একটা অর্ধস্ফুট চিৎকার রেবেকার কণ্ঠ থেকে বের হয়ে আসে। প্রথমটায় ঘটনার আকস্মিকতায় কি করবে সে বুঝতে পারে না।
পাথরের মতই যেন কয়েকটা মুহূর্ত সেই ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে রেবেকা। একবার ভাবে সকলকে চিৎকার করে ডাকে।
কিন্তু সাহস হয় না। ব্রজদুলাল সাহা যে মৃত সে কথাটা বুঝতে রেবেকার কেন যেন দেরি হয়নি। তবু সম্বিৎ ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই-সোজা ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।
ভাবে, কি করা কর্তব্য—কি সে করবে!
অবশেষে কি মনে হওয়ায় পাশের ঘরে গিয়ে সাহার পারিবারিক চিকিৎসক ডাঃ চক্রবর্তীকে ফোন করে দেয় অবিলম্বে একবার আসার জন্য।
ফার্ণ রোডেই ডাঃ চক্রবর্তী থাকেন। ব্রজদুলালের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের পরিচয়। ফোন পেয়ে আধ ঘণ্টার মধ্যেই চলে আসেন তিনি।
রেবেকা বারান্দাতেই দাঁড়িয়েছিল, ডাঃ চক্রবর্তীর গাড়ির সাড়া পেয়ে নিজে গিয়ে দরজা খুলে দেয়।
ডাঃ চক্রবর্তী জিজ্ঞাসা করেন, কি ব্যাপার, কেমন আছেন মিঃ সাহা?
চলুন, দেখবেন।
উপরে গিয়ে ব্রজদুলালকে পরীক্ষা করেই বুঝতে পারেন ডাঃ চক্রবর্তী তিনি মৃত। এতটুকুও আর বিলম্ব না করে সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিকটবর্তী থানায় ফোন করে দেন। আরও আধ ঘণ্টা পরে থানা-অফিসার সুখময় মল্লিক এসে হাজির হন।
ডাঃ চক্রবর্তীর মৃতদেহ দেখেই মনে হয়েছিল, কোন তীব্র বিষের ক্রিয়ায় ব্ৰজদুলালের মৃত্যু ঘটেছে। তাই তিনি কালবিলম্ব না করে পুলিসকে খবর দিয়েছিলেন।
পুলিস অফিসার সুখময় মল্লিক ও ডাঃ চক্রবর্তীর প্রথমটায় ধারণা হয়েছিল ব্যাপারটা আত্মহত্যা। মদের সঙ্গে কোন তীব্র বিষপান করে তিনি বুঝি আত্মহত্যা করেছেন এবং সেইভাবে তদন্ত শুরু করেছিলেন সুখময় মল্লিক।
কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটা ওলট-পালট হয়ে গেল আকস্মিক ভাবে অকুস্থানে কিরীটীর আবির্ভাবে পরের দিন সকালে।
০৪. সুখময় মল্লিক যখন নীচের পারলারে
সুখময় মল্লিক যখন নীচের পারলারে বসে সকলের জবানবন্দি নিচ্ছেন—কিরীটী সেখানে গিয়ে উপস্থিত।
মল্লিকের সঙ্গে কিরীটীর পূর্বপরিচয় ছিল। কিরীটীকে আসতে দেখে ঐ সময় মল্লিক একটু যেন বিস্ময়ের সঙ্গেই শুধায়, কি ব্যাপার মিঃ রায়, আপনি?
কিরীটী বলে, কাল রাত দশটা নাগাদ মিঃ সাহা আমাকে ফোন করেছিলেন আজ সকালে আটটা নাগাদ একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্য।
কেন বলুন তো? মল্লিক যেন একটু বিস্ময়ের সঙ্গেই প্রশ্ন করেন।
কি একটা জরুরী ব্যাপারে তিনি আমার সাহায্য চান বলেছিলেন।
কি জরুরী ব্যাপার, কিছু বলেন নি আপনাকে?
না, তা অবিশ্যি কিছু ফোনে বলেন নি। কিন্তু আপনি এখানে—কি ব্যাপার বলুন তো সুখময়বাবু?
