজির প্রাণের দোস্ত মুল্লা নূরীর এ বিরল কবিতা এই একটা ডাকুর মুখে!

কবিতার মোদ্দা মানে হল—অন্যায় যে করে সেই ভয় পায়, অন্যায় যে করে না তার ভয়ও নেই।

তুমি দস্যুদের কেউ নও! কে তাহলে তুমি! রূঢ়স্বরে জিজ্ঞাসা করেছেন সিদ্দি সাহেব, কিন্তু স্বরটা নিজের অজান্তেই নরম হয়ে এসেছে শেষের দিকে।

এবার লোকটা একটু অবান্তর হলেও আধ্যাত্মিক কবিতাতেই জবাব দিয়েছে। আমির খসরুর একটি চেৎ কবিতার কলি আউড়ে চলেছে–

সব কোয়ি উসকো জানে হৈ
পর এক নহী পহচানে হৈ
আঠ দহড়ী মে লেখা হৈ
ফিকর কিয়া মন-দেখা হৈ।

নিজেই তারপর হেসে উঠে বলেছে, কিছু মনে করবেন না, একটু তত্ত্বকথা বলে ফেললাম। কিন্তু আপনাদের ধরন দেখে মনে হচ্ছে কাউকে মারকাট করে একটা রক্তারক্তি না করলে আপনাদের শান্তি নেই। এ মরুভূমিতে বড় বেয়াড়া সব পোকামাকড় আছে বালির গাদার ভেতরে। তার কোনটা আপনাদের কামড়াচ্ছে জানতে পারি?

লোকটার নির্বিকার ভাব দেখে মনে মনে একটু দ্বিধাগ্রস্তই হয়েছেন সিদ্দি সাহেব। বাইরে তবু রূঢ় গলাটা বজায় রেখে জিজ্ঞাসা করেছেন আবার, ওসব বাজে কথা রেখে আগে বলো, তুমি কে! কী করছ এখানে?।

আমি! লোকটা হেসে বলেছে, ছিলাম সামান্য একজন শিলাদার। আমার মনসবদার ছিলেন হাজারি জাট দো সদ সওয়ার। আর আমি তাঁর দলে বিস্তি। একদিন তাঁর সঙ্গে করার করার অপরাধে তিনি কুড়িজনের বদলে দশজনের সর্দারিতে নামিয়ে বিস্তির জায়গায় মীর-দহ্ করে দেন। সেই দুঃখেই কাজ ছেড়ে মিরাট থেকে গুজরাট যাচ্ছি সেখানে যদি ভাগ্য ফেরাতে পারি।

লোকটার চেহারা, পোশাক ও ঘোড়াটাকে লক্ষ করে তার কথাটা খুব অবিশ্বাস। করতে পারেননি সিদ্দি ফুলাদ।

কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে করছিলে কী নীচের বালির দিকে চেয়ে?

সন্দেহের চেয়ে সরল কৌতূহলই বেশি ছিল তাঁর জিজ্ঞাসায়।

এখানে বালিতে লেখা একটা অদ্ভুত গল্প পড়ছিলাম! গম্ভীর মুখেই বলেছে লোকটা।

বালিতে লেখা গল্প! লোকটার পরিহাস করার স্পর্ধায় সিদ্দি আগুন হয়ে উঠেছেন আবার।

মিছে গরম হবেন না। লোকটি শান্ত গম্ভীর স্বরে বলেছে, কাল রাত্রেই এখানে একটা নাটকীয় ব্যাপার ঘটেছে, বালিতে তার চিহ্ন এখনও মোছেনি। সেই চিহ্নগুলোই পড়ছিলাম।

চিহ্নগুলো কী নাটকীয় ব্যাপার জানাচ্ছে? উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন সিদ্দি ফুলাদ।

জানাচ্ছে যে, এখানে বালির ওপর একটা দ্বন্দ্বযুদ্ধ গোছের হয়ে গেছে। একজন। লম্বা-চওড়া জোয়ান আর একজন বালক বলেই মনে হয়। লড়াইটা তলোয়ার নিয়েই হয়েছে, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, তাতে জোয়ান মর্দকে হারিয়ে ছেলেটি ঘোড়ায় চড়ে পালিয়ে গেছে। এই দেখুন, দুজনের লড়াই-এর ঘোরাফেরার দাগ। ওই দেখুন একটা পাগড়ির টুকরো। তলোয়ারের কোপে কাটা হয়ে মাটিতে পড়েছে। তারপর ওখানে দেখুন হালকা ছেলেমানুষের পায়ের দাগ ঘোড়ার খুরের দাগে গিয়ে মিলেছে। তারপর ঘোড়া ছুটিয়েই সে পালিয়ে গেছে। এই দেখুন তার পেছনে ভারী নাগরার। দাগ। সে দাগ এইখানে এসে থেমেছে, তারপর আবার ফিরে গিয়ে আর-এক ঘোড়ার খুরের দাগের সঙ্গে মিশেছে। জোয়ান মর্দটা ছেলেমানুষটিকেই ঘোড়ায় চড়ে এবার অনুসরণ করেছে বোঝা যাচ্ছে।

ফিরোজা! নিশ্চয় আমার ফিরোজা! চিৎকার করে উঠেছেন সিদ্দি ফুলাদ।

ফিরোজা! কে ফিরোজা? অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছে অচেনা ভূতপূর্ব শিলাদার।

ফিরোজা আমার মেয়ে! আমার একমাত্র মেয়ে! আর্তকণ্ঠে বলেছেন ফুলাদ সাহেব, তোমার কথা যদি সত্য হয় তাহলে এখনও সে বেঁচে আছে। তবে যে-দস্যুরা। আমাদের কাফিলায় হানা দিয়েছিল তাদেরই কেউ এখনও তাকে অনুসরণ করছে। নিশ্চয়। আমার মেয়েকে যদি উদ্ধার করতে পারো তাহলে

তাহলে দেবার মতো আপনার এমন কিছুই নেই যার লোভ দেখাতে পারেন। শিলান্দার হেসে বলেছে, সুতরাং ও সব আশা দিয়ে আপনার মেয়ের একটু বর্ণনা দিন।

বেশ একটু ক্ষুব্ধ হলেও সিদ্দি ফুলাদ তা-ই দিয়েছেন।

শিলাদার তা শুনে একটু চিন্তিতভাবে বলেছে, ব্যাপারটা খুব সহজ মনে হচ্ছে।। বোঝা যাচ্ছে এই ডাকুর দলের কেউ-ই আপনার মেয়ের পেছনে লেগে আছে। তাকে এড়াতে গিয়ে আবার সে-দলের কবলে যদি আপনার মেয়ে পড়ে তাহলে তাদের হদিস পেলেও গায়ের জোরে লড়াই করে আপনার মেয়েকে উদ্ধার করা যাবে। না। কারণ আপনার অনুচর তো মাত্র এই ক-টি, আর সঙ্গে আছি মাত্র আমি। সুতরাং উদ্ধার করতে বাহুবলের সঙ্গে বুদ্ধিও খাটাতে হবে।

শিলাদার লোকটি তারপর ঘোড়া ছুটিয়ে একাই মরুপ্রান্তরের ওপর দিয়ে দিগন্ত ছাড়িয়ে চলে গেছে।

সিদ্দি ফুলাদ আর তাঁর অনুচরেরা তার সঙ্গে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু তাতে ফল খারাপ হতে পারে বলে সে বারণ করেছে।

 

৭.

শিলাদারের কথা তখন মেনে নিলেও নিজেদের কাফিলার দিকে ফিরতে ফিরতে সিদ্দি ফুলাদ-এর মনে সন্দেহ জেগেছিল।

ওই একটা অজানা অচেনা সওয়ার তাঁকে মিথ্যে ধাপ্পাই কি দিয়ে গেল! তার কথায়। বিশ্বাস করা কি ঠিক হয়েছে!

কিন্তু বিশ্বাস না করেই বা কী করতে পারতেন! লোকটা ডাকুদের কেউ হলে। অতি-বড় ধড়িবাজ অভিনেতা বলতে হবে। সেই সঙ্গে কিছু বিদ্যে আর রসকষও আছে। কবিতার কলি আবৃত্তি থেকেই তা বোঝা গেছে। প্রথমে তার ওপর যে সন্দেহটা হয়েছিল তা সে কথাবার্তায় ব্যবহারে দূর করে দিয়েছে। সন্দেহটা আলগা হবার পর তাকে আর মারধোর করা তো যায় না। লোকটা বালিতে তখন যে সব চিহ্ন দেখিয়ে তার অর্থ বুঝিয়েছিল, সেগুলি আজগুবি বলেও মনে হয়নি। লোকটা যদি ঠকবাজ হয় তাহলে তা মেনে নিয়ে নিজেদেরই যা খোঁজবার খুঁজতে হবে। সে সুযোগ তো সে কেড়ে নিয়ে যায়নি। কিন্তু খুঁজবেন কোথায়?

বেলা বাড়ার সঙ্গে সমস্ত মরুভূমি বিরাট তপ্ত বালির তাওয়া হয়ে ওঠে। চোখের ওপর দিকচক্রবাল তখন প্রচণ্ড তাপে যেন কাঁপতে থাকে। যেদিকে তাকাও শুধু ধূ ধূ শূন্যতা। এর মধ্যে কোথায় পাবেন তাঁর হারানো মেয়ের সন্ধান?

তিন দিনের অবিরাম ছোটাছুটিতে, অমানুষিক পরিশ্রমের ক্লান্তিতে হতাশায় সিদ্দি ফুলাদ এবার একেবারে ভেঙে পড়ে প্রায় বেহুঁশ হয়ে গেছেন মরুভূমির হলকা-লাগা জ্বরে।

সেই রাত্রেই তাঁর মেয়ে ফিরে এসেছে। এনেছে সেই শিলাদার অজানা সওয়ার। কী করে কোথা থেকে ফিরোজাকে সে উদ্ধার করেছে তা সে কিছুই বলেনি। সিদ্দি ফুলাদও তখন জানতে চাননি। প্রাণের প্রাণ মেয়েকে ফিরে পেয়েই তিনি তখন আনন্দে অধীর। মন্ত্রবলে যেন সুস্থও হয়ে উঠেছেন। সিদ্দি বংশের পরমাসুন্দরী যুবতী। মেয়ের, কে জানে, ক-দিন ক-রাত একত্র থেকে একই ঘোড়ার পিঠে অপরিচিত অনাত্মীয় একজন যুবাপুরুষের সামনে বসে জনহীন মরুপ্রান্তরের ভেতর দিয়ে আসার মতো অবিশ্বাস্য ব্যাপারে চরম ইজ্জতহানির আতঙ্কে তটস্থ হতেও ভুলে গেছেন।

সত্যি কথা বলতে গেলে নিজের অগোচরে মনের ভেতর একটা বাসনা তাঁর জেগেছিল। হলই বা সামান্য শিলাদার, তার ভবিষ্যৎ কী হবে কে বলতে পারে! কুড়িজনের সর্দারি বিস্তি থেকে দশজনের নায়ক মীর-দতে নামিয়ে দিয়েছিল বটে, তবু সরকারের দেওয়া ঘোড়া হাতিয়ার নিয়ে কম মাইনের সওয়ার-সিপাই যারা হয় সেই পাশা তো নয়, নিজের ঘোড়া আর হাতিয়ার নিয়ে যারা অনেক বেশি তঙ্খার ফৌজি হয়—সেই শিলাদার। আর মীর-দহতে নামলেও আবার একদিন দহ-হাজারিতে যে উঠবে না, কে বলতে পারে!

শিলাদারের চেহারাটাও তাঁর ভাল লেগেছে। লম্বা-চওড়া জোয়ান নয়, একটু রোগা-পাতলাই মনে হয় বরং, কিন্তু একেবারে যেন ইস্পাতের ফলা। আর মুখোনা একটু যেন আলাদা ছাঁচের। কোথায় যেন এ মুখ তিনি দেখেছেন বলেও তাঁর মনে হয়েছে। ইরানি তুরানি হাবশি ধাঁচের মুখ নয়, তা থেকে আলাদা যেখানে তাঁদের আদিবাস, সেই জাঞ্জিরায় থাকবার সময়ই রত্নগিরি না কোথায় একবার গিয়ে প্রায় হুবহু এই ছাঁচের মুখ যেন দেখেছিলেন, ঠিক স্মরণ করতে পারেননি।

সামান্য শিলাদার হয়ে সন্তুষ্ট থাকবার মানুষ যে সে নয়, লোকটার চেহারা-চরিত্র দেখেই বোঝা যায়। সিদ্দি ফুলাদ পেছনে থেকে তাকে যথাসাধ্য সাহায্য করতে প্রস্তুত। ফিরোজার ভাবগতিক যদি তিনি কিছু বুঝে থাকেন তাহলে উদ্ধারকর্তার প্রতি সে বিরূপ নয় বলেই মনে হয়। না, জুটি তাদের খুব বেমানান হবে না। আর এদের দুজনকে মিলিয়ে দিতে পারলে মরুভূমির বিশ্রী ব্যাপারটা আর বিশ্রী থাকবে না। তার কালিমাই রঙে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।

কিন্তু সব পরিকল্পনা অমনভাবে ভেস্তে যাবে তিনি ভাবতে পারেননি। চালচলন দেখে আর আবৃত্তি করা শায়েরিতে চোস্ত ফারসি আরবি জবান শুনে যা ভেবেছিলেন, আগ্রায় পৌঁছোবার পর বচনরাম নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গেই সে ধারণা চুরমার হয়ে বুকে বড় বেজেছে।

মন থেকে তখনই বচনরামকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন। মেয়েকে উদ্ধার করার ঋণশোধ হিসেবে নিজে প্রথম মীর আতিশ হবার পরই বচনরামকে একটা কাজ জুটিয়ে দিয়েছেন। সেই কাজই বচনরামের মীর-ঈ-ইমার হবার পথে প্রথম ধাপ হয়েছে। বচনরামকে কোতল করবার হুকুম দেওয়ার সময় সিদ্দি ফুলাদ তাই শোধবোধ ওইভাবেই হয়ে গেছে বলে মনের বেয়াড়া কাঁটাটা চাপা দিতে পেরেছিলেন।

বচনরাম কিন্তু ধরা পড়েনি। ধরা পড়া দূরে থাক, শহর-কোতোয়ালের বাড়ি থেকে সে যে কোথায় গেছে তারই কোনও হদিস পাওয়া যায়নি। মহল্লার দারোগা দু-দিন তার কাটরা-ই-পর্চার বাসার কাছে ওত পেতে থেকে শেষ পর্যন্ত তার বিফলতার কথা সিদ্দি ফুলাদকে জানিয়েছে। শহর-কোতোয়ালের লাগানো হরকরারাও বচনরামের কোনও খবর আনতে পারেনি।

ইতিমধ্যে আর ক-টা এমন ব্যাপার ঘটেছে যা জানতে পারলে সিদ্দি ফুলাদ আরও। বিচলিত হতেন। কিন্তু এ খবর জেনেছেন শুধু কুমার রামসিং তার বিশ্বস্ত মুনশি গিরধরলালের কাছে। তিনি অবশ্য উচ্চবাচ্য করে এ খবর একেবারে চেপে গেছেন। কিন্তু বেশ একটু বিমূঢ়ই হয়েছেন ভেতরে ভেতরে।

 

৮.

খবরটা সত্যই অদ্ভুত। সকালেই মুনশিজি ফ্যাকাশে মুখে আগ্রা প্রাসাদের পূর্ব প্রাকারের ঝরোকা-ই-দর্শনের নীচে কুমার রামসিং-এর খোঁজে এসেছেন। আওরঙ্গজেব তখনও এই বারান্দায় প্রতি সকালে প্রজাদের দেখা দেওয়ার রেওয়াজ উঠিয়ে দেননি। সূর্যোদয়ের মিনিট পঁয়তাল্লিশ বাদে প্রতিদিন তিনি ওই ঝরোকা-ই-দর্শনে প্রজাদের দর্শন দিয়ে সেখানেই আধঘণ্টার ওপর সময় দেওয়ান-ই-আম-এ যারা ঢুকতে পায় না, সেই অতি-সাধারণ প্রজাদের আর্জিনালিশ শোনেন।

সেদিন সম্রাট তখনও ঝরোকায় এসে পৌঁছোননি। সম্রাটকে নিত্য দেখা যারা ধর্মের অনুষ্ঠান করে তুলেছে, প্রভাতে তাঁর মুখ না দেখে যারা জলগ্রহণ করে না, সেই দর্শনীয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা বারান্দার নীচে যমুনা-তীরের বালুকা প্রান্তরে ঊর্ধ্বমুখ হয়ে আছে সম্রাটের আবির্ভাবের প্রতীক্ষায়। সেদিন সকালে কুমার রামসিং-এর চৌকি ছিল বলে তিনিও সম্রাটের দেখা দেওয়ার অপেক্ষায় বাইরে অনুচর সমেত তৈরি হয়ে আছেন।

মুনশি গিরধরলাল তাঁর কাছে গিয়ে প্রথমেই উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞাসা করেছেন, খারাপ খবর কিছু নেই তো?

কুমার রামসিং বেশ অবাকই হয়েছেন। গিরধরলালের হঠাৎ মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি! নইলে কথা নেই বার্তা নেই, সাত-সকালে এই ঝরোকা-ই-দর্শন-এ এসে এরকম আহাম্মকের মতো প্রশ্ন করার মানে কী?

খারাপ খবর থাকবে কেন? কীসের খারাপ খবর? গিরধরলালের ফ্যাকাশে মুখ আর ভীত দৃষ্টি লক্ষ করে তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন।

এবার মুনশিজি একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে মুনিবকে সেই অদ্ভুত ঘটনাটা সবিস্তারে জানিয়েছেন। গত রাত্রে ফৌজদার আলি কুলীর সঙ্গে একটা মুশায়েরা থেকে ফিরছিলেন। তখনকার আগ্রা কেন, কোনও শহরেই রাস্তায় আলো দেবার কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। নেহাত প্রাসাদের তোরণে, দু-একটা সরকারি দোকানে আর কোতোয়ালি চবুতরায় রাত্রে আলো জ্বলত। এ বাদে কোথাও সিপাইদের ঘাঁটিতে বা কোথাও আমির-ওমরাহ-এর বাড়িতে তেলের আলো বা মশাল জ্বালা হত। আলি কুলীর সঙ্গে গল্প করে ফিরতে ফিরতে খাস বাজারের পাশে একেবারে কোতোয়ালি চবুতরার কাছেই সেখানকার আলোয় একজনকে দেখে মুনশিজি একেবারে থ হয়ে যান। ফৌজদার আলি কুলীও তাকে দেখেছে। কিন্তু সে তো চেনে না! সে গিরধরলালের যেন ভূত দেখার মতো থমকে থামা দেখেই অবাক হয়ে যায়।

ভূত দেখলে নাকি, মুনশিজি! আলি কুলী ঠাট্টার সুর দিতে গিয়েও একটু বিস্মিত কণ্ঠেই জিজ্ঞাসা করেছে।

না, ও কিছু নয়!

ব্যাপারটা হালকা করে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে মুনশিজি আবার হাঁটতে শুরু করেছেন।

লোকটাও মুনশিজিকে দেখে একটু যেন থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। চবুতরায় জ্বলা বাতির আলোয় তখন তাকে ভালভাবেই দেখা গেছে। তারপর হন হন করে হেঁটে সে আলোর পরিধি ছাড়িয়ে আবার দূরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। গিরধরলাল তখনই একটা কিছু করতে পারতেন। কিন্তু ব্যাপারটা এমন অবিশ্বাস্য যে, নিজের চোখের ভুল মনে করে মিছে কেলেঙ্কারির ভয়ে কাউকে কিছু আর জানাতে সাহস করেননি। আলি কুলীর কাছে এক জায়গায় বিদায় নিয়ে সেই রাত্রেই অন্ধকার শহরের এক প্রান্ত থেকে আর-এক প্রান্তে কুমার রামসিং-এর বাড়িই গেছেন তাঁকে ব্যাপারটা জানাতে।

কিন্তু সেখানে মীর আতিশ শহর-কোতোয়াল সিদ্দি ফুলাদ-এর রক্ষীদল তোপ বন্দুক নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। সিদ্দি ফুলাদ নিজে উপস্থিত থাকলে হয়তো ভেতরে যাবার অনুমতি পেতেন, কিন্তু শহর-কোতোয়ালের অধীন থানাদার তা দেয়নি।

বিফল হয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে গিরধরলালকে। সারারাত তারপর ঘুমোতে পারেননি। সেদিন সকালে কেল্লার বাইরে তাঁর প্রভু কুমার রামসিং-এর চৌকি জেনে ভোর না হতেই সেখানে ছুটে এসেছেন তাঁর কাছে।

মুনশিজির মুখে সব শুনে কুমার রামসিং-ও এ ব্যাপারে তাজ্জব বনে গেছেন। তিনিই এবার বিমূঢ় হয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন মুনশিজিকে, আপনি শিবাজি ভোঁসলেকেই দেখেছেন বলছেন! দেখার ভুল হয়নি তো?

তা হতে পারে কুমার সাহেব! মুনশিজি দিশাহারাভাবে বলেছেন, কিন্তু আমি স্পষ্ট শিবাজি ভোঁসলেকেই দেখেছি। ও মুখ তো আমার মনে ছাপা। একটা গোটা দিন তাঁর সঙ্গে কাটিয়ে তাঁকে আগ্রা নিয়ে এসেছি এই আমিই। তাই ভয় পেয়ে কাল রাত্রেই আপনার কাছে ছুটে গেছলাম। দেখা করতে না পেরে আজ ভোরেই আবার এসেছি। আপনি তো চৌকিতে আসবার আগেই শিবাজির শিবির হয়ে এসেছেন!

তা এসেছি! চিন্তিতভাবে বলেছেন কুমার, নিজের চোখে দেখেও এসেছি তাঁকে। উনি কিছুদিন ধরে অসুখের মানত হিসেবে রোজ ভারে ভারে মিঠাই-মণ্ডা, ফলমূল নানা মন্দিরে আর ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত, সাধু-সন্ন্যাসীকে পাঠাচ্ছেন, জানো তো! অসুখ সত্ত্বেও ভোরে উঠে পূজা-পাঠ সেরে তারই ব্যবস্থা করেন। কাল রাত্রের ব্যাপারটার কোনও মানে পাচ্ছি না, কিন্তু আজ ভোরে স্বচক্ষে তাঁকে দেখে এসেছি।

সেদিন চৌকি সেরে অত্যন্ত দুর্ভাবনা মাথায় নিয়ে কুমার বাড়ি ফিরেছেন। যত আজগুবিই মনে হোক, সাবধানের বিনাশ নেই বলে কুমার তাঁর নিজের অনুচরদের পাহারা আরও কড়া করেছেন। দণ্ডে দণ্ডে তারা শিবাজির খবর নেবে। রাত্রে পর্যন্ত ঘুরে আসবে তাঁর শোবার ঘর।

পরামর্শ করবার জন্যে শহর-কোতোয়াল সিদ্দি ফুলাদকে বিশ্বাস করে ব্যাপারটা জানাবার কথা একবার ভেবেছেন। কিন্তু তার সুবিধে হয়নি। ফুলাদ সাহেব দু-দিন ধরে নাকি কোতোয়ালিতে আসছেন না। শিবাজির শিবির পাহারা দেবার অমন গুরু দায়িত্বও তাঁর অধীন থানাদারের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। হয়তো হঠাৎ অসুস্থই হয়েছেন কোতোয়ালের সাহেব—ভেবেছেন কুমার রামসিং।

সিদ্দি ফুলাদ-এর অসুখ কিন্তু হয়নি। হয়েছে তার চেয়ে অনেক দারুণ কিছু। তাঁর পাগল হতে আর বাকি নেই। সেই অবস্থাই তাঁর হয়েছে, যা হয়েছিল রাজপুতানার মরুতে প্রথম আগ্রা আসবার পথে মরুর ঝড় আর দস্যুদের হানার পর।

তখনকার মতোই তাঁর নয়নের মণি ফিরোজাকে হঠাৎ আর পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ কে যেন অন্দরমহলের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ও পাহারা তুচ্ছ করে তাকে হাওয়ার মতো অদৃশ্য করে নিয়ে চলে গেছে।

সেবারে এই বিপদে দেবদূতের মতো দেখা দিয়ে কন্যাকে যে উদ্ধার করে এনেছিল সেই বচনরাম নিজেও নিরুদ্দেশ।

পারিবারিক এ চরম লজ্জাকর ব্যাপারের কথা কাউকে জানাবারও নয়। সিদ্দি ফুলাদ সমস্ত কাজকর্ম ছেড়ে একাই সারা শহর খুঁজে বেড়িয়েছেন দিনরাত্রি। কিন্তু বৃথাই।

 

৯.

এরই মধ্যে এসেছে ষোলোশো ছেষট্টি সালের উনিশে আগস্ট তারিখ!

আগ্রা আর সেই সঙ্গে মোগল সাম্রাজ্যের ভিত্তি যা টলিয়ে দিয়েছিল ওই তারিখে, আগ্রার কেউ কিন্তু তার কোনও আভাস পায়নি।

শিবাজি একটু বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে শয্যাগত হয়েছেন এই কথাই সকলে জেনেছে। প্রহরীরা তাঁকে বিছানায় শায়িত অবস্থায় দেখেও গেছে। গায়ে লেপ ঢাকা। তার ভেতর দিয়ে শিবাজির বিশেষ সোনার কঙ্কণ পরা হাতটা দেখলেই চেনা যায়।

সন্ধ্যার সময় যথারীতি মিষ্টান্নের ভারাগুলি বাহকেরা বয়ে নিয়ে গেছে বাইরে। গোড়ায় গোড়ায় নিত্য পরীক্ষা করে দেখলেও রক্ষীরা এখন আর তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। তারা মিষ্টান্নের ভারীদের বাধা দেয়নি।

শিবাজির ঘরে রাত্রেও কুমার রামসিং-এর অনুচরেরা এসে তদারক করে গেছে। শিবাজির সোনার কঙ্কণ পরা সেই হাত দেখেই তারা আশ্বস্ত হয়েছে। তারা দেখেছে। একজন চাকর শয্যাপ্রান্তে বসে শিবাজির পদসেবা করছে। পরের দিন সকালে আটটা নাগাদ শিবাজির সৎভাই চাকরটিকে নিয়ে শিবির থেকে বেরিয়ে গেছেন। যাবার সময় সকলকে সাবধান করে গেছেন, অসুস্থ শিবাজিকে যেন বিরক্ত না করা হয়। .

