।আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে হরপ্রসাদ কথাটা সুসীমকে না শুধিয়ে পারেন নি, তবে যে বলেছিলে ভায়া সুনন্দাকে তুমি নিমন্ত্রণ জানাও মি!
মৃদু হেসে সুসীম বলেছিল, কাল রাত্রে নিমন্ত্রণ করেছিলাম–
সত্যি?
সত্যি।
হরপ্রসাদ অতঃপর চুপ করেই গিয়েছিলেন।
কিন্তু সুসীমের বোন সুধা সুনন্দাকে আসতে দেখে খুশী হয় নি। আসলে একমাত্র ভাইয়ের সঙ্গে সুনন্দার প্রগাঢ় ঘনিষ্ঠতাটা কোনদিনই প্রীতির চোখে দেখে নি সুধা। কি জানি কেন, সুনন্দাকে আদপেই যেন তার ভাল লাগতো না কোনদিন। সুনন্দার চালচলন বেশভূষা প্রসাধন কথাবার্তা কোনটাই সুধার কোনদিন ভাল লাগে নি।
সুনন্দার সঙ্গে সুধারও আলাপ-পরিচয় ছিল, যেহেতু সুধাও একসময় সুনন্দার সহপাঠিনী ছিল। এবং অতীতে সেই সূত্রেই সুসীমদের বাড়িতে সুনন্দার যাতায়াত শুরু হয়েছিল। সেই সময়ই সুসীমের আলাপ প্রথম সুনন্দার সঙ্গে। এবং ক্রমশ শ্রাবণী, বিশাখা চৌধুরী প্রভৃতির সঙ্গেও তখনই আলাপ হয়।
সুধার তারপর অবিশ্যি বিয়ে হয়ে যাওয়ায় পড়া বন্ধ হয়ে যায়। সে স্বামীর ঘর করতে চলে যায় পাটনা।
প্রথম যেদিন সুধা লক্ষ্য করেছিল, সুনন্দা তাদের গৃহে তার কাছে এলেও তার আকর্ষণটার মূল হচ্ছে সুসীম এবং সুধাদের বাড়িতে এলে বেশীর ভাগ সময় সে সুসীমের ঘরে তার বন্ধুদের সঙ্গেই কাটায়, তখন থেকেই সুধার যেন কেমন ব্যাপারটা ভাল লাগত না।
মুখে কিছু না বললেও, সেই থেকেই সে সুনন্দাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। এবং ক্রমশ তার মনে যেন সুনন্দার প্রতি একটা বিতৃষ্ণা জমে উঠতে থাকে।
তবে কোনদিনই সে সুনন্দা সম্পর্কে কোন অসন্তোষ প্রকাশ করে নি। কারণ সে জানতো সুসীমের সঙ্গে সুনন্দার একটা প্রগাঢ় ঘনিষ্ঠতা আছে।
বিয়ের ব্যাপারে তাই সে আসতেও চায় নি প্রথমটায়। কিন্তু হরপ্রসাদ বলেছিলেন স্ত্রীকে, ছিঃ সুধা, এ সময় তোমার মনে যাই থাক না কেন, না যাওয়াটা হবে একটা অমার্জনীয় অপরাধ। তা ছাড়া সে যখন পছন্দ করে বিয়ে করছে, তখন তোমার আমার কি বলবার থাকতে পারে!
একান্ত অনিচ্ছার সঙ্গেই আসতে হয়েছিল সুধাকে। কিন্তু এসে যখন শুনলে সুনন্দা নয়—অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে সুসীমের বিয়ে হচ্ছে, তখন সুধা সত্যিই খুশী হয়েছিল। ভারী মনটা তার হালকা হয়ে গিয়েছিল। নতুন উৎসাহে সে বিয়ের ব্যাপারে কোমর বেঁধেছিল।
কিন্তু বৌভাতের উৎসবে সুনন্দাকে আসতে দেখে আবার সুধা যেন একটু ক্ষুন্নই হয়েছিল, যদিও সে জানতো না শেষ পর্যন্ত কেন সুসীম সুনন্দাকে না বিয়ে করে শ্রাবণীকে বিয়ে করলো!
