কিরীটীর প্রশ্নে কতকটা যেন বিস্ময়ের সঙ্গেই তাকান সাধন দত্ত তার মুখের দিকে।
কিন্তু কিরীটীর সঙ্গে চোখাচোখি হলো না সাধন দত্তর। কারণ কিরীটী তখন হাত বাড়িয়ে সামান্য ঝুঁকে সম্মুখের ছোট গোল টেবিলটার উপরে রক্ষিত কাচের ছাইদানিটায় হাতের
অগ্নিদগ্ধ চুরোটের অগ্রভাগটা ঝাড়ছিল।
সুধা দেবী আর বিষ্ণু দে!
হ্যাঁ, হরপ্রসাদবাবু তার জবানবন্দীতে কি বলেন নি যে তার স্ত্রী সুধা দেবী তাঁর একমাত্র ভাইয়ের সুনন্দা চ্যাটার্জীর সঙ্গে প্রগাঢ় ঘনিষ্ঠতা কোন দিনই তেমন প্রীতির চোখে দেখেন নি?
হ্যাঁ, তাই বলেছিলেন বটে।
তাহলে স্বভাবতই কি আমরা ধরে নিতে পারি না যে আমন্ত্রণ না করা সত্ত্বেও রবাহূতভাবে সুনন্দা চ্যাটার্জীর সেরাত্রের উৎসবে সুসীম নাগের বাড়িতে উপস্থিতিটা সুধা দেবীর কাছে প্রীতির ব্যাপার হয় নি? এবং সুধা দেবী একজন নারী–
কিন্তু–
কি জানেন সাধনবাবু, ঐদিনকার ব্যাপারে সুধা দেবী অবহেলার যোগ্য নন! আর বিষ্ণু দে ভদ্রলোকটি এবং তার জবানবন্দীও অবহেলার বস্তু নয়!
কিন্তু বিষ্ণু দে–
বিশাখা তার জবানবন্দীতে বলেছেন, সুনন্দা চ্যাটার্জীর মৃত্যুর ব্যাপারটা জানাজানি হবার আধঘণ্টাটাক আগে তিনি নাকি ঐ হলঘরে কাকে ডাকতে এসে সোফায় সুনন্দা চ্যাটার্জীর পাশে বসে একজন ভদ্রলোককে তার সঙ্গে কথা বলতে দেখেছিলেন এবং সেই সময় ম্যাজিসিয়ান ভদ্রলোক তাসের ম্যাজিক দেখাচ্ছিলেন।
এবং বিষ্ণু দে-ও তার মিনিট পনেরো পরে হলঘরে এসে তাই দেখেছিলেন। অর্থাৎ তাহলে কি এই দাঁড়াচ্ছে না যে, বিষ্ণু দে ও বিশাখা চৌধুরী দুজনে ব্যাপারটা দেখেছেন?
হ্যাঁ।
কিন্তু বিশাখা তাঁর জবানবন্দীতে বলেছেন, সেই ম্যাজিসিয়ানের বেশভূষা, এমন কি তার কণ্ঠস্বরটা পর্যন্ত নাকি মৃণাল সেনের মতো!
তা তো বলেছেনই।
কিন্তু সেকথা কি বিষ্ণু দে বলেছেন?
না।
অথচ তার কাছ থেকেও ঐ একই ব্যাপারটা কি আমরা আশা করি না?
তিনি বলেছেন, তিনি নাকি ম্যাজিসিয়ানের কণ্ঠস্বর চিনতে পারেন নি।
মিথ্যে কথা।
কি বলছেন মিঃ রায়?
বললাম তো মিথ্যে কথা। A deliberate and intentional lie! বিষ্ণু, মৃণাল ও। সুসীমবাবু তিনজনেই মিথ্যা বলেছেন।
কিন্তু–
এর মধ্যে কোন কিন্তুই নেই, মিঃ দত্ত। নিমন্ত্রণ-বাড়িতে অত লোক তার ম্যাজিক দেখলো, তিনি প্রকাশ্যে সকলের চোখের সামনে হলঘরের মধ্যে ম্যাজিক দেখালেন, অথচ সুসীমবাবু আর মৃণাল তাঁকে দেখলেন না—আপনি কি আমাকে কথাটা বিশ্বাস করতে বলেন?
অবিশ্যি আপনি যা বলছেন—
যুক্তি ছাড়া কিরীটী রায় কথা বলে না।
তাহলে কি আপনার ধারণা নীরেন সেন হত্যাকারী নয়?
ধারণা আমার কিছুই নয়, আর কিছুই এই মুহূর্তে আমি বলছি না। It is too early to say anything! তবে এইটুকু আপনাকে বলতে পারি মিঃ দত্ত–
কি?
জবানবন্দীতে সেরাত্রে তিনজন মিথ্যা কথা বলেছে—
তিনজন!
হ্যাঁ।
কে কে?
সুসীম নাগ, ডাঃ মৃণাল সেন—
আর?
শ্ৰীমতী বিশাখা চৌধুরী।
.
০৯.
পরের দিন বেলা নটা নাগাদ কিরীটী ডাঃ মৃণাল সেনের সঙ্গে সুসীমের গৃহে উপস্থিত হলো।
সুসীম ঐ সময় তার নীচের হলঘরে বসে দরজা বন্ধ করে কতকগুলো পুরাতন চিঠি দেশলাই জ্বেলে একটার পর একটা পোড়াচ্ছিল একাকী।
ভৃত্য এসে দরজায় ধাক্কা দিতে সুসীম শুধায়, কে?
আজ্ঞে দাদাবাবু, আমি দীনু। মৃণালবাবু আর এক ভদ্রলোক এসেছেন, আপনাকে ডাকছেন মৃণালবাবু।
যা, এই ঘরে পাঠিয়ে দে।
যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি সুসীম পোড়া চিঠির ছাইগুলো একত্র করে বাইরে বাগানের মধ্যে ফেলে দেয় জানালাপথে। এবং তখনো যে চিঠিগুলো পোড়ানো বাকি ছিল, সেগুলো একটা বইয়ের আলমারির মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে দেয়।
চিঠিগুলো সুনন্দার।
দীর্ঘ বারো বৎসরের আলাপে অনেক চিঠিই লিখেছিল তাকে সুনন্দা। একটি চিঠিও সুনন্দার নষ্ট করে নি সুসীম এতদিন। সযত্নে বাণ্ডিল বেঁধে এতদিন রেখে দিয়েছিল সব চিঠি। কিন্তু আজ সকালে উঠেই কেন যেন মনে হয়েছিল সুসীমের, ওগুলোর প্রয়োজন আজ তার জীবনে ফুরিয়েছে। সুনন্দার স্মৃতি মন থেকে আজ তার মুছে ফেলাই উচিত। সুনন্দা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক আজ তার জীবন থেকে।
আজ থাক শুধু শ্রাবণী।
দরজায় ধাক্কা পড়লো।
সুসীম! মৃণালের গলা শোনা যায়।
সুসীম এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়।
পরিচয় করিয়ে দিই—আমার বন্ধু সুসীম নাগ, আর সুসীম তুমি এঁকে কখনো না দেখলেও আমার মুখে এঁর কথা বহু শুনেছে—কিরীটী রায়!
দুজনে দুজনকে নমস্কার জানায়।
কিন্তু কিরীটীর নামটা শুনে সুসীমের ভ্রূ-দুটো যেন ঈষৎ কুঞ্চিত হয়।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সুসীম যেন মুখে একটা খুশির ভান এনে সাদর অভ্যর্থনা জানায়, বসুন, বসুন মিঃ রায়।
ঘরে ঢুকতেই কাগজ পোড়ার গন্ধটা কিরীটীর নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করেছিল। সে বলে, ঘরে একটা কাগজ পোড়ার গন্ধ পাচ্ছি যেন, মিঃ নাগ!
কাগজ পোড়ার?
হ্যাঁ। বলতে বলতে সহসা নীচু হয়ে ঘরের মেঝে থেকে একটুকরো পোড়া কালো কাগজ তুলে নেয় হাতে কিরীটী, কিছু পোড়াচ্ছিলেন নাকি?
হ্যাঁ-হ্যাঁ, কতকগুলো পুরাতন কাগজপত্র—
হুঁ, জঞ্জাল রেখে তো লাভ নেই!
মৃদুকণ্ঠে যেন কতকটা স্বগতোক্তির মতই কথাগুলো বলে কিরীটী।
কিছু বলছিলেন মিঃ রায়?
না, কিন্তু আপনার লাইব্রেরীতে বেশ ভাল কালেকশন আছে বলেই মনে হচ্ছে মিঃ নাগ!