- বইয়ের নামঃ বিদ্যুৎ-বহ্নি
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- প্রকাশনাঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১. পাইপটা নিভে গিয়েছিল
কিরীটী নতুন করে আবার পাইপে অগ্নিসংযোগ করে, পাইপে কয়েকটা টান দিয়ে খানিকটা ধোঁয়া উদগীরণ করে বলে, কথাটা কারোরই অজানা থাকবার কথা নয়। কারণ ঐ দিন সকালেই ইংরাজী বাংলা সব কাগজে ঘোষণা করা হয়েছিল কলকাতা শহরের কোন কোন এলাকায় সেদিন রাত্রে নির্দিষ্ট একটা সময়ের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকবে অর্থাৎ নিষ্প্রদীপ হবে।
তালুকদার কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, তার মানে, তুমি কি বলতে চাও কিরীটী?
এইটুকুইতোমাকে বলতে চাই তালুকদার যে, হত্যাকারী পূর্ববিজ্ঞাপিত নির্দিষ্ট সময়ে নিষ্প্রদীপের ঐ গোল্ডেন অপারচুনিটিটুকুর অত্যন্ত সুচারু ভাবে সত্যিকারের বুদ্ধিমানের মত সদ্ব্যবহার করেছে।
তা না হয় মানলাম বুদ্ধিমানের মত নিষ্প্রদীপের পূর্ব-নির্দিষ্ট সময়টুকু সদ্ব্যবহার করেছে কিন্তু হত্যাকারী এটা তো জানত না যে, ঠিক সেই সেইদিনই ব্রজদুলাল সাহা সন্ধ্যার ভাই কাউন্টে মাদ্রাজ থেকে ফিরে আসবেন। তাঁর ফিরে আসাটা তো জানতে পেরেছি আমরা-অফিসের জরুরী ট্রাঙ্ককল পেয়ে অকস্মাৎ।
সম্ভবতঃ তা নয়।
তা নয়, মানে?
মানে আমার ধারণা–
কি?
ব্রজদুলাল সাহার মাদ্রাজ থেকে অকস্মাৎ প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারেও হত্যাকারীর হাত ছিল।
তুমি কি বলতে চাও কিরীটী? সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তালুকদার কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
কিরীটী কিন্তু একান্তই নির্বিকার।
সোফার উপরে শরীরটাকে একটা নিশ্চিন্ত আলস্যের ভঙ্গীতে এলিয়ে দিয়ে তার সম্মুখে উপবিষ্ট তালুকদারের সঙ্গে কথা বলছিল।
পাইপে এবারে আর একটা টান দিয়ে বলে, বলছিলাম এই যে, ঐ দিকটায় একটু নজর দিলে ক্ষতিই বা কি?
কোন দিকটায়?
বলছিলাম, কিরীটী বলে, সেদিন ব্রজদুলাল সাহার মাদ্রাজ থেকে অকস্মাৎ প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে হত্যাকারীর হাত ছিল—সেটাকে আমাদের বর্তমান প্রবলেমের আকসন হিসাবে ধরে নিলে ক্ষতিটাই বা কি?
ক্ষতি নয় কিন্তু–
তুমি তো জান তালুকদার, কিরীটী আবার বলে, মন আমার কখনও হঠাৎ কিছু ধরে নেয় না।
তা জানি। তবে–
তবের কথা থাক। আমি সেই রকম ইঙ্গিতই যেন একটা ঐব্যাপারে পাচ্ছি বলেই বলছিলাম
.
