কথাটা একটু পরিষ্কার করে বল তো?
এখনও ঠিক বলতে পারছিনা তালুকদার, কারণ একটা জায়গায় এসে আমার চিন্তার যোগসূত্রটা ছিঁড়ে যাচ্ছে- আচ্ছা কিরীটী, তালুকদার প্রশ্ন করেন, এখনও কি তোমার ধারণা ব্যাপারটা হতাই?
নিঃসন্দেহে। আত্মহত্যা আদৌ নয়। হতভাগ্য ব্রজদুলাল সাহার দেহে তাঁর অজ্ঞাতেই হাই ভোল্টেজের ইলেকট্রিক কারেন্ট পাস করিয়ে তাঁকে মুহূর্তে হত্যা করা হয়েছে।
বল কি?
ঠিক তাই।
কিন্তু সেটা কেমন করে সম্ভব হল?
কেমন করে যে সম্ভব হল সেটাই ভাবছি এখনও। তবে সম্ভব হয়েছিল নিশ্চয়ই, নচেৎ ঐভাবে তাঁকে অতর্কিতে মৃত্যুবরণ করতে হত না।
তারপরই একটু থেমে হঠাৎ কি একটা কথা মনে পড়ায় কিরীটী বলে, ভাল কথা তালুকদার, সাহার সেই শয়নকক্ষটা লক-আপ করে রাখা হয়েছে, না?
হ্যাঁ। কেন, তুমিই তো সুখময়বাবুকে ঘরটাতে তালাবন্ধ করে রাখতে বলে দিয়েছিলে! একটু বস তালুকদার, আমি চট করে একটা টেলিফোন করে আসি।
কাকে ফোন করবে?
সুখময়বাবুকে।
কিরীটী ঘর থেকে উঠে গেল।
.
তালুকদার অতঃপর সোফাটায় বসে একটা পিকটোরিয়াল সাপ্তাহিক ইংরাজী ম্যাগাজিনের পাতাগুলো উল্টে উল্টে ছবি দেখতে থাকেন।
পুলিসের বড়কতা ঐদিন সকালেই তালুকদারকে ডেকে ব্রজদুলাল সাহার হত্যার রহস্যজনক ব্যাপারটার যাবতীয় দায়িত্ব তাঁর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। সেই সূত্রেই ঐদিন সন্ধ্যায় কিরীটীর শরণাপন্ন হয়েছিলেন তালুকদার।
কারণ থানা অফিসার সুখময় মল্লিকের কাছে গিয়ে শুনেছিলেন কি ভাবে ঘটনাচক্রে কিরীটী ব্রজদুলালের হত্যার পরের দিন গিয়ে অকুস্থানে হাজির হয়েছিল।
কিন্তু কিরীটীর ওখানে এসে, তার মতামত শুনে ব্রজদুলালের হত্যার রহস্যের মীমাংসার ব্যাপারে যে খুব বেশী আশান্বিত হয়েছেন তা নয়।
অথচ এও সে ভালভাবেই জানে যে, কিরীটী ঐ হত্যারহস্যের মীমাংসায় পৌঁছবার একটা-না-একটা পথ খুঁজে পেয়েছে যদিও—তথাপি সে নিজে থেকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে যতক্ষণ মুখ না খুলবে ততক্ষণ যতটুকু সে বলেছে তার বেশী জানবার আর কোন উপায়ই নেই।
একটু পরেই কিরীটী ফিরে এল একেবারে বাইরে বেরুবার বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে।
রাত তখন বোধ হয় পৌনে আটটা।
গ্রীষ্মের রাত। পৌনে আটটা বিশেষ করে কলকাতা শহরে তো এমন কিছুই নয়। একেবারে সন্ধ্যারাত্রি বললেও বেশী বলা হয় না।
কিরীটীর পরিবর্তিত বেশের দিকে তাকিয়ে তালুকদার প্রশ্ন করেন, কোথাও বেরুচ্ছ নাকি এখন?
