ও, এই কথা! মৃদু হাসির সঙ্গে সুনন্দার কণ্ঠ থেকে কথাটা উচ্চারিত হয়। যাক, ওসব কথা যেতে দাও। সসীম পরক্ষণেই বলে, কাল আমার বৌভাতের উৎসবে যদি আসো তো সত্যই জেনো খুশী হব।
সত্যি বলছো খুশী হবে?
সত্যি।
সত্যি?
সত্যি, সত্যি, সত্যি। আসবে কিনা বল এখন!
যাবো।
কথা দিলে?
দিলাম।
.
০২.
মাথাটার মধ্যে তখনো যেন কেমন ঝিঁঝিম্ করছিল সুসীমের। এমন সময় সুসীমের ভগ্নীপতি হরপ্রসাদ সামনে এসে দাঁড়ালেন, সুসীম!
কে? ও আপনি!
পুলিসে ফোন করে এলাম।
পুলিস!
হ্যাঁ। উই মাস্ট ইনফরম দি পুলিস! সর্বাগ্রে পুলিসকেই একটা সংবাদ দেওয়া প্রয়োজন।
হরপ্রসাদের মুখের দিকে তাকিয়ে পুনরায় ঘরের চারিদিকে তাকাতেই লক্ষ্য করলো সুসীম, ইতিমধ্যে অত বড় হলঘরটা কখন যেন একেবারে খালি হয়ে গিয়েছে।
ঘরের মধ্যে সে ও হরপ্রসাদ ব্যতীত ঐ মুহূর্তে তৃতীয় আর কোন প্রাণীই নেই। এবং সোফার উপরে উপবিষ্ট ভঙ্গিতে রয়েছে সুনন্দার মৃতদেহটা। সুনন্দা মৃত! নতুন করে যেন আবার মনে পড়লো সুসীমের, সুনন্দা মৃত! সরু সাদা একটা সিল্ক কর্ডের সাহায্যে গলায় ফাঁস দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
.
নিকটবর্তী থানা-অফিসার সাধন দত্ত যখন এসে সুসীমের গৃহে পৌঁছলেন সংবাদটা পেয়ে, রাত তখন প্রায় দেড়টা।
সমস্ত বাড়িটা তেমনি সুসজ্জিত। ঘরে ঘরে তেমনি অত্যুজ্জ্বল সব আলো জ্বলছে। প্রায়। দেড়শত আমন্ত্রিত নানা বয়েসী নারী-পুরুষে তখনো বাড়িটা ভর্তি।
শুধু থেমে গিয়েছে সানাই। আর থেমে গিয়েছে অকস্মাৎ কোন যাদুমন্ত্রবলে যেন উৎসবগৃহের সমস্ত কলহাসি, গুঞ্জন। প্রায় দেড়শ নরনারী মূক, যেন একেবারে বোবা হয়ে একতলায়। সব ভিড় করে রয়েছে। দোতলা থেকে সবাই নীচে নেমে এসেছে।
এমন কি সুসীমের সব আত্মীয়স্বজন ও নববধূ শ্রাবণী পর্যন্ত নীচে চলে এসেছে। সকলের চলচ্ছক্তি তো বটেই, জিহ্বাও যেন আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছে।
আর সুসীম—সে যেন কেমন অসহায়ের মতো নীচের হলঘরের পাশের লাইব্রেরী ঘরটার মধ্যে একাকী একটা সোফার উপরে বসে চোখ বুজে পড়ে আছে।
হরপ্রসাদই করিডোরে থানা-অফিসারের আগমন-প্রতীক্ষ্ণয় দাঁড়িয়ে ছিলেন। পুলিসের কালো রংয়ের ভ্যানটা এসে করিডোরের সামনে দাঁড়াতেই তিনি এগিয়ে গেলেন।
সাধন দত্ত ভ্যান থেকে নেমে হরপ্রসাদকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে তাঁকেই প্রশ্ন করলেন, এটাই তো সুসীম নাগের বাড়ি?
হ্যাঁ, আসুন।
কি ব্যাপার বলুন তো?
সুসীম আমার শ্যালক, আজ তার বৌভাতের উৎসব ছিল এই বাড়িতে। তার এক পরিচিতা মহিলা সুনন্দা চ্যাটার্জী আজ এখানে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। তিনিই নিহত হয়েছেন।
ডেড বডি কোথায়?
