হাতের টর্চটা জ্বেলেই সাধন দত্ত তখন বাথরুমের ভিতরটা দেখতে লাগলেন। ঝঝকে তক্তকে বড়লোকের বাড়ির বাথরুম। দুটো দরজা বাথরুমের, একটা ঐ হলঘরের সংলগ্ন—যে। দরজাপথে এইমাত্র সাধন দত্ত প্রবেশ করেছেন, আর দ্বিতীয় দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ। হাত ধোবার বেসিন, মিরার, দেওয়ালের গায়ে ইউরিন্যাল, কমোড সবই আছে। এমন কি সোপকেসে সাবান ও টাওয়েলও আছে।
কিন্তু বাথরুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই খুব মৃদু হলেও একটা কেমন মিষ্টি বিজাতীয় গন্ধ নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করেছিল সাধন দত্তর। নাক দিয়ে নিঃশ্বাসের সঙ্গে টেনে টেনে গন্ধটা কিসের অনুভব করবার চেষ্টা করতে করতে আলো ফেলে ফেলে এদিক ওদিক ভাল করে তাকাতে তাকাতে অকস্মাৎ কমোডটার পাশেই সাদা মতো কি একটা সাধন দত্তর নজরে পড়লো।
কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গিয়ে নীচু জিনিসটা তুলে নিতেই বুঝলেন সেটা একটা রুমাল। রুমালটা হাতে তুলে নিতেই বুঝতে পারলেন ঐ রুমালটা থেকেই সেই গন্ধটা আসছিল। মিষ্টি গন্ধ—গন্ধটা এবারে কিসের বুঝতে দেরী হলো না.সাধন দত্তর। ক্লোরোফরমের মিষ্টি গন্ধ।
রুমালটা পকেটে ঢুকিয়ে আরো কিছুক্ষণ বাথরুমটার চারিদিক ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে বাথরুম থেকে বের হয়ে এলেন সাধন দত্ত।
হলঘরে পুনরায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই ওদিককার দরজাপথে হরপ্রসাদের সঙ্গে সুসীম এসে ঘরে ঢুকলো।
আপনিই এ বাড়ির মালিক সসীম নাগ? প্রশ্ন করেন সাধন দত্ত।
হ্যাঁ।
আপনারই বৌভাতের উৎসব আজ এ বাড়িতে ছিল?
হ্যাঁ।
কিন্তু দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বসুন!
সুসীম বসলো।
সাধন দত্ত আবার প্রশ্ন শুরু করলেন।
উনি অর্থাৎ যিনি নিহত হয়েছেন তিনিও শুনলাম, হরপ্রসাদবাবুর কাছে, আজকের আমন্ত্রিতদের মধ্যে একজন ছিলেন!
হ্যাঁ।
ওঁর নাম শুনলাম সুনন্দা চ্যাটার্জী, তাই না?
হ্যাঁ।
কোথায় থাকেন উনি? এই কলকাতায়ই কি?
হ্যাঁ। তিলজলায় থাকে।
বিবাহিতা না অবিবাহিতা?
কুমারী?
হ্যাঁ।
কি করতেন উনি?
ক্যালকাটা গার্লস কলেজের ইংরাজী সাহিত্যের অধ্যাপিকা ছিলেন।
আচ্ছা উনি যে মারা গিয়েছেন, সেটা সর্বপ্রথম কে টের পায়?
প্রথমে—প্রথমে বোধ হয় জানতে পারে মৃণাল—
মৃণাল!
আমার বন্ধু। সেও আজ এখানে উপস্থিত আছে।
হরপ্রসাদবাবু, মৃণালবাবুকে একটিবার এ ঘরে ডেকে আনতে পারেন?
মৃণাল আমাদের সঙ্গেই এসেছিল, বাইরে সে দাঁড়িয়ে আছে।
ও, তাই নাকি! হরপ্রসাদবাবু, তাঁকে ডাকুন তো ঘরে।
হরপ্রসাদ বললেন, ডাকছি। কথাটা বলেই হরপ্রসাদ ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন এবং একটু পরেই মৃণালকে নিয়ে হরপ্রসাদ পুনরায় ঐ ঘরে ঢুকলেন।
ডাঃ মৃণাল সেন।
লম্বা-চওড়া রীতিমত বলিষ্ঠ চেহারা মৃণাল সেনের। এবং গায়ের রং শ্যাম হলেও চেহারায় ও চোখে-মুখে অপূর্ব একটা শ্ৰী আছে। পরিধানে শান্তিপুরী ধুতি ও আদ্দির পাঞ্জাবি। চোখে কালোমোটা সেলুলয়েডের ফ্রেমের চশমা।
আপনার নাম মৃণাল সেন?
