সুখময় প্রশ্নটা করেন, তাহলে অন্যরকম কিছু বলেই তো আপনার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা, মিঃ রায়?
কিরীটী পাইপটায় পাউচ থেকে তামাক ভরতে ভরতে মৃদু কণ্ঠে বলে, আই অ্যাম সরি সুখময়বাবু, আমার কিন্তু সেরকমই বলে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা–
কি মনে হচ্ছে?
ইট ইজ নট এ কেস অফ সুইসাইড! মনে হচ্ছে ডেফিনিট কেস অফ হোমিসাইড!
হোমিসাইড? মানে হত্যা?
হ্যাঁ।
কিন্তু কেন?
দেখুন মিঃ মল্লিক, আপনার নজর পড়েছে কিনা জানি না—তবে আমার কিন্তু তিনটে ব্যাপার অত্যন্ত কুইয়ার লাগছে।
কুইয়ার লাগছে, কি?
প্রথমতঃ ধরুন লোকটার যে পরিচয় এখন পর্যন্ত আপনার কাছ থেকে পেয়েছি নিশ্চয়ই বলতে পারি আমরালোকটাসেলফ-মেড-ম্যান এবং জীবনে যাকে বলে সত্যিকারের সাকসেসফুল ম্যান, তাই। সেক্ষেত্রে এ ধরনের একজন লোক হঠাৎ কেন সুইসাইড করতে যাবেন?
তা অবিশ্যি—
দ্বিতীয়তঃ ধরুন, ঐ ধরনের লোকদের শত্রু থাকাটা এমন কিছু বিচিত্র যেমন নয়, তেমনি লোকটা যে একেবারে সাধু-চরিত্রের ছিলেন তাও মনে করবার কিছু নেই এবং সেক্ষেত্রে সেদিক থেকে গোপন আঘাত আসাটাও খুব একটা অস্বাভাবিক কি?
বুঝলাম না আমি ঠিক!
বুঝলেন না?
না।
লোকটা বিপত্নীক ছিল, অর্থ ছিল এবং কিছু কিছু দোষও যে ছিল তাও জেনেছি আমরা। আর–
আর?
সুন্দরী তরুণী সেক্রেটারীও ছিল এবং তার থাকবার ব্যবস্থাও এই বাড়িতেই। ওয়েল তবে কি আপনি মিঃ রায়— কিছুই আমি বলছি না সুখময়বাবু ব্যাপারগুলো শুধু চিন্তা করতে বলছি। এবং সেদিক দিয়ে চিন্তা করতে গেলে প্রব্যাবিলিটি কোথায় বেশী? হত্যার না আত্মহত্যার? তারপর কাম টু আওয়ার থার্ড পয়েন্ট—যে লোকটা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সুইসাইড করবে বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তার পক্ষে ব্যবসা-সংক্রান্ত ব্যাপার ডিসকাশন করে তার পার্সোন্যাল অ্যাসিস্টেন্টকে অমন কুল ব্রেনে পাটনা পাঠানো কি খুব স্বাভাবিক?
সুখময়বাবু চুপ করে থাকেন।
কিরীটী ইতিমধ্যে হস্তষ্কৃত পাইপটায় অগ্নিসংযোগ করেছিল। পাইপটায় গোটা দুই টান দিয়ে। বলে, আরও কয়েকটা ছোটখাটো ব্যাপার নিশ্চয়ই আপনার কাছে বিচিত্র লেগেছে!
কি বলুন তো?
প্রথমতঃ উপরের ঘরের ঐ টেবিল-ল্যাম্পটা! আগেরটা কোথায় গেল এবং নতুনটাই বা কে আনল এবং কেন আনা হল?
ল্যাম্পটা?
হ্যাঁ। দ্বিতীয়তঃ ঘরের যে দরজাটা নিজ হাতে ব্রজদুলাল বন্ধ করে দিয়েছিলেন, সেটা কে খুলল?
কেমন যেন বোকার মতই ফ্যালফ্যাল করে সুখময় মল্লিক কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে থাকেন। কি বলবেন জবাবে বুঝতে পারেন না। বলে কি লোকটা!
