এরপর কিরীটী সুখময়ের দিকে তাকিয়ে বলে, মিঃ মল্লিক!
বলুন?
আপনি সুশান্তবাবুকে আসবার জন্য খবর পাঠাননি?
হ্যাঁ, লোক পাঠিয়েছি তো। যাকে পাঠিয়েছি তাকে বলেও দিয়েছি সুশান্তবাবুকে তাঁর ফ্ল্যাটে পাওয়া গেলে, হংকং হোটেলে পাওয়া যাবে। প্রয়োজন হলে সেখানেও যেতে।
তবে তিনিও হয়তো এসে পড়বেন। চলুন ওপরে যাওয়া যাক। চলুন প্রশান্তবাবু, সাধনবাবু! মিস মন্ডল, আপনিও।
.
সকলে এসে উপরে ব্রজদুলাল সাহার ঘরের তালা খুলে প্রবেশ করল।
ঘরের যাবতীয় জিনিসপত্র ব্রজদুলালের হত্যার পরদিন সকালে যেমন ছিল, যেখানে যেটি, সাতদিন পরে ঠিক তেমনিই আজও সব আছে।
কিরীটী একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে নিল।
তারপর সুখময়ের দিকে চেয়ে বললে, মিঃ মল্লিক, ভৃত্য জীবন আর দারোয়ান মিশিরকে একবার এ ঘরে ডেকে আনুন।
সুখময় মল্লিক ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
কিরীটী ঘরের দক্ষিণ দিককার জানলাটা খুলে দিয়ে ভোলা জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
ঘরের মধ্যে বাকী সকলে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘরের মধ্যে অদ্ভুত একটা স্তব্ধতা যেন থমথম করতে থাকে।
মিনিট কয়েক বাদেই সুখময় মল্লিক ভৃত্য জীবন ও দারোয়ান মিশিরকে নিয়ে ফিরে এলেন।
ভৃত্য জীবনকে ঘরে ঢুকতে দেখেই কিরীটী ঘুরে দাঁড়াল, জীবন!
আজ্ঞে?
প্রশান্তকে দেখিয়ে বলে, এই বাবুকে চেনো!
কেন চিনব না আজ্ঞে, উনি তো বাবুর বড় ভাইপো?
এ বাড়িতে উনি এর আগে কখনও এসেছেন?
আজ্ঞে না।
এবারে দারোয়ান মিশিরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে কিরীটী, মিশিরজী।
জী?
ওই বাবুকো তুম্ পয়ছান্তে?
জী নেহি।
কভি দেখা নেই?
নেহি জী।
বাইরে ওই সময় জুতোর শব্দ শোনা গেল।
মিঃ মল্লিক, দেখুন তো আপনার সুশান্তবাবু বোধ হয় এলেন। কিরীটী সুখময়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে।
সুখময় মল্লিককে আর এগিয়ে দেখতে হল না।
সত্যি সুশান্ত সাহা ও একজন প্লেন-ড্রেস সি.আই.ডি অফিসার ঘরে এসে ঢোকেন।
সুশান্তর দাঁড়াবার ভঙ্গিটা যেন কেমন একটু শিথিল।
কোনমতেই যেন যে সোজা হয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছিল না।
আজও তার পরিধানে দামী সুট ছিল।
সুশান্ত ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই বলে, কোথায় সুখময় মল্লিক, কেন সে আমাকে এখানে এভাবে ধরে নিয়ে এল আমি জানতে চাই। কোথায় সে?
কণ্ঠস্বর জড়িত। বোঝা যায় অতিরিক্ত মদ্যপানে সুশান্ত সাহা নেশাগ্রস্ত, ঠিক প্রকৃতিস্থ নয়।
কিরীটীই এগিয়ে এল, সুশান্তবাবু, বসুন সোফাটায়।
সুশান্ত বলে ওঠে, ড্যাম ইট, বসতে আমি আসিনি–কথাটা সুশান্তর শেষ হয় না, ঘরের মধ্যে অন্যান্য দণ্ডায়মান সকলের দিকে একে একে তার নজর পড়ে এবং সর্বশেষে প্রশান্তর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, এই যে বড় সাহেব, তুমিও তাহলে উপস্থিত হয়েছ! ভাল, ভাল!
