ইতি তোমার—নী
চিঠিটা পড়তে পড়তে সুসীমের মনের মধ্যে একটা কথা উঁকি দেয়, তবে কি সেই কারণেই যেচে নিজে আমন্ত্রণ নিয়ে সুনন্দা তার বৌভাতের উৎসবে এসেছিল?
কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যায় সুসীম।
মিঃ নাগ!
যা! সাধন দত্তর ডাকে চমকে সুসীম তার দিকে তাকালো। চিঠিটা আপনার বন্ধু নীরেনবাবুর হাতের লেখা কিনা সেটা প্রমাণসাপেক্ষ। তবে তার অন্যান্য চিঠির সঙ্গে মিলিয়ে আমার তো ধারণা হয়েছে, একই হাতের লেখা—যদিচ হুবহু একেবারে মেলে নি। কিন্তু হাতের লেখার সঙ্গে হুবহু মিল হোক বা না-ই হোক, এ চিঠি যে নীরেনবাবুরই লেখা তার অকাট্য প্রমাণ কিন্তু আমি অন্যভাবেও পেয়েছি।
কি প্রমাণ?
প্রমাণ পেয়েছি, যেদিন চিঠিটা লেখেন নীরেনবাবু তার আগের দিন সন্ধ্যায় তিনি সুনন্দা চ্যাটার্জীর বাড়িতে গিয়েছিলেন।
তাতে কি হলো?
শুনুন, এখনো সব কথা শেষ হয় নি আমার। সেদিন দুজনার মধ্যে কোন কারণে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়, মিস্ চ্যাটার্জীর ঝি মনোরমা শুনেছে—
ঝগড়া হয়েছিল?
হ্যাঁ, আর সেই সময় ঝগড়া করে বের হয়ে আসবার মুখে নাকি নীরেনবাবু তাকে শাসিয়ে এসেছিলেন, সুনন্দা দেবীকে তিনি হত্যা করবেন!
সত্যি–সত্যি বলছেন?
সত্যিই বলছি—মনোরমা বলেছে।
হঠাৎ ঐ সময় সাধন দত্তর শেষ কথাটা যেন একটা অন্য উপলব্ধি জাগায় সুসীমের মনে। সে চমকে ওঠে এবং ব্যগ্রকণ্ঠে শুধায়, হোয়াট আর ইউ ড্রাইভিং এট মিঃ দত্ত!
এখনো বুঝতে পারছেন না? নীরেনবাবুই হত্যা করেছেন সেরাত্রে মিস চ্যাটার্জীকে!
না—দ্যাট কাণ্ট বি! ইপসিবল! ফ্যানাটিক!
না, ইপসিবল বা ফ্যানাটিক নয় সুসীমবাবু। গম্ভীর কণ্ঠে কথাটা বলে পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে রুমালটা সুসীমের সামনে মেলে ধরেন সাধন দত্ত, আরো প্রমাণ আছে—এই রুমালটা দেখুন, এই রুমালের কোণে সুতো দিয়ে লেখা N অর্থাৎ নীরেনের আদ্যাক্ষর–
কিন্তু—
এই রুমালটা আমি কোথায় পেয়েছি জানেন?
কোথায়?
সেরাত্রে আপনারই এই বাড়িতে। যে হলঘরে মিস্ চ্যাটার্জী নিহত হন, সেই হলঘরেরই সংলগ্ন বাথরুমের মধ্যে। আর–
আর?
রুমালটার মধ্যে ক্লোরোফরমের গন্ধ ছিল!
না না—এসব আপনি কি বলছেন মিঃ দত্ত! আর্ত ব্যাকুল কণ্ঠে যেন কথাগুলো বলতে গিয়ে সুসীম ভেঙে পড়ে।
যা বলছি, মিথ্যা একটি বর্ণও তার মধ্যে নেই। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, সেক্ষেত্রে নীরেনবাবুই সুনন্দা চ্যাটার্জীকে হত্যা করেছিলেন।
কি বলছেন আপনি? তাহলে কি আপনি নীরেনকে অ্যারেস্ট করছেন?
