সে কি! চমকে প্রশ্ন করে মৃণাল।
হ্যাঁ ডাক্তার। মরফিনের সাহায্যে তাকে কিছুটা আধো ঘুমন্ত আধো জাগ্রত অবস্থার মধ্যে
এনে পরে তার গলায় হত্যাকারী ফাঁস লাগিয়েছে। ফাঁস দেবার মুহূর্তে অবিশ্যি হত্যাকারী আরো কিছুটা কসাস হয়েছিল একটা ক্লোরোফরমের হুইপ দিয়ে।
সকলেই স্তব্ধ হয়ে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কিরীটী বলতে থাকে, হত্যাকারী যে শুধু কসাই ছিল তাই নয়, রসিকও বটে!
রসিক!
হ্যাঁ ডাক্তার, রসিকজন। হোমিওপ্যাথরা শুনেছি থুজা ঔষধের সাহায্যে unwanted, undesirable growthকে ধ্বংস করেন, এক্ষেত্রে হত্যাকারী থুজার শিশিতে ক্লোরোফরম এনে বোধ হয় সেই কথাটাই বলতে চেয়েছিল। তোমরা হয়তো হত্যাকারীর রসিকতাটা ধরতে পারো নি মৃণাল, কিন্তু তার জন্য আক্ষেপের কারণ নেই, কারণ সে রসের সন্ধানটা যখন আমি অন্তত পেয়েছি, সে-সব কথা—যাক কারণ যথাসময়েই সব কিছুর ব্যাখ্যা আমি সকলের কাছে করবো, এখন যে জিজ্ঞাস্যগুলো আপনাদের কাছে আমার আছে সুসীমবাবু, সেগুলোই শেষ করে নেওয়া যাক।
পূর্ববৎ কিরীটীর মুখের দিকেই সকলে তখনো চেয়ে আছে যেন বোবা দৃষ্টিতে।
কিরীটী বলে, ময়নাতদন্ত থেকে জানা গিয়েছে সম্ভবত রাত এগারটা থেকে সোয়া এগারটার মধ্যেই সুনন্দা চ্যাটার্জী নিহত হয়েছিলেন। ডাক্তার তুমিই প্রথম বল, ঠিক ঐ সময়টাতে তুমি সেরাত্রে কোথায় ছিলে এবং কি করছিলে?
আমি!
হ্যাঁ, মনে করে বল। মানে সুনন্দা চ্যাটার্জীর মৃত্যুর ব্যাপারটা জানাজানি হবার আধঘণ্টা পূর্বে–
আমি তখন ওপরের ছাতে নিমন্ত্রিতদের খাওয়ার তদারক করছিলাম।
কেউ তার সাক্ষী আছে?
সাক্ষী!
হ্যাঁ, witness—কারণ তা না-হলে তুমি যে সত্য কথা বলছো তার প্রমাণ হবে কি করে?
কেন সুসীম—সুসীমই তো জানে। সে-সময় সে একবার ছাতে গিয়েছিল।
কথাটা কি সত্য সুসীমবাবু? সুসীমের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে কিরীটী।
সত্যি। মৃদুকণ্ঠে সুসীম বলে।
তারপরই বোধ হয় ডাক্তার তুমি নেমে এসেছিলে নীচের হলঘরে তোমার বান্ধবীকে ডাকতে!
হ্যাঁ।
আচ্ছা রাত দশটা থেকে পৌনে এগারটার মধ্যে তুমি কোথায় ছিলে?
সে সময় আমি—আমি বোধ হয় হলঘরেই ছিলাম—
হলঘরে সে-সময় কাকে কাকে তুমি দেখেছো?
অনেকেই ছিল। তার মধ্যে বিষ্ণুকেও আমি দেখি—
বিষ্ণুবাবুকে তুমি দেখেছিলে?
হ্যাঁ, বিষ্ণু তখন সোফায় উপবিষ্ট সুনন্দার সঙ্গে দাঁড়িয়ে বোধ হয় কথা বলছিল—তাই না বিষ্ণু?.