কিরীটী আবার গম্ভীর এবং গলায় নির্দেশের সুর এনে বলে, বসুন সুশান্তবাবু!
বসব?
হ্যাঁ, বসুন।
আপনারা সবাই দাঁড়িয়ে থাকবেন—আর শুধু আমি বসব মিঃ রায়?
হ্যাঁ, আপনি বসুন।
ও-কে বস! তবে বসলাম।
ধপ করে সুশান্ত সোফার উপরে বসে পড়ল।
কিরীটী এবারে সাধন মিত্রের দিকে তাকিয়ে বললে, আজ এই সময় এমন যে একটা যোগাযোগ হবে, সত্যিই বলছি, ভাবতেও পারিনি সাধনবাবু। কিন্তু ঘটনাচক্রে ভগবানের ইচ্ছায় যখন যোগাযোগটা হলই, তখন যে কথাটা আপনাদের প্রত্যেককেই আমার বলবার ছিল সেটা আজই বলব।
একটু থেমে কিরীটী আবার বলতে লাগল, গত ২৩শে জুলাই রাত্রে এই কক্ষের মধ্যে নৃশংস হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল, সেই হত্যাকান্ডের কথাই বলব। কেমন করে সে রাত্রে ব্রজদুলালবাবু নিহত হয়েছিলেন আপনারা হয়ত এখনও সকলে তা ঠিকমত জানেন না।
১৬. সবাই রুদ্ধ নিশ্বাসে
সবাই রুদ্ধ নিশ্বাসে যেন কিরীটীর কথা শুনতে থাকে।
কিরীটী বলে, আপনারা হয়ত সবাই জানেন গত ২৩শে জুলাই এই অঞ্চলে রাত দশটা পঁয়তাল্লিশ থেকে সোয়া এগারোটা পর্যন্ত ইলেকট্রিক কারেন্ট বন্ধ থাকায় এই অঞ্চলটা ঐ আধ ঘণ্টা সময় অন্ধকার হয়ে ছিল। সেই সময়ের মধ্যেই হত্যাকারী এই ঘরের মধ্যে কৌশলে ব্রজদুলালবাবুর মৃত্যু-ফাঁদ পাতে—যে ফাঁদে ব্রজদুলালবাবু অবধারিত ভাবে পা দেন নিজের অজ্ঞাতেই।
মৃত্যুফাঁদ! মৃদুকণ্ঠে কথাটা উচ্চারণ করে সাধন মিত্র।
হ্যাঁ, মৃত্যুফাঁদ। ডেথ-ট্র্যাপ। এবং মৃত্যুফাঁদটা কি ছিল জানেন—একটা টেবিল ল্যাম্প?
টেবিল-ল্যাম্প? কথাটা বলে যেন হাঁ করে তাকায় সাধন মিত্র কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ মিঃ মিত্র, একটা টেবিল-ল্যাম্প। যে টেবিল-ল্যাম্পটা ঐ ত্ৰিপয়ের উপরে বরাবর থাকত এবং যেটা সে-রাত্রে ব্রজদুলালকে হত্যা করবার পর হত্যাকারী সেই রাত্রেই সরিয়ে ফেলে ঐ নতুন টেবিল-লাম্প ঐখানে রেখে দেয়।
ঐ টেবিল-ল্যাম্পটা—
একটা নতুন ল্যাম্প। এবং অরিজিন্যাল ল্যাম্পটা সরিয়ে ঐ নতুন ল্যাম্পটা রেখেই হত্যাকারী সে রাত্রের তার হত্যার নিদর্শন রেখে গিয়েছে তার নিজের অজ্ঞাতে। এমনিই হয়, ভগবানের বিচারে পাপের ছাপ এমনি করেই হত্যাকারী তার অজ্ঞাতে রেখে যায়। আর ঐ ল্যাম্পটাই আমাকে সত্যের সন্ধান দিয়েছে।
সুখময় মল্লিক বলেন, ব্যাপারটা কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারছি না মিঃ রায়।
কেন বুঝতে পারছেন না সুখময়বাবু? ময়না তদন্তের রিপোর্ট থেকে আমরা জেনেছি সেরাত্রে হাই ভোলটেজের ইলেকট্রিক কারেন্ট পাস করবার জন্যই ব্রজদুলালবাবুর আকস্মিক মৃত্যু ঘটেছিল, কেমন কিনা?