মৃণাল উঠে পড়লো কিরীটীকে ফোন করতে।
.
১৫.
বিষ্ণু দের মনটা অত্যন্ত বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল। মনের মধ্যে উৎসবের সেই রাতটার কথাই বার বার যেন ভেসে উঠছিল।
উৎসবের আনন্দের মধ্যে সুনন্দার আকস্মিক মৃত্যুটা এবং সমস্ত ঘটনার নাটকীয় বীভৎসতাটা আজো সে যেন ভুলতে পারছে না।
দিল্লীতে তার যাবার কথা ছিল আরো কয়েকদিন পরে, কিন্তু এক মুহূর্তও সে যেন আর টিকতে পারছিল না কলকাতা শহরে।
পরের দিনই তাই সে কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
কিন্তু দিল্লীতে গিয়েও স্বস্তি পায় নি এক মুহূর্ত বিষ্ণু।
সর্বক্ষণ যেন সেই দুঃস্বপ্নটা জাগরণে ও নিদ্রায় তাকে তাড়া করে নিয়ে ফিরেছে। সুনন্দার সঙ্গে পরিচয় ছিল বটে বিষ্ণুর, কিন্তু সসীম বা মৃণালের মতো ঘনিষ্ঠতা ছিল না। নিঃসন্দেহে ভাল লাগতো সুনন্দাকে বিষ্ণুর, কারণ সুনন্দার ছিল একটা বিচিত্র আকর্ষণ। যে আকর্ষণকে বিষ্ণু দে কেন, অনেকেই কাটিয়ে উঠতে পারে নি। সে-ও কাটিয়ে উঠতে পারে নি। সুনন্দাকে মনে মনে হয়তো কিছুটা ভালবেসেছিল বিষ্ণু—তাই সে সুনন্দার নিষ্ঠুর মৃত্যুতে আঘাত পেয়েছিল মনে।
দিল্লীতে বসে কয়েকদিন ধরে বিষ্ণু অনেক ভেবেছে, কে সুনন্দাকে অমন করে হত্যা করলো! কিন্তু ভেবে-ভেবেও কোন কূলকিনারা পায় নি ব্যাপারটার।
মৃণাল ঘরে ফিরে এসে বললে, কিরীটী এখুনি আসছে।
তার পরের আধঘণ্টা সময় যেন ওদের একটা বিচিত্র স্তব্ধতার মধ্যে অতিবাহিত হয়।
সকলের মধ্যেই একটা বিশেষ উত্তেজনা যেন পরিলক্ষিত হয়, অথচ কেউ কিছু বলছে না। মধ্যে মধ্যে এ ওর মুখের দিকে তাকায়। কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ করে তিনজনই।
প্রত্যেকেই যেন ভাবছে তখন।
.
মৃণালও ভাবছিল সুনন্দার কথাটাই। এবং গত কদিন ধরে সর্বক্ষণই প্রায় সে ভাবছিল বুঝি সুনন্দার কথাটা।
সুনন্দার মৃত্যুর ব্যাপারটা সত্যিই তাকে যেন বিস্ময়াবিভূত করে দিয়েছে।
কিরীটী স্পষ্টাস্পষ্টি তাকে মুখে কিছু না বললেও তার হাবভাব কথাবার্তা সব কিছুর মধ্যেই যেন মৃণালের মনে হয়েছে, কিরীটী তাদের কবন্ধুকে কেমন একটু সন্দিগ্ধভাবেই দেখতে শুরু করেছে।
সত্যিই তো–সন্দেহ হবারই তো কথা!
