রামরতন। আপনার কথা প্রকৃত; কিন্তু সকলে কি অর্থের সংকুলান করিয়া উঠিতে পারে?
পিতা। আমি কাহারও নিকট এরূপ অধিক অর্থ চাহি নাই যে, তিনি তাহা দিতে না পারেন। মূল কথা, আজকাল সকলেই ফাকি দিয়া আপন আপন কাৰ্য উদ্ধার করিতে চাহেন। তাহ কি কখন হয়? কিছু খরচ না করিলে, বড় মানুষের বাড়ীতে কি কন্যার বিবাহ দেওয়া যায়?
রামরতন। আপনি কত টাকা প্রার্থনা করিয়াছিলেন?
পিতা। অতি সামান্য। আমি নগদ এক পয়সাও চাহি নাই, তবে কি না, বিবাহে আমাকে যে কিছু সামান্য খরচ করিতে হইবে, তাহা আমি আপন ঘর হইতে করিব কেন? কেবল মাত্র সেই খরচের টাকাটা প্রদান করিলেই হইতে পারিত। তবে গহনা, তাহা ত তাহার কন্যারই থাকিবে।
রামরতন। খরচের নিমিত্ত কত টাকা হইলে হইতে পারে? পি। চারি হাজার টাকার অধিক নহে। রামরতন। অলঙ্কার বলিয়া কি দিতে হইবে?
পিতা। আমি হীরামতি চাহিতেছি না। কন্যাটীর গাত্রে যাহা কিছু সোণার অলঙ্কার পরিবে, তাহার সমস্তই দিতে হইবে।
রামরতন। কত ভরি সোণা হইলে সেই সমস্ত গহনা প্রস্তুত হইতে পারে?
পিতা। অধিক নহে। বোধ হয়, তিনশত ভরি সোেণা হইলেই সকল গহনা হইয়া যাইবে।
রামরতন। মহাশয়! আমি আপনার মনোভাব কতক পরিমাণে অবগত হইলাম। এখন আপনি অনুগ্ৰহ করিয়া একবার আমার কন্যাটীকে অগ্রে স্বচক্ষে দর্শন করুন। কন্যাটী দেখিয়া যদি আপনার মনোনীত হয়, তাহা হইলে তখন দেনা পাওনার বন্দোবস্ত করিব; কিন্তু আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহার মধ্যে কোন কোন বিষয় কিছু কিছু বিবেচনা করিতে হইবে।
পিতা? আপনি কি করিয়া থাকেন? রামতন। সামান্য চাকরী। পিতা। সামান্য চাকরী করিয়া আপনি কিরূপে এত টাকা প্রদান করিতে সমর্থ হইবেন?
রামরতন। সে ভাবনা আমার। যে ব্যক্তি সামান্য চাকরী করে, তাহার কি পৈত্রিক বা অন্য কোন উপায়ে প্রাপ্ত কোন রূপ অর্থ থাকিতে নাই?
পিতা। আচ্ছা মহাশয়! আপনি কল্য প্রাতঃকালে এখানে আগমন করিবেন। আপনার সহিত গমন করিয়া আমি আপনার কন্যাটীকে দেখিয়া আসি।
পাত্রের পিতার কথা শুনিয়া রামরতন বাবু তাহাতে সম্মত হইলেন, এবং পরদিবস প্রাতঃকালে তিনি আসিয়া তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবেন, এইরূপ স্থির করিয়া সেই দিবস সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।
রামরতন বাবুর কন্যাটী বেশ সুরূপা। এই নিমিত্তই তাহার মনে মনে বিশ্বাস ছিল যে, কোন বড়লোক তাহার কন্যাটী পাইলে অর্থ না চাহিয়াই তাহাকে গ্রহণ করিবে। এই নিমিত্তই তিনি ভাল পাত্রের অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছিলেন। তাঁহার ইচ্ছা ছিল যে, একটী ভাল পাত্র পাইলে, তাহার নিমিত্ত তিনি সর্বপ্রকারে দুই তিন সহস্র পর্যন্ত টাকা প্রদান করিবেন। এই টাকা যে তিনি সহজে অর্পণ করিতে পারিবেন তাহা নহে, তাহার নিমিত্ত তাহাকে ঋণ-জালে আবদ্ধ হইতে হইবে।