কেউ তা করেনি। কিন্তু ক্রমশ প্রহরীরা সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছে শিবাজির শিবির, অস্বাভাবিক রকম শান্ত দেখে। শিবাজির দর্শনার্থীদের কোনও ভিড়ই না থাকাটা বেশ সন্দেহজনক।

শিবাজি যে তাঁর ছেলে শম্ভজিকে নিয়ে পালিয়েছেন তা ধরা পড়েছে সকাল দশটা নাগাদ। হুলস্থুল পড়ে গেছে শহরে সম্রাটের দরবারে। যেমন করে তোক শিবাজিকে ধরতেই হবে আবার।

কিন্তু ধরবে কোথায়? মালোয়া খাণ্ডেশের ভেতর দিয়েই নিজের রাজ্যে পালাবার চেষ্টা করা শিবাজির পক্ষে স্বাভাবিক। সে দিকেই অনুসরণ করবার দ্রুত ব্যবস্থা যখন হচ্ছে তখনই মথুরায় হঠাৎ শিবাজিকে তাঁর ছেলে সমেত দেখতে পাওয়ার খবরে সব. গোলমাল হয়ে গেছে।

মালোয়ার দিকে অনুসরণ তাতে একটু হয়তো বিলম্বিত হয়ে থাকবে। উত্তর দক্ষিণ এবং তারপর পূর্বদিকে কিন্তু অক্লান্তভাবে অনুসন্ধান চালানো হয়েছে। মাঝে মাঝে শিবাজির যা খবর এসেছে তা কিন্তু পূর্বদিক থেকেই, কখনও ইলাহাবাদে কখনও বারাণসীধামে কখনও গয়ায়, এমনকী এদিকে পুরী আর ওদিকে গোদাবরী তীরের গ্রামে পর্যন্ত শিবাজিকে দেখেছে বলে অনেকে দাবি করে পাঠিয়েছে।

শিবাজির সঙ্গে একটি বালককেও দেখা গেছে। সে বালক শম্ভুজি ছাড়া আর কে হতে পারে। বালকটিও সামান্য নয়। এক জায়গায় ঘোড়া কেনবার ব্যাপারে বচসা হওয়ায় নগররক্ষীরা এসেছে শিবাজি আর ছেলেটিকে গ্রেফতার করতে। শিবাজি শুধু নয়, সেই ছেলেটিও হঠাৎ তলোয়ার খুলে দাঁড়িয়েছে। রক্ষীরা সংখ্যায় অনেক বশি। কিন্তু অসি-যুদ্ধে তাদের শুধু প্রাণটুকু রেখে দিয়ে নাকালের একশেষ করে শিবাজি আর ছেলেটি নিজেদের মুক্ত করে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেছে।

এসব কাহিনী আগ্রায় পৌঁছে আওরঙ্গজেবকে যদি দিশাহারা করে থাকে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। এদিকে দক্ষিণ থেকে যখন গুপ্তচরের খবর আসছে যে শিবাজি তাঁর রাজধানীতে পৌঁছে গেছেন, তখনও বিশ্বস্ত হরকরা মারফত পুব দিক থেকেও শিবাজির সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে।

সত্যি তাহলে কোনটা?

আওরঙ্গজেব তা নির্ধারণ করতে পারেননি। সঠিকভাবে ঐতিহাসিকরাও পারেননি জয়পুরের দপ্তরখানায় পুরনো ডিঙ্গল পত্রগুলি আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত। এ চিঠিগুলি অমূল্য। কুমার রামসিং-এর সভাসদেরা প্রতিদিনের একেবারে টাটকা খবর, এমনকী কথাবার্তার বিবরণ পর্যন্ত রাজস্থানের কথ্য ডিঙ্গল ভাষায় লিখে পাঠিয়েছে। রাত্রের লেখা চিঠি পরের দিন সকালেই চলে গেছে উটের ডাকে।

এসব চিঠি থেকে শিবাজি যে আগ্রা থেকে রাজগড়ের সরলরেখার দূরত্ব ছ-শো সত্তর মাইল দিনে অন্তত চল্লিশ মাইল ঘোড়া চালিয়ে মোট পঁচিশ দিনে পার হয়েছিলেন তা নির্ভুলভাবে প্রমাণিত হয়েছে। শিবাজির মতো অসামান্য বীরের পক্ষে কাজটা অসাধ্যও নয়। তাঁর বয়স তখনও চল্লিশ হয়নি।

শিবাজির আগ্রা থেকে পালাবার সঠিক রাস্তা জানবার পর প্রশ্ন থেকে যায়, মথুরা ইলাহাবাদ বারাণসী ইত্যাদি জায়গায় তাহলে শিবাজির মতো কাকে দেখা গেছে। তার সঙ্গে বালকটিই বা কে!

সুরাটের ব্রাহ্মণ চিকিৎসক নাভাকে সত্যিকার ওই ধনরত্ন তাহলে কে দিয়েছিলেন? স্বয়ং শিবাজি রাজগড় থেকে গোদাবরী তীরের গ্রামের সেই কৃষক-জননীকে সত্যিই ডেকে পাঠিয়ে তার অভিযোগের প্রতিকার করেছিলেন কেন?

 

দাসমশাই থামলেন।

মস্তক যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ সেই শিবপদবাবু বলে উঠলেন, তার মানে আপনি বলতে চান, ওই আপনার পূর্বপুরুষ বচনরামই শিবাজি সেজে উত্তর আর পুব দিকে গিয়ে মোগলদের ধোঁকা দিয়েছিলেন।

না, ঘনশ্যাম দাস অনুকম্পাভরে বললেন, তবে কৃষ্ণাজি অনন্ত সভাসদের শিব-ছত্রপতি-চেন চরিত্র-এর মতো আর-একটি যে অমূল্য মারাঠি বখর হারিয়ে গেছে তা খুঁজে পাওয়া গেলে এই বিবরণই পাওয়া যাবে।

সে বিবরণ কে লিখে গেছলেন? সেই বচনরাম? শ্রদ্ধাবিগলিত স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন শিরোশোভা যাঁর কাশের মতো শুভ্র সেই হরিসাধনবাবু।

হ্যাঁ, তিনিই লিখে গেছলেন—শিবাজির সঙ্গে তাঁর চেহারায় মিলের কথা জানতে পারার পর কীভাবে ওই ফন্দি এঁটে তিনি কাজে লাগান। শহর-কোতোয়াল সিদ্দি ফুলাদও এই মিলটাই লক্ষ করেছিলেন, শুধু মিলটা কার সঙ্গে তা স্মরণ করতে পারেননি তখন!

ঘনশ্যাম দাস ওঠবার উপক্রম করলেন।

কিন্তু ওই ফিরোজাবিবি! ব্যাকুলভাবে বলে উঠলেন মেদভারে হস্তীর মতো যাঁর বিপুল দেহ সেই ভবতারণবাবু, তার কী হলো তা কি জানা গেছে? সে কি ফিরেছে তার বাবার কাছে?

ফেরেনি বলেই তো জানি!—একটু রহস্যময় হাসি যেন ফুটে উঠল ঘনশ্যাম দাসের মুখে, সে মুখে হাসি ফোটা যদি সম্ভব হয়—কে জানে, নকল শিবাজির সঙ্গে যাকে বালকঘেশে দেখা গেছে সে কে?

দাস হলেন ঘনাদা

১.

না, তস্য তস্য!

বললেন শ্রীঘনশ্যাম দাস, ঘনাদা নামে যিনি কোনও কোনও মহলে পরিচিত।

এ উক্তির আনুপূর্ব বোঝাতে একটু পিছিয়ে যেতে হবে এ কাহিনীর। স্থান-কাল-পাত্রও একটু বিশদ করা প্রয়োজন।

স্থান এই কলকাতা শহরেরই প্রান্তবর্তী একটি বৃহৎ কৃত্রিম জলাশয়, করুণ আত্মছলনায় যাকে আমরা হ্রদ বলে অভিহিত করে থাকি। জীবনে যাদের কোনও উদ্দেশ্য নেই, অথবা কোনও উদ্দেশ্যেরই একমাত্র অনুসরণে যারা পরিশ্রান্ত, উভয় জাতির নানা বয়সের স্ত্রী-পুরুষ নাগরিক প্রতি সন্ধ্যায় এই জলাশয়ের চারিধারে এসে নিজ নিজ রুচি প্রবৃত্তি অনুযায়ী স্বাস্থ্য অর্থ কাম মোক্ষ এই চতুর্বর্গের সাধনায় একা, একা বা দল বেঁধে ভ্রমণ করে উপবিষ্ট হয়।

এই জলাশয়ের দক্ষিণ তীরে একটি নাতিবৃহৎ বৃক্ষকে কেন্দ্র করে কয়েকটি আসন বৃত্তাকারে পাতা। সেই আসনগুলিতে আবহাওয়া অনুকূল থাকলে প্রায় প্রতিদিনই পাঁচটি প্রবীণ নাগরিককে একত্র দেখা যায়।

এ কাহিনী সূচনার পাত্র এঁরাই। তাঁদের একজনের শিরোশোভা কাশের মতো শুভ্র, দ্বিতীয়ের মস্তক মর্মরের মতো মসৃণ, তৃতীয়ের উদর কুম্ভের মতো স্ফীত, চতুর্থ মেদভারে হস্তীর মতো বিপুল এবং পঞ্চম জন উষ্ট্রের মতো শীর্ণ ও সামঞ্জস্যহীন।

প্রতি সন্ধ্যায় এই পঞ্চ সভাসদের অন্তত চারজনকে এই বিশ্রাম-আসনে নিয়মিতভাবে সমবেত হতে দেখা যায় এবং আকাশের আলো বিলীন হয়ে জলাশয়ের চারিপার্শ্বের আলো জ্বলে ওঠার পর ফেরিওয়ালাদের ডাক বিরল না হওয়া অবধি স্বাস্থ্য থেকে সাম্রাজ্যবাদ ও বাজারদর থেকে বেদান্তদর্শন পর্যন্ত যাবতীয় বিষয় ও তত্ত্ব তাঁরা আলোচনা করে থাকেন।

এ সমাবেশের প্রাণ হলেন শ্রীঘনশ্যাম দাস, প্রাণান্তও বলা যায়।

এ আসর কবে থেকে তিনি অলংকৃত করছেন ঠিক বলা যায় না, তবে তাঁর আবির্ভাবের পর থেকে এ সভার প্রকৃতি ও সুর সম্পূর্ণ পরিবর্তিত। কুম্ভের মতো যাঁর উদরদেশ স্ফীত সেই ভোজনবিলাসী রামশরণবাবু আগেকার মতো তাঁর রুচিকর রন্ধন-শিল্প নিয়ে সবিস্তারে কিছু বলবার সুযোগ পান না। মস্তক যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ সেই ভূতপূর্ব ইতিহাসের অধ্যাপক শিবপদবাবু ঐতিহাসিক বিষয় নিয়েও নিজের মতামত জ্ঞাপন করতে দ্বিধা করেন।

কারণ, শ্রীঘনশ্যাম দাস সম্বন্ধে সবাই সন্ত্রস্ত। কোথা থেকে কী অশ্রুতপূর্ব উল্লেখ ও উদ্ভট উদ্ধৃতি দিয়ে বসবেন, নিজেদের অজ্ঞতা প্রকাশের আশঙ্কাতেই যার প্রতিবাদ করতে পারতপক্ষে কেউ প্রস্তুত নন।

মেদভারে হস্তীর মত যিনি বিপুল সেই সদাপ্রসন্ন ভবতারণবাবু সেদিন কী। কুক্ষণে ঐতিহাসিক উপন্যাসের কথা তুলেছিলেন!

ভবতারণবাবু নির্বিবাদী নিপাট ভালোমানুষ। সরকারি পূর্ত বিভাগে মাঝারি স্তরে কী একটা আয়েসি চাকরি করতেন। কয়েক বছর হল রিটায়ার করেছেন। ধর্মকর্ম এবং নির্বিচারে যাবতীয় মুদ্রিত গল্প উপন্যাস পড়াই এখন তাঁর কাজ।

এ সভায় বেশিরভাগ সময়ে ভবতারণবাবু নীরব শ্রোতা হিসাবেই বিরাজ করেন। এই দিনে আলোচনায় একবার ঢিল পড়ায় কী খেয়ালে নিজের দুর্বলতার কথাটা প্রকাশ করে ফেলেছেন।

দিবানিদ্রার প্রসঙ্গ থেকেই কথাটা বলবার সুযোগ পেয়েছিলেন।

হ্যাঁ, ও রোগ আমার ছিল। যেন লজ্জিতভাবে বলেছিলেন ভবতারণবাবু, ডাক্তার বলেছিল দিনে ঘুমোনো বন্ধ না করলে চর্বি আরও বাড়বে। কিন্তু দিনে ঘুমোনো বন্ধ করি কী করে? দুপুরের খাওয়া সারতে না সারতেই চোখ দুটো ঘুমে জুড়ে আসে। তারপর ওই এক ওষুধে ভোজবাজি হয়ে গেল!

ওষুধটা কী? সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করলেন উদর যাঁর কুম্ভের মতো স্ফীত বর্তুলাকার সেই রামশরণবাবু, কফি?

না, না, কফি কেন হবে?ভবতারণবাবু গদগদ স্বরে বললেন, আজকালকার সব ঐতিহাসিক উপন্যাস। কী অপূর্ব জিনিস ভাবতে পারবেন না, একবার পড়তে শুরু করলে ঘুম দেশ ছেড়ে পালাবে।

আপনি ওইসব উপন্যাস পড়েন? মস্তক যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ সেই শিবপদবাবু নাসিকা কুঞ্চিত করলেন।

পড়ি মানে? ওই তো এখন আমার ওষুধ। ভবতারণবাবু উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, পড়ে দেখবেন একখানা। আর ছাড়তে পারবেন না। আহা, কী সব গল্প আর কী সব। চরিত্র! চোখের সামনে যেন জ্বলজ্বল করে। শাজাহাঁ, ক্লাইব, নুরজাহান, সিরাজ, বাহাদুর শা, জগৎশেঠ, উমিচাঁদ সব যেন আপনার চেনা পাড়ার ছেলেমেয়ে মনে হবে, আর কী সুন্দর তাদের আলাপ কথাবার্তা! একটু কোথাও খিচ নেই। পাছে বুঝতে না পারেন তাই এক কথা একশো বার বুঝিয়ে দেবে। ইতিহাসকে ইতিহাস, আরব্যোপন্যাসকে আরব্যোপন্যাস।

শুধু তাই নয়তো! মর্মরমসৃণ মস্তক ঝাঁকি দিয়ে শিবপদবাবু যেন তাঁর অবজ্ঞা প্রকাশ করলেন, পড়ে এখনও অবশ্য দেখিনি, কিন্তু ইতিহাসের শ্রাদ্ধ না হলেই বাঁচি। চোখের সামনে যা আছে তা-ই যারা দেখতে পায় না তারা ইতিহাসের ওপর চড়াও হলে একটু ভয় করে কিনা! সেদিন কী একটা এখনকার সামাজিক উপন্যাসে কলকাতার এক বাঙালি ধনীর স্কাই-স্ক্রেপাবের কথা পড়ে খুঁজতেই গিয়েছিলাম নিউ আলিপুরে। আজকের দিন নিয়েই এই! দু-চারশো বছর আগেকার কথা হলে তো একেবারে বেপরোয়া। পানিপথের প্রথম যুদ্ধেই হয়তো ট্যাঙ্ক দেখিয়ে ছাড়বে!

হুঃ!

নাসিকাধ্বনি শুনে সকলকেই সচকিত সন্ত্রস্ত হয়ে এবার ঘনশ্যাম দাসের দিকে তাকাতে হল। এতক্ষণ তাঁর নীরব থাকাই অবশ্য অস্বাভাবিক বলে বোঝা উচিত ছিল।

হ্যাঁ, ঘনশ্যাম দাসই নাসিকাধ্বনি করেছেন। সকলের দৃষ্টি যথোচিত আকৃষ্ট হবার পর তিনি কেমন একটু বাঁকা হাসির সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, পানিপথের প্রথম যুদ্ধ কবে হয়েছে যেন?

২১শে এপ্রিল, ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ। শিবপদবাবুকে বিদ্যা প্রকাশের এ সুযোগ পেয়ে বেশ যেন একটু গর্বিত মনে হল।

আর আপনার ওই যুদ্ধের ট্যাঙ্কের ব্যবহার হয় প্রথম কবে?—ঘনশ্যাম দাসের কথার সুরটা এবারও যেন বাঁকা।

কিন্তু শিবপদবাবু এখন নিজের কোটের মধ্যে। তিনি সগর্বে গড় গড় করে শুনিয়ে দিলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ১৫ই সেপ্টেম্বর ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে মিত্রপক্ষের চতুর্থ বাহিনী ঊনপঞ্চাশটি ট্যাঙ্ক ফ্রান্সের সোম থেকে আস্কর অভিযানে ব্যবহার করে। ইতিহাসে যুদ্ধের সচল ট্যাঙ্কের ব্যবহার সেই প্রথম।

আপনাদের ইতিহাসের দৌড় ওই পর্যন্ত!—ঘনশ্যাম দাসের মুখে অনুকম্পা মাখানো বিদ্রূপ।

তাঁর ঐতিহাসিক পাণ্ডিত্যের ওপর এ কটাক্ষে শিবপদবাবু যদি গরম হয়ে ওঠেন, তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না বোধ হয়।

কী বলে তাহলে আপনার ইতিহাস? শিবপদবাবুও গলা পেঁচিয়ে বললেন।

ইতিহাস আমারও না, আপনারও নয়। দাসমশাই করুণাভরে হেসে বললেন, সত্যিকার ইতিহাসটা কী তা শুনতে চান?

চাই বই কী! শিবপদবাবুর যুদ্ধং দেহি ভাব।

তাহলে শুনুন, গসমশাই শুধু অজ্ঞানতিমির দূর করবার কর্তব্যবোধেই যেন। বলতে শুরু করলেন, প্রথম পানিপথের যুদ্ধে ট্যাঙ্ক ব্যবহার হয়নি বটে, কিন্তু সচল দুর্গের মতো এ যুদ্ধযান আবিষ্কৃত ও ব্যবহৃত হয়েছে তারও ছ-বছর আগে। এর নাম দেওয়া হয়েছিল মান্টা।

ছ বছর আগে মানে ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে? শিবপদবাবুর গলায় বিস্ময়ের চেয়ে বিদ্রূপটাই স্পষ্ট।

হ্যাঁ, সেই জোড়া ছুরির বছরেই প্রথম সচল ট্যাঙ্ক নিয়ে মানুষ যুদ্ধ করে। দাসমশাই করুণাভরে জানালেন।

জোড়া ছুরির বছর! সেটা আবার কী? এবার শিবপদবাবুর গলায় আর বিদ্রূপ

নেই।

ওই ১৫২০ খ্রিস্টাব্দেরই নাম ছিল জোড়া ছুরির বছর টেনচটিটলান-এ।— পরিতৃপ্তভাবে ঘনশ্যাম দাস সমবেত সকলের ব্যাদিত মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে নিলেন একবার। তারপর বিশদ হলেন—তার আগের বছর ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দের নাম ছিল একটি খাদ্য। এই দুটি বছর সমস্ত পৃথিবীর ইতিহাসকে ওলট-পালট করে দিয়ে গেছে। কিন্তু জোড়া ছুরির বছরে টেনচটিটলান-এ ওই সচল ট্যাঙ্ক প্রথম মাথা থেকে বার করে কাজে না লাগালে ইতিহাস আর-এক রাস্তায় চলে যেত। একদিন দেনার দায়ে মাথার চুল বিকোনো অথর্ব হার্নারেমন্ডো কর্টেজ তাহলে ক্ষোভে দুঃখে স্পেনের সম্রাট পঞ্চম চার্লসকে শোনাবার সুযোগ পেতেন না যে, স্পেনে যত শহর আছে গুনতিতে তার চেয়ে অনেক বেশি রাজ্য তিনি সম্রাটকে ভেট দিয়েছেন। ভলতেয়ারের লেখা এ বিবরণ গালগল্প বলে যদি উড়িয়েও দিই, তবু এ কথা সত্য যে টেনটিন-এর নাম তাহলে অন্য যা-ই হোক, মেক্সিকো সিটি হয়ে উঠত না, আর ঘনশ্যামের পেছনে দাস পদবি লাগাবার সৌভাগ্য হত না আমার কপালে।

উপস্থিত সকলের ঘূর্ণমান মাথা স্থির করতে বেশ একটু সময় লাগল। মাথার কেশ যাঁর কাশের মতো শুভ্র সেই হরিসাধনবাবুই প্রথম একটু সামলে উঠে, দুবার ঢোক গিলে, তাঁর বিমূঢ় বিহ্বলতাকে ভাষা দিলেন, ও, আপনি স্পেনের হয়ে কর্টেজ-এর মেক্সিকো বিজয়ের কথা বলছেন? সেই যুদ্ধে প্রথম সচল ট্যাঙ্ক ব্যবহার হয়? কিন্তু তার সঙ্গে আপনার পদবি দাস হওয়ার সম্পর্ক কী?

সম্পর্ক এই যে, ঘনশ্যাম দাস যেন সকলের মূঢ়তা ক্ষমার চক্ষে দেখে বললেন, কর্টেজ-এর অমূল্য ডায়ারি চিরকালের মতো হারিয়ে না গেলে ও মেক্সিকোর অ্যাজটেক রাজত্ব জয়ের সবচেয়ে প্রামাণ্য ইতিহাস হিস্টোরিয়া ভেদাদেরা দে লা কনকুইস্তা দে লা নুয়েভা এল্পনার লেখক বার্নাল ডিয়াজ নেহাত হিংসায় ঈর্ষায় চেপে না গেলে, প্রথম ট্যাঙ্কের উদ্ভাবক ও কর্টেজ-এর উদ্ধারকর্তা হিসেবে যাঁর নাম ইতিহাসে পাওয়া যেত তিনি দাস বলেই নিজের পরিচয় দিতেন।

পদবি তাঁর দাস ছিল? মেদভারে হস্তীর মতো বিপুল ভবতারণবাবু বিস্ফারিত নয়নে জিজ্ঞাসা করলেন, তার মানে তিনি বাঙালি ছিলেন?

বাঙালি অবশ্য এখনকার ভাষায় বলা যায়। দাসমশাই বুঝিয়ে দিলেন, তবে তখনও এ শব্দের প্রচলন হয়নি। তিনি অবশ্য এই গৌড় সমতটের লোকই ছিলেন।

আপনার কোনও পূর্বপুরুষ তাহলে? স্ফীতোদর রামশরণবাবু সবিস্ময়ে বললেন, অতি-বৃদ্ধ প্রপিতামহটহ কেউ!

না, তস্য তস্য। বললেন দাসমশাই। তারপর একটু থেমে কৃপা করে উক্তিটি ব্যাখ্যা করলেন বিশদভাবে, অর্থাৎ, আমার ঊর্ধ্বতন দ্বাবিংশতম পূর্বপুরুষ ঘনরাম, দাস পদবির উৎপত্তি যাঁর থেকে।

মর্মরের মতো মস্তক যাঁর মসৃণ সেই শিবপদবাবু নিজের কোটেও কেঁচো হয়ে থাকতে হওয়ায় এতক্ষণ বোধ হয় মনে মনে গজরাচ্ছিলেন। এবার ভুরু কপালে তুলে। একটু ঝাঁঝালো গলাতেই জিজ্ঞাসা করলেন, ১৫১৯ কি ২০ খ্রিস্টাব্দে আপনার সেই বাঙালি পূর্বপুরুষ মেক্সিকো গেছলেন?

