একটি জীর্ণ মলিন পিংক কালারের পর্দা ঝুলছে সেই দ্বারপথে। মেঝেতে জীর্ণ মলিন একটা কার্পেট বিস্তৃত।
সমস্ত ঘরটা জুড়ে একটা যেন ঘিঘিনে ভাব।
ঘর শুধু নয়, কিরীটী দেখছিল আলফ্রেড লোকটাও যেন অনুরূপ দেখতে।
বেঁটে গুণ্ডা প্যাটার্নের চেহারা লোকটার। মাথার চুল রুক্ষ, কাঁচায়-পাকায় মেশানো। মুখময় ছোট ছোট দাড়ি। বোধ হয় দিন-দুই ক্ষৌরি হয় নি লোকটার। তোবড়ানো গাল। টিয়াপাখীর ঠোঁটের মতো নাকটা যেন বেঁকে সামনের দিকে ঝুলে পড়েছে। রোমশ ভ্র। পরিধানে একটা স্ট্রাইপ দেওয়া স্লিপিং পায়জামা ও গায়ে জীর্ণ মলিন একটা ঝলঝলে অনুরূপ রাত্রিবাস।
বসতে পারি? সাধন দত্তই ইংরাজীতে শুধান।
বসুন।
পরিষ্কার বাংলায় জবাব দিল আলফ্রেড।
তুমি এখানে বুঝি একাই থাক মিঃ ঘোষ? সাধন দত্ত আবার প্রশ্ন করলেন।
সে খবরে তোমার কোন দরকার আছে কি অফিসার? এই আনআর্থলি আওয়ারে একজন নিরীহ ভদ্রলোকের বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটাতে এসেছো কেন সেইটুকুই সর্বাগ্রে জানালে বাধিত হবো।
নিশ্চয়ই। আমরা এসেছি একটা মার্ডার কেসের তদন্তের ব্যাপারে।
হোয়াট? কি বললে?
বললাম তো, একটা হত্যার তদন্তের ব্যাপারে—
কিন্তু–
দিন-দশেক পূর্বে ভবানীপুর অঞ্চলে একটা মার্ডার হয়, তুমি বোধ হয় সংবাদপত্রে পড়ে থাকবে মিঃ ঘোষ–
সংবাদপত্র আমি পড়ি না।
পড় না!
না।
কখনো পড়ো না?
না। যত সব মিথ্যা খবর—আর ট্রাস্ খবর!
ও। তা ভবানীপুরে দিন-দশেক আগে অধ্যাপিকা সুনন্দা চ্যাটার্জী নামে এক মহিলা নিহত হন, তাঁরই অর্থাৎ সেই কেসেরই তদন্তের ব্যাপারে এসেছি আমরা।
কয়েক মুহূর্ত অতঃপর ঘোষ যেন স্তব্ধ হয়ে থাকে।
তারপর মৃদু কণ্ঠে বলে, কিন্তু তুমি বলছো ভবানীপুর না কোথায় দিন দশেক আগে কে একজন মার্ডারড হয়েছে, তার জন্যে আমার কাছে আসবার তোমার কি প্রয়োজন হলো বুঝতে পারছি না তো!
তুমি অধ্যাপিকা সুনন্দা চ্যাটার্জীকে চিনতে না?
নো, নেভার! নেভার হার্ড দি নেম ইভেন্!
নামও শোন নি কখনো তার? প্রশ্ন করলো এবারে কিরীটীই।
সিওরলি নট! হু ইজ সী?
পরিচয় তো দিলাম একটু আগে! আবার কিরীটী বললে।
আমিও তো বললাম, জীবনে তার নামই আমি কখনো শুনি নি।
অথচ আমরা জানি, যেরাত্রে বকুলবাগান রোডে সুসীম নাগের বাড়িতে সুনন্দা চ্যাটার্জী নিহত হন, তুমি সেরাত্রে সেখানে উপস্থিত ছিলে!
আর ইউ ম্যাড? আই নেভার ইভেন্ হার্ড অফ দেম্! তাছাড়া কবে বললে, দশ দিন আগে?
হ্যাঁ, গত মোলই জুন—কিরীটী বলে।
লেট মি রিকলেক্ট! ইয়েস্ ইয়েস্, আই ওয়াজ অন ডিউটি দ্যাট নাইট!
ডিউটিতে ছিলে?
অফ্ কোর্স! ইয়েস—আই নাউ ডিসটিংকট্রলি রিমেম্বার—আই ওয়াজ অন্ ডিউটি দ্যাট নাইট!
