কিন্তু সাধন দত্ত রাজী হন নি।
অথচ সাধন দত্তর যুক্তি যাই হোক না কেন এবং সুনন্দাকে যে নীরেনই হত্যা করেছে সেসম্পর্কে যতই তিনি স্থিরনিশ্চিত হোন না কেন, মৃণাল কোনমতেই যেন মন থেকে ব্যাপারটা মেনে নিতে পারে নি—সাধন দত্তর যুক্তিটাকে গ্রহণ করতে পারে নি।
তা ছাড়া বন্ধু হিসাবেও নীরেনের এই দুর্দিনে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ানো তার কর্তব্য। এই কথাটা ভেবে মৃণাল যখন কোন দিক দিয়ে কোন পথ খুঁজে পাচ্ছিলো না, তখন হঠাৎ তার কিরীটীর কথা মনে পড়ে যায়।
কিরীটী রায়! একসময় তার সঙ্গে মৃণালের যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল।
তীক্ষ্ণ বুদ্ধি লোকটার। সে হয়তো তাকে এ সময় কোন একটা পথ দেখিয়ে দিতে পারে। শুধু কি পথ, কিরীটীর কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো একটা কথা মৃণালের মনে হয়, নীরেনের এই দুর্দিনে তাকে একমাত্র হয়ত ঐ কিরীটী রায়ই সাহায্য করতে পারে।
পুলিসের অসাধ্য কিছুই নেই।
একবার যখন তারা নীরেনকে সুনন্দার হত্যা-ব্যাপারে সন্দেহ করে গ্রেপ্তার করেছে, তখন সহজে তারা তাকে নিষ্কৃতি দেবে না।
বরং আপ্রাণ চেষ্টাই করবে তাকেই হত্যাকারী প্রমাণিত করতে।
আর তারা নীরেনের বন্ধু হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকবে!
না, তা উচিত নয়—কর্তব্যও নয়।
০
পরের দিনই সকালের দিকে মৃণাল কিরীটীর বাড়িতে গিয়ে হাজির হলো।
কি ব্যাপার ডাক্তার? কিরীটী শুধায়।
বিশ্রী একটা বিপদে পড়ে এসেছি তোমার শরণাপন্ন হয়ে।
কি হলো?
সংক্ষেপে ঘটনা বিবৃত করে মৃণাল তখন।
কিরীটী সমস্ত ব্যাপারটা শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর এক সময় সোফা থেকে উঠে পায়চারি শুরু করে।
.
০৮.
সাধন দত্ত যাই বলুন না কেন কিরীটী, আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না নীরেন সুনন্দাকে সেরাত্রে হত্যা করেছে!
কিন্তু তোমার বন্ধুর বিরুদ্ধে যে প্রমাণগুলো সাধন দত্ত হস্তগত করেছেন একটু আগেই তুমি বললে, সেগুলো তো একেবারে কিছু নয় বলে অস্বীকার করতে পারা যাচ্ছে না ডাক্তার–
কি এমন প্রমাণ? সেই চিঠি আর সুসীমের ঘরের বাথরুম থেকে কুড়িয়ে পাওয়া এক কোণে লাল সুতোয় এন লেখা রুমালটা তো! কিন্তু ঐ এন লেখা রুমালটা যে নীরেনেরই, তার প্রমাণ কি? সুসীমের বাড়িতে সেদিন নিমন্ত্রিত বহু লোকের সমাগম হয়েছিল, তাদের অনেকের নামেরই আদ্যাক্ষর খুঁজলে দেখা যাবে হয়ত এন!
শান্তকণ্ঠে কিরীটী পূর্ববৎ পায়চারি করতে করতেই বাধা দিয়ে বলে, তোমার যুক্তির যে সারবত্তা নেই তাও আমি বলছি না ডাক্তার–
তবে?
তুমি যেমন বলছে সেই লাল সুতোয় এন লেখা রুমালটা তোমার বন্ধু নীরেনবাবুর না হয়ে অন্য যাঁরা সে রাত্রে ওখানে উপস্থিত ছিলেন তাঁদেরও কারো হতে পারে, তেমনি অবিসংবাদিভাবে যে এটা তোমার বন্ধু নীরেনবাবুর নয় তারও কোন অকাট্য প্রমাণ তো তুমি দিতে পারছে না ডাক্তার!
