- বইয়ের নামঃ বিদ্যুৎ-বহ্নি
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- প্রকাশনাঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১. পাইপটা নিভে গিয়েছিল
কিরীটী নতুন করে আবার পাইপে অগ্নিসংযোগ করে, পাইপে কয়েকটা টান দিয়ে খানিকটা ধোঁয়া উদগীরণ করে বলে, কথাটা কারোরই অজানা থাকবার কথা নয়। কারণ ঐ দিন সকালেই ইংরাজী বাংলা সব কাগজে ঘোষণা করা হয়েছিল কলকাতা শহরের কোন কোন এলাকায় সেদিন রাত্রে নির্দিষ্ট একটা সময়ের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকবে অর্থাৎ নিষ্প্রদীপ হবে।
তালুকদার কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, তার মানে, তুমি কি বলতে চাও কিরীটী?
এইটুকুইতোমাকে বলতে চাই তালুকদার যে, হত্যাকারী পূর্ববিজ্ঞাপিত নির্দিষ্ট সময়ে নিষ্প্রদীপের ঐ গোল্ডেন অপারচুনিটিটুকুর অত্যন্ত সুচারু ভাবে সত্যিকারের বুদ্ধিমানের মত সদ্ব্যবহার করেছে।
তা না হয় মানলাম বুদ্ধিমানের মত নিষ্প্রদীপের পূর্ব-নির্দিষ্ট সময়টুকু সদ্ব্যবহার করেছে কিন্তু হত্যাকারী এটা তো জানত না যে, ঠিক সেই সেইদিনই ব্রজদুলাল সাহা সন্ধ্যার ভাই কাউন্টে মাদ্রাজ থেকে ফিরে আসবেন। তাঁর ফিরে আসাটা তো জানতে পেরেছি আমরা-অফিসের জরুরী ট্রাঙ্ককল পেয়ে অকস্মাৎ।
সম্ভবতঃ তা নয়।
তা নয়, মানে?
মানে আমার ধারণা–
কি?
ব্রজদুলাল সাহার মাদ্রাজ থেকে অকস্মাৎ প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারেও হত্যাকারীর হাত ছিল।
তুমি কি বলতে চাও কিরীটী? সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তালুকদার কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
কিরীটী কিন্তু একান্তই নির্বিকার।
সোফার উপরে শরীরটাকে একটা নিশ্চিন্ত আলস্যের ভঙ্গীতে এলিয়ে দিয়ে তার সম্মুখে উপবিষ্ট তালুকদারের সঙ্গে কথা বলছিল।
পাইপে এবারে আর একটা টান দিয়ে বলে, বলছিলাম এই যে, ঐ দিকটায় একটু নজর দিলে ক্ষতিই বা কি?
কোন দিকটায়?
বলছিলাম, কিরীটী বলে, সেদিন ব্রজদুলাল সাহার মাদ্রাজ থেকে অকস্মাৎ প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে হত্যাকারীর হাত ছিল—সেটাকে আমাদের বর্তমান প্রবলেমের আকসন হিসাবে ধরে নিলে ক্ষতিটাই বা কি?
ক্ষতি নয় কিন্তু–
তুমি তো জান তালুকদার, কিরীটী আবার বলে, মন আমার কখনও হঠাৎ কিছু ধরে নেয় না।
তা জানি। তবে–
তবের কথা থাক। আমি সেই রকম ইঙ্গিতই যেন একটা ঐব্যাপারে পাচ্ছি বলেই বলছিলাম
.
বস্তুতঃ উভয়ের মধ্যে কয়েকদিন আগেকার একটা রহস্যপূর্ণ হত্যার ব্যাপার নিয়ে আলোচনা চলহিল কিরীটীরই বাসায় তার দোতলার বসবার ঘরে বসে, সন্ধ্যার দিকে।
হত্যাকাণ্ডটা ঘটেছিল দিন-সাতেক আগে বালীগঞ্জ অঞ্চলে গচা লেনে।
বিপত্নীক ব্রজদুলাল সাহা যাকে বলে সত্যিকারের ধনীই ছিলেন।
রাণীগঞ্জ অঞ্চলে তিনটি কয়লার খনি ছাড়াও কোলকাতায় তাঁর একটি লোহার কারবার ছিল। বিরাট ফলাও কারবার, সাহা স্টীল কোম্পানী। সাহা স্টীল কোম্পানীর অফিস ডালহৌসি স্কোয়ারে। বিরাট একটা সাততলা বাড়ির দোতলার সবটা নিয়ে সাহা স্টীল কোম্পানীর অফিস।
ব্রজদুলাল সাহার বয়স বাহান্ন থেকে তিপ্পান্নর মধ্যে ছিল। সুন্দর স্বাস্থ্যবান লোক, শরীরে কোনরকম বোগ ইত্যাদি ছিল না।
ধনী ব্যবসায়ী হিসাবে গত কয়েক বছর ধরে ব্রজদুলাল সাহা কলকাতা শহরে সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। বিশেষ করে বালীগঞ্জ অঞ্চলে বিরাট প্রাসাদতুল্য এক বাড়ি ফাঁদবার পর। বছর দুই হল গচা লেনে বিরাট বাড়ি করেছিলেন। শুধু বাড়িই নয়, মনের মত করে প্রচুর অর্থব্যয়ে গৃহটি সাজিয়েও ছিলেন।
ঐশ্বর্যকে করায়ত্ত করতে কিন্তু ব্রজদুলালকে অনেকগুলো বৎসর জীবনের খেসারত দিতে হয়েছিল। অতি সাধারণ অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়েছেন ব্রজদুলাল সাহা একটা দুর্জয় প্রতিজ্ঞা নিয়ে। এবং সাফল্যের দুয়ারে সবে যখন পা দিতে চলেছেন স্ত্রী মায়া দেবী চোখ বুজলেন। বয়স তখন কতই বা ব্রজদুলালের! মাত্র সাঁইত্রিশ বছর। সমস্ত দেহে তখনও অটুট স্বাস্থ্য!
সে যাই হোক, ব্রজদুলাল কিন্তু আর দ্বিতীয় সংসার করেননি। অবিশ্যি করবার মত তাঁর ফুরসৎ বা মনের তাগিদও ছিল না।
কোন সন্তানাদি ছিল না ব্রজদুলালের। গচা লেনে বিরাট বাড়ি করবার পর বলতে গেলে সেখানে তিনি এবং লোকজনের মধ্যে চারজন ভৃত্য, দুজন ঠাকুর, দুজন দারোয়ান, ড্রাইভার ও একজন অল্পবয়েসী সেক্রেটারী ছিল—ভারতীয় খৃষ্টান, বছর চব্বিশের তরুণী, রেবেকা।
রেবেকাকে থাকবার জন্য তিনতলায় দুটো ঘর ছেড়ে দিয়েছিলেন ব্রজদুলাল।
০২. সাহার গৃহে রেবেকা
সাহার গৃহে রেবেকা কেবল সেক্রেটারীই নয়, বাড়ির কেয়ারটেকার হিসাবেও ছিল। আর ছিল একজন, সাধন মিত্র।
সাধন ছিল সাহার অফিসে তাঁর পাসোন্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। একই গ্রামে ছিল সাধনের বাড়ি।
গ্রামের স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতা শহরে ভাগ্যান্বেষণে এসেছিল সাধন। এবং কোথাও অনেক চেষ্টা করে, কোন সুবিধা করতে না পেরে অবশেষে একদিন ব্রজদুলালের শরণাপন্ন হয়।
কি জানি কেন যে ব্রজদুলাল কোন আত্মীয়স্বজনকে তো নয়ই, এমন কি গ্রামের পরিচিত বা অন্যান্য ভাবে পরিচিত কাউকেই কখনও সাহায্য করতেন না। বলতেন, আত্মীয়স্বজন বা পরিচিত জন কাউকেই আমি কোন সাহায্যই করতে চাই না—
কারণ হয়ত তার একটা ছিল কিন্তু সেটা কেউ জানত না, অথচ ব্রজদুলালের ভাইপো ভাইঝি ছিল। তাদের কখনও নিজের গৃহে প্রবেশ তো দূরের কথা, তাদের কখনও কোন খোঁজখবর নিতেন না। সেই ব্রজদুলাল সাহাই সাধনকে শুধু পড়ার ব্যবস্থাই যে করে দিলেন তা নয়। নিজের গৃহে স্থানও দিলেন। এবং সেই থেকে সাধন ব্রজদুলালের গৃহেই থেকে যায়।
সেও আজ থেকে বছর বারো-তেরো আগেকার কথা।
ব্রজদুলালের ব্যবসাও তখন আজকের মত বিরাট ফলাও হয়ে ওঠেনি। অবস্থাও এমনি শাঁসালো হয়ে ওঠেনি। ছোটখাটো একটা লোহার কারবার মাত্র এবং থাকেন তিনি তখন গড়িয়ার দিকে ছোট বাসা-বাড়ি নিয়ে।
কিছুদিন আগে স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে। একটিমাত্র ভৃত্য নিয়ে তাঁর সংসার।
তারপরই লাগলো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ একদিন এবং মাত্র বছর চারেকের মধ্যে কোথা দিয়ে কোন্ পথে যে চঞ্চলা লক্ষ্মী তাঁর সোনার ঝাঁপটি হাতে নিয়ে ব্রজদুলালের গৃহে অচঞ্চলা হয়ে বসলেন—ফলে দেখতে দেখতে চার বছরের মধ্যেই দেখা গেল ব্রজদুলাল তিনটি খনির মালিক ও সাহা অ্যাণ্ড স্টীল কোম্পানীর ম্যানেজিং ডাইরেক্টার! কথায় বলে পুরুষস্য ভাগ্যম। সেটার প্রকৃষ্ট প্রমাণ যেন ঐ ব্রজদুলাল সাহা।
সাধনেরও আপনার বলতে ত্রিসংসারে কেউ ছিল না। ছোটবেলায় একই দিনে কলেরায় মা-বাপ হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল সে গাঁয়ে দূরসম্পকীয় এক দিদির বাড়িতে।
গ্রামের স্কুল থেকে ম্যাট্রিকটা পাস করবার পর দিদির আশ্রয়ে আর ভার-বোঝা না হয়ে থেকে একদিন সামান্য একটি সুটকেসে খান দুই জামা-কাপড় নিয়ে কলকাতায় এসে উপস্থিত হল। পাইস হোটেলে খেয়ে এখান-ওখানে অনেক ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু কোন সুরাহাই হয় না। অবশেষে একদিন ব্রজদুলালের অফিসে গিয়ে সাহসে ভর করে দেখা করল। গ্রামের কৃতী পুরুষ ব্রজদুলাল যদি একটা হিল্লে করে দেন এই আশায়। ব্রজদুলাল ছেলেটির চেহারায় ও তার সঙ্গে কথা বলে মুগ্ধ হলেন। স্থান দিলেন নিজের গৃহে। ব্রজদুলালের আশ্রয়ে মাথা খুঁজতে পেরে সে যেন বেঁচে গিয়েছিল। যেমন সুন্দর স্বাস্থ্যবান চেহারা তেমনি তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। ব্রজদুলালের কাছে সাধন একটা চাকরিই চেয়েছিল কিন্তু ব্রজদুলাল বললেন, চাকরি দেখা যাবে পরে, এখন পড়াশুনা কর।
পড়ব, কিন্তু……
কিন্তু দিয়ে দরকার নেই—কালই কলেজে ভর্তি হয়ে যাও।
.
সাধন কলেজে ভর্তি হয়ে গেল। ক্রমে সে কৃতিত্বের সঙ্গে অর্থনীতিতে এম. এ. পাস করবার পর ব্রজদুলাল তাঁর নিজের অফিসেই সাধনকে ঢুকিয়ে দিলেন।
সত্যিই ঐ সুন্দর, স্বাস্থ্যবান, বুদ্ধিদীপ্ত অথচ বিনয়ী, নম্র ছেলেটিকে পুত্ৰাধিক ভালবেসেছিলেন ব্রজদুলাল। এবং অনেকেরই ধারণা হয়েছিল—নিজের ভাইপো-ভাইঝিদের বঞ্চিত করে হয়ত ব্রজদুলাল তাঁর সব কিছুই একদিন ঐ সাধনকেই দিয়ে যাবেন।
ইদানীং এমন হয়েছিল সাধন না হলে ব্রজদুলালের কোন কাজই হত না। সকল ব্যাপারের পরামর্শদাতা ছিল ঐ সাধন মিত্র। সাধন একতলায় থাকত অফিস-ঘরের পাশের ঘরটিতেই—অর্থাৎ ব্রজদুলালের গচা লেনের বাড়িতেই।
০৩. পুলিসের রিপোর্ট
ব্যবসা-সংক্রান্ত ব্যাপারেই দিন-পনের আগে ব্রজদুলালকে মাদ্রাজে যেতে হয়েছিল এবং কথা ছিল দিন-কুড়ি আগে সেখানে তিনি থাকবেন।
কিন্তু সাতদিনের মাথায় অফিস থেকে সকালবেলা আটটা নাগাদ অকস্মাৎ একটা জরুরী ট্রাঙ্ক কল পেয়ে ব্রজদুলালকে কলকাতায় ফিরে আসতে হয় ঠিক নিহত হবার রাত্রে—সন্ধ্যায় ভাইকাউন্টে।
সন্ধ্যা রাত সোয়া সাতটা নাগাদ গৃহে এসে পৌঁছান এয়ারপোর্ট থেকে ব্রজদুলাল তাঁর নিজেরই গাড়িতে গচা লেনের বাড়িতে।
রাত আটটা থেকে নটা তাঁর শোবার ঘরে সাধনের সঙ্গে কি সব কথাবার্তা হয়। তার পরই সাধনকে তিনি একটি জরুরী ব্যাপারে সেই রাত্রেই গাড়ি নিয়ে পাটনায় মাসখানেক পূর্বে সাহা অ্যাণ্ড স্টীল কোম্পানীর নতুন ব্রাঞ্চ অফিস খোলা হয়েছিল, সেই অফিসে যেতে বলেন।
সাধন নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে রাত সাড়ে নটা নাগাদ চলে যায় পাটনায়।
যতদূর জানা গিয়েছে দুর্ঘটনার রাত্রে ব্রজদুলালের বাড়িতে তিনি এবং ভৃত্যের দলই ছিল। কারণ দুপুরের দিকে বের হয়ে গিয়ে রাত সাড়ে আটটার শোতে রেবেকা মেট্রোতে সিনেমা দেখতে যায়।
তাছাড়া সে জানত না যে ঐ রাত্রেই ফিরে আসবেন ব্রজদুলাল।
রাত দশটায় ডিনার শেষ করে ব্রজদুলাল শুতে যান।
রাত পৌনে এগারোটায় কুড়ি মিনিটের জন্য ঐ অঞ্চল নিষ্প্রদীপ হয়।
সোয়া বারোটায় রেবেকা সিনেমা থেকে ফিরে এসে তিনতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠবার সময় দোতলায় ব্রজদুলালের ঘরে আলো জ্বলতে দেখে। তার কৌতূহল হয় এবং গিয়ে দেখে ঘরের দরজা হা-হা করছে খোলা। খোলা দরজা-পথে উঁকি দিতেই ব্রজদুলালের ঘরের মধ্যের দৃশ্যটা তার চোখে পড়ে।
স্লিপিং গাউন ও পায়জামা পরিহিত ব্রজদুলাল সাহা একটা সোফার উপরে উপবিষ্ট, কিন্তু দেহের উধ্বাংশ ও মাথাটা সোফার হাতলের উপর থেকে অসহায়ভাবে নিচের দিকে ঝুলছে। একটা হাত ঝোলা অবস্থায় মাটিতে ঠেকে রয়েছে।
ঐভাবে ব্রজদুলাল সাহার চেয়ারে বসে থাকার সমস্ত ভঙ্গীটাই এমন যে—রেবেকা যেন সেদিকে দৃষ্টি পড়ামাত্রই ভয়ানক চমকে ওঠে।
কেমন সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে সে খোলা দরজা-পথে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ঝুলে-থাকা ব্রজদুলালের মুখটা সে দেখতে পায়।
চোখ দুটো যেন কোটর থেকে বের হয়ে আসছে। সমস্ত মুখে তখনও স্পষ্ট হয়ে রয়েছে। যেন অসহ্য যন্ত্রণার চিহ্ন। দুহাতের আঙুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ।
সামনের একটা গোলাকার শ্বেতপাথরের টেবিলের উপরে জ্বলছে সুদৃশ্য একটি টেবিল ল্যাম্প। তার পাশে একটি অর্ধসমাপ্ত ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটের বোতল, একটি দামী কাচের শূন্য গ্লাস উল্টে পড়ে আছে। তার পাশে সোডা সাইফন ও চাবির একটা রিং।
একটা অর্ধস্ফুট চিৎকার রেবেকার কণ্ঠ থেকে বের হয়ে আসে। প্রথমটায় ঘটনার আকস্মিকতায় কি করবে সে বুঝতে পারে না।
পাথরের মতই যেন কয়েকটা মুহূর্ত সেই ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে রেবেকা। একবার ভাবে সকলকে চিৎকার করে ডাকে।
কিন্তু সাহস হয় না। ব্রজদুলাল সাহা যে মৃত সে কথাটা বুঝতে রেবেকার কেন যেন দেরি হয়নি। তবু সম্বিৎ ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই-সোজা ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।
ভাবে, কি করা কর্তব্য—কি সে করবে!
