কিন্তু কে সে ভদ্রলোক?
সুসীমবাবু বলছেন, অমন চেহারার কেউই তাঁর গৃহে নিমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন না।
তবে ভদ্রলোকটি কোথা থেকে এলেন আর কোথায়ই বা গেলেন?
তবে কি সে-ই সুনন্দা চ্যাটার্জীর হত্যাকারী?
সত্যি সত্যি সে হত্যাকারী হলেও, ব্যাপারটা যেন কেমন দুর্বোধ্য। কারণ সেই লোকই যদি সুনন্দাকে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করে থাকে তো সুসীমের অপরিচিত হয়েও কোন্ দুঃসাহসে সে এখানে প্রবেশ করেছিল আজ রাত্রে?
আর কেমন করেই বা এত লোকের মাঝখানে, বলতে গেলে এতগুলো লোকের এক রকম চোখের উপরেই সুনন্দাকে হত্যা করে গেল লোকটা?
ইতিমধ্যে রাত্রি শেষ হয়ে এসেছিল। নিমন্ত্রিতরা সকলেই যে যার গৃহে ফিরে গিয়েছেন। সাধন দত্তও মৃতদেহ মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করে আপাততঃ সুসীমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে
উঠে আবার বসে পড়ে প্রশ্ন শুরু করলেন।
.
০৪.
সবাই চলে গিয়েছে।
কেবল সুসীম, শ্রাবণী, ভগ্নীপতি হরপ্রসাদ, সুসীমের বোন সুধা উপরের লাইব্রেরী-ঘরে যেন তখনো বিহ্বল বিমূঢ় হয়ে বসে ছিল।
এ কি অপূর্ব, অকল্পিত বিভ্রাট! হরপ্রসাদ লোকটি যেমন স্থির ধীর, তেমনি তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন এবং রীতিমত রসিক প্রকৃতির। সুদীর্ঘকাল দুই পুরুষ ধরে ওঁদের পরিবার পাটনা শহরে আছে। হরপ্রসাদ পাটনা হাইকোর্টে ব্যারিস্টার হিসাবে প্র্যাকটিস্ করেন এবং একজন নামকরা ব্যারিস্টার। বয়সে দুএক বছরের বড়ই হবেন হরপ্রসাদ সুসীম থেকে। কিন্তু তা হলেও উভয়ের মধ্যে অর্থাৎ হরপ্রসাদ ও সুসীমের মধ্যে একটা রসের এবং মধুর প্রীতির সম্পর্ক বরাবরই ছিল। সুনন্দা যে একসময় দীর্ঘদিন ধরে শ্যালক সুসীমের মনোহারিণী ছিল, ব্যাপারটা হরপ্রসাদের বা তার স্ত্রী সুধার অজানা ছিল না।
তাই মধ্যে মধ্যে সুসীমকে একটু রসিকতার সুরেই বলতেন হরপ্রসাদ, দেখ ভায়া, তোমার বান্ধবীটি যখন তোমার মন হরণ করেছেন তখন যে তিনি সত্যি সত্যিই মনোহারিণী সন্দেহ নেই, কিন্তু কি জান ভায়া—
কি?
ঐ মন হারানো ও মন পাওয়া পর্বের মধ্যে একটা মাধুর্য আছে নিঃসন্দেহে, কিন্তু তুমি ব্যাপারটা যেভাবে টেনে টেনে দীর্ঘস্থায়ী করে তুলছে তাতে করে তোমার ওপরে তাঁর আস্থাটা শেষ পর্যন্ত যদি মিইয়েই যায় তাতে করে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না।
মৃদু হেসে জবাব দিয়েছে সুসীম, না, সে ভয় নেই।
নেই তো?
না।
একটু বেশী স্যাংগুইন-ই যেন তুমি বলে মনে হচ্ছে ভায়া!
তা একটু বৈকি। পুনরায় হাসির সঙ্গেই জবাব দিয়েছে সুসীম তার ভগ্নীপতিকে। কিন্তু তারপর হঠাৎ যখন তাঁর বিবাহের আট বছর বাদে হরপ্রসাদ শ্যালকের কাছ থেকে চিঠি পেলেন, সুসীমের বিবাহের দিন স্থির, তিনি যেন অবিলম্বে সুধাকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন—তখনো কিন্তু হরপ্রসাদ ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেন নি যে পাত্রী সুনন্দা চ্যাটার্জী নয়, শ্রাবণী চৌধুরী।
যাই হোক, স্ত্রী-সহ হরপ্রসাদ অবিলম্বে মানে বিয়ের সাতদিন আগেই কলকাতায় এসে পৌঁছালেন এবং গাড়ি থেকে নেমেই শ্যালককে কৌতুক করে জিজ্ঞাসা করলেন, মন-জানাজানির পর্ব তাহলে এতদিনে শেষ হলো ভায়া!