হ্যাঁ।
কি করেন আপনি?
ও ডাক্তার। জবাবটা দিল সুধীমই।
ডাক্তার! ভ্রূ-দুটো যেন মুহূর্তের জন্য কুঞ্চিত হলে সাধন দত্তর।
আপনি শুনলাম ডাক্তার সেন সুসীমবাবুর বন্ধু!
হ্যাঁ, অনেকদিনের বন্ধু আমরা। স্পষ্ট সহজ কণ্ঠে জবাব দেয় মৃণাল।
সুনন্দা চ্যাটার্জীর সঙ্গে নিশ্চয়ই আপনারও পরিচয় ছিল, ডাক্তার সেন?
ছিল।
শুনলাম আপনিই নাকি প্রথম ব্যাপারটা জানতে পারেন?
আমি! কেমন যেন একটু থতমত খেয়ে পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে মৃণাল বলে, হ্যাঁ, আমিই–
ব্যাপারটা আমাকে ডিটেইলস্ বলবেন, ডাক্তার সেন?
অতঃপর মৃণাল যা বললো তা হচ্ছে?
নিমন্ত্রিতদের লাস্ট ব্যাচ তখন তেতলার ছাদে খেতে বসেছে। পাতে লুচি তরকারি পড়েছে, কিন্তু তখনও কেউ খেতে শুরু করে নি। কারণ যারা যারা সেই ব্যাচে বসবে, তাদের মধ্যে সকলে এসে পৌঁছায় নি আসরে।
মৃণালও ঐ লাস্ট ব্যাচে বসবে বলে ছাতে উঠে এসেছিল। এবং সুসীমই ঠেলেঠুলে তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
তুই হ্যাঁ, বসে পড় মৃণাল, আমি একবার নীচে যাই। সুসীম বলেছিল।
কেন, তুইও চল না—এই সঙ্গে বসে যাবি!
না রে, এখনো দেখছি কেউ কেউ আসেন নি—
তুইও যেমন! রাত কত হয়েছে জানিস? আর কেউ আসবে না, চল!
না। তুই হ্যাঁ, আমি আরো আধঘণ্টা দেখি।
মৃণাল অতঃপর উপরে চলে যায়। এবং ছাতে যেখানে খাওয়ার জায়গা হয়েছিল সেখানে পৌঁছে হঠাৎ এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে সুনন্দার কথা মনে পড়ে।
সুনন্দা তো কই তখনো খায় নি!
মৃণাল নীচে নেমে আসে সুনন্দাকে খোঁজবার জন্য। কারণ মৃণালকে সুনন্দা বলেছিল ফিরবার পথে যেন সুনন্দাকে সে সঙ্গে নিয়ে তার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যায়। কারণ সুনন্দার নিজের গাড়িটা সেদিন কারখানায় দেওয়ায় তাকে নাকি ট্যাক্সিতে আসতে হয়েছিল।
মনে পড়ে সুনন্দাকে সে ঘণ্টাখানেক আগে হলঘরের আলমারিগুলোর সামনে একটা সোফার উপরে বসে থাকতে দেখে শুধিয়েছিল, কি ব্যাপার, এখানে যে এভাবে দল ছেড়ে চুপচাপ বসে!
সুনন্দা জবাব দিয়েছিল, এমনি।
মনটা কেমন করছে বুঝি?
কেন?
মৃদু হেসে মৃণাল বলেছিল, না এমনিই বলছি—
আশ্চর্য তোমরা মৃণাল পুরুষরা, সত্যি—
কি রকম?
নিজেদের তোমরা এমন একটা উঁচু আসনে বসাতে অভ্যস্ত–
না না—আজকে ঝগড়া নয়, খালি পিস্-সন্ধি—
সুনন্দা হেসে ফেলে।
চল, ওঠো।
কোথায়?
চল বর্মা থেকে আমাদের এক কমন ফ্রেণ্ড এসেছে, নীচে তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।