হ্যাঁ।
সেই কারেন্ট পাস করানো হয়েছিল, যে টেবিল-ল্যাম্পটার কথা বলছি সেটারই ভিতর দিয়ে।
কিন্তু সেই অরিজিন্যাল টেবিল-ল্যাম্পটি গেল কোথায়? প্রশ্ন করেন সুখময় মল্লিক।
মিস রেবেকা মণ্ডলকে জিজ্ঞাসা করুন, উনিই হয়ত বলতে পারবেন কোথায় সে ল্যাম্পটা।
কিরীটীর মুখ থেকে কথাটা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সকলের দৃষ্টি যেন একসঙ্গে গিয়ে পড়ল ঘরের মধ্যে দণ্ডায়মানা রেবেকার উপরে।
রেবেকা প্রথমটায় বোধ হয় একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে ওঠে, হোয়াট ড়ু ইউ মিন! এ কথার আপনার অর্থ কি মিঃ রায়, আমি জানতে চাই। ইট ইজ নট অনলি ইনসালটিং-ড্যামেজিং টু।
কিরীটী মৃদু হেসে একবার রেবেকার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, অবশ্যই ড্যামেজিং মিস মণ্ডল এবং ড্যামেজিং যে হতে পারে সেটা অন্ততঃ আপনার মত বুদ্ধিমতী মেয়ের পক্ষে পূর্বেই বোঝা উচিত ছিল।
What do you mean? কি বলতে চান আপনি?
বলতে চাই ল্যাম্পটা আপনারই ঘরে আলমারির টানার মধ্যে পাওয়া গিয়েছে।
What? কি বললেন?
যা বললাম তা তো আপনার অজানা নয় মিস মণ্ডল।
সাজানো-মিথ্যা একটা ষড়যন্ত্র!
কোর্টে তাই বলবেন—বলেই জীবনের দিকে তাকিয়ে কিরীটী শুধায়, ল্যাম্পটা কোথায় তুমি পেয়েছিলে জীবন?
আজ্ঞে সেক্রেটারী মেমসাহেবের ঘরে—
চিৎকার করে ওঠে সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে রেবেকা, জীবন, ইউ লায়ার–
লায়ার ও নয় মিস মণ্ডলল্যাম্পটা সত্যিই ও আপনার ঘরে পেয়েছিল। ওকে আমি বাড়ির সর্বত্র ল্যাম্পটা খুঁজে দেখতে বলেছিলাম। ও আপনার ঘরে আলমারির ড্রয়ারের মধ্যেই। সেটা খুঁজে পেয়ে আমাকে পৌঁছে দেয়।
সুশান্ত জড়িত কণ্ঠে বলে ওঠে, তাহলে মেমসাহেব, তুমিই–
না সুশান্তবাবু—ঠিক উনি নন—যদিও উনি সাহায্যকারিণী ছিলেন সে-রাত্রের ব্যাপারে। কিরীটী বলে ওঠে।
সাধন মিত্র এতক্ষণ একপাশে চুপ করে যেন পাথরের মতই দাঁড়িয়েছিল।
সমস্ত মুখখানা তখন তার ফ্যাকাশে, রক্তশূন্য।
তার দিকে তাকিয়ে এবার কিরীটী বললে, সাধনবাবু, নারীর মন বড় বিচিত্র বস্তু! তা হলেও এটা আপনার মত একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তির অন্ততঃ বোঝা উচিত ছিল। যে নারী একজনের সঙ্গে স্বার্থের জন্য প্রেমের খেলা খেলতে পারে, সে আর একজনের সঙ্গেও পারে। এখন বোধ হয় বুঝতে পারছেন, ইউ হ্যাভ বিন ডিসিঙ্! আপনিও প্রতারিত হয়েছেন!
