না তুমি যাও, অন্য এক সময় বরং আলাপ করা যাবে। তাছাড়া—
তাছাড়া আবার কি?
আমি একজনের জন্য অপেক্ষা করছি।
বিস্ময়ে পাল্টা প্রশ্ন করে মৃণাল, অপেক্ষা করছে! কার জন্য?
কাল বলবো, আজ নয়।
বেশ। কালই তবে শুনবো।
মৃণাল আর দাঁড়ায় নি।
কিন্তু খাওয়ার পর ছাত থেকে হলঘরে এসে যখন সে ঢুকলো তখন হলঘর একেবারে খালি, কেবল সেই সোফাটার উপরে তেমনি তখনো একাকী বসে আছে সুনন্দা।
রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারটা।
সুনন্দা!বলে ডেকে কাছে এগিয়ে গিয়েই কিন্তু থমকে দাঁড়িয়ে যায় মৃণাল।
অস্বাভাবিক—অস্বাভাবিক মনে হয় সুনন্দাকে। আর একটু কাছে গিয়েই ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে দেরি হয় না মৃণালের। এবং তারপর গায়ে হাত দিতেই সে সুনন্দার মৃত্যু সম্পর্কে স্থিরনিশ্চিত হয়।
তারপর? সাধন দত্ত শুধালেন।
ঠিক সেই সময় বিশাখা এসে হলঘরে ঢোকে।
বিশাখা তখনো ব্যাপারটা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে নি।
সে তাই কৌতুক করতে করতে এগিয়ে আসে, কি ব্যাপার, নিভৃতে দুজনে মুখোমুখি!
ফিরে তাকায় মৃণাল বিশাখার মুখের দিকে। মৃণালের সমস্ত মুখ ফ্যাকাশে রক্তশূন্য। চোখের দৃষ্টি অসহায় বিহূল।
চমকে ওঠে বিশাখা, বলে, কি ব্যাপার, মৃণাল?
মৃণাল কোন কথা না বলে নিঃশব্দে শুধু ইঙ্গিতে সুনন্দাকে দেখায়।
বিশাখা সুনন্দার দিকে তাকিয়ে বোকার মতোই তখনো ব্যাপারটা না বুঝতে পেরে পুনরায় প্রশ্ন করে, কি হয়েছে সুনন্দার?
সি ইজ ডেড!
ডেড?
একটা আর্ত অস্ফুট চীৎকার যেন বের হয়ে আসে বিশাখার কণ্ঠ থেকে।
তারপরই বিশাখা ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। এবং ব্যাপারটা মুহূর্তের মধ্যে সকলের গোচরীভূত হয়ে যায়।
.
০৩.
অতঃপর সাধন দত্ত নিমন্ত্রিতদের মধ্যে যাঁরা ঐ সময় সুসীমের গৃহে উপস্থিত ছিলেন একে একে তাদের সকলকেই ডেকে ব্যাপারটা সম্বন্ধে আর কেউ কিছু জানেন কিনা জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন।
কিন্তু কারো কাছ থেকেই বিশেষ কোন সংবাদ পাওয়া গেল না। এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল, কেউই বড় একটা সুনন্দাকে লক্ষ্য করেন নি।
মাত্র দুজন ছাড়া।
বিষ্ণু দে আর বিশাখা চৌধুরী।
বিষ্ণু দে ওদের মানে সুসীমদেরই এক বন্ধু। তিনিও সুনন্দাকে চিনতেন। আর বিশাখা চৌধুরী শ্রাবণী, সুসীম ও মৃণালের বান্ধবী। বিশাখাও চিনতো সুনন্দাকে তবে কোন ঘনিষ্ঠ পরিচয় তার সুনন্দার সঙ্গে ছিল না নাকি।
প্রশ্ন করে জানা গেল, বিশাখা চৌধুরী নাকি দুর্ঘটনা জানাজানি হবার প্রায় আধ ঘণ্টাটাক আগে ঐ হলঘরে কাকে ডাকতে এসে সুনন্দাকে ঐ সোফায় বসে থাকতে দেখেছিল এবং সে তখন একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছিল।
আরো একটা ব্যাপার জানা গেল ঐ সঙ্গে যে ঠিক ঐ সময়টাতেই নাকি আমন্ত্রিতদের মধ্যে কে একজন ম্যাজিসিয়ান ভদ্রলোক ঘরের মধ্যে উপস্থিত নরনারীদের নানা ধরনের চমৎকার তাসের খেলা দেখিয়ে সকলকে মুগ্ধ করে রেখেছিলেন।
পাশেই বসেছিল সুসীম ও মৃণাল। সুসীমই হঠাৎ প্রশ্ন করে, তাসের খেলা!
হ্যাঁ।
কে আবার আজ দেখাচ্ছিলেন তাসের খেলা?
বিশাখা জবাব দেয়, তা তো জানি না। তাকে চিনিও না, কখনো আগে দেখি নি। ভদ্রলোককে।
মৃণাল এবারে শুধায়, কেমন দেখতে ভদ্রলোক ছিলেন মনে আছে তোমার?
মনে আছে বৈকি। বিশাখা জবাব দেয়, ভদ্রলোককে দেখতে অনেকটা ঠিক তোমারই মতো। আমার মতো?
মৃণাল যেন বিশাখার কথায় বিস্ময়ে কেমন একপ্রকার অভিভূত হয়েই তার মুখের দিকে তাকায়।
বিশাখার কথা তখনো শেষ হয়নি। এবং মৃণাল ও উপস্থিত সকলের বিস্ময়ের আরো কিছু বাকী ছিল।
বিশাখা বলল, শুধু অনেকটা সেই ভদ্রলোক তোমার মতোই বা দেখতে বলছি কেন, তার গলার স্বরটাও মনে পড়ছে এখন যেন তোমারই মতো শুনেছিলাম।
সত্যি বলছো বিশাখা! কেমন যেন প্রায় নিশ্চুপ কণ্ঠে প্রশ্নটা করলো মৃণাল।
সত্যিই বলছি, বিশ্বাস কর। তবে পার্থক্যও কিছু ছিল বৈকি। বেশভূষাটা পর্যন্ত তোমারই মতো হলেও, তাঁর ছিল ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি ও চোখে কালো কাচের চশমা।
বিশাখার জবানবন্দীটা যেন সকলকে সত্যিই কেমন বিমূঢ় করে দেয়। ম্যাজিক দেখানোর কথাটা আরো দশ-বারোজন নিমন্ত্রিতও সমর্থন করলেন। কিন্তু সর্বাপেক্ষা আশ্চর্য যে সুসীম ব্যাপারটা ঘুণাক্ষরেও জানে না। কারণ ও-ধরনের চেহারার কোন লোকই তার নিমন্ত্রিতদের লিস্টে নাকি আজ ছিল না।
মৃণালও তাই বললে।
আর বিষ্ণু দে—তিনি বললেন, দুর্ঘটনাটা আবিষ্কৃত হবার বোধ হয় মাত্র মিনিট দশ-পনের আগে কি একটা কাজে ঐ হলঘরের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে তিনি নাকি ঠিক ঐখানে ঐ সোফার উপরে সুনন্দাকে বসে থাকতে দেখেছিলেন অন্য এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। এবং সেই ভদ্রলোকের চেহারা নাকি বিশাখা বর্ণিত সেই ম্যাজিসিয়ান ভদ্রলোকের মতোই ছিল।
অর্থাৎ যতদূর জানা যাচ্ছে ঐ বিষ্ণু দে ভদ্রলোকই সুনন্দা চ্যাটার্জীকে শেষ জীবিত দেখেন যে সময় সুনন্দা তার পার্শ্বে উপবিষ্ট একই সোফায় অনেকটা যাকে প্রায় সেই ম্যাজিসিয়ান ভদ্রলোকের মতই দেখতে তারই সঙ্গে কথা বলছিল।
সাধন দত্ত প্রশ্ন করলেন, ভদ্রলোকের চেহারাটা আপনার ঠিক মনে পড়ছে, মিঃ দে?
হ্যাঁ, বললাম তো, বিশাখা দেবী এইমাত্র যে চেহারার কথা বললেন সেই ভদ্রলোকের চেহারাটাও ঠিক তেমনি ছিল।
বিস্ময়ের ব্যাপার সন্দেহ নেই।
বিভিন্ন ব্যক্তির জবানবন্দী থেকে যা দাঁড়াচ্ছে তাতে করে এইটুকু অন্ততঃ বোঝা যাচ্ছে যে, বিশাখা দেবী ও অন্যান্য অনেকেরই বিবৃত চেহারার কোন এক ভদ্রলোক ঐ দিন ঐ উৎসবে সুসীমের গৃহে উপস্থিত ছিলেন।