আর ভাবতে পারে নি বলেই নিজে তো সুনন্দার কাছে যায়ই নি, নিমন্ত্রণের একটা চিঠি পাঠাবার কথাটা পর্যন্ত ভাবতে পারে নি, সাহস পর্যন্ত হয় নি।
কারণ সুসীমের চাইতে কে আর বেশী করে চিনত সুনন্দাকে!
মনশ্চক্ষে যেন সুসীম স্পষ্ট দেখেছিল সেই ধনুকের মতো ভ্রূ ঈষৎ উত্তোলিত করে সামনের উপরের পাটির দাঁত দুটো দিয়ে নীচের ওষ্ঠটা কামড়িয়ে ধরে ক্ষণকাল মুখের দিকে চেয়ে থেকে সুনন্দা জবাব দিচ্ছে তার স্বভাবসিদ্ধ ব্যঙ্গের ভঙ্গিতে ও কণ্ঠস্বরে, সুসীম বুঝি ভেবেছিলে দেশাচার আছে বলেই নিমন্ত্রণ করবার অধিকারটাও সকলেরই সকলকে আছে!
আজ সুসীমও ঐ কথার পর সহসা পরমুহূর্তেই কোন জবাব জুগিয়ে উঠতে পারত না নিজের ওষ্ঠে। আর সুনন্দাও তাকে কেবল এটুকু বলেই নিষ্কৃতি দিত না।
পরমুহূর্তেই বলতো, তা এসেছে যখন–সামাজিকতা আমারও করা কর্তব্য, কি বল? আমার ড্রাইভার মহীন তো তোমার বাড়ি চেনে, সেই যাবেখন লৌকিকতাটুকু সেরে আসতে। হ্যাঁ দেখো, ভুলে যেও না যেন আবার ওকে দুটো খাইয়ে দিতে!
তারপর কি আর দাঁড়াতে পারত সীম?
সেদিনকার মতোই হয়তো অসহ্য অপমানে আর হিংস্র একটা আক্রোশে—ঠিক যাকে বলে একেবারে ফেটে পড়তে সে এবং সেদিনকার মতোই ইতর বলে বের হয়ে আসা ছাড়া উপায়ই বা শেষ পর্যন্ত কি আর থাকত তার! তাই তো সে যায় নি। অথচ রীতিমত পরিচিত, স্বল্প-পরিচিত সকলকেই সুসীম নিমন্ত্রণ করেছিল তার বিবাহহাৎসবে, করেছিল অবিশ্যি দুটো কারণে।
প্রথমতঃ সে পুরুষ। সৌভাগ্যবান্ কৃতী পুরুষ। জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। অর্থে, বিদ্যায়, স্বাস্থ্যে, পরিচিতিতে—কিসে নয়?
সব দিক দিয়েই সে যখন প্রতিষ্ঠিত, তখন বয়সটা আটচল্লিশ বছর হয়েছে বলেই যে তার ভাগ্যে মনের মতো এবং দশজনকে দেখাবার মতো বৌ জুটবে না, এ কথাটা যে কত বড় মিথ্যে সেটা প্রমাণিত করার এই একটা মস্ত সুযোগ এবং দ্বিতীয়তঃ সুনন্দাকেও বুঝিয়ে দেওয়া যে সুসীমের মত স্বামী-সৌভাগ্য সুনন্দার ছিল না!
কিন্তু সত্যিই কি তাই? এ বিয়েতে কি সে মনের মধ্যে সত্যিকারের তৃপ্তি পেয়েছে? নিশ্চয়ই পায় নি। আর যাকেই ফাকি দেওয়া যাক না, নিজের মনকে তো আর ফাঁকি দেওয়া যায় না! নইলে শ্রাবণীর মতো মেয়েকে বধূরূপে পাচ্ছে জেনেও বিয়ের আগের রাত্রে কেন নিদ্রাহীন রাত্রি কেটেছিল তার?
বাসরঘরের নির্জনতার মধ্যেও কেন সে শ্রাবণীর মুখের দিকে সহজভাবে তাকাতে পারে নি? নিজের মনকে বার বার কেন বোঝাতে হয়েছে নিজেকে, আমি ঠকি নি—আমি ঠকি নি!
বধূসহ গৃহে প্রত্যাগমন করেও কেন সে ঝিম মেরে ছিল?
কিছুতেই উৎসাহ পাচ্ছিল না!
.
