সেও আজ থেকে বছর বারো-তেরো আগেকার কথা।
ব্রজদুলালের ব্যবসাও তখন আজকের মত বিরাট ফলাও হয়ে ওঠেনি। অবস্থাও এমনি শাঁসালো হয়ে ওঠেনি। ছোটখাটো একটা লোহার কারবার মাত্র এবং থাকেন তিনি তখন গড়িয়ার দিকে ছোট বাসা-বাড়ি নিয়ে।
কিছুদিন আগে স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে। একটিমাত্র ভৃত্য নিয়ে তাঁর সংসার।
তারপরই লাগলো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ একদিন এবং মাত্র বছর চারেকের মধ্যে কোথা দিয়ে কোন্ পথে যে চঞ্চলা লক্ষ্মী তাঁর সোনার ঝাঁপটি হাতে নিয়ে ব্রজদুলালের গৃহে অচঞ্চলা হয়ে বসলেন—ফলে দেখতে দেখতে চার বছরের মধ্যেই দেখা গেল ব্রজদুলাল তিনটি খনির মালিক ও সাহা অ্যাণ্ড স্টীল কোম্পানীর ম্যানেজিং ডাইরেক্টার! কথায় বলে পুরুষস্য ভাগ্যম। সেটার প্রকৃষ্ট প্রমাণ যেন ঐ ব্রজদুলাল সাহা।
সাধনেরও আপনার বলতে ত্রিসংসারে কেউ ছিল না। ছোটবেলায় একই দিনে কলেরায় মা-বাপ হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল সে গাঁয়ে দূরসম্পকীয় এক দিদির বাড়িতে।
গ্রামের স্কুল থেকে ম্যাট্রিকটা পাস করবার পর দিদির আশ্রয়ে আর ভার-বোঝা না হয়ে থেকে একদিন সামান্য একটি সুটকেসে খান দুই জামা-কাপড় নিয়ে কলকাতায় এসে উপস্থিত হল। পাইস হোটেলে খেয়ে এখান-ওখানে অনেক ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু কোন সুরাহাই হয় না। অবশেষে একদিন ব্রজদুলালের অফিসে গিয়ে সাহসে ভর করে দেখা করল। গ্রামের কৃতী পুরুষ ব্রজদুলাল যদি একটা হিল্লে করে দেন এই আশায়। ব্রজদুলাল ছেলেটির চেহারায় ও তার সঙ্গে কথা বলে মুগ্ধ হলেন। স্থান দিলেন নিজের গৃহে। ব্রজদুলালের আশ্রয়ে মাথা খুঁজতে পেরে সে যেন বেঁচে গিয়েছিল। যেমন সুন্দর স্বাস্থ্যবান চেহারা তেমনি তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। ব্রজদুলালের কাছে সাধন একটা চাকরিই চেয়েছিল কিন্তু ব্রজদুলাল বললেন, চাকরি দেখা যাবে পরে, এখন পড়াশুনা কর।
পড়ব, কিন্তু……
কিন্তু দিয়ে দরকার নেই—কালই কলেজে ভর্তি হয়ে যাও।
.