অবশেষে কি মনে হওয়ায় পাশের ঘরে গিয়ে সাহার পারিবারিক চিকিৎসক ডাঃ চক্রবর্তীকে ফোন করে দেয় অবিলম্বে একবার আসার জন্য।
ফার্ণ রোডেই ডাঃ চক্রবর্তী থাকেন। ব্রজদুলালের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের পরিচয়। ফোন পেয়ে আধ ঘণ্টার মধ্যেই চলে আসেন তিনি।
রেবেকা বারান্দাতেই দাঁড়িয়েছিল, ডাঃ চক্রবর্তীর গাড়ির সাড়া পেয়ে নিজে গিয়ে দরজা খুলে দেয়।
ডাঃ চক্রবর্তী জিজ্ঞাসা করেন, কি ব্যাপার, কেমন আছেন মিঃ সাহা?
চলুন, দেখবেন।
উপরে গিয়ে ব্রজদুলালকে পরীক্ষা করেই বুঝতে পারেন ডাঃ চক্রবর্তী তিনি মৃত। এতটুকুও আর বিলম্ব না করে সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিকটবর্তী থানায় ফোন করে দেন। আরও আধ ঘণ্টা পরে থানা-অফিসার সুখময় মল্লিক এসে হাজির হন।
ডাঃ চক্রবর্তীর মৃতদেহ দেখেই মনে হয়েছিল, কোন তীব্র বিষের ক্রিয়ায় ব্ৰজদুলালের মৃত্যু ঘটেছে। তাই তিনি কালবিলম্ব না করে পুলিসকে খবর দিয়েছিলেন।
পুলিস অফিসার সুখময় মল্লিক ও ডাঃ চক্রবর্তীর প্রথমটায় ধারণা হয়েছিল ব্যাপারটা আত্মহত্যা। মদের সঙ্গে কোন তীব্র বিষপান করে তিনি বুঝি আত্মহত্যা করেছেন এবং সেইভাবে তদন্ত শুরু করেছিলেন সুখময় মল্লিক।
কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটা ওলট-পালট হয়ে গেল আকস্মিক ভাবে অকুস্থানে কিরীটীর আবির্ভাবে পরের দিন সকালে।
০৪. সুখময় মল্লিক যখন নীচের পারলারে
সুখময় মল্লিক যখন নীচের পারলারে বসে সকলের জবানবন্দি নিচ্ছেন—কিরীটী সেখানে গিয়ে উপস্থিত।
মল্লিকের সঙ্গে কিরীটীর পূর্বপরিচয় ছিল। কিরীটীকে আসতে দেখে ঐ সময় মল্লিক একটু যেন বিস্ময়ের সঙ্গেই শুধায়, কি ব্যাপার মিঃ রায়, আপনি?
কিরীটী বলে, কাল রাত দশটা নাগাদ মিঃ সাহা আমাকে ফোন করেছিলেন আজ সকালে আটটা নাগাদ একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্য।
কেন বলুন তো? মল্লিক যেন একটু বিস্ময়ের সঙ্গেই প্রশ্ন করেন।
কি একটা জরুরী ব্যাপারে তিনি আমার সাহায্য চান বলেছিলেন।
কি জরুরী ব্যাপার, কিছু বলেন নি আপনাকে?
না, তা অবিশ্যি কিছু ফোনে বলেন নি। কিন্তু আপনি এখানে—কি ব্যাপার বলুন তো সুখময়বাবু?
কিরীটীর জ্ঞাতার্থে সুখময় মল্লিক তখন গতরাত্রের সমস্ত ব্যাপারটা বিবৃত করেন।
সব শুনে কিরীটী তো একেবারে বোবা। বলে, সে কি! তিনি মৃত? হ্যাঁ।
খুব সম্ভবতঃ সুইসাইড বলে মনে হচ্ছে।
সুইসাইড!
হ্যাঁ, সেই রকম মনে হচ্ছে।
হুঁ, তা মৃতদেহ কোথায়?
ওপরে তাঁর শোবার ঘরে।
মৃতদেহটা আমি একবার দেখতে পারি?
নিশ্চয়ই। চলুন না।
আর কালবিলম্ব না করে কিরীটী সুখময় মল্লিকের সঙ্গে দ্বিতলে যায় এবং যে ঘরের মধ্যে তখনও সোফার উপরে মৃতদেহটা ছিল সেই ঘরে গিয়ে প্রবেশ করে।
মৃতদহের ভঙ্গীটাই যেন প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করে কিরীটীর।
মৃতদেহের ভঙ্গী দেখলে মনে হয় যেন মৃত্যুর কারণটাই যাই হোক না কেন, ঐ ভাবে চেয়ারের উপরে বসে বসে তাঁর মৃত্যু হয়নি।
মৃত্যুর পরে কেউ ব্রজদুলালকে ঐভাবে সোফাটার উপরে বসিয়ে দিয়েছে যেন।
মৃতের দুচোখে আতঙ্ক নয়, যেন এখনও বিস্ময়ের আকস্মিকতা স্পষ্ট হয়ে আছে।
কিরীটীর দিকে তাকিয়ে মল্লিক প্রশ্ন করে, কি মনে হচ্ছে আপনার মিঃ রায়?
আমার কিন্তু সেরকম মনে হচ্ছে না মিঃ মল্লিক। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী বলে।
মনে হচ্ছে না?
না।
তবে?
কি জানি কেন মনে হচ্ছে, দেহের ভঙ্গী যেন ঠিক আত্মহত্যা নয়। তাছাড়া কোন তীব্র বিষের ক্রিয়াতেই যদি আকস্মিক মৃত্যু ঘটে থাকে, মৃত্যু মুহূর্তের বিক্ষেপ ও কুঞ্চনের কোন চিহ্নই তো মৃতের দেহে দেখা যাচ্ছে না।
কথা বলে পুনরায় কিরীটী প্রখর দৃষ্টি নিয়ে মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে থাকে আরও কিছুক্ষণ।
দেখতে দেখতেই তার নজরে পড়ে মৃতের ঝুলন্ত ডান হাতের তর্জনীর দিকে। তর্জনীর মাথায় কালো একটা দাগ।
এগিয়ে গিয়ে মৃতের মুখটাও একবার তুলে দেখল। ঘাড়টা শক্ত হয়ে রয়েছে।
বুঝতে পারে কিরীটী, মৃতদেহে রাইগার মটিস সেটু ইন করেছে ইতিপূর্বেই।
তারপর তর্জনীর মাথার ছোট কালো দাগটিও বেশ কিছুক্ষণ ধরে পরীক্ষা করে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল।
মিঃ মল্লিক কিরীটীকে লক্ষ্য করতে থাকেন নিঃশব্দে।
এবারে ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখতে লাগল কিরীটী।
বেশ বড় সাইজের ঘর। চারিদিকে বড় বড় জানলা। দক্ষিণে একটিমাত্র জানলার কবাট ব্যতীত সব বন্ধ। এবং সব জানলাতেই পর্দা টানা। রুচি আভিজাত্য ও প্রাচুর্যের চিহ্ন—যা কিছু ঘরের মধ্যে আছে সবকিছুর মধ্যেই যেন বিরাজ করছে। একধারে কোণাকুনি একটি সিঙ্গল বেড।
মাথার ধারে ত্রিপয়ের উপরে ঈষৎ নীলাভ রংয়ের ফোন।
অন্যদিকে একদিকে একটি গডরেজের স্টীলের প্রমাণ সাইজের আলমারি, তার পাশেই দেওয়ালের মধ্যে গাঁথা একটি লোহার সে।
আর এক পাশে একটি কাচের ছোট আলমারি। তার মধ্যে কিছু ফরেন লিকারের বোতল ও কাচের গ্লাস ইত্যাদি সাজানো। এবং ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় সুদৃশ্য মাঝারি সাইজের একটি সোফা সেট।
আর কোন আসবাবপত্র নেই ঘরের মধ্যে। মেঝেতে দামী পুরু কাশ্মীরী কার্পেট বিস্তৃত। ঘরের মধ্যে দুটি দরজা।
একটি দরজা খোলাই ছিল। অন্য দরজাটি পাশের ঘরে যোগাযোগ রেখেছে। সেটা এ-ঘর থেকে বন্ধ। দুটি দরজায়ই ইয়েল লক লাগানো।
ঘরের সংলগ্ন বাথরুমও আছে। বাথরুমের দরজাটা ভেজানোই ছিল। বাথরুমের ভিতরে। গিয়েও একবার ঘুরে এল কিরীটী।
ফিরে এসে ঘরে ঢুকে আবার যেখানে সোফার উপরে মৃতদেহ ছিল সেখানে এসে দাঁড়াল।
সামনে ত্রিপয়ের উপরৈ টেবিল-ল্যাম্পটা তখনও জ্বলছিল।
নতুন ঝকঝকে দামী একটা টেবিল ল্যাম্প। প্লাগ পয়েন্টের সঙ্গে লাগানে! ল্যাম্পটা। ল্যাম্পের সঙ্গে যে সুইচ সেটা টিপে আলোটা নিভিয়ে দিল কিরীটী।
তারপরই হঠাৎ সুখময় মল্লিকের দিকে তাকিয়ে বললে কিরীটী, সব চাইতে পুরনো চাকর এ-বাড়িতে কে মিঃ মল্লিক?
জীবন।
তাকে একবার ডাকতে পারেন এ-ঘরে?
এখুনি ডাকছি। সুখময় ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
০৫. ভৃত্য জীবনকে সঙ্গে নিয়ে
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভৃত্য জীবনকে সঙ্গে নিয়ে সুখময় ঘরে এসে ঢুকলেন।
লোকটার বয়স হয়েছে। চামড়ার কুঞ্চন,ও চুলে পাক ধরেছে। বেঁটে-খাটো নাদুস-নুদুস চেহারা, ভারী একজোড়া গোঁফ। পরনে একটা ফসা ধুতি ও গায়ে অনুরূপ ফতুয়া।
কিরীটী লোকটার মুখের দিকে তাকাল।
বড় ড্যাবডেবে চোখ। চোখের দৃষ্টিতে কেমন যেন একটা ভীতি।
এর নামই জীবন, মিঃ রায়। সুখময় পরিচয় করিয়ে দিলেন।
তুমি বাবুর কাছে কত দিন আছ জীবন? কিরীটী প্রশ্ন করে।
আজ্ঞে তা প্রায় বছর চোদ্দ তো হবেই।
তোমার চাইতে তাহলে বোধ হয় পুরনো আর কেউ এ বাড়িতে নেই?
না।
বাবুর কাজকর্ম কে বেশী দেখাশোনা করত?
আজ্ঞে বরাবর আমিই করতাম।
তুমিই?
আজ্ঞে। এবং ঘরে আমি ছাড়া আর কোন চাকরবাকরকে তো তিনি ঢুকতেই দিতেন না।
হুঁ। আচ্ছা জীবন, দেখ তো এই ঘরের মধ্যে ভাল করে চেয়ে, কোন কিছু খোয়া গিয়েছে বা নতুন কিছু তোমার নজরে পড়ছে কিনা।
কিরীটীর নির্দেশে জীবন অনেকক্ষণ ধরে ঘরের চারিদিকে তাকাতে তাকাতে হঠাৎ মৃতের সামনে ত্রিপয়ের উপরে রক্ষিত টেবিল-ল্যাম্পটার দিকে তাকিয়ে বলে, আজ্ঞে ঐ টেবিল-ল্যাম্পটা–
কি?
ওটা তো ছিল না মনে হচ্ছে।
ঐ টেবিল-ল্যাম্পটা ছিল না?
আজ্ঞে না। ভাল করে দেখে বল।
জীবন আরও এগিয়ে গিয়ে ল্যাম্পটা দেখে বলে, না বাবু, এটা ছিল না। তবে অনেকটা এই রকমই দেখতে টেবিল-ল্যাম্প ছিল এখানে। এটা নতুন বলে মনে হচ্ছে। তাছাড়া সেটার ঢাকনাটা ছিল নীল রংয়ের রেশমী কাপড় ঝালর দেওয়া। আর এটা তো দেখছি সবুজ প্লাস্টিকের। না, এ সে ল্যাম্প নয়।
ঠিক বলছ?
আজ্ঞে।
এটা এর আগে দেখেছ?
না।
আচ্ছা জীবন, তোমার বাবু কি প্রত্যহ মদ খেতেন?
হ্যাঁ। শোবার আগে ঐখানে বসে প্রত্যহ খেতেন। এবং খেতে খেতেই রাত্রে সংবাদপত্র পড়তেন।
কিন্তু কোন কাগজ তো দেখছি না। কাল রাত্রে কি কাগজ পড়েননি?
কাল রাত্রে তো আমি কাগজ দিয়েছিলাম। তিনি নিজে চেয়ে নিয়েছিলেন কাগজটা।
কি কাগজ পড়তেন তিনি?
আজ্ঞে স্টেটসম্যান কাগজ।
কাল রাত্রে নিশ্চয়ই তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল?
আজ্ঞে।
কখন কাল রাত্রে তুমি তোমার বাবুকে শেষ জীবিত দেখ?