শিবপদবাবু যেভাবে প্রশ্নটা করলেন, তাতে-গঞ্জিকা পরিবেশনের আর জায়গা পেলেন না!—কথাটা খুব যেন উহ্য রইল না।

দাসমশাই তবু অববাধের প্রতি করুণার হাসি হেসে বললেন, শুনতে একটু আজগুবিই লাগে অবশ্য। কিউবা বাহামাদ্বীপ ইত্যাদি আগে আবিষ্কার করলেও ক্রিস্টোফার কলম্বাস-ই তিন বারের বান ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে আসল দক্ষিণ আমেরিকার মাটি স্পর্শ করেন। তাঁর আমেরিকা আবিষ্কারের মাত্র একুশ বছর বাদে তখনকার এক বঙ্গসন্তানের সেই সুদূর অ্যাজটেকদের রাজধানী টেনটিন-এ গিয়ে হাজির হওয়া অবিশ্বাস্যই মনে হয়। কিন্তু ইতিহাসের বুনন বড় জটিল। কোন জীবনের সুতো যে কার সঙ্গে জড়িয়ে কোথায় গিয়ে পৌঁছোয় তা কেউ জানে না। যে বছর কলম্বাস প্রথম আমেরিকার মাটিতে পা রাখেন সেই ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দেরই ১লা মে তারিখে পোর্তুগালের এক নাবিক ভাস্কো দা গামা আফ্রিকার দক্ষিণের উত্তমাশা অন্তরীপ পার হয়ে এসে ভারতের পশ্চিম কূলের সমৃদ্ধ রাজ্য কালিকটে তার চারটে জাহাজ ভেড়ায়। যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিল তাতে বিফল হয়ে ভাস্কো দা গামাকে ফিরে যেতে হয়। কিন্তু কালিকটের জামোরিনের ওপর আক্রোশ মেটাতে দশটি সশস্ত্র জাহাজ নিয়ে ভাস্কো দা গামা ফিরে আসে ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে। এবার নরপিশাচের মতো সে শুধু কালিকট ধ্বংস করেই ক্ষান্ত হয় না। কালিকট ছারখার করে সেখান থেকে কোচিন যাবার পথে হিংস্র হাঙরের মতো সমুদ্রের ওপর যা ভাসে এমন কোনও কিছুকেই রেহাই দেয়নি। যে সব জাহাজ ও সুলুপ লুঠ করে জ্বালিয়ে সে ড়ুবিয়ে দেয় তার মধ্যে ছিল একটি মকরমুখী পালোয়ার সদাগরি জাহাজ। সে সদাগরি জাহাজ সমতট থেকে সূক্ষ্ম কার্পাস বস্ত্র নিয়ে বাণিজ্য করতে গেছল ভূগুকচ্ছে। সেখানে থেকে ফেরার পথেই এই অপ্রত্যাশিত সর্বনাশ। দা গামার পৈশাচিক আক্রমণে সে সদাগরি জাহাজের সব মাঝি মাল্লা যাত্রীরই শেষ হয়ে যাবার কথা। কিন্তু তা হয়নি। রক্ষা পেয়েছিল একটি দশ বৎসরের বালক। দয়ামায়ার দরুন নয়, নেহাত কুসংস্কারের দরুনই দা গামার জাহাজের নরপশুরা তাকে রেহাই দেয়। জ্বলন্ত সদাগরি জাহাজ যখন ড়ুবছে তখন ছেলেটি কেমন করে সাঁতরে এসে দা গামার-ই খাস জাহাজের হালটা ধরে আশ্রয় নেয়। একজন মাল্লা তাকে সেখানে দেখতে পেয়ে পৈশাচিক আনন্দে আরও ক-জনকে ডাকে ছেলেটিকে বন্দুক ছুড়ে মেরে মজা করবার জন্যে। কিন্তু সেকালের ম্যাচলক বন্দুক। ছুড়তে গিয়ে বন্দুক ফেটে সেই লোকটাই পড়ে মারা। ঠিক সেই সময়ে তিনটে শুশুকের জাতের ড়ুগংকে জলের মধ্যে ডিগবাজি খেতে দেখা যায় জাহাজের কিছু পেছনে। দুটো ব্যাপার নিজেদের কুসংস্কারে এক সঙ্গে মিলিয়ে দৈবের অশুভ ইঙ্গিত মনে করে ভয় পেয়ে

ছেলেটিকে আর মারতে তারা সাহস করে না। তার বদলে তাকে তুলে নেয়। জাহাজের ওপরে।

১৫০৩ সালে ভাস্কো দা গামা লিসবন-এ ফেরবার পর ছেলেটি বিক্রি হয়ে যায় ক্রীতদাসের বাজারে। সেখান থেকে হাত ফেরতা হতে হতে একদিন সে কিউবায় গিয়ে পৌঁছোয়। দশ বছর বয়সে দা গামার জাহাজে যে লিসবন-এ এসেছিল সে তখন চব্বিশ-পঁচিশ বছরের জোয়ান। জুয়ারেজ নামে কিউবায় এসে বসতি করা একটি পরিবারের সে ক্রীতদাস।

কর্টেজ তখন সেই কিউবাতেই সে দ্বীপের বিজেতা ও শাসনকর্তা ভেলাসকেথের বিষ নজরে পড়েছে। বিষ নজরে পড়েছে ওই জুয়ারেজ পরিবারেরই একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেমের ব্যাপারে। মেয়েটির নাম ক্যাটালিনা জুয়ারেজ। কর্টেজ স্বভাবে-চরিত্রে একেবারে তখনকার মার্কামারা অভিজাত স্প্যানিশ। উদ্দাম দুরন্ত বেপরোয়া যুবক। প্রেম সে অনেকের সঙ্গেই করে বেড়ায়, কিন্তু বিয়ের বন্ধনে ধরা দিতে চায় না। বিশেষ করে জুয়ারেজ পরিবার বংশে খাটো বলেই ক্যাটালিনার সঙ্গে বেশ কিছুদিন প্রেম চালিয়ে সে তখন সরে দাঁড়িয়েছে। ভেলাসকেথ-এর কোপদৃষ্টি সেই জন্যেই পড়েছে। কর্টেজ-এর ওপর। ভেলাসকেথ-এর সঙ্গে জুয়ারেজ পরিবারের মাখামাখি একটু বেশি। ক্যাটালিনার আর-এক বোন তার অনুগ্রহধন্যা।

জুয়ারেজ পরিবারের সঙ্গে বেইমানি করার দরুন ভেলাসকেথ-এর এমনিতেই রাগ ছিল, কর্টেজ তার ওপর তাঁর বিরুদ্ধেই চক্রান্ত করছে খবর পেয়ে ভেলাসকেথ তাকে কয়েদ করলেন একদিন। কর্টেজ-এর বুঝি ফাঁসিই হয় রাজদ্রোহের অপরাধে। সেকালে স্পেনের নতুন-জেতা উপনিবেশে এ ধরনের বিচার আর দণ্ড আকছার হত।

কর্টেজ কিন্তু সোজা ছেলে নয়। পায়ের শিকল খুলে গারদের জানলা ভেঙে একদিন সে হাওয়া। আশ্রয় নিল গিয়ে এক কাছাকাছি গির্জেয়। তখনকার দিনে গির্জের অপমান করে সেখান থেকে কাউকে ধরে আনা অতি বড় স্বেচ্ছাচারী জবরদস্ত শাসকেরও সাধ্য ছিল না। কিন্তু গির্জের মধ্যে কর্টেজ-এর মতো ছটফটে দুরন্ত মানুষ ক-দিন লুকিয়ে থাকতে পারে। সেখান থেকে লুকিয়ে বেরোতে গিয়ে আবার কটেজ ধরা পড়ল।

এবার হাতকড়া বেড়ি পরিয়ে একেবারে জাহাজে নিয়ে তোলা হল তাকে। পরের দিন সকালেই তাকে চালান করা হবে হিসপানিয়েলায় বিচার আর শাস্তির জন্যে।

বিচার মানে অবশ্য প্রহসন আর শাস্তি মানে প্রাণদণ্ড ছাড়া আর কিছু নয়।

কর্টেজ-এর এবার আর কোনও আশা কোনও দিকে নেই।

ভেলাসকেথ এবার তাঁর ক্ষমতার বহরটা না বুঝিয়ে ছাড়বেন না।

অথচ এই ভেলাসকেথ-এর সঙ্গেই কর্টেজ প্রধান সহায় রূপে কিউবা-বিজয়ের অভিযানে ছিলেন। ভেলাসকেথ-এর প্রিয়পাত্রও তখন হয়েছিলেন কিছুদিন। হবারই কথা। ভেলাসকেথ তাঁর অভিযানে সব দিকে চৌকস এমন যোগ্য সহকারী আর পাননি। তখন স্পেনের কল্পনাতীত সাম্রাজ্য বিস্তারের দিনেও অসীম সাহসের সঙ্গে স্থির বুদ্ধি ও দুরন্ত প্রাণশক্তির এমন সমন্বয় বিরল ছিল।

কর্টেজ-এর জন্ম স্পেনের পুব-দক্ষিণ দিকের মেদেলিন শহরে। ছেলেবেলায় নাকি ক্ষীণজীবী ছিলেন, কিন্তু বয়স বাড়বার সঙ্গে সঙ্গেই সমর্থ জোয়ান হয়ে উঠেছেন। বাবা মায়ের ইচ্ছে ছিল কর্টেজ আইন পড়ে। বছর দুই কলেজে পড়েই কটেজ পড়ায় ইস্তফা দিয়ে পালিয়ে আসেন। তখন স্পেনের হাওয়ায় নতুন অজানা। দেশ আবিষ্কারের উত্তেজনা ও মাদকতা। দুঃসাহসিক নিরুদ্দেশ যাত্রার উদ্দীপনা সব তরুণের মনে। এসব অভিযানে সোনা দানা হিরে মানিকের কুবেরের ভাণ্ডার লুঠ করে আনার প্রলোভন যেমন আছে, তেমনই আছে অজানা রহস্যের হাতছানি, আর সেই সঙ্গে গৌরব-মুকুটের আশা।

উনিশ বছর বয়সে ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে কর্টেজ স্পেন ছেড়ে পাড়ি দিলেন নতুন আবিষ্কৃত পশ্চিমের দেশে ভাগ্যান্বেষণে। সফল বিফল নানা অভিযানে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ১৫১১ সালে কর্টেজ ভেলাসকেথ-এর সঙ্গে গেলেন তাঁর কিউবা-বিজয়ের সহায় হয়ে। মান-সম্মান অর্থ-প্রতিপত্তি কিছুটা তখন তাঁর হয়েছে। ভবিষ্যৎ তাঁর উজ্জ্বল বলেই সকলের ধারণা। ঠিক এই সময়ে স্বভাবের দোষে আর ভাগ্যের বিরূপতায় এই সর্বনাশ তাঁর ঘটল। চোর-ডাকাতের মতো ফঁসিকাঠে লটকেই তাঁর জীবনের সব উজ্জ্বল সম্ভাবনা শেষ হবে।

জাহাজের গারদকুইরির ভেতর হাত-পায়ে শেকলবাঁধা অবস্থায় এই শোচনীয় পরিণাম নিশ্চিত জেনে কর্টেজ তখন ভেঙে পড়েছেন। উপায় থাকলে আত্মহত্যা করেই নিজের মানটা অন্তত তিনি বাঁচাতেন।

হঠাৎ কর্টেজ চমকে উঠে দুকান খাড়া করেন।

এই রাত্রে নির্জন জাহাজঘাটার পাড়ে কোথায় কোন ধর্মযাজক আভে মেরিয়া-র স্তোত্র পাঠ করতে এসেছেন।

পর মুহূর্তেই কর্টেজের বিস্ময়ের আর সীমা থাকে না।

এ তো আভে মেরিয়া নয়। ভাষাটা ল্যাটিন, সুরটাও মাতা মেরির বন্দনার স্তোত্রের, কিন্তু কথাগুলো যে আলাদা!

কর্টেজ দুবছর কলেজে একেবারে ফাঁকি দিয়ে কাটাননি। ল্যাটিনটা অন্তত শিখেছিলেন।

স্তোত্রের সুরে উচ্চারিত কথাগুলোর মানে এবার তিনি বুঝতে পারেন। এ তো তাঁর উদ্দেশেই উচ্চারণ করা শ্লোক! ল্যাটিনে বলা হচ্ছে যে, ভাবনা কোরো না বন্দি বীর! আজ গভীর রাত্রে সজাগ থেকো। যে তোমাকে মুক্ত করতে আসছে তাকে বিশ্বাস কোবরা।

জাহাজের মাল্লা আর প্রহরীরা গোমুখখু। তাদের বুঝতে না দেবার জন্যেই এই ল্যাটিন স্তোত্রের ছল, তা কর্টেজ বুঝলেন।

কিন্তু কে তাঁকে উদ্ধার করতে আসছে! এমন কোন দুঃসাহসিক বন্ধু তাঁর আছে যে তাঁকে এই জাহাজের গারদ থেকে উদ্ধার করবার জন্যে নিজের প্রাণ বিপন্ন করবে?

সত্যিই কেউ আসবে কি?

আশায় উদ্বেগে অধীর হয়ে কর্টেজ জেগে থাকেন।

সত্যিই কিন্তু সে এল। গভীর রাত্রে প্রহরীরা যখন ঢুলতে ঢুলতে কোনও রকমে। পাহারা দিচ্ছে, তখন জাহাজের গারদ কুঠুরির একটি মাত্র শিক দেওয়া জানালায় গাঢ় অন্ধকারে একটা সিঁড়িঙ্গে ভুতুড়ে ছায়াই যেন দেখা গেল।

কিছুক্ষণ বাদেই জানালার শিকটা দেখা গেল কাটা হয়ে গেছে নিঃশব্দে।

সেই ভুতুড়ে ছায়া গোছের লোকটা এবার জানালা গলে নেমে এল ভেতরে। কর্টেজ-এর হাত-পায়ের শিকল কেটে খুলে দিতে বেশিক্ষণ তার লাগল না।

চাপা গলায় সে এবার বললে, জানালা দিয়ে বাইরে চলে যান এবার। ডেক এর। এদিকটা অন্ধকার। পাহারাতেও কেউ নেই। ডেক-এর রেলিং থেকে একটা দড়ি ঝুলছে দেখবেন। নির্ভয়ে সেটা ধরে নীচে নেমে যান। সেখানে একটা ডিঙি বাঁধা আছে। সেইটে খুলে নিয়ে প্রথম স্রোতে নিঃশব্দে ভেসে জাহাজঘাটা ছাড়িয়ে চলে যান। তারপর যেখানে তোক তীরে উঠলেই চলবে।

এই নির্দেশ পালন করতে গিয়েও একবার থেমে কর্টেজ না জিজ্ঞেস করে পারলেন , আর আপনি?

আমার জন্যে ভাববেন না, বললে অস্পষ্ট মূর্তিটা, আগে নিজের প্রাণ বাঁচান। আমি যদি পারি তো আপনার পিছু পিছু ওই ডিঙিতেই গিয়ে নামব। নইলে গোলমাল যদি কিছু হয়, জাহাজেই তার মওড়া নিতে হবে।

কর্টেজ নির্দেশ মতো ডিঙিতে পৌঁছোবার পর ছায়ার মতো মূর্তিটাও তাতে নেমে এল। জাহাজের ওপর কেউ কিছু জানতে পারেনি।

ডিঙি খুলে স্রোতে ভাসিয়ে অনেকখানি দূরে তীরে গিয়ে ওঠেন দুজনে।

কর্টেজ তখন কৌতূহলে অধীর হয়ে পড়েছেন। কে এই অদ্ভুত অজানা মানুষটা? গায়ে আঁটসাঁট পোশাক সমেত যে চেহারাটা দেখা যাচ্ছে তার সঙ্গে তাঁর চেনা-জানা কোনও কারওই মিল নেই। তারা কেউ এমন রোগাটে লম্বা নয়। মুখটা তখনও অবশ্য দেখা যাচ্ছে না। একটা শুধু দু-চোখের জন্যে দুটো ফুটো করা কাপড় তাতে বাঁধা।

তীরে নামবার পর কর্টেজ কিছু জিজ্ঞাসা করবার অবসর অবশ্য পেলেন না। লোকটা তাঁকে সে সুযোগ না দিয়ে ব্যস্তভাবে বলল, আর দেরি করবার সময় নেই, ডন কর্টেজ। আরবারে যে গির্জেয় আশ্রয় নিয়েছিলেন, সোজা সেখানেই যেতে হবে সামনের বনের ভেতর দিয়ে। আসুন।

এ দিকের এই বনাঞ্চলটা কটেজ-এর অচেনা। কিন্তু লোকটার সব যেন মুখস্থ। অন্ধকার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা পথে কিছুক্ষণ বাদেই কর্টেজকে সে গির্জের পেছনের কবরখানার কাছে পৌঁছে দিয়ে বললে, এবার আপনি নিরাপদ, উন কটেজ। কেউ এখনও আপনার পালাবার খবর জানতে পারেনি। যান, ভেতরে চলে যান এদিক দিয়ে। ” কিন্তু কর্টেজ গেলেন না। সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে স্পেনের আদব কায়দা মাফিক কুর্নিশ করে দৃঢ়স্বরে বললেন, না, আমার এত বড় উপকার যিনি করলেন, তাঁর পরিচয় না জেনে আমি কোথাও যাব না। বলুন আপনি কে? কী আপনার নাম?

আমার পরিচয় কী দেব, ডন কর্টেজ। লোকটা তার মুখের ঢাকা খুলে ফেলে বললে, ক্রীতদাসের কি কোনও পরিচয় থাকে। আমরা গোরু ঘোড়ার বেশি কিছু নয়। আমায় সবাই গানাদো মানে গোরু-ভেড়া বলেই ডাকে হুকুম করতে।

কর্টেজ তখন হতভম্ব। স্প্যানিশে গানাদো মানে গোরু-ভেড়া। তার চেয়ে ভাল সম্বোধন যার নেই তেমনই একটা ক্রীতদাসকে কুর্নিশ করে আপনি বলেছেন বলে বেশ একটু লজ্জাও বোধ করছেন। কিন্তু মানুষ হিসেবে কর্টেজ খুব খারাপ ছিলেন না। এত বড় উপকারের কৃতজ্ঞতাটা তাই তৎক্ষণাৎ উড়িয়ে দিতে না পেরে একটু ইতস্তত করে তুই-এর বদলে তুমি বলেই সম্বোধন করে বিস্মিতভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি—মানে কাদের ক্রীতদাস তুমি?

যে জুয়ারেজ পরিবারে আপনি আগে যাতায়াত করতেন, তাদেরই। লোকটির মুখে অন্ধকারেও যেন একটু অদ্ভুত হাসি দেখা গেল—ক্রীতদাসদের কেউ তো লক্ষ করে দেখে না! নইলে আপনার ফাইফরমাশও আমি অনেক খেটেছি।

কিন্তু, কিন্তু, কর্টেজ একটু ধোঁকায় পড়েই বললেন এবার, তোমায় তো চেহারায় এদেশের আদিবাসী বলে মনে হয় না। দু-চারজন যে কাফ্রি ক্রীতদাস এখন এখানে আমদানি হয়েছে তাদের সঙ্গেও তোমার মিল নেই। তাহলে তুমি

হ্যাঁ, ডন কর্টেজ, আমি অন্য দেশের মানুষ। কর্টেজ-এর অসম্পূর্ণ কথাটা পূরণ করে লোকটি বললে, আপনারা এক ইন্ডিজ-এর খোঁজে পশ্চিম দিকে পাড়ি দিয়েছেন, কিন্তু আর-এক আসল ইন্ডিজ আছে পূর্ব দিকে। আমি সেখানকার মানুষ। ছেলেবেলায় বোম্বেটেদের কাছে ধরা পড়ে এদেশে এসে ক্রীতদাস হয়েছি।

কর্টেজ সব কথা মন দিয়ে শুনলেন কি না বলা যায় না। আর-এক প্রশ্ন তখন তাঁর মনে প্রধান হয়ে উঠেছে। একটু সন্দিগ্ধভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, দু-প্রহর রাত্রে জাহাজঘাটার পাড়ে আভে মেরিয়ার সুরে স্তোত্র পাঠ করে কে আমায় এ উদ্ধারের জন্যে তৈরি থাকতে বলেছিল?

একটু চুপ করে থেকে লোকটি বললে, আর কেউ নয় ডন কর্টেজ, এই অধীন।

তুমি!—কর্টেজ সত্যিই এবার দিশাহারা—তোমার অমন শুদ্ধ ল্যাটিন উচ্চারণ! এ শ্লোক তৈরি করলে কে? শেখালে কে তোমায়?

কেউ শেখায়নি ডন কর্টেজ। লোকটি সবিনয়ে বললে, ও শ্লোক আমিই তৈরি করেছি আপনাকে হুঁশিয়ার করবার জন্যে।

তুমি ও শ্লোক তৈরি করেছ? তুমি ল্যাটিন জানো!-কর্টেজ একেবারে তাজ্জব।

আজ্ঞে, হ্যাঁ-লোকটি যেন লজ্জিত—এখানে চালান হবার আগে অনেককাল ডন লোপেজ দে গোমারার পরিবারে ক্রীতদাস ছিলাম। পণ্ডিতের বাড়ি। শুনে শুনে আর লুকিয়ে-চুরিয়ে পড়াশুনা করে তাই একটু শিখেছি। কিন্তু আর আপনি দেরি করবেন না, ডন কটেজ। গিঞ্জেয় গিয়ে লুকোন তাড়াতাড়ি। বাইরে কেউ আপনাকে দেখলেই এখন বিপদ।

ফিরে গির্জের বাগানে ঢুকতে গিয়েও কর্টেজ কিন্তু আবার ঘুরে দাঁড়ালেন।

কী হবে ওই গির্জের মধ্যে চোরের মতো লুকিয়ে থেকে?কর্টেজ বললেন ক্ষোভ আর বিরক্তির সঙ্গে, কতদিন বা ওভাবে লুকিয়ে থাকতে পারব? আর যদি বা পারি, ছুঁচোর মতো গর্তে লুকিয়ে বাঁচার চেয়ে ফাঁসিকাঠে ঝোলাও ভাল।

ভরসা দেন তো এই অধম একটা কথা নিবেদন করতে পারে। লোকটি। বিনীতভাবে বললে।

কী কথা? কর্টেজ এবার মনিবের মেজাজেই কড়া গলায় বললেন।

লোকটি তবু না ভড়কে বললে, ছুঁচোর মতো গর্তে লুকিয়ে বাঁচবার মানুষ সত্যিই তো আপনি নন। ডন জুয়ান দে গ্রিজাল ভা এই সবে পশ্চিমের কুবেরের রাজ্যের সন্ধান পেয়ে ফিরেছেন, শুনেছেন নিশ্চয়। কিউবার শাসনকর্তা মহামহিম ভেলাসকেথ সেখানে আর একটি নৌবহর পাঠাবার আয়োজন করছেন। এ নৌ-অভিযানের ভার নেবার উপযুক্ত লোক আপনি ছাড়া কে আছে সারা স্পেনে!

খুব তো গাছে চড়াচ্ছ! তিক্ত স্বরে বললেন কর্টেজ, হাতে-পায়ে বেড়ি দিয়ে যে আমায় ফাঁসিতে লটকাতে চায়, সেই ভেলাসকেথ আমায় এ ভার দেবার জন্যে হাত বাড়িয়ে আছে বোধহয়!

হাত তিনি সত্যিই বাড়াবেন, ডন কর্টেজ। বললে লোকটি, শুধু একটি ভুল যদি আপনি শোধরান।

কী ভুল শোধরাব? গরম হয়ে উঠলেন কর্টেজ। লোকটি কিন্তু অবিচলিত। ধীরে ধীরে বললে, ডোনা ক্যাটালিনাকে আপনি বিয়ে করুন, ডন কর্টেজ। তিনি শুধু যে আপনাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসেন তা নয়, তাঁর মতো গুণবতী মেয়ে সারা স্পেনে খুব কম আছে। তাঁর কথা ভেবে তাঁর খাতিরেই আপনাকে আমি উদ্ধার করেছি।

সাহস তো তোর কম নয়! লোকটার আস্পর্ধায় তুই-তোকারি করে ফেললেও একটু যেন নরম ভাবিত গলাতেই বললেন কর্টেজ, আমি কাকে বিয়ে করব না করব তাও তুই উপদেশ দিতে আসিস!

 

২.

গোরু যার ডাক নাম—সেই ক্রীতদাস গানাদোর পরামর্শই কিন্তু শুনেছিলেন ডন, হার্নারেমন্ডো কর্টেজ। তাঁর বরাতও ফিরেছিল তাইতে। ডোনা ক্যাটালিনা জুয়ারেজকে বিয়ে করে আবার শুধু ভেলাসকেথ-এর সুনজরেই তিনি পড়েননি, নেতৃত্বও , পেয়েছিলেন কুবেরের রাজ্য খুঁজতে যাবার নৌবহরের।

ক্রীতদাস গানাদোকে তিনি ভোলেননি। স্ত্রী ক্যাটালিনার অনুরোধে জুয়ারেজ পরিবারের কাছ থেকে তাকে কিনে নিয়ে সঙ্গী অনুচর করে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর অ্যাজটেক রাজ্য বিজয়ের অভিযানে।

সে অভিযান এক দীর্ঘ কুৎসিত কাহিনী।

গানাদোর কাছে তা বিষ হয়ে উঠেছিল শেষ পর্যন্ত। স্প্যানিয়ার্ডদের নৃশংস বর্বরতা দেখে যেমন সে স্তম্ভিত হয়েছিল তেমনই হতাশ হয়েছিল অ্যাজটেকদের ধর্মের পৈশাচিক বীভৎস সব অনুষ্ঠান দেখে। তাদের নিষ্ঠুরতম দেবতা হলেন হুইটজিলপচলি। জীবন্ত মানুষের বুকে ছুরি বসিয়ে তার হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে বার করে তাঁকে নৈবেদ্য দিতে হয়। এ নারকীয় অভিযান থেকে ফিরে যেতে পারলে গানাদো তখন বাঁচে।

কিন্তু ফেরা আর তার হত না! হিতকথা বলেই একদিন সে কর্টেজ-এর প্রিয়পাত্র হয়েছিল। সেই হিতকথাই আবার গানাদোর সর্বনাশ ডেকে এনেছিল একদিন।

কর্টেজ-এর স্প্যানিশ বাহিনীর তখন চরম দুর্দিন।

স্পেনের সৈনিকদের অমানুষিক অত্যাচারে সমস্ত টেনচ্‌টিট্‌লান তখন খেপে গিয়ে তাদের অ্যাকসিয়াক্যা্টল-এর প্রাসাদে অবরুদ্ধ থাকতে বাধ্য করেছে। টেনচ্‌টিট্‌লান নতুন মহাদেশের ভেনিস। শহরের চারিধার হ্রদে ঘেরা। কর্টেজ কোনও মতে তাঁর বাহিনী নিয়ে এ দ্বীপ নগর থেকে বেরিয়ে পালাবার জন্য ব্যাকুল। কিন্তু তার উপায় নেই। অ্যাজটেকদের আগ্নেয়াস্ত্র নেই, ইস্পাতের ব্যবহার তারা জানে না, তারা ঘোড়া কখনও আগে দেখেনি, কিন্তু তাদের তীরধনুক, ব্রোঞ্জের বল্লম, তলোয়ার আর ইট-পাটকেল নিয়ে সমস্ত নগরবাসী তখন মরণপণ করেছে বিদেশি সাদা শয়তানদের নিঃশেষ করে দেবার জন্যে। অ্যাসিয়াক্যাল্স-এর প্রাসাদ থেকে কারও এক পা বাড়াবার উপায় নেই।

এই বিপদের মধ্যে স্পেনের সৈনিকদের মধ্যেই আবার কর্টেজ-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকিয়ে উঠেছে। তার নেতা হল অ্যান্টোনিও ভিল্লাফানা নামে এক সৈনিক।

প্রাসাদের একটি গোপন কক্ষে গানাদো ভিল্লাফানার দলের এ চক্রান্তের আলোচনা একদিন শুনে ফেলেছে। কিন্তু কর্টেজকে এসে সে খবর দেবার আগেই তাকে ধরে ফেলেছে ভিল্লাফানা।

ক্রীতদাস গানাদোর কাছে তো আর অস্ত্রশস্ত্র নেই। অ্যান্টোনিও ভিল্লাফানা তাকে সোজা এক তলোয়ারের কোপেই সাবাড় করতে যাচ্ছিল। কিন্তু গানাদো যে কর্টেজ-এর পেয়ারের অনুচর তা মনে পড়ায় হঠাৎ তার মাথায় শয়তানি বুদ্ধি খেলে গেছে।

সঙ্গীদের কাছ থেকে একটা তলোয়ার নিয়ে তার দিকে ছুড়ে দিয়ে বলেছে, নে হতভাগা কালা নেংটি, তলোয়ার হাতে নিয়েই মর।

তলোয়ার নিয়ে আমি কী করব, হুজুর! ভয়ে ভয়েই যেন বলেছে গানাদো, আমার মতো গোলাম তলোয়ারের কী জানে!