কিন্তু আমি বলছি, ইউ ওয়্যার প্রেজেন্ট দেয়ার দ্যাট নাইট! গম্ভীর কণ্ঠে যেন কিরীটী প্রতিবাদ জানাল।
ননসেন্স! এনিথিং মোর হ্যাভ ইউ গট টু সে? ই নট, ডোন্ট ওয়েস্ট মাই টাইম! বাজ অফ—
শোন মিঃ আলফ্রেড ঘোষ, উপযুক্ত প্রমাণ আছে আমাদের কাছে যে সে রাত্রে তুমি সে বাড়িতে উপস্থিত ছিলে।
ড্যাম রট!
নো মিঃ ঘোষ, তোমার বৌ সাক্ষী দেবে—
হোয়াট? মাই ওয়াই?
কথাটা হঠাৎ শোনামাত্রই ইলেকট্রিক শক্ খাওয়ার মতই চমকে ওঠে বলে মনে হয় আলফ্রেড ঘোষ।
হ্যাঁ, তোমার স্ত্রী—বিশাখা ঘোষ।
হঠাৎ যেন কিরীটীর শেষের কথায় জোঁকের মুখে নুন পড়লো।
বিশাখা নামটা কিরীটীর মুখ থেকে উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই আলফ্রেডের মুখের চেহারাটা একেবারে সত্যি-সত্যিই কেমন যেন মুহূর্তে বদলে গেল।
কয়েকটা মুহূর্ত সে কোন কথাই অতঃপর বলতে পারে না।
তারপর একসময় আমতা আমতা করে বলে, বিশাখা!
হ্যাঁ বিশাখা ঘোষ, তোমার স্ত্রী। কঠিন কণ্ঠে কিরীটী জবাব দেয়।
কিন্তু ততক্ষণে আলফ্রেড নিজেকে সামলে নিয়েছে, হঠাৎ হো হো করে ঘর ফাটিয়ে হেসে ওঠে।
আমার ওয়াইফ! বিশাখা! ইয়েস, ওয়ান্স আপন এ টাইম দ্যাট বীচ্ ওয়াজ মাই ওয়াইফ– কিন্তু অনেক কাল আমাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে—
না। কঠিন কণ্ঠে কিরীটী জবাব দেয়, তোমাদের ডিভোর্স এখনও হয় নি।
কিরীটীর কথার সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় দপ্ করে যেন হাসির শেষ রেশটুকুও নিভে গেল আলফ্রেডের মুখের উপর থেকে।
এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো মিঃ আলফ্রেড,ঘোষ, সব কিছু সংবাদ নিয়েই আমরা এসেছি তোমার কাছে!
হ্যাঁ, না—হয় নি বটে আজো ডিভোর্স, কিন্তু কিন্তু, তার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্কই নেই, তাকে আমি সম্পূর্ণ মুক্তি দিয়েছি।
মুক্তিই যদি দিয়ে থাক তো ডিভোর্স আজো তোমাদের হয় নি কেন?
হয় নি মানে হয় নি—এমনিই হয় নি!
তাই কি? না অন্য কোন গুরুতর কারণ আছে?
কারণ! কি কারণ?
যে হাঁস সোনার ডিম দেয়, তাকে যে হত্যা করা যায় না!
কি বললে?
বলছিলাম যে হাঁস সোনার ডিম দেয়, তাকে কি হত্যা করা যায়? মিঃ ঘোষ, মাইনে তো তুমি পাও তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ সব মিলিয়ে, তাই না?
হ্যাঁ। তাহলে লয়েডস্ ব্যাঙ্কে তোমার অ্যাকাউন্টে গত তিন বছরে চোদ্দ হাজার টাকা কোথা থেকে এলো?
সে—সে আমি, মানে—আই হ্যাভ আরনড দ্যাট মানি!
আরনড! বাট হাউ? কাম-কনফেস্ এভরিথিং! গোপন করার চেষ্টা করলে জেনো বিপদই ডেকে আনবে—
আমাকে—আমাকে, মানে-হ্যাঁ, আমাকে একজন টাকাটা দিয়েছে—
কে দিয়েছে? তোমার স্ত্রী নিশ্চয়?
হ্যাঁ।
ঠিক সেই সময় সাধন দত্ত বললেন, ইউ আর আণ্ডার অ্যারেস্ট মিঃ ঘোষ!