রাত সাড়ে নটায় সাধনবাবু ঘর থেকে চলে যাবার পরই বাবু আমাকে আবার নীচে থেকে ডাকেন।
কলিং বেল আছে নাকি এ ঘরে?
আছে। দুটো কলিং বেল, এই যে দেখুন না-সোফার গায়ে একটা, আর একটা খাটের সঙ্গে।
হুঁ। তারপর?
আমি ঘরে এলে বাবু আমাকে সোডা বোতল ও গ্লাস সব দিতে বললেন। আমি সব দেবার পর তিনি ঘরের দরজা বন্ধ করে দেন।
ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন কাল রাত্রে?
হ্যাঁ।
ঘরের দরজা বন্ধ করেই কি তিনি রোজ শুতেন?
হ্যাঁ। দরজা বন্ধ করেই বরাবর শুতেন।
আচ্ছা, ঐ যে বন্ধ দরজাটা দেখা যাচ্ছে—পাশের ঘরেরই তো?
হ্যাঁ।
পাশের ঘরটায় কেউ থাকে?
আজ্ঞে না। ওটা বাবুর প্রাইভেট চেম্বার। তবে বাড়িতে যখন কাজ করতেন ঐ ঘরে বসেই। করতেন।
ঐ দরজার তালার চাবিটা কোথায়?
চাবি কোথায় তা জানি না। তবে দরজাটা এ ঘর থেকে খোলা ও বন্ধ করা দুই গেলেও ও-ঘর থেকে চাবি ছাড়া খোলা যায় না।
কিরীটী অতঃপর দরজার চাবির নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকল।
ঘরটি মাঝারি আকারের। দুদিকের দেওয়ালে স্টীলের আলমারি ও কিছু স্টীলের র্যাক। র্যাকে ফাইল-পত্র সব সাজানো। মাঝখানে একটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি সুদৃশ্য দামী সেক্রেটারিয়েট টেবিল। একটি দামী গদী-মোড়া রিভলভিং চেয়ার ছাড়াও গোটাচারেক চেয়ার অন্যদিকে টেবিলে রয়েছে, টেবিলের উপরে একটি টেবিল-ল্যাম্প ও ফোন।
ঘরটি এয়ার-কণ্ডিশন করা। ঘরের জানলা দরজা সব বন্ধ এবং ভারী লাল রঙের দামী পর্দা ঝোলানো জানলায় দরজায়। মেঝেতে দামী কার্পেট বিস্তৃত। এ ঘরে ও দুটি দরজা। ঐ মধ্যবতী দরজাটা ছাড়াও অন্য একটি দরজা।
সেই দরজাটিও বন্ধ ছিল এবং কিরীটী পরীক্ষা করে দেখল—ঐ দরজাতেও ইয়েল লক সিস্টেম।
০৬. অফিস-রুমটা পরীক্ষার পর
অফিস-রুমটা পরীক্ষার পর কিরীটী সুখময়কে নিয়ে আবার নীচে এল যে ঘরে বসে সুখময় সকলের জবানবন্দি নিচ্ছিলেন।
সুখময় প্রশ্নটা করেন, তাহলে অন্যরকম কিছু বলেই তো আপনার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা, মিঃ রায়?
কিরীটী পাইপটায় পাউচ থেকে তামাক ভরতে ভরতে মৃদু কণ্ঠে বলে, আই অ্যাম সরি সুখময়বাবু, আমার কিন্তু সেরকমই বলে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা–
কি মনে হচ্ছে?
ইট ইজ নট এ কেস অফ সুইসাইড! মনে হচ্ছে ডেফিনিট কেস অফ হোমিসাইড!
হোমিসাইড? মানে হত্যা?
হ্যাঁ।
কিন্তু কেন?
দেখুন মিঃ মল্লিক, আপনার নজর পড়েছে কিনা জানি না—তবে আমার কিন্তু তিনটে ব্যাপার অত্যন্ত কুইয়ার লাগছে।
কুইয়ার লাগছে, কি?
প্রথমতঃ ধরুন লোকটার যে পরিচয় এখন পর্যন্ত আপনার কাছ থেকে পেয়েছি নিশ্চয়ই বলতে পারি আমরালোকটাসেলফ-মেড-ম্যান এবং জীবনে যাকে বলে সত্যিকারের সাকসেসফুল ম্যান, তাই। সেক্ষেত্রে এ ধরনের একজন লোক হঠাৎ কেন সুইসাইড করতে যাবেন?
তা অবিশ্যি—
দ্বিতীয়তঃ ধরুন, ঐ ধরনের লোকদের শত্রু থাকাটা এমন কিছু বিচিত্র যেমন নয়, তেমনি লোকটা যে একেবারে সাধু-চরিত্রের ছিলেন তাও মনে করবার কিছু নেই এবং সেক্ষেত্রে সেদিক থেকে গোপন আঘাত আসাটাও খুব একটা অস্বাভাবিক কি?
বুঝলাম না আমি ঠিক!
বুঝলেন না?
না।
লোকটা বিপত্নীক ছিল, অর্থ ছিল এবং কিছু কিছু দোষও যে ছিল তাও জেনেছি আমরা। আর–
আর?
সুন্দরী তরুণী সেক্রেটারীও ছিল এবং তার থাকবার ব্যবস্থাও এই বাড়িতেই। ওয়েল তবে কি আপনি মিঃ রায়— কিছুই আমি বলছি না সুখময়বাবু ব্যাপারগুলো শুধু চিন্তা করতে বলছি। এবং সেদিক দিয়ে চিন্তা করতে গেলে প্রব্যাবিলিটি কোথায় বেশী? হত্যার না আত্মহত্যার? তারপর কাম টু আওয়ার থার্ড পয়েন্ট—যে লোকটা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সুইসাইড করবে বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তার পক্ষে ব্যবসা-সংক্রান্ত ব্যাপার ডিসকাশন করে তার পার্সোন্যাল অ্যাসিস্টেন্টকে অমন কুল ব্রেনে পাটনা পাঠানো কি খুব স্বাভাবিক?
সুখময়বাবু চুপ করে থাকেন।
কিরীটী ইতিমধ্যে হস্তষ্কৃত পাইপটায় অগ্নিসংযোগ করেছিল। পাইপটায় গোটা দুই টান দিয়ে। বলে, আরও কয়েকটা ছোটখাটো ব্যাপার নিশ্চয়ই আপনার কাছে বিচিত্র লেগেছে!
কি বলুন তো?
প্রথমতঃ উপরের ঘরের ঐ টেবিল-ল্যাম্পটা! আগেরটা কোথায় গেল এবং নতুনটাই বা কে আনল এবং কেন আনা হল?
ল্যাম্পটা?
হ্যাঁ। দ্বিতীয়তঃ ঘরের যে দরজাটা নিজ হাতে ব্রজদুলাল বন্ধ করে দিয়েছিলেন, সেটা কে খুলল?
কেমন যেন বোকার মতই ফ্যালফ্যাল করে সুখময় মল্লিক কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে থাকেন। কি বলবেন জবাবে বুঝতে পারেন না। বলে কি লোকটা!
প্রথম দিককার তিনটি যে পয়েন্ট বললেন তার অবিশ্যি কিছু অর্থ হয়। কিন্তু শেষে যে কথাগুলো বললেন তার মাথামুণ্ডু কিছুই যেন বুদ্ধির গোচর হয় না মল্লিকের।
নতুন টেবিল-ল্যাম্পটা কোথা থেকে এল? ঐদিনের স্টেটসম্যান কাগজটা কোথায় গেল?
যে দরজাটা ব্রজদুলাল নিজে হাতে বন্ধ করে দিয়েছিলেন সে দরজাটা কে খুললে?
কিরীটী বোধ করি মল্লিকের মনের ভাবটা অনুধাবন করতে পারে।
অতঃপর মৃদু হেসে বলে, বসুন, সুখময়বাবু—আপনার জবানবন্দি নেওয়া নিশ্চয়ই শেষ করতে পারেননি এখনো?
না। সবে শুরু করেছিলাম।
তাহলে শেষ করুন।
আপনি যা বললেন তাই যদি হয় তো মিঃ রায় তাহলে এখন তো দেখছি সত্যি সত্যিই
ব্যাপারটা অন্য রকম দাঁড়াচ্ছে। সুখময় বসতে বসতে বলেন কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে।
হ্যাঁ, ব্রজদুলাল সাহাকে কেউ গতরাত্রে হত্যা করেছে যখন আমরা বুঝতেই পারছি, জবানবন্দির ব্যাপারেও দৃষ্টিটা আপনার সেই দিকেই দিতে হবে।
মৃদু শান্ত কণ্ঠে কিরীটী কথাগুলো বলে।
০৭. জবানবন্দি নেওয়া শুরু
জবানবন্দি নেওয়া শুরু করলেন অতঃপর সুখময় মল্লিক।
বাড়ির লোকজনেরা তখনও ঘরের বাইরে বারান্দাতেই সবাই দাঁড়িয়েছিল পুলিস প্রহরায়।
ভৃত্য জীবন, রামখেলন, হরি ও নারাণ। রাঁধুনী বামুন ব্রিজনন্দন। দারোয়ান মিশির ও ধনবাহাদুর। ড্রাইভার, কেরামউল্লা—অফিসের ড্রাইভার সেও থাকত ব্রজদুলালের গৃহে সার্ভেন্টস কোয়াটারে।
বাড়ির নীচের তলায় একেবারে পশ্চিম দিকে ভৃত্য ঠাকুর ও ড্রাইভারদের থাকবার জন্য আলাদা ব্যবস্থা। তারা সব ঐখানেই থাকে।
জীবন ব্রজদুলালের খাস ভৃত্য। সে একমাত্র ব্রজদুলালের কাজকর্ম ছাড়া অন্য কিছুই করত না।
নতুন লোক বলতে ওদের মধ্যে কেউই নয়।
চার-পাঁচ বছর ধরে সকলেই ঐ বাড়িতে কাজ করছে।
ভৃত্যদের মধ্যে জীবন আর নারাণ ব্যতীত অন্য কেউ তো বড় একটা উপরেই যেত না। কাজেই ভৃত্যদের কারও কাছ থেকেই জিজ্ঞাসাবাদ করে বিশেষ কোন নির্ভরযোগ্য সংবাদই পাওয়া গেল না।
সবাই রাত সাড়ে নটায় ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল একমাত্র ভৃত্য জীবন বাদে।
সে শুতে যায় রাত দশটা নাগাদ।
কিরীটী জীবনকেই একবার জিজ্ঞাস করে, রেবেকা রাত্রে কখন ফিরেছে, সে জানে কিনা?
জীবন বলে, জানি না।
দোতলায় উঠবার সিঁড়িতে কোলাপসিবল গেট দেখলাম জীবন, ওটা রাত্রে বন্ধ থাকে, না খোলা থাকে।
আমি শোবার আগে রাত সাড়ে দশটা নাগাদ রোজ বন্ধ করে দিই। জীবন জবাব দেয়।
কাল রাত্রে বন্ধ করেছিলে?
হ্যাঁ। রাত দশটায়।
রেবেকা তাহলে তিনতলায় গেল কি করে?
আজ্ঞে উনি তো প্রায়ই রাত করে ফেরেন—ওঁর কাছে ঐ গেটের একটা ড়ুপ্লিকেট চাবি আছে।
দারোয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল, রাত পৌনে বারোটা নাগাদ গতরাত্রে রেবেকাকে সে গেট খুলে দিয়েছে।
কিরীটী শুধোয়, আচ্ছা মিশির, কাল রাত্রে সাধনবাবুর বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়া ও রেবেকার রাত্রে ফেরা ছাড়া আর কেউ রাত সাড়ে নটার পরও এ বাড়ি থেকে বের হয়েছে বা এসেছে কিনা মনে পড়ে?
জী, না।
বাবু যে কদিন বাড়িতে ছিল না তার মধ্যে অপরিচিত কেউ এ বাড়িতে এসেছে?
হ্যাঁ।
কে?
একজন বুড়ো সাহেব।
একজন বুড়ো সাহেব?
জী।
সে কেন এসেছিল?
সে বলেছিল সে মেমসাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চায়। সে নাকি মেমসাহেবের আত্মীয়।
দেখা করেছিল বুড়ো সাহেব রেবেকার সঙ্গে।
তা জানি না, তবে ভিতরে গিয়েছিল।
কিরীটী তখন জীবনকে ডেকে সাহেবের কথা জিজ্ঞেস করে। সাহেব সম্পর্কে সে কিছু জানে কিনা।
জীবন বলে, হ্যাঁ, সেই বুড়ো সাহেব মেমসাহেবের সঙ্গে দেখা করেছিল। মেমসাহেব সে-সময় বাবুর চেম্বারে কি সব লেখাপড়া করছিল। সাহেবের কথা বলতে তিনি সাহেবকে ঐ ঘরে পাঠিয়ে দিতে বলেন। আমি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।
সাহেব কতক্ষণ ছিল?
তা প্রায় ঘণ্টাখানেক তো হবেই। জীবন বলে।
আর একটা কথা জীবন, সাধনবাবু কাল সে-সময় কি বাড়িতেই ছিলেন? কিরীটী আবার। প্রশ্ন করে।
আজ্ঞে না।
সাধনবাবু তাহলে কাল সারাদিন বাড়িতে ছিলেন না তুমি বলছ জীবন?
আজ্ঞে।
.
সবার শেষে রেবেকাকে ঘরে ডাকা হল।
বছর চব্বিশ বয়স হবে রেবেকার। নিঃসন্দেহে রেবেকাকে সুন্দরী বলা চলে। গায়ের রঙ চকচকে না হলেও বেশ ফর্সা। রোগা দোহারা দীঘাঙ্গীই বলা চলে। মুখখানি লম্বাটে ধরনের হলেও চোখ নাক ও হৃ দুটি সত্যিই সুন্দর। গতরাত্রের প্রসাধনের প্রলেপটা তখনও কিছু অবশিষ্ট আছে।
পরিধানে দামী একটা তাঁতের কালো সরুপাড় শাড়ি। হাতে চারগাছি করে সরু সোনার চুড়ি।
ভারতীয় খ্রীশ্চান না জানা থাকলে এবং হঠাৎ দেখলে অবস্থাপন্ন বাঙালী গৃহস্থঘরের মেয়ে বলেই মনে হবে বুঝি রেবেকাকে।
আপনারই নাম মিস রেবেকা মণ্ডল? থানার ওসি মিঃ মল্লিক প্রশ্ন শুরু করেন।
হ্যাঁ।
এখানে আপনি ব্রজদুলালবাবুর সেক্রেটারী হয়ে ছিলেন?
হ্যাঁ।
কতদিন এখানে আছেন?
এক বছর পাঁচ মাস।
এক্সকিউজ মি, কত করে মাইনে পান আপনি?
