কিন্তু যেজন্য এসেছিলেন বিশাখা দেবী, কই সে-সম্বন্ধে তো কিছু বললেন না!
কিছু না মিঃ রায়, আমি—আমি যাই–
পা বাড়ায় বিশাখা ঘর থেকে বের হয়ে যাবার জন্যে।
দাঁড়ান বিশাখা দেবী, শুনুন!
ঘুরে দাঁড়ালো বিশাখা কিরীটীর সে-ডাকে।
নীরেনবাবু সম্পর্কে আপনি আমাকে যা বলতে এসেছিলেন, নির্ভয়ে এবং নিঃসঙ্কোচেই আপনি আমাকে তা বলে যেতে পারেন।
বিশাখা কেমন যেন অসহায় বোবাদৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
বসুন-বসুন ঐ সোফাটায়। বিশাখা বসে পড়লো।
আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, সব কথা যদি আপনি আমার কাছে অকপটে স্বীকার করেন তো নিশ্চয়ই তাকে আমি–
মিঃ রায়!
হ্যাঁ কথা দিচ্ছি, আমি তাকে নিশ্চয়ই ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচাবো।
পারবেন—সত্যি বলছেন পারবেন?
পারবো। কিন্তু তার আগে সব কথা আপনাকে আমার কাছে স্বীকার করতে হবে।
অকস্মাৎ দুহাতে মুখ ঢেকে যেন কান্নায় একেবারে ভেঙে পড়ে বিশাখা, জানি না—আমি কিছু জানি না–কিছু জানি না–
অতঃপর মুহূর্তকাল চুপ করে থেকে কিরীটী বললে, কিছু জানেন না?
না, না, না—
বেশ, আমার কয়েকটা প্রশ্নের সত্য জবাব দিন অন্তত! সেরাত্রে কাকে আপনি দেখেছিলেন সুসীমবাবুর বাড়ির হলঘরে সুনন্দা চ্যাটার্জীর পাশে বসে কথা বলতে? বলুন, জবাব দিন?
জানি না, জানি না—চিনতে পারি নি—তাকে আমি চিনতে পারি নি—
কিন্তু আমি বলছি আপনি জানেন এবং চিনতে পেরেছিলেন তাকে। বলুন সত্যি কিনা?
না, না—
নীরেনবাবু, তাই না!
না, না—
হ্যাঁ, তিনি নীরেনবাবুই। বলুন সত্যি কিনা?
অশ্রুভেজা চোখ তুলে তাকালো বিশাখা কিরীটীর মুখের দিকে।
আর একটা কথা, আপনার স্বামী আলফ্রেড ঘোষ এখন কোথায়?
জানি না—
জানেন। বলুন তিনি কোথায়? সে রাত্রে তিনি কলকাতায় ছিলেন, তাই না?
মাথা নিচু করলো বিশাখা।
আলফ্রেড ঘোষের সঙ্গে তো আপনার কোন সম্পর্কই নেই, সত্যি কিনা?
সত্যি।
কতদিন হলো আপনাদের separation হয়েছে?
ছবছর। তা এখনো ডিভোর্স হয় নি কেন? কারণটা কি?
কারণ কিছুই নেই—
নিশ্চয়ই আছে। কি কারণ বলুন?
বলতে পারবো না—আমি বলতে পারবো না! বলতে বলতে আবার দুহাতে মুখ ঢাকলো বিশাখা।
একটু থেমে কিরীটী বললে, আপনি না বললেও আমি তা ঠিক জানতে পারবো বিশাখা দেবী—
আমি—আমি যাই—
আসুন।
বিশাখা অতঃপর সোফা থেকে উঠে টলতে টলতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
.
একটু পরেই পাশের ঘর থেকে সাধন দত্ত এসে ঐ ঘরে ঢুকলেন।
আশ্চর্য দাওয়াই বাতলেছিলেন তো মিঃ রায়! দত্ত বলেন।
মৃদু হেসে কিরীটী বলে, আশ্চর্যের কিছুই নেই এতে মিঃ দত্ত—
আশ্চর্য নয়! কি বলেন, একেবারে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসেছে!
