শ্রাবণী, শোন—
কি আর শুনবো—কি আর তুমি বলবে? কিন্তু কেন এমনটা করলে তুমি আমার সঙ্গে? আমি তো কোনদিন তোমার কোন ক্ষতি করি নি, তবে তুমি আমার এতবড় ক্ষতিটা কেন করলে?
শ্রাবণী, বিশ্বাস করো, কোন ক্ষতি তোমার আমি করি নি—
এখনো তাই বলবে?
সত্যি বলছি, বিশ্বাস করো—
বিশ্বাস! আচ্ছা বলতে পারো, সুনন্দাকে যে শেষ পর্যন্ত নিমন্ত্রণ করেছিলে—কথাটা কেন আমার কাছে গোপন করেছিলে?
বলতাম নিশ্চয়ই, কিন্তু বলবার সময় পেলাম কোথায়?
বলবার সময় পাও নি, না? কিন্তু পরশু রাত্রে সুনন্দার সঙ্গে ফোনে কথা বলবার পর যখন সুধার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল তাকেও তো কথাটা বলো নি! জামাইবাবুকেও বলল নি! ইচ্ছা করেই তুমি বলো নি! কিন্তু–
কি বল, থামলে কেন?
না থাক, ভুল যখন আমারই, সে ভুলের প্রায়শ্চিত্তও করতে তো হবে আমাকেই। তুমি শুধু কাল আমার শিলং যাবার ব্যবস্থা করে দাও।
কিন্তু ভেবে দেখ একটু শ্রাবণী, কালই যদি তুমি শিলং চলে যাও, ব্যাপারটা কি সকলের চোখেই বিশ্রী ঠেকবে না?
বিশ্রী ঠেকুক আর না-ই ঠেকুক, আমি যাবোই।
যেও তুমি, আমি বাধা দেব না। তবে জামাইবাবু আর সুধা চলে যাক, তারপর যেও। শুধু আমার এই অনুরোধটুকু তুমি রাখো শ্রাবণী। এখন শোবে চল
না, তুমি যাও।
শুতে যাবে না?
না।
সুসীম আর অনুরোধ জানাল না। ঘরের মধ্যে চলে গেল।
আর শ্রাবণী ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রইলো অন্ধকারে।
০৬-১০. বিচিত্র একটা সংবাদ
তিনদিন পরে।
বিচিত্র একটা সংবাদ যেন সুসীমকে একেবারে বিমুঢ় করে দেয়।
সকালের দিকে সুসীম নীচে তার বসবার ঘরে একটা চেয়ারে বসে সেদিনকার দৈনিকটার উপর চোখ বুলাচ্ছিল, এমন সময় থানা-অফিসার সাধন দত্ত এসে ঘরে ঢুকলেন।
বসুন, মিঃ দত্ত! কোন খবর আছে নাকি?
আছে।
কি?
একটা বিশেষ ব্যাপারে আলোকসম্পাতের জন্যে আপনার কাছে আসতে হলো আমাকে সুসীমবাবু! সাধন দত্ত বললেন।
কি বলুন তো?
দুদিন ধরে খোঁজখবর নিয়ে যা জানতে পারলাম—
কি?
সুনন্দা দেবীর সঙ্গে গত বারো বছর ধরে তিনজন খুব ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন আপনারা–
তিনজন!
হ্যাঁ, প্রথম হচ্ছেন আপনি—
আমি? হ্যাঁ, তা আমি—মানে আমার সঙ্গে সুনন্দার—
কথাগুলো যেন কেমন এলোমেলো হয়ে যায় সুসীমের।
সাধন দত্ত বলেন, হ্যাঁ আপনি, ডাঃ মৃণাল সেন আর—
কিন্তু–
শুনুন, আরো একজন ছিল—
কে?
নীরেন সেন।
বিস্ময়ে যেন বোবা হয়ে যায় সুসীম, সাধন দত্তর মুখ থেকে নামটা উচ্চারিত হতেই।
.
