দুটি কারণে। এক হচ্ছে—সুনন্দা ব্রাহ্ম, নীরেনের কাকা—যিনি অবিবাহিত এবং প্রচুর সম্পত্তির মালিক, তিনি নীরেনের বিবাহটা মেনে নিতেন না এবং বিবাহ করলে নীরেনকে তার সমস্ত সম্পত্তি থেকে তিনি বঞ্চিত করতেন। নীরেনের পক্ষে ঐ বিরাট fortuneকে অস্বীকার করার ক্ষমতা ছিল না। দ্বিতীয়তঃ, বিশাখা আর তার স্বামী আলফ্রেডের ভয়ে–
ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না তো মিঃ রায়!
আলফ্রেড, বিশাখা, সুসীম আর নীরেনের একটা চোরাই মাদক দ্রব্যের ব্যবসা ছিল। বর্মার ভিতর দিয়ে চীন ও ভারতবর্ষের মধ্যে চোরাই আফিমের কারবার চালাচ্ছিল ওরা। বেচারী সুনন্দা সে কথাটা জানতো না–
বলো কি!
হ্যাঁ। পরে অবিশ্যি কিছুদিন আগে জানতে পেরে ও চুপ করে ছিল। এদিকে সুসীম নীরেন ও সুনন্দার সম্পর্কটা জানতো না। শ্রাবণীকে বিয়ে করার কিছুদিন আগে ব্যাপারটা জানতে পেরে সুনন্দাকে যখন সে বলে তার মুখোশ সে খুলে দেবে, সুনন্দা তখন মরীয়া হয়ে সুসীমকে বলে, তাহলে সে-ও সুসীমের চোরাকারবারের ব্যাপারটা প্রকাশ করে দেবে। ওদের দুজনের মধ্যে যেদিন কথা-কাটাকাটি হয়, ঠিক সেইদিনই ঘটনাচক্রে আলফ্রেড সুনন্দার বাড়িতে তার পাশের ঘরে উপস্থিত ছিল। সে-ই তার জবানবন্দীতে সব কথা বলেছে—প্রকাশ করে দিয়েছে। আর তার মুখ থেকে সব কথা শোনবার পরই সুনন্দাকে হত্যার উদ্দেশ্যটাও আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে। একে তো নীরেনের ব্যাপার নিয়ে সুনন্দার প্রতি আক্রোশ ছিলই সুসীমের, তার উপরে ঐ চোরাকারবার—কাজেই তখন সুনন্দাকে এ পৃথিবী থেকে অবিলম্বে সরিয়ে ফেলা ছাড়া অন্য পথ আর ছিল না সুসীমের।
কিন্তু সুনন্দাকে যে সুসীমই হত্যা করেছে তার প্রমাণ?
মোক্ষম দুটি প্রমাণ আছে।
কি প্রমাণ?
প্রথমতঃ, থুজার শিশিতে সুসীমের finger-print পাওয়া গিয়েছে, আর রুমালটা—
কোন্ রুমাল?
যেটা সুসীমবাবুর বাথরুমে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন মিঃ দত্ত। সুসীমের দুটো নাম ছিল তুমি বোধ হয় জান—
দুটো নাম!
হ্যাঁ, দুটো নাম। একটা ডাকনাম, অন্যটা পোশাকী নাম। ডাকনামটা হচ্ছে নাড়ু আর পোশাকী নামটা হচ্ছে সুসীম। আর সেই নাড়ুরই আদ্যক্ষর ইংরেজী এন রুমালের কোণে লেখা! সুসীমের পরিধেয় বস্ত্র ও রুমাল ইত্যাদিতে ঐ এনই ব্যবহার করতে সে অনেকদিন ধরে। সুধা দেবীর মুখ থেকেই পরশু আমি সংবাদটা পেয়েছিলাম। সুসীম চমৎকার ভাবে সমস্ত ব্যাপারটা সাজিয়েছিল—যাতে করে নীরেনকেই পুলিস সন্দেহ করে এবং তার পক্ষেও এক ঢিলে দুই পাখী মারা হয়! অবিশ্যি আলফ্রেডের স্বীকারোক্তি না পেলে এবং সুসীম সেরাত্রে বিশাখাকে হত্যার চেষ্টা না করলে এত দ্রুত আমার মীমাংসায় পৌঁছানো সম্ভবপর হতো না। অবিশ্যি আরো একজন সুসীমকে সন্দেহ করেছিল—
কে?