তবু হাতে করে তোল, হতভাগা! পৈশাচিক হাসি হেসে বলেছে অ্যান্টোনিও, গোলাম হয়ে আমার ওপর তলোয়ার তুলেছিস বলে তোকে উচিত শিক্ষা দিয়েছি বলবার একটা ওজর চাই যে।

নেহাত যেন অনিচ্ছায় ভয়ে ভয়ে তলোয়ারটা তুলে নিয়েছে গানাদো। অ্যান্টোনিও তলোয়ার নিয়ে এবার তেড়ে আসতেই ভয়ে ছুটে পালিয়েছে আর-একদিকে।

কিন্তু পালাবে সে কোথায়! হিংস্র শয়তানের হাসি হেসে বেড়ালের ইঁদুর ধরে খেলানোর মতো তলোয়ার ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ তাকে নাচিয়ে বেড়িয়ে মজা করেছে অ্যান্টোনিও ভিল্লাফানা। তারপর হঠাৎ বেকায়দাতেই বোধহয় গানাদোর তলোয়ারের একটা খোঁচায় তার জামার আস্তিন একটু ছিঁড়ে যাওয়ায় খেপে উঠেছে অ্যান্টোনিও। এবার আর ইঁদুর খেলানো নয়, একেবারে সোজাসুজি ভবলীলা শেষ গানাদোর।

কিন্তু অ্যান্টোনিওর সঙ্গীরা হঠাৎ থ হয়ে গেছে।

এ কি সেই ক্রীতদাস গানাদোর আনাড়ি ভীরু হাতের তলোয়ার! এ যেন স্বয়ং এ সিড় কম্পিয়াডর আবার নেমে এসেছেন পৃথিবীতে তাঁর তলোয়ার নিয়ে।

ইঁদুর নিয়ে বেড়ালের খেলা নয়, এ যেন অ্যান্টোনিওকে বাঁদর-নাচ নাচানো তলোয়ারের খেলায়।

প্রথম অ্যান্টোনিওর জামার আর-একটা আস্তিন ছিড়ল। তারপর তার আঁটসাঁট প্যান্টের খানিকটা, মাথার টুপিটার বাহারে পালকগুলো তারপর গেল কাটা, তারপর একদিকের চোমরানো গোঁফের খানিকটা।

সঙ্গীরা তখন হাসবে না কাঁদবে ভেবে পাচ্ছে না।

অ্যান্টোনিও ভিল্লাফানা ছুটে বেড়াচ্ছে এদিক থেকে ওদিক তলোয়ারের খোঁচা বাঁচাতে।

হঠাৎ একটি মোক্ষম মারে অ্যান্টোনিওর হাতের তলোয়ার সশব্দে পড়ে গেছে। মাটিতে। আর সেই সঙ্গে বজ্ৰহুঙ্কার শোনা গেছে—থামো।

চমকে সবাই ফিরে তাকিয়ে দেখেছে, কর্টেজ নিজে এসে সেখানে দাঁড়িয়েছেন তাঁর প্রহরীদের নিয়ে।

অগ্নিমূর্তি হয়ে তিনি গানাদোকে বলেছেন, ফেলো তোমার তলোয়ার। এত বড় তোমার স্পর্ধা, স্পেনের সৈনিকের ওপরে তুমি তলোয়ার তোলো!

ও স্পেনের সৈনিক নয়, তলোয়ার ফেলে দিয়ে শান্ত স্বরে বলেছে গানাদো, ও স্পেনের কলঙ্ক। আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল গোপনে। তা ধরে ফেলেছি বলে আমায় হত্যা করতে এসেছিল। তলোয়ার ধরে তাই ওকে একটু শিক্ষা দিচ্ছিলাম।

না, ডন কর্টেজ।অ্যান্টোনিও এবার হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে কর্টেজ-এর পায়ের কাছে—বিশ্বাস করুন আমার কথা, আপনার পেয়ারের ক্রীতদাস বলে ধরাকে ও সরা দেখে। আমাকে এই এদের সকলের সামনে যানয়-তাই বলে অপমান করেছে। আমি তাতে প্রতিবাদ করি বলে, আমাদের একজনের তলোয়ার খাপ থেকে তুলে নিয়ে আমার ওপর চড়াও হয়।

চড়াও হওয়াটা কর্টেজ নিজের চোখেই দেখেছেন। তার সাক্ষ্য-প্রমাণের দরকার নেই।

অ্যান্টোনিও খাস বনেদি ঘরের ছেলে না হলেও তারই নীচের ধাপের একজন। হিড্যালগো। তার ওপর সামান্য একজন ক্রীতদাসের তলোয়ার তোলা ক্ষমাহীন

অপরাধ।

রাগে আগুন হয়ে অ্যান্টোনিওর কথাই বিশ্বাস করে কর্টেজ গানাদোকে বেঁধে নিয়ে যেতে হুকুম দিয়েছেন। ক্রীতদাসের বিচার বলে কিছু নেই। এ অপরাধের জন্যে সেদিনই যে তার মৃত্যুদণ্ড হবে একথাও কর্টেজ জানিয়েছেন তৎক্ষণাৎ।

হিড্যালগো আর প্রহরীরা তাকে বেঁধে নিয়ে যাবার সময় গানাদো এ দণ্ডের কথা শুনে একটু শুধু হেসে বলেছে, প্রাণদণ্ডটা আজই না দিলে পারতেন, ডন কর্টেজ! তাতে আপনাদের একটু লোকসান হতে পারে।

আমাদের লোকসান হবে তোর মতো একটা গোরু কি ভেড়া মরে গেলে!- কর্টেজ একেবারে জ্বলে উঠেছেন এতবড় আস্পর্ধার কথায়।

গানাদো কিন্তু নির্বিকার। ধীর স্থির গলায় বলেছে, হ্যাঁ, সে ক্ষতি আর হয়তো সামলাতে পারবেন না। বিশ্বাসঘাতক ভিল্লাফানার শয়তানি আজ না হোক, একদিন নিশ্চয় টের পাবেন, কিন্তু ততদিন পর্যন্ত আপনার এ বাহিনী টিকবে কি? আমায় আজ মৃত্যুদণ্ড দিলে উদ্ধারের উপায় যা ভেবেছি, বলে যেতেও পারব না।

কর্টেজ-এর রাগ তখন সপ্তমে উঠেছে। সজোরে গানাদোর গালে একটা চড় মেরে তিনি প্রহরীদের বলেছেন, নিয়ে যা এই গোরুটাকে এখান থেকে। নইলে নিজের হাতটাই নোংরা করে বসব এইখানেই ওকে খুন করে!

 

৩.

হাত নোংরা না করুন, প্রায় হাতজোড়ই করতে হয়েছে কর্টেজকে সেইদিনই গানাদোর কাছে তার কয়েদঘরে গিয়ে।

কর্টেজ আর তার অ্যাসিয়াক্যাল-এর প্রাসাদে বন্দি সৈন্যদলের অবস্থা তখন সঙ্গিন। প্রাসাদে খাবার ফুরিয়ে এসেছে। খবর এসেছে যে, দ্বীপনগর টেনটিন থেকে বাইরের স্থলভূমিতে যাবার একটিমাত্র সেতুবন্ধ পথ অ্যাজটেকরা ভেঙে নষ্ট করে দিচ্ছে। প্রাসাদকারাগার থেকে বেরিয়ে অন্তত লড়াই করে সে সেতুবন্ধের পথে যাবার একটা উপায় না করলেই নয়।

শুধু সেই জন্যেই কর্টেজ অবশ্য গানাদোর কাছে যাননি। একদিন যে তাঁর প্রাণ বাঁচিয়েছে, যার কাছে অনেক সুপরামর্শ পেয়ে বড় বড় বিপদ থেকে তিনি উদ্ধার পেয়েছেন, ক্রীতদাস হলেও তার প্রতি কৃতজ্ঞতাটা মন থেকে একেবারে মুছে ফেলতে কর্টেজ পারেননি। কিছুটা অনুশোচনাতেও কর্টেজ তাঁর মেক্সিকো অভিযানের দোভাষী ও নিত্যসঙ্গিনী মালিঞ্চে ওরফে মারিনাকে নিয়ে গেছেন গানাদোর কাছে।

কর্টেজ নিজে প্রথমে কিছু বলতে পারেননি। মালিঞ্চেই তাঁর হয়ে বলেছে, আমার কথা বিশ্বাস করো, গানাদো। হার্নারেমন্ডো তোমার এ পরিণামে সত্যি মর্মাহত। কিন্তু ক্রীতদাস হয়ে মনিবের জাতের কারও বিরুদ্ধে হাত তোলার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড রদ করবার ক্ষমতা তাঁরও নেই। শুধু স্পেনের জন্যে মস্ত বড় কিছু যদি তুমি করতে পারো, তাহলেই কর্টেজ শুধু প্রাণদণ্ড মুকুব নয়, দাসত্ব থেকেও তোমায় মুক্তি দিতে পারেন সম্রাটের প্রতিনিধি হিসাবে।

হ্যাঁ, বলো গানাদো, কর্টেজ এবার ব্যাকুলভাবেই বলেছেন, আমাদের এ সংকট থেকে বাঁচাবার কোনও উপায় যদি তোমার মাথায় এসে থাকে, এখুনি বলো। তা সফল হলে শুধু নিজেদের নয়, তোমাকে বাঁচাতে পেরেই আমি বেশি খুশি হব। বলো কী ভেবেছ?

ভেবেছি, বলে গানাদো এবার যা বলেছে কর্টেজ বা মালিঞ্চে কেউই তা বুঝতে পারেনি।

এ আবার কী আওড়াচ্ছ? অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছে মালিঞ্চে, তুকতাকের মন্ত্র নাকি?

না, একটু হেসে বলেছে গানাদো, ডন কর্টেজকে আমি ছেলেবেলায় শেখা একটা কথা বললাম। বললাম তোমায় রথ দেখাব বলেই ভেবেছি, রথও দেখবে কলাও বেচবে।

সত্যি রথই দেখিয়েছে গানাদো। রথের মতো কাঠের মোটা তক্তায় তৈরি দোতলা সাঁজোয়া গাড়ি। সে ঢাকা সাঁজোয়া গাড়ির দুই তলাতেই বন্দুক নিয়ে থাকবে সৈনিকেরা। নিজেরা কাঠের দেওয়ালের আড়ালে তীরবল্লম আর ইট-পাটকেলের ঘা বাঁচিয়ে নিরাপদে বন্দুক ছুঁড়তে পারবে শত্রুর ওপর। এই কাঠের সাঁজোয়া গাড়ির নামই হল মান্টা।

সেই মান্টা না উদ্ভাবিত হলে কর্টেজ আর তার মুষ্টিমেয় বাহিনী সেবার দ্বীপনগর টেনচুটিটুলান থেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে পারত না। নতুন আবিষ্কৃত আমেরিকা মহাদেশের ইতিহাসই হয়তো তাহলে পালটে যেত।

কর্টেজ নিজের কথা রেখেছিলেন। গানাদোকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে দামি দামি বহু উপহার সমেত সম্রাটের সওগাত বয়ে নিয়ে যাবার জাহাজেই স্পেনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

পাঠাবার আগে দাসত্ব থেকে মুক্তিপত্র লিখে দেবার সময় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এখন তুমি মুক্ত স্বাধীন মানুষ, গানাদো। বলো কী নামে তোমায় মুক্তিপত্র দেব? কী নেবে তুমি পদবি?

নাম আমার নিজের দেশের ছেলেবেলায় দেওয়া ঘনরামই লিখুন, বলেছিলেন গানাদো, আর আমার বংশ যদি ভবিষ্যতে থাকে তাহলে এ ইতিহাস চিরকাল স্মরণ করাবার জন্যে পদবি দিন দাস।

ঘনশ্যাম দাস থামতেই ঈষৎ ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞাসা করলেন মর্মরের মতো মস্তক যাঁর মসৃণ সেই শিবপদবাবু, কিন্তু এ ইতিহাস আপনি পেলেন কোথায়? আপনার আদিপুরুষ সেই গানাদো, থুড়ি ঘনরাম বাংলায় পুঁথি লিখে গিয়েছিলেন নাকি?

হ্যাঁ, পুঁথিই তিনি লিখে গেছলেন।ঘনশ্যাম দাস একটু বাঁকা হাসির সঙ্গে বললেন, তবে সে পুঁথি দেখলেও আপনি পড়তে পারতেন না। নাম এক হলেও ধর্মমঙ্গল লিখে যিনি রাঢ়ের লোককে এক জায়গায় একটু বিদ্রূপ করে গেছেন, ইনি সে ঘনরাম নয়। বাংলায় নয়, দেশে ফেরবার আগে প্রাচীন ক্যাস্টিলিয়ান-এই তিনি তাঁর পুঁথি লিখে গেছলেন। ফ্যালানজিস্টরা স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় ধ্বংস করে না দিলে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে বিখ্যাত পণ্ডিত মুনোজ তাঁর অক্লান্ত চেষ্টায় যেখান থেকে ফ্রানসিসক্যান ফ্রায়ার বার্নাদিনো দে সাহাগুনের অমূল্য রচনা হিস্টোরিয়া ইউনিভার্সাল দে নুয়েভা এসপানা মানে নতুন স্পেনের বিশ্ব-ইতিহাসের পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করেন, স্পেনের উত্তরে টলোসা মঠের সেই প্রাচীন পাঠাগারেই এ পুঁথি পাওয়া যেত।

এত জায়গা থাকতে টলোসা মঠে কেন, আর ফ্যাল্যানজিস্টরা যত মন্দই হোক, হঠাৎ একটা নির্দোষ মঠের পাঠাগার ধ্বংস করবার কী দায় পড়েছিল তাদের, জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও শিবপদবাবু নিজেকে সংবরণ করলেন বুদ্ধিমানের মতো! রাত যথেষ্ট হয়েছে।

আবার ঘনাদা (গল্পগ্রন্থ)

ছুঁচ

আগুন! আগুন!

সত্যিকার আগুন নয়, ঘনাদাকে তাতাবার একটা ফিকির। ফিকিরটা একেবারে মাঠে মারা যায়নি। ঘনাদা তাঁর সান্ধ্যভ্রমণ সেরে এসে বসবার ঘরে ঢুকতে গিয়ে এক পা চৌকাঠের এপারে চালিয়ে সভয়ে থমকে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখের চেহারাটা দেখবার মতো। প্রায় পিছু ফিরে ছুট মারেন আর কী!

শেষ পর্যন্ত আমাদের জমায়েত হয়ে বসার ধরনেই বোধহয় সাহস পেয়ে নিজেকে সামলে নির্বিকার ভঙ্গিতে ঘরে এসে ঢুকে তাচ্ছিল্যভরে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় আগুন হে!

শিশির ঘনাদার মৌরসি আরাম-কেদারাটা সসম্রমে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, আজ্ঞে, বাজারের কথা বলছি।

আরামকেদারায় নিজেকে এলিয়ে দিয়ে ঘনাদা মৃদু কৌতূহল প্রকাশ করলেন, বাজারে আগুন লেগেছে নাকি?

আজ্ঞে, লেগেছে তো অনেক দিনই। ক্রমশই বাড়ছে যে! শিবু উদ্বেগ দেখালে।

বাড়বে, আরও বাড়বে! ঘনাদার নির্লিপ্ত ভবিষ্যদ্বাণী।

কী বলছেন, ঘনাদা! তা হলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। এখনই তো কোনও জিনিস ছোঁবার জো নেই। আলু বারো আনা, বাঁধাকপি দেড় টাকা, মাংস চার টাকা, মাছ সাত টাকা।

আজই সকালের বাজারটা নিজের হাতে করতে হয়েছে বলে যতখানি রয় সয় বাড়িয়ে ফিরিস্তি দিলাম।

কিন্তু ঘনাদা তাতেও অবিচলিত। নিশ্চিন্ত ভাবে বললেন, ও তো কিছুই নয়। কলির এই তো সবে সন্ধে!

গৌরকে এবার উলটো দিক থেকে আঁচ দিতে হল। ঘনাদাকেই সমর্থন করে আমাদের জ্ঞান বিতরণ করে বললে, মানুষ কী রেটে বাড়ছে জানিস! পঞ্চাশ বছরে মানুষের ভারেই মেদিনী টলমল করবে। ডাঙার ফসলে তো কুলোবেই না, সমুদ্রে চাষ করেও কূল পাওয়া যাবে না। উপোস করে মরতে হবে।

গৌরের এ বক্তৃতায় কিছুটা বুঝি কাজ হল। তিনি স্বয়ং উপস্থিত থাকতে আর কারুর মাতব্বরি সহ্য করতে ঘনাদা একান্ত নারাজ। গৌর থামবার পর একটু নাসিকাধ্বনি করে বললেন, উপোস করে মরতে হবে।

হবে না? গৌর নিজের কথা প্রমাণ করতে ব্যস্ত হল, অত খাবার আসবে কোথা থেকে? সমুদ্রের জলের প্ল্যাঙ্কটন হেঁকে খাবার তৈরির কারখানা বসিয়েও সে রাক্ষুসে দুনিয়ার খিদে মেটাতে পারবে কি? ছাদে ছাদে অ্যালজির চাষ করেও না।

বটে! ঘনাদার টিটকিরির ধরনে আশান্বিত হয়ে উঠলাম।

কিন্তু ওই পর্যন্তই।

পলতেটা ফুরফুর করে দুটো ফুলকি ছেড়েই ঠাণ্ডা। ধরল না।

তার বদলে শিশিরের কাছে চার হাজার আটশো অষ্টাশিতম সিগারেট ধার করে ঘনাদা শিশিরেরই দেশলাই দিয়ে ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, আচ্ছা, উঠি।

সেকি! এখনই উঠবেন কী! এই তো এলেন! আমরা শশব্যস্ত।

কিন্তু ঘনাদাকে ঠেকানো গেল না। সত্যিই উঠে দাঁড়িয়ে হাই তুলে বললেন, না, একটু জরুরি কাজ রয়েছে।

ঘনাদার জরুরি কাজ! এই সান্ধ্যভ্রমণে খিদেটা শানিয়ে আসার পর!

আমরা কোনও রকমে হাসি চাপলাম।

কিন্তু এত খেটে শেষে শক্ত অসুখে পড়বেন যে! শিবু গভীর সহানুভূতি জানাল, এক-আধ দিন একটু বিশ্রাম নিলে হয় না?

ঘনাদা জবাব না দিয়ে যেভাবে ভসনার দৃষ্টিতে আমাদের দিকে চেয়ে বেরিয়ে গেলেন, তাতে মনে হল য়ুরি গ্যাগারিনকে ভোস্টকে চড়বার মুখে আমরা যেন পিছু ডেকেছি।

অতএব আবার মন্ত্রণাসভা বসাতে হল।

ঘনাদাকে এবার চাগানো যায় কী করে?

গতিক এবার মোটেই সুবিধের নয়। সমস্যাটাই গোলমেলে।

রাগারাগি ঝগড়াঝাঁটি কিছু হয়নি যে ঘনাদা জেদ করে গুম হয়ে আছেন। দিব্যি খাচ্ছেন-দাচ্ছে, ঘুরছেন-ফিরছেন, আলাপ-সালাপ করছেন, কিন্তু আসল টোপটি গেলাতে গেলেই কেমন পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছেন। এ ক-দিন হেন চেষ্টা নেই যে করিনি, কিন্তু সবই পণ্ডশ্রম। আমাদের জ্বলন্ত দেশলাইয়ের কাঠি যেন বারুদের বদলে ভিজে বালিতে পড়ে নিবে গিয়েছে।

এখন করা যায় কী!

তোয়াজ করা ছেড়ে চটিয়ে দেখা যাক। শিবুর পরামর্শ।

আহা, চটাতেই তো গেলাম। গৌরের হতাশা, কিন্তু কাজ হল কই।

আরও কড়া দাওয়াই চাই। আমার সিদ্ধান্ত।

আমার ধার দেওয়া সিগারেট সব ফেরত চাইব? শিশিরের দ্বিধা।

না, তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। আমাদের আশঙ্কা।

তা হলে ধার বাড়িয়ে দি? একেবারে পাঁচ হাজার? শিশিরের উৎসুক জিজ্ঞাসা।

মন্দ নয় মতলবটা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটাও বাতিল করতে হল। প্যাঁচটা পুরোনো। দাঁত কেটে গেছে। ঠিক ধরবে না।

হঠাৎ গৌর বলে উঠল, ঠিক হয়েছে, আর ভাবনা নেই।

কী ঠিক হয়েছে, কী? আমরা উৎসুক।

কানের জল কী করে বেলোয়? গৌর প্রশ্ন করে নিজেই জবাব দিলে, জল ঢেলে। তাই ভাঁওতা দিয়েই ভাঁওতা বার করতে হবে।

সেটা কী রকম?

ভাঁওতাটা দেব কী?

ভবি কি ভুলবে?

আমাদের প্রত্যেকের নানারকম সন্দেহ।

চল, দেখাই যাক না।

আমাদের তেতলার সিঁড়ির নীচে দাঁড় করিয়ে রেখে গৌর ঘরের মধ্যে কী করতে গেল জানি না।

খানিকবাদে যখন বেরিয়ে এল তখন হাতে তার একটা বাঁধানো খাতা।

আমাদের সরব ও নীরব কৌতূহল অগ্রাহ্য করে সে আগেভাগে সিঁড়ি দিয়ে বেশ একটু সশব্দেই ওপরে উঠল। আমরা তার পিছু পিছু।

তেতলায় ঘনাদার একানে একটি ঘর। সামনে ছোট একটু খোলা ছাদ।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই খোলা দরজার ভিতর দিয়ে দেখতে পেলাম ঘনাদা আমাদের পায়ের শব্দ পেয়ে তাড়াতাড়ি একটা জামা আর হাতের ছুঁচসুতোটা তক্তপোশের তলাতেই সরিয়ে ফেলে চোখের চশমাটা খুলছে।

তাঁকে এ সব তুচ্ছ কাজ যে করতে হয়, ঘনাদা তা জানাতে চান না।

গৌরই এখন সর্দার। কী তার প্যাঁচ না জেনে শুধু তার মুখের দিকে দৃষ্টি রেখে সকলে মিলে ভেতরে গিয়ে ঢুকলাম।

ব্যবস্থা সব করে ফেললাম, ঘনাদা! গৌর একেবারে মূর্তিমান উৎসাহ।

আমরাও চোখেমুখে যথাসাধ্য উজ্জ্বলতা ফুটিয়ে তুললাম দেখাদেখি।

হুঁ, করে ফেললে তা হলে! ঘনাদা চশমাটা খাপে ভরতে ভরতে এমনভাবে মন্তব্য করলেন যেন গৌর আর তাঁর মধ্যে এক ড্রয়ার ভর্তি চিঠিপত্র চালাচালি ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। কমিটি মিটিং-টিটিং পার হয়ে ব্যাপারটা বিশেষজ্ঞদের অনুমোদন নিয়ে এবার শুধু আইনসভায় পাস হবার অপেক্ষায়।

আমরাই মাঝে থেকে ভ্যাবাচাকা। একবার গৌরের মুখের দিকে তাকাই, আর একবার ঘনাদার দিকে।

সাংকেতিক গৌর-ঘনাদা সংবাদ আরও কিছুক্ষণ এমনই ভাবে চলল।

এ তো আর ফেলে রাখবার জিনিস নয়! গৌর যদি বলে তো ঘনাদা তৎক্ষণায় সায় দিয়ে বলেন, ফেলে রাখলে চলবে কেন! সেরকম পরামর্শ কেউ দিচ্ছে বুঝি?

দিলেই বা শুনছে কে? গৌরের মুখ থেকে খসতে না খসতে ঘনাদা বলেন, না, উচিতই নয়। এ কি একটা ছেলেখেলা!

এর মধ্যে শিবুও আছে তা ভাবতেও পারিনি। সে হঠাৎ বলে উঠল, একটু অসুবিধে অবশ্য হবে।

আমার একেবারে চক্ষুস্থির করে দিয়ে শিশির তাতে চটে উঠে বললে, হোক না অসুবিধে, তাতে আমরা পেছপাও নাকি! কাজের উদ্দেশ্যটা তো ভাবতে হবে।

উদ্দেশ্যটাই তো আসল। কমল হেরি ভ্রান্ত কেন কাঁটাবনে যেতে! না না, কাঁটা হেরি শান্ত কেন কমল, কমল…ওই মানে, যা বলে আর কী! আমার মুখ দিয়েও ফস করে কী ভাবে বেরিয়ে গেল দেখে আমিই অবাক।

মুখে মুখে পাক খেতে খেতে ব্যাপারটা যখন বেশ ঘোরালো ধোঁয়া হয়ে উঠেছে, গৌর তখন একটুখানি আলো ছাড়ল, মাটি অবশ্য অনেকটা ফেলতে হবে।

ঘনাদার চোখদুটো একটু বড় হল কি? ও চোখ দেখে বোঝা কঠিন।

আমরা তখন যা তোক একটা জো পেয়ে গেছি। আর আমাদের পায় কে।

হ্যাঁ, বেশ ভাল মাটি, বললে শিশির।

গঙ্গামাটিই ভাল। শিবু সুপরামর্শ দিলে।

কতই বা আর খরচ! একটা ঠেলা বোঝাই করে আনলেই হবে, আমি ব্যবস্থাটাও করে ফেললাম।

গৌর আরেকটু আলোকপাতের জন্যেই বোধহয় উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে ছাদটার দিকে তাকিয়ে যেন মনে মনে মেপে ফেলে বললে, ছোটখাটো একটা বাগান হবে— যাকে বলে, roof garden আর কী! তবে ফুল-টুল কিছু নয়, স্রেফ তরি-তরকারি। আলু-বেগুন-ঢ্যাঁড়স-ঝিঙে-পটল—পটলই বা নয় কেন?

গৌর ঘনাদার দিকে চেয়ে তাঁকে সমর্থন জানাবার সুযোগ দিলে।

কিন্তু ঘনাদার মুখে কোনও শব্দ নেই। শব্দ যদি বেরোয় তো মেঘের ডাকই শোনা যাবে মনে হয়। কারণ, ঘনাদা ছাড়া আর কারও মুখ হলে আষাঢ়ের মেঘের সঙ্গে তার মিলটা আরও স্পষ্ট বোঝা যেত!

ঘনাদা কিছু বলুন না বলুন, আমাদের থামলে চলে না। আমরা ধরতাই পেয়ে গেছি।

শিবুই ঘনাদার হয়ে জবাব দিলে, পটল নয় বা কেন, কী বলছিস! আলবৎ পটল, একশোবার পটল। পাটনাই পটল। পটলই যদি না ফলাতে পারলাম তো ছাদের উপর বাগান করা কেন? চেষ্টায় কী না হয়।

শিবু দম নেবার জন্য থামতেই আমি ধরে নিলাম, নিশ্চয়! অ্যাব্রাহাম লিংকনের কথা মনে করো না? কুড়ুল দিয়ে সেই গাছ কাটার পর বাবা জিজ্ঞেস করতেই কী বলেছিল?

