আর শ্রাবণীও সেটা কোনদিন সুসীমকে বুঝতে দেয় নি।
কারণ সুনন্দার প্রতি সুসীমের মনোভাবটা শ্রাবণীর অজ্ঞাত ছিল না।
সেদিন মাত্র দিন-পনের আগে হঠাৎ যখন সুসীম গিয়ে শ্রাবণীর কাছে বিবাহের প্রস্তাব করেছিল, তখন শ্রাবণী একটু যেন বিস্মিতই হয়েছিল। কয়েকটা মুহূর্ত সে জবাব দিতেও পারে নি।
আমি বুঝতে পারছি প্রস্তাবটা তোমার কাছে খুবই আকস্মিক মনে হচ্ছে শ্রাবণী, তাই এখুনি এই মুহূর্তেই কোন জবাব তোমার কাছে আমি চাই না। তুমি বরং ভেবে দেখো—কালপরশু না-হয় আবার আমি আসব!
যাবার জন্য সুসীম পা বাড়ায়।
শোন!
হঠাৎ সেই সময় শ্রাবণী ডাকে।
একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না—
কি?
আমার কথা না হয় ছেড়েই দিচ্ছি, কিন্তু কারোরই তো এতদিন জানতে বাকী ছিল না যে তুমি সুনন্দাকেই বিয়ে করবে!
প্রত্যুত্তরে হাসে সুসীম।
হাসছো যে?
কথাটা এতদিন লোকে জানত বটে, মিথ্যাও তুমি বল নি, কিন্তু—
থামলে কেন, বল?
ভুল বোঝা বলে মানুষের একটা ব্যাপারও তো থাকতে পারে!
ভুল?
হ্যাঁ, সবটাই হয়তো একটা ভুলের ওপরই এতদিন দাঁড়িয়ে ছিল—
এই বারো বছর ধরে ভুল?
সারাজীবনেও তো মানুষের কোন কোন ভুল শোধরায় না–তা এ তো বারোটা বছর!
তবু একটু বেশী সময়ই নয় কি?
তাই তো তোমাকে সময় দিয়ে যাচ্ছি। জবাব তো আজই এই মুহূর্তেই আমি চাইছি না।
শ্রাবণী অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। কোন কথাই বলে না। সুসীমও চুপ করেই থাকে।
তারপর শ্রাবণী এক সময় বলে, এ রকমটা যে একদিন হবে আমি তা জানতাম।
তুমি জানতে! বিস্ময়ে তাকায় সুসীম শ্রাবণীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, জানতাম। আর তুমি চোখ বুজে না থাকলে এতদিনে সেটা জানতে পারতে।
কি কি জানতে পারতাম?
জানতে পারতে সে তোমাকে সত্যিই ভালবাসে না। শুধু তোমাকেই বা বলি কেন, কোন পুরুষকে ভালবাসার মতো নারীমনই ওর নেই।
শ্রাবণী!
হ্যাঁ, নারীর যে মন পুরুষকে ভালবাসে, সে মনই যে ওর নারী হয়েও নেই। যাক সে কথা, আমার কথা আমি বলছি না, তুমি বরং আরো কিছুদিন ভেবে দেখ।
ভেবেই আমি তোমার কাছে আজ এসেছিলাম শ্রাবণী।
সত্যি বলছো?
হ্যাঁ।
বেশ, তাহলে তুমি ব্যবস্থা করতে পারো।
আনন্দে সুসীম শ্রাবণীর একটা হাত ধরে ফেলে বলে, সত্যি–সত্যি শ্রাবণী!
সত্যি।
আঃ! তুমি-তুমি আমাকে বাঁচালে। কি নিশ্চিন্ত যে তুমি আমাকে করলে। কিন্তু একটা কথা শ্রাবণী–
বল?
আজ-কালের মধ্যেই কিন্তু চাকরিতে তোমাকে তাহলে ইস্তফা দিতে হবে—
না।
সে কি! বিয়ের পরেও চাকরি করবে?
না, বিয়ের পরে আর করবো না। তবে রেজিগনেশান দেবো বিয়ের পর–এখন নয়।
কি ভেবে এবারে সুসীম বলে, বেশ।
আর একটা কথা—
কি?