প্রথম দিককার তিনটি যে পয়েন্ট বললেন তার অবিশ্যি কিছু অর্থ হয়। কিন্তু শেষে যে কথাগুলো বললেন তার মাথামুণ্ডু কিছুই যেন বুদ্ধির গোচর হয় না মল্লিকের।
নতুন টেবিল-ল্যাম্পটা কোথা থেকে এল? ঐদিনের স্টেটসম্যান কাগজটা কোথায় গেল?
যে দরজাটা ব্রজদুলাল নিজে হাতে বন্ধ করে দিয়েছিলেন সে দরজাটা কে খুললে?
কিরীটী বোধ করি মল্লিকের মনের ভাবটা অনুধাবন করতে পারে।
অতঃপর মৃদু হেসে বলে, বসুন, সুখময়বাবু—আপনার জবানবন্দি নেওয়া নিশ্চয়ই শেষ করতে পারেননি এখনো?
না। সবে শুরু করেছিলাম।
তাহলে শেষ করুন।
আপনি যা বললেন তাই যদি হয় তো মিঃ রায় তাহলে এখন তো দেখছি সত্যি সত্যিই
ব্যাপারটা অন্য রকম দাঁড়াচ্ছে। সুখময় বসতে বসতে বলেন কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে।
হ্যাঁ, ব্রজদুলাল সাহাকে কেউ গতরাত্রে হত্যা করেছে যখন আমরা বুঝতেই পারছি, জবানবন্দির ব্যাপারেও দৃষ্টিটা আপনার সেই দিকেই দিতে হবে।
মৃদু শান্ত কণ্ঠে কিরীটী কথাগুলো বলে।
০৭. জবানবন্দি নেওয়া শুরু
জবানবন্দি নেওয়া শুরু করলেন অতঃপর সুখময় মল্লিক।
বাড়ির লোকজনেরা তখনও ঘরের বাইরে বারান্দাতেই সবাই দাঁড়িয়েছিল পুলিস প্রহরায়।
ভৃত্য জীবন, রামখেলন, হরি ও নারাণ। রাঁধুনী বামুন ব্রিজনন্দন। দারোয়ান মিশির ও ধনবাহাদুর। ড্রাইভার, কেরামউল্লা—অফিসের ড্রাইভার সেও থাকত ব্রজদুলালের গৃহে সার্ভেন্টস কোয়াটারে।
বাড়ির নীচের তলায় একেবারে পশ্চিম দিকে ভৃত্য ঠাকুর ও ড্রাইভারদের থাকবার জন্য আলাদা ব্যবস্থা। তারা সব ঐখানেই থাকে।
জীবন ব্রজদুলালের খাস ভৃত্য। সে একমাত্র ব্রজদুলালের কাজকর্ম ছাড়া অন্য কিছুই করত না।
নতুন লোক বলতে ওদের মধ্যে কেউই নয়।
চার-পাঁচ বছর ধরে সকলেই ঐ বাড়িতে কাজ করছে।
ভৃত্যদের মধ্যে জীবন আর নারাণ ব্যতীত অন্য কেউ তো বড় একটা উপরেই যেত না। কাজেই ভৃত্যদের কারও কাছ থেকেই জিজ্ঞাসাবাদ করে বিশেষ কোন নির্ভরযোগ্য সংবাদই পাওয়া গেল না।
সবাই রাত সাড়ে নটায় ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল একমাত্র ভৃত্য জীবন বাদে।
সে শুতে যায় রাত দশটা নাগাদ।
কিরীটী জীবনকেই একবার জিজ্ঞাস করে, রেবেকা রাত্রে কখন ফিরেছে, সে জানে কিনা?
জীবন বলে, জানি না।
দোতলায় উঠবার সিঁড়িতে কোলাপসিবল গেট দেখলাম জীবন, ওটা রাত্রে বন্ধ থাকে, না খোলা থাকে।
আমি শোবার আগে রাত সাড়ে দশটা নাগাদ রোজ বন্ধ করে দিই। জীবন জবাব দেয়।
কাল রাত্রে বন্ধ করেছিলে?
হ্যাঁ। রাত দশটায়।
রেবেকা তাহলে তিনতলায় গেল কি করে?
আজ্ঞে উনি তো প্রায়ই রাত করে ফেরেন—ওঁর কাছে ঐ গেটের একটা ড়ুপ্লিকেট চাবি আছে।
দারোয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল, রাত পৌনে বারোটা নাগাদ গতরাত্রে রেবেকাকে সে গেট খুলে দিয়েছে।