ঘরের দরজাটা ভেজানোই ছিল। সহসা একটা মৃদু শব্দ কানে আসতেই দরজাটার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে যেন স্তব্ধ হয়ে গেল সুসীম।
ধীরে ধীরে দরজার পাল্লা দুটো খুলে যাচ্ছে।
কে-কে ওখানে?
দরজাটা একেবারে খুলে গেল, মৃণাল এসে এদিক-ওদিক ভীত শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে ঘরের মধ্যে ঢুকলো। এবং ঢুকেই দরজাটা ভিতর থেকে ভেজিয়ে দিল।
কি ব্যাপার মৃণাল, এত রাত্রে?
ওষ্ঠের উপর আঙুলের সঙ্কেতের ইশারা জানিয়ে নিম্নকণ্ঠে মৃণাল বললে, চুপ!
কি হয়েছে কি?
আমি—আমি ভুল করেছি সুসীম—
ভুল!
হ্যাঁ, ভুল–কিরীটীকে এই ঘটনার মধ্যে টেনে নিয়ে এসে।
কিন্তু–
আজ দুপুরে সে আমার ওখানে এসেছিল। তার কথাবার্তায় বুঝলাম—
কি–কি বুঝলে? উৎকণ্ঠায় যেন ভেঙে পড়ে সুসীমের গলার স্বর।
সুনন্দার হত্যার ব্যাপারে সে আমাকেই সন্দেহ করছে। কিন্তু তুমি তুমি তো জান। সুসীম—
আমি—আমি কি জানি?
সুনন্দাকে আমি ভালবাসতাম সত্যি এবং আমার চাইতেও সে তোমাকে ভালবাসে জেনে আজ আর অস্বীকার করবো না, আক্রোশও হয়েছিল আমার প্রচণ্ড তার ওপরে, হত্যাই তাকে আমি করতে চেয়েছিলাম কিন্তু সুনন্দার ঘরে যে চিঠি পাওয়া গিয়েছে, সে চিঠি আমি লিখি নি—
কে বলেছে সে চিঠি তুমি লিখেছো?
কিরীটী।
ননসেন্স! ওটা একটা হামবাগ! বোস বোস তুমি।
ঠিক সেই মুহূর্তে ভেজানো দরজাটা পুনরায় খুলে গেল। এবং ঘরে প্রবেশ করলো বিষ্ণু দে।
এ কি! বিষ্ণু, তুমি এত রাত্রে? সুসীম প্রশ্ন করে।
কেন, তুমিই তো রাত এগারটায় কি জরুরী ব্যাপারে আমাকে এখানে আসতে বলেছে সুসীম!
আমি তোমাকে আসতে বলেছি! কই না তো!
বাঃ রে, তুমি ফোনে বললে, তুমি জান সুনন্দাকে কে হত্যা করেছে–কিন্তু তুমি বিশ্বাস করা সুসীম, আমি তাকে হত্যা করি নি। তবে–
কি? বিষ্ণুর মুখের দিকে তাকায় সুসীম।
রাত ঠিক দশটায় সে-রাত্রে আমি সুনন্দাকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা সরবৎ এনে দিয়েছিলাম—
সরবৎ এনে দিয়েছিলে?
হ্যাঁ।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বিষ্ণু বলতে থাকে, সে সরবৎটা শেষ করে আমাকে বলেছিল, আমার সঙ্গে নাকি তার কি কথা আছে। কিন্তু গ্লাসটা রেখে ফিরে আসতে আমার কয়েক মিনিট দেরি হয়েছিল, এসে দেখি সে হলঘরে নেই—
তুমি-তুমি তাকে সে-রাত্রে সরবৎ খাইয়েছিল বিষু? মৃণাল শুধায়।
হ্যাঁ, হ্যাঁ—কিন্তু সে সরবতের মধ্যে কিছু ছিল না, আমি হলফ করে বলতে পারি।
তোমার কথাটা কিরীটী রায় বিশ্বাস করবে ভাবো
মৃণালের কথা শেষ হলো না। দরজা ঠেলে এসে ঘরে ঢুকলো বিশাখা, এই যে বিষ্ণু তুমি-তুমি কিরীটী রায়কে বলেছে যে আমি সেরাত্রে সুনন্দাকে হত্যা করেছি!
ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হয়েছে সহসা।
একটা পাষাণভার স্তব্ধতা।
আমি বলেছি! বিষ্ণু কোনমতে শুধায়।
হ্যাঁ, হ্যাঁ—তুমি—
বিশাখার কথা শেষ হলো না, হঠাৎ ঘরের মধ্যে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি নারী-কণ্ঠস্বর যেন কোন অদৃশ্য অলক্ষ্য থেকে ভেসে এলো, হ্যাঁ তুমি—তুমিই হত্যা করেছে সুনন্দাকে বিশাখা!
কে? কে? কে?
একসঙ্গে সকলেই চিৎকার করে ওঠে।
কে–কে ও কথা বললে?
কিন্তু কোথায় কে, কেউই তো নেই ঘরে!
অকস্মাৎ সঙ্গে সঙ্গেই যেন একটা ভয়ের অনুভূতি সকলের মেরুদণ্ড দিয়ে শির শির করে বয়ে যায়।
সকলেই ওরা পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকায় কি এক অসহায় আতঙ্ক-বিহ্বল দৃষ্টিতে। ঠিক সেই মুহূর্তে আবার যেন অলক্ষ্য থেকে সেই অচেনা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো স্পষ্ট, সুসীম, মৃণাল, বিষ্ণু, বিশাখা—এত তাড়াতাড়ি আমাকে তোমরা ভুলে গেলে! আমি কে, তাই না? আমি সুনন্দা-সুনন্দা–
কথাগুলো শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা সুমিষ্ট হাসির লহরী যেন ঘরময় ছড়িয়ে পড়লো।
আতঙ্কিত দৃষ্টি নিয়ে ওরা একে অন্যের মুখের দিকে তাকায় আবার। ঘরের মধ্যে সব কটি প্রাণীই যেন একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছে।
টুক…টুক…টুক…
ঘরের ভেজানো দরজার গায়ে মৃদু নক পড়লো।
এবং ভেজানো দরজার ওপাশ থেকে কিরীটীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ভিতরে আসতে পারি সুসীমবাবু?
বাকশক্তি ওদের সকলের তখন যেন একেবারে এতটুকুও অবশিষ্ট নেই।
কেউ সাড়া দেয় না। সবাই যেন বোবা।
ধীরে ধীরে কিরীটী ও সাধন দত্ত ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন।
নমস্কার। এই যে আপনারা সকলেই দেখছি এখানেই জমায়েত হয়েছেন! ভালোই হলো–we can have a frank discussion amongst ourselves!
বাধা দিয়ে কিরীটীকে সাধন দত্ত বললেন, কিন্তু কর্তব্যটা চুকিয়ে নিলে হতো না আগে মিঃ রায়?
একটু অপেক্ষা করুন মিঃ দত্ত। তারপরই মৃণালের দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, মিঃ দত্ত এসেছেন সুনন্দা চ্যাটার্জীর হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করতে–
সুনন্দার হত্যাকারী!
হ্যাঁ, ডাক্তার। এভাবে আজ এই রাত্রে এইখানে তোমাদের সকলকে এই ঘরে একত্রিত করার মূলেও ছিল ওঁর কৌশল। It is not an accident! কারণ উনি চেয়েছিলেন সকলের সামনে থেকেই হত্যাকারীর মুখোশ খুলে দিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবেন আজ এখান থেকে–
আমাদের মধ্যে থেকে! সুসীমই এবারে প্রশ্নটা করে।
হ্যাঁ সুসীমবাবু, প্রমাণিত হয়েছে যে এই মুহূর্তে এখানে আপনারা যে চারজন উপস্থিত আছেন, তারই মধ্যে একজন সেরাত্রে সুনন্দা দেবীকে হত্যা করেছেন।
আমাদের মধ্যেই একজন?
কথাটা বলে সুসীম যেন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে কিরীটীর মুখের দিকে।