উপরের হলঘরে—চলুন।
হরপ্রসাদই সাধন দত্তকে সিঁড়ি দিয়ে দোতলার পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন আগে আগে। সাধন দত্ত তার পিছনে পিছনে সিঁড়ি অতিক্রম করে চললেন।
তা নিহত হয়েছে বলছেন?
হ্যাঁ, গলায় সরু একটা সিল্ক কর্ডের ফাঁস লাগিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে ভদ্রমহিলাকে হত্যা করা হয়েছে।
বলেন কি? ফাঁস!
হ্যাঁ।
কোন ডাক্তারকে ডেকেছিলেন?
ডাক্তার একজন এখানে উপস্থিত আছেন।
দুজন এসে উপরের হলঘরে ঢুকলেন।
মৃতদেহ পরীক্ষা করে সাধন দত্ত অস্ফুট কণ্ঠে কেবল বললেন, হাউ হরি? সত্যিই যে ফাঁস লাগিয়েই মারা হয়েছে দেখছি! কিন্তু বাড়ি-ভর্তি এত লোকের মাঝখানে এঁকে এমনি ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করা হলো, আর কেউ আপনারা ব্যাপারটা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারলেন না?
তাই তো দেখছি—অসহায় ভঙ্গিতে যেন আমতা আমতা করে কথাটা বললেন হরপ্রসাদ।
নট ওনলি মিস্টিরিয়াস—আবিলিভে টু! কিন্ত কে প্রথমে ব্যাপারটা আবিষ্কার করলেন?
তা—তা তো ঠিক জানি না। এখানে আজ যারা উপস্থিত, সম্ভবতঃ তাদেরই মধ্যে কেউ।
আজকের উৎসবে আপনাদের এ বাড়িতে এসেছিলেন হয়তো বহু লোক এবং তাদের মধ্যে সকলে নিশ্চয়ই নেই?
প্রশ্নটা করে সাধন দত্ত হরপ্রসাদের মুখের দিকে তাকালেন।
না। কারণ যাঁদের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে অনেকেই চলে গিয়েছেন। যারা এখনো আছেন তারা এক-চতুর্থাংশ হবেন—
অনেকেরই তাহলে এখনো খাওয়া-দাওয়া হয় নি?
না। এই ব্যাপারের পর—
হুঁ স্বাভাবিক। তাহলে বলতে পারছেন না—কে প্রথম ব্যাপারটা আবিষ্কার করেন?
না।
তা আপনার শ্যালক—এ বাড়ির মালিক সুসীমবাবু কোথায়?
নীচে আছে। বেচারা এমন হতভম্ব হয়ে গিয়েছে—
হবারই তো কথা। তাকে একবারটি এ ঘরে ডেকে আনবেন?
নিশ্চয়ই। আমি এখুনি ডেকে নিয়ে আসছি।
হরপ্রসাদ কথাটা বলে সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
.
সাধন দত্ত হরপ্রসাদের অনুপস্থিতিতে ঘরের চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন।
হলঘরের যেদিকটায় সোফার উপরে মৃতদেহ ছিল, সেদিকটায় চারটে প্রমাণ-সাইজের স্টীলের গডরেজের আলমারি সামান্য সামান্য ব্যবধানে পাশাপাশি দাঁড় করানো ছিল। এবং সেই আলমারিগুলোর দিকে এগিয়ে যেতেই আরো একটা ব্যাপার সাধন দত্তের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। আলমারির পিছনেই একটি সংলগ্ন বাথরুম এবং বাথরুমের দরজাটা তখনো খোলাই রয়েছে। বাথরুমটা কিন্তু অন্ধকার।
মুহূর্তকাল যেন সাধন দত্ত কি ভাবলেন, তারপরই পকেট থেকে টর্চ বের করে বাথরুমের মধ্যে প্রবেশ করতে যেতেই দরজার পাশে দেওয়ালে বাথরুমের আলোর সুইচটা তার নজরে পড়লো। হাত বাড়িয়ে সুইচটা টিপলেন, কিন্তু খুট করে একটা শব্দ হলো মাত্র, আলোটা জুললো না বাথরুমের।