বস্তুতঃ উভয়ের মধ্যে কয়েকদিন আগেকার একটা রহস্যপূর্ণ হত্যার ব্যাপার নিয়ে আলোচনা চলহিল কিরীটীরই বাসায় তার দোতলার বসবার ঘরে বসে, সন্ধ্যার দিকে।
হত্যাকাণ্ডটা ঘটেছিল দিন-সাতেক আগে বালীগঞ্জ অঞ্চলে গচা লেনে।
বিপত্নীক ব্রজদুলাল সাহা যাকে বলে সত্যিকারের ধনীই ছিলেন।
রাণীগঞ্জ অঞ্চলে তিনটি কয়লার খনি ছাড়াও কোলকাতায় তাঁর একটি লোহার কারবার ছিল। বিরাট ফলাও কারবার, সাহা স্টীল কোম্পানী। সাহা স্টীল কোম্পানীর অফিস ডালহৌসি স্কোয়ারে। বিরাট একটা সাততলা বাড়ির দোতলার সবটা নিয়ে সাহা স্টীল কোম্পানীর অফিস।
ব্রজদুলাল সাহার বয়স বাহান্ন থেকে তিপ্পান্নর মধ্যে ছিল। সুন্দর স্বাস্থ্যবান লোক, শরীরে কোনরকম বোগ ইত্যাদি ছিল না।
ধনী ব্যবসায়ী হিসাবে গত কয়েক বছর ধরে ব্রজদুলাল সাহা কলকাতা শহরে সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। বিশেষ করে বালীগঞ্জ অঞ্চলে বিরাট প্রাসাদতুল্য এক বাড়ি ফাঁদবার পর। বছর দুই হল গচা লেনে বিরাট বাড়ি করেছিলেন। শুধু বাড়িই নয়, মনের মত করে প্রচুর অর্থব্যয়ে গৃহটি সাজিয়েও ছিলেন।
ঐশ্বর্যকে করায়ত্ত করতে কিন্তু ব্রজদুলালকে অনেকগুলো বৎসর জীবনের খেসারত দিতে হয়েছিল। অতি সাধারণ অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়েছেন ব্রজদুলাল সাহা একটা দুর্জয় প্রতিজ্ঞা নিয়ে। এবং সাফল্যের দুয়ারে সবে যখন পা দিতে চলেছেন স্ত্রী মায়া দেবী চোখ বুজলেন। বয়স তখন কতই বা ব্রজদুলালের! মাত্র সাঁইত্রিশ বছর। সমস্ত দেহে তখনও অটুট স্বাস্থ্য!
সে যাই হোক, ব্রজদুলাল কিন্তু আর দ্বিতীয় সংসার করেননি। অবিশ্যি করবার মত তাঁর ফুরসৎ বা মনের তাগিদও ছিল না।
কোন সন্তানাদি ছিল না ব্রজদুলালের। গচা লেনে বিরাট বাড়ি করবার পর বলতে গেলে সেখানে তিনি এবং লোকজনের মধ্যে চারজন ভৃত্য, দুজন ঠাকুর, দুজন দারোয়ান, ড্রাইভার ও একজন অল্পবয়েসী সেক্রেটারী ছিল—ভারতীয় খৃষ্টান, বছর চব্বিশের তরুণী, রেবেকা।
রেবেকাকে থাকবার জন্য তিনতলায় দুটো ঘর ছেড়ে দিয়েছিলেন ব্রজদুলাল।
০২. সাহার গৃহে রেবেকা
সাহার গৃহে রেবেকা কেবল সেক্রেটারীই নয়, বাড়ির কেয়ারটেকার হিসাবেও ছিল। আর ছিল একজন, সাধন মিত্র।
সাধন ছিল সাহার অফিসে তাঁর পাসোন্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। একই গ্রামে ছিল সাধনের বাড়ি।
গ্রামের স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতা শহরে ভাগ্যান্বেষণে এসেছিল সাধন। এবং কোথাও অনেক চেষ্টা করে, কোন সুবিধা করতে না পেরে অবশেষে একদিন ব্রজদুলালের শরণাপন্ন হয়।
কি জানি কেন যে ব্রজদুলাল কোন আত্মীয়স্বজনকে তো নয়ই, এমন কি গ্রামের পরিচিত বা অন্যান্য ভাবে পরিচিত কাউকেই কখনও সাহায্য করতেন না। বলতেন, আত্মীয়স্বজন বা পরিচিত জন কাউকেই আমি কোন সাহায্যই করতে চাই না—
কারণ হয়ত তার একটা ছিল কিন্তু সেটা কেউ জানত না, অথচ ব্রজদুলালের ভাইপো ভাইঝি ছিল। তাদের কখনও নিজের গৃহে প্রবেশ তো দূরের কথা, তাদের কখনও কোন খোঁজখবর নিতেন না। সেই ব্রজদুলাল সাহাই সাধনকে শুধু পড়ার ব্যবস্থাই যে করে দিলেন তা নয়। নিজের গৃহে স্থানও দিলেন। এবং সেই থেকে সাধন ব্রজদুলালের গৃহেই থেকে যায়।