চুপ করেই দাঁড়িয়ে রইলো।
.
মৃত্যু মানুষের জীবনে একান্তই স্বাভাবিক ঘটনা নিঃসন্দেহে।
কিন্তু তবু সেই মৃত্যুকেই মনে হয় অস্বাভাবিক, যখন অকস্মাৎ বিনা নোটিশে এসে হাজির হয়। শুধু অস্বাভাবিকই নয়, যেন একেবারে অকস্মাৎ বিমূঢ় করে ফেলে।
সুনন্দা চ্যাটার্জীর আকস্মিক মৃত্যুটাও ঠিক তেমনি করেই বাড়ির মধ্যে অতগুলো লোককে যেন একেবারে অভিভূত, বিমূঢ় করে দিয়েছিল মুহূর্তে। কিছুক্ষণের জন্য সকলে যেন একবারে বোকা বনে গিয়েছিল।
লর্ড বায়রনের সেই বিখ্যাত কবিতার ঘটনা–ভিসন অফ ব্যালসেজারের মতোই সুনন্দার মৃত্যুটা অমোঘ নিষ্ঠুর এক অদৃশ্য হাতে যেন লেখা হয়ে গেল!
সুনন্দা চ্যাটার্জী মৃত।
ঐ যে বিরাট হলঘরটার এক কোণে দামী সোফাটার উপরে হেলান দিয়ে এখনো বসে আছে সুনন্দা চ্যাটার্জী, শুধু মাথাটা বুকের সামনে ঝুলে পড়েছে করুণ অসহায় এক ভঙ্গিতে—
ঐ সুনন্দা চ্যাটার্জী মৃত। মাত্র কিছুক্ষণ পূর্বেই অমোঘ নিষ্ঠুর সত্যতা আবিষ্কৃত হয়েছে–সুনন্দা চ্যাটার্জী মৃত।
পরিধানে দামী সাদা ইটালীয়ান সিফনের শাড়ি, গায়ে ডি রেড় ভেলভেটের ব্লাউজ, কনুই পর্যন্ত হাতা। চোখেমুখে সূক্ষ্ম একটা প্রসাধনের প্রলেপ। তার জামাকাপড় সর্বাঙ্গ থেকে এখনো ঘরের বাতাসে ভাসছে তার প্রিয় সেন্ট কালিফোর্নিয়ান পপির মৃদু মিগ্ধ সুবাসটা। মাথার খোঁপাটা ভেঙে ঘাড়ের পাশে লুটিয়ে পড়েছে। এক হাত নিরাভরণ, অন্য হাতের সুডৌল মোমের মত মসৃণ মণিবন্ধে দামী সোনার ওমেগা রিওয়াটা এখনো টিটি করে চলছে। সব ঠিক তেমনিই আছে, শুধু সুনন্দার ঐ দেহের মধ্যে প্রাণটুকুই নেই।
সুনন্দা মৃত।
একটু আগেও নাকি বিশাখা হলঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে সুনন্দার উচ্ছ্বসিত হাসি শুনেছিল। মৃত সুনন্দা চ্যাটার্জী—তবু এখনো তার সেই যৌবন-ঢলঢল-দেহ ঠিক তেমনিই আছে।
মৃত্যু কখন এসেছিল এবং নিঃশব্দে এসে কখন বাড়িভর্তি এতগুলো আমন্ত্রিত লোকের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সুনন্দার মোমের মতো নরম এবং শঙ্খের মতো ধবল গ্রীবায় সরু সাদা ঐ সিল্ক কর্ডের ফসটি লাগিয়ে যে তাকে চিরতরে শ্বাসরুদ্ধ করে রেখে গিয়েছে সেটাই কেউ জানতে পারে নি।
শুধু আশ্চর্যই নয়, বিস্ময়কর। তবু সুনন্দা চ্যাটার্জী মৃত।
একদা প্রথম যৌবনে যাকে ঘিরে কত হতভাগ্য যুবক আশা-আকাঙ্ক্ষা আর কল্পনার জাল বুনেছে এবং তাদের সে আশা-আকাঙ্ক্ষা আর কল্পনাকে নির্মম নিষ্ঠুর ব্যঙ্গোক্তিতে রূঢ় প্রত্যাখ্যান জানালেও মরীচিকার মত যার পিছনে পিছনে তারা ঘুরেছে আর ঘুরেছে—এই সেই সুনন্দা চ্যাটার্জী। শোনা যায় তেত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত কোন পুরুষ তাকে স্পর্শ করা দূরে থাক নির্দিষ্ট একটা ব্যবধান ছাড়া কাছে গিয়ে দাঁড়াবারও সাহস পায় নি। তেত্রিশটি বসন্ত তার রুদ্ধ দ্বারে ব্যর্থ আঘাত হেনে ফিরে গেলেও সুনন্দার দিকে চাইলে মনে হবে-যৌবন বুঝি ওর দেহে অষ্টাদশীর মতোই অটুট। দীর্ঘদিন ধরেই সে দেহচর্চার সঙ্গে লাঠি ছোরা আর যুযুৎসু বিদ্যায়ও পারদর্শিনী হয়ে উঠেছিলো, তাই ছেলেরা বরাবরই বলে এসেছে—ও মেয়ে নয়, আগুনের শিখা।
সেই সুনন্দা চ্যাটার্জীকে কিনা অমনি করে সরু একটা সিল্ক কর্ডের ফাঁসে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরতে হলো!
এর চাইতে অভাবিত, বিস্ময়কর আর কি ঘটতে পারে?
কিন্তু অভাবিতই হোক আর বিস্ময়করই হোক, সুনন্দা মৃত।
রাতও বেশি নয়—মাত্র সাড়ে এগারটা। তাও গ্রীষ্মের রাত্রি সাড়ে এগারটা। উৎসবের বাড়িতে রাত সাড়ে এগারটা তো রাতই নয়। তখনো আমন্ত্রিতদের মধ্যে কেউ কেউ এসে পৌঁছায় নি বলেই সুসীম নিচের করিডোরে নিজেই অভ্যর্থনা করবার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। উৎসবটা তারই বৌভাতের।
এ-কান ও-কান হতে হতে তার কানে গিয়ে সংবাদটা পৌঁছাতেই দ্রুতপদে সুসীম উপরে উঠে আসে।
এবং হলঘরটার মধ্যে ঐ সময় যারা মূক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তাদেরই মধ্যে বান্ধবী বিশাখাকে সামনে দেখে তাকেই প্রশ্ন করে, কি–কি ব্যাপার?
বিশাখা ততক্ষণে বোধ হয় নিজেকে সামলে নিতে পেরেছিল কিছুটা। সে বলে অত্যন্ত নিম্নকণ্ঠে, যেন একপ্রকার ফিসফিস করেই, সুনন্দা ইজ ডেড!
ডেড!
যেন ভূত দেখার মতই হঠাৎ চমকে ওঠে কথাটা বলে সুসীম।
সি হ্যাজ বিন ব্রুটালি মার্ডারড!
সত্যি-সত্যি–
এবারে বিশাখা চোখের ইঙ্গিতে অদূরে সোফার উপরে উপবিষ্ট ভঙ্গিতে বসা সুনন্দার মৃতদেহটা দেখিয়ে দিল।
সেই দিকে তাকিয়ে যেন মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে যায় সুসীম।
কয়েক মুহূর্ত সেই নিপ্রাণ দেহটার দিকে তাকিয়ে থেকে পায়ে পায়ে সোফাটার সামনে এগিয়ে যন্ত্রণাকাতর রুদ্ধকণ্ঠে বলে, হাউ অ্যাবসার্ড! নো, নো–দ্যাট কান্ট বি–কান্ট বি—
বিরাট হলঘরটি ফুলে আর লতাপাতায় এবং অত্যুজ্জ্বল সব ফ্লুরোসেন্ট আলোয় ঝলমল করছে। মেঝেতে দামী কার্পেট বিছানো। চারপাশে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ মূক সব সুসজ্জিত আমন্ত্রিত নরনারীর দল।
সুসীম যেন অসহায় বোবা দৃষ্টিতে চারিদিকে একবার চোখ তুলে তাকালো। সুনন্দা যে তার গৃহে আজ অভ্যাগতা—অতিথি!
বলতে গেলে সবার আগে সেই বিকেলেই এসেছে সুনন্দা!
মাত্র মাসখানেক পূর্বের সেই ব্যাপারের পরও সুনন্দা যে একপ্রকার নিজে থেকে যেচেই নিমন্ত্রণ নিয়ে তার বিবাহের উৎসবে আসবে, সুসীম তা বিশ্বাস কেন—ভাবতেও বুঝি পারে নি।