বিয়েটা কিন্তু আমাদের রেজিস্ট্রী করে হবে, রাজী তো?
বেশ। আমার আপত্তি নেই।
.
ঘটনাচক্রে মধুরাত্রি ওদের যাপন করা হয়ই নি।
তাই সুধা পরের দিন রাত্রে নতুন উৎসাহে আবার ঘর সাজিয়েছিল। এবং স্বামীকে বলে এক রাত্রির জন্য এমন কি সানাইয়ের পর্যন্ত ব্যবস্থা করেছিল। সুসীম অনেক বাধা দিয়েছিল, কিন্তু কান দেয় নি তার কথায় সুধা। রাত্রে নিজের হাতে শ্রাবণীকে সাজিয়ে পাঠিয়েছিল সেই ঘরে।
সুসীম ঘরের কোণে একটা ইজিচেয়ারের উপর বসে ছিল। শ্রাবণী এসে ঘরে ঢুকতেই সে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু শ্রাবণী স্বামীর সঙ্গে কোন কথাই বললো না। ঘরের সংলগ্ন যে ব্যালকনি ছিল সেই ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল।
সারাদিন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দেখাও হয় নি—কথাও হয় নি।
শ্রাবণী ঘরে ঢুকেই ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াতে সুসীম যেন কেমন একটু থতমত খেয়ে যায়। অতঃপর কিছুক্ষণ সে ঘরের মধ্যেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
তারপর কি ভেবে ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে ব্যালকনির দিকেই অগ্রসর হয়।
অন্ধকারে শ্রাবণী ব্যালকনির রেলিং ধরে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
বাইরে সানাই তখনো বাজছে।
সুসীম এসে পিছনে দাঁড়াতেও কিন্তু শ্রাবণী ফিরে তাকাল না বা কোন কথা বললো না। তবু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সুসীম। কিন্তু শ্রাবণী যখন সাড়া দিলই না, তখন মৃদুকণ্ঠে ডাকে, শ্রাবণী!
শ্রাবণী নিরুত্তর।
সুসীম আবার ডাকল, শ্রাবণী!
তথাপি শ্রাবণী কোন সাড়া দেয় না।
সাড়া দিচ্ছ না কেন শ্রাবণী? তুমি কি কথা বলবে না?
আমি কিছুদিনের জন্য শিলং যেতে চাই—এবং কালই যেতে চাই।
মৃদুকণ্ঠে শ্রাবণী এবারে কথাগুলো বলে।
শিলং!
হ্যাঁ।
ও। তা কালই তুমি যেতে চাও!
হ্যাঁ, এখানে—এ বাড়িতে যেন এক মুহূর্তও আর আমি টিকতে পারছি না।
বেশ। কিন্তু সেখানে—
সেখানে ছোট মাসী আছে আমার, কিছুদিন সেখানে গিয়ে আমি থাকবো।
বেশ। তবে আমি ভাবছিলাম, আমাদের কথা হয়েছিল বিয়ের পর মাসখানেক আমরা মুসৌরী গিয়ে মধুচন্দ্রিমা যাপন করবো–
না না–ওসব এখন থাক!
বেশ তাই হবে, কিন্তু একটা কথা—
কি?
সত্যিই যদি আমাকে কিছু তোমার বলবার থাকে তো বলতে পার।
বলবার! তোমাকে?
হ্যাঁ।
মুহূর্তকাল নিঃশব্দে অন্ধকারে যেন স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে রইলো শ্রাবণী।
তারপর বললো, কিছু বলবার নেই আজ আর তোমাকে–কিছু বলবার আর নেই—
শ্রাবণী!
হ্যাঁ, বলবার যা সেদিনই তো আমি বলেছিলাম তোমাকে, যেদিন বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে আমার কাছে গিয়ে তুমি দাঁড়িয়েছিলে। কিন্তু কেন—কেন সেদিন সত্য কথাটা গোপন করেছিলে বলতে পার?
সত্য কথা গোপন করেছি!
করো নি? সুনন্দাকে যে তুমি ভুলতে পারো নি, কোনদিন পারো না—কথাটা কেন গোপন করেছিলে আমার কাছে সেদিন?