হঠাৎ ঐ সময় কিরীটীই প্রশ্নটা করে রেবেকা মণ্ডলকে।
কিরীটীর প্রশ্নে রেবেকা ওর মুখের দিকে ক্ষণেকের জন্য তাকাল, তারপর মৃদু কণ্ঠে বললে, পাঁচশো টাকা।
পাঁচশো টাকা! কিরীটী কথাটা পুনরাবৃত্তি করে।
হ্যাঁ।
কিরীটী টাকার অঙ্কটা শুনে কয়েক মুহূর্ত ওর চোখের দিকে চেয়ে থাকে।
তারপর ধীরে ধীরে বলে, তার মানে মাইনের ঐ পাঁচশো টাকা একরকম আপনার অল ফাউই ছিল। কারণ থাকা-খাওয়া যখন আপনার এইখানেই ছিল।
তা বলতে পারেন।
হুঁ। Decent pay! কতকটা যেন আত্মগত ভাবেই কথাটা নিম্নকণ্ঠে উচ্চারণ করে কিরীটী আবার। ও সি-র দিকে তাকিয়ে বলে, Yes carry on–
আবার প্রশ্ন শুরু হয়।
মিস মণ্ডল, আপনার আপনজন কে আছে?
আপনার বলতে আমার সংসারে এক মামা। তিনি আসানসোলে স্টেশনমাস্টার।
আর কোন আত্মীয়স্বজন–
না।
আচ্ছা, বাড়ি কোথায় আপনার?
মুর্শিদাবাদ।
সেইখানেই কি বরাবর থাকতেন?
ম্যাট্রিক পাশ করা পর্যন্ত সেখানে ছিলাম।
কিন্তু আপনি তো বললেন আপনার বলতে এক মামা ছাড়া আর কেউ নেই।
এক পিসী ছিল, বছর দেড়েক হল মারা গেছেন। তাঁর কাছেই থাকতাম মুর্শিদাবাদে।
কতদূর পড়াশুনা করেছেন?
আই এ পাশ করে স্টেনো টাইপিং শিখেছি।
এখানে চাকরি নিয়ে আসবার আগে কোথাও চাকরি করেছেন?
হ্যাঁ, বছর দুই কলকাতাতে একটা বিলাতী ফার্মে স্টেনো-টাইপিস্ট ছিলাম। সেখান থেকেই সাহা স্টীল অ্যাণ্ড কোম্পানীতে চাকরি পাই। এক বছর অফিসে কাজ করবার পর মিঃ সাহা আমাকে পাসোন্যাল সেক্রেটারী করে এখানে নিয়ে আসেন।
আপনার বস কেমন লোক ছিলেন বলে আপনার ধারণা?
হি ওয়াজ এ পারফেক্ট জেন্টলম্যান। ঠাণ্ডা মেজাজের এবং অত্যন্ত ধীর-স্থির প্রকৃতির লোক ছিলেন। নিজের এমপ্লয়িদের উপরে তাঁর অত্যন্ত দরদ ছিল। তাই তো অবাক হয়ে গিয়েছি, কেন তিনি ঐভাবে আত্মহত্যা করলেন!
রেবেকা মণ্ডলের কথা শুনে মনে হল তার বস ব্রজদুলাল সাহার আকস্মিক আত্মহত্যায় সে শুধু ব্যথিতই নয়, বিস্মিতও।
০৮. কিছুক্ষণ অতঃপর সকলেই চুপ
কিছুক্ষণ অতঃপর সকলেই চুপ করে থাকে। ঘরের মধ্যে একটা স্তব্ধতা বিরাজ করে।
সেই স্তব্ধতা আবার ভঙ্গ করল কিরীটীই। সে-ই প্রশ্ন করল।
আপনার ধারণা তাহলে মিস মণ্ডল, মিঃ সাহা আত্মহত্যাই করেছেন?
আত্মহত্যা যে করেছেন কথাটা বুঝতে কারোরই কষ্ট হবার তো কথা নয় মিঃ রায়।
কিন্তু কথা হচ্ছে তাই যদি হয়ে থাকে সত্যি তো নিশ্চয় ঐভাবে আহত্যা করার কোন তাঁর কারণ ছিল বা ঘটেছিল!
হবে।
ব্যাপারটায় কোন রকম আলোকসম্পাত করতে পারেন আপনি?
না। আই অ্যাম র্যাদার বিউইলডার্ড।
আচ্ছা মিস মণ্ডল, আপনি যখন তাঁর পার্সোন্যাল সেক্রেটারী ছিলেন নিশ্চয়ই তাঁর আপনি কনফিডেন্স-এ ছিলেন? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
তা ছিলাম।
তাঁর ব্যবসা-সংক্রান্ত ও ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও নিশ্চয়ই আপনি অনেক কিছু জানেন আশা করতে পারি? জিজ্ঞাসা করলেন এবার ও সি।
তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছুই বলতে পারব না, কারণ তিনি ও-ব্যাপারে অত্যন্ত রিজার্ভড ছিলেন। তবে তাঁর বিজনেস সংক্রান্ত ব্যাপারে অনেক কথাই জানি।
বিজনেসের অবস্থা তাঁর কেমন ছিল?
দেখুন, ও ব্যাপারে জানেন—আমার ধারণা—মিঃ মিত্র, আমার চাইতেও বেশী।
ইউ মিন সাধনবাবু?
হ্যাঁ। তবে আমি যতদূর জানি তাঁর বিজনেসের অবস্থা ক্রমশঃ ভালর দিকেই উত্তরোত্তর যাচ্ছিল।
আচ্ছা, এই সাধনবাবু লোকটিকে আপনার কেমন মনে হয় মিস মণ্ডল?
খুব ভদ্র, অমায়িক।
আপনার সঙ্গে আলাপ কেমন?
এক বাড়িতে থাকি, সর্বদা দেখাশোনা হয়, সেদিক দিয়ে আলাপ তো একটু বেশী হবারই
কথা।
তা অবিশ্যি ঠিক। আমি জিজ্ঞাসা করছিলাম লোকটিকে কেমন মনে হয় আপনার? কিরীটীই প্রশ্ন করে।
খুব ইনটেলিজেন্ট আর অ্যামবিশাস।
ইউ লাইক হিম?
কি বলতে চান আপনি?
সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নটা করে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় মিস রেবেকা মণ্ডল কিরীটীর দিকে।
একটু যেন অসন্তুষ্ট হয়েছে বলেও সে মনে হয় কারণ ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে ওঠে রেবেকার।
না। এই বলছিলাম আর কি, ভদ্রলোকটিকে আপনার ভাল লাগে কিনা?
সত্যিকারের কোন ভদ্রলোককে না ভাল লাগবার তো কোন কারণ থাকতে পারে না।
তা অবিশ্যি ঠিক। আচ্ছা ভাল কথা মিস মণ্ডল, কাল দুপুরে কে একজন সাহেব আত্মীয় আপনার শুনলাম দেখা করতে এসেছিলেন? আপনার সেই মামা নাকি?
মামা? কই না!
তবে কে এসেছিলেন আপনার সঙ্গে দেখা করতে কাল দুপুরে?
কাল দুপুরে?
হ্যাঁ।
ও হ্যাঁ, মনে পড়ছে। মিঃ আথার মুর, সিংগাপুর থেকে এসেছিলেন মিঃ সাহার সঙ্গে দেখা করতে, এজেন্সীর ব্যাপারে।
কিন্তু তিনি জীবনকে বলেছিলেন তিনি নাকি আপনার আত্মীয়!
ননসেন্স! একথা বলতেই পারে না। জীবন বলেছে ঐ কথা?
হ্যাঁ।
ওর কথায় কান দেবেন না আপনারা।
কেন বলুন তো?
লোকটা একের নম্বরের মিথ্যাবাদী। লায়ার!
তাই বুঝি?
হ্যাঁ, ডাইনে-বাঁয়ে অকারণ মিথ্যে কথা বলে লোকটা।
তা কি করে জানলেন যে লোকটা মিথ্যাবাদী?
বহুবার বহু প্রমাণ পেয়েছি।
মিঃ সাহা জানতেন কথাটা?
জানতেন বৈকি। আর সেই জন্যই পুরনো বিশ্বাসী লোক হলেও ওকে তেমন পছন্দ করতেন না।
লোকটা তাহলে বিশ্বাসী?
অন্ততঃ মিঃ সাহার তাই ধারণা ছিল।
আপনার?
বিশ্বাসী বলেই মনে হয়।
ঐ সময়কার মত জবানবন্দি শেষ করে থানার ও সি সুখময় মল্লিক উঠে দাঁড়ান।
কিরীটীও বিদায় নেয় অতঃপর।
০৯. পাটনা থেকে ফিরে এল সাধন মিত্র
ঐদিনই সন্ধ্যার দিকে পাটনা থেকে ফিরে এল সাধন মিত্র। এবং বাড়িতে পৌঁছে ব্রজদুলালের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে তো একেবারে স্তম্ভিত।
কিরীটী সুখময় মল্লিককে পূর্বেই বলে রেখেছিল সাধন মিত্র ফিরলেই যেন তাকে একটা সংবাদ দেওয়া হয়।
যে পুলিস অফিসারটিকে কিরীটীর নির্দেশেই সুখময় মল্লিক গচা লেনের বাড়িতে প্রহরায় রেখে গিয়েছিলেন তাঁর কাছ থেকে ফোনে সাধন মিত্রের পৌঁছানো সংবাদ পেয়েই সুখময় কিরীটীকে সংবাদটা দেন। এবং সাধন মিত্র গচা লেনের বাড়িতে এসে পৌঁছবার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই কিরীটী সুখময়কে সঙ্গে নিয়ে গচা লেনের বাড়িতে এসে হাজির হল।
.
সন্ধ্যার অন্ধকার তখন চারিদিকে ঘনিয়ে এসেছে।
বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতেই ভৃত্য জীবন এগিয়ে এল।
জীবন!
আজ্ঞে?
সাধনবাবু আছেন বাড়িতে? সুখময় মল্লিকই প্রশ্ন করেন।
আজ্ঞে হ্যাঁ, উপরে আছেন তাঁর ঘরে।
তাঁকে একবার খবর দাও, বল আমরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই।
বসুন, আমি খবর দিচ্ছি।
জীবন ওঁদের পারলারে বসিয়ে খবর দিতে গেল।
বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সাধন মিত্র এসে পারলারে প্রবেশ করল।
সাধন মিত্রের চেহারাটা সত্যিই দেখবার মত।
বেশ পরিষ্কার গায়ের রঙ। সুন্দরই বলা চলে। মুখে কয়েকটা বসন্তের ক্ষতচিহ্ন। চক্ষু দুটি বুদ্ধিদীপ্ত। ছুরির ফলার মত যেন ধারাল চোখের দৃষ্টি।
সাধন মিত্রের দিকে তাকিয়ে সুখময় মল্লিকই প্রশ্ন করেন, সাধন মিত্র আপনার নাম?
হ্যাঁ।
বসুন।
কিরীটী একদৃষ্টে চেয়ে চেয়ে দেখছিল সাধন মিত্রকে, মুখের মধ্যে কোথাও কোন সেরকম বেদনা বা দুশ্চিন্তার চিহ্ন নেই।
বেশভূষাও পরিপাটি। এবং পোশাক দেখে মনে হয় বোধ হয় কোথাও বেরুচ্ছিল। পরিধানে দামী লংস, ডবল কপের শার্ট, গলায় দামী একটি আমেরিকান টাই।
সুখময় মল্লিক বসবার জন্য অনুরোধ করা সত্ত্বেও সাধন মিত্র কিন্তু বসে না। যেমন দাঁড়িয়ে ছিল তেমনিই থাকে।
সুখময় মল্লিক আবার বলেন, ব্যাপারটা নিশ্চয়ই আপনি শুনেছেন সাধনবাবু?
হ্যাঁ। মৃদু শান্তকণ্ঠে প্রত্যুত্তর দেয় সাধন মিত্র।
এখানে এসেই খবরটা পেলেন বোধ হয়? সুখময় আবার জিজ্ঞাসা করেন।
হ্যাঁ, terribly shocking! তাছাড়া রেবেকা বলছিল—
কি বলছিলেন মিস মণ্ডল? কিরীটীই এবার প্রশ্নটা করে।
বলছিল, আপনাদের ধারণা নাকি ব্যাপারটা হত্যা, homicide!
হ্যাঁ। জবাব দেন সুখময় মল্লিক।
কিন্তু–
হ্যাঁ, কারণ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট যদিও এখনও আমরা পাইনি—সুখময়ই কথা বলেন, তবু ব্যাপারটা যে আত্মহত্যা নয়—হত্যা, সেটাই আমাদের ধারণা।
সাধন মিত্র চোখ তুলে তাকাল সুখময়ের দিকে, হত্যাই তাহলে আপনাদের স্থির ধারণা?
হ্যাঁ।
কিন্তু হঠাৎ কে তাঁকে হত্যা করতে যাবে আর কেনই বা করবে, এটা তো আমি বুঝতে পারছি না মিঃ মল্লিক! সাধন মিত্র বলে।
Why and why অর্থাৎ কে করতে পারে আর কেন করল সেটুকু জানতে পারলে তো আমাদের যাবতীয় মুশকিল আসানই হয়ে যেত সাধনবাবু। কিন্তু আপনার কি ধারণা, ব্যাপারটা তা নয়? সুখময় মল্লিক শুধান।
To tell you frankly, আমার অন্ততঃ তা মনে হয় না। কারণ আপনারা জানেন না, কিন্তু আমি তাঁকে অনেকদিন ধরে জানতাম। তাঁর কোন শত্রু থাকতে পারে আমি বিশ্বাসই করতে পারি না। তাছাড়া–
বলুন, থামলেন কেন?
না। কিছু না। আই সিমপ্লি ডোন্ট বিলিভ ইট, রাদার আই কান্ট বিলিভ ইট, আমি বিশ্বাস করতে পারি না।
সহসা ঐ সময় কিরীটী শান্তকণ্ঠে সাধন মিত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, তাহলে কি আপনার ধারণা মিঃ মিত্র, উনি আত্মহত্যাই করেছেন?
সত্যি কথা বলতে কি, সেরকম কিছুও আমি ভাবতে পারছি না। কেনই বা আত্মহত্যা তিনি করতে যাবেন? সাধন মিত্র বলে।
কেন?
মিঃ সাহা সত্যিকারের বুদ্ধিমান, বিবেচক ও স্থিতধী লোক ছিলেন। আত্মহত্যা করবার মত টেম্পারামেন্ট কোনদিনই তাঁর ছিল না। তাছাড়া–
তাছাড়া?
তাছাড়া মান যশ অর্থ প্রতিপত্তি সবই তো বেশি পেয়েছিলেন এবং যতদূর জানি খুশিই ছিলেন। সেক্ষেত্রে হঠাৎ কেন আত্মহত্যা করতে যাবেন?
আচ্ছা মিঃ মিত্র—কিরীটীই আবার কথা বলে।
বলুন?
অফিস-সংক্রান্ত কাজেই শুনলাম আপনি মিঃ সাহাকে নাকি মাদ্রাজ থেকে আকস্মিক ভাবে ট্রাঙ্ক কল করে ডেকে এনেছিলেন?
হ্যাঁ, এনেছিলাম। পাটনার ব্রাঞ্চ অফিস সংক্রান্ত একটা জরুরী ব্যাপারে তাঁর উপস্থিতির প্রয়োজন হয়েছিল বলে তাঁকে ডেকে আনতে বাধ্য হয়েছিলাম।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তো তিনি পাটনা যাননি?
না। আমাকেই পাঠিয়েছিলেন।
আচ্ছা মিঃ মিত্র, আপনি তাঁর পাসোন্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন এবং আপনাকে তিনি যেমন স্নেহ করতেন তেমনি বিশ্বাসও করতেন শুনেছি।
ঠিক শুনেছেন।
তাঁর জীবনের অনেক কথাই আশা করতে পারি আপনি জানেন?