সুনন্দা নিহত হওয়ায় হরপ্রসাদ ও সুধা এই কথাগুলি ভাবছিল।
হরপ্রসাদ ও সুধা দুজনের মনের মধ্যেই নানা প্রশ্ন উদিত হতে থাকে, কিন্তু কেউই সুসীমকে মুখ ফুটে কোন প্রশ্ন করতে পারে না।
সুধা কিন্তু শেষ পর্যন্ত চুপ করে থাকতে পারে না, ঘরের পাষাণ-স্তব্ধতা ভঙ্গ করে কতকটা যেন নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করবার মতো কথাটা উচ্চারণ করে, কিন্তু কে হত্যা করলো ওকে অমন করে?
সুধার কণ্ঠ হতে কথাটা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন সহসা ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলে চম্কে সুধার মুখের দিকে তাকালো।
কে!
সুধার কণ্ঠ হতে উচ্চারিত কথাগুলোর মধ্যে কে নিষ্ঠুর এই শব্দটা যেন একটা বিষাক্ত ছুঁচের মতো সকলের চেতনাকে বিদ্ধ করে।
সুসীম ভাবে কে, হরপ্রসাদ ভাবে কে, সুধা ভাবছে কে, শ্রাবণীও ভাবে কে?
কয়েকটা স্তব্ধ মুহূর্ত অতিবাহিত হবার পর হরপ্রসাদ কথা বলেন, তার চাইতেও বড় কথা, এই বাড়িতেই বিশ্রী ব্যাপারটা ঘটলো!
সুধা অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে, কিন্তু তার জন্য কি আমরা দায়ী?
দায়ী—আমরা দায়ী কেমন করে? অসহায় কণ্ঠে কথাটা বলে সুসীম সকলের মুখের দিকে তাকায়।
মনে হলো সত্যিই যেন সুসীম একটা অবলম্বন খুঁজছে।
দায়ী আমরা নিশ্চয়ই হয়তো নয়—হরপ্রসাদ বলেন।
হয়তো মানে! কি কি আপনি বলতে চান হরপ্রসাদবাবু? শ্রাবণী প্রশ্নটা করে।
ণা না—তাই তো বলছিলাম। আমরা—আমরা দায়ী হবো কেন? কিন্তু পুলিস—
হরপ্রসাদের কথাটা শেষ হলো না, সুধা স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে শুধায়, পুলিস কি?
এ বাড়িতে ব্যাপারটা যখন ঘটেছে, তখন আমাদের তারা—মানে ঐ পুলিস খুব সহজে নিষ্কৃতি দেবে কি?
নিষ্কৃতি দেবে না মানে! এ কি জুলুম নাকি? সুধা যেন তীক্ষ্ণকণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে।
জুলুমের কথা নয় সুধা, কথাটা হচ্ছে আইনের। অদ্ভুত শান্ত কণ্ঠে যেন কথাটার প্রত্যুত্তর দিলেন হরপ্রসাদ।
আইন!
হ্যাঁ, আইন, আইনই জুলুম করবে।
রেখে দাও তোমার আইন, জুলুম করলেই অমনি হলো! প্রতিবাদ জানায় সুধা পুনরায় তীক্ষ্ণকণ্ঠে।
এবারে আর হরপ্রসাদ কোন জবাব দিলেন না। মৃদু হাসলেন মাত্র।
.
০৫.
সুনন্দা চ্যাটার্জীর নিহত হওয়ার ব্যাপারটা আর যার মনেই যেটুকু রেখাপাত করুক বা না করুক—স্বামী-স্ত্রী সুসীম ও শ্রাবণীর মনের মধ্যে কিন্তু কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম চিড় ধরিয়ে দিয়ে গেল।
আনন্দের আকাশে কোথায় যেন একটা কালির বিন্দুর মত মেঘ দেখা দিল। বিবাহের পূর্বে শ্রাবণীর সঙ্গে সুসীমের যে পরিচয়টা ছিল, তার মধ্যে আর যাই হোক ঘনিষ্ঠতা বলতে যা বোঝায় সেরকম সত্যই কিছু ছিল না সুসীমের দিক থেকে।
কিন্তু সুসীম যেটা কোনদিনই বুঝতে পারে নি বা বুঝবার কোন অবকাশ পায় নি সেটা হচ্ছে শ্রাবণীর একটা দুর্বলতা ছিল তার প্রতি।