জুৎসই দৃষ্টান্তগুলো যথাসময়ে আমার কেমন করে ঠিক জুগিয়ে যায়।

শিশির শুধু একটু শুধরে দিলে, লিঙকন নয়, স্যার আইজ্যাক নিউটন।

বন্ধুবিচ্ছেদের সময় এটা নয়। আমি উদারভাবে মেনে নিয়ে বললাম, ওই একই কথা। আসল ব্যাপার হল এই যে, খাদ্য বাড়াতে হবে, যেমন করে পারা, যেখানে পারো।

গৌর দ্বিগুণ উৎসাহিত হয়ে উঠল, ঠিক বলেছ। Grow more food! পৃথিবীতে খাদ্যাভাব দিন দিন বাড়ছে, দুর্ভিক্ষ রাক্ষসী করাল মুখব্যাদান করে ক্রমশ এগিয়ে আসছে সমস্ত মানবজাতির দিকে। এখন এতটুকু জমি ফেলে রাখলে চলবে না। ছাদ, ছাদই সই।

আর ঘনাদার ঘরের সামনেই যখন বাগান, তখন দেখাশোনা সম্বন্ধে তো ভাবতেই হবে, না! শিবু ছাদে তরি-তরকারির বাগানের সপক্ষে সব চেয়ে জোরালো যুক্তি দেখাল।

ঘনাদা তবু নীরব। চোখদুটোতেই শুধু একটু ঝিলিক যেন দিচ্ছে। এই ঝিলিক এখন না নেভে! গৌরকেই উদ্দেশ করে বললাম, নার্সারিতে বীজ-টিজের অর্ডার দিয়েছিস তো?

তা আর দিইনি! গৌর কর্তব্য সম্বন্ধে হুঁশিয়ারির প্রমাণ দিলে, শুধু বীজ কেন? সিৰ্জি থেকে ফসফেট, ধাপা থেকে হাড়ের গুঁড়ো-সব আনছি।

ঘনাদা এখনও যদি ফেটে না পড়েন তা হলে তো নাচার।

এইজন্যই বুঝি ব্রহ্মাস্ত্রটি গৌর এতক্ষণ চেপে রেখেছিল। এইবার বাঁধানো খাতাটা ভক্তিভরে ঘনাদার সামনে খুলে ধরে বলল, এখন এইটিতে শুধু একটা সই দিতে হবে ঘনাদা!

কেন? সেফটি ভালভ প্রায় ফাটিয়ে বয়লারের যেন স্টিম বেরুল।

এই আপনার সইটা সবার আগে থাকলে আবেদনটার দাম বাড়বে কিনা? গৌর সগর্বে জানালে।

কীসের আবেদন?–ছাদে ধান-খেত করার?

ঘনাদার বিদ্রুপটা গৌর গায়েই মাখলে না৷ বিনীত ভাবে বলল, না, না, ছাদে চাষ তো হচ্ছেই, তার ওপরে আরও কিছু করা তো দরকার এই খাদ্য-সংকটে। তাই আমরা সবাইকে একটা শপথ নেবার আবেদন জানাচ্ছি। এই পড়ুন না। আন্তর্জাতিক আবেদন বলে এসপেরান্টোতে লিখলাম।

বাঁধানো খাতার প্রথম পাতাটাতেই হিজিবিজি একটা কী লেখা রয়েছে বটে, কিন্তু তার পাঠোদ্ধার করতে লিপিবিশারদ প্রত্নতাত্ত্বিকেরও ক্ষমতায় কুলোবে বলে মনে হয় না।

ঘনাদা একবার সেদিকে চকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, তুমিই পড়ো।

এসপেরান্টোটা বাংলায় অনুবাদ করেই পড়ো। আমাদের কাতর অনুরোধ।

গৌর মূল এসপেরান্টো পড়তে না পারায় যেন বেশ ক্ষুন্ন হয়েই বাংলায় অনুবাদ করে যা শোনালে, তার মর্ম হল এই যে, পৃথিবীর অন্ন-সমস্যার আংশিক সমাধানের জন্যে আমাদের সকলকে এখন থেকেই স্বল্পাহারের শপথ নিতে হবে। আধ-পেটা যদি না পারি তো অন্তত সিকি ভাগ খাওয়া সকলে যেন ছাড়ে—এই আবেদন।

আবেদনটা বুঝিয়ে দিয়েই গৌর সোৎসাহে জানালে, পরীক্ষাটা নিজেদের ওপরই শুরু করছি, ঘনাদা! আজ থেকেই মেসের সিকি মেনু হেঁটে দিয়েছি। কাল সকাল থেকে ভাত ডাল আর স্রেফ একটি তরকারি। মাছ হতেও পারে, না-ও হতে পারে। মাপেও সব কিছু কম। থালায় বাটিতে যা দেবার দিয়ে এক হাতা করে তুলে রাখা হবে। যাকে বলে বাধ্যতামূলক জাতীয় সঞ্চয়।

এই? ঘনাদা নাসিকাধ্বনি করলেন।

হ্যাঁ, আপাতত তো এই। গৌর বেশ হতভম্ব। আমরা তো বটেই।

আপনি আরও কিছু ভেবেছেন নিশ্চয়? শিবুর উসকানির চেষ্টা।

আরও কিছু নয়, অন্য কিছু। ঘনাদা সংক্ষিপ্ত।

মানে গোড়াতেই আপনি অন্য কিছু বুঝেছিলেন? আমাদের বিস্ময়।

হ্যাঁ, ভেবেছিলাম, পেটেন্টটা বুঝি নেওয়ার ব্যবস্থা করে এসেছ। আমার চুঁচটা সত্যিই ফাল হয়ে বেরিয়েছে শেষ পর্যন্ত।

আপনার ছুঁচ! শিশির তক্তপোশের তলা থেকে ছুঁচসুষ্ঠু গুঁজে রাখা জামাটা তুলে ধরে ছুঁচটা বার করতে করতে বললে, ফাল তো হয়নি। এখনও ছুঁচই আছে দেখছি।

ও ছুঁচ নয়। ছুঁচের মতোই সরু ছোট কাঁচের পিপেট! ঘনাদা আমাদের প্রতি করুণাকটাক্ষ করে বললেন, একবার রক্তনদী বইয়ে যা সেইসঙ্গে একদিন জলে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল, যা না থাকলে সূর্যদেবকে বধ করার অস্ত্র এ যুগে আর তৈরি করবার আশা মানুষকে ছাড়তে হত।

সূর্যদেব মানে, আমাদের এই সত্যিকার আকাশের সূর্য, আপনার সেই ছুঁচেই কাত।

এক রকম তাই বলতে পারো, ঘনাদার বলার ধরনে বোঝা গেল কোনওরকম বড়াই তাঁর পছন্দ নয়।

শিশির ছুঁচটা রেখে দিয়ে সিগারেটের টিনটা তখন খুলে ফেলেছে।

ঘনাদা সিগারেট তুলে নিয়ে, ধরিয়ে, গোটা দুই সুখটান দিয়ে খানিকক্ষণ চোখ দুটি বুজে চুপ করে রইলেন।

আমরা উদগ্রীব।

আমাদের বেশ কিছুক্ষণ আশা-নিরাশার দোলায় দুলিয়ে রেখে ঘনাদা অবশেষে চোখ মেলে তাকিয়ে ওপরের ছাদটাকেই সম্বোধন করে বললেন, তখন আমি কোথায়?

আমরাও তখন আর নেই।

ঘনাদার এরকম স্মৃতিভ্রংশ আমাদের কল্পনাতীত।

তাঁর স্মরণশক্তির মরা আঁচ যথাসাধ্য চাগিয়ে তোলার আশায় যে যেমন পারি কাঠকুটো এগিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম।

কলম্বিয়ায়? আমার কুটো।

চুকচিদের দেশে! শিবুর প্যাঁকাটি।

নোভালা জেমলিয়া! গৌরের ক-ফোঁটা কেরোসিন।

আমাদেরই এই মেসে! শিশিরের এক আঁজলা জল একেবারে।

আমরা খেপে উঠে শিশিরকে নিয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার দরকার হল না।

ঘনাদার চোখদুটোর সঙ্গে কান দুটোও বোধহয় ছাদেই ছিল। সেখান থেকে আমাদের দিকে কৃপা করে নামিয়ে বললেন, হ্যাঁ, ইয়েমেন থেকে লালপানি পার হয়ে ইরিট্রিয়ার ওপর তখন ভাসছি। মার্কিন প্লেন, কিন্তু গাঢ় কমলা আর সবুজে ছোপানো গা, তাতে মান্ধাতার যুগের আম্‌হারিক অক্ষরে সব কিছু লেখা।

আমার পাশের সিটের ভদ্রলোক নড়ে-চড়ে বসলেন। মনে হল সেই নড়া-চড়াতেই বুঝি প্লেনটাই টালমাটাল হয়ে গোঁত্তা মেরে পড়ে।

প্লেনের সিটগুলো নেহাত ছোটখাটো নয়। কিন্তু ভদ্রলোক একেবারে বৃত্রাসুরের বড় ভাই। দুটো সিট ভেঙে এক করে দিলে হয়তো তিনি একটু আরাম করে বসতে পারতেন। কিন্তু তার তো উপায় নেই। ইয়েমেন থেকেই পাশের সিটে এই পাঁচমণি লাশের মৃদুমন্দ ঠেলাঠুলি ধাক্কা খেতে খেতে আসছি। তিনি স্বস্তিতে বসতে না পেরে উসখুস করছেন, সেই সঙ্গে আমিও।

ভদ্রলোক নীচের দিকে চেয়ে হঠাৎ বললেন, এই ইরিট্রিয়া নিয়েও ইতিহাসে এত মারামারি। দেশটার চেহারা দেখেছেন!

বললাম, যা দেখছেন তা ইরিট্রিয়া নয়।

ইরিট্রয়া নয়!

সামনে পেছনে ও পাশে যাঁরা বসে ছিলেন, তাঁরাও চমকে উঠলেন সে আওয়াজে। চমকাবার মতোই আওয়াজ। ভদ্রলোকের গলাখানি তাঁর বপুর সঙ্গেই পাল্লা দেবার মতো। সেই গলা তিনি আবার চটে উঠে ছেড়েছেন সপ্তমে।

আশেপাশের যাত্রীরা কেউ একটু মুচকে হেসে, কেউ বিরক্তিকর কুটি করে, মুখ ফেরালেন।

আমি শান্তভাবে বললাম, না, ইরিট্রিয়া ছাড়িয়ে ফরাসি সোমালিল্যান্ডের পাড় ছুঁয়ে আমরা এখন ইথিয়োপিয়ায় পৌছে গেছি।

ভদ্রলোক খানিকক্ষণ আমার মুখের দিকে যেভাবে তাকালেন, তাতে মনে হল, জানলা ভেঙে আমায় টুপ করে বাইরে ফেলে দেবেন, না, প্লেনের ভেতরেই হাড়গোড়-ভাঙা দ বানিয়ে দেবেন, ঠিক করে উঠতে পারছেন না।

শেষ পর্যন্ত কী ভেবে বলা যায় না, নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন গলাটা সপ্তম থেকে একটু নামিয়ে, আপনি এ সব জায়গা চেনেন? আগে এসেছেন কখনও?

তা, আসতে-টাসতে হয় মাঝে মাঝে। একটু হেসে কবুল করলাম।

কেন? বাজখাঁই গলার প্রশ্নে আবার প্লেনটা বুঝি কাঁপল।

তোজোকে একটু আদর করতে।

তোজোকে আদর করতে! কে সে?

হেসে তাঁর দিকে ফিরে গলা নামিয়ে সাবধান করার সুরে বললাম, যা বলে ফেলেছেন, ফেলেছেন। ইথিয়োপিয়ার বুকের ওপর তাদেরই প্লেনে বসে তোজো কে, এ প্রশ্ন আর করবেন না। আগেকার দিন হলে কোতল করতেও পারত।

কোতল করত? আমাকে! ভদ্রলোকের ওই চেহারাই আরও ফুলে ফেঁপে জামার বোতামগুলো প্রায় ঘেঁড়ে আর কী!

তাঁকে ঘাড় কাত করে আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে যেন সসম্রমে বললাম, না, আপনাকে বোধহয় সাহস করত না।

ভদ্রলোক এবার একটু খুশি হলেন মনে হল। তাই আবার একটু টিপুনি দিয়ে বললাম, তবে নেস নাগান্তির কানে কথাটা না যাওয়াই ভাল।

নেগুস নাগান্তি! নামটা শুনেই ভদ্রলোকের গলায় আর যেন তেমন ঝাঁজ পাওয়া গেল না। একটু হতভম্ব হয়েই জিজ্ঞাসা করলেন, নেগুসই তো জানি, নেগুস নাগান্তি আবার কী? তোজোর সঙ্গে তাঁর কী সম্পর্ক?

নেগুস বলতে বোঝায় সম্রাট আর নেগুস নাগান্তি মানে সম্রাটের সম্রাট, রাজচক্রবর্তী। তোজো হল তাঁরই পোষা চল্লিশটি সিংহের মধ্যে সবচেয়ে যেটি পেয়ারের, তার নাম। নেগুস-এর প্রাসাদে সে ছাড়াই থাকে সারাক্ষণ।

ভদ্রলোক আমার দিকে খানিক চেয়ে থেকে কী ভাবলেন কে জানে। তারপর হঠাৎ পাশেই রাখা আমার হাতটা ধরে ফেলে করমর্দনের ছুতোয় হাড়গোড়গুলো কতখানি পলকা পরীক্ষা করতে করতে খুশিতে ডগমগ হয়ে বললেন, আপনার সঙ্গে আলাপ করে অত্যন্ত সুখী হলাম। আপনার নামটা জানতে পারি?

হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে যেন প্রায় ককিয়ে ককিয়ে বললাম, অধীনের নাম দাস। এখন আপনার নামটা জানবার সৌভাগ্য এই গোলামের হবে?

কথাবার্তা আরবিতেই হচ্ছিল। এ সব বিনয় সৌজন্য ও-ভাষায় জমে ভাল।

ভদ্রলোক বাদশাহি চালেই বললেন, শেখ ইবন ফরিদ।

ইবন ফরিদ! নামটা শুনে আমি গদগদ হয়ে উঠলাম, প্রায় সাড়ে সাতশো বছর আগে এক ইবন ফরিদ আরবকে ধন্য করেছিলেন। তাঁর কথা আর আপনাকে কী বলব। নিশ্চয় জানেন।

তা আর জানি না। ইবন ফরিদ তাঁর আকর্ণবিস্তৃত গোঁফে চাড়া দিলেন।

আপনিও তো তাঁর মতো টহলদার দেখছি। তিনি অবশ্য মস্ত বড় ভৌগোলিক ছিলেন। আপনি সেরকম লেখেন-টেখেন নাকি?

আমার দিকে চেয়ে একবার চোখ মটকে হাসতে হাসতে ইবন ফরিদ বললেন, এখনও লিখিনি। তবে লিখব। সময় হলেই লিখব। আপনি তো আড্ডিস আবাবাতেই থাকবেন?

ইচ্ছে তো সেইরকম। সবিনয়ে স্বীকার করলাম।

হ্যাঁ, নেগুস-এর পোষা সিংহ নির্ভয়ে আদর করতে হলে ওখানেই থাকতে হয় আর বুনো সিংহ শিকার করতে হলে যেতে হয় অন্য কোথাও। বলে ইবন ফরিদ আমার পায়ের ওপর বিরাশি সিক্কার একটি আদরের থাপ্পড় দিয়ে প্লেন ফাটিয়ে হাসতে আরম্ভ করলেন।

 

আড্ডিস আবাবা শহরের সবচেয়ে যা আমার ভাল লাগে, তা সেখানকার গন্ধ। পৃথিবীর ছোট বড় আর কোনও শহরের অমন অপরূপ গন্ধ আছে বলে জানি না। গন্ধটা পোড়া ইউক্যালিপটাস কাঠের। সমস্ত হাবশি জাতিদের যিনি এক রাজছত্রতলে মিলিয়েছিলেন, সেই নেগুস নাগান্তি দ্বিতীয় মেনেলিক সর্বত্র ইউক্যালিপটাস গাছ পুঁতেছিলেন। সে গাছ এত বেড়েছে যে, লোকেরা ইউক্যালিপটাস জ্বালানি কাঠ হিসেবে পোড়ায়। শহরের হাওয়ায় তাই একটা মিষ্টি পরীদের গায়ের মতো সুবাস সারাক্ষণ ভাসছে।

রাত্রে সে গন্ধটা আরও মন মাতানো। তা-ই নেশায় হোটেল থেকে বেরিয়ে শহরের একেবারে প্রান্ত পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম। হোটেলের ম্যানেজার বেরুবার সময় সাবধান করে দিয়েছিল যে, আড্ডিস আবাবার পথে-ঘাটে সারারাত হায়নারা চরে বেড়ায়। আশেপাশের পাহাড় থেকে তারা নেমে আসে, আবার ভোর হতেনা-হতে ফিরে যায়। জ্যান্ত মানুষকে সাধারণত তারা এড়িয়ে চলে, তবে দুনিয়ায় অমন ছিচকে শয়তান জানোয়ার আর দুটি নেই। বেকায়দায় পেলে তারা সব করতে পারে। কোনও রকমে জখম অসহায় অবস্থায় পেলে জ্যান্ত মানুষের মাংস তারা খুবলে খেতে পারে।

আড্ডিস আবাবার রাস্তাঘাট অত রাত্রে বেশ নির্জন পেয়েছিলাম। দিনের বেলায় গাধা ও ঘোড়ার সে নোংরা ভিড় আর নেই। এখানে সেখানে দু-একটা হায়না দূর থেকে চোখে পড়েছে। দেখতে না দেখতে তারা ছায়ার মতো মিলিয়ে গেছে কোথায়।

শহরের একদিকের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত এসে যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখান থেকে একটি তেপান্তরের রাস্তা সুডানের খার্তুম হয়ে মরুভূমির দেশে ওয়াদি হালফার দিকে গেছে। এই পথেই ইথিয়োপিয়ার রাজারা একদিন উত্তরের দিকে দিগ্বিজয়ে গিয়েছিলেন!

কিছুদুরে কোথায় একটা হায়নার হাসির শব্দে চমকে ফিরতেই এমন কিছু দেখলাম, যাতে শরীর-মন এক মুহূর্তে সজাগ হয়ে উঠল। একটা মোটা ইউক্যালিপটাস গাছের গুঁড়ির পেছনে নিজেকে পাথরের মতো নিস্তব্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

হায়না কিংবা জন্তু জানোয়ার কিছু নয়, মানুষ। আর এই মানুষটিকে অন্তত এত রাত্রে শহরের এই প্রান্তে দেখবার কথা সত্যি বলতে গেলে কল্পনাও করিনি।

মুখ দেখতে পাওয়ার দরকার নেই। আকার দেখেই মানুষটাকে চিনতে দেরি হয় । আবিসিনিয়ার মানুষরা শক্ত সমর্থ জোয়ান হয় বটে, কিন্তু অমন একটা দৈত্যাকার মাংসের পাহাড় অন্তত এই কদিনে আড্ডিস আবাবার রাস্তায় ঘাটে দরবারে কোথাও চোখে পড়েনি।

ইবন ফরিদই যে পালের গোদা একটা গণ্ডারের মতো নির্জন রাস্তা দিয়ে শহরের বাইরে কোথাও হনহন করে হেঁটে চলেছে, এ বিষয়ে তখন আর সন্দেহ নেই।

কিছুদূর সে এগিয়ে যাবার পর নিঃশব্দে তার পিছু নিলাম। খুব নিঃশব্দে নেবার দরকার ছিল না। কারণ, সে নিজেই পদভারে মেদিনী কাঁপিয়ে যেভাবে চলেছে, তাতে আর কোনও শব্দ তার কানে যাবার কথা নয়।

কিন্তু ইবন ফরিদ সত্যি চলেছে কোথায়? শহর তো এইখানেই শেষ। তারপর তো প্রায় গাছপালাহীন পাথুরে ঢেউখেলানোে তেপান্তর।

হঠাৎ মনে পড়ল দুদিন আগেই আড্ডিস আবাবার বাজারে যে-শিকারির সঙ্গে আলাপ হয়েছে তার কথা। শখের শিকারি সে নয়। দুর্লভ দামি চামড়ার ব্যবসার খাতিরেই তার শিকার। বিশেষ করে কালো চিতার খোঁজেই সে আবিসিনিয়ার এমন সব দুর্গম দূর জায়গায় দেশি অনুচরদের নিয়ে যায় যে নেগুসের তহসিলদাররাও জানে কিনা সন্দেহ।

শহরের বাইরেই সম্প্রতি সে তাঁবু গেড়েছে জানি। লোকজন রসদ সংগ্রহ করে নুতন শিকারের সফরিতে বেরুনোই তার উদ্দেশ্য।

আমার অনুমানই ঠিক। কিছুদূর যেতেই শিকারির সাদা তাঁবুটা অন্ধকারেই রাস্তার ধারে ঝাপসা ভাবে দেখা গেল। কাছে-পিঠে বাঁধা ঘোড়াগুলোরও পা ঠোকার শব্দ শোনা গেল সেই সঙ্গে সঙ্গে।

ইবন ফরিদের আসাটা যে অপ্রত্যাশিত নয়, শিকারিকে টর্চ হাতে তাঁবু থেকে কিছু দুরে অপেক্ষা করতে দেখেই তা বোঝা গেল।

শিকারির হাতের টর্চটা একবার জ্বলে উঠতে ইবন ফরিদ হাঁক দিয়ে তার উপস্থিতি জানালে। আমি তখন পথের ধারে মাটির উপর শুয়ে পড়েছি।

ইবন ফরিদের চালচলনে সন্দেহ করবার মতো সত্যিই অবশ্য তখনও কিছু নেই। হাঁক দিয়ে সাড়া দেওয়াটা অন্তত লুকোচুরি কোনও ব্যাপারের সঙ্গে খাপ খায় না।

কিন্তু গোপনীয় যদি কিছু না হয়, তা হলে এত রাত্রে এই শহরের বাইরে এসে দেখা করার মানে কী?

ইবন ফরিদের আড্ডিস আবাবায় এতদিন থাকাটাও তো একটু অদ্ভুত। টিটকিরি দিয়েও আমায় যা সে জানিয়েছিল, তাতে এতদিনে তার তো সিংহ-শিকারে বেরিয়ে যাবার কথা। আড্ডিস আবাবায় প্লেন থেকে নামবার পর এই ক-দিনের মধ্যে কোথাও আর না দেখে আমি তার কথাটা সত্যি বলেই নিয়েছিলাম।

এতদিন সে ছিল কোথায়? লুকিয়েই বা ছিল কেন?

হাতে পাঁজি মঙ্গলবার। রহস্য কিছু থাক বা না-থাক, শেষ পর্যন্ত ভাল করে ব্যাপারটা না বুঝে আমি ফিরব না ঠিক করে ফেলেছি।

ইবন ফরিদকে নিয়ে শিকারি তার বড় তাঁবুটায় ঢোকবার পরই অত্যন্ত সন্তর্পণে তাঁবুর বাইরে গিয়ে বসলাম।

নিস্তব্ধ রাত। ঘোড়াদের নিঃশ্বাস আর পা ঠোকার শব্দ ছাড়া মাঝে মাঝে এদিক-ওদিক থেকে হায়নার হাসি শুধু শোনা যাচ্ছে।

ভেতরে কথাবার্তা চলছে বুঝতে পারছি, কিন্তু তাঁবুর কাপড়টা বেশ মোটা। দু একটা শব্দ ছাড়া ভাল করে কোনও কথা বোঝা যাচ্ছে না।

কথাবার্তা ফরাসিতেই চলছে সন্দেহ নেই। কিন্তু দুজনের কারুরই যে ফরাসি মাতৃভাষা নয়, যেটুকু শুনতে পাচ্ছিলাম তার উচ্চারণ ও বলার ধরন থেকেই বুঝলাম।

শিকারি লোকটির সঙ্গে আড্ডিস আবাবার বাজারে ইথিয়োপিয়ার আমহারিকেই আলাপ হয়েছিল। তাতে তাকে হাবশি ভাবিনি, ভাবার কোনও কারণও ছিল না। রোদে পোড়া চেহারাটা একেবারে কড়া তামাটে হয়ে এলেও তার মুখ-চোখের গড়ন থেকে চুলের রঙে বোঝা যায় মধ্যোপসাগরের উত্তরে ইউরোপের কোনও দেশের সে লোক। এদেশে অনেক দিন থেকে ভাষাটা দেশের লোকের মতোই বলতে শিখেছে।

এখন কিন্তু তার অশুদ্ধ ফরাসি উচ্চারণেও কী যেন একটা ইঙ্গিত পাচ্ছিলাম। মদ্রদেশের অনেকের ইংরেজি উচ্চারণে যেমন জাতীয় বৈশিষ্ট্য ধরা যায়, এ-ও অনেকটা প্রায় তাই।

ফরাসিটা চোস্ত শিখেছিলেন বটে ঘনাদা! শিবু হঠাৎ ফোড়ন পেড়ে বসল, ভুল উচ্চারণ শুধু ধরে ফেলেন না, তা থেকেই ভুল যে করে তার জাতের খবর পর্যন্ত বার করে ফেলেন!

ঘনাদার সিগারেটটার ধোঁয়াতে আমরা হঠাৎ বোধহয় কাশতে শুরু করলাম। সে কাশিকে হাসি চাপার চেষ্টা বলে যদি কেউ সন্দেহ করে আমরা নাচার।

ঘনাদা অন্তত করলেন না। শিবুর তারিফটা একটু হেসে অম্লান বদনে হজম করে শুরু করলেন, লোকটা গ্রিক বলে বুঝলাম। শুধু ওইটুকু নয়, বুঝলাম তার চেয়ে আরেকটু বেশি। জন্তু-জানোয়ারের চামড়া শিকারই লোকটার ব্যবসা হতে পারে, কিন্তু সে নেহাত সাধারণ শিকারি মাত্র নয়। ইবন ফরিদ তো নয়ই। একটু দুটো কথা যা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম, তা শিকারের জগতের নয়।

নিউক্লিয়ার ফিশন অর্থাৎ পারমাণবিক বিস্ফোরণ কোথায় লাগে কিংবা বিজ্ঞানে সত্যিকার যুগান্তর, এ ধরনের কথা কালোচিতার খোঁজে ইথিয়োপিয়ারও পাণ্ডববর্জিত অঞ্চলে ঘুরে বেড়ায়, অথবা বুনো সিংহ-শিকার যার নেশা, সেরকম লোকদের আলাপের বিষয় হওয়া একটু আশ্চর্য।

আরও একটু ভাল করে যদি শুনতে পেতাম! সেই চেষ্টাতেই তাঁবুর কাপড়ের গায়ে কানটা ভাল করে লাগাতে গিয়েই কেলেংকারি করে ফেললাম। আর তাতেই শাপে বর হয়ে গেল।

তাঁবুর গায়ে কানটা লেপটে লাগাতে গিয়ে অসাবধানে তাঁবুর বাইরের একটা খুঁটিতে বাঁধা দড়িতে কেমন করে হাত ঠেকে গেছল।

তাঁবুটা একটু তাতে নড়ে উঠতেই চারিদিক কাঁপিয়ে দড়াম দড়াম করে দুটি পিস্তলের গুলি ছুটল।

দুটোই কানের পাশ দিয়ে তো? শিবুর আবার সরল জিজ্ঞাসা।

না, ঘনাদার গলাটা একটু বেশি ভারী শোনাল।

সন্ত্রস্ত হয়ে আমরা শিবুকে ধমকালাম, শিবুটার কেমন বুদ্ধি! দুটোই কানের পাশে হয় কখনও? রবার্ট ব্লেকের গল্প পেয়েছিস!