সে, মৃণাল ও নীরেন একই বছরে বি. এস-সি. পাস করে। একই কলেজে পড়েছে তারা। তারপর মৃণাল গিয়ে ভর্তি হলো কারমাইকেল মেডিকেল কলেজে। সে এক বছর এম. এসসি পড়ে পড়া ছেড়ে বাপের কোলিয়ারীর বিজনেস দেখাশোনা করতে শুরু করে। কারণ হঠাৎ সেই সময় তার বাপের মৃত্যু হয়।
আর বর্ষায় এক ধনী টিম্বার-মার্চেন্ট কাকা ছিলেন নীরেনের—তার কাছেই সে চলে যায় ভাগ্যান্বেষণে ঐ সময়ই। সেও আজ প্রায় দশ বছর হতে চললো বৈকি। মনে পড়ে সুসীমের, গত দশ বছরে অবশ্য অনেকবার এসেছে নীরেন কলকাতায় এবং কখনো এক মাস, কখনো বা দুমাস থেকে গিয়েছে।
সেই নীরেনের সঙ্গে যে সুনন্দার কোন দিন কোন সূত্রে আলাপ ছিল, স্বপ্নেও তা জানতে পারে নি সুসীম। আর সুনন্দার সঙ্গে নীরেনের যদি আলাপই ছিল তো সেকথা কোন দিন তাদের ঘুণাক্ষরে জানতেই বা দেয় নি কেন সে? ব্যাপারটা রীতিমতো বিস্ময়েরই।
এ আপনি কি বলছেন মিঃ দত্ত, নীরেনের সঙ্গে সুনন্দার পরিচয় ছিল? কথাটা শেষ পর্যন্ত সুসীম না বলে পারে না।
মৃদু রহস্যপূর্ণ হাসি হেসে সুসীমের দিকে তাকিয়ে সাধন দত্ত বললেন, কেন, আপনি তো উভয়েরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আপনি ব্যাপারটা জানতেন না বলতে চান?
বিশ্বাস হয়তো করবেন না আপনি, তবে ব্যাপারটা আমি জানতাম না সত্যিই। আর মৃণালও যে জানে না, তাও আমি জোর করে বলতে পারি।
আপনার এখানে আসার আগে আমি ডাঃ সেনের ওখান হয়েই এসেছি। তিনিও আপনার মতই বললেন, তিনিও জানতেন না কিছু। তাতেই কিন্তু ব্যাপারটা আমার কাছে একটু দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে–
কিন্তু কথাটা আপনি জানলেন কি করে?
কতকগুলো চিঠি দেখে।
চিঠি!
হ্যাঁ। চিঠিগুলো গতকাল সুনন্দা দেবীর তিলজলার বাড়ির শোবার ঘর সার্চ করতে গিয়ে পেয়েছি। চিঠিগুলো অবিশ্যি সবই প্রেমপত্র বলা চলতে পারে।
প্রেমপত্র!
হ্যাঁ। চিঠিগুলো লিখেছেন ডাঃ সেন, আপনি ও নীরেনবাবু। তবে বেশীর ভাগ চিঠিই নীরেনবাবুর লেখা।
নীরেনের লেখা!
হ্যাঁ, বর্মার পোম থেকে লেখা চিঠি। আর সত্যি কথা বলতে কি, আপনাদের সবার চিঠিগুলো পড়ে নীরেনবাবুর চিঠিগুলোর মধ্যেই যেন বেশী ঘনিষ্ঠতার ইঙ্গিত পেয়েছি।
চিঠিগুলো দেখতে পারি?
একজিবিট হিসাবে চিঠিগুলো আপাততঃ থানায় রয়েছে। মামলার সময় দেখতে পাবেন বৈকি, অবশ্য দেখতে চাইলে! কিন্তু যেজন্যে আমি বিশেষ করে এসেছি সেটা হচ্ছে, সুনন্দা চ্যাটার্জী যেদিন নিহত হয় তার ঠিক আগের দিনই কোন এক সময় সুনন্দা চ্যাটার্জীকে নীরেনবাবু একটা চিঠি লেখেন–
কি চিঠি?
সে চিঠিটার কপি আমার কাছে আছে। বলে পকেট থেকে একটা লেখা কাগজ বের করে সুসীমের হাতে তুলে দিলেন সাধন দত্ত।—দেখুন!
সংক্ষিপ্ত চিঠি।
সোনা,
কালকের ব্যাপারের জন্যে সত্যিই আমি দুঃখিত। বিশ্বাস কর, আমি ছাড়া তুমি এ দুনিয়ার আর কারো হবে এ আমার পক্ষে ভাবাও দুঃসাধ্য। আমি টেম্পার লুজ করেছিলাম একমাত্র সেই কারণেই। যাই হোক, তুমি যখন চেয়েছে তখন সেটা নিশ্চয়ই আমি ফিরিয়ে দেবো। কাল তো তুমি সুসীমের ওখানে আসছেই, কালই সেখানে দিয়ে দেবো। তোমার বাড়িতে গিয়েই দিয়ে আসতে পারতাম, কিন্তু তা পিরবো না—কারণ তোমার বাড়ির দরজায় আর কখনো এ জীবনে আমি পা দেবো না, আর আমার বাড়ির দরজাও তোমাকে মাড়াতে দেবো না।