কাল বৌভাতের উৎসব বাড়িতে। আত্মীয়স্বজনে বাড়িটা গমগম করছিল। রাত বোধ করি তখন বারোটা বেজে গিয়েছে। অত্যন্ত ক্লান্ত বোধ করছিল সুসীম নিজেকে। শুতে যাবে এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো।
ঘরে সে-সময় কেউ ছিল না, নইলে সুসীম নিশ্চয়ই ফোনটা ধরত না। ভাগ্যে কেউ ঐ সময় ঘরে ছিল না!
একান্ত অনিচ্ছায় শিথিল হাতে ফোনের রিসিভারটা তুলে নিয়েছিল সে, হ্যালো! সসীম?
সুসীম?
পরিচিত-অত্যন্ত পরিচিত সেই নারী কণ্ঠস্বর সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা বিদ্যুৎ-তরঙ্গ বইয়ে দেয় সুসীমের শিরায় শিরায়।
সোজা হয়ে বসে সুসীম, কে সুনন্দা?
আশ্চর্য তো, তুমিই ঠিক ফোনটা ধরলে! সুনন্দার সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর পুনরায় শোনা গেল।
হ্যাঁ, আমিই।
খুব ব্যস্ত বুঝি?
না না, ব্যস্ত কি–
আজ তো তোমার কালরাত্রি, তাই না?
কালরাত্রি কথাটা প্রথমটায় ঠিক যেন বুঝতে না পেরে পুনরাবৃত্তি করে সুসীম, কালরাত্রি!
তাই তো বলে আজকের রাতটাকে?
এতক্ষণে কথাটা বুঝতে পেরে সুসীম বলে, ও হ্যাঁ!
বেহুলার স্বামীকে কালনাগিনী দংশেছিল এই রাত্রে, তাই এই রাতটাকে বলে কালরাত্রি। তা কই—আমাকে তো নিমন্ত্রণও করলে না!
তুমি—কথাটা বলতে গিয়েও যেন বলতে পারে না সুসীম।
যাই বা না যাই, চিঠিও তো একটা দিতে পারতে ডাকে—প্রজাপতি-মার্কা! বুকপোস্টে দুপয়সার ডাকটিকিটের বেশী তো কিছু আর খরচ হতো না!
সুসীম চুপ করে থাকে।
অন্য পক্ষ আবার বলে, কি, চুপ করে রইলে যে?
তারপর একটু থেমে আবার সুনন্দা বলে, বুঝতে পেরেছি—
কী?
কেন তুমি আমাকে নিমন্ত্রণ করো নি।
কেন?
আমার উপস্থিতিতে তোমার শ্রাবণী যদি সবার চোখে ছোট হয়ে যায় সেই ভয়ে। কারণ তুমি তো জানই, আমার পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব হবে না!
তার মানে?
তুমি যে—
কি?
না, থাক।
কেন, শুনিই না?
সত্যি বল তো সুসীম, তুমি যে শ্রাবণীর জীবনে চতুর্থ পুরুষ, সে কথাটা কি সত্যিই তুমি জান না?
শ্রাবণীর আমার পূর্বে আর কোন স্বামী ছিল বলে তো শুনি নি!
কি একটা কথা বললে বল তো সুসীম! বিয়ে করার পর পুরুষ নাকি বোকা হয়ে যায় শুনেছি, কিন্তু তুমি যে দেখছি বিয়ের পর এক রাত্রি বৌয়ের সঙ্গে বাস করেই বোকা হয়ে গেলে!
তাই মনে হচ্ছে বুঝি?
নিশ্চয়ই। নইলে অন্তত তুমি কি করে ভাবলে আজকের দিনে কোন কুমারী মেয়ের জীবনে তার স্বামীই একমেবাদ্বিতীয় পুরুষ!
ও, এই কথা! কিন্তু যারা আমার বিশেষ পরিচিত তারা যে তোমার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয় তাই বা ভাবছো কি করে?
মানে? গলার স্বরটা তীক্ষ্ণ ধারালো শোনালো সুনন্দার।
চমকে উঠলে যেন মনে হচ্ছে। কিন্তু সত্যি-সত্যিই এতে চমকাবার কি আছে? তুমি তো একটু আগেই বললে কোন কুমারী মেয়ের জীবনে, বিশেষ করে তেত্রিশ বছর বয়স পর্যন্তও যারা কুমারী, তাদের যদি কখনো বিয়ে হয়ই, সেই স্বামীই তার জীবনে প্রথম বা একমেবাদ্বিতীয় পুরুষ হতে পারে না!