কি জানতে চান বলুন স্পষ্ট করে, জানা থাকলে নিশ্চয়ই বলব।
মিঃ মিত্র?
বলুন।
তাঁর সম্পর্কে অনেক কথাই বললেন কিন্তু একটা কথা বলেননি।
কি বলিনি?
বলছিলাম তাঁর চরিত্র কেমন ছিল? বহুদিন ধরে তিনি বিপত্নীক ছিলেন শুনেছি—
সেরকম একটু-আধটু দুর্বলতা মানুষ মাত্রেরই থাকে, বিশেষ করে ঐরকম বয়েসে উইডোয়ার হলে।
তাহলে খুলেই বলি মিঃ মিত্র—কিরীটী বলে, আমি জানতে চাইছিলাম তাঁর সঙ্গে রেবেকা মণ্ডলের সম্পর্কের কথাটা।
মুহূর্তকাল সাধন মিত্র চুপ করে থাকে, তারপর মৃদু একটা হাসি তার ওষ্ঠপ্রান্তে দেখা দেয়।
কই, জবাব দিলেন না তো আমার প্রশ্নের? কিরীটী আবার বলে।
বোধ হয় একটু দুর্বলতা ছিল ঐ দিকে তাঁর।
শুধু দুর্বলতাই।
হ্যাঁ। আর কি বলব বলুন!
আর কিছু জানেন না আপনি?
দেখুন, তাঁকে আমি অত্যন্ত ভক্তি করতাম, শ্রদ্ধা করতাম। এবং আপনারা শুনেছেন কিনা জানি না, তাঁর স্নেহ ও সাহায্য না পেলে আজ আমি যা হয়েছি তা হতে পারতাম না। আর বেশী কিছু তাঁর সম্পর্কে আমার পক্ষে বলা সম্ভবপর নয়। আমাকে ক্ষমা করবেন।
১০. কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলে না
অতঃপর উভয় পক্ষই কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলে না।
সুখময় মল্লিক বোধ হয় ভাবছিলেন, আর কি প্রশ্ন তাঁদের থাকতে পারে সাধন মিত্রকে।
কিরীটীর মুখের দিকে তাকান সুখময় মল্লিক।
কিরীটী একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করছিল একটা জ্বলন্ত কাঠি দিয়ে, সিগারটা ধরে উঠলে কাঠিটা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে ফেলে দিয়ে তাকাল আবার সাধন মিত্রের মুখের দিকে।
আচ্ছা মিঃ মিত্র, মিঃ সাহার আত্মীয়স্বজন কে কোথায় আছে জানেন কিছু?
তাঁর বড় ভাইয়ের দুটি ছেলে ও একটি মেয়ে আছে জানি।
দুই ছেলে, এক মেয়ে?
হ্যাঁ। এবং তাঁদের সম্পর্কে যতটুকু জানি—একজন প্রশান্ত সাহা, বেশীদূর লেখাপড়া শেখেননি, এই কলকাতা শহরেই অ্যালান ইলেকট্রিক্যালস কোম্পানীতে চাকরী করেন। বিয়ে-থা শুনেছি করেননি। দ্বিতীয় সুশান্ত সাহা আই. এ. পর্যন্ত পড়েছিলেন, শেয়ার মার্কেটের দালাল, ভালই বোধ হয় উপায় করেন। তবে নেশা ও রেসের মাঠে শুনেছি পকেট সর্বদাই খালি থাকে। ভাইঝি শ্রীমতী দেবী, হাসপাতালের নার্স। বিয়ে-থা করেননি।
তাঁরা এ বাড়িতে যাতায়াত করেন না?
শ্ৰীমতী দেবী দু-একবার মনে পড়ে এসেছেন। তবে ভাইপোদের কখনও তিনি বাড়িতে ঢুকতে দিতেন না। তবু অবিশ্যি মধ্যে মধ্যে সুশান্ত ঝড়ের মত তাঁর অফিসে গিয়ে হাজির হতেন।
কেন?
টাকার জন্য।
টাকা দিতেন মিঃ সাহা ভাইপোকে?
দিতেন। ভীষণ চটে রাগারাগি করতেন, কিন্তু দিতেন। কারণ আমার মনে হয়েছে বরাবর, ঐ জুয়াড়ী, নেশাখোর উচ্ছৃঙ্খল লোকটাকে মুখে রাগারাগি করলেও উনি ভালই বোধ হয় সত্যি বাসতেন তাঁকে ভাইপো-ভাইঝিদের মধ্যে।
আচ্ছা, প্রশান্তবাবু আসতেন না কখনও তাঁর কাকার কাছে?
না। আসতে তাঁকে কখনও দেখিনি।
আচ্ছা সাধনবাবু, কোন উইল মিঃ সাহা করে গিয়েছেন বলে জানেন?
করেছেন বলেই জানি।
নিশ্চয় করে জানেন না কিছু।
না। তবে আপনি সাহা কোম্পানীর সলিসিটার রূপচাঁদ চ্যাটার্জীকে জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন। তিনি সব জানেন।
সাধন মিত্রের কথাটা শেষ হল না, ঘরের মধ্যে সুট-পরিহিত সাতাশ-আঠাশ বৎসরের একটি সুশ্রী যুবক এসে ঢুকল।
আগন্তুক কারোর দিকে না তাকিয়ে একেবারে সোজাসুজি সাধনের দিকেই তাকিয়ে বলে, এই যে সাধন মিত্তির, হোয়াট অল দিস? কাকা নাকি সুইসাইড করেছে?
সাধন মিত্র কোন জবাব দেয় না। তার আগেই সুখময় মল্লিক আগন্তুকের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন, কে আপনি জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?
সুখময়ের প্রশ্নে আগন্তুক ফিরে তাকাল সুখময়ের দিকে, কে আমি? ইয়েস পুলিস অফিসার,
অফ কোর্স ইউ ক্যান আস্ক দ্যাট। আমার নাম সুশান্ত সাহা।
আপনি কার কাছে শুনলেন সুশান্তবাবু যে আপনার কাকা সুইসাইড করেছেন?
কার কাছে আবার—আজ অফিসে গিয়েই তো শুনলাম।
আজ কখন অফিসে গিয়েছিলেন আপনি? কিরীটী এবারে প্রশ্নটা করল।
কেন, দুপুরবেলা।
আপনার দাদা কোন সংবাদ পাননি?
গড নোস!
আপনি দেননি?
নো স্যার।
কেন?
কেন আবার কি? ইট ইজ দেয়ার হেডেক, নট মাইন। কথাটা বলে সুশান্ত সাহা ঘর থেকে। বের হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু কিরীটীর ইঙ্গিতে সুখময় তাকে ডাকল, সুশান্তবাবু, কোথায় যাচ্ছেন?
উপরে।
কিরীটী বলে, এখন যাবেন না।
যাব না? বাট হোয়াই? কেন যাব না বলুন তো? তাছাড়া who are you?
আমি থানার ও সি—সুখময় বললেন।
O.C.–I see! তা আমি উপরে যাব না কেন—শুনতে পারি কি?
জীবিত থাকতে তিনি আপনার এবাড়িতে আসা যখন পছন্দ করতেন না তখন তাঁর উইল না জানা পর্যন্ত আপনাকে তো আমরা এ বাড়ির উপরে যেতে দিতে পারি না!
পারেন না! বাঁকা দৃষ্টিতে তাকাল সুশান্ত সুখময়ের দিকে।
না।
ননসেন্স! আমার নিজের কাকার বাড়ি এটা—আর আমরাই তাঁর সব।
তা আমরাও জানি সুশান্তবাবু-তবু সেটা এখনও প্রমাণসাপেক্ষ। কিরীটী শান্তকণ্ঠে বলে।
মানে! কি আবার প্রমাণসাপেক্ষ—আমরা তাঁর ভাইপো কিনা?
না। তাঁর মৃত্যুর পর আপনাদের এ বাড়িতে প্রবেশের কোন সত্যিকারের আইনত অধিকার আছে কিনা সেইটাই প্রামণসাপেক্ষ।
প্রমাণসাপেক্ষ। তা আমাদের নেই তো কার আছে শুনি? আইনত তাঁর যাবতীয় স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী আমরা ছাড়া আর কারা?
কথাটা আপনার যেমন মিথ্যা নয় সুশান্তবাবু তেমনি এও মিথ্যা নয় যে জীবিত থাকাকালীন কোনদিন আপনাদের এখানে তিনি প্রবেশ করতে দেননি।
কে বললে?
যেই বলুক কথাটা যে সত্যি, আপনি কি অস্বীকার করতে পারেন?
নিশ্চয়ই করি। নিশ্চয়ই ঐসব আজগুবী কথা সাধন মিত্তির বলেছে আপনাদের! ও কে? দেখে নেব সাধন মিত্তির, আমিও সুশান্ত সাহা–
কথাটা বলে সাধনের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বোধ হয় ঘর থেকে পুনরায় বেরিয়ে যাবার জন্য পা বাড়ায় দরজার দিকে সুশান্ত।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী আবার বাধা দেয়, যাবেন না সুশান্তবাবু, আপনার সঙ্গে আরও কিছু আমাদের কথা আছে।
ঘুরে দাঁড়াল সুশান্ত সাহা দরজার মাঝবরাবর গিয়ে এবং জ্ব-দুটো কুঁচকে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বলে, কথা আছে—আমার সঙ্গে?
হ্যাঁ।
কিন্তু আমার আপনার সঙ্গে কোন কথা নেই। বলে আবার পা বাড়াবার চেষ্টা করে সুশান্ত।
বাধা দিলেন এবারে সুখময় মল্লিক, আপনার না থাকলেও আমাদের আছে। দাঁড়ান।
আমি যদি না শুনি আপনাদের কথা, আমাকে জোর করে শোনাবেন নাকি?
শান্ত কণ্ঠে এবার কিরীটীই বলে, প্রয়োজন হলে শোনাতে হবে বৈকি। শুধু আপনি কেন, তাঁর আত্মীয়স্বজন বা পরিচিতদের মধ্যে প্রত্যেকেই যাঁরা তাঁর সম্পত্তির ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড তাঁদের প্রত্যেককেই আমাদের প্রয়োজন। কারণ—
কারণ?
কারণ—ব্রজদুলালবাবু আত্মহত্যা করেন নি, তিনি নিহত হয়েছেন।
কি—কি বললেন?
বললাম কেউ তাঁকে হত্যা করেছে এবং তাদেরই কারও পক্ষে সেটা সম্ভব বেশী যারা তাঁর সম্পত্তির ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড ছিল।
সুশান্ত অতঃপর কিছুক্ষণ যেন কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে, তারপর শান্ত কণ্ঠে বলে, আই সি! তাহলে আপনার ধারণা আমাদের মধ্যেই কেউ-না-কেউ তাঁকে হত্যা করেছি তাঁর সম্পত্তির লোভেই?
আপাততঃ সেটাই কি স্বাভাবিক ভাবে মনে হয় না সুশান্তবাবু?
চমৎকার। তাহলে এই ধরে নেব যে আপনারা আমাকে কাকার সম্ভাব্য হত্যাকারী হিসাবে অ্যারেস্ট করবেন?
না, অ্যারেস্ট করছি না।
তবে? যতক্ষণ না আপনাদের প্রত্যেকের উপর থেকে পুলিসের সন্দেহ সম্পূর্ণভাবে দূর হয়, আপনারা প্রত্যেকেই সন্দেহের তালিকার মধ্যে থাকবেন। বললে আবার কিরীটী।
হুঁ। তাহলে এখন আমাকে কি করতে হবে সেটা জানতে পারি কি?
হ্যাঁ, যতক্ষণ না এই ব্যাপারের সম্পূর্ণ মীমাংসা হয় আপনি এ বাড়িতে যেমন ঢুকতে পারবেন না তেমনি আপনার বর্তমান কলকাতার রেসিডেন্স থেকে কোথাও যেতে পারবেন না পুলিসের পারমিশন ব্যতীত।
বেশ তাই হবে।
আপনি এবারে যেতে পারেন।
সুশান্ত সাহা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
১১. পরের দিন ময়না তদন্তের রিপোর্ট
পরের দিন ময়না তদন্তের রিপোর্ট ও কাচের গ্লাস ও সঙ্গের বোতলের কেমিক্যাল অ্যানালিসিসের রিপোর্ট পাওয়া গেল।
গ্লাসে বা বোতলের মধ্যে কোন রকম বিষ যেমন পাওয়া যায় নি তেমনি মৃতদেহেও কোন রকম বিষের সন্ধান মেলেনি। ময়না তদন্তকারী ডাক্তার রিপোর্ট দিয়েছেন, মৃত্যুর কারণ হাই। ভোল্টের ইলেকট্রিক কারেন্ট।
তালুকদারই রিপোর্টটা নিয়ে এসেছিল কিরীটীর এখানে।
তিনি বলেন, ব্যাপারটা কেমন হল কিরীটী, এ যে কেমন গোলমাল হয়ে গেল!
রিপোর্টগুলো দেখবার পরই কিরীটী যেন কেমন আত্মচিন্তায় সমাহিত হয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষণের। জন্য। হাতের ধরা পাইপটা নিভে গিয়েছিল।
সেটায় পুনরায় অগ্নিসংযোগ করে কিরীটী বলে, যদিও হত্যাকারী নিঃসন্দেহে খুব চতুর এবং অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে হত্যার ব্যাপারে তবু বলব সেদিনকার একটা ব্যাপার তাকে—যাকে বলে সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছিল।
বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করেন তালুকদার, সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছিল একটা ব্যাপার?
হ্যাঁ।
কি বল তো?
কারোরই তো ব্যাপারটা অজানা থাকবার কথা নয় তালুকদার, কারণ ঐদিন সকালেই কাগজে ঘোষণা করা হয়েছিল কলকাতা শহরে কোন কোন এলাকায় সেদিন রাত্রে কিছুক্ষণের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকবে।
কথাটা একটু পরিষ্কার করে বল তো?
এখনও ঠিক বলতে পারছিনা তালুকদার, কারণ একটা জায়গায় এসে আমার চিন্তার যোগসূত্রটা ছিঁড়ে যাচ্ছে- আচ্ছা কিরীটী, তালুকদার প্রশ্ন করেন, এখনও কি তোমার ধারণা ব্যাপারটা হতাই?
নিঃসন্দেহে। আত্মহত্যা আদৌ নয়। হতভাগ্য ব্রজদুলাল সাহার দেহে তাঁর অজ্ঞাতেই হাই ভোল্টেজের ইলেকট্রিক কারেন্ট পাস করিয়ে তাঁকে মুহূর্তে হত্যা করা হয়েছে।
বল কি?
ঠিক তাই।
কিন্তু সেটা কেমন করে সম্ভব হল?
কেমন করে যে সম্ভব হল সেটাই ভাবছি এখনও। তবে সম্ভব হয়েছিল নিশ্চয়ই, নচেৎ ঐভাবে তাঁকে অতর্কিতে মৃত্যুবরণ করতে হত না।
তারপরই একটু থেমে হঠাৎ কি একটা কথা মনে পড়ায় কিরীটী বলে, ভাল কথা তালুকদার, সাহার সেই শয়নকক্ষটা লক-আপ করে রাখা হয়েছে, না?
