হ্যাঁ, আপনাদের মধ্যেই একজন–
সুসীম, বিশাখা, মৃণাল ও বিষ্ণু পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। সকলের চোখেই যেন একই প্রশ্ন, কে—কে? কে হত্যা করেছে সেরাত্রে সুনন্দাকে?
কে? কে?
হঠাৎ বিষ্ণু দে চিৎকার করে ওঠে, না, না—এ torture! Unbearable torture! এ অসহ্য—অসহ্য—
থাম বিষ্ণু! তীক্ষ্ণকণ্ঠে প্রতিবাদ জানায় সুসীম, মিঃ রায় যা বলছেন তাই যদি সত্যি হয় তো কেন আমরা স্বীকার করছি না কে আমাদের মধ্যে সেরাত্রে সুনন্দাকে হত্যা করেছি? Come, speak out! মৃণাল, বিষ্ণু–-চুপ করে থেকো না, দোহাই তোমাদের—এর চেয়ে জঘন্য, এর চেয়ে কলঙ্কের ব্যাপার হতে পারে না। আমরাই আমাদের একজন প্রিয় বান্ধবীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছি–কিন্তু কেন, কেন হত্যা করেছি–
হত্যা করা হয়েছে তাকে এইজন্য যে–because she knew something!
কী জানতে পেরেছিল সে?
কিন্তু সেটা তো হত্যার উদ্দেশ্য। কি ভাবে সেরাত্রে হত্যাকারী সুনন্দা দেবীকে হত্যা করেছিল, সেই আলোচনাতেই আগে আসা যাক। কিরীটী বললে।
পাথরের মতোই যেন সবাই ঘরের মধ্যে বসে থাকে। শ্বাসরোধকারী একটা স্তব্ধতা।
কিরীটী বলতে লাগলো, হত্যাকারী দুঃসাহসী নিঃসন্দেহে। প্রচণ্ড risk-ও নিয়েছিল সে এবং successfulও হয়েছিল। তবু—তবু সে দুজনার চোখকে ফাঁকি দিতে পারে নি। ছদ্মবেশ নেওয়া সত্ত্বে।
ছদ্মবেশ! মৃণাল প্রশ্ন করে।
হা ছদ্মবেশ। সব কিছুই আমি explain করবো। রাত দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে সেরাত্রে সরবতের সঙ্গে মরফিন প্রয়োগ করে নেশাগ্রস্ত সুনন্দাকে কৌশলে বাথরুমের মধ্যে নিয়ে গিয়ে, ক্লোরোফরমের হুইপ দিয়ে গলায় ফাঁস পরিয়ে দিয়েছিল হত্যাকারী।
কিন্তু তা কি করে সম্ভব? মৃণালই পুনরায় প্রশ্ন করে।
বুঝতে পেরেছি তুমি কি বলতে চাও। ফাস দেওয়ার পরে তাকে বাথরুম থেকে বের করে এনে সোফার ওপরে বসিয়ে নিজে তার পাশে বসে হত্যাকারী ফাঁসটা টাইট করে দেয়। ঘুমে। তখন মরফিনের ও ক্লোরোফরমের ক্রিয়ায় ঢলে পড়েছে সুনন্দা–প্রতিবাদ জানাবার বা চিৎকার করবারও বেচারীর তখন আর কোন ক্ষমতা ছিল না।
তবে কি—
হ্যাঁ মৃণাল, বিষ্ণু দে ও বিশাখা দেবী সেরাত্রে সুনন্দার পাশে বসে যে ব্যক্তিটিকে তার সঙ্গে কথা বলতে দেখেছিলেন—সে-ই সুনন্দার হত্যাকারী। এবং সুনন্দা was dead at that time–
না, না—তা কেমন করে হবে! আমি যে তার পরেও তার সঙ্গে কথা বলেছি কিরীটী! মৃণাল বলে।
না, তুমি কথা বললেও তার কোন জবাব পাও নি। কঠিন কণ্ঠে কিরীটী বলে, it was a deliberate lie-মিথ্যা, সে তখন already মৃত—নিহত! তাই আমি বলেছিলাম সেদিন, সবাই তোমরা তোমাদের জবানবন্দীতে মিথ্যা কথা বলছো!