শিবুর দিকে পিস্তলের নলটার মতোই অগ্নিদৃষ্টি ফেলে ঘনাদা বললেন, দুটো গুলিই কাছাকাছি একেবারে মাথার ঠিক ওপর দিয়ে। খানিকটা চুলের ডগা পুড়েই গেল তাতে।

হাসি দূরে থাক, আমরা কাশি পর্যন্ত চেপে রইলাম প্রাণপণে।

ঘনাদা আমাদের তদগত চেহারাগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে আবার শুরু করলেন, স্পষ্ট তারপর শুনতে পেলাম গ্রিক শিকারি বলছে, আপনি কি খেপে গেলেন নাকি ফরিদ সাহেব? গুলি ছুঁড়লেন কাকে?

কেউ যদি থাকে? বলে ইবন ফরিদ হাসল, আপনি বুঝতে পারছেন না, সিয়ে সোলোমাস। সাবধানের মার নেই। তাঁবুটা কী রকম নড়ে উঠল দেখলেন? কেউ থাকতেও পারে ওখানে।

থাকতে পারে দুটো-একটা হায়না। সোলোমাসের গলাটা প্রসন্ন নয়, রাত্রে মাঝে মাঝে তাঁবুর আশেপাশে খাবারের গন্ধ শুকে অমন ঘোরে। দিলেন তো তাঁবুটা ফুটো করে!

আরে, ও ফুটো! ক্যাম্বিসের তাঁবুর বদলে রাজপ্রাসাদ পাবেন থাকবার, কাজটা যদি হাসিল হয়। আচ্ছা, তাঁবুর বাইরেটা একবার ঘুরে দেখে এলে হয় না? ইবন ফরিদের সন্দেহটা তখনও যায়নি বোঝা গেল।

আমি সবে গা ঢাকা দেবার জন্যই তৈরি হচ্ছিলাম। কিন্তু সোলোমাসের কথায় আশ্বাস পেলাম।

সোলোমাস তখন বলছেন, মানুষ হলে না লাগলেও ভয়ে একবার চেঁচাত। জানোয়ার হলেও তাই। মিছিমিছি আপনি জেগে স্বপ্ন দেখছেন। এখন কাজের কথা সেরে ফেলুন তাড়াতাড়ি।

এত স্পষ্ট সব কথা শুনতে পাওয়ার কারণ তখন আমি বুঝে ফেলেছি। তাঁবুর ওই দুটো পিস্তলের গুলির ফুটোই আমার সহায় হয়েছে।

ফুটো দুটো কাছাকাছি হওয়ায় আরও সুবিধে। আলতোভাবে তাতে কান ঠেকিয়ে কাজের কথাও শুনলাম।

ফরিদ তখন বলছে, ওই চিমসে কালা ছুঁচোটাই আমাদের ভরসা। হাঁটা পথে এখান থেকে যদিও কোথাও যায় তো আপনি আছেন, আর উড়ে কোথাও যেতে চাইলে আমি। আসল ঘাঁটি ওরই শুধু জানা। সেখানেই চলেছে যতটা পারে এলোমলো ঘুরে ফিরে সকলের চোখে ধুলো দিয়ে। ওকে নজরে রেখে পিছু নিলেই কাম ফতে। হতভাগা জানেও না যে, যমকে ফাঁকি দিতে পারে, তবু আমাকে নয়। কাজটা শেষ করে যমের চেহারাই ওকে দেখাব।

দু-চারটে অন্য কথা বলে ফরিদ তাঁবু থেকে বেরুল। বেরোবার সময় সোলোমাসের টর্চটা ধার নিয়ে তাঁবুর পেছনটা তদারক করে দেখে যেতেও ভুলল না।

আমি তখন সেখান থেকে সরে গিয়েছি অবশ্য।

ফরিদ চলে যাওয়ার পর ধীরে-সুস্থে গিয়ে সোলোমাসের তাঁবুর পর্দাটা সরালাম।

সরাতে না সরাতে সত্যই অবাক।

আসুন, দাস! বলে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে সোলোমাস আমার দিকেই ফিরে দাঁড়িয়ে হাসছেন, আপনার অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে আছি।

আমার অপেক্ষায়? আমি সন্দিগ্ধ ভাবে সোলোমাসের দিকে তাকালাম।

হ্যাঁ, আপনারই। তাঁবুর পেছনে বসে সবই তো শুনেছেন।

আমিই যে তাঁবুর পেছনে ছিলাম, তা-ও আপনি জানতেন? আমি সত্যই অবাক। প্রথমে কি আর ঠিক জানতাম! কিন্তু দুটো গুলির পরও না চিৎকার, না পালাবার শব্দ শুনে বুঝলাম একটি মানুষ ছাড়া দুনিয়ায় আর কারও পক্ষে এ মনের জোর সম্ভব নয়।

সেই একটি মানুষের এত পরিচয় আপনি জানলেন কী করে?

সোলোমাস হাসলেন—তা হলে আর তাঁবুর পেছনে শুনলেন কী? আপনার পরিচয় জানাই তো আমাদের আসল কাজ। পরিচয় না জেনে কি আপনার পিছু নিয়েছি?

তা হলে আমার পিছু নিয়েছেন সে কথা স্বীকার করছেন!আমি ভেতরে ভেতরে গোলমালে পড়লেও বাইরের কড়া গলায় তা বুঝতে দিলাম না।

না স্বীকার করে উপায় কী! বিশেষ নিজের কানেই সব যখন শুনে ফেলেছেন।

ক্রমশ আমিই যেন বেকায়দায় পড়ছিলাম কথা কাটাকাটিতে তাই একটু রেগেই বললাম, আমিই তাঁবুর পেছনে ছিলাম বুঝেও ফরিদ সাহেবকে হায়নার কথা বলেছিলেন কেন?

আলাপ-আলোচনাটা দীর্ঘ হবে মনে হচ্ছে, সোলোমাস হাসলেন, আপনারও অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করবার আছে, আমারও কিছু বলবার। সুতরাং এমন ভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে একটু বসলে হত না। এত রাত্রে আপনাকে আর কী দিয়ে আপ্যায়িত করতে পারি। খাঁটি জংলি মধু থেকে তৈরি আবিসিনিয়ার নামকরা তেজ আছে। বসুন। তাই একটু চাখতে দিই।

না, তার দরকার হবে না। আমি এমনিই বসছি। এখন আমার কথাগুলোর জবাব দিলে বাধিত হব। বলে আমি চিতার চামড়ায় ঢাকা একটা নিচু কৌচের উপর

বসলাম।

সোলোমাসও পাশে একটা মোড়া টেনে বসে বললেন, কেন ফরিদ সাহেবকে হায়নার কথা বলেছিলাম এই কথা জানতে চাইছেন তো? বলেছিলাম ফরিদ সাহেবকে ধোঁকা দেবার জন্য। হায়নারা রাত্রে শহরের রাস্তায় ধাঙ্গড়ের কাজ করে ঘঘারে, আমার তাঁবুর দড়ি নাড়তে তারা কখনও আসে না আমি জানি।

ওঃ, আমায় তা হলে অনুগ্রহ করেছিলেন! এ অনুগ্রহের কারণ? এবারে সত্যি অবাক হওয়ার দরুন বিদ্রুপের সুরটা ঠিক গলায় ফুটল না।

অনুগ্রহ নয়, আত্মরক্ষা যদি বলি!

আত্মরক্ষা! আপনি আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন?আমি জ্বলে উঠলাম, শত্রুকে বাঁচাবার চেষ্টা আপনার আত্মরক্ষা!

কথাটা একটু গোলমেলে বটে! সোলোমাস হাড়-জ্বালানো হাসি হেসে বললেন, আমি অবশ্য বলতে পারি, শত্রুকে বাঁচানোই এ ক্ষেত্রে আমাদের আত্মরক্ষা। ফরিদ সাহেব আহাম্মুক, তাই না বুঝে শুনে অমন গুলি ছুঁড়েছিল! আপনি মারা গেলে আমাদের নিজেদেরই তো সর্বনাশ। যা খুঁজছি তার পথ দেখাত তা হলে কে!

এই তা হলে আপনার কৈফিয়ত? কিন্তু মারা তো আরেকটু হলে গিয়েছিলাম, টিপটা একটু না দৈবাৎ ফসকালে!

দৈবাৎ যেটা ভাবছেন, তার পিছনে মানুষের হাতও তত থাকতে পারে? এই সোলোমাসেরই হাত?

আমি বিস্ময় সামলে ওঠার আগেই সোলোমাস এবার গম্ভীর হয়ে বললেন, হ্যাঁ, আমিই গুলি ছোঁড়বার সময় হঠাৎ চমকাবার ভান করে হাতটা তার একটু ওপর দিকে নাড়িয়ে দিয়েছিলাম।

কেন? তখনও তো আপনি জানেন না যে আমিই ওখানে আছি।

ঠিক জানি না, কিন্তু আশা একটু করছিলাম বই কী! আপনার এত খবর আমরা রাখছি, আর আপনি আমাদের এই ডেরার খবর নিতে একবার আসবেন না তদন্তে, এ কি হতে পারে।

মনে মনে লজ্জিত হয়ে অবশ্য স্বীকার করলাম যে ইবন ফরিদকে ঠিক বুঝেও সোলোমাসকে একেবারেই সন্দেহ করতে পারিনি। মুখে কিন্তু ঝাঁজের সঙ্গে বললাম, আমি আসব—তাও জানতেন, এসেছি কি না এসেছি ঠিক না জেনেই প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করেছেন, এখন আবার আমারই অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলেন! আপনার রহস্যটা কী বলুন তো? সাপ নেউল দুই-এর মাথাতেই হাত বুলোতে চান নাকি?

একরকম প্রায় ধরে ফেলেছেন! অন্তত ফরিদ সাহেবের খুব হিতৈষী যে নয় বোঝা উচিত।

হিতৈষী তা হলে কার? সন্দিগ্ধ ভাবে জিজ্ঞাসা করলাম।

আপনাদের। সোলোমাসের এবার স্পষ্ট উত্তর।

তা হলে ফরিদ সাহেবের দলে কেন?

চোরের উপর বাটপাড়ি করবার জন্য। সোলোমাস হাসলেন।

হাসিতে চটে গিয়ে বললাম, বিশ্বাস করব কীসে?

প্রমাণ দিলে। সোলোমাসের জবাবে কোনও দ্বিধা নেই।

দিন প্রমাণ তা হলে! আমি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সোলোমাসের দিকে তাকালাম।

ধরুন, যদি বলি রেনে লাভাল? সোলোমাসের মুখে ঈষৎ হাসি দেখা গেল।

ওনাম শত্রুরা সবাই জানে।আমিও অবিশ্বাসের হাসি হাসলাম এবারে।

তাহলে এমন কিছু বলি যা শত্রুদের জানবার কথা নয়?

তাই তো শুনতে চাইছি, আমি কড়া গলায় বললাম।

মোট একশো সাঁইত্রিশ। বলে সোলোমাস আমার দিকে চেয়ে মুচকে মুচকে হাসতে লাগলেন।

আমি তখন সত্যই চমকে গেছি। কোনও রকমে সামলে জিজ্ঞাসা কমলাম, কি রকম মিলিয়ে?

পাঁচ, চটপট জবাব দিলেন সোলোমাস।

আমি সত্যই তাজ্জব।

আমরাও। গৌর তো বলেই ফেলল, ভারী মজার ধাঁধা তো ঘনাদা!

হ্যাঁ, সাঙ্ঘাতিত মজার! সে মজার ধাঁধার উত্তর খুঁজতে বাঘা বাঘা বৈজ্ঞানিকেরা সারা দুনিয়ায় তখন হিমসিম খাচ্ছে, আর শয়তানেরা ছলে বলে কৌশলে তা আদায় করবার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘনাদা সিগারেটটায় কয়েকটা রাম টান দিয়ে ফেলে দিয়ে বলতে শুরু করলেন, সোলোমাস অন্তত সে শয়তানের দলের নন এটুকু তখনই বুঝলাম। কারণ, যেটুকু তিনি বলেছেন শয়তানের কারুর তা কল্পনারও বাইরে। কিন্তু সত্যি সোলোমাস তাহলে কে? শত্রুর দলে তিনি এমন করে পরিচয় ভাঁড়িয়ে আছেনই বা কেন? চোরের ওপর বাটপাড়ি করাই তাঁর উদ্দেশ্য বলছেন। সত্যিই কি তাই? চোরের ওপর বাটপাড়ি তিনি করছেন কী স্বার্থে! কার হয়ে?

এসব প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরছিল বলেই খানিকক্ষণ চুপ করে ছিলাম।

সোলোমাসই হেসে বললেন, আপনি খুব মুশকিলে পড়েছেন বুঝতে পারছি, দাস। আরও একটা প্রমাণ তাই দিচ্ছি। এমন অকাট্য প্রমাণ যা পেলে অবিশ্বাসের আর কোনও কারণ থাকবে না আশা করি।

একটু থেমে যেন আমার মুখের ভাবটা পরীক্ষা করে সোলোমাস বললেন, আপনার এখান থেকে নাইরোবি যাবার কথা। কেমন ঠিক না?

এবার আমি একেবারে থ! আমায় গোপন নির্দেশ যে পাঠিয়েছে, সে এবং আমি ছাড়া দুনিয়ায় এ-খবর কারুর জানার কথা নয়। আড্ডিস আবাবা থেকে যে নাইরোবি যেতে হবে, এ-খবর আমি নিজেই ইয়েমেন থেকে রওনা হবার আগে জানতাম না। ঠিক রওনা হবার কিছু আগে সুইজারল্যান্ডের এক ব্যাঙ্কের ছাপমারা লেফাফার ভেতর সংকেতলিপিতে এই নির্দেশ এসেছে যে, আড্ডিস আবাবার বিশেষ একটি হোটেলে কদিন থেকে আমি যেন নাইরোবিতে রওনা হই। সেখান থেকে কোথায় যেতে হবে তার নির্দেশ নাইরোবির একটি সুইস ব্যাঙ্কের শাখাতেই পাব।

সোলোমাসকে অবিশ্বাস করার আর কোনও মানেই হয় না। কিন্তু তাঁর রহস্যটা কী তা না বুঝলে আর আমার শান্তি নেই।

তাঁর অনুমান যে ঠিক, একথা অকপটেই স্বীকার করে বললাম, আপনার কথাই ঠিক। কিন্তু যে-খবর শত্রুপক্ষের তো নয়ই, মিত্রপক্ষেরও কারুর জানা অসম্ভব, তা আপনি জানলেন কী করে? আমি এসব নির্দেশ কার মারফত পাই তা জানেন কি?

জানি বই কী! সোলোমাস হাসলেন, কোনও সুইস ব্যাঙ্কের মারফত।

যে কোনও সুইস ব্যাঙ্ক মক্কেলদের স্বার্থরক্ষার ব্যাপারে কীরকম বিশ্বাসী তা-ও নিশ্চয় জানেন! অবাক হয়ে আমি বললাম, মরা মানুষের পেট থেকে কথা বার হতে পারে, কিন্তু তাদের পেট থেকে হবে না। তাহলে আপনি এ খবর পেলেন কী করে?

সোজা উত্তরটা বুঝতে পারছেন না কেন? সোলোমাস যেন আমার নির্বুদ্ধিতায় একটু ক্ষুন্ন হয়ে বললেন, আমিও সুইস ব্যাঙ্কের মারফতই ওই খবরটা পেয়েছি। শুধু ওই খবরটুকু নয়, ওটা বাতিল করার নির্দেশও!

তার মানে?

তার মানে নাইরোবিতে নয়, আপনাকে এখন যেতে হবে সুদানের খার্তুম শহরে। নাইরোবি যাওয়া বাতিল করে এই নির্দেশ এসেছে।

মাথাটা সত্যিই গুলিয়ে যাচ্ছিল। যে আজগুবি টহলে একমাস আগে প্যারিস থেকে রওনা হয়ে ইউরোপের ও এশিয়ার নানা শহরে টক্কর খেতে খেতে ইথিয়োপিয়ার এই রাজধানীতে এসে পড়েছি, তাতে মাথা স্থির রাখা কঠিন। কিন্তু সোলোমাস সে অস্থির মাথাটি যেন চরকি বাজির মতো ঘুরিয়ে দিয়েছেন।

একটু নিজেকে সামলে জিজ্ঞাসা করলাম, এ নির্দেশ আমার কাছে না এসে আপনার কাছে এসেছে কেন?

বোধহয় আরও নিরাপদ করবার জন্যে।

কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার দেখা তো না হতেও পারত? আমি তো দৈবাৎ আজ এখানে এসে পড়েছি। এবার মনে হল অকাট্য যুক্তি দিয়েছি।

দৈবাৎ এসেছেন সত্যি। দৈবাৎ যদি না আসতেন তাহলে বাধ্য হয়ে আমাকেই যেতে হত খবরটা পৌঁছে দেবার জন্য। তবে আপনার মতো লোক ইবন ফরিদের সূত্র ধরে আমার কাছে পৌঁছোতেনই আমি জানি। তাই তখন বলেছিলাম, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি। শহরের বাজারে সেদিন আমি নিজে যেচে যে আপনার সঙ্গে আলাপ করেছিলাম, সে কথাও আশা করি মনে আছে?

এত ব্যাখ্যাতেও ব্যাপারটা আমার কাছে সম্পূর্ণ পরিষ্কার হল না। সোলোমাসের নিশ্চিত ধারণা দেখলাম, ইবন ফরিদের সূত্র ধরে তাঁর কাছে আমি পৌঁছোতামই। এই ধারণা কেমন করে এত দৃঢ় হল আমি বুঝতে পারলাম না। ইবন ফরিদকে যা-ই সন্দেহ করে থাকি, তোড়জোড় করে অনুসরণ করার মতো দাম তার আছে বলে তো মনে হয়নি।

অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসেই কি ফরিদকে অগ্রাহ্য করেছি। আর এই অগ্রাহ্য করাটা অনুমান না করতে পেরেই সোলোমাস অমন ধারণা করেছেন।

নিজের সন্দেহ-সংশয় আপাতত চাপা দিয়ে এবার অন্য প্রশ্ন করলাম, ইবন ফরিদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ হল কী করে? কী করে তার দলে ভিড়লেন?

ভিড়লাম চেষ্টা করে। এ ব্যাপারে আসল শনি যে কারা, তা তো আমাদের অজানা নয়। সুতরাং, তাদের ওপর নজর রাখতে তাদেরই দলে ভিড়বার ছল করতে হয়।

সে ছলে তারা ভুলবে কেন? একটু কড়া হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম।

যাতে ভোলে তার জন্যে পাঁচটা ঝুটোর মধ্যে একটা সাচ্চা খবর দিয়ে তাদের বিশ্বাস জাগাতে হয়।

তার মানে শত্রুদের সত্যিকার গোপন খবর আপনি জুগিয়েছেন? অবাক আর নয়, এবার আমি জ্বলে উঠলাম।

বললাম তো, সোলোমাস নির্বিকার ভাবে বললেন, তাদের বিশ্বাস করাবার জন্যই দিতে হয়েছে। অবশ্য এমন খবর দিয়েছি যাতে শেষ পর্যন্ত কোনও ক্ষতি হবার নয়।

যেমন?

যেমন ইয়েমেন থেকে আপনি আড্ডিস আবাবা আসছেন।

এই খবর আপনি দিয়েছেন। আমি একেবারে আগুন হয়ে উঠলাম, ওই ফরিদকে?

হ্যাঁ দিয়েছি, তাতে লোকসান হয়েছে কী? সোলোমাস হাসলেন।

আপনি কী বারুদ নিয়ে খেলা করছেন, জানেন?

জানি, বারুদ নিয়েই আমাদের খেলা, গম্ভীর হয়েই সোলোমাস বললেন এবার। খানিকক্ষণ চুপ করে রইলাম নিজের কর্তব্যটা স্থির করবার জন্য। সোলোমাসকে অবিশ্বাসও যেমন করতে পারা যায় না, তেমনই, বিশ্বাসও নয়। কী তাঁর প্যাঁচ, কী তাঁর মতলব কে জানে? হয়তো শত্রুপক্ষের চর হয়ে আমার ওপরও টেক্কা দেবার এটা এক নতুন ফন্দি।

মুখে সেসব কিছু না জানিয়ে চলে আসার আগে শুধু বললাম, আপনার কথা মতোই আমার রাস্তা বদলাচ্ছি। এর ভেতর চালাকি যদি কিছু থাকে—

তাহলে খার্তুমে গেলেই ধরা পড়বে, সোলোমাস নিজেই কথাটা পূরণ করে দিলেন।

 

খার্তুম গিয়ে সোলোমাসের নির্দেশ যে মিথ্যে নয় তার প্রমাণও যেমন পেলাম, সেই সঙ্গে আরেকটা এমন ব্যাপার দেখলাম, যেটা অত্যন্ত সন্দেহজনক।

ওখানকার সুইস ব্যাঙ্কের শাখায় সই দিয়ে সত্যিই একটা শিলমোহর করা নতুন নির্দেশের খাম পেলাম। খামটা নিয়ে খার্তুমের সবচেয়ে খানদানি রাস্তা খেদিভ অ্যাভেনিউ ধরে খেদিভ আর ভিক্টোরিয়া অ্যাভেনিউর মোড়ে যেখানে উটের পিঠে বসা জেনারেল গর্ডনের বিরাট ব্রোঞ্জের মূর্তিটা স্থাপিত সেখান পর্যন্ত এসেছি, এমন সময়ে দুরের আব্বাস স্কোয়ারের দিকে চোখ পড়ায় থমকে দাঁড়ালাম। আব্বাস স্কোয়ারের মাঝখানের জোড়া মিনারের বিরাট মসজিদের কাছ থেকেই যে-লোকটা আসছে তাকে দূর থেকে দেখেও চিনতে যেমন ভুল হবার কথা নয়, তার খার্তুমে আসাও তেমনই অভাবনীয়।

লোকটা আর কেউ নয়—ইবন ফরিদ।

সোলোমাস কি তাহলে দু-মুখখা সাপের শয়তানিই করেছে?

আমায় খার্তুম আসার নির্দেশ দিয়ে ফরিদকেও কি তা আবার জানিয়েছে!

না, আর ধোঁকার মধ্যে থাকার কোনও মানে হয় না। ব্যাপারটার একটা ফয়সালা এখুনি আজই করে ফেলতে হবে।

ফরিদ আমায় দেখতে পায়নি। ভিক্টোরিয়া অ্যাভেনিউ দিয়ে সে খেদিভ অ্যাভেনিউর দিকেই আসছে। গর্ডনের মূর্তির আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে খানিক অপেক্ষা করে আমি ফরিদের পিছু নিলাম দুর থেকে।

ফরিদ খেদিভ অ্যাভেনিউর একটা নামকরা হোটেলে গিয়ে ঢোকার কিছুক্ষণ বাদে সেখানে গিয়ে হোটেল-ক্লার্ককে জিজ্ঞাসা করে ঘরের নম্বর জেনে নিয়ে একেবারে সটান ইবন ফরিদের ঘরের দরজায় গিয়ে টোকা দিলাম! ফরিদের কামরার দরজায় কিন্তু বিরক্ত কোরো না বিজ্ঞপ্তি লটকানো।

ভেতর থেকে বাঘের মতো গলায় আওয়াজ এল, দূর হও। বাইরের নোটিস পড়তে পারো না!

কী করে পারব। হিব্রু ভাষায় বললাম, ইংরেজিটা যে জানি না।

খানিকক্ষণ ভেতরে আর কোনও আওয়াজ নেই। তারপর আবার বাজখাঁই গলায় প্রশ্ন হল, পড়তে পারো না তো আমার কথা বুঝলে কী করে?

ফরিদ সে কথা জিজ্ঞাসা করতে পারে অবশ্য। কারণ সে ইংরেজিতেই প্রথম ধমক দিয়েছিল।

বললাম, শুনে বুঝতে পারলেই কি পড়তে পারা যায়! তুমি তো আরবি বলো খাসা, কিন্তু অক্ষর চেনো কি?

ওধারে এবার গর্জন শোনা গেল, কী তুমি?

মোলায়েম মিষ্টি করে বললাম, ইবন ফরিদ।

দড়াম করে দরজাটা এবার খুলে গেল। ফরিদের মাংসের পাহাড়ে যেন ভূমিকম্প শুরু হয়েছে।

ও, তুই–মানে আপনি!ফরিদ চটপট সামলে নিয়ে বললে, আসুন, আসুন। তা, এ রকম রসিকতার মানে কী?

কামরার ভেতরে ঢোকার পর ফরিদ দরজাটা বন্ধ করে দিচ্ছে দেখে বললাম, যেন অবাক হয়ে, রসিকতা কোথায় দেখলেন?

ফরিদ গর্জন করতে পারলেই বোধহয় খুশি হত। তার বদলে অতি কষ্টে রাগ চেপে রেখে হাসবার চেষ্টা করে বললে, ইবন ফরিদ নামটা নেওয়া যদি রসিকতা না হয় তাহলে মাপ চাইছি।

ইবন ফরিদ নামটা রসিকতা! আমি যেন আকাশ থেকে পড়ে বললাম, আপনি যদি ও নাম নিতে পারেন, তাহলে আমি নিলেই রসিকতা হবে কেন?

ও নাম আমার নয় বলতে চান? ফরিদ আর বুঝি নিজেকে সামলাতে পারে না।

তাই তো বলছি। মধুর হেসে বললাম, আপনি ইবন ফরিদ তো নন-ই, আরবও আপনার দেশ নয়।

কথাটা বলে ফরিদের মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। এবার হয় সে ফাটবে, নয় প্যাঁচ খেলবে।

শেষেরটাই ঠিক হল। দু-এক মুহূর্ত কী ভেবে নিয়ে ফরিদ বললে, মানলাম আপনার কথাই সত্যি, কিন্তু আপনি জানলেন কার কাছে?

কারুর কাছে জানিনি, নিজেই বুঝেছি। আপনি আরবি ভাষা যত ভালই বলুন, সত্যিকারের আরব হলে অন্তত ইবন ফরিদ নামটার দাম জানতেন!

তার মানে? ফরিদ সত্যিই এবার একটু হতভম্ব।

মানে, ইবন ফরিদ যে পর্যটক ভূগোলবিদ নয়, আরবি ভাষার অদ্বিতীয় একজন সুফি কবি, এ-খবর শিক্ষিত আরব মাত্রেই শুধু নয়, আরবি সাহিত্যের সঙ্গে কিছু পরিচয় যার আছে সে-ও জানে। ভূগোলবি পর্যটক হিসেবে যাঁর নাম-ডাক ছিল, তিনি ইবন ফরিদ নন, ইবন জুবের।

ফরিদ হাঁ করে আমার দিকে তখন তাকিয়ে। বলেই ঘনাদা হঠাৎ ভ্রূকুটি করলেন।

 

আমাদের সকলেরই তখন কোথা থেকে কাশির ছোঁয়াচ লেগেছে।

শিশির সবার আগে সামলে উঠে লজ্জিত ভাবে বললে, আপনার ঘরে লবঙ্গ আছে, ঘনাদা?