না, তা পারছি না—তবে সে তো নীরেনকে জিজ্ঞাসা করলেই জানা যেতে পারে!
এ যে ছেলেমানুষের মত কথা বলছো!
মানে? ধর যদি নীরেনবাবু সত্যি কথা না বলেন—
বাঃ, কেন সে মিথ্যে না বলতে যাবে?
কেন যাবে, তাই না? যাবে, হয়ত কোন স্বার্থ থাকলে–
না, না—সত্যি বলছি কিঃটিী, নীরেন তাকে কিছুতেই হত্যা করতে পারে না—
আহা, সে তো পরের কথা! আপাততঃ রুমালটার কথাটাই ভাবা যাক না!
রুমালটার কথা আবার কি ভাববো?
কেন, তুমিই তো একটু আগে বললে, সাধনবাবু বলেছেন, রুমালটায় ক্লোরোফর্মের গন্ধ ছিল।
তা তো ছিল। কিন্তু–
কথা হচ্ছে, তাহলে কি ভাবে সুনন্দা দেবীকে হত্যা করা হয়েছে? ক্লোরোফর্ম দেবার পরে ফাঁস লাগিয়ে, না ক্লোরোফর্মের সাহায্য হত্যাকারী আদপেই নেয় নি? কেবলমাত্র কোন ব্যক্তিবিশেষের ওপর সুনন্দা দেবীর হত্যার সন্দেহটা আরোপ করবার জন্য ক্লোরোফর্ম মাখিয়ে হত্যাকারী ঐ রুমালটি বাথরুমে ফেলে রেখে গিয়েছিল–
মৃণালের মনে হয়, লোকটা কি আবোল-তাবোল বকছে! কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করে না।
কিন্তু যাক সে কথা, একটা কথার জবাব দিতে পারো ডাক্তার?
কি?
তোমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েও নীরেনবাবু সুনন্দার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কথাটা তোমাদের দুবন্ধুর কাউকেই কেন এতদিন জানতে দেয় নি?
বললাম তো একটু আগে, ব্যাপারটা আমাদেরও কম আশ্চর্য, অভিভূত করে নি! কেন যে সে কথাটা গোপন করেছিল–
আচ্ছা এমনও তো হতে পারে—
কি?
তুমি ও সুসীমবাবু দুজনেই সুনন্দা দেবীকে ভালবাসতে—তাই তোমাদের বন্ধু হলেও সুনন্দার ব্যাপারটা তিনি তোমাদের কাছ থেকে গোপন করে গিয়েছেন?
মৃণাল চুপ করে থাকে।
জান তো, ভালবাসার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বন্ধুত্বের কোন মূল্য নেই! তা ছাড়া আরো একটা কথা–
কি?
সুনন্দা দেবীকে লেখা সেই অদ্ভুত চিঠিটা! বিশেষ করে সাধন দত্ত যখন জোর গলায় বলছেন, সে চিঠি নীরেবাবুরই হাতের লেখা!
হ্যাঁ বলেছেন বটে, তবে—
উঁহু, বেশ জটিল—আর আমার কি মনে হচ্ছে জান?
কি?
এর পশ্চাতে রয়েছে মদনের ফুলশর—
মদনের ফুলশর!
হুঁ। মনে করো কবির সেই অক্ষয় পংক্তি—পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছো এ কি সন্ন্যাসী!
তাহলে–
Love is jealous, love is selfish! অবিশ্যি এ-ও আমি সাধন দত্তর মত হলফ করে বলছি না যে তোমার বন্ধু নীরেনবাবুই তোমাদের বান্ধবী সুনন্দা দেবীর হত্যাকারী–
দেখো কিরীটী, ওসব আমি কিছু বুঝি না। আমি আবারও হলফ করে তোমাকে বলছি যে নীরেন নির্দোষ। আর সেটা তোমাকেই প্রমাণ করে দিতে হবে।