হ্যাঁ। কেন, তুমিই তো সুখময়বাবুকে ঘরটাতে তালাবন্ধ করে রাখতে বলে দিয়েছিলে! একটু বস তালুকদার, আমি চট করে একটা টেলিফোন করে আসি।
কাকে ফোন করবে?
সুখময়বাবুকে।
কিরীটী ঘর থেকে উঠে গেল।
.
তালুকদার অতঃপর সোফাটায় বসে একটা পিকটোরিয়াল সাপ্তাহিক ইংরাজী ম্যাগাজিনের পাতাগুলো উল্টে উল্টে ছবি দেখতে থাকেন।
পুলিসের বড়কতা ঐদিন সকালেই তালুকদারকে ডেকে ব্রজদুলাল সাহার হত্যার রহস্যজনক ব্যাপারটার যাবতীয় দায়িত্ব তাঁর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। সেই সূত্রেই ঐদিন সন্ধ্যায় কিরীটীর শরণাপন্ন হয়েছিলেন তালুকদার।
কারণ থানা অফিসার সুখময় মল্লিকের কাছে গিয়ে শুনেছিলেন কি ভাবে ঘটনাচক্রে কিরীটী ব্রজদুলালের হত্যার পরের দিন গিয়ে অকুস্থানে হাজির হয়েছিল।
কিন্তু কিরীটীর ওখানে এসে, তার মতামত শুনে ব্রজদুলালের হত্যার রহস্যের মীমাংসার ব্যাপারে যে খুব বেশী আশান্বিত হয়েছেন তা নয়।
অথচ এও সে ভালভাবেই জানে যে, কিরীটী ঐ হত্যারহস্যের মীমাংসায় পৌঁছবার একটা-না-একটা পথ খুঁজে পেয়েছে যদিও—তথাপি সে নিজে থেকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে যতক্ষণ মুখ না খুলবে ততক্ষণ যতটুকু সে বলেছে তার বেশী জানবার আর কোন উপায়ই নেই।
একটু পরেই কিরীটী ফিরে এল একেবারে বাইরে বেরুবার বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে।
রাত তখন বোধ হয় পৌনে আটটা।
গ্রীষ্মের রাত। পৌনে আটটা বিশেষ করে কলকাতা শহরে তো এমন কিছুই নয়। একেবারে সন্ধ্যারাত্রি বললেও বেশী বলা হয় না।
কিরীটীর পরিবর্তিত বেশের দিকে তাকিয়ে তালুকদার প্রশ্ন করেন, কোথাও বেরুচ্ছ নাকি এখন?
হ্যাঁ, একটু ঘুরে আসা যাক। তোমার হাতে যদি তেমন জরুরী বা প্রয়োজনীয় কোন কাজ থাকে তো আমার সঙ্গে যেতে পার।
কিরীটী টোবাকো পাউচ ও লাইটারটা হাতে তুলে নিতে নিতে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে কথাগুলো।
তালুকদার ম্যাগাজিনটা টেবিলের উপর রেখে দাঁড়িয়ে বলেন, না, অন্য কোন কাজ তেমন নেই, তোমার এখানেই তো এসেছিলাম। চল।
রাস্তায় বের হয়ে দুজনে একটা ট্যাক্সি নেয়।
ট্যাক্সিওয়ালা কিরীটীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে, কোন দিকে যাব বাবুজী?
গর্চা লেন চল। কিরীটী বলে।
পার্শ্বে উপবিষ্ট তালুকদার গচা লেন কথাটা কানে যেতেই কিরীটীর মুখের দিকে তাকান।
গাড়ি তখন গচা লেনের দিকেই ছুটে চলেছে।
কিন্তু গাড়ি কিছুদূর এগুবার পরই কিরীটী ড্রাইভারকে সোজা এগিয়ে যেতে বলল একটা রেস্তোরাঁর দিকে চায়ের পিপাসা পেয়েছে বলে।
১২. পান্থশালা
ঐ পাড়ারই একটা আধুনিক রেস্তোরাঁ।
রেস্তোরাঁটি খুব বেশী দিনের নয়। কিন্তু বেশী দিনের না হলেও মালিক প্রচুর অর্থব্যয় করে আধুনিক সাজসরঞ্জাম ও আরামের ব্যবস্থায় রেস্তোরাঁটি সত্যিকারের যাকে বলে আকর্ষণীয় করে তুলেছিল।
সামান্য কয়েক মাসেই পান্থশালা রেস্তোরাঁ-প্রিয় লোকদের কাছে ঐ অঞ্চলের আকর্ষণের অন্যতম বিলাস ও আরামকেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
রেস্তোরাঁটির মধ্যে একটি ব্যবস্থা বিশেষ ছিল। তরুণ ও তরুণী খরিদ্দারদের জন্য ছোট ছোট নির্জন কিউবিক্যালস। কাজেই অল্পবয়সের কলেজের ছাত্রছাত্রী ও তরুণ-তরুণী খরিদ্দারদের ভিড়ই ছিল সর্বাপেক্ষা বেশী পান্থশালায়।
কিরীটী ও তালুকদার যখন পান্থশালায় এসে ঢুকলো রাত তখন সোয়া আটটা। বিরাট হলঘরের এক কোণে একটা টেবিলে মুখোমুখি বসে দুকাপ কফির অর্ডার দিল কিরীটী দুজনের জন্য।
.
কিরীটী লক্ষ্য করেনি।
তার ঠিক হাত দশেক দূরেই দেওয়াল ঘেঁষে আলো-আধাঁরির মধ্যে অন্য একটা টেবিলে মুখোমুখি বসেছিল দুকাপ চকোলেট ড্রিংক ও কিছু স্যান্ডুউইচ নিয়ে দুটি যুবক-যুবতী।
মিস রেবেকা মন্ডল ও সাধন মিত্র।
তাদের পরস্পরের মধ্যে নিম্নলিখিত কথাবার্তা চলছিল।
রেবেকা বলছিল, কিন্তু ঐ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া আমার আর উপায়টা কি বল সাধন—যার চাকরি করছিলাম, যে দয়া করে তার গৃহে স্থান দিয়েছিল সে-ই যখন চলে গেল তখন আর দাবী কোথায় আমার ওখানে থাকবার আর থাকতেই বা দেবে কে আমাকে?
মৃদুকণ্ঠে সাধন বলে, নতুন করে দাবীরও তো সৃষ্টি হতে পারে আবার!
নতুন দাবী? মন্দ বলনি কথাটা সাধন। প্রশান্ত, সুশান্ত ও শ্রীমতী সাহাও এসে ঐ বাড়িতে আর যার যে ব্যবস্থাই করুক আমার ব্যবস্থাটা যে বাড়ির বাইরে হবে, সে কি আর আমি জানি না!
কিন্তু তারাই যে বাড়ির একমাত্র মালিক হচ্ছে তা তুমি জানলে কি করে? ব্যাপারটা তো এখনও পর্যন্ত কেউই জানে না।
ওর আবার জানাজানির কি আছে সাধন! মিঃ সাহা নিজে বিপত্নীক ছিলেন, কোন সন্তানাদিও তাঁর নেই—সেক্ষেত্রে ওরা ছাড়া আর তাঁর টাকাকড়ি বিষয়সম্পত্তি পাবে কে!
তুমি তো জান, তাদের প্রতি মিঃ সাহা কোনদিন এতটুকু সন্তুষ্ট ছিলেন না।
সে তুমি যাই বল সাধন, হাজার হোক নিজের ভাইপো-ভাইঝি তো তাদের বঞ্চিত করে অপর কাউকে কিছু তিনি দিয়ে যাবেন, এটা আমার কোন মতেই বিশ্বাস হয় না। তাছাড়া আরও একটা কথা, নতুন ম্যানেজমেন্টে যদি আমার চাকরিই না থাকে তখন তো আমাকে চলে যেতেই হবে ঐ বাড়ি থেকে। সেক্ষেত্রে মানে মানে সময় থাকতে আগেভাগেই সরে পড়াই কি ভাল নয়?
তুমি দেখছি বড় অল্পেতেই হতাশ হয়ে পড় রেবেকা—সাধন বলে।
মানে?
তা নয় তো কি। সমস্ত ব্যাপারটাই এখনও পর্যন্ত অন্ধকারে রয়েছে।
অন্ধকারে কেন হবে? আমার মনে হয় সুশান্তবাবু উইলের সম্পর্কে কিছু কিছু জানেন।
চমকে ওঠে যেন সাধন মিত্র। বলে, কে বললে?
কেন, জান না? আজ দুপুরে যে ঐ বাড়িতে এসে জীবনকে হম্বিতম্বি করছিল সুশান্তবাবু।
হম্বিতম্বি করছিল?
হ্যাঁ। বলছিল পুরনো আগাছা নাকি সব কেটে সাফ করে দেবে বাড়ি থেকে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
১৩. পান্থশালা থেকে যখন বের হয়ে
পান্থশালা থেকে যখন বের হয়ে এল কিরীটী ও তালুকদার রাত তখন পৌনে নটা।
আগের ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়েছিল ওরা।
নতুন একটা ট্যাক্সি নিয়ে ওরা যখন গচা লেনে ব্রজদুলাল-ভবনে এসে পৌঁছাল তখন নটা বেজে মাত্র সাত মিনিট।
ট্যাক্সির ভাড়া রাস্তা থেকেই মিটিয়ে দিয়ে কিরীটী আর তালুকদার গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। এবং কয়েক পা এগুতেই ওদের নজরে পড়ল, পারলারের কাচের জানলাপথে আলো দেখা যাচ্ছে।
পারলারের দরজার দিকে এগুতেই ওদের কানে এল একটা রুক্ষ পুরুষের কণ্ঠস্বর : সেটাই তো আমি জানতে চাইছি মিঃ মল্লিক। কেন এখানে এ-সময় আমাকে ডেকে নিয়ে আসা হল? যে বাড়িতে ঘৃণায় আজ পর্যন্ত কখনও আমি পা ফেলিনি সেখানে কেন আমাকে ডেকে আনা হল?
সুখময় মল্লিকের কণ্ঠস্বর শোনা যায়, কিন্তু আজ যখন আপনাদের কাকা ব্রজবাবুর মৃত্যুতে আপনারাই এ বাড়ির মালিক হচ্ছেন তখন আজ হোক কাল বা পরশুই হোক একদিন এখানে আসতেই হবে আপনাকেও।
কে বললে আপনাকে সে কথা? যার খুশি সে আসুক, জানবেন প্রশান্ত সাহা এখানে জীবনেও পা দেবে না।
কিন্তু কেন বলুন তো প্রশান্তবাবু? এত রাগ কেন আপনার ব্রজবাবুর উপরে?
রাগ? একটা লম্পট, আউট অ্যান্ড আউট স্কাউলে, একটা।
লম্পট!
নয়? কারও জানতে আজও বাকি আছে, ঐ তাঁর সেক্রেটারী না কি সেই খ্রীস্টান মেয়েটা রেবেকার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথাটা?
সে কথাটা আপনি বিশ্বাস করেন প্রশান্তবাবু?
পৃথিবীসুদ্ধ লোক করে, আর আমিই বা করব না কেন?
কিন্তু এও শুনেছি অনেক লোকই নাকি বলে কথাটা মিথ্যে। মিথ্যে?
হ্যাঁ।
তারা জানে না।
আপনিই বা স্থিরনিশ্চিত হলেন কি করে? এ-বাড়িতে তো কখনও আসেন নি?
না, আসিনি—
তবে?
তবে আবার কি! ঐসব নোংরামি কখনও কেউ চাপা দিয়ে রাখতে পারে, না পেরেছে?
বুঝলাম। কিন্তু যা আপনি নিজে চোখে কখনও দেখেন নি, কেবলমাত্র লোকের কথা শুনে–
লোকেরাই বা তাঁর সম্পর্কে মিথ্যে রটনা করবে কেন বলতে পারেন মিঃ মল্লিক? তাদের কি স্বার্থ?
স্বার্থ হচ্ছে ঈষ। শান্ত কণ্ঠে সুখময় জবাব দেন, হ্যাঁ, একটা কথা জানবেন, কেউ কখনও আশাতিরিক্ত উন্নতি করলে তার আত্মীয়স্বজন বন্ধু ও পরিচিত জনেরাই তার আড়ালে নিন্দে করে, কলঙ্ক রটায়, এবং সেটা করে নিছক ঈষায়। এবং এ যে কত বড় গোপন ও কুৎসিত ব্যাধি আমাদের প্রায় প্রত্যেকের মনে সেটা যেন আমরা জেনেও জানতে চাই না।
না, না—সে আপনি যাই বলুন মিঃ মল্লিক, তার মুখ-চোখই আমাকে বলে দিত, কি টাইপের লোক সে। যাক গে মশায়, ও নিয়ে তর্ক আমি করতে চাই না। আমাকে যেতে দিন।
কিরীটী এতক্ষণ দরজার একপাশে দাঁড়িয়েছিল, এবারে তালুকদারকে নিয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করল। এবং কতকটা যেন অকস্মাৎই গিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
ওদের পদশব্দে ঘরের মধ্যে উপস্থিত সুখময় মল্লিক ও প্রশান্ত সাহা দুজনেই যুগপৎ ওদের দিকে ফিরে তাকায়।
এই যে মিঃ রায় এসে গিয়েছেন, প্রশান্তবাবু আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে চাইছেন। সুখময় মল্লিক কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়েই কথাটা উচ্চারণ করেন।
ওঁরই নাম প্রশান্ত সাহা? কিরীটী সুখময় মল্লিকের দিকে তাকিয়েই প্রশ্নটা করে।
হ্যাঁ, উনিই। আপনার ফোন পেয়ে তখুনিই ওঁকে আমি ফোন করি এখানে চলে আসবার জন্য। এসে দেখি আমার আগেই উনি এখানে এসে পৌঁছে গিয়েছেন।
কিরীটী প্রশান্ত সাহার দিকে চেয়ে ছিল।
সুশান্ত সাহাকে তার সুপুরুষ মনে হয়েছিল, কিন্তু, প্রশান্ত সাহা ততোধিক সুন্দর।
যেমন লম্বাচওড়া চেহারা তেমনি উজ্জ্বল গায়ের বর্ণ।
পরিধানে একটা রেয়ন সিল্কের সাদা লংস ও টেরিলিনের ঈষৎ নীলাভ রংয়ের শার্ট এবং চোখে সোনার ফ্রেমের ফ্যান্সি চশমা। দাড়িগোঁফ নিখুঁত কামানো।
শুধু সুন্দর চেহারাই নয়, বেশভূষাও যেমন পরিচ্ছন্ন তেমনিই নিখুঁত রুচির পরিচায়ক।
১৪. কিরীটী প্রশান্তর মুখের দিকে
আপনিই প্রশান্ত সাহা? কিরীটী প্রশান্তর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কে? আপনাকে তো চিনলাম না?