যদিও আলাপ ছিল, তবুও সেভাবে জানবার বা বুঝবার চেষ্টাই করি নি কখনো। আর সময় পেলাম কোথায়?
মানে?
মানে পনের দিন আগে পর্যন্তও তো ব্যাপারটা ভাবতে পারি নি।
ভাবতে পারো নি—সময় পেলে না মানে? বারোটা বছর যে একটা যুগ হে–তোমাদের উভয়ের জানাজানি–
ও, তুমি সুনন্দার কথা বলছে বুঝি? কিন্তু সে তো নয়! হরপ্রসাদকে থামিয়ে দিয়েই কথাটা বলে সুসীম।
বিস্ময়ের যেন সত্যিই অবধি থাকে না হরপ্রসাদের। বলেন, সে কি হে? তুমি কি তবে সুনন্দাকে বিয়ে করছো না?
না।
সত্যি বলছো?
সত্যিই।
হরপ্রসাদ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বলছিলেন। এবারে সোফাটায় বসে পড়ে বললেন, দাঁড়াও, দাঁড়াও-তুমি যে ভায়া সত্যি-সত্যিই আমাকে বোকা বানিয়ে দিচ্ছ! রসিকতা করছে না তো?
রসিকতা কেন হবে! হাসতে হাসতে সুসীম বলে, বিয়ে করছি আমি অন্য একটি মেয়েকে-শ্রাবণী চৌধুরী তার নাম।
ও। তা–তাহলে সুনন্দা–
পূর্ববৎ হাসতে হাসতেই সুসীম বলেছিল, সুনন্দা নামটা শুনেই তো বোঝা উচিত ছিল হরপ্রসাদ—সে হচ্ছে দশের নন্দিতা! কোন ব্যক্তিবিশেষের নন্দিতা হতে সে রাজী হবে কেন?
বল কি!
তাই।
কিন্তু–
না হে, তা ছাড়া—
তা ছাড়া?
প্রেম আর বিয়ে ও দুটো বস্তু তো এক নয় হে। একটা হচ্ছে সযতনে ব্যবহার করবার মতো পোশাকী দামী সিফন শাড়ী, অন্যটা আটপৌরে শাড়ি—একান্ত সাংসারিক ঘরোয়া ব্যাপার।
কিন্তু তাহলে তোমার ও সুনন্দার মধ্যে এতদিনকার সম্পর্কটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে! একেবারে ছাড়াছাড়ি নয় তো?
ছাড়াছাড়ি হবে কেন?
তাই তো ভায়া, ব্যাপারটা যেন কেমন গোলমেলে মনে হচ্ছে!
গোলমেলে কেন হতে যাবে?
হ্যাঁ, গোলমালের বৈকি—
না, গোলমেলে কিছু নেই।
বলছো?
হুঁ।
কিন্তু শ্রাবণীকে কি ব্যাপারটা বলেছো?
বলবার প্রয়োজন হয় নি–
প্রয়োজন হয় নি!
না। সে জানে।
জানে মানে?
একটু আগেই তো বললাম, সেও অপরিচিতা ছিল না। সুনন্দার কথা সে সবই জানত।
.
এ কথাটাও পরে শুনেছিলেন হরপ্রসাদ, সুসীম শেষ পর্যন্ত সুনন্দাকে তার বিবাহে নিমন্ত্রণ পর্যন্ত করে নি।
তাই সেই সুনন্দা যখন বৌভাতের দিন সেজেগুজে এসে হাজির হলো উৎসব-বাড়িতে, হরপ্রসাদ একটু অবাকই হয়েছিলেন। তারপর সুসীম সুনন্দাকে যেভাবে রিসিভ করেছিল— যেন বিশেষভাবে আমন্ত্রিত হয়েই সে এসেছে, ব্যাপারটা হরপ্রসাদকে যেন আরো একটু বেশী অবাক করে।