কেন? ঘনাদার গলা গম্ভীর।

এই সবাই একটা একটা চিবোতাম। গলাটা কেমন খুস খুস করছে কি না।

তা লবঙ্গ কেন? উখো দিয়ে চাঁছো না। শিবু ঠিক সময়মতো সুর পালটে দাঁত খিচিয়ে উঠল, না ঘনাদা আপনি বলে যান। ভারি একটু কাশি, তার জন্যে লবঙ্গ চাই, বচ চাই, বাসক সিরাপ চাই! কডলিভার অয়েল যে চাওনি এই আমাদের ভাগ্যি।

শিশির ও আমরা বকুনি খেয়ে যথাবিহিত কুঁকড়ে গেলাম।

ঘনাদা মানের গোড়ায় জল পেয়ে আবার শুরু করলেন, ফরিদ খানিক একেবারে বোবা হয়ে থেকে তারপর বললে, আমি ইবন ফরিদ হই বা না হই, আরব আমার দেশ হোক বা না হোক, তাতে আপনার কী আসে-যায় যে আড্ডিস আবাবা থেকে

এই খার্তুম পর্যন্ত পিছু নিয়ে এই হোটেলে এসে ধাওয়া করেছেন?

ফরিদের গলায় রাগের ঝাঁজ কিন্তু নেই। সে যেন অন্য মানুষ। নামই ভাঁড়াক আর যা-ই করুক, সে যেন কারুর সাতে-পাঁচে নেই। শুধু নিজের খুশিতে একটু দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি কেন মিছিমিছি তার পিছু নিয়ে তাকে বিব্রত করছি এই তার নালিশ।

ফরিদের তালেই তাল দিয়ে তার দিকে চেয়ে মুচকে হেসে বললাম, শুধু কি আড্ডিস আবাবা থেকে? পিছু নিয়েছি সেই ইয়েমেন থেকে, তা বুঝি জানেন না?

আমি এই সুর ধরব ফরিদ ভাবতে পারেনি। তবু যথাসম্ভব নিরীহ ভালমানুষের মতো জিজ্ঞাসা করলে, কেন নিয়েছেন তাই তো জানতে চাইছি।

তাহলে আমার মুখ থেকেই শুনতে চান? হো হো করে হেসে উঠে তার পিঠে একটা দোস্তির আদরের চাপড় দিয়ে বললাম, আসুন তাহলে বসা যাক।

ফরিদ তখন মেঝেতেই উপুড় হয়ে বসে পড়েছিল অবশ্য।

আরে, ওখানে নয়। এই আপনার সোফায়, বলে হাত ধরে তাকে তুলে সোফায় বসিয়ে দিলাম।

ধরা হাতটা আরেক হাতে টিপতে টিপতে যেভাবে সে আমার দিকে তাকাল, তাতে তার চোখে ঠিক বন্ধুত্বের প্রীতি উথলে উঠছে বলে মনে হল না।

যেন সেসব কিছু লক্ষ না করেই তার পাশে বসে পড়ে বললাম, কেন আপনার পেছনে ছিনে জোঁকের মতো লেগে আছি, জানেন? বছর দুয়েক হল একটা মানুষ ফ্রান্স থেকে নরওয়ে যাবার পথে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। এমন কত লোকই তো যায়। বিভিন্ন দেশের পুলিশ কিছু দিন একটু খোঁজ-খবর হই-চই করে, তারপর নামটা খরচের খাতায় লিখে দেয়। আর সব দেশের পুলিশ তা করলেও ফ্রান্সের সুরে তা করেনি। না করাটা একটু আশ্চর্য। কারণ লোকটা বৈজ্ঞানিক বটে, কিন্তু কেওকেটা কেউ নয়। পারমাণবিক বোেমা কি গ্রহান্তরে যাবার রকেটের বারুদও তার গবেষণার বিষয় নয়। ফটো কেমিস্ট যাদের বলে, তিনি সেই জাতের রাসায়নিক। তাঁর নামটা বৈজ্ঞানিক মহলে পর্যন্ত খুব বেশি লোক জানে না। তাঁর নাম ধরা যাক রেনে লাভাল।

একটু থেমে ফরিদের দিকে চাইলাম। ফরিদ সোজা লোক নয়, রেনে লাভালের নাম শুনেও চমকাবার কোনও লক্ষণ তার দেখা গেল না।

আবার বললাম, রেনে লাভাল নিরুদ্দেশ হবার কিছুকাল পরে ক-টা মজার ব্যাপার ঘটল। দুনিয়ায় এক ফরাসি পুলিশ দপ্তরে ছাড়া যার সম্বন্ধে কারুর কোনও আগ্রহ নেই, সেই লাভালেরই প্যারিসের আগেকার বাসাবাড়িতে একদিন চুরি হল। লাভালের বাসাবাড়ি ফরাসি পুলিশ তালাবন্ধ করে রেখেছিল। সেখানে দামি কোনও জিনিসপত্রও ছিল না। তবু সে বাড়িতে পুলিশের প্রায় নাকের ওপর দিয়ে বেপরোয়া হয়ে কোন চোর কীসের লোভে এল চুরি করতে? চুরির পর পুলিশ সব কিছু মিলিয়ে দেখল। জিনিসপত্র কিছুই খোয়া যায়নি। এমনকী নরওয়ে যাবার সময় বই কাগজপত্র যা লাভাল যেমন ভাবে রেখে গিয়েছিলেন, আর পুলিশ বাড়িতে তালা দেবার সময় শুধু ওপর থেকে ফটো নিয়ে যা ছোঁয়নি, সেসব ঠিক তেমনই রাখা আছে। চোর তাহলে কীসের খোঁজে এসেছিল এত বিপদ ঘাড়ে নিয়ে?

ফরাসি পুলিশের হাতে চোর শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ল। সাধারণ একটা দাগি সিঁধেল চোর। সে পুলিশের কাছে স্বীকার করল যে, অচেনা একজন বিদেশি একটা বিশেষ ফরমাশ দিয়ে তাকে লাভালের বাসায় চুরি করতে পাঠিয়েছিল। তার জন্যে টাকাও দিয়েছিল।

প্রচুর বড়লোকের বাড়ির সিন্দুক ভাঙলেও অত টাকা পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ। কাজ হাসিল করতে পারলে আরও টাকা দেবে বলেছিল, এবং সে কথা সে-বিদেশি রেখেছে।

কাজ তাহলে তুমি হাসিল করেছ? ওই অঞ্চলের কমিশেয়ার দ্য পুলিশ স্বয়ং কড়া ধমক দিয়ে চোরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন।

কিন্তু কড়া ধমক খেয়ে চোর হাসতে শুরু করেছিল। পাহারাদার পুলিশকে মারমুখখা দেখে তারপর বলেছিল, আজ্ঞে হাসিল করেছি বই কী! কিন্তু কাজটা কী শুনবেন? শুনলে আপনারাও হাসবেন।

কী কাজ বললা? আবার ধমক দিয়েছিলেন কমিশেয়ার।

আজ্ঞে, কাগজ-ফেলার ঝডির হেঁড়া কাগজগুলো নিয়ে গিয়ে সেই বিদেশিকে দেওয়া। হেঁড়া কাগজের বদলে নোট পেয়েছিলাম গাদা গাদা। চোরটা হাসতে গিয়ে নিজেকে সামলেছিল। কমিশেয়ার ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলেও বাইরে তা বুঝতে দেননি কাউকে। জিজ্ঞেস করেছিলেন আবার, আর কিছু নাওনি তুমি? ঠিক করে বললা?

আজ্ঞে, ঠিক বলেছি। মা মেরির দিব্যি! চোরটা সত্যি কথাই বলছে মনে হয়েছিল।

কমিশেয়ার বিদেশি অচেনা লোকটার চেহারার বর্ণনা জেনে নিয়ে চোরটাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন।

শুধু এই একটা ঘটনা নয়, এরকম আরও দু-একটা অদ্ভুত ব্যাপার তখন ঘটে। যে ল্যাবরেটরিতে লাভাল কাজ কতেন, খোঁজ করতে করতে জানা যায় যে, সেখানে তাঁর এক সহকারীকে তাঁর আগে থাকতেই পাওয়া যাচ্ছে না। সহকারী ফরাসি নয়, ইউরোপের ভিন্ন দেশের লোক। নিজের দেশে যাবে বলে ছুটি নিয়ে লাভাল নিরুদ্দেশ হবার মাস ছয়েক আগে সে চলে যায়। কিন্তু তারপর আর সে ফিরে আসেনি। লাভালের ব্যাপারটা নিয়ে টনক না নড়লে পুলিশ সেই সহকারীর খোঁজ বোধহয় করতই না। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সত্যিই শেষ পর্যন্ত গোখরো বেরুল। ক্রমশ ফরাসি সরকার জানতে পারল যে, রেনে লাভালের নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছনে গভীর রহস্য আছে কিছু। কিছুকাল থেকে তিনি যেন খুব ভয়ে ভাবনায় দিন কাটাচ্ছেন মনে হয়েছিল। ল্যাবরেটরির সহকর্মীদের তিনি বিশেষ কিছু বলেননি, কিন্তু তিনি খুব যে বিপদের মধ্যে আছেন এই আভাসটুকু দিয়েছিলেন। বন্ধু ও সহকর্মীরা অবশ্য এসব কথার মানে তখন বুঝতে পারেনি। তাঁর নিরুদ্দেশ হওয়ার সঙ্গে এই সব ব্যাপার জড়িয়ে ফরাসি পুলিশের ধারণা হল যে, রেনে লাভালকে তাঁর শত্রুরা কেউ কোথাও পাচার করেছে, কিংবা তিনি নিজেই গা-ঢাকা দিয়ে কোথাও লুকিয়ে আছেন।

ফরিদ কী বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে বললাম, কিন্তু ফরাসি সরকারেরও যা অজানা সে কথা জানে মাত্র দু-একটি লোক। আপনি তাদের একজন।

আমি! ফরিদ আকাশ থেকে পড়ল যেন।

হ্যাঁ, আপনি। আপনি জানেন যে চেষ্টা করলেও মসিয়ে লাভালকে শত্রুরা কেউ চুরি করে নিয়ে যেতে পারেনি। তিনি নিজেই তাদের ফাঁকি দিয়ে গা-ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে আছেন। কেন তিনি গা-ঢাকা দিয়ে আছেন তা-ও আপনি জানেন, আর ধরুন একজন পরম বিশ্বাসী বন্ধু হিসেবে তাঁরই গোপন নির্দেশ অনুসারে আপনি তাঁকে সাহায্য করতে তাঁর লুকোনো আস্তানায় চলেছেন।

এই পর্যন্ত বলে একটু থামলাম, তারপর ফরিদের চোখে চোখ রেখে কড়া গলায় আবার বললাম, এখন মনে করুন আমি শত্রুপক্ষের চর, মনে করুন আপনার মারফত লাভালের গুপ্ত আস্তানা খুঁজে বার করবার জন্য আমি সাবধানে ছায়ার মতো আপনার পিছু নিয়েছি, কিন্তু তা সত্ত্বেও আপনি তা জানতে পেরে গেছেন। তারপর এখন হাতে পেয়ে আমার সম্বন্ধে কী আপনি করবেন?

ফরিদ এতটুকু বিচলিত হল না এ কথাতেও। বরং শান্ত গম্ভীর স্বরে বললে, বিশেষ কিছু করব না, শুধু আজ সুইস ব্যাঙ্কে গিয়ে যে নির্দেশ-দেওয়া লেফাফাটি এনেছেন, সেটি আপনার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে একটি গোল-কিক করে আপনাকে দরজার বাইরে পাঠিয়ে দেব।

কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে একটা ছোট রিভলভার বার করে সে আমার দিকে তখন ধরেছে।

সেদিকে চেয়ে ভয়ে ভয়ে বললাম, সত্যিকার রিভলভার মনে হচ্ছে। শুধু সত্যিকার রিভলভার নয়, ফরিদ হিংস্রভাবে হেসে সেফটি ক্যাচটা সরিয়ে বললে, ছ-ছটা গুলি ভরা আর সেফটি ক্যাচটাও সরানো৷ একটু ট্যাফু করলেই ওই বুকটা ঝাঁঝরা করে দেব!

কিন্তু তাতে বড় বেশি বিশ্রী আওয়াজ হবে না? হোটেলের লোকেরা মকে উঠতে পারে। এমনকী পুলিশ-টুলিশ নিয়ে ছুটেও আসতে পারে এ-ঘরে। সুদানি পুলিশ বড় বেয়াড়া শুনেছি।

সুদানি পুলিশ ঘুণাক্ষরেও কিছু জানবে না, এবিষয়ে নিশ্চিত থাকতে পারেন! ফরিদ কুটিল হাসির সঙ্গে চিবিয়ে চিবিয়ে বললে, কারণ, এ হোটেলের মালিক থেকে চাকর পর্যন্ত কেউ সেনর সাবাটিনির ঘরে কী হচ্ছে উঁকি দিয়ে দেখতেও সাহস করবে না।

ও, আপনি তাহলে সেনর সাবাটিনি! আমি পরিচয় জেনে ধন্য হবার ভাব দেখালাম।

আমি যে-ই হই, ফরিদ মানে সাবাটিনি কড়া গলায় বললে, তোর পকেটের লেফাফাটা এবার বার কর দেখি, ছুঁচো। এখন বুঝতে পারছিস বোধহয়, ও লেফাফা সঙ্গে নিয়ে সিংহের গুহায় ঢুকে কী বোকামি করেছিস! অবশ, ও লেফাফা তোর কাছ থেকে কেড়ে নিতামই। সেই জন্যই আমার খার্তুম আসা। শুধু হাঙ্গামাটা তুই বাঁচিয়ে দিলি এই যা!

আমি যেন প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম, এ-লেফাফা আপনাকে দিতে হবেই? নিয়ে আপনি ছাড়বেন না?

না ছাড়ব না। ভালয় ভালয় দিস তো জ্যান্ত এ-ঘর থেকে বেরুতে পারবি। আর দিলে লেফাফা তো যাবেই, সেই সঙ্গে প্রাণটা। সাবাটিনির কী সে উল্লাসের হিংস্র হাসি!

কিন্তু এ-লেফাফা নিয়ে কী লাভ আপনার হবে! আমি কাতরভাবে বোঝাবার চেষ্টা করলাম, রেনে লাভাল নিরিবিলিতে কোথায় একটু লুকিয়ে আছেন, তাঁকে কেন মিছিমিছি জ্বালাতন করবেন?

জ্বালাতন কেন করব? সাবাটিনি আবার হেসে উঠল, তাঁকে জ্বালাতন কিছু করব , শুধু তাঁকে তাঁর যন্ত্রপাতি কাগজপত্র লটবহর সমেত এমন জায়গায় পাচার করব, যেখানে তাঁর গবেষণার কোনও বিষ্ম আর হবে না।

কোথায়? আপনার নিজের দেশ ইটালিতে? আমার যেন দারুণ কৌতূহল।

না। সাবাটিনি গর্জন করে উঠল, কোথায় তাতে তোর কী দরকার?

ও বুঝেছি,আমি ভালমানুষের মতো বললাম, নামটা আপনার ইটালিয়ান হলেও আপনার দেশ জাত বলে কিছু নই। ও সব বালাই ঘুচিয়ে আপনি শুধু নিজের স্বার্থের ধান্দাতেই ঘোরেন। রেনে লাভালকে পাবার জন্য যারা সবচেয়ে বেশি দাম দেবে তাদের কাছেই তাঁকে বেচবেন।

চুপ কর, ছুঁচো, সাবাটিনি গর্জন করে উঠল, তোর কাছে বক্তৃতা শোনবার আমার সময় নেই। সুবোধ ছেলের মতো লেফাফাটা বার কর। আমি এক থেকে পাঁচ গুনছি। তার মধ্যে লেফাফা না দিলে এই রিভলভারই যা বলবার বলবে। এক…

দোহাই! দোহাই! আমি কাতর অনুনয় জানালাম, লেফাফাটা তো দিতেই হবে বুঝতে পারছি, কিন্তু তার আগে পৃথিবী থেকে চিরকালের মতো অন্নাভাব ঘোচাবার কল্পনাতীত উপায় যিনি আবিষ্কার করতে চলেছেন, তাঁর গোপন ঠিকানাটা একটু দেখে নিতে দেবেন? সত্যি বলছি, শিলমোহর দেওয়া খামটা খুলেও দেখিনি এখনও।

তাহলে এ-জন্মে আর তা দেখা তোর ভাগ্যে নেই। সাবাটিনি নির্মমভাবে হেসে উঠে গুনতে আরম্ভ করল, এক…দুই…।

সাবাটিনির পেছনে কামরার দরজাটা খোলার খুট করে একটু আওয়াজ হল।

সাবাটিনি চমকে উঠলেও আমার দিক থেকে চোখ বা পিস্তল কিছুই না ফিরিয়ে বিরক্তির সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলে, কে?

পেছন থেকে চাপা গলায় আওয়াজ এল, আমি সোলোমাস।

সোলোমাস! সাবাটিনি হতভম্ব হল বুঝতে পারলাম, কিন্তু তার চোখ আর পিস্তল আমার ওপরই নিবদ্ধ রইল। দাঁতে দাঁত চেপে শুধু বললে, এখানে কেন?

শোনা গেল, তোমায় শেষ করতে!

আমি হাত তুলে সভয়ে চিৎকার করে উঠলাম, ও কী করছেন, মসিয়ে সোলোমাস? পিস্তল ছুঁড়বেন না! আমার গায়ে গুলি লাগবে যে!

সাবাটিনি চমকে একটু পিছনে তাকাতেই তার হাতের রিভলভার এল আমার হাতে, আর সে তখন সোফার ওধারে চিৎপাত।

রিভলভারটার সেফটি ক্যাচ আবার লাগিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বললাম, উঠুন সেনর সাবাটিনি। মেঝেয় অমন শুয়ে থাকা কি ভাল!

সাবাটিনির কিন্তু ওঠবার কোনও লক্ষণ তখনও নেই। একবার বন্ধ দরজা আর একবার আমার দিকে ভ্যাবাচাকা খেয়ে তাকিয়ে বললে, সোলোমাস কোথায় গেল?

সোলোমাস আবার যাবে কোথায়? আড্ডিস আবাবাতেই আছে। হেসে বললাম, ভেনট্রিলোকুইজম বিদ্যেটা অনেক সময় খুব কাজে লাগে।

সাবাটিনি সেই বিরাট দেহ নিয়েও এবারে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললে, শয়তান, পাজি, ছুঁচো, শুধু তোর হাতে রিভলভার-তাই, নইলে তোর হাড়-মাংস আমি আলাদা করে রাখতাম।

রিভলভারটা দুরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললাম, ও আফশোস আপনার তাহলে আর রাখলাম না।

আমার কথা শেষ হতে না হতেই সাবাটিনি লাফ দিয়ে পড়ল। না, আমার ওপরে নয়, রিভলভারটা যেখানে ছুঁড়েছিলাম সেদিকে। কিন্তু সেখান পর্যন্ত তাকে পৌঁছোতে হল না। তার শয়তানি বুঝেই সোফাটা তৎক্ষণাৎ ঠেলে দিয়েছিলাম। তার ধাক্কায় হুমড়ি খেয়ে সে দেওয়ালের গায়ে গিয়ে ছিটকে পড়ল।

সেখান থেকে তাকে তুলে একটা ধোবি পাট দিয়ে বললাম, কী ভাগ্যি, সেনর সাবাটিনি, আপনার ঘরে এ-হোটেলের মালিক থেকে চাকরবাকর কেউ উঁকি দিতে সাহস করে না, নইলে আপনার কাছে দুটো লড়াইয়ের প্যাঁচ শেখবার এ সৌভাগ্য হয়তো পেতাম না। হয়তো হোটেলের লোকেরা ভূমিকম্প হচ্ছে বলে এ-ঘরের দরজা ভেঙে ঢুকতে পারত।

সাবাটিনিকে একটা চরকি পাক দিয়ে মাটিতে ফেলে আবার বললাম, আপনার মতো টনটনে ন্যায়নীতিবোধ কোথাও আমি দেখিনি। ধর্মযুদ্ধে অন্যের হাতে রিভলভার আপনি পছন্দ করেন না, কিন্তু নিজের হাতে সেটা রাখা ন্যায্য মনে করেন! আপনাকে আবার তাই একটা সেলাম জানাচ্ছি।

সাবাটিনি তার নিজের খাটের ওপরেই মুখ থুবড়ে পড়ে তখন কাতরাচ্ছে।

পকেট থেকে শিলমোহর দেওয়া চিঠিটা বার করে বললাম, এ চিঠি আপনাকে খুলে এখন আমি দেখাতে পারি, কিন্তু দেখিয়ে কোনও লাভ হবে কি? কারণ, এ চিঠির ঠিকানাতেই আমি নিজে এখন যাচ্ছি। আর সেখানে আপনার এই শ্রীমুখ দেখার কোনও বাসনা কেন জানি না আমার হচ্ছে না। তা সত্ত্বেও যদি আপনি দেখাতে চান, তাহলে আশা করি উইল-টুইল করেই যাবেন। অবশ্য কার জন্যই বা করবেন? আপনার জন বলতে স্বয়ং শয়তান ছাড়া আর কে-ই বা আপনার থাকতে পারে!

কথাগুলো বলে বেরিয়ে যেতে গিয়েও আমায় ফিরে দাঁড়াতে হল। সাবাটিনি কাতরাতে কাতরাতেই তখন বিষটালা গলায় বলছে, ওই দুমুখো সাপ সোলোমাসই তোকে সব জানিয়েছে, আমি বুঝেছি। কিন্তু এই আমি বলে রাখছি, ওই সোলোমাসের ছোবল তোকেও খেতে হবে। তোর নিপাত যাবার আর বেশি দেরি নেই।

সাবাটিনির অভিশাপ কানে নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম।

 

খার্তুম থেকে বেরুবার আগেই সাবাটিনির অভিশাপ কিছুটা অন্তত ফলল।

যাবার দিনই সুইশ ব্যাঙ্কের সেই চিঠিটা কী ভাবে আমার তালা দেওয়া হোটেলের কামরায় আমার ব্রিফকেস থেকে যে চুরি গেল বুঝতে পারলাম না।

কী ভাগ্যি আমি লেফাফাটা খুলে আগেই পড়ে রেখেছিলাম। চিঠিটা পড়েই কেন যে পুড়িয়ে দিইনি এই আমার আফশোস৷

কিন্তু আফশোস করে বা চুরির কিনারা করবার চেষ্টায় সময় নষ্ট করে কোনও লাভ নেই।

চুরি যাবার দরুনই যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি সব ব্যবস্থা করে পরের দিন সকালেই একটি প্লেনে রওনা হয়ে পড়লাম। কিন্তু সেখানেও বাধা।

খার্তুম থেকে বেরিয়ে ঝড়ের মধ্যে পড়ে প্লেনটা জখম হয়ে কোনওমতে নুবিয়ার মরুভূমির দক্ষিণপ্রান্তে নীলনদ যেখানে হঠাৎ যেন পিছনে ফিরে যাবার জন্য বাঁক নিয়েছে, সেই ছোট শহর আবু হামেদ-এ গিয়ে নামল। সেখান থেকে তোড়জোড় করে অন্য প্লেনে কায়রো যেতে দিন দশেক লাগল। কায়রো থেকে অবশ্য সোজা দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকার আর এক প্রান্তে অতলান্তিক সমুদ্রের ধারে এক গহন জংলি রাজ্যে গেলাম। লেফাফায় সেই নির্দেশই ছিল।

জংলি রাজ্যের নাম গ্যাবোঁ। জায়গাটা একেবারে অচেনা নয়। আফ্রিকার দুষ্প্রাপ্য গ্যালাগো ধরতে অনেক আগে একবার ওখানকার জঙ্গলে গেছলাম। কী ধরতে গেছলেন? শিবু হাঁদার মতো জিজ্ঞাসা করে বসল। গ্যালাগো। ঘনাদা নামটা আবার বলে ধৈর্যের পরিচয় দিলেন।

গ্যালাগো? গৌর উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, গোরিলার মাসতুতো-পিসতুতো ভাই, না ঘনাদা?