সাধন কলেজে ভর্তি হয়ে গেল। ক্রমে সে কৃতিত্বের সঙ্গে অর্থনীতিতে এম. এ. পাস করবার পর ব্রজদুলাল তাঁর নিজের অফিসেই সাধনকে ঢুকিয়ে দিলেন।
সত্যিই ঐ সুন্দর, স্বাস্থ্যবান, বুদ্ধিদীপ্ত অথচ বিনয়ী, নম্র ছেলেটিকে পুত্ৰাধিক ভালবেসেছিলেন ব্রজদুলাল। এবং অনেকেরই ধারণা হয়েছিল—নিজের ভাইপো-ভাইঝিদের বঞ্চিত করে হয়ত ব্রজদুলাল তাঁর সব কিছুই একদিন ঐ সাধনকেই দিয়ে যাবেন।
ইদানীং এমন হয়েছিল সাধন না হলে ব্রজদুলালের কোন কাজই হত না। সকল ব্যাপারের পরামর্শদাতা ছিল ঐ সাধন মিত্র। সাধন একতলায় থাকত অফিস-ঘরের পাশের ঘরটিতেই—অর্থাৎ ব্রজদুলালের গচা লেনের বাড়িতেই।
০৩. পুলিসের রিপোর্ট
ব্যবসা-সংক্রান্ত ব্যাপারেই দিন-পনের আগে ব্রজদুলালকে মাদ্রাজে যেতে হয়েছিল এবং কথা ছিল দিন-কুড়ি আগে সেখানে তিনি থাকবেন।
কিন্তু সাতদিনের মাথায় অফিস থেকে সকালবেলা আটটা নাগাদ অকস্মাৎ একটা জরুরী ট্রাঙ্ক কল পেয়ে ব্রজদুলালকে কলকাতায় ফিরে আসতে হয় ঠিক নিহত হবার রাত্রে—সন্ধ্যায় ভাইকাউন্টে।
সন্ধ্যা রাত সোয়া সাতটা নাগাদ গৃহে এসে পৌঁছান এয়ারপোর্ট থেকে ব্রজদুলাল তাঁর নিজেরই গাড়িতে গচা লেনের বাড়িতে।
রাত আটটা থেকে নটা তাঁর শোবার ঘরে সাধনের সঙ্গে কি সব কথাবার্তা হয়। তার পরই সাধনকে তিনি একটি জরুরী ব্যাপারে সেই রাত্রেই গাড়ি নিয়ে পাটনায় মাসখানেক পূর্বে সাহা অ্যাণ্ড স্টীল কোম্পানীর নতুন ব্রাঞ্চ অফিস খোলা হয়েছিল, সেই অফিসে যেতে বলেন।
সাধন নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে রাত সাড়ে নটা নাগাদ চলে যায় পাটনায়।
যতদূর জানা গিয়েছে দুর্ঘটনার রাত্রে ব্রজদুলালের বাড়িতে তিনি এবং ভৃত্যের দলই ছিল। কারণ দুপুরের দিকে বের হয়ে গিয়ে রাত সাড়ে আটটার শোতে রেবেকা মেট্রোতে সিনেমা দেখতে যায়।
তাছাড়া সে জানত না যে ঐ রাত্রেই ফিরে আসবেন ব্রজদুলাল।
রাত দশটায় ডিনার শেষ করে ব্রজদুলাল শুতে যান।
রাত পৌনে এগারোটায় কুড়ি মিনিটের জন্য ঐ অঞ্চল নিষ্প্রদীপ হয়।
সোয়া বারোটায় রেবেকা সিনেমা থেকে ফিরে এসে তিনতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠবার সময় দোতলায় ব্রজদুলালের ঘরে আলো জ্বলতে দেখে। তার কৌতূহল হয় এবং গিয়ে দেখে ঘরের দরজা হা-হা করছে খোলা। খোলা দরজা-পথে উঁকি দিতেই ব্রজদুলালের ঘরের মধ্যের দৃশ্যটা তার চোখে পড়ে।
স্লিপিং গাউন ও পায়জামা পরিহিত ব্রজদুলাল সাহা একটা সোফার উপরে উপবিষ্ট, কিন্তু দেহের উধ্বাংশ ও মাথাটা সোফার হাতলের উপর থেকে অসহায়ভাবে নিচের দিকে ঝুলছে। একটা হাত ঝোলা অবস্থায় মাটিতে ঠেকে রয়েছে।
ঐভাবে ব্রজদুলাল সাহার চেয়ারে বসে থাকার সমস্ত ভঙ্গীটাই এমন যে—রেবেকা যেন সেদিকে দৃষ্টি পড়ামাত্রই ভয়ানক চমকে ওঠে।
কেমন সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে সে খোলা দরজা-পথে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ঝুলে-থাকা ব্রজদুলালের মুখটা সে দেখতে পায়।
চোখ দুটো যেন কোটর থেকে বের হয়ে আসছে। সমস্ত মুখে তখনও স্পষ্ট হয়ে রয়েছে। যেন অসহ্য যন্ত্রণার চিহ্ন। দুহাতের আঙুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ।
সামনের একটা গোলাকার শ্বেতপাথরের টেবিলের উপরে জ্বলছে সুদৃশ্য একটি টেবিল ল্যাম্প। তার পাশে একটি অর্ধসমাপ্ত ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটের বোতল, একটি দামী কাচের শূন্য গ্লাস উল্টে পড়ে আছে। তার পাশে সোডা সাইফন ও চাবির একটা রিং।