আর কোন কথা নয়?
না, তারপরই আমি নীচে চলে যাই।
যদি কিছু মনে না করেন তো একটা কথা জিজ্ঞাসা করতাম—
করুন!
সুনন্দা চ্যাটার্জীকে শেষ পর্যন্ত কেন আপনি বিয়ে করলেন না?
মুহূর্তকাল চুপ করে থাকে সুসীম, তারপর মৃদুকণ্ঠে বলে, আজ আর সে কথা আপনাকে বলতে আমার কোন বাধা নেই মিঃ রায়। দেহেই সে শুধু নারী ছিল, মনে ছিল সে এক বিচিত্র জীব। না নারী, না পুরুষ। অন্ধের মত আমি ছুটে বেড়িয়েছি তার পিছনে পিছনে—একটাআধটা দিন নয়, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর—তবু জানতে পারি নি তার আসল পরিচয়টা—চিনতে পারি নি তার আসল চেহারাটা। তবু-তবু আজ অস্বীকার করবো না আপনার কাছে মিঃ রায়, তাকে আমি ভালবাসতাম। জীবনে কাউকে আমি অমন করে বুঝি ভালবাসি নি–
শেষের দিকে গলাটা ধরে আসে সুসীমের। চোখের কোল দুটো ছলছল করে ওঠে। মানুষের জীবনটা সত্যিই কি বিচিত্র মিঃ রায়, সুসীম বলতে থাকে, নইলে দেখুন বারোটা বছর তো অপেক্ষা করেছিলাম ওকে নিয়েই ঘর বাঁধবো বলে–
আপনি তাকে ভুল বোঝেন নি তো মিঃ নাগ! কিরীটী বলে।
ভুল! না মিঃ রায়, ভুল বুঝি নি। আর ভুল বুঝি নি বলেই শ্রাবণীকে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করেছি। তার পরিচিতজনেরা সবাই জানতে এবং বলেছেও চিরদিন, ওর চোখে নাকি একটিমাত্র দৃষ্টিই আছে—ব্যঙ্গের দৃষ্টি। ও নাকি শুধু জানে ব্যঙ্গ করতেই। কিন্তু আমি জানি তা নয়, সেটা ওর বাইরের একটা খোলস ছিল মাত্র। আসলে ও ছিল ক্লীবনা পুরুষ, না নারী—আর সেইটাই যে মুহূর্তে জানতে পারলাম, সেই রাত্রেই সোজা ওর বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম শ্রাবণীর কাছে—তাকে প্রস্তাব জানিয়েছিলাম। তাই তো নীরেনের ব্যাপার যখন শুনলাম, প্রথমেই আমার মনে হয়েছিল নীরেন এত বড় ভুলটা করলো কি করে!
আচ্ছা মিঃ নাগ—
বলুন?
নীরেনবাবুর সঙ্গে সুনন্দা দেবীর ঘনিষ্ঠতার ব্যাপারটা কি সত্যিই আপনি জানতেন না?
না।
কোন কারণে আপনার কোনরকম সন্দেহও হয় নি?
না। আচ্ছা আর একটা কথা, নীরেনবাবুকে তো আপনি এ ব্যাপারে সন্দেহ করেন না—কিন্তু আর কারো ওপরে কি আপনার সন্দেহ হয়?
না।
ডাঃ সেনকে?
য়্যাঁ! মৃণালকে? না।
আপনি তো নিশ্চয়ই চান যে সুনন্দা দেবীর হত্যাকারী ধরা পড়ুক!
চাই বৈকি।
আচ্ছা এবারে তাহলে আমি উঠবো মিঃ নাগ আজকের মতো—তবে আবার হয়তো। আমি আসবো—আবার হয়তো বিরক্ত করবো আপনাদের।
না, না—বিরক্তির কি আছে! যখনই প্রয়োজন হবে আসবেন—
ধন্যবাদ।
কিরীটী উঠে দাঁড়ালো।
.
১০.
গাড়িতে উঠে কিরীটী মৃণালকে সম্বোধন করে বলে, বিশাখা দেবী কোথায় থাকেন মৃণাল?
শ্যামবাজারে।
এখন গেলে তার সঙ্গে দেখা হতে পারে?
তা হয়তো হতে পারে, কারণ এখন তো তার গ্রীষ্মের ছুটি চলেছে!
কিরীটী হীরা সিংকে নির্দেশ দেয় শ্যামবাজারের দিকে গাড়ি চালাতে।
শ্যামবাজারে রামধন মিত্রের লেনে বিশাখা থাকে। মৃণালই হীরা সিংকে নির্দেশ দিয়ে নিয়ে এল বিশাখার বাড়িতে।
.
একটা দোতলা বাড়ির দোতলার তিনখানা ঘর নিয়ে বিশাখা থাকে।
ছোট সংসার। বিশাখা, তার বিধবা মা ও একটি বেকার জুয়াড়ী ভাই জগদীন্দ্র। বিশাখার চাকরির আয় থেকেই সংসার চলে।
বিশাখার সব কিছু পরিচয়ই কিরীটী মৃণালকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করে গাড়িতেই জেনে নেয়। বিশেষ করে যেটা সাধন দত্তও তাকে জানাতে পারেন নি।
ইন্টারমিডিয়েট পড়তে পড়তেই শোনা যায় বিশাখা নাকি কোন একজনকে রেজেস্ট্রী করে বিয়ে করেছিল। কিন্তু বিয়ে করলেও প্রকাশ্যে সেই স্বামীকে নিয়ে বিশাখা ঘর করে নি।
কিরীটী শুধিয়েছিল, কেন?
বিশাখার জীবনে সে এক চরম দুঃখের কাহিনী কিরীটী। কেবল দুঃখের কেন লজ্জারও। ব্যাপারটা একমাত্র আমি ছাড়া আর কেউ জানে না অনাত্মীয়ের মধ্যে। আর আপনার জনেদের মধ্যে একমাত্র জানেন ওর মা।
কিন্তু দুঃখের কাহিনী বলছো কেন ডাক্তার?
বিশাখার মুখেই শুনেছি, লোকটা শুধু পাষণ্ডই নয়, হৃদয়হীন নিষ্ঠুরও। আমি অবিশ্যি আলফ্রেডকে চোখে কখনো দেখি নি, নামটা শুনেছি।
লোকটার নাম আলফ্রেড বলছে–
হ্যাঁ, ক্রিশ্চান। শুনেছি, মাত্র একটা বছর নাকি স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল বিশাখার।
তারপর বুঝি ডিভোর্স হয়ে গেল?
না, ডিভোর্স আজ পর্যন্ত হয় নি।
কেন?
সেও এক দুর্বোধ্য ব্যাপার। কারণ জিজ্ঞাসা করেও জবাব পাই নি বিশাখার কাছ থেকে। যাই হোক, আলফ্রেডের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হবার পর বিশাখা ক্রমে এম. এ. পাস করে, তারপর অধ্যাপিকার চাকরি নেয়।
বিশাখা দেবীর বিবাহের ব্যাপারটা মিস্ চ্যাটার্জী জানতেন না?
যতদূর জানি জানতো না।
সুসীমবাবু—তোমার বন্ধুও না?
না।
.
মৃণালের অনুমান মিথ্যে হয় নি। বিশাখা বাড়িতেই ছিল।
মৃণালের মুখে কিরীটীর পরিচয় পেয়ে বিশাখা তাকে সমাদরে অভ্যর্থনা করে বসতে দিল। ছোটখাটো দেখতে এবং রোগা চেহারার শ্যামলা মেয়েটি প্রথম দর্শনেই যেন কিরীটীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। চোখে-মুখে একটা তীক্ষ্ণ বুদ্ধির দীপ্তি। বয়েস বিশাখার যাই হোক না কেন, কুড়ি-বাইশের বেশী বলে মনে হয় না। যে ঘরে কিরীটী ও মৃণালকে বিশাখা বসতে দিয়েছিল সে ঘরটিতে সামান্য আসবাবের মধ্যে যেন একটা পরিচ্ছন্ন রুচির বিকাশ।
বিশাখা বলে, চা নিয়ে আসি?
কিরীটী বাধা দেয়, না বিশাখা দেবী, এ সময় চায়ের জন্য আপনি ব্যস্ত হবেন না, বসুন। ডাক্তার সেন আমার পরিচয়টা আপনাকে দিল বটে, তবে এ সময় আমার এখানে আসার উদ্দেশ্যটা ব্যক্ত করলো না।