কিরীটীর জ্ঞাতার্থে সুখময় মল্লিক তখন গতরাত্রের সমস্ত ব্যাপারটা বিবৃত করেন।
সব শুনে কিরীটী তো একেবারে বোবা। বলে, সে কি! তিনি মৃত? হ্যাঁ।
খুব সম্ভবতঃ সুইসাইড বলে মনে হচ্ছে।
সুইসাইড!
হ্যাঁ, সেই রকম মনে হচ্ছে।
হুঁ, তা মৃতদেহ কোথায়?
ওপরে তাঁর শোবার ঘরে।
মৃতদেহটা আমি একবার দেখতে পারি?
নিশ্চয়ই। চলুন না।
আর কালবিলম্ব না করে কিরীটী সুখময় মল্লিকের সঙ্গে দ্বিতলে যায় এবং যে ঘরের মধ্যে তখনও সোফার উপরে মৃতদেহটা ছিল সেই ঘরে গিয়ে প্রবেশ করে।
মৃতদহের ভঙ্গীটাই যেন প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করে কিরীটীর।
মৃতদেহের ভঙ্গী দেখলে মনে হয় যেন মৃত্যুর কারণটাই যাই হোক না কেন, ঐ ভাবে চেয়ারের উপরে বসে বসে তাঁর মৃত্যু হয়নি।
মৃত্যুর পরে কেউ ব্রজদুলালকে ঐভাবে সোফাটার উপরে বসিয়ে দিয়েছে যেন।
মৃতের দুচোখে আতঙ্ক নয়, যেন এখনও বিস্ময়ের আকস্মিকতা স্পষ্ট হয়ে আছে।
কিরীটীর দিকে তাকিয়ে মল্লিক প্রশ্ন করে, কি মনে হচ্ছে আপনার মিঃ রায়?
আমার কিন্তু সেরকম মনে হচ্ছে না মিঃ মল্লিক। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী বলে।
মনে হচ্ছে না?
না।
তবে?
কি জানি কেন মনে হচ্ছে, দেহের ভঙ্গী যেন ঠিক আত্মহত্যা নয়। তাছাড়া কোন তীব্র বিষের ক্রিয়াতেই যদি আকস্মিক মৃত্যু ঘটে থাকে, মৃত্যু মুহূর্তের বিক্ষেপ ও কুঞ্চনের কোন চিহ্নই তো মৃতের দেহে দেখা যাচ্ছে না।
কথা বলে পুনরায় কিরীটী প্রখর দৃষ্টি নিয়ে মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে থাকে আরও কিছুক্ষণ।
দেখতে দেখতেই তার নজরে পড়ে মৃতের ঝুলন্ত ডান হাতের তর্জনীর দিকে। তর্জনীর মাথায় কালো একটা দাগ।
এগিয়ে গিয়ে মৃতের মুখটাও একবার তুলে দেখল। ঘাড়টা শক্ত হয়ে রয়েছে।
বুঝতে পারে কিরীটী, মৃতদেহে রাইগার মটিস সেটু ইন করেছে ইতিপূর্বেই।
তারপর তর্জনীর মাথার ছোট কালো দাগটিও বেশ কিছুক্ষণ ধরে পরীক্ষা করে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল।
মিঃ মল্লিক কিরীটীকে লক্ষ্য করতে থাকেন নিঃশব্দে।
এবারে ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখতে লাগল কিরীটী।
বেশ বড় সাইজের ঘর। চারিদিকে বড় বড় জানলা। দক্ষিণে একটিমাত্র জানলার কবাট ব্যতীত সব বন্ধ। এবং সব জানলাতেই পর্দা টানা। রুচি আভিজাত্য ও প্রাচুর্যের চিহ্ন—যা কিছু ঘরের মধ্যে আছে সবকিছুর মধ্যেই যেন বিরাজ করছে। একধারে কোণাকুনি একটি সিঙ্গল বেড।
মাথার ধারে ত্রিপয়ের উপরে ঈষৎ নীলাভ রংয়ের ফোন।
অন্যদিকে একদিকে একটি গডরেজের স্টীলের প্রমাণ সাইজের আলমারি, তার পাশেই দেওয়ালের মধ্যে গাঁথা একটি লোহার সে।