আমার তো মনে হয় ব্যাপারটা নিছক একটা joke-কৌতুক ছাড়া কিছুই নয়।
কি বললেন, joke-কৌতুক!
হ্যাঁ, joke-বাংলা ভাষায় যাকে কৌতুক বলে।
তার মানে?
মানেটা খুবই সহজ। আমি বলতে চাই, there was no intention behind! সেদিনকার উৎসবের মধ্যে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যেই হয়ত কেউ ম্যাজিসিয়ান সেজে খানিকটা কৌতুক-বলতে পারেন নিছক খানিকটা আনন্দ সৃষ্টি করবারই চেষ্টা করেছিলেন মাত্র। যদিচ ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত সুনন্দা চ্যাটার্জীর আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিত মৃত্যুতে ঘোরালো হয়ে ওঠায় বেচারী ম্যাজিসিয়ান হয়তো শেষ পর্যন্ত আত্মগোপন করতে এক প্রকার বাধ্য হয়েছেন।
কিন্তু–
তবে এটুকু আপনাকে বলতে পারি মিঃ দত্ত, ব্যাপারটা নিতান্তই যাকে বলে কাকতালীয়। সুনন্দা চ্যাটার্জীর মৃত্যুর সঙ্গে সত্যিই আমার মনে হয় কোন যোগ নেই। কিন্তু সে কথা যাক, আপাততঃ সব কিছু শুনে সকলের সঙ্গে কথা বলে ও অকুস্থান ঘুরে যে কথাগুলো আপনাকে আমি বলতে চাই–
কি, বলুন?
বিশাখা বিবাহিত, সে কথাটা আপনি বোধ হয় জানেন না।
সে কি? তার তো জানি বিয়েই হয় নি?
না, সে বিবাহিত। তার স্বামী হচ্ছে একজন ভারতীয় ক্রিশ্চান—আলফ্রেড ঘোষ। ইস্টার্ন রেলওয়েতে চাকরি করে—গার্ড।
সত্যি বলছেন!
তাই তো শুনলাম।
বিবাহিত—তবু নিজেকে কুমারী বলে চালাচ্ছে। এ যে রীতিমত জটিল বলে মনে হচ্ছে!
সেই জটিলতার কারণটাই তো খুঁজে বের করতে হবে আপনাকে মিঃ দত্ত!
কিন্তু কেমন করে?
সে খুব শক্ত হবে না। আগে আপনি একটা খোঁজ নিন তো!
কিসের খোঁজ নেবো?
রেলওয়ে গার্ড মিঃ আলফ্রে ঘোষ সম্পর্কে details খবরাখবরটা যোগাড় করুন তো।
বেশ।
দ্বিতীয়তঃ, প্রোমে নীরেন সেন সম্পর্কে যাবতীয় সংবাদ আপনাকে সংগ্রহ করতে হবে।
করবো। আর কিছু?
না, আপাততঃ আর কিছু নয়। ঐ সংবাদগুলো আমাকে আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন। সংগ্রহ করে দিন।
বেশ, দেবো।
হ্যাঁ, আর আগে যা বলেছি—যাবার পথেই কিন্তু সে কাজটা সেরে যাবেন মিঃ দত্ত!
.
সাধন দত্ত বিদায় নিয়ে চলে গিয়েছেন প্রায় ঘণ্টা-দুই পূর্বে।
কিরীটী সোফাটার উপরে হেলান দিয়ে চোখ বুজে ছিল। ঘরের আলোটা সাধন দত্ত চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিভিয়ে দিয়েছিল কিরীটী। জংলী এসে অন্ধকার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ালো, কিন্তু ঘর অন্ধকার থাকায় ইতস্তত করে—ডাকবে কি ডাকবে না!
কিন্তু জংলীর পদশব্দ কিরীটীর শ্রুতিগোচর হয়েছিল, সে প্রশ্ন করে, কি রে জংলী?