সুসীমের নব-বিবাহিত স্ত্রী—
শ্রাবণী!
হ্যাঁ।
আশ্চর্য!
এতে তো আশ্চর্যের কিছু নেই ডাক্তার। নারীর ব্যাপারে নারীর মনই সর্বাগ্রে সন্দিগ্ধ হয়। শ্রাবণীও ঠিক সেই কারণেই অর্থাৎ সন্দেহ হওয়ায় কলকাতা থেকে সরে যায়।
সবশেষে কিরীটী বলছিল, বিচিত্র দুটি চরিত্র তোমাদের ঐ সুসীম আর বিশাখা! বলতে ইচ্ছা করে—যেমন দেবা তেমনি দেবী! আলফ্রেডের টাকার প্রয়োজন ছিল, কারণ সে ছিল নেশার দাস আর জুয়াড়ী—সে টাকা যোগাত সুসীম, বিনিময়ে বিশাখাকে তুলে দিয়েছিল আলফ্রেড সুসীমের হাতে।
সত্যি বলছো!
হ্যাঁ। কিন্তু বিশাখা ভালবাসত নীরেনকে—
Is it!
তাই সুনন্দার জন্য বিশাখার পক্ষে নীরেনকে পাওয়া সম্ভবপর ছিল না বলেই সুনন্দার প্রতি বিশাখার একটা আক্রোশ ছিল। সেই কারণেই ছদ্মবেশে সুসীমকে চিনতে পেরেও বিশাখা সেরাত্রে মুখ খোলে নি।
কিন্তু বিষ্ণু-বিষ্ণু কেন মুখ খোলে নি? সে কেন সব প্রকাশ করে নি?
ভয়ে। আসলে লোকটা প্রচণ্ড ভীরু—
একটা কথা, নীরেনের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল কেন সুনন্দার দুর্ঘটনার আগের রাত্রে?
কারণ এ তো সোজা কথা! সুনন্দা নীরেনদের চোরাই কারবারের ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল বলে–
কি করে?
বিশাখার একখানা চিঠিতে। আক্রোশের বশে নীরেনের প্রতি সুনন্দার মনটা বিগড়ে দেবার জন্যে মরীয়া হয়ে শেষ পর্যন্ত সে সুনন্দাকে একটা চিঠি দিয়েছিল–
তারপর?
দুজনের ঝগড়া হতে সুনন্দা বলেছিল, নীরেনের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক আর নেই। সে-ও যেন নীরেনকে লেখা তার চিঠিগুলো ফেরত দেয় এবং সেও ফিরিয়ে দেবে তাকে লেখা নীরেনের চিঠিগুলো। তারপর তাদের গোপনে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাবে। কিন্তু নীরেন চিঠি দিয়ে জানায়, সেগুলো সে ফেরত দেবে, তবে সে বিশাখার চিঠিটাও চায়। কিন্তু–
কি?
বেচারী সুনন্দা সত্যিই ভালবাসত নীরেনকে। তাই সে চেয়েছিল সুসীমের বাড়িতে এসে সুসীমের সামনেই সব কিছুর একটা মুখোমুখি মীমাংসা করে নেবে। তাই যেচে সে নিমন্ত্রণ নিয়েছিল সুসীমের। বেচারী তখন স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি, সুসীমের বাড়িতে সেরাত্রে যাওয়া মানেই মৃত্যুর ফাঁসে গলা এগিয়ে দেওয়া। কারণ সুসীমকে ফোন করার পরই সে তার plan স্থির করে ফেলে মনে মনে। অবিশ্যি সুসীম গোড়াতেই একটা মারাত্মক ভুল করেছিল
ভুল!
হ্যাঁ।
কি ভুল?
শ্রাবণীকে ঝোঁকের মাথায় হঠাৎ বিয়ে করে—
সত্যিই আশ্চর্য! মৃণাল বলে।
প্রেম আর ঈর্ষা এমন দুটি বস্তু ডাক্তার, যার মধ্যে আশ্চর্য বলে কিছু নেই। কারণ যা কিছু ঘটেছে সেরাত্রে, সব কিছুর মূলেই ছিল ঐ প্রেম আর ঈর্ষা। সবটাই সেই পঞ্চশরের কীর্তি।