আপনি যদি আমি হতেন, তাই কি করতেন না! আচ্ছা আমি তাহলে আজকে উঠবো।
সাধন দত্ত উঠে দাঁড়ান।
মিঃ দত্ত!
সাধন দত্ত যাবার জন্য পা বাড়িয়েছিলেন, সুসীমের ডাকে ঘুরে দাঁড়ালেন।
আপনি কি সত্যিই তাহলে বিশ্বাস করেন যে নীরেনই সুনন্দাকে হত্যা করেছে?
প্রত্যুত্তরে নিঃশব্দে মৃদু হাসলেন সাধন দত্ত শুধু।
কিন্তু–কিন্তু আপনার ভুলও তো হতে পারে মিঃ দত্ত!
ভুল?
হ্যাঁ–
না, ভুল আমার হয় নি। গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলেন সাধন দত্ত।
.
০৭.
কি যেন সেই কবিতাটা?
কিরীটীর প্রশ্নে কেমন যেন বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় তার মুখের দিকে, কবিতা!
হ্যাঁ, সেই যে—
In the same hour and hall
The fingers of a hand
Came forth against the wall,
And wrote as if on sand :
The fingers of a man;–
A solitary hand.
এ যেন ঠিক সেই ব্যালসেজারস্ ফিস্টের সলিটারি হ্যাণ্ডের মতোই সুনন্দা চ্যাটার্জীর মৃত্যুলিপি লেখা হয়ে গেল!
কথাগুলো বলে কিরীটী কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যে এদিক থেকে ওদিক পায়চারি করতে লাগলো।
মৃণাল সেন কিন্তু ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে ওঠে।
নীরেনের গ্রেপ্তারের সংবাদটা সে জানতো না। সুসীম টেলিফোনে তাকে জানিয়েছিল এবং সেই সঙ্গে জানিয়েছিল নীরেনের সঙ্গে সুনন্দার প্রগাঢ় ঘনিষ্ঠতার কথা, যদিচ সে আগেই কথাটা সাধন দত্তর মুখে শুনেছিল। সংবাদটা শুনে অবধি মৃণালও কম আশ্চর্য হয় নি। কারণ সেও সুসীমের মতোই প্রথম শুনলো যে সুনন্দার সঙ্গে নীরেনের একটা প্রগাঢ় ঘনিষ্ঠতা ছিল!
নীরেন তাদের উভয়েরই বন্ধু, অথচ তারা এতদিন ঘুণাক্ষরেও দুজনের একজনও জানতে পারেনি যে সুনন্দার সঙ্গে তার এতটা ঘনিষ্ঠতা কখন কি ভাবে গড়ে উঠেছিল। ব্যাপারটা জানবার পর মৃণালের যেটা স্বভাবতই মনে হয়েছে সেটা হচ্ছে, নীরেন তাদের কাছ থেকে ব্যাপারটা গোপন করেছে।
কিন্তু কেন? ব্যাপারটা তাদের কাছে গোপন করবার মতো কি এমন কারণ থাকতে পারে নীরেনের?
সুনন্দার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কথাটা যদি তারা জানতই, তাতে এমন কি এসে যেত! বিশেষ করে তাদের দুজনেরই সঙ্গে যখন সুনন্দার পরিচয় ছিল!
সে কি ভেবেছিল, সুনন্দার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার ব্যাপারটা জানতে পারলে তারা খুশি হবে না? এই পর্যন্ত চিন্তা করেই মৃণাল নিজের কাছেই নিজে কেমন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
নীরেনকে সামনাসামনি পেলে হয়তো মৃণাল তাকে কথাটা স্পষ্টাস্পষ্টিই জিজ্ঞাসা করতো। কিন্তু সে অবকাশ সে পায় নি। তার কারণ সংবাদটা যখন সে সুসীমের কাছ থেকে জানতে। পারলো, তার আগেই নীরেনকে সাধন দত্ত গ্রেপ্তার করেছেন।
নাগালের বাইরে সে—হাজতে।
তবু চেষ্টা করেছিল মৃণাল সাধন দত্তর সঙ্গে দেখা করে নীরেনের সঙ্গে হাজতে দেখা করবার একটা অনুমতি পাওয়ার।