একজন মেয়েছেলে দেখা করতে চায়।
কিরীটী মুহূর্তকাল যেন কি ভাবলো; তারপরে মৃদুকণ্ঠে বললে, ঘরের আলোটা জ্বেলে দিয়ে এ-ঘরেই পাঠিয়ে দে তাকে।
ঘরে ঢুকে আলোটা জ্বেলে দিয়ে জংলী নীচে চলে গেল।
একটু পরেই পদশব্দ শোনা গেল ঘরের দরজার সামনে।
আসুন বিশাখা দেবী!
সত্যি, বিশাখাই ঘরে প্রবেশ করলো।
সর্বাঙ্গে একটা চাদর জড়ানো ছিল বিশাখার এবং সেই চাদরের সাহায্যেই মাথায় ঈষৎ অবগুণ্ঠন ভোলা ছিল।
বসুন বিশাখা দেবী!
বিশাখা কিরীটীর মুখোমুখি ছোট সোফাটার উপরে উপবেশন করলো।
জানতাম আপনি আসবেন, আপনার আগমন প্রতীক্ষ্ণই করছিলাম আমি এতক্ষণ।
আমি আসবো আপনি জানতেন!
জানতাম।
কথাটা বলে হঠাৎ যেন কিরীটী স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো।
বিশাখাও স্তব্ধ, কিরীটীও স্তব্ধ।
উভয়ের মধ্যখানে যেন একটা স্তব্ধতার পাষাণভার।
বেশ কিছুক্ষণ পরে বিশাখাই প্রথমে কথা বলে, কিরীটীবাবু!
বলুন?
এইমাত্র আপনি যা বললেন তা কি সত্যি?
কি সত্যি বিশাখা দেবী?
আমি যে এ-সময় আসবো আপনি জানতেন!
সত্যিই জানতাম বিশাখা দেবী। আর আপনি কেন এসেছেন তাও জানি।
জানেন?
জানি।
তারপর একটু থেমে কিরীটী বলে, থানা-অফিসার মিঃ দত্ত আপনার কাছে গিয়েছিলেন, তাই না?
হ্যাঁ, কিন্তু আশ্চর্য-আপনি জানলেন কি করে!
কারণ আমিই তাকে যেতে বলেছিলাম।
আপনি যেতে বলেছিলেন?
হ্যাঁ।
কিন্তু কেন?
সে কথা যাক, আপনি বরং যা বলতে এসেছেন বলুন।
জবাবে বিশাখা অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ করেই থাকে।
কেবল নিঃশব্দে শাড়ির আঁচলের পাড়ের একটা অংশ টেনে টেনে সোজা করতে থাকে।
কই, বললেন না?
মিঃ রায়!
বলুন?
আচ্ছা সত্যিই কি আপনি মনে করেন—
কি?
মানে বলছিলাম, নীরেনের ফাঁসি হবে!
কাউকে কেউ হত্যা করলে, প্রচলিত আইনে সেই শাস্তিই তো তার প্রাপ্য—to be hanged by neck till death!
সহসা যেন আর্তকণ্ঠে একটা চাপা উদ্বেগ প্রকাশ পায়, না, না—তা হতে পারে না! আমি বলছি নীরেন নির্দোষ—সে হত্যা করে নি! আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ রায়—
নির্দোষিতা তো তার এমনি প্রমাণিত হবে না বিশাখা দেবী, তার জন্য রীতিমত প্রমাণ চাই।
অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো বিশাখা কিরীটীর মুখের দিকে। উদ্বেগ আর আশঙ্কায় বিশাখার সমস্ত মুখখানা কেমন যেন করুণ মনে হয়।
বিহ্বল কণ্ঠে বিশাখা বলে, প্রমাণ!
হ্যাঁ, প্রমাণ। বিশাখা দেবী, নীরেনবাবুর যদি ফঁসিই হয়, তাতে আপনার কি? তিনি তো আপনার কেউই নন?
বিশাখার চোখের কোল দুটো ছলছল করে ওঠে।
উপরের পাটির দাঁত দিয়ে সে তার নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে।
কেউ নয়—সত্যিই তো, সে আমার কে? কেউ তো নয়! কথাগুলো যেন কতকটা আত্মগতভাবে বলে বিশাখা এবং দুচোখের কোল বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
তারপরই হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় সোফা থেকে বিশাখা, বলে, আমি যাই–