হ্যাঁ, একটু ঘুরে আসা যাক। তোমার হাতে যদি তেমন জরুরী বা প্রয়োজনীয় কোন কাজ থাকে তো আমার সঙ্গে যেতে পার।
কিরীটী টোবাকো পাউচ ও লাইটারটা হাতে তুলে নিতে নিতে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে কথাগুলো।
তালুকদার ম্যাগাজিনটা টেবিলের উপর রেখে দাঁড়িয়ে বলেন, না, অন্য কোন কাজ তেমন নেই, তোমার এখানেই তো এসেছিলাম। চল।
রাস্তায় বের হয়ে দুজনে একটা ট্যাক্সি নেয়।
ট্যাক্সিওয়ালা কিরীটীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে, কোন দিকে যাব বাবুজী?
গর্চা লেন চল। কিরীটী বলে।
পার্শ্বে উপবিষ্ট তালুকদার গচা লেন কথাটা কানে যেতেই কিরীটীর মুখের দিকে তাকান।
গাড়ি তখন গচা লেনের দিকেই ছুটে চলেছে।
কিন্তু গাড়ি কিছুদূর এগুবার পরই কিরীটী ড্রাইভারকে সোজা এগিয়ে যেতে বলল একটা রেস্তোরাঁর দিকে চায়ের পিপাসা পেয়েছে বলে।
১২. পান্থশালা
ঐ পাড়ারই একটা আধুনিক রেস্তোরাঁ।
রেস্তোরাঁটি খুব বেশী দিনের নয়। কিন্তু বেশী দিনের না হলেও মালিক প্রচুর অর্থব্যয় করে আধুনিক সাজসরঞ্জাম ও আরামের ব্যবস্থায় রেস্তোরাঁটি সত্যিকারের যাকে বলে আকর্ষণীয় করে তুলেছিল।
সামান্য কয়েক মাসেই পান্থশালা রেস্তোরাঁ-প্রিয় লোকদের কাছে ঐ অঞ্চলের আকর্ষণের অন্যতম বিলাস ও আরামকেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
রেস্তোরাঁটির মধ্যে একটি ব্যবস্থা বিশেষ ছিল। তরুণ ও তরুণী খরিদ্দারদের জন্য ছোট ছোট নির্জন কিউবিক্যালস। কাজেই অল্পবয়সের কলেজের ছাত্রছাত্রী ও তরুণ-তরুণী খরিদ্দারদের ভিড়ই ছিল সর্বাপেক্ষা বেশী পান্থশালায়।
কিরীটী ও তালুকদার যখন পান্থশালায় এসে ঢুকলো রাত তখন সোয়া আটটা। বিরাট হলঘরের এক কোণে একটা টেবিলে মুখোমুখি বসে দুকাপ কফির অর্ডার দিল কিরীটী দুজনের জন্য।
.
কিরীটী লক্ষ্য করেনি।
তার ঠিক হাত দশেক দূরেই দেওয়াল ঘেঁষে আলো-আধাঁরির মধ্যে অন্য একটা টেবিলে মুখোমুখি বসেছিল দুকাপ চকোলেট ড্রিংক ও কিছু স্যান্ডুউইচ নিয়ে দুটি যুবক-যুবতী।
মিস রেবেকা মন্ডল ও সাধন মিত্র।
তাদের পরস্পরের মধ্যে নিম্নলিখিত কথাবার্তা চলছিল।
রেবেকা বলছিল, কিন্তু ঐ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া আমার আর উপায়টা কি বল সাধন—যার চাকরি করছিলাম, যে দয়া করে তার গৃহে স্থান দিয়েছিল সে-ই যখন চলে গেল তখন আর দাবী কোথায় আমার ওখানে থাকবার আর থাকতেই বা দেবে কে আমাকে?
মৃদুকণ্ঠে সাধন বলে, নতুন করে দাবীরও তো সৃষ্টি হতে পারে আবার!
নতুন দাবী? মন্দ বলনি কথাটা সাধন। প্রশান্ত, সুশান্ত ও শ্রীমতী সাহাও এসে ঐ বাড়িতে আর যার যে ব্যবস্থাই করুক আমার ব্যবস্থাটা যে বাড়ির বাইরে হবে, সে কি আর আমি জানি না!
কিন্তু তারাই যে বাড়ির একমাত্র মালিক হচ্ছে তা তুমি জানলে কি করে? ব্যাপারটা তো এখনও পর্যন্ত কেউই জানে না।