তাদের সকলের সঙ্গেই যখন ছিল সুনন্দার এতদিনকার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ও পরিচয়, তখন কতকটা স্বাভাবিকভাবেই তো তাদের উপরে সন্দেহ এসে পড়তে পারে।
তারপর নীরেনের ব্যাপারটা।
নীরেন তাদের এমন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল, অথচ তারা কেউ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে নি কখন ইতিমধ্যে তার ও সুনন্দার মধ্যে পরিচয় ঘটলো এবং সেই পরিচয় ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হলো। এবং সুনন্দার আকস্মিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে, সুনন্দার ঘরের টেবিলের টানার মধ্যে নীরেনের চিঠিগুলো ঐভাবে আবিষ্কৃত না হলে হয়তো ব্যাপারটা আজও ওরা জানতে পারতো কিনা সন্দেহ।
বিশাখা অবিশ্যি ওদের ঘনিষ্ঠতার ব্যাপারটা জানত, কিন্তু কই বিশাখাও তো এতদিন ওদের কিছু জানতে দেয় নি! বিশাখারই বা ব্যাপারটা গোপন করার কি কারণ থাকতে পারে? যতদূর মনে হয়, বিশাখা হয়তো ইচ্ছা করেই ব্যাপারটা গোপন করে গিয়েছে!
কিন্তু কেন? বিশেষ করে বিশাখা যখন অমন তীব্রভাবে সুনন্দাকে ঘৃণা করতো!
আশ্চর্য বিশাখার সুনন্দার প্রতি এতটা ঘৃণার ব্যাপারটাও এতদিন জানত না মৃণাল!
কখন কোন প্রসঙ্গেই কথাটা সে ইতিপূর্বে প্রকাশ করে নি!
সেদিন বিশাখার মুখে আচমকা কথাগুলো শুনে মৃণালের তাই বুঝি বিস্ময়ের অবধি ছিল। সে যেন চমকে উঠেছিল বিশাখার মুখে কথাগুলো শুনে। কিন্তু কেন যে এই তীব্র ঘৃণা, সেটাই এখন পর্যন্ত ভেবে কিছু পায় নি মৃণাল।
কি এমন কারণ থাকতে পারে বিশাখার সুনন্দার প্রতি ঐ তীব্র ঘৃণার? তবে কি বিশাখাও মনে মনে নীরেনকেই ভালবাসত?
ব্যাপারটা যেন সব কিছু কেমন জট পাকিয়ে তোলে।
এতদিন জেনে এসেছে সুনন্দার মৃত্যুর পূর্বে পর্যন্ত সুনন্দা সুসীমকেই সর্বাপেক্ষা বেশী ভালবাসত, অথচ এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা আসলে তা নয়।
সুনন্দা ভালবাসত সব চাইতে বেশী নীরেনকেই। আবার এতদিন মনে হয়েছে মৃণালের, বিশাখা বুঝি এসব ভালবাসাবাসির মধ্যে আদৌ ছিল না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তা নয়, বিশাখাও বোধ হয় নীরেনকেই ভালবাসত।
কিন্তু নীরেন–নীরেন কি সে কথা জানত? চকিতে ঐ সময় একটা চিন্তা মৃণালের মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে যায়। তবে কি সুনন্দার ঐ নিষ্ঠুর হত্যার মূলে ছিল ভয়াবহ একটা কুটিল হিংসা!
শিউরে ওঠে যেন মৃণাল কথাটা মনে হতেই।
তবে—তবে কি বিশাখাই হত্যা করেছে সুনন্দাকে?
সুসীমের মনের মধ্যেও বিচিত্র চিন্তা তরঙ্গ তুলে যাচ্ছিল।
মনে হচ্ছিল তার, এর চাইতে শেষ পর্যন্ত বিয়েটা না করলেই বোধ হয় ভালো হতো।
শ্রাবণীকে বিয়ে করে সুনন্দাকে সে জব্দ করতে চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সুনন্দা মরে এখন মনে হচ্ছে সে-ই বেশী জব্দ হয়েছে। জীবনটাকে যেন আরো বিষময় করে তুলেছে তার স্ত্রী শ্রাবণী।
সে-রাত্রি থেকে শ্রাবণীর যেন অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটেছে। গতরাত্রে তো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শেষ পর্যন্ত রীতিমত একটা ঝগড়াই হয়ে গিয়েছে। শ্রাবণীর নাকি সারাটা রাত ঘুম হয় না। সর্বক্ষণ মনে হয় এক অশরীরী নারী যেন তার আশেপাশে ঘুরছে।
শ্রাবণী বলে, পারছি না—এখানে আর এক মুহূর্তও আমি টিকতে পারছি না। আমাকে তুমি এখান থেকে যেতে দাও, নচেৎ নিশ্চয়ই আমি পাগল হয়ে যাবো!