পরদিবস অতি প্রত্যূষে রামরতন বাবু সেই পাত্রের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন; এবং তাহার পিতাকে সঙ্গে করিয়া আপন বাড়ীতে আনিলেন। বাড়ীর স্ত্রীলোকগণ পূর্ব্ব হইতেই কন্যাটাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করিয়া সাজাইয়া রাখিয়াছিলেন। গাত্রের পিতার সহিত আরও দুই তিন জন লোক আগমন করিয়াছিলেন। তাঁহারা সকলেই কন্যাটীকে উত্তম রূপে দেখিলেন, কন্যা দেখিয়া সকলেই সন্তুষ্ট হইলেন, সকলেরই মনোমত হইল। তাহার মধ্যে একজন প্রকাশ্যে পাত্রের পিতাকে বলিয়াও ফেলিলেন, আমরা আপনার পুত্রের নিমিত্ত এ পর্যন্ত যত পাত্রী দেখিয়াছি, তাহার মধ্যে একটী ও এরূপ সুশ্রী নহে। এই পাত্রীটীর সহিত আপনার পুত্রের বিবাহ দিতে হইবেই হইবে। আপনি অর্থের নিমিত্ত এই পাত্রীকে যেন কোন রূপেই হস্তান্তর করিবেন না।
কন্যা দেখা সমাপ্ত হইলে সকলেই প্রস্থান করিলেন। যাইবার সময় পাত্রের পিতা বলিয়া গেলেন, কল্য বৈকালে আপনি আমার নিকট গমন করিবেন। সেই সময় দেনা পাওনা সম্বন্ধে কথা বার্তা হইবে। পাত্রী আমার মনোনীত হইয়াছে। ইনি খুব সুরূপা না হউন, ইহাকে আমার পুত্রবধূ করিতে আমার কোনরূপ আপত্তি নাই।
পরদিবস কথিত সময়ে রামরতন পাত্রের পিতার নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন; এবং তাহাকে কহিলেন, মহাশয়ের যদি পাত্রীটী পসন্দ হইয়া থাকে এবং আমার কন্যার সহিত আপনার পুত্রের বিবাহ দিবার মতও যদি আপনার পরিবারবর্গের হইয়া থাকে, তাহা হইলে আমাকে কি কি আয়োজন করিতে হইবে, তাহা আমাকে বলিয়া দিন; যদি আমার বাধ্য হয়, তাহা হইলে আমি তাহার চেষ্টায় নিযুক্ত হই।
রামরতনের কথা শুনিয়া পাত্রের পিতা কহিলেন, আমি আপ নাকে ত একরূপ পূৰ্বেই বলিয়া দিয়াছি। যদি চাহেন, তাহা হইলে আমি একটী ফর্দ করিয়া আপনাকে দিতেছি। আপনি যদি তাহাতে সম্মত হন, তাহা হইলে আপনি যাহা জানিতে চাহিতেছেন, তাহার সমস্তই স্থির হইয়া যাইবে।
এই বলিয়া তিনি তাহার বাক্স হইতে একটা ফর্দ বাহির করিয়া রামরতনের হস্তে প্রদান করিলেন। সেই ফর্দখানির মৰ্ম্ম এইরূপ;
বরাভরণ–
সোণার ঘড়ি একটী – ৩০০টাকা
সোণার চেন এক ছড়া – ৩০০টাকা
হীরার আংটী একটী – ৫০০টাকা
গার্ডচেন এক ছড়া ২৫ ভরি – ৬২৫টাকা
বেণারসী চেলী এক জোড় – ১০০টাকা
কন্যাভরণ–
সুবৰ্ণ ৩০০ ভরি ২৫টাকা হিসাবে – ৭৫০০ টকা
রৌপ্য ১০০ ভরি – ১০০টাকা
দানসামগ্রী পিত্তল-কাসা এক প্রস্থ – ১০০টাকা
ঐ চাঁদির এক প্রস্থ ১০০০ ভরি – ১০০০টাকা
খাট বিছানা – ২০০টাকা
ফুলশয্যা, নমস্কারী ইত্যাদি – ৫০০টাকা
নগদ – ৪০০১টাকা