না। ঘনাদা অনুকম্পার সঙ্গে বললেন, লেমুর যাদের বলে, সেইরকম আধা বাঁদর একজাতের ঘোট প্রাণী। কোনওটা ইদুরের চেয়ে বড় হয় না।

মোটে ইদুর! শিশির ফোঁস করে যেভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তাতে মনে হল গ্যালাগো জানোয়ারটা তাকে ঠকিয়ে একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছে।

আমাদের ভাগ্য ভাল যে ঘনাদা সে দীর্ঘনিশ্বাস অগ্রাহ্য করে আবার শুরু করলেন, বিষুবরেখার উত্তরে অতলান্তিকের ধারে এই ছোট রাজ্যটি ফরাসিদের অধিকারে। রাজ্যটি কঙ্গোরই প্রতিবেশী এবং কঙ্গোর সঙ্গে তার মিলও কম নয়। বেশির ভাগই ঘন জঙ্গলে ঢাকা। এক একটা গাছ একশো থেকে দেড়শো হাত প্রায় লম্বা। বছরের অর্ধেক সময়ে নদী-নালা ভেসে জলা-জঙ্গল একাকার হয়ে থাকে। সিংহের দেখা খুব বেশি না পাওয়া গেলেও আফ্রিকার বিরল জানোয়ার ওকাপি ওই সব জঙ্গলে মেলে, তা ছাড়া চিতাবাঘ আছে, এক জাতের লাল বুনো মোষ, সোনালি বেড়াল, বিরাট সব কাঠবেড়ালি আর ওই গ্যালাগো।

এই জংলি রাজ্যে ঠিকানা মনে থাকা সত্ত্বেও রেনে লাভালের আস্তানা খুঁজে বার করতে কম বেগ পেতে হল না। প্লেন তো নামিয়ে দিয়ে গেল সমুদ্রের তীরের লিব্রেভিল বন্দরে। সেখান থেকে আঁকাবাঁকা কুইলা নদীতে যতদূর সম্ভব মোটর লঞ্চ ও তারপর জংলি ডিঙি বেয়ে, কোথাও বা হেঁটে, বুনো হিংস্র আদিবাসীদের এড়িয়ে লাভালের নির্দেশ দেওয়া অঞ্চলে পৌঁছোতে প্রায় দু-হপ্তা লেগে গেল।

এই অঞ্চলটায় দুর্ভেদ্য বন-জঙ্গল শেষ হয়ে গিয়ে পাহাড়ি উপত্যকা শুরু হয়েছে। ওকান্দে জাতের যেসব বাহকেরা এতদূর আমার মালপত্র বয়ে নিয়ে সঙ্গে এসেছিল, তারা আর যেতে চাইলে না। সামনে ফাঙ্গ বলে আরেক জংলিজাতের এলাকা। সেখানে ওকালেদের দেখতে পেলে আর রক্ষা নেই। অগত্যা একটা পাহাড়ে ঢিপির পাশে ছোট একটা কুঁড়ে গোছের তৈরি করিয়ে তারই মধ্যে বেশির ভাগ সঙ্গের জিনিস রাখলাম। তারপর নিতান্ত দরকারি জিনিসপত্র একটা ছোট ব্যাগে ভরে রওনা হলাম রেনে লাভালের ডেরা খুঁজতে। সামনে ছোটখাটো একটা পাহাড় হাজার চারেক ফুট উঁচু। তারই মাঝামাঝি একটা পাহাড়ের খাঁজে লাভালের আস্তানা লুকোনো বলে নির্দেশ পেয়েছি।

অচেনা পাহাড় বেয়ে উঠে সে আস্তানা খুঁজে বার করতে সন্ধে হয়ে গেল। পাহাড়ের দুটো শাখার মাঝখানে এমন ভাবে আস্তানাটা লুকোনো যে, সহজে চোখে পড়ার কথা নয়।

আস্তানা বলতে তিনটি ছোট বড় জঙ্গলের কাঠের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি ঘর। বড়টি ল্যাবরেটরি আর দুটি শোবার ও রান্নার। কিন্তু তিনটি ঘরের কোথাও কেউ নেই। ঘরদোরের চেহারা দেখলে মনে হয়, অন্তত দু-একদিন আগেও সেখানে কেউ-কেউ ছিল। রান্নাঘরে একটা স্টোভের ওপর একটা জলভরা কেটলি চাপানো। পাশের টেবিলে একটা ডিশের ওপর একটা বাসি অমলেট ভাজা পড়ে আছে। কেউ যেন অমলেট ভাজা সেরে চায়ের জল কেটলিতে চড়িয়ে হঠাৎ চলে গেছে। কেটলিটা নামিয়ে স্টোভটা নেড়ে দেখে বুঝলাম তেল ফুরিয়েই সেটা শেষ পর্যন্ত নিবে গেছে। কেটলির জলও ফুটে ফুটে অর্ধেক হয়ে যে আগুন নেববার পর ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, ভেতরে কেটলির গায়ে পরপর জলের গোল গোল দাগেই তা বোঝা গেল।

এটা যে লাভালের আস্তানা, সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি সরঞ্জাম দেখেই তা ধরা যায়। কিন্তু লাভাল গেছে কোথায়? হঠাৎ অমন করে গেছেই বা কেন?

কোনও শত্রু তাকে এখানে আক্রমণ করেছিল বলেও মনে হল না। সেরকম কোনও চিহ্ন নেই। ল্যাবরেটরি থেকে ঘরদোরের জিনিসপত্র সব কেউ ছুঁয়েছে বলেও মনে হল না।

আমার সন্দেহ হয়তো অমূলক। লাভাল হয়তো কাছেই কোথাও গেছে। এখুনি ফিরে আসবে ভেবে অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। কিন্তু বৃথাই।

এত রাত্রে আর খুঁজতে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। ওই আস্তানাতেই রাতটা কাটাবার জন্যে তৈরি হচ্ছি, এমন সময় নিস্তব্ধ পাহাড়ে কোথায় যেন একটা পাথর খসে পড়বার শব্দ পেলাম। তারপর বুঝতে পারলাম পাহাড়ের খাড়াই পথে এই আস্তানার দিকে কে যেন সন্তর্পণে আসছে। পাহাড়ি রাস্তার আলগা নুড়ি পাথর নড়াচড়ার শব্দ একটু ভাল করে কান পাতলেই শোনা যায়।

কোনও জানোয়ার-টানোয়ার হবে কি? না, তা হওয়া সম্ভব নয়। এখানে সিংহ নেই বললেই হয়। আর সিংহ কি জংলি চিতা মানুষের ব্যবহার করা পথে পারতপক্ষে আসবে না।

রাতটা খুব অন্ধকার নয়। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ খানিক আগে পাহাড়ের ওপরে উঠতে শুরু করেছে। তেলের অভাবে আলো-টালো এতক্ষণ জ্বালতে না পারলেও খুব অসুবিধে হয়নি। এখন মনে হল, তেল না থেকে ভালই হয়েছে। যে আসছে, সে লাভাল নিশ্চয়ই নয়। কারণ, তা হলে নিজের আস্তানায় এত সন্তর্পণে সে আসত না। সে যাই-হোক, আস্তানায় আলো থাকলে দেখতে সে পেতই দূর থেকে। তাতে হয় পালাত, নয় আরও সাবধান হয়ে হানা দিত। তার চেয়ে আধা-অন্ধকারে আমি যে তার জন্যে আগে থাকতে প্রস্তুত থাকতে পারছি এই ভাল।

এক হাতে পিস্তল আর এক হাতে টর্চটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে কাঠের বাড়িটার পিছন দিকে গিয়ে দাঁড়ালাম। কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমী কি অষ্টমীর লালচে চাঁদ তখন পাহাড়ের মাথায় আরও খানিকটা উঠে এসেছে। চারিদিকে কেমন একটা ছমছমে ভূতুড়ে আবছা অন্ধকার। আমি যেখানটায় দাঁড়িয়েছিলাম সেখানটায় সেই চাঁদের আলোর ছায়াতেই অন্ধকার আরও গাঢ়।

চুপিসাড়ে যে পাহাড়ি পথে উঠে আসছিল, একটা পাথুরে ঢিপি ঘুরে আসতেই তার মূর্তিটা অন্তত দেখা গেল।

জানোয়ার নয়, মানুষই, আর জংলিও যে নয় ওই আবছা আলোতেই দূর থেকে তার পোশাক দেখেই তা বুঝতে দেরি হল না।

কে তাহলে লোকটা?

লাভাল যে নয়, মুখ না দেখে শুধু আকৃতি দেখেই বুঝতে পারলাম। লাভাল গোলগাল ছোটখাটো মানুষ। আর এ লোকটা মোটা তো নয়ই, বরং বেশ রোগা ও লম্বা। সন্তর্পণে আসছে বটে, কিন্তু একটা পা বেশ খুঁড়িয়ে।

ঠিক সময় বুঝে ধরব বলে নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

লোকটা লাভালের আস্তানার সামনে এসে এদিক-ওদিক চেয়ে ভেতরে গিয়ে ঢুকতেই নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে খোলা দরজার বাইরের দিকে দাঁড়ালাম।

লোকটা তখন একটা দেশলাই জ্বালাবার চেষ্টা করছে। ড্যাম্প ধরা বলেই বোধহয় কাঠিটা ধরছে না।

দেশলাই জ্বালাবার সঙ্গে সঙ্গেই তার মুখে টর্চটা ফেললাম।

কে? বলে আঁতকে উঠে সে যতখানি চমকাল, আমি তার চেয়ে কম নয়। লাভালের আস্তানায় চোরের মতো ঢুকেছে আর কেউ নয়, সোলোমাস। সাবাটিনি নিজে শয়তান হলেও সোলোমাস সম্বন্ধে তাহলে মিথ্যে বলেনি!

প্রথম বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলে তখন আমি কর্তব্য স্থির করে ফেলেছি। টর্চের আলোটা তার মুখের ওপর রেখেই ভেতরে ঢুকে পিস্তলটা তার দিকে উঁচিয়ে বললাম, আপনার সব খেল খতম, মসিয়ে সোলোমাস।

সোলোমাস কিন্তু ভয় পাওয়ার বদলে এবার উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, যেন হাতে চাঁদ পেয়ে, ওঃ আপনি! আপনি এসেছেন দাদা! আপনার আশায় কীভাবে যে দিন গুনছি!

কড়া গলায় বললাম, ওসব চালাকি রাখুন, সোলোমাস। একবার আমায় আহাম্মক বানিয়েছেন বলে কি বার বার পারবেন ভাবছেন? আপনার সব শয়তানি আমি জানি। বলুন, কেন লুকিয়ে এখানে এসেছেন? কোথায় লাভালকে সরিয়েছেন? সরিয়েছেন, না শেষ করে দিয়েছেন?

এ সব আপনি কী বলছেন! সোলোমাসের গলার স্বর সত্যিই যেন কাতর, একটু ধৈর্য ধরুন। আমায় আলোটা জ্বালতে দিন, তারপর সব কথা শুনুন।

আমি তখন আর সোলোমাসের অভিনয়ে ভুলতে রাজি নই। কঠোর হয়ে বললাম, আপনাকে আমি আর বিশ্বাস করি না এতটুকু। তা ছাড়া, আলো আপনি জ্বালবেন কীসে? এখানে তেল নেই।

তেল ছাড়া আলো জ্বলবে! সোলোমাস গম্ভীর গলায় বলে ঘরের একদিকে যেতেই আমি টর্চটা তার ওপর রেখে বললাম, কোনও চালাকির চেষ্টা করেছেন কি গেছেন। আপনার দোস্ত সাবাটিনির পরিণাম তাহলে আপনার হবে।

সাবাটিনির পরিণাম! তার সঙ্গে তাহলে এখানে আপনার দেখা হয়েছে! বলে সোলোমাস অবাক হয়ে ফিরে দাঁড়ালেন। কোথায় কী একটা টেপায় ঘরের ছাদের একটা গুপ্ত আলো তখন জ্বলে উঠেছে।

সেই গুপ্ত আলোর রহস্যে যেটুকু কৌতূহল হয়েছিল, সোলোমাসের পরের কথায় তা ভুলে গিয়ে একেবারে থ হয়ে গেলাম।

সোলোমাস আগের কথার খেই ধরেই উৎসুক হয়ে বললেন, কখন দেখা হল? আজ? তার কী পরিণামের কথা বলছেন?

এবার আমাকে হতভম্ব হতে হল, কী বলছেন আপনি? আজ তার সঙ্গে কোথায় দেখা হবে? তাকে শেষ দেখেছি খার্তুমে।

সোলোমাস হতাশভাবে বললেন, বুঝেছি, তাই আপনি অমন উলটো-পালটা কথা বলছেন। সাবাটিনি যে এখানে, তার জন্যই যে আমাদের এই সর্বনাশ—এসব আপনি কিছুই জানেন না।

সোলোমাসের গলায় সত্যের সুর যতই থাক, সন্দেহ আমার গেল না। কঠিন হয়ে বললাম, আবার আমায় ধোঁকা দেবার চেষ্টা করছেন, সোলোমাস!

ধোঁকা আপনাকে কোনও সময়ই দিইনি, দাস! ক্লান্তভাবে বললেন সোলোমাস, আপনিই শুধু সাবাটিনির ছোঁয়াচ লেগে সব কিছু বাঁকা দেখছেন। অবিশ্বাস করতে হয় করবেন, কিন্তু তার আগে ধৈর্য ধরে কথাগুলো একটু শুনবেন?

তাই শুনলাম এবার। শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

সাবাটিনিকে আমি যতখানি চিনেছিলাম, সে তার চেয়ে অনেক পাকা শয়তান। আমার হাতে ওই লাঞ্ছনাতেও তার মতলবের কোনও পরিবর্তন হয়নি। আমায় নির্দেশ দেওয়া চিঠি চুরির মূলে যে সে-ই ছিল, এ-বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ নেই। সেই নির্দেশ অনুসরণ করে আমার আগেই সে এখানে পৌঁছেছে। সম্ভবত কায়রো যাওয়ার পথে আমার যে দেরিটা হয়েছিল, তাতেই এ সুবিধে সে পেয়েছে। এখানে এসে সে যা চাল চেলেছে, বদমায়েশি বুদ্ধিতে তার তুলনা হয় না। এ-অঞ্চলের জংলি অধিবাসী হল ফাঙ্গ বলে এক অসভ্য জাত। সাবাটিনি কূট কৌশলে তাদেরই লাভালের বিরুদ্ধে খেপিয়ে দিয়েছে। কাছাকাছি নির্জন একটি পাহাড়-ঘেরা জায়গা ফাঙ্গদের পবিত্র দেবস্থান। সেখানকার একটি বিদুঘুটে আকারের পাথর তারা পুজো করে। সাবাটিনি সেই পাথরটা চুরি করে সরিয়ে দিয়ে ফাঙ্গদের ওঝা পুরুতদের ঘুষ দিয়ে বা যেভাবে তোক বুঝিয়েছে যে বিদেশি একটা লোক অন্য দেবতার পুজোর মন্দির বানিয়ে তাদের দেশ অপবিত্র করেছে বলেই ফাঙ্গদের নিজেদের দেবতা তাদের ছেড়ে গেছে। লাভালের ল্যাবরেটরিটাই ফাঙ্গদের দুশমন দেবতার মন্দির বলে সাবাটিনি বুঝিয়েছে। ফাঙ্গরাই একদিন এই ল্যাবরেটরির কাঠের বাড়ি তৈরি করতে ও বহুদুর থেকে সেখানকার যন্ত্রপাতি সাজসরঞ্জাম বয়ে আনতে সাহায্য করেছিল। এখন সেই ল্যাবরেটরি আর লাভালের ওপরই তারা খাপ্পা। লাভালকে তারা হঠাৎ চড়াও হয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে বন্দী করেছে। আর চার মাস বাদে তাদের নিজেদের দেবতার উৎসবের দিন। সেই দিন এই ল্যাবরেটরিতেই লাভালকে বলি দিয়ে সমস্ত কিছু তারা পুড়িয়ে দেবে নিজেদের দেবতাকে সন্তুষ্ট করে ফিরিয়ে আনতে। এই তাদের সংকল্প। লাভালকে যেদিন জংলিরা ধরে নিয়ে যায়, সোলোমাস তার আগেই এ আস্তানায় পৌছোলেও জংলিদের হানা দেবার সময় উপস্থিত ছিলেন না। ল্যাবরেটরির জন্যেই কয়েকটা গাছ-গাছড়া সংগ্রহ করতে বেরিয়েছিলেন। ফিরে এসে লাভালের লেখা চিঠি পড়ে তিনি সব বুঝতে পারেন। লাভাল বন্দী হয়ে চলে যাবার আগে ওই চিঠিটুকু লিখে যেতে পেরেছিলেন।

সোলোমাস লাভালের লেখা শেষ চিঠি আমায় দেখালেন। তাতে কটি মাত্র কথা তাড়াতাড়ি পেনসিল দিয়ে লেখা।

মেলাস, আমি বন্দী। সাবাটিনের ষড়যন্ত্র। ল্যাবরেটরি বাঁচাও।

চিঠি পড়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এ কদিন আগের কথা?

পাঁচদিন বললেন সোলোমাস, এ-পাঁচদিন কী করে যে আমার কেটেছে তা বলতে পারি না। এ আস্তানায় এসে ওই চিঠি পেয়েই আবার পালিয়ে যেতে হয়েছে। কখন জংলিরা আবার আসে কে জানে! ল্যাবরেটরি বাঁচাবার কথা লাভাল লিখে গেছেন। কিন্তু জংলিরা এলে বাঁচাব কী করে? একলা তাদের বিরুদ্ধে কী করতে পারি? বিশেষ করে সাবাটিনি যখন তাদের মন্ত্রণাদাতা। জংলিরা কিন্তু ল্যাবরেটরি ভাঙতে আসেনি। সেটাও সাবাটিনির পরামর্শে নিশ্চয়। সাবাটিনি তো সত্যিই ল্যাবরেটরি ভাঙতে চায় না। আপাতত জংলিদের সাহায্যে আমাদের জব্দ করে— পরে ল্যাবরেটরিসুদ্ধ লাভালকে লোপাট করে নিয়ে যাওয়াই তার মতলব। ফাঙ্গরা চার মাসের পর উৎসবের দিন ল্যাবরেটরির সঙ্গে লাভালকেও শেষ করতে চায় এ-খবর তারপর জেনেছি। জেনেছি একটি মাত্র বিশ্বাসী জংলির কাছে। সে-ই ছিল লাভালের ও আমার একমাত্র সঙ্গী ও অনুচর। আপাতত সে দলের লোকের ভয়ে ল্যাবরেটরিতে আসে না। তবে আমি এখান থেকে দূরে যে পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে আছি, খোঁজ করে সেখানে আমার সঙ্গে দেখা করেছে। তার কাছেই সাবাটিনি ও ফাঙ্গদের সমস্ত খবর পেয়েছি। পেয়ে কী করব কিছুই ঠিক করতে না পেরে শুধু আপনার পথ চেয়ে আছি। আপনার দেরি দেখে তো ভয় হচ্ছিল সাবাটিনি আপনাকেও কোনও ভাবে বন্দী-টন্দি করেছে।

একটু চুপ করে থেকে ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি যে আলো জ্বাললেন, তাতে কোনও ভয় নেই?

না। সোলোমাস আশ্বাস দিলেন, পাহাড়ের খাঁজে এমন ভাবে এল্যাবরেটরি লুকোনো যে, বাইরে কোথাও থেকে এর আলো দেখা যায় না। তা ছাড়া, জংলিরা থাকে এখান থেকে অনেক পশ্চিমে জঙ্গলের মধ্যে বোমায় ঘেরা গ্রামে। সেখান থেকে রাত্রে তারা রাজত্বের লোভেও বেরুবে না। ভয় শুধু সাবাটিনিকে। কিন্তু সে-ও এখন মতলব হাসিল করে নিশ্চিন্ত মনে পরের চালের ফন্দি আঁটছে। তার রাত্রে এদিকে আসার কোনও দরকার নেই। আমি যে এখানে এসেছি, তা সে জানে না। আমি তাই প্রতি রাত্রে এসে ল্যাবরেটরিটা দেখে শুনে লুকোনো বিদ্যুতের ব্যাটারিগুলো চালু রেখে যাই।

আচ্ছা, লাভাল তো চিঠিটা মেলাস বলে কাকে লিখেছেন। এবার আমি না বলে পারলাম না। আপনার নাম অথচ সোলোমাস বলেই জেনেছি।

সোলোমাস একটু দুঃখের হাসি হেসে বললেন, সন্দেহ দেখছি এখনও আপনার সম্পূর্ণ যায়নি! শুনুন, মেলাস আমার পদবি। আমার পুরো নাম হল সোলোমাস মেলাস। পরিচয়টা লুকোবার জন্যেই শুধু সোলোমাস নামটা নিয়েছিলাম। লাভাল চিরকাল আমাকে মেলাস বলেই ডাকেন।

একমহর্তে ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। বিস্মিত আনন্দে বললাম, ও, আপনিই তা হলে লাভালের সেই সহকারী, যিনি লাভালের আগেই দেশে যাবার নাম করে নিরুদ্দেশ হয়ে যান?

হ্যাঁ, লাভাল ও আমি দুজনে পরামর্শ করেই ওই ব্যবস্থা করেছিলাম। ঠিক হয়েছিল, প্রথমে আমি গা-ঢাকা দেব। তারপর লাভাল। আমার দেশ যে গ্রিস, তা নাম দেখেই নিশ্চয় বুঝেছেন। গ্রিসে যাবার নাম করে, দুনিয়ার কেউ কল্পনাও করতে পারে না, আমি গ্যাবোতে হাজির হব এমন জায়গা খুঁজে বার করে এখানে ল্যাবরেটরি বসাবার ব্যবস্থা আমিই করি। লাভাল পরে পালিয়ে এসে এখানে ওঠেন। শত্রুদের ধোঁকা দেবার জন্যে আমাকে তারপর বাইরে গিয়ে তাদের সঙ্গে মিথ্যে যোগাযোগ করতে হয়। শত্রুরা, বিশেষ করে সাবাটিনি, যাদের হয়ে কাজ করছে তারা কিন্তু ক্রমশই আমাদের চারিধারে জালের বেড়া দুর্ভেদ্য করে আনছে বলে ভয় হয়। বড় বড় রাজাগজাদের সাহায্য চাইতে আমরা নারাজ। রক্ষকই তা হলে ভক্ষক হয়ে দাঁড়াবে। পরামর্শের জন্যে একান্ত বিশ্বাসী বন্ধু হিসেবে লাভাল তাই আপনাকে স্মরণ করেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আপনাকে ডাকাও বৃথা হয়েছে। লাভালের যুগান্তকারী গবেষণা আর সম্পূর্ণ হবে না।

সোলোমাস দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চুপ করবার পর বললাম, আমাদের দেশে একটা কথা আছে, সোলোমাস—যতক্ষণ শাস, ততক্ষণ আশ। সুতরাং আশা ছাড়বেন না। শুধু একটা কথা আগে আমি জানতে চাই। গবেষণা সত্যি কতদূর এগিয়েছে। পুরো সংখ্যা যে একশো সাঁইত্রিশ সে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ নেই তো?

না।

মূলাধার শুধু একটি?

হ্যাঁ।

আর সাজানো কীভাবে?

ওই মাঝের একটি ম্যাগনেসিয়াম পরমাণুকে ঘিরে পঞ্চান্নটি কার্বন, বাহাত্তরটি হাইড্রোজেন, পাঁচটি অক্সিজেন ও চারটি নাইট্রোজেন পরমাণু। সোলোমাস বলে গেলেন।

এই সমস্ত পরমাণু মিলিয়ে কৃত্রিম উপায়ে মূল জিনিস তৈরি করতে পেরেছেন ল্যাবরেটরিতে?

হ্যাঁ, তা পেরেছি। শুধু জিনিসটা এখনও অসাড় বলা যায়। আসল কাজ ঠিক করছে না। সেই আসল কাজ করাবার গবেষণাই চলেছে। মানে এতদিন পর্যন্ত চলছিল। বলে সোলোমাস আবার দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন।

একটু চুপ করে ভেবে নিয়ে এবার বললাম, আপনাদের বিশ্বাসী জংলির নাম কী?

উজি।

উজি মানে তো সোয়াহিলি ভাষায় বুড়ো। লোকটা বুড়ো নাকি? জিজ্ঞেস করলাম।

না, বুড়ো নয়। জোয়ান। ও-ই তার ডাক নাম।

শুনুন, উজিকে দিয়েই ফাঙ্গদের কাছে খবর পাঠাবেন যে, তাদের মুঙ্গু, মানে দেবতা, এই ক-দিন বাদেই অমাবস্যার রাত্রে তাদের বোমা, মানে, কাঠের দেওয়াল ঘেরা গ্রাম থেকে কিছুদূরে যে টিঙ্গা টিঙ্গা অর্থাৎ জলা আছে, তার ওপারে এক ওকুমে, মানে, আবলুশ কাঠের গাছ থেকে তাদের সঙ্গে কথা বলবেন।

সোলোমাস হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এ-খবর পাঠাবার মানে?

মানে, সত্যিই সেদিন তাদের দেবতা ওই ওকুমে গাছ থেকে তাদের জানাবেন যে, যে বিদেশিকে তারা ধরে নিয়ে গেছে, সে দেবতার দস্তুরমতো পেয়ারের লোক। তাকে এখুনি ছেড়ে দিয়ে তার ঘর-বাড়ি মন্দির মানে ল্যাবরেটরি যদি তারা নিজেরাই পাহারা দেবার ব্যবস্থা এখন থেকে না করে, তা হলে তিনমাস বাদে কুলৌ নদীর যে দুটি শাখা তাদের গাঁয়ের দুদিক দিয়ে বয়ে গেছে, তার একটা রক্তে লাল হবে আর একটায় আগুন জ্বলবে।

সোলোমাস আমার দিকে সন্দিগ্ধভাবে চেয়ে বললেন, এই সব বিপদ দেখেশুনে আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে, দাস! ফাঙ্গরা যদি সত্যিই ওই জলার ধারে দেবতার কথা শুনতে যায় তো তারা ওই সব আজগুবি কথা বিশ্বাস করে লাভালকে ছেড়ে দেবে মনে করেন? সাবাটিনি তাদের পেছনে আছে একথা ভুলবেন না। যদি তিন মাস তারা দেবতার কথার প্রমাণ দেখবার জন্য অপেক্ষা করে?

তা হলে প্রমাণ দেখতে পাবে! বলে হাসলাম।

সোলোমাস অত্যন্ত ক্ষুন্নস্বরে বললেন, এটা কি ঠাট্টা-ইয়ার্কির সময়, দাস?

ঠাট্টা-ইয়ার্কি করছি না, সোলোমাস। সত্যিই এক নদীতে জল লাল করে আরেক নদীতে আগুন জ্বালব। আপনাদের ল্যাবরেটরিতে সেন্ট্রিফিউজ নিশ্চয় আছে?

আছে। সোলোমাস তখনও হতভম্ব।

ভাল। আর শুধু ক-টা টেস্টটিউব আর জোরালো বিদ্যুতের আলো হলেই চলবে।

কী চলবে? সোলোমাস অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী করবেন আপনি?

দুটো নেহাত তুচ্ছ প্রাণীর বংশবৃদ্ধি করাব।

বংশবৃদ্ধি করাবেন! সোলোমাসের চোখ কপালে উঠল, কী প্রাণীর?

একটা হল জিম্ননাডিনিয়াম ব্রিভ, আর একটা নটিলিউকা মিলিয়ারিস-নেহাত আণুবীক্ষণিক নগণ্য প্রাণের কণা, দুটো সুতলি চাবুকের মতো শুড় বার করা একরকম ডাইনো ফ্ল্যাজেলেট। হাতের ব্যাগটা খুলে একটা পিপেট বার করে বললাম, তার জন্যে এই কাঁচের সূক্ষ্ম ছুঁচই যথেষ্ট।

আমি রসায়নের গবেষণা করি, ও সব প্রাণিতত্ত্ব বুঝি না। বলে সোলোমাস যে ভাবে হাল ছেড়ে দিয়ে চুপ করে গেলেন, তাতে মনে হল আমার মাথা খারাপ হওয়া সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ তাঁর আর তখন নেই।

অমাবস্যার আগের দিন পর্যন্ত, দিনে সোলোমাসের সঙ্গে তার গোপন গুহায় লুকিয়ে থেকে, রাত্রে তাদের ল্যাবরেটরিতে আমি যা করবার করে ফেললাম। তারপর গোপনে উজির হাতে ক-টা দাগ-দেওয়া টেস্টটিউব দিয়ে নদীর কোন শাখায় কোনগুলো ফেলতে হবে বলে দিলাম।

অমাবস্যার রাতে টিঙ্গা টিঙ্গার ধারে জংলি ফাঙ্গরা সত্যিই এসে জড়