সাধন মাথা নীচু করে।
কিরীটী বলে, তবে আপনার দুঃখের কোন কারণ নেই। ঐ রেবেকা মণ্ডল যেমন আপনাকে প্রেমের ব্যাপারে প্রতারণা করেছে তেমনি নিজেও প্রতারিত হয়েছে। ও জানে না এখনও যে, ও নিজে যেমন আপনার সঙ্গে প্রেমের খেলা খেলেছে, তেমনি প্রশান্ত সাহাও ওর সঙ্গে নিতান্তই স্বার্থের খাতিরেই প্রেমের খেলা খেলেছে এতদিন।
সহসা যেন রেবেকা পাগলের মতই চিৎকার করে ওঠে, না–না—এ অসম্ভব—
কিরীটী ওই সময় বলে ওঠে, না প্রশান্তবাবু, এ ঘর থেকে বেরুবার চেষ্টা করবেন না–
প্রশান্ত সবার অজ্ঞাতে দরজার দিকে এগুচ্ছিল পায়ে পায়ে, হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়।
কিরীটী সুখময়ের দিকে তাকিয়ে বলে, মিঃ মল্লিক, পুট হিম আণ্ডার অ্যারেস্ট।
সুখময় মল্লিক সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে প্রশান্তর হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেন।
১৭. ব্রজদুলাল সাহার পৈশাচিক হত্যার পশ্চাতে
সেই রাত্রেই।
কিরীটী বলছিল, ব্রজদুলাল সাহার পৈশাচিক হত্যার পশ্চাতে ছিল বিচিত্র একটা নাটক। যার পাত্রপাত্রী ছিল ব্রজদুলাল সাহা স্বয়ং, তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র প্রশান্ত সাহা, তাঁর পি.এ. সাধন মিত্তির এবং তাঁর সেক্রেটারী মিস রেবেকা মণ্ডল।
বলাই বাহুল্য, বিপত্নীক ব্রজদুলালের দুর্বলতা জন্মেছিল রেবেকার উপরে। শুধু ব্রজদুলালের কেন—সাধন মিত্রেরও দুর্বলতা জন্মেছিল রেবেকার উপরে।
কিন্তু ওদের দুজনের কেউ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি যে রেবেকা ভালবেসেছিল প্রশান্ত সাহাকে। আবার রেবেকাও তেমনি জানতে পারেনি ঘুণাক্ষরেও, প্রশান্তর তার প্রতি সবটাই ছিল নিছক একটা অভিনয়। নারীর চাইতে সে কাঞ্চনকেই জীবনে বেশী প্রাধান্য দিয়েছে।
এরপর আসা যাক ঘটনায়।
ব্রজদুলাল তাঁর ভ্রাতুস্পুত্রদের আদৌ দেখতে পারতেন না। অবিশ্যি দেখতে না পারলেও প্রশান্ত ও সুশান্তবাবুদের ধারণা ছিল ব্রজদুলাল তাদের একেবারে বঞ্চিত করবেন না। কিন্তু যে মুহূর্তে প্রশান্ত সাহা জানতে পারল ব্রজদুলালবাবু রেবেকাকে বিবাহ করবেন স্থির করেছেন—রেবেকারই মারফৎ সঙ্গে সঙ্গে সে ব্রজদুলালকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার জন্য স্থিরপ্রতিজ্ঞ হল। কিন্তু একা অত বড় দায়িত্বটা নেওয়া সম্ভব নয় তাই সে রেবেকার সাহায্য চাইল। রেবেকাও সম্মত হল, যেহেতু প্রশান্তকে সে মনে মনে ভালবাসত।
মিঃ মল্লিক শুধালেন, রেবেকাকে ব্রজদুলাল বিবাহ করবেন স্থির করেছিলেন, কথাটা জানলেন কি করে মিঃ রায়?
কথাপ্রসঙ্গে ভৃত্য জীবনই আমাকে কথাটা পরশু রাত্রে বলে ফেলেছিল। এবং কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই ব্রজদুলালের হত্যারহস্যটা আমার কাছে অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যায়। কেবল একটা কিন্তু থেকে যায়–
কিন্তু!
হ্যাঁ, বুঝতে পারছিলাম না রেবেকা যখন ব্রজদুলালকে বিবাহ করতে সম্মত হয়েছিল তখন এত বড় নৃশংস ব্যাপারটা কী করে ঘটতে পারে। কারণ রেবেকার অজ্ঞাতে তো এত বড় ব্যাপারটা সংঘটিত হওয়া সম্ভবপর হতে পারে না আদৌ। কিন্তু সে প্রশ্নের মীমাংসাটাও একটু আগে আজ সন্ধ্যায় অকস্মাৎই যেন হয়ে গেল পান্থশালায়।