সবাই স্তব্ধ, নির্বাক।
কিরীটী আবার বলে, তুমি, বিষ্ণুবাবু, বিশাখা দেবী–বলুন, বলুন বিষ্ণুবাবু চিনতে পারেন নি সেদিন আপনি সুনন্দা দেবীর পার্শ্বে উপবিষ্ট ব্যক্তিটিকে? বিশাখা দেবী, আপনি চিনতে পারেন নি?
বিশাখা যেন হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগিণীর মতো চেঁচিয়ে উঠে প্রতিবাদ করে, না, না, না–পারি নি—পারি নি–
পেরেছেন! You did!
না–না—না—
হ্যাঁ পেরেছেন, বলুন–বলুন সে কে? বলতে আপনাকে হবেই বিশাখা দেবী। আর সেরাত্রে বাথরুমের মধ্যেও যাকে দেখেছিলেন, তাকেও আপনি চিনেছিলেন। কেন বুঝতে পারছেন না আপনি, আপনি সেরাত্রে তাকে চিনতে পেরেছিলেন বলেই গতরাত্রে আপনাকে হত্যাকারী আক্রমণ করেছিল–
না, না, না—তবু চেঁচাতে থাকে বিশাখা।
কঠিন ঋজুকণ্ঠে এবারে কিরীটী বলে, চিনতে পারেন নি–সুসীমবাবুকে আপনি চিনতে পারেন নি এখনো বলছেন?
সুসীম!
মৃণালের কণ্ঠ থেকে যেন একটা অস্ফুট আর্তনাদ বের হয়ে এলো।
হ্যাঁ, সুসীমবাবুই।
কথাটা বলেই কিরীটী পুনরায় বিষ্ণু দের দিকে ফিরে তাকিয়ে কঠিন কণ্ঠে বলে, বিষ্ণুবাবু, সেরাত্রে কার কাছ থেকে আপনি সুনন্দা দেবীর জন্য সরবৎ চেয়ে এনেছিলেন?
আমি!
হ্যাঁ।
বিশাখা দিয়েছিলো—
বিশাখা দেবী, কথাটা কি সত্যি?
বিশাখা জবাব দেয় না।
তার মাথাটা তখন প্রায় বুকের কাছে ঝুলে পড়েছে।
.
১৮.
হ্যাঁ, সুসীমবাবুই।
পরের দিন মৃণালের বাসায় বসেই বলছিল কিরীটী, সুসীমবাবুই যে সেরাত্রে সুনন্দা দেবীকে হত্যা করেছেন, সেটা আমার মনই বলেছিল। কারণ তার মতো সুনন্দা দেবীকে হত্যা করার সুযোগ সেদিন ঐ উৎসবের বাড়িতে আর কারো ছিল না। কিন্তু হত্যা করবার কারণ বা উদ্দেশ্যটা তখনো আমি খুঁজে পাই নি। এবং উদ্দেশ্যটা যে মুহূর্তে আমি খুঁজে পেলাম, সেই মুহূর্তেই ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু উদ্দেশ্যটা কি? সুনন্দাকে তার মতো কেউ তো ভালবাসত না! মৃণাল বললে।
কথাটা মিথ্যা নয়। কিন্তু যে মুহূর্তে তিনি জানতে পেরেছিলেন, সুনন্দা তাঁকে নিয়ে শুধু খেলাই করে এসেছে দীর্ঘদিন ধরে সেই হতাশা আর পরাজয়ের অপমান তাকে উন্মাদ করে তুলেছিল।
খেলাই করে এসেছে সুনন্দা তাকে নিয়ে!
হ্যাঁ ডাক্তার–নির্মম খেলা। কারণ সুনন্দা ভালবাসত সত্যিকারের—
কাকে?
নীরেন সেনকে। আর নীরেনের সঙ্গে তার বিবাহও হয়ে গিয়েছিল এক বছর পূর্বে।
সে কি!
রেজিস্টারার্স অফিসে খোঁজ নিলেই ব্যাপারটা তুমি জানতে পারবে ডাক্তার—
কিন্তু এটা তো বুঝতে পারছি না কিরীটী, সে-কথাটা কেন তবে তারা গোপন করে রেখেছিল!