সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে বিশাখা কিরীটীর মুখের দিকে চোখ তুলে তাকালো।
১১-১৫. কিরীটী বোধহয় মুহূর্তের জন্য ভাবে
কিরীটী বোধহয় মুহূর্তের জন্য ভাবে, ঠিক কি ভাবে কেমন করে তার বক্তব্যটা সদ্যপরিচিতা এক ভদ্রমহিলার কাছে ব্যক্ত করবে!
কি ভাবে কোথা থেকে শুরু করে বিশাখা চৌধুরীর কাছে যেটুকু জানবার জেনে নেবে!
দেখুন বিশাখা দেবী, ডাক্তার সেন আপনার পরিচিত এবং আমারও পরিচিত। সেই সূত্রেই অবিশ্যি এই অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করতে এলাম—
বিশাখা সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর কথার জবাব দেয় না।
নিঃশব্দে কেবল কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
অবিশ্যি আজ এই সময় না হলেও কাল বা পরশু যখনই হোক আপনার কাছে আমাকে আসতে হতো, কারণ–
মৃদুকণ্ঠে বাধা দিয়ে বিশাখা বললে, আপনি অত কিন্তু করছেন কেন মিঃ রায়, আপনি কেন এসেছেন তা আমি বুঝতে পেরেছি–
পেরেছেন?
তা পেরেছি বৈকি। সুনন্দার মৃত্যু সম্পর্কেই বোধ হয় কিছু জিজ্ঞাস্য আছে আমার কাছে আপনার!
ঠিক তাই। তবে–
অবিশ্যি সত্যি কথাই বলছি, আপনি যখন এসেছেন এবং আপনি যখন ডাঃ সেনের বন্ধু, তখন অনুমানই করে নিয়েছি সুনন্দার মৃত্যুর রহস্যের সন্ধানের ভারটা আপনার বন্ধুর অনুরোধেই হয়ত আপনি হাতে নিয়েছেন। তাই নয় কি?
কিরীটী বিশাখার শেষ কথাতেই বুঝতে পারে, মেয়েটি বুদ্ধিমতী।
মৃদু হেসে কিরীটী বলে, অনুমান আপনার মিথ্যে নয় বিশাখা দেবী। সেনের অনুরোধেই যেমন এ ব্যাপারে আমি হাত দিয়েছি, তেমনি সেই ব্যাপারেই এ সময়ে আপনার এখানে আমার আসা। কিন্তু আপনিও কি চান না বিশাখা দেবী–
কি?
সে রাত্রে অমন নৃশংসভাবে যে আপনাদের পরিচিত সুনন্দা চ্যাটার্জীকে হত্যা করেছে সে ধরা পড়ক!
চাই বৈকি। কিন্তু আমি ঠিক আপনাকে যে সে ব্যাপারে কিভাবে সাহায্য করতে পারি, সেটাই এখনো বুঝে উঠতে পারছি না!
সে-রাত্রে সুনন্দা দেবীর হত্যার ব্যাপারটা রহস্যে আবৃত হয়ে আছে নিঃসন্দেহে। আর সাহায্যের কথা বলছেন! কার কাছে যে কিভাবে সাহায্য পাবো, কে কতটুকু সূত্র আমার হাতে তুলে দেবেন তাও আগে থাকতে বলা দুষ্কর। তবু আপনারা সে-রাত্রে যাঁরা অকুস্থানে উপস্থিত ছিলেন—
উপস্থিত শুধু আমরা কজনাই তো নয় মিঃ রায়, নিমন্ত্রণ-বাড়িতে সে রাত্রে প্রায় পাঁচশ জন উপস্থিত ছিলেন।
তা অবিশ্যি ছিলেন কিন্তু সুনন্দা চ্যাটার্জীর পরিচিত আপনারা যে কজন ছিলেন, আপাততঃ তাঁদের যা বলবার তা জানতে পারলেই মনে হচ্ছে হয়তো আমার কাজটা অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
আপনি সত্যিই কি তাই মনে করেন মিঃ রায়?