আসবেই তো—
আপনি জানতেন ও আসবে?
জানতাম। এ যে যাকে বলে প্রাণের টান! একটু চোখ খোলা থাকলে আপনিও ব্যাপারটা বুঝতে পারতেন মিঃ দত্ত।
কি বলছেন!
হ্যাঁ তাই, আজ সকালে ওর বাড়িতে গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে যে মুহূর্তে ওর হাতের আংটিটার প্রতি আমার নজর পড়েছিল—
আংটি!
হ্যাঁ, ওর ডান হাতের অনামিকায় যে নাম মিনা করা আছে—সে নামটা হচ্ছে নীরেন।
আশ্চর্য, আপনি তাও দেখেছেন?
ভাল করে চোখ মেলে সব না দেখলে বুঝবো কি করে?
কথাটা বলে উঠে গিয়ে কিরীটী ঘরের কোণে ফোন ডায়েল করতে শুরু করে এবং নিম্নকণ্ঠে কার সঙ্গে যেন ফোনে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে।
ফোনে কথা বলা শেষ করে কিরীটী পুনরায় এসে নিজের জায়গায় বসতেই সাধন দত্ত বলেন, বিশাখা দেবীর কথাবার্তা শুনে এবারে তো আপনি মানবেন নিশ্চয়ই যে, নীরেনবাবুই সেরাত্রে সুনন্দা চ্যাটার্জীকে হত্যা করেছিলেন গলায় সিল্ককর্ডের ফাঁস দিয়ে!
তা যদি বলেন তো বিশাখাই বা হত্যাকারিণী নয় কেন?
কি বললেন?
বলছিলাম বিশাখাও তো হত্যা করে থাকতে পারে সেরাত্রে সুনন্দা চ্যাটার্জীকে। কেবল বিশাখাই বা বলি কেন, সুসীমবাবু এবং আমাদের ডাঃ সেনও সেরাত্রে সুনন্দাকে হত্যা করে। থাকতে পারে।
কিরীটীর শেষের কথায় কেমন যেন বিস্ময়ে ফ্যালফ্যাল্ করে চেয়ে থাকেন সাধন দত্ত ওর মুখের দিকে।
সুনন্দার মৃত্যুটা অত্যন্ত জটিল মিঃ দত্ত এবং হত্যাটা পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকারী অত্যন্ত কৌশলে সেরাত্রে হত্যা করলেও হত্যা করবার জন্য সে পূর্ব হতেই প্রস্তুত করেছিল নিজেকে। তারপর একটু থেমে আবার বলে, না মিঃ দত্ত, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। সুনন্দাকে হত্যার উদ্দেশ্যটা যে সেরাত্রে হত্যাকারীর কি ছিল, সেটাই এখনো আমার কাছে স্পষ্ট হয় নি। যদি একটা ব্যাপারে কারো সাহায্য পেতাম—
কি?
সুনন্দার অতীত জীবনটা যদি জানতে পারতাম! কিন্তু মৃণাল সুসীমবাবু বা নীরেনবাবু–কেউই কিছু বলবে না আমি জানি!
কথাগুলো বলতে বলতে সহসা যেন কিরীটীর কণ্ঠস্বর পরিবর্তিত হয়ে যায়, স্পষ্ট ও দৃঢ়কণ্ঠে সে বলে, কিন্তু বলতে তাদের হবেই একদিন-সব কথা বলতে তাদের হবেই!
আবার যেন সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর কণ্ঠস্বর ঝিমিয়ে আসে, কতকটা যেন আপন মনেই বলে, কিন্তু কেমন করে—কেমন করে–
ঢং ঢং ঢং। ঐ সময় দেওয়াল-ঘড়িতে রাত্রি এগারটা ঘোষিত হলো।
সাধন দত্ত বলেন, রাত এগারটা, আমি উঠলাম।
সাধন দত্ত উঠে পড়লেন।
কিরীটী তার ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিল।
সেরাত্রে দুর্ঘটনার স্থানে উপস্থিত যারা ছিল, তাদের মধ্যে বিশেষ দুটি লোকের সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়ানো এখনও তার বাকী আছে।