জবাব দিল এবারে তালুকদার পাশ থেকে, ওঁকে না চিনলেও নাম নিশ্চয়ই ওঁর শুনেছেন, উনি সত্যসন্ধানী শ্রীযুক্ত কিরীটী রায়।
কিরীটী রায়! কথাটা যেন কিছুটা আত্মগত ভাবেই উচ্চারণ করে প্রশান্ত।
প্রশান্তবাবু, আপনি তো য়ালেন ইলেকট্রিক্যালস কোম্পানীতে চাকরি করেন, তাই না? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ।
সেখানে কি কাজ করেন?
সেখানে আমি ওদের ওয়ার্কশপে ইলেকট্রিক্যাল মেকানিক।
কিছু মনে করবেন না, কত মাইনে পান?
তিনশো টাকা।
বিয়ে করেননি তো এখনও?
না।
কেন বলুন তো এখনও বিয়ে করেননি?
কেন আবার কি, তিনশো টাকা আবার একটা টাকা নাকি! একজন মানুষেরই ভদ্রভাবে জীবন ওই টাকাতে কাটে না তায় আবার পরিবার! ক্ষমা করবেন মশাই, এতবড় নিরেট গদত আমি নই।
তা তো সত্যিই, আজকালকার দিনে তিনশো টাকা আবার কি! কিন্তু এবারে বোধ হয় বিয়ে করবেন—কি বলেন, কাকার সম্পত্তি যখন পাচ্ছেন?
কি বললেন? কাকার সম্পত্তি? তাহলেই হয়েছে! ব্রজদুলাল সাহাটি যে কি একখানা চিজ ছিল আপনারা তো আর জানতেন না। মশাই, ও আশা আমি করি না। যাক গে, লোকটার নামও আমার সহ্য হয় না। জীবনে এ বাড়িতে কখনও এর আগে আমি পা দিইনি। দিতামও না, আজ যদি আপনারা আমাকে এখানে ডেকে না আননে। কেন ডেকেছেন এবারে বলুন?
কেন ডেকেছি? তার কারণ আছে—
কি কারণ?
এক্ষুনি জানতে পারবেন, একটু অপেক্ষা করুন।
না মশাই, ক্ষমা করুন আমাকে। আমার কাজ আছে, এখুনি আমাকে যেতে হবে।
প্রশান্ত সাহার কথাটা শেষ হল না, দরজার বাইরে ভারী গলায় শোনা গেল, ভিতরে আসতে পারি মিঃ মল্লিক?
কে? সুখময় মল্লিক শুধান।
আমি রূপচাঁদ চ্যাটার্জী।
আসুন, আসুন—ভেতরে আসুন।
ব্রজদুলাল সাহার সলিসিটার মিঃ রূপচাঁদ চ্যাটার্জী এসে ঘরে ঢুকলেন।
ভদ্রলোকের বয়েস হয়েছে, অন্ততঃ পঞ্চাশের নীচে নয়। বেশ হৃষ্টপুষ্ট চেহারা।
পরিধানে দামী সুট। হাতে একটা চামড়ার ফোলিও।
রূপচাঁদ চ্যাটার্জী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে পরপর সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে শেষে তাকালেন প্রশান্ত সাহার মুখের দিকে, প্রশান্তবাবু, আপনিও আছেন দেখছি! কিন্তু মিঃ মল্লিক কে?
সুখময় মল্লিক তখন বললেন, আমারই নাম সুখময় মল্লিক। উনি ডি.সি, মিঃ তালুকদার আর উনি–
ওঁর আর পরিচয় দিতে হবে না মিঃ মল্লিক, কিরীটী রায়কে আমি চিনি। যদিও আমাদের পরস্পরের সঙ্গে পরিচয়ের সৌভাগ্য আজও হয়নি।
একটু থেমে রূপচাঁদ চ্যাটাজী আবার বলেন, আপনি যখন আমার অফিসে ফোন করেন তখন আমি অফিসে ছিলাম না। বাইরে বারলো সাহেবের চেম্বারে একটা কনসালটেশনে গিয়েছিলাম। ফিরে আসতেই আমার জুনিয়ার বললে, আমাকে নাকি আপনি চেম্বারে ফোন করে ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই এখানে চলে আসতে বলেছেন। কিন্তু কি ব্যাপার বলুন তো?
১৫. কথা বলে এবারে কিরীটী
কথা বলে এবারে কিরীটী, আমিই সুখময়বাবুকে বলেছিলাম ফোনে আপনাকে আজ একবার এখানে আসবার জন্য খবর দিতে মিঃ চ্যাটার্জী। ব্রজদুলাল সাহা, আপনার ক্লায়েন্টের উইল সম্পর্কে কয়েকটা ইনফরমেশান আমার দরকার।
উইল সম্পর্কে?
হ্যাঁ।
কিন্তু কিরীটীবাবু, আমার ক্লায়েন্ট তো কোন উইল শেষ পর্যন্ত করে যেতে পারেন নি? কেন, প্রশান্তবাবু তো জানেন সেকথা। ওঁকে তো আজই বলেছি।
রূপচাঁদ চ্যাটার্জী কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী প্রশান্ত সাহার দিকে তাকাল। কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য।
পরক্ষণেই তাকাল আবার রূপচাঁদ চ্যাটার্জীর দিকে, আপনার ক্লায়েন্টের কোন উইল নেই?
না। মাদ্রাজ যাবার আগে সর্বপ্রথম তিনি উইলের কথা আমাকে জানান।
তার আগে কখনও উইলের প্রশ্ন ওঠেনি?
না। সেই প্রথম উইলের কথা আমাকে বলেন এবং কি ভাবে উইল হবে মুখে সেটা বলে আমাকে একটা ড্রাফট তৈরী করে রাখতে বলেন, মাদ্রাজ থেকে ফিরে এসে সেটা পাকাপাকি করবেন বলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তো সব ভেস্তে গেল। মাদ্রাজ থেকে যেদিন ফিরলেন সেই রাত্রেই আত্মহত্যা করলেন।
আত্মহত্যা তো তিনি করেননি মিঃ চ্যাটার্জী! গম্ভীর কণ্ঠে কিরীটী এবার বলে।
সে কি, আত্মহত্যা করেননি?
না। স্থির কণ্ঠে কিরীটী পুনরায় প্রতিবাদ জানাল।
কিন্তু আমি যে শুনেছিলাম—
ভুল শুনেছিলেন। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। কিরীটী আবার বলে।
হত্যা করা হয়েছে?
হ্যাঁ।
বাট হাউ!
হাই ভোলটেজ ইলেকট্রিক কারেন্ট তাঁর দেহে পাস করিয়ে তাঁকে সেরাত্রে হত্যা করা হয়েছে মিঃ চ্যাটার্জী।
এতক্ষণে প্রশান্ত সাহা কথা বললে, সরি বলছেন কিরীটীবাবু, কাকাকে হত্যা করা হয়েছে?
হ্যাঁ প্রশান্তবাবু। তাঁকে সত্যিই হত্যা করা হয়েছে।
কিন্তু কে-কে তাঁকে হত্যা করবে?
যার স্বার্থ ছিল সে-ই। যাক সেকথা প্রশান্তবাবু, আপনাকে আমার যেজন্য প্রয়োজন এবং যেজন্য ডেকেছিলাম—অনুগ্রহ করে আমার সঙ্গে একবার ওপরে যাবেন কি?
ওপরে? কেন বলুন তো?
এক্সপার্ট ওপিনিয়ন নেব।
এক্সপার্ট ওপিনিয়ন কি ব্যাপারে?
আপনি তো একজন ইলেকট্রিক্যাল মেকানিক, ইলেকট্রিকের ব্যাপারেই আপনার ওপিনিয়ন আমার চাই। চলুন।
ওরা ঘর থেকে বের হয়ে দোতলার সিঁড়ির দিকে এগুচ্ছে, এমন সময় সাধন আর রেবেকাকে সেখানে প্রবেশ করতে দেখা গেল।
রেবেকা আর সাধন মিত্র যেন হঠাৎ ওই সময় ওদের ওখানে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে যায়।
কিরীটী কিন্তু ওদের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলে, যাক, আপনারা দুজনও এসে গিয়েছেন ভালই হল। বাকী রইলেন শুধু সুশান্তবাবু।
এরপর কিরীটী সুখময়ের দিকে তাকিয়ে বলে, মিঃ মল্লিক!
বলুন?
আপনি সুশান্তবাবুকে আসবার জন্য খবর পাঠাননি?
হ্যাঁ, লোক পাঠিয়েছি তো। যাকে পাঠিয়েছি তাকে বলেও দিয়েছি সুশান্তবাবুকে তাঁর ফ্ল্যাটে পাওয়া গেলে, হংকং হোটেলে পাওয়া যাবে। প্রয়োজন হলে সেখানেও যেতে।
তবে তিনিও হয়তো এসে পড়বেন। চলুন ওপরে যাওয়া যাক। চলুন প্রশান্তবাবু, সাধনবাবু! মিস মন্ডল, আপনিও।
.
সকলে এসে উপরে ব্রজদুলাল সাহার ঘরের তালা খুলে প্রবেশ করল।
ঘরের যাবতীয় জিনিসপত্র ব্রজদুলালের হত্যার পরদিন সকালে যেমন ছিল, যেখানে যেটি, সাতদিন পরে ঠিক তেমনিই আজও সব আছে।
কিরীটী একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে নিল।
তারপর সুখময়ের দিকে চেয়ে বললে, মিঃ মল্লিক, ভৃত্য জীবন আর দারোয়ান মিশিরকে একবার এ ঘরে ডেকে আনুন।
সুখময় মল্লিক ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
কিরীটী ঘরের দক্ষিণ দিককার জানলাটা খুলে দিয়ে ভোলা জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
ঘরের মধ্যে বাকী সকলে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘরের মধ্যে অদ্ভুত একটা স্তব্ধতা যেন থমথম করতে থাকে।
মিনিট কয়েক বাদেই সুখময় মল্লিক ভৃত্য জীবন ও দারোয়ান মিশিরকে নিয়ে ফিরে এলেন।
ভৃত্য জীবনকে ঘরে ঢুকতে দেখেই কিরীটী ঘুরে দাঁড়াল, জীবন!
আজ্ঞে?
প্রশান্তকে দেখিয়ে বলে, এই বাবুকে চেনো!
কেন চিনব না আজ্ঞে, উনি তো বাবুর বড় ভাইপো?
এ বাড়িতে উনি এর আগে কখনও এসেছেন?
আজ্ঞে না।
এবারে দারোয়ান মিশিরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে কিরীটী, মিশিরজী।
জী?
ওই বাবুকো তুম্ পয়ছান্তে?
জী নেহি।
কভি দেখা নেই?
নেহি জী।
বাইরে ওই সময় জুতোর শব্দ শোনা গেল।
মিঃ মল্লিক, দেখুন তো আপনার সুশান্তবাবু বোধ হয় এলেন। কিরীটী সুখময়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে।
সুখময় মল্লিককে আর এগিয়ে দেখতে হল না।
সত্যি সুশান্ত সাহা ও একজন প্লেন-ড্রেস সি.আই.ডি অফিসার ঘরে এসে ঢোকেন।
সুশান্তর দাঁড়াবার ভঙ্গিটা যেন কেমন একটু শিথিল।
কোনমতেই যেন যে সোজা হয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছিল না।
আজও তার পরিধানে দামী সুট ছিল।
সুশান্ত ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই বলে, কোথায় সুখময় মল্লিক, কেন সে আমাকে এখানে এভাবে ধরে নিয়ে এল আমি জানতে চাই। কোথায় সে?
কণ্ঠস্বর জড়িত। বোঝা যায় অতিরিক্ত মদ্যপানে সুশান্ত সাহা নেশাগ্রস্ত, ঠিক প্রকৃতিস্থ নয়।
কিরীটীই এগিয়ে এল, সুশান্তবাবু, বসুন সোফাটায়।
সুশান্ত বলে ওঠে, ড্যাম ইট, বসতে আমি আসিনি–কথাটা সুশান্তর শেষ হয় না, ঘরের মধ্যে অন্যান্য দণ্ডায়মান সকলের দিকে একে একে তার নজর পড়ে এবং সর্বশেষে প্রশান্তর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, এই যে বড় সাহেব, তুমিও তাহলে উপস্থিত হয়েছ! ভাল, ভাল!
কিরীটী আবার গম্ভীর এবং গলায় নির্দেশের সুর এনে বলে, বসুন সুশান্তবাবু!
বসব?
হ্যাঁ, বসুন।
আপনারা সবাই দাঁড়িয়ে থাকবেন—আর শুধু আমি বসব মিঃ রায়?
হ্যাঁ, আপনি বসুন।
ও-কে বস! তবে বসলাম।
ধপ করে সুশান্ত সোফার উপরে বসে পড়ল।
কিরীটী এবারে সাধন মিত্রের দিকে তাকিয়ে বললে, আজ এই সময় এমন যে একটা যোগাযোগ হবে, সত্যিই বলছি, ভাবতেও পারিনি সাধনবাবু। কিন্তু ঘটনাচক্রে ভগবানের ইচ্ছায় যখন যোগাযোগটা হলই, তখন যে কথাটা আপনাদের প্রত্যেককেই আমার বলবার ছিল সেটা আজই বলব।
একটু থেমে কিরীটী আবার বলতে লাগল, গত ২৩শে জুলাই রাত্রে এই কক্ষের মধ্যে নৃশংস হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল, সেই হত্যাকান্ডের কথাই বলব। কেমন করে সে রাত্রে ব্রজদুলালবাবু নিহত হয়েছিলেন আপনারা হয়ত এখনও সকলে তা ঠিকমত জানেন না।
১৬. সবাই রুদ্ধ নিশ্বাসে
সবাই রুদ্ধ নিশ্বাসে যেন কিরীটীর কথা শুনতে থাকে।
কিরীটী বলে, আপনারা হয়ত সবাই জানেন গত ২৩শে জুলাই এই অঞ্চলে রাত দশটা পঁয়তাল্লিশ থেকে সোয়া এগারোটা পর্যন্ত ইলেকট্রিক কারেন্ট বন্ধ থাকায় এই অঞ্চলটা ঐ আধ ঘণ্টা সময় অন্ধকার হয়ে ছিল। সেই সময়ের মধ্যেই হত্যাকারী এই ঘরের মধ্যে কৌশলে ব্রজদুলালবাবুর মৃত্যু-ফাঁদ পাতে—যে ফাঁদে ব্রজদুলালবাবু অবধারিত ভাবে পা দেন নিজের অজ্ঞাতেই।
মৃত্যুফাঁদ! মৃদুকণ্ঠে কথাটা উচ্চারণ করে সাধন মিত্র।
হ্যাঁ, মৃত্যুফাঁদ। ডেথ-ট্র্যাপ। এবং মৃত্যুফাঁদটা কি ছিল জানেন—একটা টেবিল ল্যাম্প?
