গোফুর। আর যদি না পাওয়া যায়, তাহা হইলে কি হইবে?
দারোগা। সে পরের কথা; যাহা হয়, পরে দেখিতে পাইবেন।
ওসমান। কার হুকুম মত আপনি আমাদিগের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে চাহেন? বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করি বার কোন ওয়ারেন্ট আছে কি?
দারোগা। কাহার হুকুম মত আমি তোমাদিগের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে চাই, তাহা তুমি বালক, জানিবে কি প্রকারে? আমি আমার নিজের হুকুমে তোমাদিগের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিব।
ওসমান। যদি প্রবেশ করিতে না দি?
দারোগা। তোমার কথা শোনে কে?, আমি জোর করিয়া প্রবেশ করিব। তাহাতে যদি তুমি কোনরূপ প্রতি বন্ধকতা জন্মাও, তাহা হইলে তোমায় অপর আর এক মোকদ্দমায় আসামী হইতে হইবে।
ওসমান। যাহার অনুসন্ধানের নিমিত্ত আপনার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবেন, তাহাকে যদি না পাওয়া যায়, তাহা হইলে জবাবদিহি কে করিবে? আপনি করিবেন কি?
দারোগা। যাহাকে জবাবদিহিতে আনিতে পারিবে, সে-ই জবাবদিহি করিবে।
ওসমান। আর যদি সে আপন ইচ্ছায় আমাদিগের বাড়ীতে আসিয়া থাকে?
দারোগা। সে উত্তম কথা; সে আসিয়া আমাদিগের সম্মুখে সেই কথাই বলুক। তাহা হইলেই সকল গোলযোগ মিটিয়া যাইবে।
গোফুর। তবে কি স্ত্রীলোকটা আমাদের বাড়ীতে আছে?
ওসমান। না, সে আমাদের এখানে আসেও নাই, বা আমাদিগের এখানে নাইও।
দারোগা। মহাশয়! আমি আর অধিক বিলম্ব করিতে পারিতেছি না। এখন কি করিতে চাহেন, বলুন। স্ত্রীলোকটাকে কি আমার সম্মুখে আনিয়া দিবেন, না আমি বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া থানাতল্লাসি করিতে আরম্ভ করিব?
গোফুর। আমি ত বলিতেছি, সেই স্ত্রীলোকটা আমা দিগের বাড়ীতে নাই। আমার কথায় আপনি বিশ্বাস না করেন, আপনার যাহা অভিরুচি হয়, তাহা আপনি করিতে পারেন। কিন্তু, আমি পূর্বেই আপনাকে সতর্ক করিয়া দিতেছি, যাহা করিবেন, ভবিষ্যৎ ভাবিয়া করিবেন।
দারোগা। আমার কাৰ্য আমি বুঝি, তাহার নিমিত্ত আমি আপনার নিকট উপদেশ গ্রহণ করিতে আসি নাই। আমি লোকজনের সহিত আপনার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতেছি, ইচ্ছা করেন যদি, তাহা হইলে আপনার বাড়ীর স্ত্রীলোকদিগকে কোন একটা গৃহের ভিতর গমন করিবার নিমিত্ত বলিতে পারেন। আর ইচ্ছা না করেন, তাহাতে আমার কোনরূপ ক্ষতি-বৃদ্ধি নাই।
এই বলিয়া দারোগা সাহেব আপনার সমভিব্যাহারী লোকজনের সহিত বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার অভিপ্রায়ে উথিত হইলেন। তখন অনন্যোপায় হইয়া গোফুর খাঁ, ওসমান, এবং সেই সময় সেই স্থানে গোফুরের বন্ধু-বান্ধব গণের মধ্যে যাহারা উপস্থিত ছিলেন, তাঁহারাও সকলে দারোগা সাহেবের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিবার নিমিত্ত উথিত হইলেন।
দারোগা সাহেব প্রথমেই অন্দরমহলের মধ্যে প্রবেশ করিলেন না। সদর বাড়ীর ভিতর যে সকল গৃহ ছিল, প্রথমেই সেই সকল গৃহের মধ্যে অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। এক একখানি করিয়া সৰ্ব্বপ্রথমে সমস্ত খোলা ঘরগুলি দেখিলেন। তাহার ভিতর কিছু দেখিতে না পাইয়া, পরি শেষে যে ঘরগুলিতে চাবি বদ্ধ ছিল, চাবি খুলিয়া সেই ঘর গুলিও একে একে দেখিতে লাগিলেন।
গোফুর খাঁর প্রকাণ্ড বাড়ী; সুতরাং সদরে ও অন্দরে অনেক ঘর। বাহিরের ঘরগুলি দেখিতে প্রায় দুই ঘণ্টা কাল অতিবাহিত হইয়া গেল। এইরূপে তালাবদ্ধ কতকগুলি ঘর দেখিবার পর এক পার্শ্বের এক নির্জন গৃহের তালা খুলিলেন। সেই গৃহের ভিতর অপর দ্রব্য-সামগ্রী কিছুই ছিল না, কেবল গৃহের মধ্যে একখানি পালঙ্কের উপর একটা বিছানা আছে মাত্র।
সেই বিছানার সন্নিকটে গিয়া বা দেখিলেন, তাহাতে সমস্ত লোকেই একবারে বিস্মিত হইয়া পড়িলেন। ইতি পূর্বে দারোগা সাহেব যাহা স্বপ্নেও একবার মনে ভাবেন নাই, তিনি তাহা দেখিয়াই যেন হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলেন। কিছুক্ষণের নিমিত্ত যেন তাহার সংজ্ঞাও বিলুপ্ত হইল। একটু পরেই দারোগা সাহেব কহিলেন, কি মহাশয়। এ কি দেখিতেছি?
দারোগা সাহেবের কথা শুনিয়া আর কাহারও মুখে কোন কথা বাহির হইল না। পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে দেখিতে লাগিলেন। কেবল হেদায়েৎ সেই বিছানার সঙ্গিক বৰ্ত্তী হইয়া কহিল, মহাশয়! এই আমার কন্যা।
এই বলিয়া হেদায়েৎ তাহার কন্যার গাত্রে হস্তাপণ করিয়া বার বার তাহাকে ডাকিতে লাগিল; কিন্তু সে নড়িল না, যা তাহার কথার কোনরূপ উত্তর প্রদান করিল না। তখন সকলেই জানিতে পারিল যে, সে আর জীবিত নাই।
দারোগা। প্রথমতঃ বড় লম্বা লম্বা কথা কহিতেছিলে যে, এখন আর মুখ দিয়া কথা বাহির হইতেছে না কেন?
গোফুর। ইহার ব্যাপার আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না।
দারোগা। এখন ত কিছুই বুঝিতে পারিবেন না। এই স্ত্রীলোকের মৃতদেহ এই তালাবন্ধ গৃহের ভিতর কিরূপে আসিল?
গোফুর। আমি ইহার কিছুই অবগত নহি।
দারোগা। (ওসমানের প্রতি) কিগো ওসমান মিঞা, আপনিও বোধ হয়, ইহার কিছুই জানেন না?
ওসমান। না মহাশয়! আমিও ইহার কিছুই অবগত নহি।
দারোগা। সদর বাড়ীর ভিতর তালাবদ্ধ গৃহে, পালঙ্কের। উপর মৃত স্ত্রীলোকের লাস রহিয়াছে। আর আপনারা বলিতেছেন যে, আপনারা কিছুই জানেন না। দ্বারে যে দ্বারবান বসিয়া আছে, সেও বলিবে, আমি কিছুই জানি না। কিন্তু কিরূপে এই স্থানে লাস আসিল, ইহার যদি সন্তোষ জনক প্রমাণ আমাকে আপনারা প্রদান করিতে না পারেন, তাহা হইলে জানিবেন, আপনাদিগের উভয়কেই আমি ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলাই।