কিরীটী মৃদু হেসে বলে, বেশ বেশ, তাই হবে—
কথা দিচ্ছ তুমি?
কথা! বেশ, কথা দিলাম।
মৃণাল অতঃপর যেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
কিন্তু একটা কথা ডাক্তার—
কি?
তোমার বন্ধু সুসীমবাবু, তাঁর—তারও কি বিশ্বাস নীরেনবাবু সত্যিই নির্দোষ?
নিশ্চয়ই।
বেশ। তবে কাল একবার তোমার বন্ধুর বাড়িটা আমি ঘুরে আসতে চাই।
বেশ তো, ইচ্ছা করলে তুমি অবিশ্যি আজ—এখুনি যেতে পারো। এখুনি তোমাকে আমি সেখানে নিয়ে যেতে পারি–
না, আজ নয়! কাল-কাল বেলা আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ তুমি এসো।
মৃণাল অতঃপর বিদায় নিল।
মৃণাল ঘর থেকে বের হয়ে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই টেলিফোনে সাধন দত্তকে ডাকল কিরীটী। কিরীটী।
কে?
সাধনবাবু, আমি কিরীটী রায়।
কি সৌভাগ্য! নমস্কার। কি খবর?
কি করছেন এখন? খুব ব্যস্ত নাকি?
না, না–বসে আড্ডা দিচ্ছি।
তাহলে একবার আসুন না গরীবের গৃহে। সুনন্দা চ্যাটার্জীর মার্ডার কেসটায় আমি একটু ইনটারেস্ট ছিলাম—
এখুনি—এখুনি আসছি!
.
আরো ঘণ্টাখানেক পরে। কিরীটীর ঘরেই সাধন দত্তও সে মুখোমুখি দুজনে বসে সুনন্দা চ্যাটার্জীর হত্যার ব্যাপারটা নিয়েই আলোচনা করছিল। সাধন দত্তর সঙ্গে বছর পাঁচেক পূর্বে ঘটনাচক্রে কিরীটীর আলাপ হয়। এবং সে ঘটনাটা হচ্ছে একটি জাল উইলের ব্যাপার। সেই সময়ই সাধন দত্তর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দেখে মুগ্ধ হয়েছিল কিরীটী।
তাই মৃণালের মুখে সাধন দত্ত নীরেন সেনকে সুনন্দার হত্যাব্যাপারে সন্দেহ করে গ্রেপ্তার করেছেন শুনে ব্যাপারটাকে আদৌ লঘুভাবে নিতে পারে নি সে। এবং এ-ও বুঝতে পেরেছিল কিরীটী, বিশেষ কোনো কারণ আছে বলেই সাধন দত্ত নীরেন সেনকে গ্রেপ্তার করেছেন।
সাধন দত্তর মুখে ই আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনাটা শোনবার পর কিরীটী বলে, কেবলমাত্র ঐ রুমাল ও চিঠিটার উপর নির্ভর করে যে আপনি নীরেনবাবুকে গ্রেপ্তার করেন নি, তা আমি জানি সাধনবাবু। তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম—
না মিঃ রায়, আপনি ঠিকই ধরেছেন। সুসীমবাবুকে বা মৃণালবাবুকে আমি বলি নি সব কিছু স্পষ্ট করে। একটু আগে আপনাকে যে মহিলাটির কথা বললাম, বিশাখা, মানে বিশাখা চৌধুরী, সেই মহিলাটি তার জবানবন্দীতে একটা কথা বলেছিলেন। অবিশ্যি সে রাত্রে নয়, পরের দিন সন্ধ্যায় তার ওখানে যখন গিয়েছিলাম—
কি বলেছিলেন তিনি?
রাত তখন সাড়ে দশটা হবে। যে বাথরুমের মধ্যে আমি সে-রাত্রে রুমালটা কুড়িয়ে পেয়েছিলাম, সেই বাথরুমে প্রবেশ করবার আর একটা দরজা ছিল পিছনের বারান্দা দিয়ে। সেই দরজা দিয়ে বাথরুমে ঢুকতে গিয়ে ফিরে আসেন বিশাখা চৌধুরী, বাথরুমে ঐ সময় নীরেন সেনকে পিছনে ফিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।
কিন্তু–
শুনুন, আরো আছে। নীরেন পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে থাকলেও ঐ সময় তার হাতে একটা শিশি দেখতে পেয়েছিলেন বিশাখা।
কিন্তু কথাটা তিনি তাঁর প্রথম দিনের জবানবন্দীতে আপনাকে প্রকাশ করেন নি কেন?
সে সময় ব্যাপারটার মধ্যে কোন গুরুত্ব খুঁজে পান নি বলেই সে রাত্রে আমাকে এ সম্পর্কে। কিছু বলতে নাকি তিনি ভুলে গিয়েছিলেন।
আচ্ছা সে-সময়, মানে যখন তিনি নীরেন সেনকে দেখতে পান তখন বাথরুমে কি আলো জ্বলছিল?
না, বাথরুম অন্ধকার ছিল। তবে—
কি?
হলঘরের আলোর খানিকটা অংশ বাথরুমের মধ্যে গিয়ে পড়ায় বাথরুমটার মধ্যে অস্পষ্ট একটা আলোছায়া ছিল। তারপর যা বলছিলাম, নীরেন সেন বাথরুম থেকে চলে যাবার পর বিশাখা গিয়ে বাথরুমে ঢুকেই নাকি ক্লোরোফর্মের গন্ধ পেয়েছিলেন।
হুঁ। আচ্ছা ঠিক রাত্রি কটায় যেন সুনন্দা চ্যাটার্জী মৃত আবিষ্কৃত হয়?
সোয়া এগারটা থেকে সাড়ে এগারটার মধ্যে।
বিশাখা চৌধুরী কি নীরেন সেনের পূর্বপরিচিত ছিলেন?
না।
ডাঃ সেন, সুসীম নাগ ও সুনন্দার সঙ্গে নিশ্চয়ই পরিচয় ছিল তার?
সুসীমের সঙ্গে ছিল, তবে এক কলেজে কাজ করলেও সুনন্দার সঙ্গে শুনেছি বিশাখার তেমন হৃদ্যতা বা ঘনিষ্ঠতা ছিল না।
বিশাখা চৌধুরীর বয়স কত হবে?
ত্রিশ-বত্রিশ হবে।
বিয়ে করেছেন?
না।
কি করেন ভদ্রমহিলা?
সুনন্দা চ্যাটার্জীর সঙ্গে একই কলেজে অধ্যাপকের কাজ করেন এই তো বললাম।
তা বিয়ে এখনো করেন নি কেন ভদ্রমহিলা? তিনিও কি ঐ তিনজনের একজনকে ভালোবাসতেন?
সে রকম কোন কিছু তো এখনো জানা যায় নি।
জানা কিন্তু উচিত ছিল। যাক্ বাথরুমের মধ্যে সেরাত্রে পিছন ফিরে স্বল্প আলোআঁধারিতে যে ব্যক্তি শিশি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি যে নীরেন সেনই, সে সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই তো আপনার বিশাখা চৌধুরীর?
না।
দৃষ্টিশক্তি খুব প্রখর বলতে হবে ভদ্রমহিলার। কিন্তু আমি ভাবছি—দৃষ্টিশক্তি যার এত প্রখর, তিনি ব্যাপারটা জেনেও সেরাত্রে আপনাকে বলেন কি কেন?
বললাম তো, ব্যাপারটায় প্রথমে উনি তত গুরুত্ব নাকি দেন নি।
কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে বিচার করতে গেলে তো দেওয়া উচিতই ছিল, তাই নয় কি মিঃ দত্ত?
তা অবিশ্যি ছিল।
চুরোটটা নিভে গিয়েছিল, সেটায় পুনরায় অগ্নিসংযোগ করে বার-দুই টান দিয়ে কিরীটী ইতিমধ্যে পায়চারি থামিয়ে যে চেয়ারটার উপর উপবেশন করেছিল সেটারই পিছনে হেলান দিয়ে যেন আরাম করে বসল গা ঢেলে দিয়ে।
সাধনবাবু, সকলের কথাই আপনি বললেন, কিন্তু সুসীম নাগের ভগ্নী সুধা দেবী ও সেদিন নিমন্ত্রিত হয়ে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে বিষ্ণু দে ভদ্রলোকটির কথা তো তেমন বিশেষ কিছু বললেন না!