টেবিল-ল্যাম্প? কথাটা বলে যেন হাঁ করে তাকায় সাধন মিত্র কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ মিঃ মিত্র, একটা টেবিল-ল্যাম্প। যে টেবিল-ল্যাম্পটা ঐ ত্ৰিপয়ের উপরে বরাবর থাকত এবং যেটা সে-রাত্রে ব্রজদুলালকে হত্যা করবার পর হত্যাকারী সেই রাত্রেই সরিয়ে ফেলে ঐ নতুন টেবিল-লাম্প ঐখানে রেখে দেয়।
ঐ টেবিল-ল্যাম্পটা—
একটা নতুন ল্যাম্প। এবং অরিজিন্যাল ল্যাম্পটা সরিয়ে ঐ নতুন ল্যাম্পটা রেখেই হত্যাকারী সে রাত্রের তার হত্যার নিদর্শন রেখে গিয়েছে তার নিজের অজ্ঞাতে। এমনিই হয়, ভগবানের বিচারে পাপের ছাপ এমনি করেই হত্যাকারী তার অজ্ঞাতে রেখে যায়। আর ঐ ল্যাম্পটাই আমাকে সত্যের সন্ধান দিয়েছে।
সুখময় মল্লিক বলেন, ব্যাপারটা কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারছি না মিঃ রায়।
কেন বুঝতে পারছেন না সুখময়বাবু? ময়না তদন্তের রিপোর্ট থেকে আমরা জেনেছি সেরাত্রে হাই ভোলটেজের ইলেকট্রিক কারেন্ট পাস করবার জন্যই ব্রজদুলালবাবুর আকস্মিক মৃত্যু ঘটেছিল, কেমন কিনা?
হ্যাঁ।
সেই কারেন্ট পাস করানো হয়েছিল, যে টেবিল-ল্যাম্পটার কথা বলছি সেটারই ভিতর দিয়ে।
কিন্তু সেই অরিজিন্যাল টেবিল-ল্যাম্পটি গেল কোথায়? প্রশ্ন করেন সুখময় মল্লিক।
মিস রেবেকা মণ্ডলকে জিজ্ঞাসা করুন, উনিই হয়ত বলতে পারবেন কোথায় সে ল্যাম্পটা।
কিরীটীর মুখ থেকে কথাটা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সকলের দৃষ্টি যেন একসঙ্গে গিয়ে পড়ল ঘরের মধ্যে দণ্ডায়মানা রেবেকার উপরে।
রেবেকা প্রথমটায় বোধ হয় একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে ওঠে, হোয়াট ড়ু ইউ মিন! এ কথার আপনার অর্থ কি মিঃ রায়, আমি জানতে চাই। ইট ইজ নট অনলি ইনসালটিং-ড্যামেজিং টু।
কিরীটী মৃদু হেসে একবার রেবেকার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, অবশ্যই ড্যামেজিং মিস মণ্ডল এবং ড্যামেজিং যে হতে পারে সেটা অন্ততঃ আপনার মত বুদ্ধিমতী মেয়ের পক্ষে পূর্বেই বোঝা উচিত ছিল।
What do you mean? কি বলতে চান আপনি?
বলতে চাই ল্যাম্পটা আপনারই ঘরে আলমারির টানার মধ্যে পাওয়া গিয়েছে।
What? কি বললেন?
যা বললাম তা তো আপনার অজানা নয় মিস মণ্ডল।
সাজানো-মিথ্যা একটা ষড়যন্ত্র!
কোর্টে তাই বলবেন—বলেই জীবনের দিকে তাকিয়ে কিরীটী শুধায়, ল্যাম্পটা কোথায় তুমি পেয়েছিলে জীবন?
আজ্ঞে সেক্রেটারী মেমসাহেবের ঘরে—
চিৎকার করে ওঠে সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে রেবেকা, জীবন, ইউ লায়ার–
লায়ার ও নয় মিস মণ্ডলল্যাম্পটা সত্যিই ও আপনার ঘরে পেয়েছিল। ওকে আমি বাড়ির সর্বত্র ল্যাম্পটা খুঁজে দেখতে বলেছিলাম। ও আপনার ঘরে আলমারির ড্রয়ারের মধ্যেই। সেটা খুঁজে পেয়ে আমাকে পৌঁছে দেয়।
সুশান্ত জড়িত কণ্ঠে বলে ওঠে, তাহলে মেমসাহেব, তুমিই–
না সুশান্তবাবু—ঠিক উনি নন—যদিও উনি সাহায্যকারিণী ছিলেন সে-রাত্রের ব্যাপারে। কিরীটী বলে ওঠে।
সাধন মিত্র এতক্ষণ একপাশে চুপ করে যেন পাথরের মতই দাঁড়িয়েছিল।
সমস্ত মুখখানা তখন তার ফ্যাকাশে, রক্তশূন্য।
তার দিকে তাকিয়ে এবার কিরীটী বললে, সাধনবাবু, নারীর মন বড় বিচিত্র বস্তু! তা হলেও এটা আপনার মত একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তির অন্ততঃ বোঝা উচিত ছিল। যে নারী একজনের সঙ্গে স্বার্থের জন্য প্রেমের খেলা খেলতে পারে, সে আর একজনের সঙ্গেও পারে। এখন বোধ হয় বুঝতে পারছেন, ইউ হ্যাভ বিন ডিসিঙ্! আপনিও প্রতারিত হয়েছেন!
সাধন মাথা নীচু করে।
কিরীটী বলে, তবে আপনার দুঃখের কোন কারণ নেই। ঐ রেবেকা মণ্ডল যেমন আপনাকে প্রেমের ব্যাপারে প্রতারণা করেছে তেমনি নিজেও প্রতারিত হয়েছে। ও জানে না এখনও যে, ও নিজে যেমন আপনার সঙ্গে প্রেমের খেলা খেলেছে, তেমনি প্রশান্ত সাহাও ওর সঙ্গে নিতান্তই স্বার্থের খাতিরেই প্রেমের খেলা খেলেছে এতদিন।
সহসা যেন রেবেকা পাগলের মতই চিৎকার করে ওঠে, না–না—এ অসম্ভব—
কিরীটী ওই সময় বলে ওঠে, না প্রশান্তবাবু, এ ঘর থেকে বেরুবার চেষ্টা করবেন না–
প্রশান্ত সবার অজ্ঞাতে দরজার দিকে এগুচ্ছিল পায়ে পায়ে, হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়।
কিরীটী সুখময়ের দিকে তাকিয়ে বলে, মিঃ মল্লিক, পুট হিম আণ্ডার অ্যারেস্ট।
সুখময় মল্লিক সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে প্রশান্তর হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেন।
১৭. ব্রজদুলাল সাহার পৈশাচিক হত্যার পশ্চাতে
সেই রাত্রেই।
কিরীটী বলছিল, ব্রজদুলাল সাহার পৈশাচিক হত্যার পশ্চাতে ছিল বিচিত্র একটা নাটক। যার পাত্রপাত্রী ছিল ব্রজদুলাল সাহা স্বয়ং, তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র প্রশান্ত সাহা, তাঁর পি.এ. সাধন মিত্তির এবং তাঁর সেক্রেটারী মিস রেবেকা মণ্ডল।
বলাই বাহুল্য, বিপত্নীক ব্রজদুলালের দুর্বলতা জন্মেছিল রেবেকার উপরে। শুধু ব্রজদুলালের কেন—সাধন মিত্রেরও দুর্বলতা জন্মেছিল রেবেকার উপরে।
কিন্তু ওদের দুজনের কেউ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি যে রেবেকা ভালবেসেছিল প্রশান্ত সাহাকে। আবার রেবেকাও তেমনি জানতে পারেনি ঘুণাক্ষরেও, প্রশান্তর তার প্রতি সবটাই ছিল নিছক একটা অভিনয়। নারীর চাইতে সে কাঞ্চনকেই জীবনে বেশী প্রাধান্য দিয়েছে।
এরপর আসা যাক ঘটনায়।
ব্রজদুলাল তাঁর ভ্রাতুস্পুত্রদের আদৌ দেখতে পারতেন না। অবিশ্যি দেখতে না পারলেও প্রশান্ত ও সুশান্তবাবুদের ধারণা ছিল ব্রজদুলাল তাদের একেবারে বঞ্চিত করবেন না। কিন্তু যে মুহূর্তে প্রশান্ত সাহা জানতে পারল ব্রজদুলালবাবু রেবেকাকে বিবাহ করবেন স্থির করেছেন—রেবেকারই মারফৎ সঙ্গে সঙ্গে সে ব্রজদুলালকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার জন্য স্থিরপ্রতিজ্ঞ হল। কিন্তু একা অত বড় দায়িত্বটা নেওয়া সম্ভব নয় তাই সে রেবেকার সাহায্য চাইল। রেবেকাও সম্মত হল, যেহেতু প্রশান্তকে সে মনে মনে ভালবাসত।
মিঃ মল্লিক শুধালেন, রেবেকাকে ব্রজদুলাল বিবাহ করবেন স্থির করেছিলেন, কথাটা জানলেন কি করে মিঃ রায়?
কথাপ্রসঙ্গে ভৃত্য জীবনই আমাকে কথাটা পরশু রাত্রে বলে ফেলেছিল। এবং কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই ব্রজদুলালের হত্যারহস্যটা আমার কাছে অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যায়। কেবল একটা কিন্তু থেকে যায়–
কিন্তু!
হ্যাঁ, বুঝতে পারছিলাম না রেবেকা যখন ব্রজদুলালকে বিবাহ করতে সম্মত হয়েছিল তখন এত বড় নৃশংস ব্যাপারটা কী করে ঘটতে পারে। কারণ রেবেকার অজ্ঞাতে তো এত বড় ব্যাপারটা সংঘটিত হওয়া সম্ভবপর হতে পারে না আদৌ। কিন্তু সে প্রশ্নের মীমাংসাটাও একটু আগে আজ সন্ধ্যায় অকস্মাৎই যেন হয়ে গেল পান্থশালায়।
মিঃ মল্লিক সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে, পান্থশালায়!
হ্যাঁ, পান্থশালায় সাধনবাবু আর রেবেকাকে দেখে ও তাদের কথাবার্তা শুনে। পান্থশালায় বসেই বুঝতে পারলাম, রেবেকা সাধন মিত্রের সঙ্গেও যখন প্রেমের খেলা খেলছে, তখন হতভাগ্য প্রৌঢ় ব্রজদুলালও তার অন্যতম ভিকটিম হয়েছিল স্বার্থজনিত প্রেমের খেলায় নিঃসন্দেহে!
যাক যা বলছিলাম, সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
একটু থেমে আবার সুখময় মল্লিকের দিকে তাকিয়ে কিরীটী বলে, আজ যখন সুখময়বাবু আপনাকে ফোনে সকলকে ডেকে এখানে জড়ো করার জন্য বলি তখনও জানতাম না—বুঝতেও পারিনি ঘটনার পরিস্থিতি সহসা এমন হয়ে দাঁড়াবে। আমাকে যেন কোন চেষ্টাই করতে হল না, আপনা হতেই যেন সব জটগুলো খুলে গিয়ে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেল।
সুখময় মল্লিক ওই সময় প্রশ্ন করেন, কিন্তু ঘটনাটা ঠিক কী ঘটেছিল বলে আপনার ধারণা মিঃ রায়? আর কেনই বা প্রশান্ত সাহা তার কাকাকে এমনি করে হত্যা করল, এবং প্রশান্তর ওপরেই বা আপনার সন্দেহ পড়ল কি করে?
কিরীটী বলে, প্রশান্ত সাহার উপরে সন্দেহ পড়েছিল আমার তিনটি কারণে।
তিনটি কারণে?
হ্যাঁ, প্রথমতঃ ব্রজদুলাল সাহার ইলেকট্রিক কারেন্টে মৃত্যু হওয়ায় এবং প্রশান্তর নিজের স্বীকৃতিতে জানতে পারা যায় যে, সে একজন ইলেকট্রিক মেকানিক, ওর দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। দ্বিতীয়তঃ তার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি, সে এক নম্বরের একজন অর্থলোলুপ। তৃতীয়তঃ ব্রজদুলালকে ও অন্তরের সঙ্গে ঘৃণা করে। সব কিছু মিলিয়ে ওর উপরে আমার সন্দেহটা দৃঢ়বদ্ধ হয়। তারপর সমস্ত ব্যাপারটা দুয়ে দুয়ে চারের মত মিলিয়ে নিতে আর আমার কষ্ট হয়নি।
একটু থেমে কিরীটী আবার বলতে লাগল, প্রশান্ত সাহা লোকটা অতীব ধূর্ত সন্দেহ নেই। সে জানত, রেবেকার প্রতি সাধনবাবুর দুর্বলতা আছে আর রেবেকা তাকে ভালবাসে। দুদিককার এই ভালবাসার ছুরি দিয়েই সে তার পথ পরিষ্কার করে নিয়েছিল। ঐদিন দ্বিপ্রহরে সাহেবের ছদ্মবেশে এসে রেবেকার সাহায্যে প্রশান্ত ব্রজদুলালের শয়নকক্ষের ইলেকট্রিক টেবিল-ল্যাম্পটা এ বাড়ির ৪৪০ ভোল্টের সঙ্গে ডিরেক্ট কানেকশন করে রেখে গিয়েছিল। সে জানত—ব্রজদুলাল রাত্রে শয়নের পূর্বে সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়েন ড্রিঙ্ক করতে করতে।
সেরাত্রেও শয়নের পূর্বে সোফায় বসে যথারীতি খবরের কাগজ পড়বার জন্য সামনের টেবিল-ল্যাম্পটা জ্বালাতে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মৃত্যু হয় হাই কারেন্টের ইলেকট্রিসিটিতে। ইতিমধ্যে নিষ্প্রদীপ হয় ঐ অঞ্চল। এবং ওই নিষ্প্রদীপের মধ্যেই কোন এক সময় অন্ধকারে ওই ঘরে সবার অলক্ষ্যে পাশের লাইব্রেরী ঘরের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করে প্রশান্ত আসল ল্যাম্পটা সরিয়ে দ্বিতীয় ল্যাম্প যথাস্থানে রেখে যায়। কিন্তু এত করেও সে তিনটি মারাত্মক ভুল করেছিল।
তিনটি মারাত্মক ভুল!
হ্যাঁ, মিঃ মল্লিক। প্রথম ভুল, রেবেকার সাহায্যে সাধনবাবুকে দিয়ে মাদ্রাজ থেকে ব্রজদুলালকে ট্রাঙ্ক কল করে তাড়াহুড়ো করে নিয়ে এসে। দ্বিতীয় ভুল করেছিল, আসল ল্যাম্পটা বদলে—দ্বিতীয় একটা নতুন ল্যাম্প সেখানে বদলে রেখে। এবং তৃতীয় মারাত্মক ভুল করেছিল, ঘরের দরজাটা খুলে রেখে দিয়ে।
হত্যা সে করেছিল নিশ্চয়ই ব্রজদুলালের সম্পত্তির লোভে? সুখময় মল্লিক বলেন। ঠিক তাই। উইলের ড্রাফট হয়ে গিয়েছে শুনে উইল পাকাপোক্ত হবার আগেই সে তাই ট্রাঙ্ক কল করে মাদ্রাজ থেকে এনে ব্রজদুলালকে হত্যা করেছিল। কারণ উইলে কোন রকম কিছু না থাকলে সম্পত্তি পেতে তো কোনন অসুবিধাই হত না। কিন্তু আর না মিঃ মল্লিক-রাত প্রায় শেষ হয়ে এল, এবারে আমি বিদায় নেব।
কিরীটী সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
ইতিমধ্যে বাইরে পুলিসের কালো ভ্যানও এসে গিয়েছিল।
হত্যাকারী প্রশান্ত সাহা ও রেবেকা মণ্ডলকে নিয়ে মিঃ মল্লিক হাজতে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন।