বিষ্ণু দে আর আলফ্রেড ঘোষ। ট্রাফিক্ সুপারিনটেনডেন্ট মিঃ এলিসকে একটু আগে সে আলফ্রেড-এর বিষয়ে কাল তাকে জানাবার জন্য ফোন করে দিয়েছে।
আর বিষ্ণু দে—সে বর্তমানে কলকাতায় নেই।
দুর্ঘটনার পরের দিনই সে ইন্সুরেন্স কোম্পানির একটা জরুরী কাজে দিল্লীতে গিয়েছে। জানা গিয়েছে, সে নাকি পরশু-তরশু ফিরছে।
কৃষ্ণা এসে ঘরে ঢুকলো।
কি হলো, আজ সারাটা রাত্রি পায়চারি করেই কাটাবে নাকি?
সুনন্দা চ্যাটার্জীর হত্যার ব্যাপারে একটা মীমাংসা আমি কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না কৃষ্ণা!
মেয়েদের মন—ও যদি এত সহজেই তুমি বুঝতে! চল, রাত দুটো বাজে—শোবে চল।
চমকে ওঠে কিরীটী স্ত্রীর কথায়, বলে, কি-কি বললে? মেয়েদের মন!
হ্যাঁ, হ্যাঁ–চল।
কিন্তু কৃষ্ণা, সুসীমবাবুর সেদিনকার সব কথাও তত তোমাকে আমি বলেছি সুনন্দা চ্যাটার্জী সম্পর্কে–
তোমার সুসীমবাবুর কথা আর বলল না, আস্ত একটি গর্দভ! নইলে এত বড় ভুলটা সে কি করে করলো?
ভুল!
নয়? সুনন্দা তাকেই জেনো ভালবাসত—
তাই যদি হবে তো—
তাকে বিয়ে করলো না কেন, এই তো? কিন্তু—
কিন্তু কি কৃষ্ণা!
কৃষ্ণা মৃদু হেসে বলে, কিন্তু এখন থাক! চল তো শোবে। ঘুমে আমার চোখ ভেঙে আসছে–চল!
.
১৩.
আরো দুদিন পরে।
ফ্রি স্কুল স্ট্রীটের একটা পুরাতন ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে এসে সাধন দত্ত আর কিরীটী তার গাড়ি থেকে নামলো।
রাত তখন প্রায় সোয়া এগারটা হবে। পাড়াটা ইতিমধ্যেই যেন নিঝুম হয়ে গিয়েছে।
পুরাতন চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি। একতলায় সব দোকান। দোকানের দরজা অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। উপরে দোতলা, তিনতলা ও চারতলায় সর্বসমেত বারোটি ফ্ল্যাট।
ছোট ছোট ফ্ল্যাট। বেডরুম ও সিটিংরুম নিয়ে মাঝারি সাইজের দুখানা করে ঘর, বাথরুম, কিচেন আর সামনে এক চিলতে করে ব্যালকনি। মাঝখান দিয়ে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে বরাবর একতলা থেকে চারতলা শেষ হয়ে সেই চারতলার ছাত পর্যন্ত। নানা ধরনের ভাড়াটে এসে ভিড় করেছে ফ্ল্যাটগুলোতে। তবে বেশীর ভাগই সব ভারতীয় ক্রিশ্চান ও অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান।
রাত সোয়া এগারোটা হলেও সব ফ্ল্যাটের তখনো আলো নিভে যায় নি। হাসি গান ও বাজনার শব্দ শোনা যাচ্ছে কোন কোন ফ্ল্যাটে। অনেক দিনের পুরাতন বাড়ি, তার উপরে বোধ হয় অনেক বছর কোন সংস্কারও হয় নি।
বহু জায়গায় সিঁড়ির সিমেন্ট চটে ইট বের হয়ে পড়েছে। কাঠের রেলিংটায় যে কত ময়লা আর ধুলো, তেল আর ঘাম জমে জমে বিচিত্র এক রূপ নিয়েছে তা বলা দুঃসাধ্য! দেওয়ালের চুনকামের অবস্থাও তাই। বাড়িটার মধ্যে আলো বাতাস খুব বেশী খেলে বলেও মনে হয় না। একটা ভ্যাপসা সোঁদা সোঁদা গন্ধ সর্বত্র।
গেট খোলাই ছিল। কেবল এক পাশে একজন মুসলমান দারোয়ান খাটিয়ার উপর বসেছিল।
ওদের দেখে, বিশেষ করে সাধন দত্তর গায়ে পুলিসের ইউনিফর্ম তাকে যেন তটস্থ করে তোলে। সঙ্গে সঙ্গে খাটিয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে।
আলফ্রেড ঘোষ এই বাড়িতে থাকে? সাধন দত্তই প্রশ্ন করেন।
হ্যাঁ সাব, যাইয়ে না—তিনতল্লামে পাঁচ নম্বর ফ্ল্যাট।
সাব হ্যায়?
জী।
কিরীটী আর সাধন দত্ত সিঁড়ি দিয়ে উঠে যান।
উঠেই সোজা বাঁদিকে পাঁচ নম্বর ফ্ল্যাট। দরজার গায়ে কলিং বেল ছিল। কলিং বেলের বোতামটা টেপেন সাধন দত্ত।
একটু পরেই দরজাটা খুলে গেল। কিন্তু সম্পূর্ণ নয়—অর্ধেক খোলা দরজার ফাঁকে একটা কুৎসিত পুরুষের মুখ উঁকি দিল, হুস দ্যাট!
ভারী কর্কশ কণ্ঠস্বর।
মিঃ আলফ্রেড ঘোষ? সাধন দত্তই প্রশ্ন করেন।
ইয়েস!
মে আই কাম্ ইন্?
কিন্তু কি দরকার তোমার এত রাত্রে একজন ভদ্রলোকের কাছে, জানতে পারি কি অফিসার?
দরকার একটা আছে বৈকি মিঃ ঘোষ!
কয়েকটা মুহূর্ত ভ্ৰ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো সাধন দত্তর মুখের দিকে আলফ্রেড।
সিঁড়ির স্বল্প আলো-আঁধারে পুলিসের ইউনিফর্ম পরিহিত সাধন দত্তর মুখের দিকে তাকিয়ে বোধ হয় আলফ্রে কিছু ভাবে।
তার ঘরের দরজায় পুলিস সাধন দত্তর ঐ মুহূর্তে এসে আবির্ভূত হওয়ার ব্যাপারটা অভূতপূর্ব তো বটেই, আকস্মিকও!
এবং তাকে যে খানিকটা ধূর্ত শিকারী বিড়ালের মত সন্দেহযুক্ত করে তুলেছে, কিরীটী ঐ মুহূর্তে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে সে কথাটা বেশ বুঝতে পারে।
তবু ওরা দুজনেই অপেক্ষা করে।
কিরীটী আর সাধন দত্ত। কারণ কিরীটী বার বার করে আসবার সময় সাধন দত্তকে বলেছিল, আলফ্রেকে যেন কোনরকম হুমকি দিয়ে বা জোরজবরদস্তি করে আগে থাকতেই ভয় দেখানো না হয়।
যাই হোক, আলফ্রেড ব্যাপারটা কোন রকম অনুমান করতে পারুক আর নাই পারুক, ওদের ঘরে ঢুকতে না দেওয়া অসমীচীন ও যুক্তিযুক্ত হবে না বুঝতে পেরেই হয়ত দরজাটা সম্পূর্ণ খুলে দরজা থেকে এক পাশে সরে দাঁড়াল এবং মৃদু কণ্ঠে চাপা বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠেই
অনিচ্ছাকৃত আহ্বান জানাল, কাম!
আগে সাধন দত্ত ও তার পশ্চাতে কিরীটী ঘরে প্রবেশ করলো।
সমস্ত ঘরটা যেন অগোছাল, অপরিচ্ছন্ন।
একধারে গোটাচারেক বহু পুরাতন জীর্ণ সোফা ও সামনে তার একটা গোল টেবিল, অন্যদিকে একটা পুরাতন হ্যাট-র্যাক ও একটা বহুকালের রংচটা অর্গান বোধ হয়।
দেওয়ালে খানকতক কুৎসিত ভঙ্গির ছবিওয়ালা ক্যালেণ্ডার ঝুলছে। ঘরের মধ্যে সর্বসমেত গোটা-দুই মাত্র জানালা। মলিন জীর্ণ নেটের পর্দা দেওয়া। দুটি দরজার একটি সদর, অন্যটি বোধহয় ওপাশের ঘরে প্রবেশের মধ্যবর্তী দরজা।