বিষ্ণুর মুখটা যেন সহসা ঐ কথায় কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যায়, সে আমতা আমতা করে বলে, আমি—কই আমি তো–
বাঃ, মনে নেই তোমার! তারই কিছুক্ষণ পরে তো তুমি হরপ্রসাদবাবুকে হলঘরের সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলছিলে, তোমার মাথাটার মধ্যে যেন কেমন করছে—
হ্যাঁ, হ্যাঁ—মনে পড়েছে বটে, ঠিক কেমন যেন আমার তখন শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। বোধ হয় ভিড়ে আর গরমে—
গরমে নয় বিষ্ণুবাবু, তখন অন্য কারণে আপনার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল!
সকলেই কিরীটীর কথায় চমকে যেন তার মুখের দিকে তাকায়। কিন্তু কিরীটী যেন খেয়ালই করে না ব্যাপারটা। সে পুনরায় বিষ্ণু দে-কেই প্রশ্ন করে, মিঃ দে, বিশাখা দেবীর সঙ্গে আপনার কতদিনের পরিচয়?
তা বছর চার-পাঁচ হবে—
আর সুনন্দা দেবীর সঙ্গে?
ঐ রকমই হবে।
সুসীমবাবু, আপনার বিশাখা দেবীর সঙ্গে কতদিনের পরিচয়?
বছর বারো-তেরো হবে। তারা একসময় আমাদের প্রতিবেশী ছিল।
তাহলে সুনন্দা দেবীর আগেই বিশাখা দেবীর সঙ্গে আপনার পরিচয় ছিল?
হ্যাঁ।
আচ্ছা মিঃ নাগ, বিশাখা দেবী ও আলফ্রেড ঘোষের বিবাহ-বিচ্ছেদ আজও হয় নি কেন বলতে পারেন?
না।
যাকগে ওদের কথা, এবারে যে নির্দিষ্ট সময়টা সম্পর্কে একটু আগে ডাক্তার সেনকে প্রশ্ন করলাম, তখন আপনি কোথায় ছিলেন–কি করছিলেন?
আমি তো কখনো বেশীক্ষণ এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকি নি। একবার ওপরে, একবার নীচে—সারা বাড়িময় আমাকে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। তাই আপনি যা প্রশ্ন করেছেন তার উত্তর এখন ঠিকভাবে বলা আমার পক্ষে তো সম্ভব নয় মিঃ রায়! সুসীম জবাব দেয়।
তা তো ঠিকই। আপনি যখন সে-রাত্রের উৎসবের ছিলেন হোস্ট। আচ্ছা রাত ঠিক দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে আপনি সেরাত্রে কোথায় ছিলেন মনে করে বলতে পারেন?
মৃদু হেসে সুসীম এবারেও বলে, না।
কিরীটী অতঃপর কিছুক্ষণ যেন কেমন গুম হয়ে বসে থাকে।
তারপরই হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে উঠে বলে, আমি চললাম। কিন্তু একটা কথা যাবার আগে বলে যেতে বাধ্য হচ্ছি ডাক্তার, তোমরা কেউ আমার প্রশ্নের জবাবে সত্য যা তা বললে না!
কি বলছো কিরীটী? মৃণাল বলে।
ঠিকই বলছি, সত্য বলে নি। কারণ তোমাদের সকলের মনেই পাপ আছে।
পাপ!
হ্যাঁ, পাপ। কিন্তু সে পাপের হাত থেকে নিষ্কৃতিও পাবে না কেউ জেনো। গরল যেমন মানুষের সমস্ত দেহ জুড়ে একদিন ফুটে ওঠে বীভৎস ভয়ঙ্কর হয়ে—পাপও ঠিক তেমনি চাপা থাকে না—চাপা দেওয়া যায় না।
কথাগুলো বলে কিরীটী আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না, ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
.
১৭.
পরের দিন রাত্রি প্রায় তখন এগারোটা।
আগের দিনই দ্বিপ্রহরে শ্রাবণী শিলং রওনা হয়ে গিয়েছে। হরপ্রসাদ ও সুধা দেবীও পাটনা রওনা হয়ে গিয়েছেন ঐদিন। অত বড় বাড়িটায় একা ছিল সুসীম। বাড়িটা যেন একেবারে নিঝুম।
এতকলার লাইব্রেরী ঘরে বসে একটা বই পড়ছিল সুসীম।