প্রশ্নটা করে সোজাসুজি স্পষ্ট দৃষ্টিতে যেন তাকিয়ে থাকে বিশাখা কিরীটীর মুখের দিকে।
কিরীটীর সে চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, কিসের একটা চাপা উত্তেজনা যেন সেই দুই চোখের দৃষ্টিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
তাই আমার মনে হয় বিশাখা দেবী!
চোখে চোখ রেখেই স্পষ্ট কণ্ঠে কিরীটী জবাবটা দিল।
অবিশ্যি আমি অস্বীকার করবো না মিঃ রায়, আপনি কেসটা হাতে নিয়েছেন জেনে আমি আনন্দিতই হয়েছি–
সত্যি আনন্দিত হয়েছেন?
নিশ্চয়ই, কারণ—বলতে বলতে থেমে যায় বিশাখা।
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে তাগিদ দেয়, কই, বললেন না কারণটা কি?
কারণ আমার ধারণা, পুলিসের সাধ্যও নেই ঐ দুর্বোধ্য ব্যাপারের কোন মীমাংসাতেই পোঁছানো!
কেন?
বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই ওদের কর্মদক্ষতা তো জানতে আর কারো বাকী নেই!
না, না—এ আপনি কি বলছেন বিশাখা দেবী? সাধনবাবু খুব কপিটেন্ট লোক—
তা হবেন হয়তো—
হবেন নয়, সত্যিই দেখবেন এ রহস্যের মীমাংসা তিনি করবেনই।
তাই বুঝি সর্বাগ্রে নীরেনবাবুকে অ্যারেস্ট করে বসে আছেন!
কান্নার স্বরে একটা যেন স্পষ্ট ব্যঙ্গ ঝরে পড়ে বিশাখার কণ্ঠ থেকে।
অ্যারেস্ট করবার কারণ আছে বলেই হয়ত তাঁকে অ্যারেস্ট করেছেন—
কি এমন অকাট্য প্রমাণ তার বিরুদ্ধে পেয়েছেন তিনি বলুন তো?
তা কেমন করে বলবো বলুন, তবে পেয়েছেন বৈকি নিশ্চয়ই কিছু!
কিছু পান নি। রামের অপরাধে শ্যামকে ধরতেই ওরা অভ্যস্ত।
বিশাখা দেবী, আমি দেখছি পুলিসের ওপরে আপনার তেমন আস্থা নেই। কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না, এর চাইতেও অনেক জটিল ও দুর্বোধ্য ব্যাপারেরও তারা মীমাংসা করতে পারে ও করেছে, এমন নজিরের অভাব নেই! সে কথা যাক, অসময়ে এসে আপনাকে বেশী আটকে রেখে বিব্রত করবো না। গোটা তিন-চার প্রশ্নের জবাব কেবল আপনার কাছ থেকে চাই–
বলুন, সাধ্যমত আমি আপনাকে সাহায্য করতে চেষ্টা করবো।
বিশাখা দেবী, আপনি দুর্ঘটনার রাত্রে আপনার জবানবন্দীতে বলেছেন, দুর্ঘটনাটা প্রকাশ হওয়ার আধ ঘণ্টাটাক আগে আপনি নাকি হলঘরে কাকে ডাকতে এসে একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে সুনন্দা চ্যাটার্জীকে একটা সোফার ওপরে পাশাপাশি বসে কথাবার্তা বলতে দেখেছিলেন—
দেখেছিলাম।
কে সে ভদ্রলোক? তাঁকে চিনতে পেরেছিলেন?
না। তাকে আমি পূর্বে কখনো দেখি নি।
কি রকম দেখতে?
রোগা, লম্বা এবং পরিধানে ধুতি-পাঞ্জাবি ছিল। আর–
আর? চোখে কালো কাচের চশমা ছিল।
হুঁ। আর একটা কথা, সে-রাত্রে হলের মধ্যে যিনি ম্যাজিক দেখাচ্ছিলেন, তাঁকে আপনি ও বিষ্ণুবাবু দুজনেই দেখেছিলেন—
বিষ্ণুবাবু দেখেছিলেন কিনা জানি না, তবে আমি দেখেছি!
যাক সে কথা, আপনি বলেছেন তার গলার স্বরটা নাকি অবিকল আমাদের ডাক্তারের গলার স্বরের মতো বলেই সে-রাত্রে আপনার মনে হয়েছিল!